মাধ্যমিক ইতিহাস – সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

Solution Wbbse

আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় “সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” এর থেকে “ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

মাধ্যমিক ইতিহাস - সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ - ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন
Contents Show

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো।

অথবা, সংক্ষেপে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র বিশ্লেষণ করো।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ভূমিকা –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে সিপাহি ছাড়াও কৃষক, সাধারণ মানুষ, জমিদার, অভিজাত, রাজা-রানিরাও অংশগ্রহণ করে। এই ঘটনাকে তাই কেউ সিপাহি বিদ্রোহ, কেউ সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া, আবার কেউ কেউ জাতীয় সংগ্রাম বলেছেন। ভারত ইতিহাসে এই বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি নির্ণয় তাই একটি বিতর্কিত বিষয়।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি –

নিছক সিপাহি বিদ্রোহ –

ঐতিহাসিক চার্লস রেইকস, হোমস, কিশোরীচাঁদ মিত্র, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ম্যালেসন, সৈয়দ আহমদ, রজনীকান্ত গুপ্ত প্রমুখ 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে নিছক সিপাহি বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। এই বক্তব্যের পক্ষে তাঁদের যুক্তি ছিল –

  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চালিকাশক্তি ছিল সিপাহিরা। তাদের অসন্তোষ থেকেই বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল।
  • এই বিদ্রোহে ভারতীয় জাতীয় চেতনার অগ্রদূত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি যোগদান করেনি।
  • ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজন্যবর্গ এই বিদ্রোহকে সমর্থন করে। তবে অনেকে শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে এই বিদ্রোহে যোগদান করেছিল।

সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া –

বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে কিছু ঐতিহাসিক বলেছেন, 1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনা ছিল সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া বা সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন, রজনীপাম দত্ত প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে একমত। লর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতির ফলে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, পেশোয়ার দত্তকপুত্র নানাসাহেব তাঁদের রাজ্য হারান। সাতারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। কুশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা রাজ্য ইংরেজরা দখল করে। নতুন ভূমিব্যবস্থায় এখানকার তালুকদাররা জমি হারায়। ফলে রাজ্যহারা রাজা-রানি, জমি হারানো তালুকদার ও কৃষক, চাকরি হারানো সৈনিকের দল- সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তারা 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে অংশ নেয়। রজনীপাম দত্ত, পি সি যোশি এবং তালমিজ খালদুন -এর মতে, ‘1857 খ্রিস্টাব্দের ঘটনা ছিল জমি হস্তান্তর ও শ্রেণিসংঘাতের প্রতিক্রিয়ার ফল’। কারণ – দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, রানি লক্ষ্মীবাঈ বা নানাসাহেব এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাঁদের পুরোনো পদমর্যাদা ফিরে পেতে চেয়েছিলেন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার -এর মতে, এই বিদ্রোহ ছিল ক্ষয়িষ্ণু অভিজাততন্ত্র ও মৃতপ্রায় সামন্তদের ‘মৃত্যুকালীন আর্তনাদ’।

গণবিদ্রোহ –

উত্তর ও মধ্য ভারতে সিপাহিদের সঙ্গে স্থানীয় সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এই বিদ্রোহকে গণবিদ্রোহের রূপ দিয়েছিল। মজফ্ফরনগর, সাহারানপুর, অযোধ্যা, কানপুর, ঝাঁসি প্রভৃতি অঞ্চলে গণবিস্ফোরণ ঘটে। বিহারের পশ্চিম দিকে ও পাটনার বহু জেলায় সাধারণ মানুষ সিপাহিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে। তাই ঐতিহাসিক জন কে, সি এ বেইলি প্রমুখ এই বিদ্রোহের গণচরিত্র লক্ষ করে একে ‘গণবিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেছেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো।

জাতীয় সংগ্রাম –

ইংল্যান্ডের টোরি দলের নেতা ডিসরেলি-সহ সমকালীন বিভিন্ন ইংরেজ ঐতিহাসিক, যেমন – নর্টন, ডাফ, আউট্রাম, হোমস, চার্লস বল প্রমুখ এই বিদ্রোহকে ‘জাতীয় সংগ্রাম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁদের মতে –

  • ভারতীয় সিপাহিরা এই বিদ্রোহ শুরু করলেও পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন স্থানের মানুষ এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল। বিশেষত অযোধ্যা, রোহিলাখণ্ড ও বিহারের জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিদ্রোহে যোগদান করে।
  • ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, নানাসাহেব, কুনওয়ার সিং প্রমুখ রাজন্যবর্গ, বহু জমিদার ও তালুকদার এই বিদ্রোহে যোগদান করে।
  • বিদ্রোহীরা দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ‘ভারতের সম্রাট’ বলে ঘোষণা করে বিদেশি প্রভাবমুক্ত এক দেশীয় শাসনব্যবস্থা স্থাপনে উদ্যোগী হয়। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলসও এই বিদ্রোহকে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ আখ্যা দিয়েছেন।

ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম –

স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনায়ক দামোদর সাভারকর 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু ঐতিহাসিকরা অনেকে এই মত স্বীকার করেননি। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ‘1857 খ্রিস্টাব্দের তথাকথিত স্বাধীনতার যুদ্ধ-না ছিল প্রথম, না ছিল জাতীয় এবং না ছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ।’ কারণ –

  • সমস্ত ভারতবাসী এই বিদ্রোহে অংশ নেয়নি। বরং অনেক ভারতীয় রাজা, শিখ ও গোর্খা সৈনিক বিদ্রোহ দমনে সরকারকে সাহায্য করেছিল।
  • বিদ্রোহীদের কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল না।
  • 1857 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের জন্মই হয়নি।
  • তা ছাড়া 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে স্বাধীনতা সংগ্রাম বললে এর পূর্ববর্তী সমস্ত বিদ্রোহের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। অন্যদিকে ঐতিহাসিক শশীভূষণ রায়চৌধুরী বলেছেন, এই বিদ্রোহ ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় যুদ্ধ এবং গণসংগ্রাম।

কৃষক বিদ্রোহ –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে অনেকে কৃষক বিদ্রোহ বলেও অভিহিত করেছেন। সমকালীন অনেক ইংরেজ কর্মচারীও বলেছেন যে, ব্রিটিশ সরকারের জমি সংক্রান্ত নীতি এই বিদ্রোহে ইন্ধন জুগিয়েছিল। তালমিজ খালদুনের মতে, কৃষকেরা এই বিদ্রোহে মরণপণ সংগ্রাম চালিয়েছিল। এই অবস্থায় জমিদাররা তাদের সংকীর্ণ স্বার্থে ইংরেজদের পক্ষ সমর্থন করে।

মুসলমান চক্রান্ত –

কোনো কোনো ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের চক্রান্ত বলে উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তানি ঐতিহাসিক আই এইচ কুরেশি, সৈয়দ মইনুল হক 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘মুসলিম চক্রান্ত’ বলে অভিহিত করেন। এই বিদ্রোহে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অযোধ্যা ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বিদ্রোহীদের তৎপরতা লক্ষ করে এই আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা ঠিক হবে না। এতে হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই লড়াই করেছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের মূল্যায়ন –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের জন্য দেশীয় সিপাহিদের অসন্তোষই মূল কারণ ছিল না। এর মূলে ছিল বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের গভীর অসন্তোষ ও হতাশা। তাদের লক্ষ্য ছিল ইংরেজ শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করা। ঐতিহাসিকদের মতে, এই বিদ্রোহ ছিল অপরিহার্য। কারণ কোনো পরাধীন জাতির পক্ষে চিরকালের জন্য বিদেশি প্রভুত্ব মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। অধ্যাপক রণজিৎ গুহ, গৌতম ভদ্র ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও এই আন্দোলনের গণচরিত্রের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে বলা যায়, 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিদ্রোহীদের মধ্যে দেশপ্রেমের কোনো অভাব ছিল না এবং এই আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ সমবেত হয়েছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে সামরিক বিদ্রোহ বলা হয় কেন?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ভূমিকা –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্বন্ধে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। ঘটনার সূত্রপাত, অংশগ্রহণ, নেতৃত্ব, পরিণতির দিক থেকে বিচার করে অনেকে এই ঘটনাকে সামরিক বা সিপাহি বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। ভারতীয় সৈন্যরা ‘সিপাহি’ নামে পরিচিত ছিলেন। সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ‘বেঙ্গল আর্মি’তে। তবে 1857 খ্রিস্টাব্দের 10 মে মিরাটের সেনানিবাসেই প্রকৃতপক্ষে ‘বিদ্রোহ’ শুরু হয়।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে সামরিক বিদ্রোহ বলা হয় কারণ –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল সেনাছাউনি থেকে। এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল অসন্তুষ্ট সিপাহিরা। তাদের অসন্তোষের কারণ ছিল –

  • পেশাগত বৈষম্য – ইউরোপীয়দের তুলনায় ভারতীয় সেনাদের বেতন ছিল কম। উচ্চপদগুলি ইংরেজদের জন্য সংরক্ষিত থাকত। যোগ্যতা থাকলেও ভারতীয় সেনাদের পদোন্নতি হত না।
  • বর্ণবৈষম্য – ইংরেজ সৈন্যরা ভারতীয় সেনাদের ‘কালা আদমি’ বলে দুর্ব্যবহার করত। শৃঙ্খলার নামে তারা ভারতীয় সৈন্যদের উপর নির্যাতন করত।
  • খাদ্য সরবরাহে বৈষম্য – সামরিক শিবিরে ভারতীয় সেনাদের ইউরোপীয় সেনাদের তুলনায় অতি নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ করা হত।
  • সমুদ্রযাত্রায় অনীহা – তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় হিন্দুদের সমুদ্রযাত্রা বা কালাপানি পার হওয়ায় ধর্মীয় ও জাতিগত বাধা ছিল। কিন্তু সিপাহিদের চাকরির শর্তই ছিল প্রয়োজনে সমুদ্রপথে বিদেশ যেতে হবে। এই বিষয়টিও ছিল সিপাহিদের বিদ্রোহী হওয়ার অন্যতম কারণ।
  • রীতিপালনে বাধা – ভারতীয় সৈন্যদের পাগড়ি, টিকি, তিলক, দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া দূরদেশে যুদ্ধে যাওয়ার অতিরিক্ত ভাতাও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
  • এনফিল্ড রাইফেল – এই অসন্তোষের পটভূমিতে সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেল -এর ব্যবহার চালু হয়। এর কার্তুজ দাঁতে কেটে রাইফেলে ভরতে হত। গুজব রটে যায়, এই কার্তুজে গোরু ও শূকরের চর্বির প্রলেপ আছে। ফলে হিন্দু-মুসলিম সিপাহিরা ধর্মনাশের আশঙ্কা করে। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে ব্যারাকপুর সেনাছাউনিতে মঙ্গল পাণ্ডের বিদ্রোহের (29 মার্চ, 1857 খ্রিস্টাব্দ) মাধ্যমে।
1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে সামরিক বিদ্রোহ বলা হয় কেন?

