মাধ্যমিক ইতিহাস – সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর

Rohit Mondal

আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় “সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” এর থেকে “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

মাধ্যমিক ইতিহাস - সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন
Contents Show

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সামাজিক কারণগুলি কী ছিল?

1857 খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট লর্ড ক্যানিং -এর শাসনকালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সিপাহিরা, দেশীয় রাজা ও সাধারণ মানুষ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। এই বিদ্রোহ ইতিহাসে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সামাজিক কারণসমূহ –

নানাবিধ সামাজিক কারণ বিদ্রোহের জন্য দায়ী ছিল, যথা –

  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সামাজিক বৈষম্য – ইংরেজরা ভারতবর্ষে এসেছিল অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে, ভারতবাসীর প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র সহানুভূতি ছিল না। তারা ভারতীয়দের বর্বর ও অসভ্য বলে মনে করত। ‘সিয়ার-উল-মুতাখরিন’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, ইংরেজরা ইচ্ছে করে ভারতীয়দের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলত। বিভিন্ন জায়গায় বোর্ডে লেখা থাকত যে, সেখানে কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ইংরেজ রাজকর্মচারীদের মনোভাব – ইংরেজরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ জাতি এবং ভারতবাসীকে বর্বর বলে মনে করত। গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসের ধারণা ছিল যে, সকল ভারতীয় দুর্নীতিগ্রস্ত। এজন্য তিনি সরকারি উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছিলেন।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ইংরেজদের সমাজসংস্কার – ইংরেজরা যেহেতু ভারতীয়দের শোষণ করত, তাই ভারতীয়রাও ইংরেজদের সংস্কারমূলক কার্যাবলিকে সন্দেহের চোখে দেখত। ফলে বাল্যবিবাহ, বিধবাবিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহের পক্ষে ইংরেজ সরকার আইন পাস করলে ভারতীয় সমাজ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে মিশনারিদের ভূমিকা – খ্রিস্টান মিশনারিরা ধর্মপ্রচারের সময় হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের সমালোচনা করত। এর ফলে হিন্দু-মুসলিমদের সঙ্গে ইংরেজদের সামাজিক ব্যবধান বেড়ে যায়। এইভাবে সামাজিক ব্যবধান ইংরেজ ও ভারতবাসীর মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি করে, যা 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে দেশীয় রাজন্যবর্গের যোগদানের কারণ কী ছিল?

অথবা, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের রাজনৈতিক কারণ সম্পর্কে লেখো।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ভূমিকা –

ভারত ইতিহাসে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই বিদ্রোহে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন দেশীয় রাজন্যবর্গ।

1857 খ্রিস্টাব্দের দেশীয় রাজন্যবর্গের যোগদানের কারণ –

বিদ্রোহে দেশীয় রাজন্যবর্গের অংশগ্রহণের কারণগুলি হল নিম্নরূপ –

  • স্বত্ববিলোপ নীতি – লর্ড ডালহৌসি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করেন (1848 খ্রিঃ)। এই নীতির দ্বারা অপুত্রক রাজাদের মৃত্যুর পর তাদের রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। এর মধ্যে সাতারা, ঝাঁসি, তাঞ্জোর, নাগপুর, সম্বলপুর, উদয়পুর, ভগত ও করৌলী রাজ্য উল্লেখযোগ্য ছিল।
  • কুশাসন – লর্ড ডালহৌসি কুশাসনের অভিযোগে অযোধ্যা রাজ্য দখল করেন। যদিও অযোধ্যা রাজ্যে কুশাসনের জন্য ইংরেজদের দীর্ঘদিনের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ দায়ী ছিল।
  • যুদ্ধনীতি – লর্ড ডালহৌসি 1849 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের মাধ্যমে পাঞ্জাব দখল করেন।
  • পদমর্যাদা লোপ – লর্ড ডালহৌসি পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও -এর দত্তকপুত্র নানাসাহেবের ‘পেশোয়া’ পদ লোপ করেন। তাঁর বার্ষিক বৃত্তি বন্ধ করে দেন। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের উপাধি বাতিল করে তাঁকে রাজপ্রাসাদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। নাগপুর ও অযোধ্যার রাজপরিবারের মর্যাদাহানি করেন ডালহৌসি। এ ছাড়া এর আগে ইংরেজদের রাজ্যগ্রাসের ফলে বহু রাজা তাদের রাজ্য হারান। ফলে রাজপরিবার ও রাজপরিবারের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তি, কর্মচারী, সৈনিক, সুবিধাভোগী শ্রেণি ইংরেজবিরোধী হয়ে ওঠে।

1857 খ্রিস্টাব্দের দেশীয় রাজন্যবর্গের যোগদানের মূল্যায়ন –

ভারতে আধুনিক শিক্ষা, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা, সমাজসংস্কার চালু হলেও ভারতের সর্বত্র তা ছড়িয়ে পড়েনি। ভারতবাসী তখনও মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণায় আচ্ছন্ন ছিল। বিক্ষুব্ধ ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণি মধ্যযুগীয় ব্যবস্থার ধারক ও বাহক ছিল। দেশীয় রাজন্যবর্গ এই বিদ্রোহের মাধ্যমে মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার তাই এই বিদ্রোহকে ‘সামন্তশ্রেণির শেষ করুণ আর্তনাদ’ বলে অভিহিত করেছেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণগুলি কী ছিল?

ভারতের জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাসে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংঘটিত এই বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ভারতে ইংরেজদের অর্থনৈতিক শোষণ।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণসমূহ –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পিছনে অর্থনৈতিক কারণগুলি হল –

  • কোম্পানির ভূমিরাজস্ব নীতি – ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অধিক পরিমাণে রাজস্ব আদায়ের জন্য বিভিন্ন প্রকার ভূমিরাজস্ব নীতি চালু করেছিল। এর ফলে ভারতের প্রাচীন জমিদার ও সাধারণ কৃষকশ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
  • অতিরিক্ত কর আরোপ – ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য, গোচারণভূমি, বনাঞ্চল, পথঘাট প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের উপর কর আরোপ করে জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল।
  • জীবিকাচ্যুত কর্মচারীদের অসন্তোষ – কোম্পানি দেশীয় রাজাদের রাজ্যগ্রাস করলে সেই রাজার অনুগত সৈন্য ও কর্মচারীরা কর্মচ্যুত হত। তা ছাড়া দেশীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে শিল্প, স্থাপত্য, সাহিত্য প্রভৃতির বিকাশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
  • মহাজন ও নীলকরদের শোষণ – কোম্পানির রাজস্বব্যবস্থার ফলে মহাজন শ্রেণির উদ্ভব ও তাদের শোষণ কৃষকদের ক্ষুব্ধ করেছিল। এ ছাড়া, কৃষকরা নীলকর সাহেবদের দ্বারা নির্যাতিত হত, যা তাদের গভীর রোষানলে পতিত করে।

উপরোক্ত অর্থনৈতিক কারণগুলিই 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ধর্মীয় কারণ কী ছিল?

1857 খ্রিস্টাব্দে বড়োেলাট লর্ড ক্যানিং -এর শাসনকালে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ সংঘটিত হয়েছিল। ওই বিদ্রোহের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল ভারতীয়দের ধর্মীয় অসন্তোষ।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ধর্মীয় কারণসমূহ –

  • খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টা – ভারতে আগত খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ ভারতীয়দের শঙ্কিত করেছিল। খ্রিস্টান মিশনারিরা দরিদ্র ভারতীয়দের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের জন্য প্রলুব্ধ করত। তারা হিন্দু ও ইসলামধর্মের নিন্দা করত এবং তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করত।
  • সরকারের ভূমিকা – ভারতের ইংরেজ সরকার 1850 খ্রিস্টাব্দে ’21 নং রেগুলেশন’ জারি করে ধর্মান্তরিতদের পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার দান করেছিল বলে ভারতীয়রা ক্ষুব্ধ হয়েছিল। তা ছাড়া খ্রিস্টান মিশনারিরা স্বাধীনভাবে জেলখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল প্রভৃতি স্থানে প্রবেশ করে ধর্মপ্রচার করতে পারত যা ভারতীয়দের অসন্তুষ্ট করেছিল।
  • সংস্কারমূলক কার্যাবলি – ইংরেজি শিক্ষা, নারীশিক্ষা, বিধবাবিবাহ প্রবর্তন এবং সতীদাহ, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি নিবারণ আইন পাস হলে ভারতীয়দের মনে ইংরেজদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল। তা ছাড়া গঙ্গানদীতে সেচব্যবস্থা প্রবর্তন ও রেলওয়ে প্রতিষ্ঠা রক্ষণশীল ভারতীয়দের ক্ষুব্ধ করেছিল।
  • সরকারি ঘোষণা – 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পূর্বে কোম্পানির চেয়ারম্যান আর ডি ম্যাঙ্গেলস ঘোষণা করেছিলেন, খ্রিস্টধর্মের বিজয় পতাকা ভারতের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত উড্ডীন রাখার জন্য ঈশ্বর (God) হিন্দুস্তানের শাসনভার ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তাই ভারতীয়দের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা প্রতিটি ইংরেজদের পবিত্র কর্তব্য। বিদ্রোহের শেষে বিচারের সময় অনেক বিদ্রোহী স্বীকার করেছিল যে, তারা ধর্মরক্ষার জন্য ইংরেজদের ধ্বংস করতে চেয়েছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সামরিক কারণগুলি কী ছিল?

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে 1857 খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এই বিদ্রোহ ছিল ভারতীয়দের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সামরিক কারণসমূহ –

এই বিদ্রোহের পিছনে বিভিন্ন সামরিক কারণ দায়ী ছিল, যথা –

  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ভারতীয় সৈন্যদের অবহেলা – ভারতীয় সিপাহিদের বেতন, পদমর্যাদা ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা ব্রিটিশ সৈন্যদের তুলনায় কম ছিল। ভারতীয়দের পদোন্নতির সুযোগ ছিল না ও বাসস্থান ছিল নিম্নমানের। একজন ইংরেজ সৈন্যের মাসিক বেতন ছিল 90 ডলার ও একজন ভারতীয় সৈন্যের মাসিক বেতন ছিল 7 টাকা।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ধর্মীয় অসন্তোষ – ইংরেজ সামরিক কর্তৃপক্ষ ভারতীয় সিপাহিদের তিলক কাটা, দাড়ি ও টিকি রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় তারা ক্ষুব্ধ হয়।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সিপাহিদের পরিবারের উপর অত্যাচার – ভারতীয় সিপাহিরা ছিল সাধারণত কৃষক পরিবারের সন্তান। কৃষকরা বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে ইংরেজদের প্রতি ক্ষুব্ধ হলে সিপাহিদের পরিবারের প্রতি ইংরেজরাও দুর্ব্যবহার করতে শুরু করে।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ভাতা – যুদ্ধের জন্য সিপাহিদের দূরদেশে যেতে হত। এসময় ইংরেজ সৈন্যদের বেতন ছাড়াও অতিরিক্ত টাকা বা ভাতা দেওয়া হত। কিন্তু ভারতীয় সিপাহিদের এরূপ কোনো ভাতা দেওয়া হত না। ফলে তারা ক্ষুব্ধ হয়। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর মধ্যে এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভই সিপাহি বিদ্রোহের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ কী ছিল?

লর্ড ক্যানিং -এর শাসনকালে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সিপাহি, রাজা-মহারাজা ও জনগণের অসন্তোষকে কেন্দ্র করে যে বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল, তা 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল সিপাহিদের মধ্যে এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজের ব্যবহার সংক্রান্ত অসন্তোষ।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ –

এনফিল্ড রাইফেল নামক এক ধরনের বন্দুকের কার্তুজ ব্যবহারকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহের সূচনা হয়।

  • বন্দুকের কার্তুজ (টোটা) একটি মোড়কের মধ্যে থাকত। মোড়কটি দাঁত দিয়ে কেটে বন্দুকের মধ্যে ভরতে হত। এসময় গুজব রটে যে, ওই মোড়কটিতে গোরু ও শুয়োরের চর্বি মাখানো থাকে।
  • ধর্মচ্যুত হওয়ার ভয়ে হিন্দু ও মুসলমান সিপাহিরা এই কার্তুজ ব্যবহার করতে অসম্মত হয় এবং বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

1857 খ্রিস্টাব্দের মঙ্গল পাণ্ডের বিদ্রোহ –

বাংলার ব্যারাকপুর সেনাছাউনিতে এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজ সংক্রান্ত ঘটনায় 34 নং নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির সৈনিক মঙ্গল পাণ্ডে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।

1857 খ্রিস্টাব্দের মিরাটে বিদ্রোহ –

1857 খ্রিস্টাব্দের 24 এপ্রিল মিরাট সেনানিবাসের 3 নং নেটিভ ক্যাভালরির 90 জন সিপাহি এনফিল্ড রাইফেলের চর্বি মাখানো কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করে। 9 মে তাদের 85 জনকে 10 বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে মিরাটের সিপাহিরা 10 মে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

তাই বলা যায়, বিভিন্ন কারণে সিপাহিদের মধ্যে যে অসন্তোষ ছিল কার্তুজের ব্যবহারকে কেন্দ্র করেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের কীরূপ মনোভাব ছিল?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ভূমিকা –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। প্রথমে বহরমপুর, পরে ব্যারাকপুর সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ ঘটে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লেও শিক্ষিত বাঙালি সমাজ এই বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি বরং বিরোধিতা করেছিল। সমকালীন বিভিন্ন তথ্য থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের তথ্যসমূহ –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালিদের বিরূপ মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় নিম্নলিখিত তথ্যগুলি থেকে –

  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মনোভাব –
    • কিশোরীচাঁদ মিত্র ছিলেন সমসাময়িক একজন বিশিষ্ট বাঙালি। তিনি লিখেছেন, ‘এই বিপ্লব মূলত সৈনিকের বিপ্লব – এক লক্ষ সৈন্যের বিদ্রোহ, ইহার সহিত জনসাধারণের কোনো সংস্রব নাই। যাহারা এই বিদ্রোহী দলে যোগ দিয়াছে তাহাদের সংখ্যা গভর্নমেন্টের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন লোকের সংখ্যার অনুপাতে অতিশয় নগণ্য। প্রথম দলের সংখ্যা কয়েক সহস্র, দ্বিতীয় দলের সংখ্যা কয়েক কোটি।’
    • সমসাময়িক মনীষী শম্ভুচরণ মিত্র এবং হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখার্জি একই কথা লিখেছেন।
    • অরবিন্দ ঘোষের মাতামহ রাজনারায়ণ বসু 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সময় অন্যান্য শিক্ষিত বাঙালিদের মতো আতঙ্কিত ছিলেন এবং বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিলেন।
    • দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বেরিলিতে নিযুক্ত একজন সামরিক কর্মচারী ছিলেন। তিনি বিদ্রোহী সিপাহিদের অত্যাচারের কাহিনি লিখেছেন এবং নিন্দা করেছেন।
    • 1857 খ্রিস্টাব্দের 26 মে কলকাতা হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা এক সভার আয়োজন করেন। রাজা রাধাকান্ত দেব, কালীপ্রসন্ন সিংহ, হরেন্দ্র ঘোষ ও অন্যান্যরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে সিপাহিদের নিন্দা ও ইংরেজ সরকারকে সাহায্যের প্রস্তাব গৃহীত হয়। কেবল বিদ্রোহী সিপাহি নয়, দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ প্রমুখ নেতা-নেত্রীদের প্রতিও নিন্দা করা হয়।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পত্রপত্রিকা – সমসাময়িক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় (20 জুন, 1857 খ্রিঃ) এই বিদ্রোহের নিন্দা করে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ‘সংবাদ ভাস্কর’ পত্রিকায় (20 জুন, 1857 খ্রিঃ) বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সরকারি বাহিনীর সাফল্য ও বিদ্রোহী সিপাহিদের ধ্বংস কামনা করা হয়।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতিষ্ঠান – সেই সময় ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন ও মহামেডান অ্যাসোসিয়েশন প্রভৃতি সভাগুলি বিদ্রোহের বিরোধিতা ও ইংরেজ সরকারকে সমর্থনের প্রস্তাব গ্রহণ করে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের উপসংহার –

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে বাংলায় যে শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে ওঠে তারা বিভিন্ন সরকারি পদে নিযুক্ত ছিল। 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ তাদের পদমর্যাদা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দিতে পারে এই আশঙ্কায় শিক্ষিত বাঙালিরা এই বিদ্রোহের বিরোধিতা করে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ব্যর্থতা কি অবধারিত ছিল?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ব্যর্থতার ভূমিকা –

1857 খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্যানিং -এর শাসনকালে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত কিছু সিপাহিরা এই বিদ্রোহের সূচনা করলেও কালক্রমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাতে যোগ দেয়। 1857 খ্রিস্টাব্দে বহরমপুর, ব্যারাকপুর এবং মিরাটের সৈন্যদের এবং আঞ্চলিক রাজা-রানিদের বিদ্রোহ ঘোষণার ফলে এই বিদ্রোহ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। কিন্তু 1858 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসের মধ্যেই তা স্তিমিত হয়ে পড়ে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণসমূহ –

ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সিপাহি বিদ্রোহের দ্রুত বিস্তার, জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও সমর্থন থাকা সত্ত্বেও 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার পশ্চাতে একাধিক কারণ ছিল –

  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাব – সিপাহিদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাব ছিল। বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য কোনো কেন্দ্রীয় সংগঠন ছিল না। এমনকি সিপাহিদের মধ্যেও মতপার্থক্য ছিল প্রবল। এইসকল কারণে বিদ্রোহ ব্যর্থতার পথে পা বাড়ায়।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা – 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ভারতের সর্বত্র সম্প্রসারিত হয়নি, কেবলমাত্র দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, অযোধ্যা, বাংলা, বিহার প্রভৃতি অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। দক্ষিণ ভারত, কাশ্মীর, রাজপুতানা প্রভৃতি অঞ্চলে এই বিদ্রোহের কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের নেতৃত্বের অভাব – এই বিদ্রোহের সর্বভারতীয় স্তরে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কোনো নেতা ছিল না। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, লক্ষ্মীবাঈ, নানাসাহেব, কুনওয়ার সিং প্রমুখ পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজ নিজ এলাকায় ইংরেজবিরোধী বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই নেতাদের উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষা করা। তা ছাড়া তাঁদের কোনো সামরিক অভিজ্ঞতাও ছিল না।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ইংরেজদের রণনৈপুণ্য – ইংরেজ সেনাপতি আউট্রাম, হ্যাভলক, হিউরোজ, নিকলসন প্রমুখ ছিলেন বিদ্রোহী নেতাদের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ। ইংরেজ সেনাপতিদের উন্নত রণকৌশল ও যোগ্য নেতৃত্ব তাদের জয় সুনিশ্চিত করেছিল।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের দেশীয় শক্তির বিরোধিতা – ভারতের অনেক আঞ্চলিক রাজা, যেমন – গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া, ইন্দোরের হোলকার, হায়দরাবাদের নিজাম, রাজপুতানা, পাঞ্জাব এবং নেপালের রাজা-সহ অনেকে বিদ্রোহদমনে ইংরেজদের সাহায্য করেছিল। তা ছাড়া শিখ, রাজপুত, মারাঠা, গোর্খা প্রভৃতি যোদ্ধা জাতিও ইংরেজদের পক্ষ নিয়ে বিদ্রোহীদের দমন করেছিল।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা – ব্রিটিশ প্রশাসনিক ব্যবস্থার দুই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ রেলব্যবস্থা ও টেলিগ্রাফ -এর ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সংবাদ ব্রিটিশ সরকার দ্রুত পেয়ে যেত। অন্যদিকে ভারতীয়দের এই সুযোগ ছিল না ফলে ভারতীয় সিপাহি ও সাধারণ মানুষের পক্ষে এই বিদ্রোহের মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের উপসংহার –

