উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। এই জাতীয়তাবাদের উন্মেষে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণ ভূমিকা পালন করে। এই অধ্যায়ে আমরা সংঘবব্ধতার গোড়ার কথার বিভিন্ন দিক আলোচনা করব।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র বিশ্লেষণ করো।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ভারতের ইতিহাসে একটি অসাধারণ ঘটনা ছিল। এটি ব্রিটিশ শাসনে বিপ্লব উত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে পরিগণিত হয়।
ভূমিকা –
১৮৫৭-র বিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রবল মতানৈক্য রয়েছে। বিদ্রোহের সময়কাল থেকে অদ্যাবধি নানা সময়ে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহাসিকরা এই বিদ্রোহের চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন।
প্রকৃতি –
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতির বিভিন্ন দিকগুলি হল —
সিপাহি বিদ্রোহ –
ম্যালেসন, জন. কে, স্যার জন লরেন্স, পি. ই. রবার্টস প্রমুখ ইংরেজ ঐতিহাসিকরা এই বিদ্রোহকে নিছক সিপাহি বিদ্রোহ ছাড়া আর কিছু মনে করেন না। সমসাময়িক ভারতীয় লেখক স্যার সৈয়দ আহমদ খান, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, কিশোরচাঁদ মিত্র, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ এই বিদ্রোহকে সিপাহি ও স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের দ্বারা সংগঠিত বিদ্রোহ বলে মনে করেছেন। কারণ এতে জনগণের সংযোগ ছিল গৌণ; সিপাহিরা নিজেদের অধিক সুযোগসুবিধা আদায়ের জন্য বিদ্রোহ করেছিল।
জাতীয় বিদ্রোহ
জে. বি. নর্টন, উইলিয়াম কে এবং ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ আলেকজান্ডার ডাফ প্রমুখ ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ উত্তর ও মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল এবং তারা মনে প্রাণে ব্রিটিশ বিতাড়ন চেয়েছিল। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ছিলেন ভারতের জাতীয় সম্রাট জাতীয়তার প্রতীক, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক।
ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম – প্রখ্যাত বিপ্লবী বিনায়ক দামোদর সাভারকার The Indian war of Inde pendence গ্রন্থে ১৮৫৭ -র বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন। কারণ ইংরেজ বিরোধী এত ব্যাপক আন্দোলন ইতিপূর্বে ভারতে আর ঘটেনি বলে এটিই ছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম।
সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া – বামপন্থী চিন্তাবিদ রজনীপাম দত্ত, এম. এন. রায় প্রমুখ এই বিদ্রোহকে রক্ষণশীল ও সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলির অভ্যুত্থান বলে উল্লেখ করেছেন। অধ্যাপক সুশোভন সরকারও এই বিদ্রোহের সামন্ততান্ত্রিক চরিত্র স্বীকার করে নিয়েছেন।
সাম্প্রদায়িক আন্দোলন – আলফ্রেড লায়াল প্রমুখ তৎকালীন অনেক ইংরেজ কর্মচারী ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে সাম্প্রদায়িক আন্দোলন বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কারণ সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে এর সূচনা ঘটেছিল।
সংশোধনবাদী মতামত – প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার ও সুরেন্দ্রনাথ সেন ১৮৫৭-র বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বহু তথ্য সংকলিত করে এই বিদ্রোহের ওপর নতুন করে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন। ডঃ মজুমদারের রচিত গ্রন্থটির নাম The Sepoy Mutiny and the Revolt of 1857 এবং ডঃ সেন রচিত গ্রন্থটির নাম Eighteen Fifty Seven
রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত – ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে ডঃ মজুমদার সিপাহিদের বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, এই বিদ্রোহ ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েনি। সকল শ্রেণির জনগণও এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেনি। তাঁর মতে, ১৮৫৭-র তথাকথিত প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ না ছিল প্রথম, না ছিল জাতীয়, না ছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ (The so called First National War of Independence in 1857 is neither First, nor National, nor a war of Independence)।
ডা. সেনের মতামত – ডা. সেন এর মতে, ১৮৫৭-র বিদ্রোহ সিপাহি বিদ্রোহ হিসেবে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা গণবিদ্রোহে পরিণত হয়। দিল্লি, অযোধ্যা, বিহার প্রভৃতি অঞ্চলে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল সর্বাধিক। যে সকল অঞ্চলে জনগণের সমর্থন ছিল সেসব অঞ্চলের বিদ্রোহী নেতাদের লক্ষ্য ছিল প্রতিবিপ্লব ঘটানো।
উপসংহার – কেমব্রিজ ঐতিহাসিক সি. এ. বেইলির মতে, ১৮৫৭-র ভারতীয় বিদ্রোহ কেবল একটি আন্দোলন নয় বা কৃষক অভ্যুত্থান নয় বা জাতীয় বিদ্রোহ নয়, এর মধ্যে আরও অনেক কিছুই ছিল (The Indian rebellion of 1857 was not one movement, be it a peasant movement, or a war of national liberation, it was many.)।
১৮৫৭-র বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলা কতটা যুক্তিসংগত? এই বিদ্রোহে বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মনোভাব কেমন ছিল?