অযোধ্যার সিপাহিদের অসন্তোষ –

বেঙ্গল আর্মির বেশিরভাগ সিপাহি ছিলেন অযোধ্যা রাজ্যের মানুষ। অযোধ্যা রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হলে এইসব সিপাহিরা প্রবল অসন্তুষ্ট হয়। তারা এর প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সূচনা ও বিস্তার –

1857 খ্রিস্টাব্দের 26 ফেব্রুয়ারি বহরমপুর সেনাছাউনিতে প্রথম সিপাহিরা বিদ্রোহী হয়। ইংরেজরা সহজেই এই বিদ্রোহ দমন করে। এরপর ব্যারাকপুর সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ ঘটে (29 মার্চ)। তারপর মিরাট (10 মে), দিল্লি (11 মে), আলিগড় (20 মে), লখনউ (30 মে), বেরিলি (31 মে), কানপুর (4 জুন), ঝাঁসি (6 জুন), ফৈজাবাদ (7 জুন), হায়দরাবাদ (18 জুলাই), দানাপুর (25 জুলাই), আরা (29 জুলাই), কোলাপুর (31 জুলাই), মুলতান (17 সেপ্টেম্বর), চট্টগ্রাম (18 নভেম্বর), ঢাকা (22 নভেম্বর) ইত্যাদি সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহী সিপাহিরা কোথাও স্থানীয় জনগণের সমর্থন পেয়েছিল আবার কোথাও পায়নি। যেখানে তারা জনসমর্থন পেয়েছিল সেখানে তারা ব্রিটিশ প্রশাসনের চিহ্ন ধ্বংস করে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে উত্তর ভারতের এক বিস্তীর্ণ অংশে বিদ্রোহের বিস্তার ঘটে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সংঘর্ষ –

বিদ্রোহী সিপাহিরা স্থানীয় এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ইংরেজ বাহিনী তাদের দমনে অগ্রসর হলে তারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। দিল্লি, লখনউ, কানপুর, আরা প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক যুদ্ধ হয়। ভারী অস্ত্র, রাইফেল ও দক্ষ সেনাপতির অভাবে বিদ্রোহী সিপাহিরা পরাজিত হয়। দেশীয় রাজাদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে ইংরেজরা শেষপর্যন্ত জয়ী হয়।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে সামরিক বিদ্রোহ বলা হয় কেন?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের মূল্যায়ন –

স্যার জন লরেন্স, স্যার জন সিলি, চার্লস রেক্স, চার্লস রবার্টস প্রমুখ ব্রিটিশ ঐতিহাসিকগণ এবং সমকালীন বিশিষ্ট ভারতীয় অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, কিশোরীচাঁদ মিত্র, হরিশচন্দ্র মুখার্জি, দাদাভাই নৌরজি, সৈয়দ আহমদ খান, রাজনারায়ণ বসু, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখও এই ঘটনাকে সামরিক বিদ্রোহ বলেছেন। ভারতের সীমিত অঞ্চলে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে ছিল। শিক্ষিত শ্রেণি বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল। অধিকাংশ দেশবাসী, অধিকাংশ সৈন্য এবং দেশীয় রাজারা বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করে। তাই এই ঘটনাকে সিপাহি বিদ্রোহ বলাই যুক্তিযুক্ত বলে তাঁরা মনে করছেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ কি সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া ছিল? যুক্তি-সহ লেখো।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ভূমিকা –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্বন্ধে ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। বিদ্রোহের উদ্দেশ্য, ঘটনা প্রবাহ, নেতৃত্ব, অংশগ্রহণ, পরিণতির দিক থেকে বিচার করে অনেক ঐতিহাসিক এই ঘটনাকে ‘সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া’ বা ‘সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ’ বলেছেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সামঞ্জতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া –

1857 খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাব সিরাজ উদ-দৌলাকে পরাজিত করে। অতঃপর কোম্পানি নৃপতি স্রষ্টায় (King Maker) পরিণত হয়ে পরপর মিরজাফর, মিরকাশিম, মিরজাফরের পুত্র নজম উদ-দৌলাকে নবাব মনোনীত করে। অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি, যুদ্ধজয় এবং স্বত্ববিলোপ নীতির দ্বারা বহু দেশীয় রাজ্য (ঝাঁসি, উদয়পুর, করৌলী, সাতারা, জয়িতপুর, তাঞ্জোর, সুরাট) গ্রাস করে। কুশাসনের অভিযোগে দখল করে অযোধ্যা রাজ্য। এর ফলে বহু রাজা-রানি নিজ রাজ্য হারান। সেখানকার অভিজাত, রাজকর্মচারী ও সৈনিক সবাই কর্মচ্যুত ও বেকার হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে এইসব শ্রেণি ইংরেজদের প্রতি বিক্ষুব্ধ ছিল। যে-কোনোভাবে তারা ইংরেজ রাজত্ব উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর হয়। সিপাহিদের দ্বারা বিদ্রোহ শুরু হলে এইসব বিক্ষুব্ধ শ্রেণি সেই বিদ্রোহে যোগদান করে এবং নিজেদের পুরোনো পদমর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন।

অযোধ্যার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্তি –

ইংরেজদের পররাজ্যগ্রাস নীতির নির্লজ্জ উদাহরণ ছিল অযোধ্যা দখল। অযোধ্যা দখলের ফলে অযোধ্যার নবাব, রাজকর্মচারী, অভিজাত, তালুকদার, কৃষক- সব শ্রেণি ইংরেজবিরোধী হয়ে ওঠে। সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হওয়ার মাত্র 10 দিনের মধ্যে অযোধ্যায় ইংরেজ শাসন লোপ পায়। একইভাবে অযোধ্যাবাসী, যারা ইংরেজ বাহিনীতে সিপাহি ছিলেন তারাও বিক্ষুদ্ধ ও বিদ্রোহী হন। অযোধ্যার তালুকদাররা (জমিদার) বিদ্রোহে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের বিস্তার –

ব্যারাকপুর সেনাছাউনিতে সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা হলেও (29 মার্চ, 1857 খ্রিস্টাব্দ) মিরাট সেনাছাউনির বিদ্রোহ (10 মে, 1857 খ্রিস্টাব্দ) প্রকৃত বিদ্রোহের রূপ ধারণ করে। এরপর দিল্লি (11 মে), আলিগড় (20 মে), লখনউ (30 মে), বেরিলি (31 মে), কানপুর (4 জুন), ঝাঁসি (6 জুন), ফৈজাবাদ (7 জুন), হায়দরাবাদ (18 জুলাই), দানাপুর (25 জুলাই), আরা (29 জুলাই), কোলাপুর (31 জুলাই), মুলতান (17 সেপ্টেম্বর), চট্টগ্রাম (18 নভেম্বর), ঢাকা (22 নভেম্বর) ও অন্যান্য স্থানে সিপাহি বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এইসব স্থানে বিদ্রোহী সিপাহিরা স্থানীয় জনগণের সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় সহানুভূতি পেয়েছিল। আবার কোথাও দেশীয় শাসক বা জমিদারদের সহযোগিতা লাভ করেছিল। বিদ্রোহী সিপাহিরা মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করলেও তাদের সমর্থক ও নেতৃত্বে ছিলেন দেশীয় শাসকবৃন্দ।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের নেতৃত্ব –

বিদ্রোহী সিপাহিরা দিল্লি দখল করে বৃদ্ধ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ‘হিন্দুস্তানের সম্রাট’ বলে ঘোষণা করে। কানপুরের পেশায়ার দত্তকপুত্র নানাসাহেব, ঝাঁসিতে রানি লক্ষ্মীবাঈ, অযোধ্যায় বেগম হজরত মহল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। বিহারের জগদীশপুরের জমিদার কুনওয়ার সিং বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন জমিহারা তালুকদার, ক্ষতিগ্রস্ত ভূস্বামী বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ কি সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া ছিল? যুক্তি-সহ লেখো।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সংঘর্ষ –

এইসব নেতৃবৃন্দের প্রভাবে বিদ্রোহী সিপাহি ও সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের পক্ষে বকৎ খান দিল্লিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ঝাঁসির রানি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেন। নানাসাহেবের পক্ষে তাঁতিয়া তোপি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কুনওয়ার সিং নিজে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পরিণতি –

বিদ্রোহ দমনের পর বৃদ্ধ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করা হয়। তাঁর পুত্র ও পৌত্রদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। রানি লক্ষ্মীবাঈ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেন। তাঁতিয়া তোপি ও হজরত মহল নেপালে পালিয়ে যান। আরা জেলা ও জগদীশপুরে গণহত্যা চলে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের মূল্যায়ন –

ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন, তালমিজ খালদুন, রজনীপাম দত্ত প্রমুখ এই বিদ্রোহকে সামন্তদের বিদ্রোহ বলেছেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার এই ঘটনাকে ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত ও মৃতপ্রায় সামন্তদের ‘মৃত্যুকালীন আর্তনাদ’ বলে অভিহিত করেছেন। তালমিজ খালদুন -এর মতে, রাজ্যহারা রাজা-রানি, জমিহারা ভূস্বামী ও কৃষক, কর্মচ্যুত কর্মচারী ও সৈনিক তাদের আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ফলাফল সম্পর্কে লেখো।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ভূমিকা –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা ছিল। লেপেল গ্রিফিন -এর মতে, এই বিদ্রোহ ভারতের আকাশকে মেঘমুক্ত করে (The Revolt of 1857 swept the Indian Sky clear of many clouds)। ‘বিদ্রোহ’ (Mutiny) নামে খ্যাত এই বিপুল অভ্যুত্থানের পরিসমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রশাসন, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা সমস্ত ক্ষেত্রে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পরিবর্তনসমূহ –

এই বিদ্রোহের ফলে যে পরিবর্তনগুলি সূচিত হয় তা হল –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের কোম্পানি শাসনের অবসান –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে। 1858 খ্রিস্টাব্দের 2 আগস্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারত শাসন আইন পাস করে (Govt. of India Act-1858)। ইংল্যান্ডের মহারানি ভিক্টোরিয়া রাজপ্রতিনিধি বা ভাইসরয় -এর মাধ্যমে ভারতের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেন এবং এরপর তাঁকে ‘ভারত সম্রাজ্ঞী’ বলে ঘোষণা করা হয়।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রশাসনিক সংস্কার –

ভাইসরয় পদের সৃষ্টি –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর ইংল্যান্ডে কোম্পানির ভারত প্রশাসন সংক্রান্ত বিষয়ে সংস্কার করা হয়। 1784 খ্রিস্টাব্দে পিটের ভারত আইন অনুসারে ‘বোর্ড অফ কন্ট্রোল’, ‘কোর্ট অফ ডাইরেক্টরস’, ‘সিক্রেট কমিটি’ লন্ডন থেকে ভারতীয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করত। তখন এই সংস্থাগুলি বাতিল করে 15 সদস্যবিশিষ্ট ইন্ডিয়া কাউন্সিল গঠিত হয়। এর সভাপতি হন ভারত-সচিব (Secretary of the State for India)। তিনি ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার ভারত বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত একজন মন্ত্রী ছিলেন। তিনি তাঁর কাজের জন্য পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকতেন। এ ছাড়া গভর্নর জেনারেল পদের নাম পরিবর্তন করে ভাইসরয় করা হয়। ভারতের প্রথম ভাইসরয় হন লর্ড ক্যানিং।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ফলাফল সম্পর্কে লেখো।
আইন পরিষদে ভারতীয়দের গ্রহণ –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর ভারতীয় প্রশাসনের সংস্কার সাধিত হয়। এ যাবৎ ভারতীয় প্রশাসনে ভারতীয়দের যোগদানের ব্যবস্থা ছিল না। 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর ভারতীয় প্রশাসনে ভারতবাসীর মতামত গ্রহণের জন্য ভারতীয় পরিষদীয় আইন (Indian Council Act-1861) পাস হয়। এই আইন অনুসারে বড়োলাট বা ভাইসরয় -এর আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যা বাড়ানো হয় এবং সেখানে ভারতীয়দের নিযুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। একইভাবে প্রদেশগুলিতেও (বাংলা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই) ছোটোলাট বা লেফটেন্যান্ট গভর্নরের পরিষদে ভারতীয় সদস্য নিযুক্ত করা হয়।

দেশীয় রাজ্যের নীতিতে পরিবর্তন –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের আগে পর্যন্ত দেশীয় রাজ্যগুলিকে রক্ষা করার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেগুলিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়েছিল। এখন থেকে ব্রিটিশদের সঙ্গে এদের সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুত্বপূর্ণ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সামরিক সংস্কার –