উপরোক্ত কারণগুলি 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ব্যর্থতার পথ প্রশস্ত করেছিল। এই কারণগুলি না থাকলে হয়তো বিদ্রোহ সাফল্য অর্জন করতে পারত। কিন্তু প্রবল উদ্যম, উৎসাহ ও উদ্দীপনা থাকা সত্ত্বেও এই বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ফলাফল আলোচনা করো।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। লেপেল গ্রিফিন -এর মতে, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ভারতের আকাশ থেকে বহু মেঘ দূর করেছিল (The Revolt of 1857 swept the Indian Sky clear of many clouds) ।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ফলাফলসমূহ –

  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের কোম্পানি শাসনের অবসান – 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর ভারতে কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে। কোম্পানির বদলে ইংল্যান্ডের মহারানি ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন। ভারত শাসনের জন্য রাজপ্রতিনিধি বা ভাইসরয় নিযুক্ত হন। 1858 খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন পাস হয়।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ক্ষয়ক্ষতি – বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহী ও শাসক – উভয়পক্ষই নিষ্ঠুরতা দেখায়। ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসের ফলে প্রচুর পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের শাসনকাঠামোর পরিবর্তন – ইংল্যান্ডের যে সংস্থাগুলির মাধ্যমে ভারতের শাসনকার্য পরিচালিত হত সেগুলির পরিবর্তন ঘটে। 15 সদস্যের ইন্ডিয়া কাউন্সিল গঠিত হয়। এই কাউন্সিলের সভাপতি হন ভারত-সচিব (Secretary of the State for India)। তিনি ছিলেন ভারত বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার একজন মন্ত্রী।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সামরিক সংস্কার – সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার জন্য এই বিভাগে ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়। যেসব জাতির সৈন্যরা বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল তাদের ‘অসামরিক’ আর যেসব জাতির সৈন্যরা বিদ্রোহ দমনে সরকারকে সাহায্য করেছিল তারা ‘সামরিক’ জাতি হিসেবে আখ্যা পায়। পাঠান, শিখ, গোর্খাদের বেশি সংখ্যায় সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হয়। গোলন্দাজ বাহিনীতে কেবল ইংরেজদের নিয়োগ করা হয়। ইউরোপীয় সৈন্যের অনুপাত বৃদ্ধি করে বিভেদনীতি প্রয়োগ করা হয়।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের নতুন আদর্শ – বিদ্রোহ দমন করে এলাহাবাদের এক দরবারে মহারানির ঘোষণাপত্র জারি করা হয়। সম-অধিকার, রাজাদের দত্তকপুত্র গ্রহণ করা, রাজ্যজয় না করা, প্রজাস্বাধীনতার কথা ঘোষণা করা হয়। 1861 খ্রিস্টাব্দে Indian Council Act পাস করে বড়োলাটের কাউন্সিলে ভারতীয় সদস্য নেওয়ার ব্যবস্থা হয়। প্রদেশেও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এভাবে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ভারতে এক নবযুগের সূচনা করে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। একপক্ষের ঐতিহাসিকরা বলেন, এটি ছিল নিছক সিপাহি বিদ্রোহ। অপরপক্ষ বলেন, এটি ছিল জাতীয় আন্দোলন। তা ছাড়াও কেউ কেউ আবার এই বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম, সামন্ততান্ত্রিক প্রতিবাদ, কৃষক বিদ্রোহ, মুসলিম চক্রান্ত প্রভৃতি নানাভাবে অভিহিত করেছেন।

  • 1857 খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহ – ইংরেজ ঐতিহাসিক চার্লস রেক্স, হোমস এবং ভারতীয়দের মধ্যে কিশোরীচাঁদ মিত্র, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে নিছক সিপাহি বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের বক্তব্য –
    • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চালিকাশক্তি ছিল সিপাহিরা। তাদের অসন্তোষ থেকেই বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল।
    • এই বিদ্রোহে ভারতীয় জাতীয় চেতনার অগ্রদূত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি যোগদান করেনি বা ভারতের সমস্ত অঞ্চলের রাজারা আন্দোলনকে সমর্থন করেনি।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের জাতীয় আন্দোলন – ঐতিহাসিক নর্টন, জন কে, কার্ল মার্কস প্রমুখ 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যোগদান করেছিল; বিদ্রোহীরা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ‘সম্রাট’ বলে ঘোষণা করে ভারতবর্ষে এক নতুন শাসনব্যবস্থা স্থাপনে সচেষ্ট হয়েছিল।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম – স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর সাভারকর 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের সামন্ততান্ত্রিক বিদ্রোহ – 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের কারণ হিসেবে অনেকেই সামন্তদের অসন্তোষকে চিহ্নিত করেছেন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার একে সামন্ততন্ত্রের মৃত্যুকালীন আর্তনাদ বলে অভিহিত করেছেন।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের মুসলিম চক্রান্ত – ঐতিহাসিক আই এইচ কুরেশি ও সৈয়দ মইদুল হক 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে মুসলিম চক্রান্ত বলে অভিহিত করেছেন। তারা এই বিদ্রোহে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের পুনঃপ্রতিষ্ঠা লক্ষ করে এরূপ মন্তব্য করেছেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের মূল্যায়ন –

হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং অধ্যাপক সুশোভন সরকার এই বিদ্রোহকে জাতীয় সংগ্রাম বলেই মনে করেন। তাঁরা বলেন, এই বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিদ্রোহীদের দেশের প্রতি ভালোবাসার কোনো অভাব ছিল না।

তা ছাড়া এই বিদ্রোহ শুধুমাত্র সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষও শামিল হয়েছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনাকে কি ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলা যায়?

1857 খ্রিস্টাব্দের ভূমিকা –

ভারত ইতিহাসে 1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনাকে কেউ কেউ সিপাহি বিদ্রোহ বলেছেন।

‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলার কারণ –

  • সূচনা – ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর বহু ক্ষোভ জমা থাকলেও এই বিদ্রোহের মতো এত বড়ো বিদ্রোহ এর আগে কখনও হয়নি। ভারতীয় সিপাহিরাই এই বিদ্রোহের সূচনা করে।
  • অংশগ্রহণ – 1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনায় যারা অংশগ্রহণ করেছিল তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল দেশীয় সিপাহিরা।
  • নেতৃত্ব – 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রধান নেতা-নেত্রীরা বেসামরিক ব্যক্তি হলেও তারা সিপাহিদের দ্বারা সমর্থিত ছিল। এই বিদ্রোহের প্রকৃত নেতৃত্বে ছিল সিপাহিরাই। সেনাছাউনি থেকে বিদ্রোহকে জনগণের মধ্যে তারাই ছড়িয়ে দেয়। সরকারি সৈন্যদের সঙ্গে সম্মুখসমরে তারাই লড়াই করে।
  • বিস্তার – ব্রিটিশ ভারতের যেসব সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল সেই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে বিদ্রোহ ছড়িয়েছিল। যেসব সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ হয়নি সেখানকার অবস্থা স্বাভাবিক ছিল।
  • শাস্তিভোগ – বিদ্রোহের সূচনায়, অংশগ্রহণে, নেতৃত্বে যেহেতু সিপাহিদের প্রধান ভূমিকা ছিল তাই বিদ্রোহ শেষে সিপাহিদেরই বেশি শাস্তিভোগ করতে হয়। কামানের গোলা, বন্দুকের গুলি বা ফাঁসির দড়িতে তাদের প্রাণ দিতে হয়।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের বিরুদ্ধ মত –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে দেশীয় সিপাহিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল -এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, সব দেশীয় সিপাহি বিদ্রোহে যোগদান করেনি। নাম্বুদ্রিপাদ দেখিয়েছেন, যত সংখ্যক সিপাহি বিদ্রোহ করেছিল ততোধিক সিপাহি বিদ্রোহ দমনে অংশ নিয়েছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের মূল্যায়ন –

যুক্তি, তথ্য ও বিরুদ্ধ মত বিশ্লেষণ করে এ কথা স্বীকার করতেই হয় যে, 1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনা ছিল অনেকাংশে সিপাহি বিদ্রোহ। কোথাও কোথাও এর পিছনে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় জনসমর্থন ছিল। চার্লস রেক্স, কে ম্যালেসন এবং দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় একই মত ব্যক্ত করেছেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কি ‘জাতীয় উত্থান’ বলা যায়?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ভূমিকা –

ভারত ইতিহাসে 1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ঐতিহাসিকেরা এই ঘটনাকে সিপাহি বিদ্রোহ বা সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া বা জাতীয় উত্থান বলেছেন। প্রত্যেক বক্তব্যের পিছনে নির্দিষ্ট যুক্তি ও তথ্য আছে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের কারণ –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় উত্থান বলার পিছনে কারণ ও যুক্তিগুলি হল –

গণ অভ্যুত্থান – 1857 খ্রিস্টাব্দে সিপাহিরা যে বিদ্রোহ শুরু করে তা জনসমর্থন লাভ করে গণ অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল। জনগণ বিদ্রোহী সিপাহিদের সমর্থন করে। তারা চিরাচরিত অস্ত্র (লাঠি, বল্লম, তরোয়াল, তিরধনুক, কুঠার) নিয়ে সরকারি ভবন ও সরকারি কার্যালয় আক্রমণ করে, আগুন ধরিয়ে দেয় এবং লুঠপাট চালায়। ইংরেজদের আবাসিক এলাকায় তারা একইভাবে আক্রমণ করে এবং হত্যাকাণ্ড চালায়। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ তখন ইংরেজবিরোধী হয়ে উঠেছিল।

জাতীয় সংগ্রাম –

অধ্যাপক সুশোভন সরকার বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বলেছেন, কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কখনও সেই দেশের আপামর জনগণ অংশগ্রহণ করে না, উদ্দেশ্যের নিরিখে সেই ঘটনাকে বিচার করতে হয়। তাই 1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনাকে তিনি জাতীয় সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন।

  • নিম্নবর্ণের মানুষের যোগদান – অধ্যাপক রণজিৎ গুহ বিদ্রোহে নিম্নবর্গের মানুষদের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানের কথা বলেছেন। ডঃ শশীভূষণ চৌধুরী বিদ্রোহে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, স্থায়িত্বে, ব্যাপকতায়, অভিনবত্বে এই বিদ্রোহ আগের বিদ্রোহগুলিকে অতিক্রম করে যায়।
  • ঘোষণাসমূহ – সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের দিল্লি ঘোষণা, আজমগড় ঘোষণায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এবং ইংরেজ বিতাড়নের আহ্বান ছিল। ব্রিজেস কাদের -এর ইস্তাহারে ইংরেজমুক্ত ভারত গঠনের কথা ছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের মন্তব্য –

বিনায়ক দামোদর সাভারকর 1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনাকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলেছেন। কার্ল মার্কসও একই কথা বলেছেন। তারাচাঁদ 1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনাকে বিদ্রোহ বলতে অস্বীকার করেছেন। নর্টন, ডাফ, হোমস এই ঘটনাকে ষড়যন্ত্র থেকে উদ্ভূত জাতীয় বিদ্রোহ বলেছেন। উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য থেকে 1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনাকে জাতীয় উত্থান বলা যায়।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কি ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলা যায়?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ভূমিকা –

বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর ‘The Indian War of Independence’ গ্রন্থে 1857 -এর বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা যায় কি না তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কি 'প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ' বলা যায়?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলা যায় কি?

  • পক্ষে যুক্তি – বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনায়ক দামোদর সাভারকর 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে দাবি করেন। তাঁর মতে, এই বিদ্রোহে সিপাহিদের নেতৃত্বে ভারতীয়রা স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে শামিল হয়েছিল। তাঁর এই মত সমর্থন করেছেন অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক সুশোভন সরকার, পি সি যোশি প্রমুখ। অধ্যাপক সুশোভন সরকারের মতে, ইটালির কার্বোনারি আন্দোলনকে যদি মুক্তিযুদ্ধ বলা যায়, তাহলে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকেও ভারতের মুক্তিযুদ্ধ বলা যাবে। অধ্যাপক পি সি যোশি তাঁর ‘1857 in Our History’ গ্রন্থে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলেছেন।
  • বিপক্ষে যুক্তি – সুরেন্দ্রনাথ সেন, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ ঐতিহাসিক 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধ বলতে নারাজ। সুরেন্দ্রনাথ সেন তাঁর ‘Eighteen Fifty Seven’ গ্রন্থে বলেছেন যে, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কখনোই স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা যায় না। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘History of Freedom Movement in India’ গ্রন্থে বলেছেন যে, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে প্রথম ভারতীয় সংগ্রাম বা স্বাধীনতার যুদ্ধ কোনোটাই বলা যায় না। প্রকৃতপক্ষে মাতৃভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য যে সর্বজনীন আদর্শ ও লক্ষ্য থাকা দরকার তা 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে ছিল না।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলার মূল্যায়ন –

উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ না বলা গেলেও স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি তৈরিতে এই বিদ্রোহ যে সহায়তা করেছিল এ কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সময় হিন্দু-মুসলিম ঐক্য – টীকা লেখো।

হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ভূমিকা –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল – হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। এই বিদ্রোহে সব স্তরের হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে শামিল হয়েছিল।

হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রকৃতি –

  1. 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে বিদ্রোহী হিন্দু ও মুসলিমরা সব ভেদাভেদ ভুলে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে নেতা বলে স্বীকার করেছিল। বাহাদুর শাহ ঐক্য ও আন্দোলনের প্রতীক স্বরূপ ছিলেন।
  2. বিদ্রোহীরা পরস্পরের ধর্মের প্রতি সহনশীলতার নজির স্থাপন করেছিল। এই সময় ইংরেজ কর্তৃত্ব মুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে সেই অঞ্চলে গো-হত্যাও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
  3. নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলিম নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যেমন – ঝাঁসিতে লক্ষ্মীবাঈ, বিহারে কুনওয়ার সিং, কানপুরে নানাসাহেব, তাঁতিয়া তোপি প্রমুখ নেতা-নেত্রী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তেমনি অযোধ্যায় বেগম হজরত মহল, দিল্লিতে বরকৎ খান প্রমুখ ছিলেন নেতৃত্বের অগ্রভাগে।

হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের উপসংহার –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ইংরেজদের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইংরেজ কর্মচারী এ্যাচিসন বলেছেন যে, এই একটা ক্ষেত্র যেখানে আমরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের লেলিয়ে দিতে পারিনি।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে গণবিদ্রোহ না বলার যুক্তিগুলি আলোচনা করো।

1857 খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্যানিং -এর শাসনকালে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত বেশ কিছু সিপাহি এই বিদ্রোহের সূচনা করলে এবং কালক্রমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বহু সাধারণ মানুষের যোগদানের ফলে এটি গণবিদ্রোহে রূপান্তরিত হয়।

1857 খ্রিস্টাব্দের গণবিদ্রোহের বিপক্ষে যুক্তি –

কিশোরীচাঁদ মিত্র, দুর্গাদাস ব্যানার্জি, স্যার সৈয়দ আহমদ, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ ব্যক্তিরা মনে করেন, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে গণ আন্দোলনের আবশ্যিক উপাদানসমূহের একান্ত অভাব ছিল। তাঁদের মতে –

  • সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাব – সিপাহিদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাব ছিল। পরিচালনার জন্য কোনো কেন্দ্রীয় সংগঠন ছিল না। এমনকি সিপাহিদের মধ্যেও মতভেদ ছিল প্রবল। বেঙ্গল আর্মি ছাড়া সিপাহিদের অন্য দুটি শাখা বিদ্রোহের বিরোধিতা করে।
  • সর্বভারতীয় চরিত্রের অভাব – 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের কোনো সর্বভারতীয় চরিত্র ছিল না। অর্থাৎ বহু দেশীয় রাজ্য যেমন – সিন্ধিয়া, হোলকার, গাইকোয়াড়, রাজস্থান, মহীশূর প্রভৃতি রাজ্য যেমন বিদ্রোহ থেকে দূরে ছিল, তেমনি ঝিন্দ, পাতিয়ালার শিখ দলপতিরা ইংরেজদের সঙ্গে বিদ্রোহ দমনে লিপ্ত হয়েছিল।
  • জাতীয় চেতনার অনুপস্থিতি – 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে স্বাধীনতার যুদ্ধ আখ্যা দেওয়া যায় না। কারণ আলোচ্য পর্বে ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেনি।

1857 খ্রিস্টাব্দের গণবিদ্রোহের মূল্যায়ন –

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, কোনো একটি নির্দিষ্ট উপাদান নয় বরং গণবিদ্রোহের একাধিক উপাদানের অনুপস্থিতি 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে লক্ষণীয়। তাই অনেকে এই বিদ্রোহকে গণবিদ্রোহ বলে মেনে নিতে রাজি নন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ কি জেহাদ ছিল? তোমার অভিমত দাও।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ভূমিকা –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে অনেক ঐতিহাসিক ব্রিটিশ শাসনের প্রতি মুসলিমদের জেহাদ বলে গণ্য করেছেন। ব্রিটিশরা মুসলমানদের সাম্রাজ্য শুধু ধ্বংসই করেনি তা জবরদখল করেছিল। তাই তারা ইংরেজ শাসনের প্রতি প্রথম থেকেই বিক্ষুব্ধ ছিল।

দিল্লি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মুজাহিদিন ও গাজিদের উদ্দেশ্য –

দিল্লি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কিছু মুজাহিদিন, জেহাদি ও গাজিরা বিদ্রোহের পূর্বে জড়ো হয়েছিল। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল দার-উল-হারব (বিধর্মীর দেশ)-কে দার-উল-ইসলামের দেশে পরিণত করা।

মহম্মদ বাকরের ভূমিকা –

দিল্লি উর্দু আখবার -এর সম্পাদক মৌলবি মহম্মদ বাকর 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জেহাদ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, ইংরেজরা তাদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হেনেছিল। তাই ঈশ্বর স্বয়ং ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এই ক্রোধের আগুনে নিজেদের পবিত্র করে ঈশ্বরের নির্দেশে সিপাহিরা বিদ্রোহ করেছিল। রায়বেরিলির ধর্মগুরু সৈয়দ আহমদ জেহাদকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন।

মহম্মদ সঈদের অভিমত –

মৌলানা মহম্মদ সঈদ বলেছিলেন, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের বিরোধীপক্ষ ছিল একমাত্র ইংরেজ, আর কেউ নয়। তাঁর বিবেচনায় জেহাদ ছিল ইংরেজবিরোধী সংগ্রামের রাজনৈতিক হাতিয়ার।

ইকতিদার আলম খান ও সীমা আলাভির দৃষ্টিভঙ্গি –

সীমা আলাভি বলেছেন যে, দিল্লিকে বাঁচানোর জন্য জেহাদিদের আত্মত্যাগ প্রশংসার যোগ্য। ইকতিদার আলম খান ও সীমা আলাভির গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, 1857 খ্রিস্টাব্দের অস্থির সময়ে জেহাদ শব্দটি সকলের কাছে সমার্থক ছিল না। কিন্তু কট্টরপন্থী মৌলবি তাত্ত্বিক শুদ্ধতায় এটি প্রয়োগের চেষ্টা করেছিলেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের মূল্যায়ন –

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি প্রতিভাত হয় যে, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘জেহাদ’ বলে উল্লেখ করলেও তা আভিধানিক অর্থে নয়, ব্যাবহারিক অর্থে গ্রহণ করা হয়েছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সিপাহিদের জেহাদে শামিল হওয়ার ডাক তারা দিতে পেরেছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কি পুরোনো ব্যবস্থার পুনঃস্থাপন বলা যায়?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ভূমিকা –

উনিশ শতকে ভারতে বহু আলোচিত বিষয়গুলির মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হল 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি ও লক্ষ্য। বিদ্রোহীরা পুরোনো ব্যবস্থাকেই ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল কি না তা নিয়ে ঐতিহাসিকরা দ্বিধাবিভক্ত। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, বিদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিল পুরোনো ব্যবস্থার পুনঃস্থাপন, আবার কেউ কেউ বলেন বিদ্রোহীরা বিকল্প ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের চেষ্টা করেছিলেন।

পুরোনো ব্যবস্থার পুনঃস্থাপন ছিল কি না?