প্রথম অংশ – ১৮৫৭-র বিদ্রোহের সর্বভারতীয় চরিত্র না থাকলেও উত্তর ও মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই বিদ্রোহ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে জাতীয় রূপ গ্রহণ করেছিল। ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন যথার্থই বলেছেন, What began as a fight for religion ended as a war for Independence.
পক্ষে যুক্তি –
- পূর্ববর্তী বিদ্রোহগুলির তুলনায় ১৮৫৭-র বিদ্রোহের ব্যাপকতা ও গণসমর্থন ছিল ব্যাপক। পূর্ববর্তী বিদ্রোহগুলিতে এত স্বতঃস্ফূর্ত গণসমর্থন ছিল না।
- দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ছিলেন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্যের প্রতীক। তাই ধর্মীয় ভাবাবেগ দিয়ে বিদ্রোহ শুরু হলেও পরবর্তীতে তা স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয়।
- আবুল কালাম আজাদের মতে, আধুনিক জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞায় বিচার করলে একে জাতীয় আন্দোলন বলা না গেলেও বিদ্রোহীদের দেশপ্রেমের খামতি ছিল না।
- জে. বি. নর্টনের মতে, এই বিদ্রোহ আচমকা ঘটেনি, এর পেছনে স্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল। বলা হয়ে থাকে যে, সাহায্যের আশায় দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ পারস্যের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন।
- জাতীয়তাবাদ বলতে আমরা যাই বুঝি না কেন বিদেশি শাসন থেকে মুক্তিলাভের জন্য গড়ে ওঠা গণ অভ্যুত্থানকে জাতীয় সংগ্রাম বলা যেতেই পারে।
- ঐতিহাসিক কে. পানিক্কর – এর মতে, ১৮৫৭-র বিদ্রোহের নেতারা নিজ নিজ অঞ্চলের স্বাধীনতার কথা চিন্তাকরে থাকতেন। থাকলেও যে জাতীয় সংগ্রামই করেছিলেন তা অস্বীকার করা যায় না।
বিপক্ষে যুক্তি – ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলা যায় না, কারণ –
- বিদ্রোহীদের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, পরিকল্পনা বা সংগঠন ছিল না।
- ঐক্য বা বোঝাপড়া কেবলমাত্র সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
- সিপাহিদের সঙ্গে বিদ্রোহী নেতাদের তেমন যোগাযোগ ছিল না।
- বিদ্রোহের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও নেতাদের মধ্যে লক্ষ্য ও আদর্শের ফারাক ছিল। জাতীয় স্বার্থে বিদ্রোহ পরিচালিত হয়নি।
মূল্যায়ন – পরিশেষে বলা যায়, একটি দেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশের সমস্ত মানুষ অংশ নেবে এ কথা আশা করা যায় না। এই বিদ্রোহে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ যোগদান করেছিল, তাই একে জাতীয় বিদ্রোহ বলা হয়ে থাকে। তা ছাড়া বিদ্রোহীদের মধ্যে জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা হয়তো ছিল না, কিন্তু জাতীয়তাবোধ ছিল।
দ্বিতীয় অংশ – দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও অভিজাত শ্রেণির একটা বড়ো অংশ মহাবিদ্রোহ থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে রেখেছিল। উপরন্তু মহাবিদ্রোহের বিরোধিতা করে আন্দোলনের প্রাণশক্তিকে দুর্বল করেছিল। সেক্ষেত্রে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণিও পিছিয়ে ছিল না। তাদের প্রতিবিপ্লবী মানসিকতা বিদ্রোহীদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল।
কারণ – সমকালীন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণি তথা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বিদ্রোহীদের সাফল্য ও ইংরেজ শাসনের অবসানের মধ্যে প্রাক্-ব্রিটিশ অন্ধকারময় যুগের পুনরাবির্ভাবের সম্ভাবনা দেখেছিলেন। ঐতিহাসিক প্রমোদ দাশগুপ্তের মতে, নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে তথা শ্রেণি স্বার্থে বাঙালি বুদ্ধিজীবী ইংরেজদেরকে সমর্থন করেছিল।
বাঙালি সমাজের ভূমিকা – ১৮৫৭-র বিদ্রোহ বাংলায় শুরু হলেও বিদ্রোহ থেকে বাঙালি সমাজ ছিল বিছিন্ন, বাংলায় কিছু অ-বাঙালি নেতৃত্ব দিলেও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ ছিল প্রায় নীরব দর্শক। সমসাময়িক বাঙালি ব্যক্তিত্ব যেমন — অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, রাধাকান্তদেব প্রমুখরা বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মতো কবি বিদেশি ঠাকুর ছেড়ে স্বদেশি কুকুর পুজোর কথা বললেও তিনিও নানাভাবে বিদ্রোহীদের কটাক্ষ করেছিলেন। রাজা রাধাকান্তদেব বিদ্রোহ ব্যর্থতার উচ্ছ্বাসে তাঁর বাগানবাড়িতে সাহেবদের নিয়ে এক ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন। লর্ড ক্যানিং নিজেই স্বীকার করেছেন, সমকালীন বুদ্ধিজীবী সমাজ সরকারকে সহযোগিতা না করলে তাদেরকে তল্পিতল্পা সহ ভারত ছাড়তে হত।