  • 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের উৎসকেন্দ্র ছিল সেনাবাহিনী, তাই সেনাবাহিনীতে গুরুতর পরিবর্তন ঘটানো হয়। ভবিষ্যতে সেনা বিদ্রোহের আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে ভারতীয় জাতিগোষ্ঠীগুলিকে বিভেদনীতির সাহায্যে বিভক্ত করা হয় –
    • যেসব জাতিগোষ্ঠীর সৈন্য 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল তাদের ‘অসামরিক (Non-Martial Race) জাতি’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের মধ্য থেকে সৈন্যনিয়োগ নিষিদ্ধ হয়। যেমন – বাঙালি, বিহারি, অযোধ্যাবাসী ইত্যাদি। বিদ্রোহের উৎসকেন্দ্র ‘বেঙ্গল আর্মি’ ভেঙে দেওয়া হয়।
    • আর যেসব জাতিগোষ্ঠীর সৈন্যরা বিদ্রোহ দমনে ইংরেজ সরকারকে সাহায্য করেছিল তারা ‘সামরিক জাতি’ (Martial Race) হিসেবে চিহ্নিত হন। ভবিষ্যতে এদের মধ্য থেকে বেশি সংখ্যায় সৈন্যনিয়োগের নীতি গৃহীত হয়। যেমন – পাঠান, শিখ, গোর্খা, রাজপুত প্রভৃতি।
  • এ ছাড়া উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ না করা, জাতি-ধর্ম-গোষ্ঠীগত অনুপাত বজায় রেখে ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়। এই বিভেদকে প্রশ্রয় দিয়ে ভবিষ্যৎ বিদ্রোহের সম্ভাবনা দূর করা ও তা দমনের সুব্যবস্থা করা হয়। ভারতীয় বাহিনীতে ইংরেজ সৈন্যসংখ্যা বাড়ানো হয়। গোলন্দাজ বাহিনীতে ভারতীয়দের নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়।
1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ফলাফল সম্পর্কে লেখো।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে মহারানির ঘোষণা –

বিদ্রোহ দমনের পর শান্তি প্রতিষ্ঠা করে এলাহাবাদের এক দরবারে মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্র জারি করা হয় (1 নভেম্বর, 1858 খ্রিস্টাব্দে)। এর দ্বারা নতুন শাসননীতি গৃহীত হয়। যেমন –

  • যোগ্যতা ও গুণ অনুসারে সমস্ত ভারতীয় সরকারি কাজের সুযোগ পাবে। এক্ষেত্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণগত ভেদ বাধা হবে না।
  • দেশীয় রাজারা দত্তকপুত্র গ্রহণ করতে পারবে।
  • নতুন কোনো রাজ্য জয় করা হবে না।
  • দেশীয় রাজাদের সঙ্গে পূর্ব সম্পাদিত চুক্তি বলবৎ থাকবে।
  • ধর্মপালন ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রজাদের স্বাধীনতা বজায় থাকবে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের যোগাযোগ বৃদ্ধি –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সময় যোগাযোগের অসুবিধা কোম্পানির সৈন্যবাহিনীর কাছে একটি বড়ো সমস্যা ছিল। তাই ইংরেজ সরকার সেই সমস্যা দূর করতে নতুন উদ্যোগে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষত নগর-বন্দরগুলির মধ্যে রেল ও সড়কপথ নির্মাণে মনোনিবেশ করে। এতে ঔপনিবেশিক সরকারের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির পাশাপাশি জাতীয়তাবাদের পথ প্রশস্ত হয়।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের মূল্যায়ন –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ফলাফল নিঃসন্দেহে ভারতে গুরুতর প্রভাব ফেলেছিল। উপনিবেশ যে কেবল শোষণ ও শাসনের ক্ষেত্র নয় – উপনিবেশবাসীদেরও কিছু দাবিদাওয়া আছে, এ কথা ব্রিটিশ সরকার স্বীকার করে। বিভেদনীতির প্রয়োগ ভারতীয় সমাজে ফলপ্রসূ হয়। মহারানির ঘোষণাপত্রের সিদ্ধান্তগুলি যে শুধুমাত্র আশ্বাস, বাস্তব নয় তা কিছুদিনের মধ্যেই ভারতবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের মনোভাব কীরকম ছিল?

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে সেই সময়ের শিক্ষিত বাঙালি সমাজ সমর্থন করেনি। উপরন্তু তারা বিদ্রোহী সিপাহিদের ও বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত নেতানেত্রীদের ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছিল। শিক্ষিত বাঙালি সমাজ এই বিদ্রোহে বিদ্রোহীদের পরাজয় ও ব্রিটিশদের জয় কামনা করেছিল।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের শিক্ষিত বাঙালি সমাজের বিরোধিতার কারণ –

শিক্ষিত বাঙালি সমাজ বিভিন্ন কারণে 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল।

  • মধ্যযুগীয় শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার ভয় – শিক্ষিত বাঙালি সমাজ মনে করেছিল বিদ্রোহীরা জয়লাভ করলে ভারতে আবার মধ্যযুগীয় মুঘল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। তারা মধ্যযুগীয় মুঘল শাসনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন।
  • আধুনিকতার অবসানের ভয় – শিক্ষিত বাঙালি সমাজ ছিল আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কারের সমর্থক। তারা মনে করেছিল বিদ্রোহীরা জয়ী হলে তাদের সামন্ততান্ত্রিক শাসনে আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কারের অবসান ঘটবে।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের বিরোধিতা –

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি বাঙালি সমাজ সেই সময়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তীব্র বিদ্বেষ প্রকাশ করে।

সভা করে বিরোধিতা করা –

বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজা রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা হয়। সভায় বিদ্রোহীদের নিন্দা করা হয়।

মেট্রোপলিটন কলেজের সভা –

রাজা রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে সিপাহি বিদ্রোহের বিরুদ্ধে আরও একটি সভা হয় মেট্রোপলিটন কলেজে (26 মে, 1857 খ্রিস্টাব্দ)। এই সভায় উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ, কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, হরচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। তাঁরা সরকারকে সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সভায় প্রস্তাব পাস করেন এবং সরকারের কাছে তা পেশ করেন।

পত্রপত্রিকায় বিরোধিতা –

সংবাদ ভাস্কর, সংবাদ প্রভাকর প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় শিক্ষিত বাঙালি সমাজ বিদ্রোহীদের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদকের সিপাহি বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ, নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না।

1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের মনোভাব কীরকম ছিল?

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় লিখেছিলেন যে, ‘হে বিঘ্ন হর…..ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের জয়পতাকা চিরকাল সমভাবে উড্ডীয়মান কর। অত্যাচারি অপকারি বিদ্রোহকারি দুর্জনদিগকে সমুচিত প্রতিফল প্রদান কর।

গ্রন্থে বিদ্রোহের বিরোধিতা –

কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর ‘মালতিমাধব’ নাটকের একটি গানে লিখেছেন –

“ভারতের কর্ত্রী যিনি ভিক্টোরিয়া মহারাণী;
চিরজীবী হোন তিনি, প্রিয় পুত্র-স্বামী সনে
দুরাত্মা বিদ্রোহী দল, যাক সবে রসাতল
রাজকরে হোক বল, দুর্জয় হউক রণে।”

আসলে তখনও ব্রিটিশ শাসনের প্রতি শিক্ষিত বাঙালির অকুণ্ঠ বিশ্বাস ছিল। সিপাহিরা ব্রিটিশ সরকারের শৃঙ্খলাপূর্ণ শাসনকে ধ্বংস করতে চাইলে শিক্ষিত বাঙালিরা স্বাভাবিকভাবেই তার বিরোধিতা করেছিল।

1857 -পরবর্তী সময়ে ভারতীয় প্রশাসন ও রাজনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়? ইংরেজদের বিভেদনীতি এবং শিক্ষিত শ্রেণির রাজনৈতিক জাগরণ কীভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়? আলোচনা করো।

নতুন যুগের সূচনা – 1857 খ্রিস্টাব্দের পর ভারত ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। একদিকে সরকারি নীতির প্রভাবে ভারতীয় প্রশাসনে ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্যদিকে ভারতীয়দের মধ্যে বিভেদনীতির প্রয়োগ শুরু হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সমর্থক শিক্ষিত শ্রেণি এখন সচেতন হয়ে ওঠে ও ইংরেজদের প্রতি সন্দিহান হয়ে ওঠে। তারা জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের কথা বলেন। বিভিন্ন সভাসমিতি গড়ে ওঠে এবং ভারতীয় রাজনীতিতে আলোড়ন শুরু হয়।

উনিশ শতকের ভারতবর্ষে সভাসমিতির বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

সভাসমিতির ভূমিকা –

1857 খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধজয় এবং 1765 খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি অধিকার লাভ করে ইংরেজরা এদেশে রাজত্ব শুরু করে। শুরু হয় শাসন ও শোষণের যুগ। কৃষকশ্রেণির উপর এর চাপ ও অভিঘাতের প্রতিক্রিয়ায় মাঝে মাঝে কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। শিক্ষাপ্রসারের সঙ্গে সঙ্গে একটি শিক্ষিত সচেতন শ্রেণি গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবোধ জেগে ওঠে। ফলে গঠিত হয় বিভিন্ন সভাসমিতি। উনিশ শতকে বাংলা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে এইরকম কয়েকটি সভাসমিতি গড়ে উঠেছিল বলে ঐতিহাসিক অনিল শীল এই সময়কে ‘সভাসমিতির যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন।

সভাসমিতির উপাদানসমূহ –

সভাসমিতি গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপাদান সহায়ক হয়েছিল। যেমন – রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। সমকালীন ইউরোপের রাজনৈতিক চিন্তার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। মেকিয়াভেলি, হবস, লক, রুশো, বেন্থাম, টম পেইন -এর দর্শন এবং আমেরিকার বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ দ্বারা তিনি উদ্‌বুদ্ধ হন। বিভিন্ন দেশের গণ আন্দোলনের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল। তিনিই ভারতে প্রথম সংগঠিত রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা করেন। ইংরেজ সরকার 1823 খ্রিস্টাব্দে Press Ordinance দ্বারা সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করলে তিনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবি জানান। তাঁর চেষ্টায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা পায়। এ ছাড়া জুরি প্রথায় বিচারব্যবস্থায় সংস্কারের দাবি করে তিনি সফল হন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সাক্ষ্যদানের মাধ্যমে তিনি গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন ঘটান। এর প্রভাবে বিভিন্ন সভাসমিতি গড়ে ওঠে।

সভাসমিতির বৈশিষ্ট্যসমূহ –

  • ঐক্যভাব – এদেশের শিক্ষিত ও সচেতন ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায় আগ্রহী ছিলেন। ইংরেজ শাসনের আঘাতে যাতে তাদের স্বার্থহানি না হয় সেজন্য তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এই ঐক্যভাব পরে তাদের একসূত্রে বাঁধে।
  • এলিট চরিত্র – এলিট (Elite) বলতে শিক্ষাদীক্ষায় আলোকিত শ্রেণিকে বোঝায়। এই শ্রেণির মানুষেরা দাবি আদায় ও স্বার্থরক্ষার জন্য বিভিন্ন সভাসমিতি গড়ে তোলেন। এই সভাসমিতিগুলিতে একজনও সাধারণ মানুষ ছিল না – সবাই ছিল মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির অন্তর্গত।
  • গোষ্ঠীস্বার্থ – এ যুগের সভাসমিতিগুলি বিভিন্ন গোষ্ঠীস্বার্থের বাহক ছিল। ইংরেজ সরকার যে শোষণমূলক পুঁজিবাদী অর্থনীতি চালু করেছিল, তার সুযোগসুবিধা ভোগ করে একটি নতুন সামাজিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এই শ্রেণি তাদের স্বার্থরক্ষা ও দাবি আদায়ের জন্য এইসব সভাসমিতি গড়ে তোলে।
  • রাজনৈতিক চেতনা – ইংরেজ সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন, কর ও শুল্কনীতি শিক্ষিত, সচেতন ভারতবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই শ্রেণি ইংরেজ শাসনের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে। ভারত যে ইংল্যান্ডের একটি উপনিবেশ – এ কথা তারা বুঝতে পারে। সভাসমিতিগুলি সাধারণত গোষ্ঠীস্বার্থের বাহক ছিল। পরবর্তীকালে সভাসমিতিগুলি গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জনস্বার্থের কথা ভাবতে শুরু করে। কালা কানুন (Black Bill Controversy) এবং সনদ আইনের (Charter Act-1853) বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা শুরু করে।
  • শিক্ষার প্রসার – ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে। এর ফলে একটি শিক্ষিত সামাজিক শ্রেণি গড়ে ওঠে। এরা পাশ্চাত্য শিক্ষাভিত্তিক বিভিন্ন পেশা (শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী) গ্রহণ করে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি নামে পরিচিত হয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে এরা পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ শাসনে অন্যান্য ভারতীয় সামাজিক শ্রেণির মতো এরাও শোষিত ও হতাশাগ্রস্ত ছিল। সরকারি পদ লাভের ক্ষেত্রে তারা বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েছিল। ফলে সভাসমিতি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে শিক্ষার প্রসার একটি সহায়ক উপাদান ছিল।
  • স্বাধীন মতপ্রকাশ – হিন্দু কলেজের একদল ছাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে বিশেষত ডিরোজিওর প্রভাবে ইংরেজ শাসনের দোষত্রুটি সম্বন্ধে সচেতন হয়। পাইওনিয়ার পত্রিকায় ‘স্বাধীনতা’, ‘বিদেশির অধীন’, ‘ভারতবর্ষ’ প্রভৃতি নিবন্ধ প্রকাশিত হত। জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকায় ইংরেজ পুলিশ ও বিচারপদ্ধতির সমালোচনা করা হয়। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, রাজ্যশাসনের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত বহু মানুষের কল্যাণ-মুষ্টিমেয়র কল্যাণসাধন নয়। বিদেশি শাসনই ভারতের দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ – এই স্বাধীন মতপ্রকাশ সভাসমিতির যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।