  • পক্ষে যুক্তি – রমেশচন্দ্র মজুমদার, এস এন সেন প্রমুখ ঐতিহাসিক মনে করেন, বিদ্রোহীরা চেয়েছিল পুরোনো ব্যবস্থাকেই ফিরিয়ে আনতে। সেই অর্থে একে Restoration বা পুরোনো ব্যবস্থার সংস্থাপন বলা যেতে পারে। ঐতিহাসিক রুদ্রাংশ মুখার্জি মনে করেন, বিদ্রোহীরা কোনো নতুন সামাজিক বিন্যাস গড়ে তুলতে উদ্যোগী হননি। ব্রিটিশ শাসন তাদের প্রচলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে বিপর্যয় ঘটিয়েছিল বিদ্রোহীরা সেই অবস্থার অবসান চেয়েছিল।
  • বিপক্ষে যুক্তি – ঐতিহাসিক রজতকান্ত রায় এ বিষয়ে ভিন্ন মত উপস্থাপন করেন। তাঁর মতে, বিদ্রোহীরা পুরোনো ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাদের কার্যকলাপ ও ঘোষণাগুলির মধ্যে পরিবর্তনের ছাপ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিদ্রোহীরা যে ধরনের বিধিব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল, তার মধ্য দিয়েও তাদের পরিবর্তিত মনোভাবের বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। সাম্প্রতিককালে আরও কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন যে, বিদ্রোহীরা একটি বিকল্প ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের চেষ্টা করেছিল। সেইদিক থেকে বিদ্রোহকে পুরোনো মুঘল শাসনব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন বলে গণ্য করা যুক্তিযুক্ত হবে না।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের মূল্যায়ন –

উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে সিপাহিদের লক্ষ্য ছিল সামরিক ক্ষেত্রে অসাম্য দূর করা এবং রাজন্যবর্গের লক্ষ্য ছিল পুরোনো মর্যাদা ফিরে পাওয়া। আবার সাধারণ মানুষের লক্ষ্য ছিল এদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুতরাং, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে কোনো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সমগ্র বিদ্রোহের লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করাটা হয়তো যথোচিত হবে না।

জাতীয়তাবাদের উপর 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রভাব লেখো।

জাতীয়তাবাদের উপর 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রভাব –

ভারতবর্ষের জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাসে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের গভীর প্রভাব পড়েছিল।

  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের জাতীয় জাগরণ – ভারতবর্ষের জাতীয় ইতিহাসে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ একটি গৌরবময় অধ্যায়রূপে চিহ্নিত। এই বিদ্রোহ আধুনিককালের জাতীয় জাগরণের পথ প্রস্তুত করে দিয়েছিল। ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র লিখেছেন, শৌর্য ও দেশাত্মবোধে সমুজ্জ্বল 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ভারতবাসীর মনে একটা অবিস্মরণীয় ছাপ রেখে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামে সেটাই প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের জাতীয়তাবাদের উন্মেষ – 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ জাতীয়তাবাদের উন্মেষের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের স্মৃতিকথা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এরা অনেকেই 1857 খ্রিস্টাব্দের অভ্যুত্থানের সঙ্গে তাদের বিপ্লবী কার্যকলাপকে ধারাবাহিক একটি বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পত্রপত্রিকার উপর প্রভাব – বিংশ শতকের শুরুতে পত্রপত্রিকাগুলির লেখায় পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ‘যুগান্তর’ ও ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকায় এই বিদ্রোহ ও তার বিদ্রোহীদের স্মৃতিচারণা করা হয়।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উক্তি – ‘দেশ’ পত্রিকায় চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন – ‘সাতান্ন বিপ্লবের বিপ্লবীরা শতাব্দী সঞ্চিত জড়তার মোহ থেকে আমাদের জাগান। এতদিন যাদের শক্তির প্রতিভূ বলে মনে করা হয়েছে, দেখা গেল বিপ্লবের সম্মুখীন হয়ে তাদের কি প্রবল আতঙ্ক! ইংরেজদের ভয়ের মধ্যেই আমরা খুঁজে পেলাম মুক্তির আশা। উপলব্ধি করলাম দেশের লোক আন্তরিকভাবে বিরুদ্ধাচরণ করলে বিদেশি সরকার প্রবলতম শক্তির অধিকারী হলেও দীর্ঘকাল প্রভুত্ব করতে পারবে না।’

মহারানির ঘোষণাপত্র (1858 খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

মহারানির ঘোষণাপত্রের ভূমিকা –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ দমন করার পর ভারতের ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় প্রভূত পরিবর্তন করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের মুঘল শাসন ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারতের শাসন ক্ষমতা ইংল্যান্ডেশ্বরী মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয়। মহারানি ভিক্টোরিয়ার প্রতিনিধিরূপে প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং আনুষ্ঠানিকভাবে এলাহাবাদে 1858 খ্রিস্টাব্দের 1 নভেম্বর যে ঘোষণাপত্রটি প্রকাশ করেন, তা মহারানির ঘোষণাপত্র নামে পরিচিত।

মহারানির ঘোষণাপত্র (1858 খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

মহারানির ঘোষণাপত্রের পটভূমি –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ঘটে যাওয়ার পর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হাতে ভারতের শাসনভার রাখতে চায়নি। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের পরিবর্তে ভারতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ‘ভারতে উন্নত ধরনের শাসন আইন, 1858’ (Act for Better Government in India, 1858) পাস করে। এই আইনে ভারতের শাসন ক্ষমতা মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয়।

মহারানির ঘোষণাপত্রের মূল বক্তব্য –

মহারানির ঘোষণাপত্রে বলা হয় যে –

  • ভারতবাসীর ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার কোনোরকম হস্তক্ষেপ করবে না।
  • জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যোগ্যতাসম্পন্ন সকল ভারতবাসী সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত হতে পারবে।
  • স্বত্ববিলোপ নীতি প্রত্যাহার করা হবে এবং দেশীয় রাজারা দত্তকপুত্র গ্রহণ করতে পারবেন।
  • সরকার ভারতের সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতি ত্যাগ করবে।
  • দেশীয় রাজাদের আশ্বস্ত করে ঘোষণা করা হয় যে, কোম্পানির সঙ্গে তাদের স্বাক্ষরিত সব যুক্তি মেনে চলা হবে।

মহারানির ঘোষণাপত্রের মূল্যায়ন –

দীর্ঘ 100 বছর (1757-1857 খ্রিঃ) ধরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে যে অপশাসন চালিয়েছিল মহারানির ঘোষণাপত্র সেই অপশাসনে মধুর প্রলেপ দিয়েছিল। তবে মহারানি ভারতীয়দের যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার কোনোটিই সঠিকভাবে পালিত হয়নি। তাই ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার মহারানির ঘোষণাকে ‘প্রতিশ্রুতিভঙ্গের অধ্যায়’ বলে অভিহিত করেছেন।

মহারানির ঘোষণাপত্রের (1858 খ্রিঃ) ঐতিহাসিক তাৎপর্য কী?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর 1858 খ্রিস্টাব্দের 1 নভেম্বর এলাহাবাদের দরবারে লর্ড ক্যানিং ‘মহারানির ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন। ওই বছরেই 2 আগস্ট ভারত শাসন আইনের দ্বারা কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে এবং মহারানি ভিক্টোরিয়া সরাসরি ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন। গভর্নর জেনারেলের পরিবর্তে ভাইসরয় পদ তৈরি হয়। স্বত্ববিলোপ নীতির অবসান, দেশীয় রাজ্যগুলির অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ, প্রত্যেক ভারতীয়কে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান, যোগ্যতা অনুযায়ী ভারতীয়দের সরকারি চাকরিপ্রদান প্রভৃতি আশ্বাসবাণী উচ্চারিত হয় এই ঘোষণাপত্রে।

মহারানির ঘোষণাপত্রের তাৎপর্য –

কিন্তু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একশো বছরের অপশাসনে সৃষ্ট গভীর ক্ষতে প্রলেপ দিতে গিয়ে অনেক প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হলেও তা সঠিকভাবে পালিত হয়নি। প্রথমত, এই ঘোষণাপত্রের দ্বারা ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহের কারণগুলি অনুধাবন করে সেগুলির প্রতিকারের চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয়ত, দেশীয় রাজন্যবর্গকে স্বশাসনের অধিকার দেওয়া হলেও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিরোধে ভাইসরয়ের সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত বলে ঘোষণা করা হয়। তৃতীয়ত, এই ঘোষণাপত্রের দ্বারা সামন্ততান্ত্রিক দেশীয় রাজন্যবর্গ ও ভূস্বামী শ্রেণির আনুগত্যের উপরই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, শিক্ষিত শ্রেণির দাবিদাওয়াকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। চতুর্থত, এই ঘোষণাপত্রের দ্বারা পুরোনো সাম্রাজ্যবাদী শাসনের মূল চরিত্রের কোনো বদল ঘটেনি, পরিবর্তন ঘটেছিল কেবল বহিরঙ্গেই।

এই সকল কারণে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার এই ঘোষণাপত্রকে প্রতিশ্রুতিভঙ্গের অধ্যায়ের সূচনাকাল বলে চিহ্নিত করেছেন। বিপানচন্দ্রও এই ঘোষণাপত্রকে ‘রাজনৈতিক ধাপ্পা’ বলেছেন।

ভারতে সভাসমিতির যুগের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

সভাসমিতির যুগ –

ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে শাসন ও শোষণের প্রতিক্রিয়ায় কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের ফলে এদেশে একটি শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে ওঠে, তারা নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য বিভিন্ন সভাসমিতি গড়ে তোলেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে ভারতের প্রেসিডেন্সি শহরগুলিতে এইসব সভাসমিতি গড়ে ওঠার জন্য ডঃ অনিল শীল এই সময়কে সভাসমিতির যুগ বলে অভিহিত করেছেন।

সভাসমিতির যুগের বৈশিষ্ট্য –

এই যুগের বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

  • ঐক্যভাব – এদেশের শিক্ষিত শ্রেণি গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায় আগ্রহী ছিল। ইংরেজ শাসনে তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্য তারা নিজেদের মধ্যে ঐক্যভাব বজায় রাখে।
  • এলিট চরিত্র – এলিট বলতে শিক্ষাদীক্ষায় আলোকিত শ্রেণিকে বোঝায়। এ যুগের সভাসমিতিতে সদস্যরূপে কোনো সাধারণ মানুষ ছিল না। সবাই ছিল মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি।
  • রাজনৈতিক চেতনা – ইংরেজ সরকারের শাসন, কর ও মুদ্রাস্ফীতি, শোষণ ও বৈষম্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সভাসমিতিগুলি তখন গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জনস্বার্থের কথা ভাবতে শুরু করে।
  • শিক্ষার প্রসার – ব্রিটিশ শাসনকালে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সূত্রে এদেশে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির জন্ম হয়। এরা আধুনিক গণতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত ছিল। প্রথমদিকে এই শ্রেণি ব্রিটিশ শাসনের অন্ধ সমর্থক ছিল, কিন্তু পরে তাদের মোহভঙ্গ হয়।

সভাসমিতির যুগের মন্তব্য –

সভাসমিতিগুলির নেতৃত্বে ছিল জমিদার শ্রেণি। পরে ইংরেজি-শিক্ষিত সরকারি পেশাজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই সভাসমিতিগুলির নেতৃত্ব দেয়। ক্রমে তাদের আন্দোলনের অভিমুখ গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয়তাবাদের পথ অনুসরণ করে।

উনিশ শতকে ভারতে কয়েকটি রাজনৈতিক সভাসমিতির বিবরণ দাও।

রাজনৈতিক সভাসমিতির ভূমিকা –

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ও পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে একটি শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে। এই শ্রেণি রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিল। তাদের উদ্যোগে শ্রেণিস্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাজনৈতিক সভাসমিতিসমূহ –

উনিশ শতকের ভারতে সমস্ত দিক থেকে অগ্রণী ছিল বাংলা। এই সময় বাংলা প্রদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমিতি গড়ে ওঠে।

  • বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা – ইংল্যান্ডের অনুকরণে এদেশে প্রথম যে-সমস্ত রাজনৈতিক সমিতি গড়ে ওঠে, তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা। 1836 খ্রিস্টাব্দের 8 ডিসেম্বর এই সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কালীনাথ রায়চৌধুরী, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখ। জমিদার শ্রেণির স্বার্থরক্ষা ছিল এই সমিতির উদ্দেশ্য।
  • জমিদার সভা – 1838 খ্রিস্টাব্দে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও রাজা রাধাকান্ত দেব এই সভা প্রতিষ্ঠা করেন। জমিদারদের স্বার্থরক্ষা এই সমিতির উদ্দেশ্য ছিল।
  • ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি – পাদরি অ্যাডাম এই সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন (1839 খ্রিস্টাব্দ)। ভারতীয়দের প্রকৃত অবস্থা ব্রিটিশ জনগণকে জানানো এই সমিতির উদ্দেশ্য ছিল। এজন্য অ্যাডাম ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাডভোকেট’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন।
  • বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি – ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক নেতা টমসন -এর উদ্যোগে এই সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় 1843 খ্রিস্টাব্দে। এই সমিতির সভাপতি ছিলেন টমসন ও সম্পাদক ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। ভারতবাসীর জন্য ইংল্যান্ড থেকে সুযোগসুবিধা আদায় করাই ছিল এই সমিতির উদ্দেশ্য।
  • ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন – জমিদার সমিতি ও বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি একত্রিত হয়ে এই সমিতি গড়ে ওঠে (1851 খ্রিস্টাব্দ)। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদক ও রাজা রাধাকান্ত দেব এর সভাপতি ছিলেন। বোম্বাই এবং মাদ্রাজে এই সমিতির শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা এই সমিতির মুখপত্র ছিল।
  • অন্যান্য – এ ছাড়া ইন্ডিয়ান লিগ (1875 খ্রিস্টাব্দ), ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (1876 খ্রিস্টাব্দ) নামে দুটি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় 1885 খ্রিস্টাব্দে।

রাজনৈতিক সভাসমিতির মূল্যায়ন –

ইংরেজ শাসন ও তার ফলশ্রুতি হিসেবে এই সভাসমিতিগুলি গড়ে ওঠে। যদিও ইংরেজ শাসনের প্রতি আনুগত্য বজায় ছিল, তথাপি ধূমায়িত ক্ষোভ এই সকল সমিতি প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল। এই সমিতিগুলিকে কেন্দ্র করেই জাতীয় আন্দোলনের পথ তৈরি হয়। তাই ডঃ অনিল শীল বলেছেন, এই সমিতিগুলি উনিশ শতকের ভারতকে আধুনিক রাজনীতির প্রাঙ্গণে এনেছিল।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অথবা, বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাকে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় কেন?

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার ভূমিকা –

উনিশ শতকে বাংলার বেশ কিছু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উন্মেষ হয়েছিল। তাই ডঃ অনিল শীল উনিশ শতককে সভাসমিতির যুগ (Age of Association) বলে অভিহিত করেছেন।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রতিষ্ঠাকাল ও প্রতিষ্ঠাতা –

  • বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠিত হয় 1836 খ্রিস্টাব্দে।
  • এই সভার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন টাকির জমিদার কালীনাথ রায়চৌধুরী, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য এবং রামমোহন রায়ের অন্যান্য শিষ্যরা।
  • 1836 খ্রিস্টাব্দের 8 ডিসেম্বর বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রথম অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল –

  • সরকারি শাসনব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করা।
  • জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য সরকারের কাছে আবেদনপত্র পেশ করা।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার কার্যাবলি –

  • রাজনৈতিক আলোচনা – বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভায় সরকারের বিভিন্ন কার্যাবলি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা হত।
  • কর আদায়ের প্রতিবাদ – ব্রিটিশ সরকার এক আইন দ্বারা নিষ্কর জমির উপর কর আদায় করলে তার বিরুদ্ধে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা জনসভা আহ্বান করে।
  • পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা – বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার মূল্যায়ন –

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তবে তার কার্যাবলি লক্ষ করে প্রখ্যাত গবেষক যোগেশচন্দ্র বাগল বলেছেন যে, এটিই হল ‘বাঙালি তথা ভারতবাসীর মধ্যে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।’

জমিদার সভা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অথবা, টীকা লেখো – জমিদার সভা।

উনিশ শতকে বাংলায় অনেক সভাসমিতি গড়ে উঠেছিল। তাই ডঃ অনিল শীল উনিশ শতককে সভাসমিতির যুগ (Age of Association) বলে অভিহিত করেছেন। জমিদার সভা (Landholders Society) ছিল এই সময়ের একটি অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান।

জমিদার সভার প্রতিষ্ঠাকাল ও প্রতিষ্ঠাতা –

  • জমিদার সভা প্রতিষ্ঠিত হয় 1838 খ্রিস্টাব্দের 12 নভেম্বর।
  • এই সভার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামকমল সেন, ভবানীচরণ মিত্র প্রমুখ।
  • জমিদার সভার সভাপতি ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব। তবে দ্বারকানাথ ঠাকুরকে এই সভার ‘প্রাণপুরুষ’ বলা হয়।

জমিদার সভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

জমিদার সভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল –

  1. জমিদারদের স্বার্থরক্ষা করা।
  2. বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ ও রাজস্ব বিভাগের সংস্কার করার জন্য আন্দোলন করা।
  3. ভারতের সর্বত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের জন্য চেষ্টা করা।

জমিদার সভার কার্যাবলি –

জমিদার সভার কার্যাবলি হল নিম্নরূপ –

  • জমিদারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা – জমিদার সভা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শাখা স্থাপন করে বিভিন্ন অঞ্চলের সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে উদ্যোগী হয়।
  • ভারতের সর্বত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রসার – জমিদার সভা ভারতের সর্বত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রসার ঘটানোর দাবি করেছিল।
  • সংস্কারসাধন – বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ ও রাজস্ব বিভাগের সংস্কারসাধনের উদ্দেশ্যে জমিদার সভা আন্দোলন চালায়।
  • সমর্থন লাভের প্রচেষ্টা – জমিদার সভা ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সহানুভূতিশীল ব্রিটিশদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করে।

জমিদার সভা প্রতিষ্ঠার সাফল্য –

জমিদার সভার কার্যাবলির প্রধান সাফল্য হল প্রতি গ্রামে দশ বিঘা পর্যন্ত নিষ্কর জমি রাখতে সরকারের সম্মতি আদায় করা। তবে জমিদার সভা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ডঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতে, এই প্রতিষ্ঠানই হল ‘ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের অগ্রদূত’।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

অথবা, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা –

বৃহত্তর একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের লক্ষ্য নিয়ে জমিদার সভা (1838 খ্রিস্টাব্দ) এবং বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটি (1843 খ্রিস্টাব্দ) একত্রিত হয়ে 1851 খ্রিস্টাব্দে গড়ে তোলে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। নবগঠিত এই সংগঠনের সভাপতি হন রাজা রাধাকান্ত দেব এবং সম্পাদক হন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের উদ্দেশ্য –

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য জানা যায় ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠানো এক আবেদনপত্র থেকে। এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল –

  • ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার ও তার সংস্কারের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা।
  • শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি জানানো।
  • বিচারব্যবস্থা সুগঠিত করার দাবি জানানো।
  • ভারতীয়দের সম্পদ রক্ষার জন্য সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো।
  • সরকারি উচ্চপদগুলিতে বেশি সংখ্যায় ভারতীয়দের নিয়োগের ব্যবস্থা করা।
  • ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির আদর্শে ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে স্বতন্ত্র এক পরিষদ গঠন করে ভারতীয়দের দাবিদাওয়া জানানোর সুযোগ সৃষ্টি করা।

বস্তুতপক্ষে দীর্ঘদিন ধরে এই সংস্থা সুচারুরূপে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছিল।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রসার –

এই সংস্থার তিনটি শাখা, যথা – বাংলার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, বোম্বাই -এর বোম্বাই অ্যাসোসিয়েশন, মাদ্রাজ-এ নেটিভ অ্যাসোসিয়েশন 1870 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের মূল্যায়ন –

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের কার্যাবলির মধ্যে খুব বেশি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না, কার্যত জমিদারদের স্বার্থরক্ষা বড়ো হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া সাধারণ জনগণের মধ্যে সংগঠনটি বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি। তবে ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় সংগঠন গড়ে তোলার উপলব্ধি ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল এই সংগঠনটি। তা ছাড়া এই সভা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে সচেতন কর্মসূচি গ্রহণের দিকটিও উন্মোচিত করতে পেরেছিল।

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (ভারতসভা) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?