সভাসমিতির মূল্যায়ন –

উনিশশতকে বাংলা, মাদ্রাজও বোম্বাই প্রেসিডেন্সিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সভাসমিতি গড়ে ওঠে। প্রথম থেকেই পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের সূত্রে এখানকার মানুষ সচেতন ছিলেন। তাই এই অঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির প্রবণতা লক্ষ করা যায়। প্রথমদিকে জমিদার শ্রেণির নেতৃত্বে এই সভাসমিতিগুলি গড়ে ওঠে। পরে ইংরেজি-শিক্ষিত বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী এইসব সভাসমিতির নেতৃত্ব দেন। এইভাবে উনিশ শতকে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সভাসমিতির বৈশিষ্ট্যগুলি পরিস্ফুট হয়।

উনিশ শতকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সভাসমিতিগুলির বিবরণ দাও।

অথবা, ব্রিটিশবিরোধী জনমত গঠনে বাংলার সভাসমিতিগুলির পরিচয় দাও।

1765 খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি অধিকার লাভ এদেশে ইংরেজ রাজত্বের সূচনা করে। শুরু হয় শাসন ও শোষণের যুগ। শিক্ষাপ্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে একটি শিক্ষিত ও সচেতন শ্রেণি গড়ে ওঠে এবং দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবোধ জেগে ওঠে। এর ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভাসমিতির জন্ম হয়।

উনিশ শতকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সভাসমিতিসমূহ –

উনিশ শতকে কলকাতা তথা বাংলা প্রেসিডেন্সিতে বিভিন্ন সভাসমিতি গড়ে ওঠে।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা –

ইংল্যান্ডের অনুকরণে এদেশে প্রথম যুগে যে-সমস্ত রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা।

  • প্রতিষ্ঠা – 1836 খ্রিস্টাব্দের 8 ডিসেম্বর কলকাতায় এই সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন 24 পরগনা (উত্তর) জেলার টাকির জমিদার কালীনাথ রায়চৌধুরী, প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ এই সভার প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। এই সভার প্রতিষ্ঠাতাগণ সবাই জমিদার ছিলেন।
  • উদ্দেশ্য – সভার সদস্যরা গোচারণভূমি বা পতিত জমিতে সরকারের কর বসানোর বিরোধিতা করেন। এই সভার রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতা ও সমতার আদর্শকে তারা সম্মান করতেন। তারা বিশ্বাস করতেন পাশ্চাত্য শিক্ষা ভারতের উন্নতিসাধন করবে। তারা এদেশে ইংল্যান্ডের মতো সম-অধিকার নীতির বাস্তবায়ন চাইতেন। লক্ষ্যপূরণের জন্য এই সভায় ইংরেজ সদস্য নেওয়া হয়। ব্রিটিশ শাসনকে তারা ‘ঐশ্বরিক দান’ বলে মনে করতেন।

জমিদার সভা –

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত সভাসমিতিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জমিদার সভা।

এই সভার উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণের স্বার্থরক্ষার্থে সরকারি শাসনব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করা এবং ত্রুটিগুলি দূর করার জন্য সরকারের কাছে আবেদনপত্র পেশ করা।

  • প্রতিষ্ঠা – 1838 খ্রিস্টাব্দের 12 নভেম্বর কলকাতায় এই সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় এই সভার নাম ছিল জমিনদারি অ্যাসোসিয়েশন। পরে এর নাম হয় ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি (Landholders Society) বা ভূম্যধিকারী সভা। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখ।
  • উদ্দেশ্য – প্রতিষ্ঠাতা সদস্যগণ সবাই জমিদার ছিলেন। তাই জমিদারি স্বার্থরক্ষা এই সভার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। ব্রিটিশ সরকারের ভূমিরাজস্ব নীতি জমিদারদের ভীত করেছিল। তাই সরকারি নীতির বিরোধিতা ও প্রতিরোধ করা এই সভার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে।
  • দাবিসমূহ – এই সভা বিভিন্ন দাবি পেশ করে। সেগুলি ছিল –
    • নিষ্কর জমি বাজেয়াপ্ত হতে না দেওয়া।
    • ব্রিটিশ ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রসার।
    • বিচার, পুলিশ ও রাজস্ব বিভাগের সংস্কার।
    • সুবিধাজনক শর্তে পতিত জমির ইজারাদান প্রভৃতি।

এ ছাড়া এই সভা বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে প্রজাকল্যাণ ও স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ দেখায়।

ভারতসভা –

আঞ্চলিকতার সীমা ছাড়িয়ে সারা ভারতব্যাপী যে রাজনৈতিক সভা গড়ে ওঠে, তার নাম হল ভারতসভা (Indian Association)।

  • প্রতিষ্ঠা – 1876 খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারতসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু ও শিবনাথ শাস্ত্রী।
  • উদ্দেশ্য – দেশে জনমত গড়ে তোলা, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করা, হিন্দু-মুসলিম মৈত্রীর প্রসার এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে সাধারণ মানুষদের যোগদানের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।
  • শাখাসমূহ – কলকাতা ছাড়াও এলাহাবাদ, কানপুর, লখনউ, মিরাট, লাহোর প্রভৃতি স্থানে ভারতসভার শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • আন্দোলন – ইংরেজ সরকার আই সি এস পরীক্ষার বয়সসীমা 23 বছর থেকে কমিয়ে 19 বছর করলে এর প্রতিবাদে এই সভা আন্দোলন করে। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার স্ট্যাটুটারি সিভিল সার্ভিস প্রবর্তন করে। এই সভা দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইন, অস্ত্র আইনের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করে। এ ছাড়া এই সভা ইলবার্ট বিলের সমর্থনেও আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়।
উনিশ শতকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সভাসমিতিগুলির বিবরণ দাও।

হিন্দুমেলা –

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশে গড়ে ওঠা অপর গুরুত্বপূর্ণ সভাটি হল হিন্দুমেলা।

  • প্রতিষ্ঠা – 1867 খ্রিস্টাব্দে নবগোপাল মিত্র কলকাতায় হিন্দুমেলা প্রচলন করেন। তিনি এ বিষয়ে রাজনারায়ণ বসু এবং জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সহযোগিতা পেয়েছিলেন।
  • উদ্দেশ্য – হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করা, হিন্দু জাতীয়তাবোধের বিকাশ, আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তোলা এবং দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলা প্রভৃতি এর উদ্দেশ্য ছিল।
  • কর্মসূচি – মেলার সূচনার দিন দেশের স্তবগান, দেশাত্মবোধক কবিতা পাঠ করা হত। তারপর দেশীয় শিল্প, ব্যায়াম প্রদর্শিত হত। শেষে দেশের গুণী ব্যক্তিত্বরা পুরস্কৃত হতেন।
  • অবদান – দেশাত্মবোধের বিকাশ, বাংলা ভাষার চর্চা ও রচনা, হস্তশিল্প বিকাশে উৎসাহ, জাতীয় অনুভূতি সৃষ্টি – এইসব ব্যাপারে এই মেলার অবদান ছিল।

উনিশ শতকে গড়ে ওঠা সভাসমিতিগুলির উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করলে স্বার্থ ও লক্ষ্যের নানা বিবর্তন দেখা যায়। গোষ্ঠীস্বার্থ সমষ্টির স্বার্থে উত্তীর্ণ হয়। ক্ষেত্রবিশেষে সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা থাকলেও জাতীয়তাবোধ ও দেশাত্মবোধ বিকশিত হয়। জাতীয় স্বার্থে আন্দোলন গড়ে ওঠে।

উনিশ শতকে বাংলায় বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার কাজকর্ম কী ধরনের ছিল? জমিদার সভার সাথে এর পার্থক্য কোথায়?

উনিশ শতকে বাংলায় বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা গড়ে উঠেছিল। এই সভাগুলির কাজকর্ম আংশিক রাজনৈতিক ছিল, কিন্তু জমিদার সভা ছিল সম্পূর্ণভাবেই রাজনৈতিক।

জাতীয়তাবাদের বিকাশে ভারতসভার ভূমিকা আলোচনা করো। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক আয়োজিত সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলনের গুরুত্ব বর্ণনা করো।

জাতীয়তাবাদের বিকাশে ভারতসভার ভূমিকা –

উনিশ শতকে ভারতে যেসব রাজনৈতিক সংগঠনগুলি গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতসভা। 1876 খ্রিস্টাব্দে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারতসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আনন্দমোহন বসু ছিলেন ভারতসভা প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা। ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে ভারতসভার ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলনের গুরুত্ব –

সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসুর উদ্যোগে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন -এর প্রথম অধিবেশন বসে (28-30 ডিসেম্বর, 1883 খ্রিস্টাব্দ)। এই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন রামতন লাহিড়ি। ভারতের ইতিহাসে এই সম্মেলনের গুরুত্ব অপরিসীম।

  • সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান – সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন ছিল একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান। এতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সদস্যরা যোগদান করেছিল।
  • বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ – এই প্রতিষ্ঠানের অধিবেশনে স্বায়ত্তশাসন, প্রতিনিধিত্বমূলক পরিষদ, উচ্চপদে ভারতীয় নিয়োগ, সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। এই বিষয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিও গৃহীত হয়।
  • জাতীয় ধনভান্ডার প্রতিষ্ঠা – জাতীয় সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে আন্দোলন পরিচালনার জন্য জাতীয় ধনভাণ্ডার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়।
  • জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মহড়া – সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলনকে ‘জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মহড়া’ বলে অভিহিত করেছেন ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী। 1885 খ্রিস্টাব্দে (25-27 ডিসেম্বর) এর দ্বিতীয় অধিবেশন সমাপ্ত হওয়ার পরের দিনই জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোক্তারা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে কার্যবিবরণী সংগ্রহ করেন এবং জাতীয় সম্মেলনের অনুকরণে প্রস্তাব পাস করেন।

উনিশ শতকের ভারতে কী কী কারণে জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটে?

ভারতে জাতীয়তাবোধের বিকাশের ভূমিকা –

বাংলা তথা ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন রকমের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দেখা যায়। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শতাব্দীকালের শাসন ও শোষণের প্রতিক্রিয়ায় গড়ে ওঠে বিক্ষোভ, বিদ্রোহ। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার, আর্থিক কাঠামোয় পরিবর্তন, মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষোভ সংগঠিতভাবে ইংরেজ শাসনের প্রতি বিরোধিতার জন্ম দেয়। ইংরেজ স্বার্থের সঙ্গে ভারতীয় স্বার্থের সংঘাতের ফলশ্রুতিতে এই দেশে জাতীয়তাবোধ বিকশিত হয়।

ভারতে জাতীয়তাবোধের বিকাশের কারণসমূহ –

ভারতে জাতীয়তাবোধ বিকাশের কারণগুলি হল –

  • বিক্ষোভ-বিদ্রোহ – ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ও শোষণ, ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি, বেকারত্ব, উপজাতিদের চিরাচরিত অধিকার লোপ ইত্যাদি এদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করেছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন ছোটো ছোটো বিক্ষোভ-বিদ্রোহ ঘটে। এই বিদ্রোহগুলির মধ্যে আধুনিক অর্থে জাতীয়তাবোধ না থাকলেও শোষণ বা বিরোধিতার উপাদান ছিল। এই অসন্তোষ ও বিরোধিতা পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছিল।
  • দেশীয় শিল্পের অবক্ষয় – ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার, ইংল্যান্ডের শিল্পায়ন, অবাধ বাণিজ্য নীতি, সরকারের শুল্কনীতি দেশীয় শিল্পের অবক্ষয় ঘটায়। এর ফলে বহু শিল্পী, কারিগর বেকার হয়ে পড়ে। ভারত ইংল্যান্ডের শিল্পপণ্যের বাজার এবং কাঁচামাল সরবরাহকারী একটি দেশে পরিণত হয়। ইংল্যান্ডের পুঁজির স্বার্থে ভারতের আর্থিক স্বার্থ বিপর্যস্ত – এই ধারণা ভারতের দরিদ্র কৃষিজীবী থেকে ধনী শিল্পপতি সব শ্রেণির মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ডের অপশাসনই ভারতের দারিদ্র্যের কারণ – এই ধারণা ভারতীয় জাতীয়তাবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
  • জাতিগত বৈষম্য – শাসক ইংরেজ ও শাসিত ভারতবাসীর মধ্যে জাতিগত বৈষম্য সামাজিক ব্যবধান সৃষ্টি করেছিল। ইংরেজরা ভারতীয়দের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত। তারা সিপাহি, দেশীয় সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করত। তারা ভারতীয়দের ঘৃণা করত এবং সামাজিক মেলামেশা এড়িয়ে চলত। কিছু পথ, ক্লাব, রেস্তোরাঁ, প্রতীক্ষালয়, রেলকামরা ইউরোপীয়দের জন্য সংরক্ষিত থাকত এবং সেখানে ভারতীয়দের প্রবেশ ও চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। সামাজিক, প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগে জাতিগত বৈষম্য ভারতীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। এই ক্ষোভ তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে।
উনিশ শতকের ভারতে কী কী কারণে জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটে?
  • পাশ্চাত্য শিক্ষা – মিশনারি ও সরকারি উদ্যোগে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। ফলে ভারতবাসী ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হয়। বিশেষ করে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব, ইউরোপীয় রাষ্ট্রদর্শন শিক্ষিত ভারতীয়দের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ফলে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার সৃষ্টি হয়। তারা নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন সভাসমিতি গড়ে তোলে এবং ভারতীয় জাতীয়তাবোধ বিকশিত হতে থাকে।
  • অতীত ঐতিহ্য – ইউরোপীয় পণ্ডিত উইলিয়ম জোনস, ম্যাক্সমুলার ও ভারতীয় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ভাণ্ডারকরের চেষ্টায় ভারতের সমৃদ্ধ অতীত ঐতিহ্য প্রচারিত হয়। এই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জাতীয়তাবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
  • সাহিত্য – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব এদেশের সাহিত্যের উপর পড়েছিল। বিভিন্ন উপন্যাস, কাব্য, নাটক, প্রবন্ধ দেশবাসীর মনে স্বাধীনতাকামী আশা-আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে এবং প্রতিবাদের মানসিকতা গড়ে তোলে।
  • পত্রপত্রিকা – সাহিত্যের মতো সংবাদপত্রও জাতীয়তাবোধের উন্মেষে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। শ্রীরামপুর মিশনারিদের ‘দিগদর্শন’, ‘সমাচার দর্পণ’ (1848 খ্রিস্টাব্দ), গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের ‘বাঙ্গাল গেজেটি’, রামমোহন রায় -এর ‘সম্বাদ কৌমুদী’, কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ গ্রামবাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের বিভিন্ন সংবাদ পরিবেশন করে জাতীয় চেতনার বিকাশে অবদান রেখেছে। এ ছাড়া সংবাদ ভাস্কর, তত্ত্ববোধিনী, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, পাইওনিয়ার, জ্ঞানান্বেষণ, অমৃতবাজার পত্রিকা, সোমপ্রকাশ, কেশরী, আজাদ, ট্রিবিউন, হিন্দু, আখবর প্রভৃতি পত্রিকাও অনুরূপ ভূমিকা পালন করেছে।
  • যোগাযোগ ব্যবস্থা – ইংরেজ সরকার নিজেদের স্বার্থে রেলপথ, সড়কপথ, টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিরাট উন্নতি ঘটে। দূর আর দূর থাকল না। প্রাদেশিকতার সীমানা ছাড়িয়ে ভারতবাসী ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হয়। এই পটভূমিতে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশ সহজতর হয়েছিল। এ ছাড়া এক মুদ্রা, এক ওজন ও পরিমাপ ব্যবস্থা, এক আইন, এক শাসন, সম-অর্থনৈতিক জীবনের বন্ধন ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে। ইংরেজদের অত্যাচার তাই সমগ্র ভারতবাসীর কাছে সমপরিস্থিতি হিসেবে প্রকাশিত হয়।

ভারতে জাতীয়তাবোধের বিকাশের উপসংহার –

ইংরেজদের শাসন ও শোষণে নির্যাতিত ও বিক্ষুব্ধ ভারতবাসী বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ জানায়। পাশ্চাত্য শিক্ষা ভারতীয়দের মানসিক স্ফুরণ ঘটায়। বিভিন্নভাবে তারা প্রতিবাদ করতে থাকে। বিভিন্ন উপাদানের সাহায্যে ভারতবাসী ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ হয়। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, হতাশা তাদের একদিকে ইংরেজ শাসনের বিরোধী ও অন্যদিকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।

দাদাভাই নৌরজির গ্রন্থের নাম লেখো।

দাদাভাই নৌরজির ‘Poverty And Un-British Rule In India’ গ্রন্থটি এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

লেখায় ও রেখায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।

অথবা, ভারতে জাতীয়তাবোধ বিকাশে সাহিত্যের ভূমিকা লেখো।

ভারতে জাতীয়তাবাদের বিকাশের ভূমিকা –

ইংরেজ শাসনকালে প্রবর্তিত নতুন পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে ভারতীয় সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হয়। এই শ্রেণি বিভিন্ন কারণে ইংরেজ শাসনের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এ যুগের সাহিত্যে এবং চিত্রকলায়। এইসব সাহিত্যের বিষয়বস্তু ছিল জাতীয় ঐক্য ও দেশের মুক্তি। এই সাহিত্যিকরা পাশ্চাত্যের কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিকদের রচনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, উদারনীতিবাদ সম্বন্ধে তাঁদের ধারণা ছিল। এইসব সাহিত্যিকরা তাঁদের রচনার মাধ্যমে দেশবাসীর দুঃখযন্ত্রণা ফুটিয়ে তোলেন। অপরদিকে চিত্রশিল্পীরা তাঁদের সৃষ্টির দ্বারা ভারতবাসীর মনে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলেন। এইভাবে লেখায় ও রেখায় ভারতীয় জাতীয়তাবোধ বিকশিত হয়।

ভারতে জাতীয়তাবাদের বিকাশের লেখায় সাহিত্য –

জাতীয়তাবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে সাহিত্যের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল –

আনন্দমঠ –

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘আনন্দমঠ’ জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও স্বাদেশিকতার বীজমন্ত্র ছিল। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় তিনি ‘বন্দেমাতরম’ সংগীতটি প্রকাশ করেন, যা পরে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে সংযুক্ত হয়। 1882 খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে যুবসমাজকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের জন্য জাতীয়তাবোধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন বঙ্কিমচন্দ্র। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, ভারতের বিকাশ হবে দেশীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করে। এই উপন্যাসের দেশপ্রেম ও আত্মোৎসর্গের আদর্শ বিপ্লবীদের প্রেরণা জোগায়।

লেখায় ও রেখায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।

বর্তমান ভারত –

স্বামী বিবেকানন্দ বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা ও বক্তৃতার মাধ্যমে ভারতের যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করেন। ‘বর্তমান ভারত’ (1905 খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থে তিনি বলেন, “হে ভারত ভুলিও না-তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত। ভুলিও না নীচ জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত তোমার ভাই।”

বিবেকানন্দ দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করেন। দেশের মুক্তির জন্য আত্মোৎসর্গের আদর্শ তুলে ধরে তিনি সবাইকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে রাজশক্তির বর্ণনা, ভারতের সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্ম ও ভারতীয় জীবনাদর্শ – এই গ্রন্থের মূল বিষয়। বৈদিক যুগ থেকে বর্তমানকাল, ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য থেকে শূদ্র জাগরণ পর্যন্ত ভারতীয় সমাজের রূপরেখা এই গ্রন্থে চিত্রিত হয়েছে।

লেখায় ও রেখায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।

বিদেশি ইংরেজ শাসনে নির্যাতিত, হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত ভারতবাসীকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি দেশবাসীকে অভীঃ এবং উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত মন্ত্র দেন। তিনি সব দেবদেবীকে বাদ দিয়ে একমাত্র ভারতমাতাকে আরাধ্যা দেবী করতে বলেন। যুবশক্তিকে নিজ বলে বলীয়ান করতে তিনি বলেন, ‘গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলার দ্বারা স্বর্গের কাছাকাছি যাওয়া যায়।’ তাঁর বাণী ছিল বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রেরণার উৎস। তাঁর বাণী হতাশাগ্রস্ত ভারতীয়দের শিরায় মাদকতার সঞ্চার করে। ভারতবাসীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে। এজন্য আর জি প্রধান বিবেকানন্দকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক বলে অভিহিত করেছেন।

গোরা –

এক আইরিশ যুবকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের মানসলোকের প্রতীকী চিত্র হল গোরা উপন্যাস (1910 খ্রিস্টাব্দ)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই উপন্যাসের মধ্যে সমকালীন যুগ ও জীবনের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন। এক দ্বন্দ্ব ও তা থেকে উত্তীর্ণ এক সামগ্রিক পরিমণ্ডল এখানে চিত্রিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের চেতনায় ভারতের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ অখণ্ডভাবে ব্যক্ত হয়েছে। একটি জাতির সামগ্রিক পরিচয় গোরার মধ্য দিয়ে চিত্রিত হয়েছে। এই উপন্যাসে সমকালীন মধ্যবিত্তের মানবতাবোধ পরিস্ফুট হয়েছে। শিক্ষিত বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠা ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ, তার অনুসন্ধানী মনোভাব ও কৌতূহল ফুটে উঠেছে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, হানাহানি থেকে গোরা মুক্তি পেতে চাইত। গোরার চেতনায় অখণ্ডতাবোধ, দেশপ্রেম নিগূঢ়ভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে।

এই উপন্যাসে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের, সমাজের সঙ্গে ধর্মের, ধর্মের সঙ্গে মানবসত্যের বিরোধ ও সমন্বয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জাতিভেদ, বৈষম্য, অভাব ও দারিদ্র্যের সমাধানের ইঙ্গিতও দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