ভারতসভা –

1876 খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বা ভারতসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতসভার প্রাণপুরুষ ছিলেন। ভারতসভা বহুমুখী উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (ভারতসভা) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?

ভারতসভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

  • ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন – ভারতসভা প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে দেশে শক্তিশালী জনমত গঠন করা। সুরেন্দ্রনাথ ‘সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা’, ‘দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইন’, ‘অস্ত্র আইন’, ‘ইলবার্ট বিল’ প্রভৃতি বিষয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে জনমত গঠন করেছিলেন।
  • রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা – ভারতসভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল অর্থবহ রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। জাতীয়তাবাদী নেতারা উপলব্ধি করেছিলেন যে, রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়া ভারতীয়দের স্বার্থরক্ষা করা সম্ভব নয়, তাই তারা ভারতসভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
  • ধর্ম ও বণের ঊর্ধ্বে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা – ভারতসভা জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা দূর করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। সুরেন্দ্রনাথ সমগ্র ভারত ভ্রমণ করে লখনউ, মিরাট, লাহোর প্রভৃতি অঞ্চলে ভারতসভার শাখা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
  • জনগণকে গণ আন্দোলনে শামিল করা – ভারতসভার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ভারতীয়দের গণ আন্দোলনে শামিল করা। এই সভার সদস্যরা গণ আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় সংশোধন আনতে চেয়েছিলেন।

ভারতসভার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আলোচনা করো।

অথবা, ভারতসভার প্রতিষ্ঠা ও কর্মসূচি সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, রাজনৈতিক সমিতি হিসেবে ভারতসভার বিবরণ দাও।

ভারতসভার প্রতিষ্ঠার ভূমিকা –

উনিশ শতকে যেসব রাজনৈতিক সমিতি গড়ে ওঠে সেগুলির অধিকাংশ ছিল আঞ্চলিক ও বিশেষ শ্রেণিস্বার্থের বাহক। কিন্তু ভারতসভা গড়ে ওঠে সমস্ত ভারতবাসীর স্বার্থরক্ষার লক্ষ্য নিয়ে। এই সভায় যে-কোনো ভারতীয় সদস্য হতে পারত – কোনো ধর্মীয় ও বর্ণগত ভেদাভেদ ছিল না।

ভারতসভার প্রতিষ্ঠা –

1876 খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারতসভা (Indian Association) প্রতিষ্ঠিত হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু ও শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন এই সভার প্রতিষ্ঠাতা।

ভারতসভার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

ভারতসভা প্রতিষ্ঠার কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল। যেমন –

  • দেশে জনমত গঠন করা।
  • রাজনৈতিক স্বার্থ ও লক্ষ্যের ঐক্যকে ভিত্তি করে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করা।
  • হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মৈত্রীর প্রসার ঘটানো।
  • রাজনৈতিক আন্দোলনে অশিক্ষিত জনগণের যোগদানের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।

ভারতসভার প্রতিষ্ঠার শাখা সমিতি –

ভারতসভা কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হলেও এই সভা ছিল সর্বভারতীয়। সেইজন্য এলাহাবাদ, কানপুর, লখনউ, মিরাট, লাহোর প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ শহরে এই সভার শাখা সমিতি গড়ে ওঠে।

ভারতসভার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন –

মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করত ভারতসভা। এই সভা বিভিন্ন স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে। যেমন –

  • আই সি এস পরীক্ষার বয়স সংক্রান্ত আন্দোলন – ব্রিটিশ সরকার আই সি এস পরীক্ষার্থীদের বয়সসীমা 21 থেকে কমিয়ে 19 বছর করেছিল। এর প্রতিবাদে এই সভা আন্দোলন করে। এর ফলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট স্ট্যাটুটারি সিভিল সার্ভিস প্রবর্তন করে।
  • দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইন ও অস্ত্র আইনের বিরোধিতা – লর্ড লিটন দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইন ও অস্ত্র আইন পাস করলে ভারতসভা প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলে। পরে সরকার সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন প্রত্যাহার করে নেয় (1883 খ্রিস্টাব্দ)।
  • ইলবার্ট বিল আন্দোলন – বৈষম্য দূর করে ভারতীয় ও ইউরোপীয় বিচারকদের সমক্ষমতা দান করার জন্য বড়োলাট রিপনের আইনসচিব কোর্টনি ইলবার্ট একটি আইনের খসড়া (Bill) তৈরি করেন। এটি ‘ইলবার্ট বিল’ নামে পরিচিত। ইংরেজরা এর প্রবল প্রতিবাদ করে। ভারতসভা বিলটি সমর্থন করে।

ভারতসভার প্রতিষ্ঠার মূল্যায়ন –

উনিশ শতকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সমিতিগুলির মধ্যে ভারতসভা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সাধারণ ভারতবাসীর স্বার্থে ভারতসভা প্রতিবাদ জানায়। পরে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে উদ্দেশ্য এক হওয়ায় ভারতসভা জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে যায়।

ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান কার্যাবলি বা পদক্ষেপগুলি উল্লেখ করো।

অথবা, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভার প্রতিবাদ আন্দোলনগুলি উল্লেখ করো।

উনিশ শতকে ভারতের প্রেসিডেন্সি শহরগুলিতে একাধিক রাজনৈতিক সভাসমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। 1876 খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারতসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ভারতীয়দের গণ আন্দোলনে শামিল করা।

ভারতসভার প্রধান কার্যাবলি বা পদক্ষেপসমূহ –

সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভার প্রতিবাদ আন্দোলনগুলি হল –

  • আই সি এস পরীক্ষার বয়স সংক্রান্ত আন্দোলন – ব্রিটিশ সরকার আই সি এস পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের বয়সসীমা 21 থেকে কমিয়ে 19 বছর করায় ভারতসভা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করে। এর ফলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট স্ট্যাটুটারি সিভিল সার্ভিস প্রবর্তন করে।
  • সংবাদপত্র আইন সংক্রান্ত আন্দোলন – 1878 খ্রিস্টাব্দে ভারতের বড়োলাট লর্ড লিটন দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন চালু করেন। এর মাধ্যমে তিনি দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে ভারতসভা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলে। পরে সরকার সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন প্রত্যাহার করে নেয়।
  • অস্ত্র আইনের বিরোধিতা – বড়োলাট লর্ড লিটন 1878 খ্রিস্টাব্দে অস্ত্র আইন জারি করে সরকারের অনুমতি ছাড়া ভারতীয়দের কোনো অস্ত্র রাখা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভা এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ জানায়।
  • ইলবার্ট বিল আন্দোলন – লর্ড রিপনের আইনসচিব কোর্টনি ইলবার্ট ‘ইলবার্ট বিল’ নামক একটি আইনের খসড়া তৈরি করেন। এতে বৈষম্য দূর করে ভারতীয় ও ইউরোপীয় বিচারকদের সমক্ষমতা দান করার কথা বলা হয়। এই ঘটনায় অসন্তুষ্ট ইংরেজরা ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে ইলবার্ট বিল সমর্থন করে ভারতসভা এক প্রতি-আন্দোলন গড়ে তোলে।
  • অন্যান্য আন্দোলন – ভারতসভা কৃষকদের স্বার্থ, চা-বাগানের কুলিদের স্বার্থ-সহ ভারতীয়দের বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।

এইভাবে দেশের জনগণকে বৃহত্তর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শামিল করার উদ্দেশ্যে ভারতসভা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

ভারতসভার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কী ভূমিকা ছিল?

অথবা, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কার্যকলাপগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।

উনিশ শতকে ভারতে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্বে যেসকল সংগঠন গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠন ছিল ভারতসভা। 1876 খ্রিস্টাব্দে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রীর উদ্যোগে ভারতসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ভারতসভার প্রাণপুরুষ।

ভারতসভার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা –

ভারতসভার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় গৃহীত পদক্ষেপগুলি ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যথা –

  • জনমত গঠন ও প্রচার – দেশের জনগণকে বৃহত্তর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শামিল করাই ছিল সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। সমগ্র ভারতে ভারতসভার রাজনৈতিক আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সুরেন্দ্রনাথ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সভাসমাবেশের মাধ্যমে জনমত গঠন ও প্রচার প্রভৃতি ছিল তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচির অন্তর্গত।
  • ব্যাপ্তি – ভারতসভার রাজনৈতিক লক্ষ্য ও কর্মসূচি প্রচারের উদ্দেশ্যে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগে সমগ্র বাংলা, লখনউ, মিরাট, লাহোর প্রভৃতি স্থানে ভারতসভার শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
  • প্রতিবাদ আন্দোলন গঠন – ভারতসভা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দেশে শক্তিশালী জনমত গঠন করা। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা’, ‘দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইন’, ‘অস্ত্র আইন’, ‘ইলবার্ট বিল’ প্রভৃতি বিষয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে জনমত গঠন করেন এবং এই সকল বিষয়ে প্রতিবাদ আন্দোলনও গড়ে তোলেন।
  • জাতীয় সভার আয়োজন – সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একনিষ্ঠ উদ্যোগে 1883 খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার কলকাতায় সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন বা অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কনফারেন্স -এর আয়োজন করা হয়। ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলনকে ‘জাতীয় কংগ্রেসের মহড়া’ বলে উল্লেখ করেছেন।
  • জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান – সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভারতসভা সাধারণ ভারতবাসীর স্বার্থে ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। 1885 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে উদ্দেশ্য এক হওয়ায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অনুগামী-সহ জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন। এর ফলে জাতীয় কংগ্রেসের শক্তিবৃদ্ধি ঘটে।

তাই বলা যায়, ভারতসভার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা ছিল নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।

ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে ভারতসভার ভূমিকা আলোচনা করো।

উনিশ শতকে ভারতে যেসব রাজনৈতিক সংগঠনগুলি গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতসভা। 1876 খ্রিস্টাব্দে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারতসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আনন্দমোহন বসু ছিলেন ভারতসভা প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা। ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে ভারতসভার ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে ভারতসভার ভূমিকা –

  • সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান – ভারতসভা ছিল একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রতিষ্ঠানকে সর্বভারতীয় আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
  • বিভিন্ন অঞ্চলে শাখা প্রতিষ্ঠা – বাংলার মফস্সলে ভারতসভার মোট শাখা ছিল 124টি। তা ছাড়া, লখনউ, মিরাট, লাহোর-সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলেও এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
  • সারা ভারতে আদর্শ প্রচার – সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতসভার আদর্শকে প্রচার করার জন্য ঝঞ্ঝার মতো সমগ্র ভারতে ভ্রমণ করেন। তাঁর বাগ্মিতা ও আদর্শে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারতসভার শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। স্যার হেনরি কটন বলেছেন, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ঢাকা থেকে মুলতান পর্যন্ত যুবসমাজের মনে প্রেরণা জোগায়।
  • ইলবার্ট বিল আন্দোলন – সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ভারতসভার ইলবার্ট বিল বিরোধী আন্দোলন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলনের ফলে ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের জাতিগত বিদ্বেষ দারুণভাবে প্রকাশ পায়। ভারতীয়রা উপলব্ধি করে যে, স্বাধীনতা অর্জন না করা পর্যন্ত ভারতে জাতীয় মর্যাদা লাভ করা সম্ভব নয়।
  • অন্যান্য আন্দোলন – ভারতসভার নেতৃত্বে পরিচালিত দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইন, অস্ত্র আইন বিরোধী আন্দোলনগুলির মাধ্যমেও ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটে।

ইলবার্ট বিল – টীকা লেখো।

ইলবার্ট বিল –

ভারতের বড়োেলাট লর্ড রিপনের উদারনৈতিক সংস্কারগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইলবার্ট বিল। লর্ড রিপনের আইনসচিব কোর্টনি ইলবার্ট একটি আইনের খসড়া প্রণয়ন করেন, যা ইলবার্ট বিল নামে পরিচিত হয়।

ইলবার্ট বিলের বিষয়বস্তু –

  1. 1873 খ্রিস্টাব্দের ফৌজদারি আইনবিধি অনুযায়ী ভারতীয় বিচারকরা কোনো ইউরোপীয়দের বিচার করতে পারত না।
  2. বৈষম্য দূর করে ভারতীয় ও ইউরোপীয় বিচারকদের সমক্ষমতা ও মর্যাদা প্রদানের উদ্দেশ্যে লর্ড রিপনের পরামর্শ অনুসারে কোর্টনি ইলবার্ট এই বিল প্রণয়ন করেন।

ইউরোপীয়দের ক্ষোভ ও আন্দোলন –

  1. ইউরোপীয়রা ইলবার্ট বিলের প্রস্তাবে অসন্তুষ্ট হয়। এই বিল তাদের মর্যাদায় প্রবলভাবে আঘাত করে, কারণ তারা মনে করত ভারতীয় বিচারকদের ইউরোপীয়দের বিচার করার কোনো যোগ্যতা নেই।
  2. ফলে ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে ইউরোপীয়রা প্রতিরক্ষা সভা নামক একটি সংগঠনের মাধ্যমে প্রবল আন্দোলন শুরু করে।

ভারতসভার প্রতি-আন্দোলন –

  1. সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভা ইউরোপীয়দের আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতি-আন্দোলন গড়ে তোলে।
  2. ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ইলবার্ট বিলের সমর্থনে আন্দোলনে যোগদান করতে থাকে। বিলের পক্ষে মিটিং-মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।

ইলবার্ট বিলের ফলাফল –

শেষপর্যন্ত সরকার ইউরোপীয়দের কাছে নতিস্বীকার করে এবং প্রস্তাবিত আইনটির বেশ কিছু উদারনৈতিক ধারা সংশোধন করা হয়।ইলবার্ট বিলের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যর্থ হলেও ভারতবাসীর রাজনৈতিক সচেতনতা এসময় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এরপরেই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জাতীয় সম্মেলন আহ্বানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।

ইলবার্ট বিল বিতর্কের গুরুত্ব বর্ণনা করো।

অথবা, ভারতের জাতীয়তাবোধ জাগরণে ইলবার্ট বিলের ভূমিকা কী ছিল?

ভারতের বড়োলাট লর্ড রিপনের শাসনকালে উল্লেখযোগ্য উদারনৈতিক সংস্কারগুলির মধ্যে অন্যতম হল ইলবার্ট বিল প্রণয়ন। বিচারের ক্ষেত্রে ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের মধ্যে বৈষম্য দূর করে সমমর্যাদা ও ক্ষমতা প্রদানের উদ্দেশ্যে লর্ড রিপনের আইনসচিব কোর্টনি ইলবার্ট এই বিলের খসড়া প্রস্তুত করেন। ইলবার্ট বিলকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয়রা প্রবল আন্দোলন শুরু করলে ভারতসভা এই বিলের সমর্থনে প্রতি-আন্দোলন গড়ে তোলে।

ভারতের জাতীয়তাবোধ জাগরণে ইলবার্ট বিলের ভূমিকা –

ইলবার্ট বিলের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যর্থ হলেও ভারতের জাতীয়তাবোধ জাগরণে এর ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।

  • সংঘবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি – ইলবার্ট বিল আন্দোলন থেকে ভারতবাসী উপলব্ধি করে যে, একমাত্র সংঘবদ্ধ আন্দোলনই ব্রিটিশ সরকারের নীতি ও কার্যাবলিকে প্রভাবিত করতে পারে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের একমাত্র উপায় হল সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন।
  • জাতিবিদ্বেষের নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ – ইংরেজরা যে ভারতীয়দের সমমর্যাদা দিতে রাজি নয় তা আবার প্রকাশিত হয়। এর ফলে ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যে জাতিবিদ্বেষ প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
  • ভারতবাসীর নিজস্ব অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি – ইলবার্ট বিলকে কেন্দ্র করে ভারতীয়দের প্রতি ইউরোপীয়দের অবজ্ঞা ও অপমানজনক আচরণ আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে ভারতবাসী নিজেদের অধিকার সম্পর্কে ক্রমশ সচেতন হয়ে ওঠে।
  • জাতীয় সম্মেলন প্রতিষ্ঠার প্রেরণা – ইলবার্ট বিল আন্দোলন ভারতবাসীর রাজনৈতিক সচেতনতা বহুলাংশে বৃদ্ধি করে। ইউরোপীয়দের প্রতিরক্ষা সভা বা ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার প্রত্যুত্তরে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জাতীয় সম্মেলন আহ্বানের প্রয়োজন অনুভব করেন।
  • আন্দোলন পরিচালনায় তহবিল গঠনের প্রয়োজনীয়তা – ইলবার্ট বিল আন্দোলন পরিচালনার জন্য ইংরেজরা প্রায় 1 লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে আন্দোলন পরিচালনা করেছিল। এর থেকে ভারতীয়রা পরবর্তীকালে আন্দোলন পরিচালনায় অর্থ-তহবিল গঠন করে আন্দোলন পরিচালনা করতে শিখেছিল।

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার ইলবার্ট বিল আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন, “ইলবার্ট বিল আন্দোলন ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।”

জমিদার সভা ও ভারতসভার তুলনামূলক আলোচনা করো।

উনিশ শতকে ভারতে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার (1885 খ্রিস্টাব্দ) পূর্বে যেসকল সংগঠন গড়ে উঠেছিল, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জমিদার সভা ও ভারতসভা। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের উদ্দেশ্যে উভয় সংগঠন গড়ে উঠলেও উভয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশ কিছু বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। যেমন –

বিষয়জমিদার সভাভারতসভা
প্রতিষ্ঠা1838 খ্রিস্টাব্দে রাজা রাধাকান্ত দেব, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখের উদ্যোগে জমিদার সভা প্রতিষ্ঠিত হয়।1876 খ্রিস্টাব্দে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আনন্দমোহন বসুর উদ্যোগে ভারতসভা প্রতিষ্ঠিত হয়।
সভাপতি ও সম্পাদকএর সভাপতি ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব এবং সম্পাদক ছিলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর।রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এর প্রথম সভাপতি এবং আনন্দমোহন বসু ছিলেন প্রথম সম্পাদক।
ব্যাপ্তিমূলত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জমিদারদের নিয়ে এই সভা গঠিত হয়েছিল।সমগ্র বাংলা, লখনউ, মিরাট, লাহোর প্রভৃতি স্থানে ভারতসভার শাখা স্থাপিত হয়েছিল।
প্রধান উদ্যোক্তাজমিদার সভার প্রাণপুরুষ ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।ভারতসভার প্রাণপুরুষ ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
লক্ষ্যএটি জমিদার বা ধনী শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল।এর মূল লক্ষ্য ছিল দেশের জনগণকে বৃহত্তর রাজনৈতিক কর্মকান্ডে শামিল করা।
কৃতিত্বএই প্রতিষ্ঠান থেকেই জনসাধারণ সর্বপ্রথম নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দাবিদাওয়া আদায়ে এবং ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি ইংরেজদের সমর্থন লাভে সক্ষম হয়।ভারতসভা ব্রিটিশ সরকারের ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট, অস্ত্র আইন প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এবং 1883 খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার কলকাতায় জাতীয় সভার আয়োজন করেছিল।

হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?