এই উপন্যাসে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের একটি সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবধারা, বিক্ষোভ-আন্দোলন, দেশাত্মবোধের প্রথম স্ফুরণের চাঞ্চল্য, ধর্ম, ভাবাবেগ স্থান পেয়েছে। গোরা উপন্যাসের সূচনা ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার মধ্য দিয়ে এবং সমাপ্তি ধর্ম ও বিশ্বমানবতার মধ্য দিয়ে। এখানেই জাতীয়তাবোধের বিকাশে ‘গোরা’ উপন্যাসের সার্থকতা।

লেখায় ও রেখায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভারতে জাতীয়তাবোধের বিকাশে রেখায়/চিত্রকলা –

ভারতে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে সাহিত্যের মতো চিত্রকলারও বিশেষ অবদান রয়েছে। ভারতীয় জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিকারী চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি।

ভারতমাতা –

জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারতমাতা’ চিত্রটির মাধ্যমে বিশ শতকে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটান। 1902 খ্রিস্টাব্দে অঙ্কিত ‘বঙ্গমাতা’ চিত্রটিই স্বদেশি আন্দোলনের আবহে 1905 খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতমাতা’ রূপে খ্যাতি লাভ করে।

ভারতমাতা হলেন ভারতবর্ষের প্রতীক। তিনি গৈরিক বসন পরিহিতা এবং চতুর্ভুজা। চার হাতে তাঁর ধানের গোছা, সাদা কাপড়, পুথি ও জপমালা। অর্থাৎ তিনি তাঁর সন্তানদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও দীক্ষা প্রদান করেন। ভারতমাতা সবুজ পৃথিবীর উপর দণ্ডায়মানা, পায়ের কাছে চারটি পদ্মফুল এবং পিছনে নীল আকাশ।

ব্যঙ্গচিত্র –

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্রগুলিও জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাঁর অঙ্কিত রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যামূলক ব্যঙ্গচিত্রগুলির মাধ্যমে তিনি ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করেছিলেন। অদ্ভুতলোক, বিরূপ বজ্র, নব হুল্লোড়, State Funeral of H.E. Old Bengal ইত্যাদি এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

ভারতে জাতীয়তাবাদের বিকাশের মূল্যায়ন –

এভাবে দেশীয় লেখক-সাহিত্যিক এবং চিত্রশিল্পীও বঙ্গচিত্রশিল্পীরা তাঁদের সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করতে সাহায্য করেছেন। কাল্পনিক চরিত্রগুলি তখন মূর্ত হয়ে উঠেছে পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে। দেশবাসীর মানসলোক তখন হয়ে উঠেছে উদবেল।

ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্র ও স্বামী বিবেকানন্দের অবদানের মূল্যায়ন করো।

জাতীয়তাবোধ হল একটি ঐক্যের অনুভূতি। কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী জনগণের মধ্যে জাতি, ধর্ম, ভাষা প্রভৃতি এক বা একাধিক কারণে গভীর ঐক্যবোধের সৃষ্টি হলে গড়ে ওঠে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সেই আদর্শকে যে দুই মহামানব দুর্বার হৃদয়াবেগের উপর প্রতিষ্ঠা করে বাস্তবায়িত হতে সাহায্য করেন, তাঁরা হলেন – ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র ও স্বামী বিবেকানন্দ।

ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান –

জননী ও ‘জন্মভূমি’ যে এক ও অভিন্ন, অর্থাৎ মাতৃভূমিই যে আমাদের মা – এ কথা ভারতবাসী প্রথম যাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করে, তিনি হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

  • দেশাত্মবোধক সাহিত্য রচনা – সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিকাশের অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর রচিত ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রভৃতি উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি জাতীয়তাবাদের প্রচার করেন। ‘আনন্দমঠ’ গ্রন্থটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের গীতা রূপে পরিচিত ছিল।
  • আনন্দমঠ ও জাতীয়তাবাদ – ‘আনন্দমঠ’ গ্রন্থের মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র সর্বপ্রথম –
    • সন্ন্যাসী, ফকির সম্প্রদায়ের ত্যাগ, বৈরাগ্য এবং দেশকে স্বাধীন করার জন্য সবকিছু উৎসর্গ করার আদর্শ প্রচার করেন, যা বিপ্লবীদের মনে সংগ্রামী মানসিকতার জন্ম দেয়।
    • আনন্দমঠের ‘সন্তানদল’ -এর আদর্শ যুবসমাজকে উদবেলিত করে তুলেছিল।
    • দেশকে মা বলে কল্পনা করে এই উপন্যাস স্বদেশপ্রেমের জোয়ার সৃষ্টি করেছিল।
    • আনন্দমঠ উপন্যাসের অন্যতম নারীচরিত্র কল্যাণী ও শান্তির আদর্শে অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ, বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে দেশপ্রেমিকদের আত্মোৎসর্গের কথা তুলে ধরে দেশের যুবসমাজকে দেশপ্রেম ও সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন।
  • বন্দেমাতরম – বঙ্কিমচন্দ্র রচিত ‘বন্দেমাতরম’ সংগীত ছিল ভারতীয় মুক্তি সংগ্রামের মূলমন্ত্র। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের অন্তর্গত এই সংগীতটি ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের প্রাণস্পন্দনরূপে কাজ করেছিল।
  • স্বদেশপ্রেম – বঙ্কিমচন্দ্র ‘বাঙালির বাহুবল’, ‘ধর্মতত্ত্ব’, ‘ভারত কলঙ্ক’ প্রভৃতি প্রবন্ধে জাতীয়তাবাদী মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি সকল ধর্মের উপর স্বদেশপ্রেমকে স্থান দিয়েছেন।
  • ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক – বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদী লেখা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রকৃত জনক বলে অভিহিত করেছেন।

ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ বিকাশে বিবেকানন্দের অবদান –

পরাধীন ভারতের দিশাহারা ও আত্মবিশ্বাসহীন জাতিকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে যারা জাতিকে সঠিক পথের দিশা দেখিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক অগ্রগণ্য হলেন শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ (1863-1902 খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর জাতীয়তাবাদী আদর্শ, স্বদেশ চেতনা ও দেশপ্রেম যুবসমাজকে তীব্র স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর উদাত্ত আহ্বানে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত আপামর ভারতবাসীর হৃদয় আন্দোলিত হয়। ঋষি অরবিন্দের মতে, “বিবেকানন্দই আমাদের জাতীয় জীবনের গঠনকর্তা ও প্রধান নেতা।” অধ্যাপক আর জি প্রধান তাঁকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক বলে অভিহিত করেছেন।

  • যুবশক্তির প্রতি আহ্বান – বিবেকানন্দ মনে করতেন দেশ গঠনে যুবকদের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ভারতীয় যুবকদের লোহার মতো পেশি, বজ্রের মতো মন ও ইস্পাতের মতো চরিত্র চেয়েছিলেন। তিনি যুবকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “ওঠো, জাগো, নিজের লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত থেমো না।”
  • গ্রন্থ রচনা – স্বামী বিবেকানন্দের রচনাগুলি ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশের সহায়ক হয়েছিল। তাঁর রচিত ‘বর্তমান ভারত’, ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’, ‘পরিব্রাজক’ প্রভৃতি গ্রন্থ এবং বিভিন্ন পত্রাবলি বিপ্লবীদের জাতীয়তাবাদী প্রেরণার উৎস ছিল।
  • উপলব্ধি – বিবেকানন্দ উপলব্ধি করেন যে, দেশের প্রকৃত শক্তি হল সাধারণ মানুষ। তিনি মুচি, মেথর, অশিক্ষিত, দরিদ্র ভারতবাসীকে নিজের ভাই সম্বোধন করে সামাজিক ভেদাভেদ দূর করতে সচেষ্ট হন। তিনি বলেছিলেন – “ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী।” তাঁর এই বাণী যুবসমাজের কাছে ছিল প্রাণসঞ্জীবনীস্বরূপ।
  • স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি – স্বামীজির বাণীগুলিতে উদ্দীপ্ত হয়ে ও উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভারতীয় যুবসম্প্রদায় স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গোপাল হালদারের মতে, বাংলাদেশকে যদি কেউ বিপ্লবীমন্ত্রে জাগিয়ে থাকেন, তিনি বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দ বলেন – কেবল সাহসী শক্তিমানরাই স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে।
  • জাতীয়তাবাদের স্বরূপ – স্বামীজির জাতীয়তাবাদে মাতৃভূমির শৃঙ্খলমোচনের পাশাপাশি মানব মুক্তির কথা বলা হয়। স্বামীজি বলেছিলেন – “জগতের ইতিহাস পর্যালোচনা কর, যেখানেই কোন সুমহান আদর্শের সন্ধান মিলিবে, দেখিতে পাইবে উহার জন্ম ভারতবর্ষে।”
  • শিকাগো সম্মেলনে খ্যাতি – বিবেকানন্দ 1893 খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগদান করেন। এই সম্মেলনে তিনি বিশ্বের দরবারে হিন্দুধর্মের উদারতা, মহত্ব, বিশ্বজনীনতা প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি সকল ধর্মসমন্বয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরোধিতা করেন।

1857-র বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলা কতটা যুক্তিসংগত? এই বিদ্রোহে বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মনোভাব কেমন ছিল?

1857-র বিদ্রোহের সর্বভারতীয় চরিত্র না থাকলেও উত্তর ও মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই বিদ্রোহ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে জাতীয় রূপ গ্রহণ করেছিল। ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন যথার্থই বলেছেন, “What began as a fight for religion ended as a war of independence.”

পক্ষে যুক্তি –

  • পূর্ববর্তী বিদ্রোহগুলির তুলনায় 1857-র বিদ্রোহের ব্যাপকতা ও গণসমর্থন ছিল ব্যাপক। পূর্ববর্তী বিদ্রোহগুলিতে এত স্বতঃস্ফূর্ত গণসমর্থন ছিল না।
  • দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ছিলেন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্যের প্রতীক। তাই ধর্মীয় ভাবাবেগ দিয়ে বিদ্রোহ শুরু হলেও পরবর্তীতে তা স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয়।
  • আবুল কালাম আজাদের মতে, আধুনিক জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞায় বিচার করলে একে জাতীয় আন্দোলন বলা না গেলেও বিদ্রোহীদের দেশপ্রেমের খামতি ছিল না।
  • জে. বি. নর্টনের মতে, এই বিদ্রোহ আচমকা ঘটেনি, এর পেছনে স্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল। বলা হয়ে থাকে যে, সাহায্যের আশায় দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ পারস্যের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন।
  • জাতীয়তাবাদ বলতে আমরা যাই বুঝি না কেন, বিদেশি শাসন থেকে মুক্তিলাভের জন্য গড়ে ওঠা গণ অভ্যুত্থানকে জাতীয় সংগ্রাম বলা যেতেই পারে।
  • ঐতিহাসিক কে. এম. পানিক্করের মতে, 1857-র বিদ্রোহের নেতারা নিজ নিজ অঞ্চলের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করে থাকতেন। থাকলেও যে জাতীয় সংগ্রামই করেছিলেন, তা অস্বীকার করা যায় না।

বিপক্ষে যুক্তি – 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলা যায় না, কারণ –

  • বিদ্রোহীদের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, পরিকল্পনা বা সংগঠন ছিল না।
  • ঐক্য বা বোঝাপড়া কেবলমাত্র সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
  • সিপাহিদের সঙ্গে বিদ্রোহী নেতাদের তেমন যোগাযোগ ছিল না।
  • বিদ্রোহের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও নেতাদের মধ্যে লক্ষ্য ও আদর্শের ফারাক ছিল। জাতীয় স্বার্থে বিদ্রোহ পরিচালিত হয়নি।

মূল্যায়ন – পরিশেষে বলা যায়, একটি দেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশের সমস্ত মানুষ অংশ নেবে, এ কথা আশা করা যায় না। এই বিদ্রোহে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ যোগদান করেছিল, তাই একে জাতীয় বিদ্রোহ বলা হয়ে থাকে। তা ছাড়া, বিদ্রোহীদের মধ্যে জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা হয়তো ছিল না, কিন্তু জাতীয়তাবোধ ছিল।