অথবা, উনিশ শতকের বাংলাদেশে জাতীয়তাবোধ বিকাশে হিন্দুমেলার অবদান লেখো।

হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার ভূমিকা –

ভারতীয়দের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে মেলার গুরুত্ব অপরিসীম। চৈত্রমেলা বা হিন্দুমেলা বাঙালির সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বাংলা বছরের শেষদিন অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির দিনে এই মেলা অনুষ্ঠিত হত বলে একে চৈত্রমেলা বলা হত। পরে মেলার আয়োজকগণ চৈত্রমেলার নাম পরিবর্তন করে হিন্দুমেলা নামকরণ করে।

হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার প্রতিষ্ঠা –

1867 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় হিন্দুমেলা শুরু হয়।

হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার প্রতিষ্ঠাতা –

নবগোপাল মিত্র ও রাজনারায়ণ বসু এই হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ঠাকুরবাড়ির সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মেলার আয়োজনে সাহায্য ও সহযোগিতা করেন।

হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য –

বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে এই হিন্দুমেলা চালু করা হয়। উদ্দেশ্যগুলি হল –

  • হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করা।
  • আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তোলা।
  • হস্তশিল্পে উৎসাহদান।
  • সাহিত্যচর্চায় উৎসাহদান।
  • বাঙালির হীনমন্যতা দূর করা।
  • শরীরচর্চায় উৎসাহ দেওয়া প্রভৃতি।
হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?

হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার কার্যাবলি –

ধর্ম ও ইতিহাস বিষয়ক বক্তৃতা, ছাত্রদের ব্যায়াম প্রদর্শনী, মেলা, গানবাজনা, ফল-ফুল প্রদর্শনী, সূচিশিল্প, মাটির জিনিসপত্রের প্রদর্শনী, প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা ইত্যাদি এই মেলায় অনুষ্ঠিত হত। মেলাপ্রাঙ্গণে ফুল-পাতা, বিভিন্ন পতাকা সাজানো থাকত। শোভাযাত্রা করে অনেকে মেলায় আসতেন।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ তে লিখেছেন, ‘আমাদের বাড়ির সাহায্যে হিন্দুমেলা বলিয়া একটি মেলা সৃষ্টি হইয়াছিল।’ নবগোপাল মিত্র মহাশয় এই মেলার কর্মকর্তারূপে নিয়োজিত ছিলেন। ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলিয়া ভক্তির সহিত উপলব্ধির চেষ্টা সেই প্রথম হয়। মেজদাদা সেই সময় বিখ্যাত জাতীয় সংগীত ‘মিলে সব ভারত সন্তান’ রচনা করিয়াছিলেন। এই মেলায় দেশের স্তবগান গীত, দেশানুরাগের কবিতা, দেশীয় শিল্প, ব্যায়াম প্রভৃতি প্রদর্শিত ও দেশী গুণী লোক পুরস্কৃত হইত’।

হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার অবদান –

1867-1880 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মোট 14 বার এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। স্বল্পকালীন হলেও জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে এই মেলার বিশেষ অবদান ছিল।

  • সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘মিলে সব ভারত সন্তান’ গানের মধ্য দিয়ে এই মেলা শুরু হত। এই গান জাতীয় সংগীতের মতো দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলে।
  • বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা সাহিত্যক্ষেত্রে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে।
  • মেলায় হাতে তৈরি জিনিসপত্রের প্রদর্শনী হত। ফলে শিল্পী ও কারিগররা উৎসাহ পায়।
  • মেলার আয়োজকরা ন্যাশনাল পেপারের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের কথা প্রচার করেন।
  • হিন্দুমেলায় জনসমাবেশ ও বক্তৃতা জাতীয় অনুভূতির সৃষ্টি করে।

হিন্দুমেলার সীমাবদ্ধতাগুলি কী ছিল?

অথবা, হিন্দুমেলা কেন জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি?

ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণা জাগরণের ইতিহাসে হিন্দুমেলার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। 1867 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় হিন্দুমেলা শুরু হয়। জাতীয়তাবোধ ও স্বদেশি চেতনায় জনগণকে অনুপ্রাণিত করাই ছিল হিন্দুমেলার প্রধান উদ্দেশ্য। তবে হিন্দুমেলার বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ছিল।

হিন্দুমেলার সীমাবদ্ধতা –

হিন্দুমেলার সীমাবদ্ধতাগুলি হল নিম্নরূপ –

  • হিন্দুধর্মের প্রাধান্য – হিন্দুমেলায় হিন্দুধর্মের অতীত ঐতিহ্য, গৌরবগাথা ও আদর্শকে তুলে ধরা হয়। শুধুমাত্র হিন্দু ভারতের জাগরণের স্বপ্ন এই মেলায় দেখানো হয়। তাই নতুন প্রজন্মের মানুষ এই ভাবধারাকে গ্রহণ করেনি।
  • রাজনৈতিক কার্যাবলির অভাব – হিন্দুমেলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প প্রদর্শনী প্রভৃতির উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করে। দেশাত্মবোধ জাগরণেও তারা সচেষ্ট হয় কিন্তু তারা সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত ছিল।
  • অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি – হিন্দুমেলার প্রতিষ্ঠার কয়েকবছর পর ‘ভারতসভা’-র মতো একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ভারতসভা সক্রিয় রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে এই সময় হিন্দুমেলা দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে।
  • সক্রিয় নেতার অভাব – ভারতসভার নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বা পরবর্তী রাজনৈতিক সংগঠনগুলির সক্রিয় নেতাদের মতো হিন্দুমেলা পরিচালনার ক্ষেত্রে সক্রিয় নেতৃত্বের অভাব ছিল। ফলে হিন্দুমেলার কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশি প্রসারলাভ করতে পারেনি বা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি।

ভারতে জাতীয়তাবোধ বিকাশের কারণগুলি লেখো।

ভারতে জাতীয়তাবোধ বিকাশের ভূমিকা –

বাংলা তথা ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন রকমের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দেখা যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ও শোষণের প্রতিক্রিয়ায় গড়ে ওঠা বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ ইংরেজ শাসনে বিরোধিতা সৃষ্টি করে। ইংরেজ স্বার্থের সঙ্গে ভারতীয় স্বার্থের সংঘাতের ফলশ্রুতিতে এদেশে জাতীয়তাবোধ গড়ে ওঠে।

ভারতে জাতীয়তাবোধ বিকাশের কারণসমূহ –

ভারতে জাতীয়তাবোধ বিকাশের কারণগুলি ছিল –

  • ইংরেজ শাসনের বিরোধিতা – কোম্পানির অতিরিক্ত শোষণ, ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি, কৃষিতে প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব, উপজাতিদের চিরাচরিত অধিকার লোপ প্রভৃতির প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন বিদ্রোহ ঘটে। এই বিদ্রোহগুলির মধ্যে ইংরেজ শাসন ও শোষণবিরোধী উপাদান ছিল।
  • দেশীয় শিল্পের অবক্ষয় – ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার, ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, পরবর্তীকালে অবাধ বাণিজ্যনীতি প্রভৃতি কারণে দেশীয় শিল্পের অবক্ষয় ঘটে। এর ফলে বহু শিল্পী-কারিগর বেকার হয়ে পড়ে। ভারত ইংল্যান্ডের শিল্পপণ্যের বাজারে পরিণত হয়। ইংল্যান্ডের স্বার্থে ভারতের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত -এই ধারণা ভারতবাসীর মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে।
  • জাতিগত বৈষম্য – ভারতীয় ও ইংরেজদের মধ্যে জাতিগত বৈষম্য বেড়ে গিয়েছিল। ইংরেজরা ভারতীয় সিপাহি ও কর্মচারীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত। তারা ভারতীয়দের ঘৃণা করত এবং সামাজিক স্তরে মেলামেশা করত না। কিছু পথ, রেলস্টেশন, রেলকামরা ইউরোপীয়দের জন্য সংরক্ষিত ছিল সেখানে ভারতীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
  • পাশ্চাত্য শিক্ষা – এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু হলে ভারতবাসী পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং গণতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়। বিভিন্ন দাবি আদায়ের জন্য সভাসমিতি গড়ে তোলে।
  • সংবাদপত্র – ইংরেজি ও আঞ্চলিক ভাষায় প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্র সরকারি নীতির সমালোচনা করে এবং দেশবাসীর দুঃখের কথা প্রচার করে। বেঙ্গল গেজেট, সম্বাদ কৌমুদী, সংবাদ ভাস্কর, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, অমৃতবাজার, কেশরী, হিন্দু প্রভৃতি পত্রিকা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
  • সাহিত্য – উপন্যাস, কাব্য, নাটক, প্রবন্ধ দেশবাসীর মনে স্বদেশপ্রেমের বাণী পৌঁছে দেয়। দেশবাসীর মধ্যে আশা-আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে।

ভারতে জাতীয়তাবোধ বিকাশের মূল্যায়ন –

উপরোক্ত কারণগুলি ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থাও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ একে অন্যকে চিনতে ও বুঝতে পারে। প্রাদেশিকতার সীমা ছাড়িয়ে ভারতবাসীর মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে। এভাবে ভারতে জাতীয়তাবোধের জন্ম হয়।

উনিশ শতকে ভারতের জাতীয়তাবাদী চেতনার ইউরোপীয় প্রেক্ষিত বর্ণনা করো।

জাতীয়তাবাদী চেতনার ইউরোপীয় প্রেক্ষিত –

উনিশ শতকে ব্রিটিশ সরকারের নানা প্রতিক্রিয়াশীল ও দমনমূলক আইন ভারতীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে, তা থেকেই ভারতীয় জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে। ইউরোপ ও বহির্বিশ্বের নানা ঘটনাবলিও ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে প্রভাবিত করেছিল। যথা –

  • আমেরিকার বিপ্লব – 1775 খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার 13টি উপনিবেশ ইংল্যান্ডের অধীনতাপাশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ভারতীয়দের উজ্জীবিত করেছিল।
  • ফরাসি বিপ্লব – 1789 খ্রিস্টাব্দে সাধারণ জনগণের বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের বদলে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শ ভারতবাসীকে জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত করেছিল।
  • ইটালির ঐক্য আন্দোলন – ইটালির ঐক্য আন্দোলনের তিন নেতা জোসেফ ম্যাৎসিনি, কাভুর ও গ্যারিবল্ডির চেষ্টায় 1870 খ্রিস্টাব্দে ইটালির ঐক্য সম্পূর্ণ হয়। ম্যাৎসিনির আদর্শ, কাভুরের দূরদর্শিতা এবং গ্যারিবল্ডির বীরত্ব ভারতবাসীকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
  • জার্মানির ঐক্য আন্দোলন – বিসমার্ক তাঁর বিখ্যাত ‘রক্ত ও লৌহ নীতি’ দ্বারা জার্মানির ঐক্যস্থাপনে সচেষ্ট হন। বিসমার্ক -এর এই প্রচেষ্টা ভারতের জাতীয়তাবোধের সূচনাকে প্রভাবিত করেছিল।
  • রাশিয়ার নিহিলিস্ট আন্দোলন – রাশিয়ার নিহিলিস্ট আন্দোলনও ভারতীয়দের চেতনা জাগ্রত করতে সাহায্য করেছিল।
  • পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার – ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে ইউরোপীয় ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন প্রভৃতির সঙ্গে ভারতীয়রা পরিচিত হয়। ফলে তাদের মধ্যে যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি উচ্চ আদর্শের সঞ্চার ঘটে। বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে, উনিশ শতকে ইউরোপীয় আন্দোলনের ধারা থেকেই ভারতীয় জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে।

ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

ভারতীয় জাতীয়তাবোধের ভূমিকা –

উনিশ শতকের বাংলা তথা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার, ইউরোপের সাহিত্য, দর্শন, গণতন্ত্র, উদারনীতিবাদ এদেশের শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। কিছু মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। ভারতবাসী নিজেদের একই ঐক্যসূত্রে বাঁধে। এইভাবে জাতীয়তাবোধের বিকাশ হয়।

ভারতীয় জাতীয়তাবোধ –

একদল লোক যখন দীর্ঘদিন ধরে বংশানুক্রমিকভাবে, ঐতিহ্য বা পরম্পরাকে বজায় রেখে স্থায়ীভাবে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাস করে, তখন তাদের বলে জাতি। আর ওই জাতির মধ্যে যখন ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সচেতন রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে, তখন তাকে বলে জাতীয়তাবোধ। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এভাবেই জাতীয়তাবোধের সঞ্চার হয়। এ ব্যাপারে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘আনন্দমঠ’ গ্রন্থের অবদান অনস্বীকার্য। একে ‘স্বাদেশিকতার বাইবেল’ বা ‘গীতা’ বলা হয়।

ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বৈশিষ্ট্যসমূহ –

ভারতীয়দের মধ্যে জাগ্রত জাতীয়তাবোধের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।

  • জাতীয়তা – ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক সাহিত্য, কাব্য, উপন্যাস এবং প্রবন্ধে জাতীয়তার কথা প্রচার করা হয়। জাতীয় ভাব তুলে ধরা হয়। এজন্য দেশের যুবসমাজের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল।
  • মুক্তির বার্তা – এ যুগের বিভিন্ন লেখায়, সাহিত্যে পরাধীনতার মর্মবেদনা ফুটে ওঠে। স্বাধীনতার আকুতি মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে। বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে দেশের পরাধীনতা থেকে মুক্তির পথ দেখানো হয়।
  • ঐক্যভাব – সাহিত্যের বিষয়বস্তুর মাধ্যমে দেশবাসীর মধ্যে ঐক্যভাব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। দেশবাসী পরস্পরের দুঃখে সমব্যথী হয়ে ওঠে। সমকালীন চিত্রশিল্পেও তার প্রতিফলন ঘটে।
  • নীতিবোধ – জাতীয়তাবাদী সাহিত্যে নৈতিক আদর্শের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। ভারতের চিরাচরিত ধর্মীয় ঐতিহ্য ও নীতিবোধের প্রতিফলন ঘটে সাহিত্যে। এ ছাড়া দেশপ্রেম ও স্বাদেশিকতার বাণী প্রচারিত হয়। ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা সমস্ত কিছুর মধ্যেই মূর্ত হয়ে ওঠে। ভারতবাসীর সমস্ত দুঃখযন্ত্রণার মূল কারণ হল ব্রিটিশ শাসন -এই ধারণা ভারতবাসীর মনে বদ্ধমূল হয়ে ওঠে।

ভারতীয় জাতীয়তাবোধের মূল্যায়ন –

উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি ভারতের উদীয়মান জাতীয়তাবোধের মধ্যে লক্ষ করা যায়। এই জাতীয়তাবোধ অন্যান্য উপাদানের প্রভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠে প্রায় জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়। ভারত ও ভারতবাসী একটি ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হয়। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়।

আনন্দমঠ উপন্যাসটি কীভাবে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিস্তারে সহায়তা করেছিল?

আনন্দমঠ উপন্যাসের ভূমিকা –

ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ বিকাশে বিভিন্ন মনীষীদের লেখার অবদান উল্লেখযোগ্য। মনীষীরা তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও প্রসার ঘটিয়েছিলেন। মনীষীদের এইসব লেখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা দেশাত্মবোধক উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’।

আনন্দমঠ উপন্যাসের রচনা ও প্রকাশ –

  • রচনা – ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের রচয়িতা হলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
  • প্রকাশ – ‘আনন্দমঠ’ প্রথম প্রকাশিত হয় 1882 খ্রিস্টাব্দের 15 ডিসেম্বর।

আনন্দমঠ উপন্যাসের পটভূমি –

‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের পটভূমি হল অষ্টাদশ শতকের সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ও ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। আনন্দমঠে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মর্মস্পর্শী বর্ণনা আছে। এই উপন্যাসের মূল সুর হল দেশাত্মবোধ এবং পরাধীন মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য সন্তানদের প্রবল প্রচেষ্টা।

আনন্দমঠ উপন্যাসের সন্তান দল –

বাংলায় মুসলিম রাজশক্তির পতন ও ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা এক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে। এই সংকটকালে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশমাতার মুক্তির জন্য সন্তান দলের আবির্ভাব ঘটে। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের মূল চরিত্রই সন্তান দল। তাদের আদর্শ অনুসরণ করে দেশের যুবসমাজকে দেশমাতার পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানান বঙ্কিমচন্দ্র।

আনন্দমঠের মূল বিষয় –

আনন্দমঠ উপন্যাসে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একদল আত্মত্যাগী সন্ন্যাসীর কার্যাবলির বিবরণ আছে। এই উপন্যাসে সত্যানন্দের আহ্বানের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধ জাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র পরাধীন দেশমাতার লাঞ্ছিত রূপ তুলে ধরেছেন। তিনি দেশমাতার উদ্ধারের জন্য আত্মবলিদানে প্রস্তুত একদল মাতৃভক্ত সন্তানের কথা বলে যুবসম্প্রদায়কে দেশপ্রেম ও সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন।

আনন্দমঠের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতের চরমপন্থী ও বিপ্লবীরা দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে তাঁকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করার কাজে ব্রতী হন।

আনন্দমঠ উপন্যাসের বন্দেমাতরম –

বন্দেমাতরম গান ও স্লোগানটি ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত। ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রসারে বন্দেমাতরম -এর অবদান অপরিসীম। 1896 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বন্দেমাতরম গানটি গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন।

আনন্দমঠ উপন্যাসের মূল্যায়ন –

ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ ও তাঁর বন্দেমাতরম গানটির অবদান অপরিসীম। অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত আনন্দমঠের স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রকৃত জনক’ বলে অভিহিত করেছেন (The real father of Indian Nationalism)।

আনন্দমঠ উপন্যাসে মাতৃরূপিণী দেশকে কীভাবে বর্ণনা করা হয়েছে?