দ্বিতীয় অংশ – দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও অভিজাত শ্রেণির একটা বড়ো অংশ মহাবিদ্রোহ থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে রেখেছিল। উপরন্তু, মহাবিদ্রোহের বিরোধিতা করে আন্দোলনের প্রাণশক্তিকে দুর্বল করেছিল। সেক্ষেত্রে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণিও পিছিয়ে ছিল না। তাদের প্রতিবিপ্লবী মানসিকতা বিদ্রোহীদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল।

কারণ – সমকালীন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণি তথা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বিদ্রোহীদের সাফল্য ও ইংরেজ শাসনের অবসানের মধ্যে প্রাক্-ব্রিটিশ অন্ধকারময় যুগের পুনরাবির্ভাবের সম্ভাবনা দেখেছিলেন। ঐতিহাসিক প্রমোদ দাশগুপ্তের মতে, নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে তথা শ্রেণি স্বার্থে বাঙালি বুদ্ধিজীবী ইংরেজদেরকে সমর্থন করেছিল।

বাঙালি সমাজের ভূমিকা – 1857-র বিদ্রোহ বাংলায় শুরু হলেও বিদ্রোহ থেকে বাঙালি সমাজ ছিল বিচ্ছিন্ন; বাংলায় কিছু অ-বাঙালি নেতৃত্ব দিলেও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ ছিল প্রায় নীরব দর্শক। সমসাময়িক বাঙালি ব্যক্তিত্ব যেমন — অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, রাধাকান্ত দেব প্রমুখরা বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মতো কবি ‘বিদেশি ঠাকুর ছেড়ে স্বদেশি কুকুর পুজোর’ কথা বললেও তিনিও নানাভাবে বিদ্রোহীদের কটাক্ষ করেছিলেন। রাজা রাধাকান্ত দেব বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ায় আনন্দে তাঁর বাগানবাড়িতে সাহেবদের নিয়ে এক ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন। লর্ড ক্যানিং নিজেই স্বীকার করেছেন, সমকালীন বুদ্ধিজীবী সমাজ সরকারকে সহযোগিতা না করলে তাদেরকে তল্পিতল্পা সহ ভারত ছাড়তে হত।র, রাজনারায়ণ বসু, রাধাকান্তদেব প্রমুখরা বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মতো কবি বিদেশি ঠাকুর ছেড়ে স্বদেশি কুকুর পুজোর কথা বললেও তিনিও নানাভাবে বিদ্রোহীদের কটাক্ষ করেছিলেন। রাজা রাধাকান্তদেব বিদ্রোহ ব্যর্থতার উচ্ছ্বাসে তাঁর বাগানবাড়িতে সাহেবদের নিয়ে এক ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন। লর্ড ক্যানিং নিজেই স্বীকার করেছেন, সমকালীন বুদ্ধিজীবী সমাজ সরকারকে সহযোগিতা না করলে তাদেরকে তল্পিতল্পা সহ ভারত ছাড়তে হত।

ব্রিটিশ বিরোধী জনমত গঠনে বাংলার সভা-সমিতিগুলির বিবরণ দাও।

ভূমিকা – দেশের স্বার্থরক্ষা ও সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য সংঘবদ্ধ আন্দোলন প্রয়োজন — ভারতীয়দের এই উপলব্ধি থেকেই উনিশ শতকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কিছু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি ব্রিটিশ বিরোধী জনমত গঠনে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল।

সভাসমিতি – এইরূপ নানা সভাসমিতির মধ্যে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা, জমিদার সভা, হিন্দুমেলা ও ভারত সভা ছিল উল্লেখযোগ্য।

বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা – 1836 খ্রিস্টাব্দে টাকির মুনশি কালীনাথ রায়চৌধুরী, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের যৌথ উদ্যোগে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা গড়ে ওঠে। এর বিভিন্ন সভায় ব্রিটিশদের ভালোমন্দ কাজের পর্যালোচনা করা হত। যোগেশচন্দ্র বাগলের মতে, এটি বাঙালি তথা ভারতবাসীদের মধ্যে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।

জমিদার সভা – 12 নভেম্বর, 1838 খ্রিস্টাব্দে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাধাকান্ত দেব ও প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের যৌথ প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে জমিদার সভা (Land Holders Society)। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতে, এটি ছিল ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের অগ্রদূত। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই জনসাধারণ সর্বপ্রথম নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দাবি আদায়ের শিক্ষা লাভ করে।

হিন্দুমেলা – 1867 খ্রিস্টাব্দে রাজনারায়ণ বসু ও নবগোপাল মিত্রের উদ্যোগে জাতীয় মেলা গড়ে ওঠে, যা 1870 খ্রিস্টাব্দে হিন্দুমেলায় পরিণত হয়। দেশীয় সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির যথার্থ বিকাশের মাধ্যমেই ভারত ও ভারতবাসীর প্রকৃত মঙ্গল সম্ভব — এই চিন্তা থেকেই জন্ম নেয় এই প্রতিষ্ঠানটি। জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় শিল্প ও জাতীয় গৌরব বৃদ্ধি করা এবং এ বিষয়ে দেশবাসীকে অবহিত করাই ছিল হিন্দুমেলার প্রধান কর্মসূচি। প্রখ্যাত জাতীয় নেতা বিপিনচন্দ্র পাল যথার্থই বলেছেন, নবগোপাল মিত্রের কাছেই আমরা জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রেরণা পেয়েছিলাম।

ভারত সভা – গ্রামীণ মধ্যবিত্ত ও রায়তশ্রেণির সদস্যদের নিয়ে 1876 খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু ও শিবনাথ শাস্ত্রীর উদ্যোগে কলকাতার এলবার্ট হলে ভারত সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনে কোনো ইউরোপীয় বা জমিদার শ্রেণির সদস্য ছিল না। তাই ভারত সভা সাধারণ ভারতবাসীর রাজনৈতিক সংগঠনের চরিত্রলাভ করে। এই সভাই সর্বপ্রথম হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ওপর জোর দেয় এবং নিম্নবর্গীয় মানুষদের গণ আন্দোলনে শামিল করে। ভারত সভার নেতৃত্বে ব্রিটিশ প্রবর্তিত অত্যাচারমূলক আইনের বিরুদ্ধে সারা ভারত জুড়ে আন্দোলন গড়ে ওঠে। যেমন — সিভিল সার্ভিস আইনের বিরুদ্ধে, অস্ত্র আইনের বিরুদ্ধে এবং ইলবার্ট বিলের পক্ষে ভারত সভা ব্যাপক আন্দোলন ও জনমত গড়ে তোলে।

উপরিলিখিত সংগঠনগুলি ছাড়াও ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (1839), বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (1840), ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (1851), ইন্ডিয়ান লিগ (1875) প্রভৃতি সভা-সমিতিগুলিও ব্রিটিশ বিরোধী জনমত গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। কেমব্রিজের ঐতিহাসিক ডঃ অনীল শীল যথার্থই মন্তব্য করেছেন, “সমিতির মাধ্যমেই ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারত আধুনিক রাজনীতির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে।” (Association brought 19th century India across the threshold of modern politics)। আর এই কারণেই তিনি উনিশ শতককে “সভাসমিতির যুগ” (Age of Associations) বলে উল্লেখ করেছেন।

জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভারত সভার ভূমিকা আলোচনা করো।

1876 খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু প্রমুখের দ্বারা ভারত সভা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি ছিল একটি সর্বভারতীয় সংগঠন।

জাতীয়তাবাদের বিকাশে ভারত সভার ভূমিকা – ভারতে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশে ভারত সভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এগুলি হল —

  1. সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন – ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই প্রতিষ্ঠানের 124টি শাখা গড়ে উঠেছিল। এগুলির মাধ্যমে ভারত সভা সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন গড়ে তোলে।
  2. রাজনৈতিক ঐক্যসাধন – ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য সাধন ছিল ভারত সভার ঘোষিত লক্ষ্য।
  3. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলা – হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য ভারত সভা জোর দিয়েছিল।
  4. জনমত গঠন – ব্রিটিশ সরকারের জনবিরোধী আইনের বিরুদ্ধে ভারত সভা জনমত গঠনের ওপর জোর দিত।
  5. জাতীয়তাবাদের উন্মেষ – বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই সভা ভারতীয় জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায়।
  6. ইলবার্ট বিলের সমর্থন – ইলবার্ট বিলের সমর্থনে সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ভারত সভা দেশের নানা স্থানে জনসভা করে গণআন্দোলন গড়ে তোলে।

মূল্যায়ণ – এই সভাই ছিল আধুনিক ভারতবর্ষের প্রথম সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ ও বিকাশ ভারত সভার হাত ধরেই ঘটেছিল। আর এই কারণে সুরেন্দ্রনাথ ‘রাষ্ট্রগুরু’ আখ্যায় ভূষিত হয়েছেন।

সুরেন্দ্রনাথ কর্তৃত্ব আয়োজিত সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলনের গুরুত্ব বর্ণনা করো।

1883 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক কলকাতায় প্রথম সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা হয়।

প্রস্তাবসমূহ – এই সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলি হল —

  • প্রতিনিধিমূলক আইনসভা গঠন
  • ব্রিটেন ও ভারতে একইসঙ্গে আই.সি.এস. (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষা গ্রহণ এবং পরীক্ষার্থীদের বয়সসীমা 19 বছর থেকে বাড়িয়ে 21 বছর করা
  • সরকারি চাকুরির ভারতীয়করণ
  • অস্ত্র আইন শিথিল করা
  • সামরিক খাতে ব্যয় হ্রাস
  • বিচারবিভাগ থেকে শাসনবিভাগের পৃথকীকরণ প্রভৃতি।

গুরুত্ব – জাতীয় সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যেমন —

  • এটি ছিল ইলবার্ট বিল সম্পর্কে ইংরেজদের প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলনের বিরুদ্ধে শিক্ষিত ভারতবাসীর যোগ্য প্রত্যুত্তর
  • এই জাতীয় সম্মেলন থেকেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠনের প্রেরণা আসে
  • আনন্দমোহন বসুর মতে, এই সম্মেলন ছিল জাতীয় পার্লামেন্টের দিকে প্রথম পদক্ষেপ।

ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ বিশ্লেষণ করো।

অথবা, উনিশ শতকে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় চেতনার উন্মেষের কারণগুলি আলোচনা করো।

ভূমিকা – জাতীয় চেতনা থেকেই জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ার দিকে ভারতে কোনো জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিল না। বিদেশি শাসনের অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবেই আধুনিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ শুরু হয়।

ইউরোপীয় প্রভাব – উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে ইউরোপ ও বহির্বিশ্বের নানা রাজনৈতিক ঘটনাবলি ভারতবাসীদের মনে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার ঘটিয়েছিল। যেমন —

  • আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (1774 খ্রি.)
  • ফরাসি বিপ্লব (1789 খ্রি.) এবং
  • জাপানের সাফল্য ও অগ্রগতি ভারতীয়দের স্বাধীন চিন্তাশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
  • ইতালির ঐক্য আন্দোলন ভারতবাসীকে অনুসরণযোগ্য পথ দেখায়।
  • তা ছাড়া রাশিয়ার নিহিলিস্ট আন্দোলনও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এইসব ঘটনাপ্রবাহ ভারতে জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়ক হয়েছিল।

ভারতীয় প্রেক্ষাপট – ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর (1757 খ্রিঃ) থেকেই নানা ঘটনাবলির ঘনঘটায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও পূর্ণতা আসে, যেমন —