ভারতে জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে এই উপন্যাস এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।

আনন্দমঠ উপন্যাসে মাতৃরূপিণী দেশের বর্ণনা –

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি 1882 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের মূল চরিত্র সন্তান দলের আদর্শে ভারতীয় যুবসমাজকে দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানান বঙ্কিমচন্দ্র। দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে তার তিনটি রূপ উপন্যাসটিতে তুলে ধরা হয়েছে। ছকের মাধ্যমে তা তুলে ধরা হল –

মাতৃরূপে দেশমা যা ছিলেনমা যা হয়েছেনমা যা হবেন
উদ্ধৃতি“এক অপরূপ সর্বাঙ্গসম্পন্না সর্ব্বাভরণভূষিতা জগদ্ধাত্রী মূর্তি”।“অন্ধকারসমাচ্ছন্না কালিমাময়ী, হৃত সর্ব্বস্বা”।“দশভূজ দশদিকে প্রসারিত – তাঁর হাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত, পদতলে শত্রু বিমদিত”।

আনন্দমঠ উপন্যাসে মাতৃরূপিণী দেশের গুরুত্ব –

  • দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেশপ্রেমের এক নতুন ধারণা প্রদান করেন। 
  • ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একদল আত্মত্যাগী সন্ন্যাসীর কার্যাবলির বিবরণ আছে, যা পরবর্তীকালে বিপ্লবী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা জোগায়।
  • দেশপ্রেম ও সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের আদর্শে ভারতবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
  • বঙ্কিমচন্দ্র বিশ্বাস করতেন যে, দেশের স্বাধীনতা আসবে সত্যানন্দের মতো ত্যাগমন্ত্রে দীক্ষিত নেতার নেতৃত্বে ও সন্তান দলের সংগ্রামের মাধ্যমে নরমপন্থী আদর্শ বা আবেদন-নিবেদন নীতির মাধ্যমে নয়।

পরিশেষে বলা যায়, ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের গুরুত্ব অপরিসীম।

জাতীয়তাবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটির ভূমিকা লেখো।

জাতীয়তাবোধ বিকাশের ভূমিকা –

প্রথম ইংরেজ শাসন বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়। আর বিভিন্ন উপাদানের প্রভাবে বাংলাতেই প্রথম জাতীয়তাবোধের স্ফুরণ ঘটে। ইংরেজ শাসনের বিরোধিতা, দেশের মুক্তিচিন্তা, দেশবাসীর অনৈক্য ও দুঃখযন্ত্রণা এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। এ যুগে আবির্ভূত কয়েকজন মনীষী তাঁদের রচনার মাধ্যমে দেশবাসীর মর্মবেদনা ফুটিয়ে তোলেন। তাঁরা দেশ ও দেশবাসীর মুক্তির পথ দেখান।

জাতীয়তাবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে বর্তমান ভারত –

জাতীয়তাবোধ জাগরণের ক্ষেত্রে বহু মনীষীর লেখা গ্রন্থের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ‘বর্তমান ভারত’ (1905 খ্রিঃ) গ্রন্থটি ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

  • বিষয়বস্তু – সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে রাজশক্তির বর্ণনা, ভারতের সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্ম ও রামকৃষ্ণের বাণী, ভারতীয় জীবনাদর্শ -এই গ্রন্থের মূল বিষয়। বৈদিক যুগ থেকে বর্তমানকাল, ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য থেকে শূদ্র জাগরণ পর্যন্ত ভারতীয় সমাজের রূপরেখা এই গ্রন্থে চিত্রিত হয়েছে।
  • জাতীয়তাবাদ – স্বামী বিবেকানন্দ সমগ্র দেশবাসীকে অখণ্ডরূপে দেখেছিলেন। সামাজিক ভেদাভেদ ভুলে সমগ্র দেশবাসীর প্রতি তিনি বলেন, “হে ভারত, ভুলিও না, তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত। ভুলিও না নীচ জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই।”
  • মুক্তির বাণী – তিনি দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করেন। দেশের মুক্তির জন্য আত্মবলিদানের আদর্শ তুলে ধরে তিনি সবাইকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।
  • দেশ গঠনের আহ্বান – স্বামী বিবেকানন্দ বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত ভারতবর্ষকে নতুনভাবে গঠন করার জন্য যুবসমাজের প্রতি আহ্বান জানান। পাশ্চাত্য প্রদেশগুলির কর্মচঞ্চলতা, গতিময় জীবন তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি তাই ভারতবাসীকেও কর্মময় জীবনে লিপ্ত হওয়ার পরামর্শ দেন। এজন্য দেশের যুবসমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি অভীঃ এবং উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত মন্ত্রের কথা বলেন। তিনি সব দেবদেবীকে বাদ দিয়ে একমাত্র ভারতমাতাকে আরাধ্যা দেবী করতে বলেন। তিনি আরও বলেন, ‘গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলার দ্বারা স্বর্গের কাছাকাছি যাওয়া যায়’। তিনি চেয়েছিলেন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, প্রাচীন ও আধুনিক ভারতীয় জীবনধারার সমন্বয়ে সমস্ত ভারতবাসীকে নিয়ে গড়ে উঠুক এক নতুন ভারত।

জাতীয়তাবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটির অবদান –

বিদেশি ইংরেজ শাসনে নির্যাতিত, শোষিত, হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত ভারতবাসীকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি যে বাণী দেন, তা পরবর্তীকালের বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রেরণা জোগায়। তাঁর বাণী হতাশ ভারতীয়দের রক্তে মাদকতার সঞ্চার করে। ভারতবাসীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে। এজন্য আর জি প্রধান তাঁকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক’ বলে অভিহিত করেছেন।

‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থের বিষয়বস্তু উল্লেখ করো।

‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থের ভূমিকা –

বর্তমান ভারত গ্রন্থের রচয়িতা হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। এটি 1899 খ্রিস্টাব্দে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় প্রবন্ধাকারে এবং 1905 খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে-বৈদিক পুরোহিতের শক্তি, রাজা ও প্রজার শক্তি, বৌদ্ধ বিপ্লব, বৈশ্য শক্তির অভ্যুদয়, শূদ্র জাগরণ, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সংঘর্ষ, স্বদেশমন্ত্র-সহ অনেক বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থের বিষয়বস্তু –

  • ভারতের ইতিহাস – ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে স্বামী বিবেকানন্দ বৈদিক যুগ থেকে সমকালীন সময় পর্যন্ত ভারতের ইতিহাস ব্যাখ্যা করেছেন। এই গ্রন্থে ‘বৈদিক পুরোহিতের শক্তি’ দিয়ে শুরু করে ক্রমান্বয়ে ‘রাজা ও প্রজার শক্তি’, ‘স্বায়ত্তশাসন’, ‘বৌদ্ধ বিপ্লব’ ও ‘তাহার ফল’, ‘ক্ষত্রিয় শক্তি’, ‘বৈশ্য শক্তি’, ‘শূদ্র জাগরণ’ ও ‘স্বদেশমন্ত্র’ আলোচিত হয়েছে।
  • শূদ্র জাগরণ – এই গ্রন্থে স্বামী বিবেকানন্দ ভারতে শূদ্র জাগরণের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তিনি বলেছেন – এমন এক সময় আসবে যখন ‘সর্বদেশের শূদ্রেরা সমাজে একাধিপত্য লাভ করিবে’।
  • ভ্রাতৃত্ববোধ – স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে ভারতীয়দের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের সঞ্চার করতে চেয়েছেন। তিনি সামাজিক ভেদাভেদ ভুলে সমগ্র দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলেছেন। তাঁর কথায় – “ভুলিও না নীচ জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর, তোমার রক্ত, তোমার ভাই।”
  • জাতীয়তাবোধ – স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর গ্রন্থে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ বিকাশের কথা বলেছেন। তিনি ভারতীয়দের ‘পরাণুবাদ’, ‘পরাণুকরণ’, ‘দাসসুলভ দুর্বলতা’ থেকে মুক্ত হতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বীরভোগ্যা স্বাধীনতা’ -অর্থাৎ বীরের ক্ষমতা অর্জন করে স্বাধীনতা অর্জন কর।

‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থের উপসংহার –

‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে স্বামী বিবেকানন্দ যুবসমাজ ও দেশ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর এই বাণী ছিল পরবর্তীকালের বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎসস্থল। তাই যথার্থভাবেই তাঁকে ‘ভারতীয় জাতায়তাবাদের জনক’ বলে অভিহিত করা হয়।

ভারতীয় যুবজাগরণে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান কী ছিল?

উনিশ শতকের ভারতীয় নবজাগরণের এবং জাতীয় জাগরণের প্রতীক ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর আদর্শে ভারতীয় যুবসম্প্রদায় ফিরে পেয়েছিল তাদের হৃত চেতনা ও আত্মবিশ্বাস। তাই স্বামীজি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন যে, “ভারতবর্ষকে যদি তুমি জানতে চাও তাহলে বিবেকানন্দকে পড়তে ও জানতে হবে।”

ভারতীয় যুবজাগরণে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান –

ভারতীয় যুবশক্তির জাগরণে স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।

  • নবভারত গঠনে যুবসমাজকে আহ্বান – স্বামীজি ছিলেন যুবসমাজের অনুপ্রেরণা। তিনি বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত ভারতবর্ষকে নতুনভাবে গঠন করার জন্য যুবসমাজের প্রতি আহ্বান জানান।
  • চরিত্রগঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ – ভারতবর্ষের যুবশক্তির জাগরণে স্বামী বিবেকানন্দ বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন চরিত্রগঠনের উপর। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, যুবসমাজের সঠিক চরিত্রগঠনই দেশের সার্বিক মুক্তিলাভের অন্যতম উপায়।
  • শরীরচর্চার উপর গুরুত্ব প্রদান – স্বামীজি বিশ্বাস করতেন, নবভারত গঠনের স্বপ্ন একমাত্র দেশের তরুণ প্রাণোচ্ছল যুবসমাজের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হতে পারে। আর এর জন্য প্রয়োজন সুস্বাস্থ্য গঠন ও শরীরচর্চা। তাই তিনি বলেছিলেন, “গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলা ভালো”।
  • স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষা ও মানবমুক্তি – দেশের যুবসম্প্রদায়ের জাগরণই ভারতবর্ষের পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনে একমাত্র সহায়ক বলে স্বামী বিবেকানন্দ মনে করতেন। তাই তিনি ‘অভীঃ’ এবং ‘উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত মন্ত্র’ -এর কথা বলেন। সকল দেবদেবীকে বাদ দিয়ে তিনি একমাত্র ভারতমাতাকে আরাধ্যা দেবী করার উপর গুরুত্ব প্রদান করেন।

স্বামী বিবেকানন্দের বাণী দেশের যুবসমাজকে এক নতুন পথের সন্ধান দেয়। পরবর্তীকালে তাঁর উপদেশ ও বাণী ভারতবর্ষের বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চলার পথের পাথেয়রূপে পরিণত হয়।

‘গোরা’ উপন্যাসে কীভাবে জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে সেই বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

গোরা উপন্যাসের ভূমিকা –

যেসব মনীষীদের লেখায় ভারতীয় জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাস। ‘গোরা’ উপন্যাসে তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরার বক্তব্য ও কার্যকলাপের মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে গঠনমূলক ও সমন্বয়বাদী জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন।

গোরা উপন্যাসের রচনা ও প্রকাশ –

  • ‘গোরা’ উপন্যাসটি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
  • ‘গোরা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় 1910 খ্রিস্টাব্দে।

গোরা উপন্যাসের পটভূমি –

বিশ শতকের প্রথম দশকে বাংলা রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে অর্থাৎ শুরু হয় বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জাতীয় স্তরে শুরু হয় উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিরোধী ছিলেন। বিংশ শতকের এই প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ গোরা উপন্যাসটি রচনা করেন।

গোরা উপন্যাসের মূল বিষয় –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সময় এক আইরিশ যুদ্ধে মারা যান। তার আসন্নপ্রসবা স্ত্রী ব্রাহ্মণ কৃষ্ণদয়ালের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি এক পুত্রসন্তান প্রসব করেই মারা যান। এই ছেলেটির নাম গোরা। কৃষ্ণদয়ালবাবুর নিঃসন্তান স্ত্রী আনন্দময়ী নিজের সন্তানের মতো লালনপালন করেন তাকে। তার পরিচয় গোপন ছিল বলে গোরা নিজেকে ব্রাহ্মণ সন্তান বলেই জানত।

গোরা উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য –

এই উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

  • জাতীয়তাবোধ – বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের মানসলোকের প্রতীকী চরিত্র হল গোরা। জাতীয়তাবোধের বিকাশে বহু উপন্যাসের মধ্যে ‘গোরা’ উপন্যাসটি বিশিষ্টতার দাবি রাখে।
  • বিরোধ-সমন্বয় – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই উপন্যাসে সমকালীন যুগজীবনের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন। এক দ্বন্দ্ব ও তা থেকে উত্তীর্ণ এক সামগ্রিক পরিমণ্ডল এখানে চিত্রিত হয়েছে। এই উপন্যাসে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের, সমাজের সঙ্গে ধর্মের, ধর্মের সঙ্গে মানবসত্যের বিরোধ ও সমন্বয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্য, অভাব ও দারিদ্র্যের সমাধানের ইঙ্গিতও রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন।
  • মধ্যবিত্ত মানসিকতা – এই উপন্যাসে শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের মানসিকতা ফুটে উঠেছে। একটি সময়ের (স্বদেশি আন্দোলনের সময়) সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবধারা, বিক্ষোভ-আন্দোলন, দেশাত্মবোধের প্রথম স্ফুরণের চাঞ্চল্য, ধর্ম, ভাবাবেগ স্থান পেয়েছে। বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠা, অনুসন্ধানী মনোভাব, কৌতূহল ও মানবতাবোধ ফুটে উঠেছে।
  • সংকীর্ণতা – আইরিশ যুবক গোরা হিন্দু পরিবারে লালিতপালিত হয়ে নিজের বিদেশি সত্তা ভুলে গিয়ে বাঙালি হয়ে যায়। কিন্তু বাঙালি মেয়ে তাকে মেনে নিতে পারেনি বা গোরাকে বাঙালি বলে মনে করেনি। সমাজের অন্দরে বাসা বাঁধা এই সংকীর্ণতা গোরা উপন্যাসে ফুটে উঠেছে।
  • অখন্ডতা – রবীন্দ্রনাথের চেতনায় ভারতের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ অখণ্ডভাবে ব্যক্ত হয়েছে। একটি জাতির সামগ্রিক পরিচয় গোরা চরিত্রের মধ্য দিয়ে চিত্রিত হয়েছে।

গোরা উপন্যাসের মন্তব্য –

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ উপন্যাসের মাধ্যমে ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক দিকনির্দেশ করেছেন। তাঁর নির্দেশিত পথ উগ্রতার নয়, বিভেদের নয় – সেবা, ভক্তি ও সমন্বয়ের।

উনিশ শতকে জাতীয়তাবাদের উন্মেষে ‘ভারতমাতা’ চিত্রটির কীরূপ ভূমিকা ছিল?

অথবা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতমাতা চিত্রের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
অথবা, ভারতীয় জাতীয়তাবোধ বিকাশে ‘ভারতমাতা’ চিত্রটির গুরুত্ব বিশ্লেষণ করো।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতমাতা চিত্রের ভূমিকা –

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। তাঁর আঁকা বিখ্যাত চিত্র হল ভারতমাতা। ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ বিকাশে ভারতমাতা চিত্রের গুরুত্ব অপরিসীম।

ভারতীয় জাতীয়তাবোধ বিকাশে ‘ভারতমাতা’ চিত্রের গুরুত্ব/ভূমিকা –

  • মায়ের ধারণা ও জাতীয়তাবাদ – ভারতমাতা চিত্রটি হল গৈরিক বসন পরিহিতা একাধারে এক দেবী ও মানবী। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই চিত্রে মায়ের ধারণার সঙ্গে জাতীয়তাবাদকে যুক্ত করেন।
  • ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রকাশ – ভারতমাতা তাঁর চারটি হাতে ধরে আছেন ধানের গোছা, শুভ্রবস্ত্র, পুথি ও জপমালা। তাঁর পায়ের চারপাশে আছে সাদা পদ্মফুল। এগুলি সবই হল ভারতীয় ঐতিহ্যের ধারক, বাহক ও প্রতীকস্বরূপ।
  • সমৃদ্ধ ভারতের প্রকাশ – ভারতমাতা চিত্রটির মাধ্যমে সমৃদ্ধ ভারতের চিত্র তুলে ধরা হয়। ধনধান্যসমৃদ্ধ শস্যশ্যামলা ভারত স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার পাশাপাশি ভারত আধ্যাত্মশক্তি ও নারীশক্তিতেও বলীয়ান।
  • ভারতবর্ষের প্রতীক – ভারতমাতা চিত্রটি ছিল ভারতবর্ষের প্রতীক। এই চিত্রটি ভারতের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে ভারতমাতা চিত্রটি জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার করে।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতমাতা চিত্রের উপসংহার –

স্বদেশি যুগে বিভিন্ন সভাসমাবেশে ভারতমাতা চিত্রটি সাজানো থাকত। ভগিনী নিবেদিতা ‘ভারতমাতা’ চিত্রটির ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন যে, এই চিত্রটির মাধ্যমে বিমূর্ত জাতীয়তাবাদ মূর্ত হয়ে উঠেছে।

‘ভারতমাতা’ চিত্রে কীভাবে জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অথবা, ভারতমাতা – টীকা লেখো।

ভারতমাতার চিত্রের ভূমিকা –

ব্রিটিশ-শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষে চিত্রশিল্পীগণ চিত্রের মাধ্যমেও ভারতীয় জাতীয়তাবোধ ফুটিয়ে তুলেছেন। ভারতীয় জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিকারী চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি। জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারতমাতা’ চিত্রটির মাধ্যমে বিশ শতকে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটান। চিত্রে ‘ভারতমাতা’ হলেন ভারতবর্ষের প্রতীক।

'ভারতমাতা' চিত্রে কীভাবে জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ভারতমাতার চিত্রকর –

‘ভারতমাতা’ চিত্রের চিত্রকর হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ভারতমাতার অঙ্কনকাল –

1902 খ্রিস্টাব্দে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বঙ্গমাতা’ চিত্র অঙ্কন করেন। পরে ভারতের স্বদেশি আন্দোলনের আবহে 1905 খ্রিস্টাব্দে তা ‘ভারতমাতা’ রূপে খ্যাতি লাভ করে।

ভারতমাতার চিত্রের বর্ণনা ও বিশ্লেষণ –

ভারতমাতা হলেন গৈরিক বসন পরিহিতা এক দেবী। ভারতমাতার চারটি হাত। তিনি চারটি হাতে ধরে আছেন ধানের গোছা, সাদা কাপড়, পুথি ও জপমালা। তিনি সবুজ পৃথিবীর উপর দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর পায়ের কাছে চারটি পদ্মফুল এবং পিছনে নীল আকাশ।

‘ভারতমাতা’ ভারতবর্ষের প্রতীক। তিনি তাঁর সন্তানদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও দীক্ষা প্রদান করেন। ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকালে জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার করে।

ভারতমাতার চিত্রের উপসংহার –

ভগিনী নিবেদিতা ‘ভারতমাতা’-র ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন যে, এই চিত্রটির মাধ্যমে বিমূর্ত জাতীয়তাবাদকে মূর্ত করে তোলা হয়েছে।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্র সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা –

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের একজন সদস্য। তিনি বঙ্গীয় ঘরানার একজন চিত্রকর ও ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাঁকে ‘আধুনিক চিত্রশিল্পের পথিকৃৎ’ বলা হয়।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অঙ্কনশিক্ষা –

1881 খ্রিস্টাব্দে 14 বছর বয়সে গগনেন্দ্রনাথের বাবা মারা যান। ফলে তাঁর স্কুলশিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি নিজের ইচ্ছেমতো ছবি আঁকা শেখেন।

তিনি হরিনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জলরঙে ছবি আঁকা শেখেন। পরে জাপানি শিল্পীদের দ্বারা (ওকাকুরা ও তাইকোয়ান) প্রভাবিত হন। তিনি তাঁর শিল্পে আধুনিকতাবাদী চিত্ররীতির পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহাসিক পার্থ মিত্রের মতে, 1940 -এর দশকের আগে আমাদের দেশে গগনেন্দ্রনাথই ছিলেন একমাত্র শিল্পী যিনি পাশ্চাত্যের চিত্ররীতি কিউবিজম্ -এর ভাষা ও নির্মাণশৈলীকে তাঁর ছবিতে কাজে লাগান। তবে তিনি কখনোই ইউরোপীয় রীতির অন্ধ অনুকরণ করেননি।

গগনেন্দ্রনাথের অঙ্কিত চিত্র –

গগনেন্দ্রনাথ তৎকালীন ভারতীয় ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে নানা ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন করেন। তিনি চিত্রের মাধ্যমে সমাজের নানা বিষয় তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তিনি ঔপনিবেশিক সমাজের তীব্র সমালোচনা করেছেন ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে। তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলি — ‘অদ্ভুতলোক’, ‘বিরূপ বজ্র’ (1917 খ্রিঃ) এবং ‘নব হুল্লোড় (1921 খ্রিঃ) প্রকাশিত হয়।

তাঁর ব্যঙ্গচিত্র সম্ভারকে দক্ষতায় ও মৌলিকতায় অতুলনীয় বলে শিল্প সমালোচকগণ মন্তব্য করেছেন। তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলির মধ্যে প্রধান হল –

  • চৌষট হাজার – মন্ত্রীদের প্রাপ্য বেতন নিয়ে অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্র।
  • মন্টেগু – চেমসফোর্ড শাসনসংস্কারের সমালোচনা করে অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্র – ‘State Funeral of H.E. Old Bengal’।
  • ঔপনিবেশিক ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্র। এতে তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে কলকারখানার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
  • বহু ভারতীয়ের মেকি দেশাত্মবোধকে ব্যঙ্গ করে অঙ্কিত চিত্র।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্র সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

গগনেন্দ্রনাথ তাঁর শিল্পকলার মাধ্যমে সমাজের নানান বিষয়কে তুলে ধরেছিলেন। ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিয়ু’ -তে তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলি ছাপা হত। শুধু বাংলার নয়, সমগ্র ভারতের ব্যঙ্গচিত্রের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহে জনগণের অংশগ্রহণ সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।

ভূমিকা: 1857 খ্রিস্টাব্দের অভ্যুত্থান সূচিত হয়েছিল সিপাহিদের দ্বারা। কিন্তু এই বিদ্রোহ শুধু সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জনগণ সক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।

মহাবিদ্রোহে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ: দিল্লি, লখনউ, অযোধ্যা প্রভৃতি অঞ্চলে যুদ্ধ দীর্ঘদিন চলে। জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ফলে এই বিদ্রোহ গণবিদ্রোহের রূপ নেয়।

প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের নমুনা:

  • দিল্লি, লখনউ, বেরিলির জনগণ তাদের বল্লম, টাঙ্গি, ছুরি, দা, কাস্তে প্রভৃতি নিয়ে বিদ্রোহী সিপাহিদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং কোম্পানির অনুগত সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
  • দিল্লি, অযোধ্যা, কানপুর, লখনউ সমেত প্রায় গোটা উত্তর ও মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাস্তাঘাট নষ্ট করে কোম্পানির সেনাবাহিনীর রসদপত্র সরবরাহের কাজে বাধা দেওয়া হয়।
  • গ্রামাঞ্চলে সুদখোর মহাজন ও নতুন জমিদারদের বাড়িঘর ও কাছারি লুঠ করা হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় ডাকাতরাও সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল।

মহাবিদ্রোহে জনগণের পরোক্ষ অংশগ্রহণ: 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহে জনগণ নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল।

  • স্থানীয় ভৃত্য, পরিচারক ও আয়া (বৃদ্ধা পরিচারিকা)রা তাদের কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়ে ইংরেজদের বিপদে ফেলেছিল।
  • বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণ ইংরেজদের কাছে বিদ্রোহী সিপাহিদের গতিবিধি সম্পর্কে খবরাখবর গোপন রাখত।
  • উপজাতি অঞ্চলের পুরুষ ও মহিলারা নানাভাবে বিদ্রোহীদের সাহায্য করত।

উপসংহার: এভাবে দেখা যায় যে, বিদ্রোহী সিপাহিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জনগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিদ্রোহে শামিল হয়ে বিদ্রোহের চরিত্রকেই বদলে দিয়েছিল।

1857-র বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলা যায় কি?

ভূমিকা: 1857-র বিদ্রোহের সর্বভারতীয় চরিত্র না থাকলেও উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে এই বিদ্রোহ জাতীয়রূপ গ্রহণ করেছিল। ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন যথার্থই বলেছেন, ধর্মনাশের বিরুদ্ধে ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হলেও তা জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধরূপে সমাপ্ত হয়।

পক্ষে যুক্তি:

  • পূর্ববর্তী বিদ্রোহগুলির তুলনায় 1857-র বিদ্রোহের ব্যাপকতা ও গণসমর্থন ছিল অভূতপূর্ব। পূর্ববর্তী বিদ্রোহগুলিতে এত স্বতঃস্ফূর্ত গণসমর্থন ছিল না।
  • দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ছিলেন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্যের প্রতীক। তাই ধর্মীয় ভাবাবেগ দিয়ে বিদ্রোহ শুরু হলেও পরবর্তীতে তা স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয়।
  • আবুল কালাম আজাদের মতে, আধুনিক জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞায় বিচার করলে একে জাতীয় আন্দোলন বলা না গেলেও বিদ্রোহীদের দেশপ্রেমের খামতি ছিল না।
  • জে. বি. নর্টনের মতে, এই বিদ্রোহ আচমকা ঘটেনি, এর পেছনে স্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল। বলা হয়ে থাকে যে, সাহায্যের আশায় দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ পারস্যের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন।
  • জাতীয়তাবাদ বলতে আমরা যাই বুঝি না কেন, বিদেশি শাসন থেকে মুক্তিলাভের জন্য গড়ে ওঠা গণঅভ্যুত্থানকে জাতীয় সংগ্রাম বলা যেতেই পারে।
  • ঐতিহাসিক কে. এম. পানিক্কর-এর মতে, 1857-র বিদ্রোহের নেতারা যদি নিজ নিজ অঞ্চলের স্বাধীনতার কথা চিন্তাই করে থাকতেন, তথাপি তারা যে জাতীয় সংগ্রামই করেছিলেন তা অস্বীকার করা যায় না।

বিপক্ষে যুক্তি: 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলা যায় না, কারণ –

  • বিদ্রোহীদের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, পরিকল্পনা বা সংগঠন ছিল না।
  • ঐক্য বা বোঝাপড়া কেবলমাত্র সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
  • সিপাহিদের সঙ্গে বিদ্রোহী নেতাদের তেমন যোগাযোগ ছিল না।
  • বিদ্রোহের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও নেতাদের মধ্যে লক্ষ্য ও আদর্শের ফারাক ছিল। জাতীয় স্বার্থে বিদ্রোহ পরিচালিত হয়নি।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, একটি দেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশের সমস্ত মানুষ অংশ নেবে এ কথা আশা করা যায় না। এই বিদ্রোহে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ যোগদান করেছিল, তাই একে জাতীয় বিদ্রোহ বলা হয়ে থাকে। তা ছাড়া, বিদ্রোহীদের মধ্যে জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা হয়তো ছিল না, কিন্তু জাতীয়তাবোধ ছিল।

1857-র অভ্যুত্থানকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা যায় কি?

ভূমিকা: 1857-র অভ্যুত্থানের মতো এত ব্যাপক ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলন ভারতে ইতিপূর্বে আর কোনোদিন ঘটেনি। দেশের মুক্তির জন্য কৃষক, কারিগর ও অন্যান্য সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। তাই প্রখ্যাত বিপ্লবী বি. ডি. সাভারকর এই অভ্যুত্থানকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলেছেন। ঐতিহাসিক হীরেন মুখোপাধ্যায় ও অধ্যাপক সুশোভন সরকার এই বিদ্রোহকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম বলেছেন।

পক্ষে যুক্তি: 1857 খ্রিস্টাব্দের অভ্যুত্থানকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম রূপে অভিহিত করার যুক্তিগুলি হল—

  • ইংরেজ কোম্পানির দীর্ঘকালের শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ ছিল ভারতবর্ষের বুকে জনগণের জ্বলন্ত প্রতিবাদ।
  • বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে চেয়েছিল—এর চেয়ে মহান লক্ষ্য আর কী হতে পারে?
  • 1857-র বিদ্রোহ সমগ্র ভারতে হয়নি ও এর কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা বা উদ্দেশ্য ছিল না। তবুও অধিকাংশ ভারতীয়ই মনেপ্রাণে ইংরেজদের বিতাড়ন চেয়েছিল। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক একসঙ্গে লড়েছিল এবং দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট ঘোষণা করেছিল।
  • ইংরেজ-বিরোধী এত ব্যাপক আন্দোলন ভারতে আর হয়নি। তাই গতানুগতিক বিচার না করে এই অভ্যুত্থানকে স্বাধীনতার সংগ্রাম বলাই যুক্তিযুক্ত।

বিপক্ষে যুক্তি: ডাঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার ও সুরেন্দ্রনাথ সেন 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেননি, কারণ—

  • এই সংগ্রাম জাতীয় সংগ্রাম নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামও নয়। তাঁদের মতে, ভারতের কিছু অঞ্চলে এই বিদ্রোহ সীমাবদ্ধ ছিল; কাজেই এই সংগ্রামকে সারা ভারতের সংগ্রাম বলা যায় না।
  • এই বিদ্রোহ ছিল সিপাহিদের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ, যা জাতীয় বিদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে না।
  • অধিকাংশ সামন্তরাজ ও জমিদার ইংরেজ কোম্পানির প্রতি অনুগত ছিল এবং বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল。
  • বিদ্রোহীদের মধ্যে সকলের স্বাধীনতা লাভের লক্ষ্য ছিল না। পৃথক পৃথক উদ্দেশ্য সিদ্ধির লক্ষ্যে বিদ্রোহ হয়েছিল।
  • শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ ও সমসাময়িক বাংলার পত্রপত্রিকাগুলিও বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল।
  • তখন বিদ্রোহীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের চেতনা ছিল না, অর্থাৎ সেই সময় জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়নি।

উপসংহার: আসলে এই বিদ্রোহ কোনো বিশেষ একটি মত দিয়ে বিশ্লেষণ করলে এর সঠিক চরিত্র বোঝা যাবে না। তাই কোনো একটি বিশেষ মত যেমন পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি আবার ভিত্তিহীন নয়। প্রত্যেক মতামতের পেছনে কিছু না কিছু সত্য লুকিয়ে আছে।

সিপাহিবিদ্রোহের বা মহাবিদ্রোহের বিস্তার বর্ণনা করো।

ভূমিকা: 29 মার্চ 1857 খ্রিস্টাব্দে ব্যারাকপুরে বিদ্রোহের সূচনা হলেও 10 মে মীরাটে এই বিদ্রোহ প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে এবং ধীরে ধীরে সমগ্র উত্তর ও মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

মীরাট: 1857 খ্রিস্টাব্দের 10 মে বিদ্রোহী সিপাহিরা এক ইংরেজ সেনাধ্যক্ষকে হত্যা করে এবং জেলখানা ভেঙে তাদের শাস্তিপ্রাপ্ত সহকর্মীদের মুক্ত করে।

দিল্লি: 1857 খ্রিস্টাব্দের 11 মে বিদ্রাহী সিপাহিরা জোরপূর্বক দিল্লিতে প্রবেশ করে এবং মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে হিন্দুস্থানের সম্রাট বলে ঘোষণা করে। দিল্লিতে নির্বিচারে ইউরোপীয় নিধন শুরু হয়। স্ত্রী-পুরুষ-শিশু কেউই বিদ্রোহীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি পুরোদমে লুঠতরাজও চলেছিল।

অযোধ্যা: অযোধ্যায় বিদ্রোহ তীব্র রূপ ধারণ করে। অযোধ্যার নবাব বন্দি থাকার কারণে তাঁর বেগম হজরত মহল বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। অযোধ্যা ও রোহিলখণ্ডের ভূমিচ্যুত তালুকদারদের সঙ্গে কৃষকরাও বিদ্রোহে শামিল হয়। মৌলবি আহমদ উল্লাহ-এর নেতৃত্বে এখানে বিদ্রোহ পরিচালিত হয়েছিল। বিদ্রোহীরা অযোধ্যা শহরকে প্রায় ছয় মাস নিজেদের দখলে রেখেছিল।

কানপুর: কানপুরে বিদ্রোহীরা কয়েকদিনের জন্য হলেও কানপুরকে বিদেশি কবলমুক্ত করেছিল। এখানে বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে ছিলেন নানাসাহেব ও তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী তাঁতিয়া টোপী।

ঝাঁসি: ঝাঁসি বলতে মধ্যভারতকে বোঝায়। এখানে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ। তাঁতিয়া টোপীও রানি লক্ষ্মীবাঈ-এর সঙ্গে যোগ দিয়ে ব্রিটিশদের অনুগত সিন্ধিয়া-র কাছ থেকে গোয়ালিয়র দুর্গটি দখল করে নেন।

বিহার: বিহারের সাহাবাদ, গয়া, আরা (জগদীশপুর)-তে ভূমিচ্যুত জমিদার কুনওয়ার সিংহের নেতৃত্বে বিদ্রোহ পরিচালিত হয়েছিল। রাঁচির সর্বস্তরের জনগণ ও ছোটোনাগপুরের আদিবাসীরাও এই বিদ্রোহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়।

উপসংহার: এভাবে দেখা যায় যে, সিপাহি বিদ্রোহ গোটা উত্তর ও মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। যদিও বাংলায় এর কোনো প্রভাব ছিল না। দক্ষিণ ভারতেও বিদ্রোহের কোনো তাপ-উত্তাপ ছিল না।

মহাবিদ্রোহ ও জাতীয়তাবোধ – টীকা লেখো।

1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সময় ভারতে জাতীয়তাবাদের আদর্শ গড়ে ওঠেনি। তবে এ কথা ঠিক যে সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতবাসীর মনে ব্রিটিশ-বিরোধী মানসিকতা তৈরি হয়েছিল, যাকে কার্ল মার্কস অজ্ঞাত ও অচেতন হাতিয়ার (unconscious tool of history in learning about the revolution.) বলেছেন।

জাতীয়তাবোধের স্বরূপ: মহাবিদ্রোহের একটি বিশেষ দিক ছিল হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। পরবর্তীকালে জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যেখানে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়গতভাবে আড়াআড়ি হয়ে গিয়েছিল, সেখানে মহাবিদ্রোহে হিন্দু-মুসলিম একযোগে একটি নির্দিষ্ট ভাবাবেগ দ্বারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে শামিল হয়েছিল। হয়তো জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা ছিল না, কিন্তু জাতীয়তাবোধ ছিল। আধুনিক শিক্ষা না থাকায় বিদ্রোহীরা গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র কথাটি চয়ন করতে পারেনি। কিন্তু তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ বিতাড়ন। জাতীয় ভাবাবেগ ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না। আবুল কালাম আজাদও বিদ্রোহীদের দেশপ্রেমের প্রশংসা করেছেন।

ভারতে জাতীয়তাবোধের উদ্ভবে মহাবিদ্রোহ: ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবাদী সংগ্রামীরা মহাবিদ্রোহ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার মনে করেন ভারতের জাতীয়তাবোধ উন্মেষে 1857 খ্রিস্টাব্দের অভ্যুত্থান কিছুটা প্রভাব ফেলেছিল। অধ্যাপক রজতকান্ত রায় এই বিষয়ে সহমত পোষণ করেছেন। যতই দিন যাচ্ছিল ততই এই বিদ্রোহের স্মৃতি ভয়ানক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল।

মূল্যায়ন: মহাবিদ্রোহের পরবর্তীকালে ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধী উগ্রমতের উদ্ভব ঘটে। ভারতীয়রা ব্রিটিশ শাসকের বৈষম্যমূলক দিকগুলি সম্পর্কে সচেতন হয় এবং স্বাধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল হয়। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটতে থাকে।

ঊনবিংশ শতককে সভাসমিতির যুগ বলা হয় কেন?