  1. ব্রিটিশ অপশাসন – ব্রিটিশ অপশাসনের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের সর্বস্তরের মানুষের মনে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল। এই অসন্তোষ থেকেই জাতীয় চেতনা জাগ্রত হতে থাকে। যার পরিণতি জাতীয়তাবাদের বিকাশ।
  2. পাশ্চাত্য শিক্ষা – পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি বহির্বিশ্বের নানা ঘটনাবলির দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব গড়ে ওঠে।
  3. অর্থনৈতিক শোষণ – ব্রিটিশ শাসন ও শোষণে ভারতের অর্থনৈতিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসক ভারতের অর্থনৈতিক সংকট মোচনের কোনো সুব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী মনোভাব গড়ে ওঠে।
  4. বৈষম্যমূলক নীতি – ব্রিটিশ শাসকেরা জাতিগত দিক থেকে ভারতীয়দের তুলনায় নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। এই শাসনব্যবস্থার প্রতি ক্ষেত্রে ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ লক্ষ্য করা যেত। এর ফলে উভয়ের মধ্যে জাতিগত বিদ্বেষ বাড়তে থাকে। ইলবার্ট বিল বিতর্ক ছিল এর জ্বলন্ত উদাহরণ, যা শিক্ষিত ভারতীয়দের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
  5. সিপাহি বিদ্রোহের প্রভাব – সিপাহি বিদ্রোহের পর মহারানির তরফে যে প্রতিশ্রুতিগুলি ভারতীয়দের দেওয়া হয়েছিল, তা পালন করা হয়নি। ফলে উভয়ের মধ্যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়। ভারতীয়রা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে পড়ে। এর ফলে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ভারতীয়দের ঘৃণা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
  6. ভারতের মনীষীদের প্রভাব – ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসে ভারতীয়দের মনে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। এক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দয়ানন্দ সরস্বতী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ মনীষীদের রচনাবলি শিক্ষিত ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করেছিল।
  7. সংবাদপত্র ও সাহিত্যের ভূমিকা – প্রখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ ডঃ এ. আর. দেশাই-এর মতে, সংবাদপত্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। ভারতের জাতীয়তাবাদের বিকাশে সাহিত্য ও নাটকের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। তখনকার দিনের নাটক ও সাহিত্যের মূল বক্তব্য ছিল দেশপ্রেম জাগ্রত করা। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সূর্যের দেশ ও শাহজাহানমেবার পতন ছাড়াও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (পদ্মিনী উপাখ্যান) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়।
  8. সভাসমিতি – বাংলায় জাতীয়তাবোধ উন্মেষে ঊনবিংশ শতকের গড়ে ওঠা সভাসমিতিগুলির গুরুত্ব উপেক্ষা করা যায় না। এই রাজনৈতিক সভাসমিতির চূড়ান্ত পরিণতি ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা, যা স্বাধীনতা পর্যন্ত ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলন পরিচালনা করেছিল।

মূল্যায়ণ – এইভাবে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে বিভিন্ন ঘটনা ও ভাবধারার প্রভাবে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। তবে এই জাতীয়তাবাদের পশ্চাতে ছিল সর্বভারতীয় ঐক্যের চেতনা।

ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসের ভূমিকা ব্যাখ্যা করো।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর উত্তর রচনাবলির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের প্রচার করেছিলেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে অমরকীর্তি হল আনন্দমঠ উপন্যাস। 1882 খ্রিস্টাব্দে এটি প্রকাশিত হয়। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি ও জীবনবোধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্বদেশপ্রীতি।

জাতীয়তাবাদী চেতনায় আনন্দমঠ – ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষে আনন্দমঠ ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ এক জাতীয়তাবাদী উপন্যাস; কারণ —

  • স্বদেশপ্রেম – বঙ্কিমচন্দ্র রচিত আনন্দমঠ উপন্যাস জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে দেশবাসীর মনে স্বাদেশিকতা ও সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ধারণা সঞ্চারিত করেছিল। স্বদেশপ্রেম যে শ্রেষ্ঠধর্ম, একথা আনন্দমঠ উপন্যাসের সন্তানদলের মুখে উচ্চারিত হয়েছিল।
  • বন্দেমাতরম সংগীত – আনন্দমঠ উপন্যাসের বন্দেমাতরম সংগীতটি (1875 খ্রি.) ছিল পরাধীন ভারতের জাতীয় সংগীত ও বিপ্লবীদের মন্ত্র। জন্মভূমিকে মাতৃরূপে কল্পনা করা এই সংগীতের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য। এই গানে বঙ্কিমচন্দ্র দেশকে ভৌগোলিক সত্তারূপে বিচার না করে একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্ররূপে দেখেছেন।
  • দেশমাতার আদর্শ – আনন্দমঠে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, দেশমাতা হলেন মা, দেশপ্রেম হল ধর্ম, দেশসেবা হল পূজা।
  • স্ববিরোধিতা – আনন্দমঠে বঙ্কিমচন্দ্র সচেতনভাবে জানিয়েছেন যে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব, ডাকাতি, দস্যুবৃত্তি হল অমলালের নামান্তর, কারণ ইংরেজ রাজত্বে সনাতন সামন্ত সমাজ অটুট থাকবে। সুতরাং ইংরেজ রাজ্যে প্রজা সুখী হবে ও নিষ্কণ্টকে ধর্মাচরণ করবে। যদিও এটি ছিল বিভ্রান্তিকর মন্তব্য।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অঙ্কিত ভারতমাতা চিত্রটি বিখ্যাত কেন?

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভাসমিতি, জাতীয়তাবাদী সাহিত্য এবং চিত্র ও ব্যঙ্গচিত্রও ভারতের জাতীয়তাবাদে সাহায্য করেছিল। এ প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অঙ্কিত ভারতমাতা চিত্রটি ছিল খুব উল্লেখযোগ্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশীয় ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে স্বদেশি আন্দোলনকালে চিত্র অঙ্কনে এক নতুন ঘরানার সৃষ্টি করেন। তার অঙ্কিত এরূপ একটি চিত্র ছিল ভারতমাতা। এই ছবিতে দেখা যায় যে —

  • বিষয়বস্তু – ভারতমাতা হলেন গেরুয়া বসন পরিহিতা এক যোগিনী মূর্তি। তিনি একাধারে দেবী ও মানবী। তিনি বরাভয়দায়িনী এবং ত্যাগ ও বৈরাগ্যের মূর্ত প্রতীক। ভারতমাতার চার হাতে শোভা পাচ্ছে রুদ্রাক্ষের মালা, শুভ্রবস্ত্র, পুঁতি ও ধানশীষ। পদযুগলের চারপাশে রয়েছে শ্বেতপদ্ম।
  • তাৎপর্য – ভারতমাতা ছবিটির মাধ্যমে শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধনধান্যপূর্ণ সমৃদ্ধশালী ভারতের ছবি তুলে ধরেন। এই ছবির মাধ্যমে ভারতের আধ্যাত্মবাদ, নারীশক্তি, ঐতিহ্য ও শস্যশ্যামল অর্থনীতির কথা ফুটে উঠেছে।
  • প্রভাব – বিশ শতকে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সংগঠন ও প্রসারে ভারতমাতা চিত্রটির প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য, কারণ স্বদেশি যুগে বিভিন্ন সভা, সমাবেশে এই চিত্রটি সজ্জিত হত। ভগিনী নিবেদিতার মতে চিত্রটি ছিল জাতীয়তাবাদ প্রসারের ক্ষেত্রে প্রথম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ছবি।

উপসংহার – বাঙালির জাতীয়তা গঠন ও দেশের যুব সম্প্রদায়কে স্বদেশভক্তি, ত্যাগ ও সেবাধর্মে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যেই রচিত হয়েছিল আনন্দমঠ। আনন্দমঠের অবদান বাঙালি জাতির জাতীয় জীবন গঠনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

ভারতের জাতীয়তাবাদের উন্মেষে বিবেকানন্দের রচিত ‘বর্তমান ভারত’ প্রবন্ধটির অবদান ব্যাখ্যা করো।

বিবেকানন্দ প্রকাশ্য রাজনীতি না করলেও তাঁর বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ ভাবধারার সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদী নবভারত গঠনের আদর্শ প্রচার করেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে ‘বর্তমান ভারত’ প্রবন্ধটি উল্লেখযোগ্য, যা ভারতের জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়ক হয়েছিল।

জাতীয়তাবাদ উন্মেষে ‘বর্তমান ভারত’-এর ভূমিকা –

স্বদেশ চেতনা – বর্তমান ভারতে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের মৃত্তিকা আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী — বল ভাই ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ।” এই উক্তির মাধ্যমে বিবেকানন্দ স্বদেশ চেতনা ও দেশপ্রেম জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন।

সামাজিক সংহতি – সমাজের অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ প্রথা নিরসনের জন্য বিবেকানন্দ (বর্তমান ভারতে) বলেছেন, “ভুলিও না নীচ জাতি, মুর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি-মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই।” বিবেকানন্দের এই তেজোদীপ্ত বাণী বিপ্লবীদের অন্তরে গভীর প্রেরণা সৃষ্টি করেছিল।

দেশের জন্য আত্মত্যাগের আহ্বান – বর্তমান ভারতে প্রকাশ পেয়েছে, “হে ভারত ভুলিও না—তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত, ভুলিও না – তোমার সমাজ যে বিরাট মহামায়ার ছায়ামাত্র। হে বীর, সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বল — আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই।”

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কীভাবে তাঁর অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক সমাজচিত্র তুলে ধরেন?

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠভ্রাতা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রশিল্পে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সমকালীন সমাজ ও সময়ের ছবিকে তিনি তুলির টানে ব্যঙ্গাত্মক রূপে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি ছিলেন রবি বর্মার সমকালীন চিত্রকর। বাংলায় তিনিই প্রথম ব্যঙ্গচিত্রকর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত প্রবাসী ও মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় গগনেন্দ্রনাথের অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্রগুলি প্রকাশিত হত। তাঁর ব্যঙ্গচিত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি ফুটে উঠেছে –

  • বিদেশি শাসনের সমালোচনা – বিদেশি শাসকদের কটাক্ষ করা হয়; একইভাবে সমাজের নানা অসংগতি ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিমায় চিত্রিত হয়।
  • মানব চরিত্র – ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে মাথা নোয়ানো মানুষ বা শহুরে জীবনের কৃত্রিম সাহেবিয়ানার মতো বিষয়গুলি তাঁর শ্লেষাত্মক কার্টুনে বিদ্ধ হয়। গগনেন্দ্রনাথ তোষামোদে বিশ্বাস করতেন না, ফলে তাঁর ব্যঙ্গচিত্র ঔপনিবেশিক সমাজের সমালোচনার প্রতিফলন হয়ে উঠেছিল।
  • দেশীয় মনীষীদের চিত্র – বিদেশি শাসকদের পাশাপাশি দেশীয় নেতারাও তাঁর ব্যঙ্গচিত্রের বিষয় হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর আবিষ্কার, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের গবেষণা, রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিমানযাত্রা বা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ ইত্যাদি নিয়ে অঙ্কিত কার্টুনগুলি ইতিহাসের অমূল্য দলিল। আনন্দের বিষয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর নামে ‘গগনেন্দ্র প্রদর্শনীশালা’ গড়ে তুলেছে।

উপসংহার – বিবেকানন্দ ‘বর্তমান ভারত’-এ দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে তার মুক্তির জন্য সর্বস্তরের মানুষের আত্মোৎসর্গের আদর্শ প্রচার করেন। তাঁর প্রেরণায় দেশপ্রেম ধর্মের বিকল্প হয়ে উঠেছিল এবং এই চিন্তাধারা পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলনে গভীর প্রভাব ফেলে।


আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় “সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” এর “ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।

আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।

ধন্যবাদ সবাইকে।

Please Share This Article

Related Posts

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস - বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা - ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

মেঘাচ্ছন্নতা বলতে কী বোঝো মেঘ কীভাবে সৃষ্টি হয় -

মেঘাচ্ছন্নতা বলতে কী বোঝো? মেঘ কীভাবে সৃষ্টি হয়?

About The Author

Solution Wbbse

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

মেঘাচ্ছন্নতা বলতে কী বোঝো? মেঘ কীভাবে সৃষ্টি হয়?

শিশির ও শিশিরাঙ্ক কাকে বলে?

মোপলা বিদ্রোহের কারণ কী?