ভূমিকা: ঊনবিংশ শতকে ভারতের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, ভারতীয় জাতীয় চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ। ভারতবাসীর জাতীয়তাবোধ থেকেই সূচনা হয় সভাসমিতি গঠনের প্রয়াস। পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে উনিশ শতকে বাংলা তথা গোটা ভারতে বেশ কিছু রাজনৈতিক সভা ও সমিতি গড়ে ওঠে। তাই কেমব্রিজ ঐতিহাসিক ডঃ অনিল শীল উনিশ শতককে সভাসমিতির যুগ (Age of Association) বলে উল্লেখ করেছেন।

উক্ত সময়কালের সভাসমিতি: উনিশ শতকে যেসব সভাসমিতি গড়ে উঠেছিল সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—

  • বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা (1836 খ্রি.)
  • জমিদার সভা (1838 খ্রি.)
  • ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (1839 খ্রি.)
  • বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (1843 খ্রি.)
  • ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (1851 খ্রি.)
  • হিন্দুমেলা (1868 খ্রি.)
  • ইন্ডিয়ান লিগ (1875)
  • ভারত সভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (1876 খ্রি.) প্রভৃতি।

গুরুত্ব: এভাবে জনমত প্রকাশের জন্য সভাসমিতি গঠনের আয়োজন শুরু হয়েছিল। এর গুরুত্বগুলি হল—

  • দেশের স্বার্থরক্ষা ও সরকারের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য সভাসমিতিগুলি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল।
  • ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রসারে ও ব্রিটিশ-বিরোধী জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এইসব সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
  • সভাসমিতির চূড়ান্ত পরিণতি ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা।

উপসংহার: ঐতিহাসিক অনিল শীল তাঁর The Emergence of Indian Nationalism গ্রন্থে লিখেছেন, “সমিতির মাধ্যমেই ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারত আধুনিক রাজনীতির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে” (Associations brought 19th century Indian across the threshold of modern politics)। তবে সমালোচকদের মতে, এই সমিতিগুলিকে গণতান্ত্রিক চরিত্র দিতে জমিদার শ্রেণি আগ্রহী ছিলেন না।f modern politics)। তবে সমালোচকদের মতে, এই সমিতিগুলিকে গণতান্ত্রিক চরিত্র দিতে জমিদার শ্রেণি আগ্রহী ছিলেন না।

জমিদার সভা বা ল্যান্ড হোল্ডারস্ সোসাইটি (1838 খ্রি.) – টীকা লেখো।

ভূমিকা – 1838 খ্রিস্টাব্দের 12 নভেম্বর রাধাকান্ত দেব, দ্বারকানাথ ঠাকুর ও প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের মিলিত প্রচেষ্টায় জমিদার সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন রাধাকান্ত দেব। এবং যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন প্রসন্ন কুমার ঠাকুর এবং ডব্লিউ সি. হারি।

উদ্দেশ্য – জমিদার সভার উদ্দেশ্যগুলি হল –

  • জমিদার ও প্রজাদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করা।
  • ভারতবাসীর রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের চেষ্টা করা।
  • নিষ্কর জমির ওপর করভার প্রত্যাহার করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা।
  • ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শাখা স্থাপন এবং বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন।

সদস্য সংখ্যা – এই প্রতিষ্ঠানের কার্য নির্বাহক সমিতির সকল সদস্য প্রতিষ্ঠিত জমিদার হলেও সংগঠনের ঘোষণাপত্রে বলা হয় যে, জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে ভারতের মাটির সঙ্গে স্বার্থযুক্ত সকল ভারতবাসীই এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য হতে পারেন।

রাজনৈতিক তাৎপর্য – জমিদার সভা প্রতিষ্ঠার তাৎপর্যগুলি হল –

  • জমিদার সভাই সর্বপ্রথম ভারতবাসীকে স্বাধীনভাবে মতামত জানাবার পথ দেখিয়েছিল।
  • ভারতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সহানুভূতিশীল ইংরেজদের সমর্থন ও সহযোগিতা লাভে সমিতি সক্ষম হয়।
  • এই সমিতির দাবি মেনে নিয়ে ব্রিটিশ সরকার প্রতি গ্রামে কিছু নিষ্কর জমি রাখতে সম্মত হয়। তাই রাজেন্দ্রলাল মিত্র যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, জমিদার সভা ছিল জাতীয় আন্দোলনের অগ্রদূত।

উপসংহার – পরিশেষে বলা যায় যে, এই প্রতিষ্ঠান থেকেই ভারতবাসী সর্বপ্রথম নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দাবি-দাওয়া আদায়ের শিক্ষালাভ করে। তাই ভারতের জাতীয়তাবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে জমিদার সভার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের রাজনৈতিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

জমিদার সভা ও বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (20 এপ্রিল 1843 খ্রি.) একত্রিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (29 অক্টোবর 1851 খ্রি.)। রাধাকান্ত দেব এর প্রথম সভাপতি এবং দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রথম সম্পাদক ছিলেন। এটি ছিল একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান। বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই এই সংগঠনের জন্ম হয়। হিন্দু পেট্রিয়ট ছিল এই সংগঠনের মুখপাত্র, যার সম্পাদক ছিলেন কৃষ্ণদাস পাল।

দাবিদাওয়া – ভারতবাসীর মুখপাত্ররূপে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান বহু বছর ধরে শিক্ষা, শাসন সংস্কার, বিচারব্যবস্থা, নীলচাষ প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে দেশে আন্দোলন গড়ে তোলে। এই প্রতিষ্ঠানের দাবিদাওয়াগুলির মধ্যে ছিল – সরকারি উচ্চপদে অধিক সংখ্যক ভারতীয়দের নিয়োগ, শাসন পরিষদ ও আইন পরিষদের পৃথক্করণ, ব্রিটিশ শাসিত উপনিবেশগুলির আদর্শে ভারতে একটি স্বতন্ত্র ব্যবস্থা পরিষদ গঠন এবং সেই পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধি গ্রহণ, ভারতবাসীর সম্পদের সুরক্ষা প্রদান প্রভৃতি।

প্রসার – মাদ্রাজ ও অযোধ্যায় এই সমিতির শাখা স্থাপিত হয়। এই সংগঠনের আদলে দাদাভাই নৌরজীর উদ্যোগে বোম্বাই-এ বোম্বাই অ্যাসোসিয়েশন (1852 খ্রি.), পুনায় ডেকান অ্যাসোসিয়েশন (1852 খ্রি.) এবং মাদ্রাজে মাদ্রাজ নেটিভ অ্যাসোসিয়েশন (1852 খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়।

উপসংহার – পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতবাসীর অধিকার আদায়ের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটির অবদান উল্লেখযোগ্য। ইংরেজ সরকার এই সংগঠনের মতামতকে অনেকক্ষেত্রে গুরুত্ব দিত। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণ এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় এর সর্বভারতীয় চরিত্রটি চোখে পড়ে। তবে ধনী ও জমিদার শ্রেণির মুখপাত্র হওয়ায় এবং গ্রামাঞ্চলে এই সমিতির প্রভাব না থাকায় এই সংগঠন বিশেষ সফলতা পায়নি।

হিন্দুমেলা (1867 খ্রি.) – টীকা লেখো।

ভূমিকা – শ্রী অরবিন্দের মাতামহ রাজনারায়ণ বসু ও নবগোপাল মিত্র 1867 খ্রিস্টাব্দে হিন্দুমেলা গঠন করেন। এই সংগঠনের সদস্যগণ হিন্দু ছিলেন বলে একে হিন্দুমেলা বলা হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি চৈত্রমেলা নামেও পরিচিত। 1870 খ্রিস্টাব্দের আগে এটি জাতীয়মেলা নামে পরিচিত ছিল এবং 1870 খ্রিস্টাব্দে এর নামকরণ হয় হিন্দুমেলা।

কর্মসূচি – এই সংগঠনের কর্মসূচির আওতায় ছিল প্রদর্শনী, লাঠি-তরোয়াল খেলা, দেশাত্মবোধক সংগীত, বক্তৃতা প্রভৃতি। এই সকল কর্মসূচির মাধ্যমেই ভারতে জাতীয়তাবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করা হয়।

উদ্দেশ্য – হিন্দুমেলার উদ্দেশ্যগুলি হল –

  • স্বদেশি ভাবধারায় দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করা, অর্থাৎ জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় শিল্প ও জাতীয় গৌরব বৃদ্ধি করা।
  • হিন্দু জাতীয়তার আদর্শে ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা।

চৈত্রমেলা নামকরণ – 1867 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1880 খ্রি. পর্যন্ত প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে এই বাৎসরিক মেলা অনুষ্ঠিত হত এবং এখানে বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের নানাভাবে সম্মানিত করা হত। তাই এই মেলা চৈত্রমেলা নামেও খ্যাত।

বৈশিষ্ট্য – হিন্দুমেলার বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

  • এই প্রতিষ্ঠানটির সকল সদস্যই হিন্দু ছিলেন।
  • হিন্দু জাতীয়তার আদর্শে ভারতবাসীর মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করার চেষ্টা করা হয়।
  • এই মেলায় স্বরচিত কবিতা, সংগীত পরিবেশিত হত।

উপসংহার – পরিশেষে বলা যায়, ভারতে জাতীয়তাবোধ জাগরণে হিন্দুমেলার অবদান অস্বীকার করা যায় না। প্রাক্-কংগ্রেস পর্বে এই সংগঠনটি যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। তাই জাতীয়তাবোধ প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিপ্লবী নেতা বিপিনচন্দ্র পাল যথার্থই মন্তব্য করেছেন, “নবগোপাল মিত্রের কাছেই আমরা প্রথম জাতীয়তাবাদের প্রেরণা পেয়েছিলাম।

ভারত সভার উদ্দেশ্য আলোচনা করো।

ভূমিকা – 1876 খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অপরাপর কয়েকজন মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর সহায়তায় ভারত সভা গঠিত হয়। এই সভা গঠনকালে এর চারটি উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। এই উদ্দেশ্যগুলি হল –

  1. জনমত গঠন – ব্রিটিশ সরকারের শাসন, শোষণ এবং পক্ষপাতমূলক আইনের প্রতিবাদের মাধ্যমে ব্রিটিশ-বিরোধী জনমত গঠন ও ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা করা।
  2. রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন – বিভিন্ন ভাষা, গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন করে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা।
  3. হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি – হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপন ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে জোরদার করা।
  4. জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটানো – সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, বিশেষত নিম্নবর্গীয় মানুষদের জাতীয় আন্দোলনে শামিল করার মধ্য দিয়ে তাদের মনে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করা।

উপসংহার – ভারতের জাতীয়তাবাদের উন্মেষে ভারত সভার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। উপরিউক্ত উদ্দেশ্যগুলির মাধ্যমেই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতসভাকে গণমুখী সর্বভারতীয় চরিত্র দিতে পেরেছিলেন। এই উদ্দেশ্যগুলিকে সামনে রেখেই তিনি ভারতবাসীর স্বার্থে নানা আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন।

ইলবার্ট বিল বিতর্কের গুরুত্ব বর্ণনা করো।

অথবা, ভারতের জাতীয়তাবোধ জাগরণে ইলবার্ট বিলের ভূমিকা কী ছিল?

ভূমিকা – ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় ভারতীয় ও ইউরোপীয় বিচারকদের সমান ক্ষমতা প্রদান করে লর্ড রিপনের আইন সচিব স্যার কাউর্টনি পারগ্রিন ইলবার্ট যে আইনের খসড়া তৈরি করেন, সেটিকে বলা হয় ইলবার্ট বিল। কিন্তু এই বিলের পক্ষে ও বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। শ্বেতাঙ্গরা এই বিলের বিপক্ষে ছিল।

গুরুত্ব – ইলবার্ট বিল সংক্রান্ত ঘটনা প্রবাহ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সহায়ক হয়েছিল –

  • ব্রিটিশ শাসনের বৈষম্যমূলক চরিত্র সম্পর্কে ভারতীয়দের ধারণা স্পষ্ট হয়।
  • শিক্ষিত ভারতবাসীর ইংরেজ শাসনের প্রতি মোহ কমতে থাকে।
  • ইংরেজ জাতি ভারতবাসীকে যে ঘৃণা বা অবজ্ঞার চোখে দেখে, তা ইলবার্ট বিল বিরোধী আন্দোলন থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
  • ভারতবাসী এই ধারণায় উন্নীত হয় যে, তার নিজ অধিকার নিজেকেই অর্জন করতে হবে।
  • অমৃতবাজার পত্রিকা ও বেঙ্গলি পত্রিকা ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ভারত সভার ভূমিকাও কম ছিল না।
  • ইলবার্ট বিল বিতর্ক থেকে ভারতীয়রা উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, ভারতের স্বাধীনতা ভিন্ন ভারতবাসীর মর্যাদা ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত নয়। ভারতবাসীকে নিজ অধিকার নিজেকেই অর্জন করতে হবে এবং সংঘবদ্ধ আন্দোলন দ্বারাই তা সম্ভব।

উপসংহার – ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার যথার্থই বলেছেন, ভারতের রাজনৈতিক অগ্রগতিতে ইলবার্ট বিলের মুখ্য ভূমিকা ছিল। (“The Ilbert Bill greatly helped the cause of Indian Political Advocate.”) ঐতিহাসিক এস. গোপাল তাঁর The Viceroyalty of Lord Ripon গ্রন্থে ইলবার্ট বিল আন্দোলনকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঊষাকাল বলেছেন।viceroyaltry of Lord Ripon গ্রন্থে ইলবার্ট বিল আন্দোলনকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঊষাকাল বলেছেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ জাতীয়তাবাদী চেতনা উন্মেষে কতটা কার্যকর ছিল?

ভূমিকা – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর রচনাবলির মধ্যে অমর কীর্তি হল আনন্দমঠ উপন্যাস। 1882 খ্রিস্টাব্দে এটি প্রকাশিত হয়। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি ও জীববোধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্বদেশ প্রীতি।

জাতীয়তাবাদী চেতনায় আনন্দমঠ – ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষে আনন্দমঠ ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ এক জাতীয়তাবাদী উপন্যাস; কারণ —

  • স্বদেশ প্রেম – বঙ্কিমচন্দ্র রচিত আনন্দমঠ উপন্যাস জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে দেশবাসীর মনে স্বাদেশিকতা ও সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ধারণা সঞ্চারিত করেছিল। স্বদেশপ্রেম যে শ্রেষ্ঠধর্ম, এ কথা আনন্দমঠ উপন্যাসের সন্তানদলের মুখে উচ্চারিত হয়েছিল।
  • বন্দেমাতরম্ সংগীত – আনন্দমঠ উপন্যাসের বন্দেমাতরম্ সংগীতটি (1875 খ্রি.) ছিল পরাধীন ভারতের প্রধান জাতীয় সংগীত বিপ্লবীদের মন্ত্র। জন্মভূমিকে মাতৃরূপে কল্পনা করা এই সংগীতের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য। এই গানে বঙ্কিমচন্দ্র দেশকে ভৌগোলিক সত্তারূপে বিচার না করে একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্ররূপে দেখেছেন।
  • দেশমাতার আদর্শ – আনন্দমঠে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, দেশমাতা হলেন মা, দেশপ্রেম হল ধর্ম, দেশসেবা হল পূজা।
  • স্ববিরোধিতা – আনন্দমঠে বঙ্কিমচন্দ্র সচেতনভাবে জানিয়েছেন যে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব, ডাকাতি, দস্যুবৃত্তি হল অমঙ্গলের নামান্তর, কারণ ইংরেজ রাজত্বে সনাতন সামস্ত সমাজ অটুট থাকবে। সুতরাং ইংরাজি রাজ্যে প্রজা সুখী হইবে ও নিষ্কণ্টকে ধর্মাচরণ করিবে। যদিও এটি ছিল বিভ্রান্তিকর মন্তব্য।

উপসংহার – বাঙালির জাতীয়তা গঠন ও দেশের যুব সম্প্রদায়কে স্বদেশভক্তি, ত্যাগ ও সেবাধর্মে উদ্‌বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যেই রচিত হয়েছিল আনন্দমঠ। আনন্দমঠের অবদান বাঙালি জাতির জাতীয় জীবন গঠনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

ভারতে জাতীয়তাবাদ উন্মেষে বিবেকানন্দের বর্তমান ভারত – এর অবদান কী ছিল?

ভূমিকা – বিবেকানন্দ প্রকাশ্য রাজনীতি না করলেও তাঁর বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ ভাবধারার সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদী নবভারত গঠনের আদর্শ প্রচার করেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে বর্তমান ভারত প্রবন্ধটি উল্লেখযোগ্য, যা ভারতের জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়ক হয়েছিল।

জাতীয়তাবাদ উন্মেষে বর্তমান ভারতের ভূমিকা –

স্বদেশ চেতনা – বর্তমান ভারতে দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, “ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের মৃত্তিকা আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী বল ভাই ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ।” এই উক্তির মাধ্যমে বিবেকানন্দ স্বদেশ চেতনা ও দেশপ্রেম জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন।

সামাজিক সংহতি – সমাজের অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ প্রথা নিরসনের জন্য বিবেকানন্দ (বর্তমান ভারতে) বলেছেন, “ভুলিও না নীচ জাতি, মুর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি-মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই।” বিবেকানন্দের এই তেজোদীপ্ত বাণী বিপ্লবীদের অন্তরে গভীর প্রেরণা সৃষ্টি করেছিল।

দেশের জন্য আত্মত্যাগের আহ্বান – বর্তমান ভারতে প্রকাশ পেয়েছে, “হে ভারত-ভুলিও না — তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত, ভুলিও না- তোমার সমাজ যে বিরাট মহামায়ার ছায়ামাত্র। হে বীর, সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বল — আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই।”

উপসংহার – বিবেকানন্দ বর্তমান ভারতে দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে তার মুক্তির জন্য আত্মোৎসর্গের আদর্শ তুলে ধরেছিলেন — তাতে উচ্চনীচ, ধনী-নির্ধন কেউই বাদ পড়েনি। তাঁর প্রেরণাতেই দেশপ্রেম ধর্মের বিকল্প হয়ে উঠেছিল। তাঁর আদর্শ ও চিন্তাধারার ছাপ পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলনে ছাপ ফেলেছিল।

রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাস – এ কীভাবে জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠেছে বর্ণনা করো।

ভূমিকা – বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সে আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল বাঙালি ও ভারতীয় জীবনধারার সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন করা। শুধুমাত্র বিদেশি শাসক শক্তির বিরুদ্ধে নিস্ফল উত্তেজনা সৃষ্টি নয়।

প্রেক্ষাপট – কিন্তু অল্পকালের মধ্যে জাতীয় জীবনের সর্বাঙ্গীন বিকাশ এবং স্বাদেশিক আন্দোলন হঠাৎ রাজনৈতিক দলাদলি, উগ্রজাতীয়তাবাদ এবং হিন্দুয়ানির ছদ্মবেশ নেয়। এভাবে সাম্প্রদায়িক মনোভাব উগ্র হয়ে জাতির শুভবুদ্ধিকে গ্রাস করে নেয়। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশপ্রেমের স্থলে উগ্র জাতীয়তাবাদ সমর্থন করেননি। শাসকের বিরুদ্ধে গুপ্ত অভিযানের রক্তাক্ত পরিণাম কোনোদিন মেনে নিতে পারেননি। এই প্রেক্ষাপটেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেন গোরা উপন্যাস।

গোরা ও জাতীয়তাবাদ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত গোরা (1910 খ্রি.) সমগ্র আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যেরই একটি যুগান্তকারী উপন্যাস। ইউরোপের Epic Novel-এর সঙ্গে তা তুলনীয়। ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ভারতের শাশ্বত জীবনোপলব্ধির বার্তা ঘোষণা করে গোরা উপন্যাসটি। 1857 তে সিপাহি বিদ্রোহের সময় জন্মেছিল গোরা। কৃষ্ণদয়াল বাবুর পুত্র হলেও সে ছিল আইরিশ সন্তান। কিন্তু গোরা জানত সে হিন্দু। গোরা প্রবলতর কণ্ঠে একটি কথাই ঘোষণা করতে চাইত ভারতবর্ষ হিন্দুর দেশ। হিন্দুর আচার-আচরণ নিষ্ঠা ভরে পালন করাই দেশ হিতৈষিতা। একটা সময় পর্যন্ত গোরাকে উগ্র জাতীয়তাবাদী বলেই মনে হয়েছে।


আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় “সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” এর “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।

আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।

ধন্যবাদ সবাইকে।

Please Share This Article

Related Posts

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

About The Author

Rohit Mondal

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

মেঘাচ্ছন্নতা বলতে কী বোঝো? মেঘ কীভাবে সৃষ্টি হয়?

শিশির ও শিশিরাঙ্ক কাকে বলে?