ব্রিটিশ বিরোধী জনমত গঠনে বাংলার সভা সমিতিগুলির বিবরণ দাও।
ভূমিকা – দেশের স্বার্থরক্ষা ও সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য সংঘবদ্ধ আন্দোলন প্রয়োজন — ভারতীয়দের এই উপলব্ধি থেকেই উনিশ শতকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কিছু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি ব্রিটিশ বিরোধী জনমত গঠনে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল।
সভাসমিতি – এইরূপ নানা সভাসমিতির মধ্যে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা, জমিদার সভা, হিন্দুমেলা ও ভারত সভা ছিল উল্লেখযোগ্য।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা – ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে টাকির মুনশি কালীনাথ রায়চৌধুরী, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের যৌথ উদ্যোগে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা গড়ে ওঠে। এর বিভিন্ন সভায় ব্রিটিশদের ভালোমন্দ কাজের পর্যালোচনা করা হত। যোগেশচন্দ্র বাগলের মতে, এটি বাঙালি তথা ভারতবাসীদের মধ্যে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
জমিদার সভা – ১২ নভেম্বর ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাধাকান্তদেব ও প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের যৌথ প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে জমিদার সভা (Land Holders Society)। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতে, এটি ছিল ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের অগ্রদূত। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই জনসাধারণ সর্বপ্রথম নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দাবি আদায়ের শিক্ষা লাভ করে।
হিন্দুমেলা – ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে রাজনারায়ণ বসু ও নবগোপাল মিত্রের উদ্যোগে জাতীয় মেলা গড়ে ওঠে, যা ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুমেলায় পরিণত হয়। দেশীয় সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির যথার্থ বিকাশের মাধ্যমেই ভারত ও ভারতবাসীর প্রকৃত মঙ্গল সম্ভব — এই চিন্তা থেকেই জন্ম নেয় এই প্রতিষ্ঠানটি। জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় শিল্প ও জাতীয় গৌরব বৃদ্ধি করা এবং এ বিষয়ে দেশবাসীকে অবহিত করাই ছিল হিন্দুমেলার প্রধান কর্মসূচি। প্রখ্যাত বিপ্লবী বিপিনচন্দ্র পাল যথার্থই বলেছেন, নব গোপাল মিত্রের কাছেই আমরা জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রেরণা পেয়েছিলাম।
ভারত সভা – গ্রামীণ মধ্যবিত্ত ও রায়তশ্রেণির সদস্যদের নিয়ে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ২৬ জুলাই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু ও শিবনাথ শাস্ত্রীর সহায়তায় কলকাতার এল বার্ট হলে ভারত সভা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনে কোনো ইউরোপীয় বা জমিদার শ্রেণির সদস্য ছিল না। তাই ভারত সভা সাধারণ ভারতবাসীর রাজনৈতিক সংগঠনের চরিত্রলাভ করে। এই সভাই সর্বপ্রথম হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ওপর জোর দেয় এবং নিম্নবর্গীয় মানুষদের গণ আন্দোলনে শামিল করে। ভারত সভার নেতৃত্বে ব্রিটিশ প্রবর্তিত অধ্যায়মূলক আইনের বিরুদ্ধে সারা ভারত জুড়ে আন্দোলন গড়ে ওঠে। যেমন — সিভিল সার্ভিস আইনের বিরুদ্ধে, অস্ত্র আইনের বিরুদ্ধে, ইলবার্ট বিলের পক্ষে ভারত সভা ব্যাপক আন্দোলন ও জনমত গড়ে তোলে।
উপরিলিখিত সংগঠনগুলি ছাড়াও ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (১৪৩৯), বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (১৮৪০), ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৫১), ইন্ডিয়ান লিগ (১৮৭৫) প্রভৃতি সভাসভাসমিতিগুলিও ব্রিটিশ বিরোধী জামত গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। কেমব্রিজ ঐতিহাসিক ডঃ অনীল শীল যথার্থই মন্তব্য করেছেন, সমিতির মাধ্যমেই ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারত আধুনিক রাজনীতির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। (Association brought 19th century India across the threshold of modern politics)। আর এই কারণেই তিনি উনিশ শতককে সভাসমিতির যুগ (Age of Associations) বলে উল্লেখ করেছেন।
জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভারত সভার ভূমিকা আলোচনা করো। সুরেন্দ্রনাথ কর্তৃত্ব আয়োজিত সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলনের গুরুত্ব বর্ণনা করো।
প্রথম অংশ – ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, ভারত সভা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল একটি সর্বভারতীয় সংগঠন।
জাতীয়তাবাদের বিকাশের ভারত সভার ভূমিকা – ভারতে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশে ভারতসভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এগুলি হল —
- সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন – ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই প্রতিষ্ঠানের ১২৪টি শাখা গড়ে উঠেছিল। এগুলির মাধ্যমে ভারত সভা সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন গড়ে তোলে।
- রাজনৈতিক ঐক্যসাধন – ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থে ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য সাধন ছিল ভারত সভার ঘোষিত লক্ষ্য।
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলা – হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য ভারত সভা জোর দিয়েছিল।
- জনমত গঠন – ব্রিটিশ সরকারের জনবিরোধী আইনের বিরুদ্ধে ভারত সভা জনমত গঠনের ওপর জোর দিল।
- জাতীয়তাবাদের উন্মেষ – বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই সভা ভারতীয় জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায়।
- ইলবার্ট বিলের সমর্থন – ইলবার্ট বিলের সমর্থনে সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ভারত সভা দেশের নানা স্থানে জনসভা করে গণআন্দোলন গড়ে তোলে।
মূল্যায়ণ – এই সভাই ছিল আধুনিক ভারতবর্ষের প্রথম সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ ও বিকাশ ভারত সভার হাত ধরেই বিকশিত হয়েছিল। আর এই কারণে সুরেন্দ্রনাথ রাষ্ট্রগুরু আখ্যায় ভূষিত হয়েছেন।
দ্বিতীয় অংশ – ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় প্রথম সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন।
প্রস্তাবসমূহ – এই সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলি হল —
- প্রতিনিধিমূলক আইনসভা গঠন
- ব্রিটেন ও ভারতে একইসঙ্গে I. C. S. (Indian Civil Service) পরীক্ষা গ্রহণ এবং পরীক্ষার্থীদের বয়স ২১ বছর করা
- সরকারি চাকুরির ভারতীয়করণ
- অস্ত্র আইন রোধ করা
- সামরিক খাতে ব্যয় হ্রাস
- বিচারবিভাগ থেকে শাসনবিভাগের পৃথকীকরণ প্রভৃতি।
গুরুত্ব – জাতীয় সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যেমন –
- প্রথম সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন ছিল ইলবার্ট বিল সম্পর্কে ইংরেজদের প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলনের বিরুদ্ধে শিক্ষিত ভারতবাসীর যোগ্য প্রত্যুত্তর
- এই জাতীয় সম্মেলন থেকেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠনের প্রেরণা আসে
- আনন্দমোহন বসুর মতে, এই সম্মেলন ছিল জাতীয় পার্লামেন্টের দিকে প্রথম পদক্ষেপ।
ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ বিশ্লেষণ করো।
অথবা, উনিশ শতকে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় চেতনার উন্মেষের কারণগুলি আলোচনা করো।
ভূমিকা – জাতীয় চেতনা থেকেই জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ার দিকে ভারতে কোনো জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিল না। বিদেশি শাসনের অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবেই আধুনিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ শুরু হয়।
ইউরোপীয় প্রভাব – উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে ইউরোপ ও বহির্বিশ্বের নানা রাজনৈতিক ঘটনাবলি ভারতবাসীদের মনে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার ঘটিয়েছিল। যেমন —
- আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৪ খ্রি.)
- ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রি.) এবং
- জাপানের সাফল্য ও অগ্রগতি ভারতীয়দের স্বাধীন চিন্তা শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- ইতালির ঐক্য আন্দোলন ভারতবাসীকে অনুসরণযোগ্য পথ দেখায়।
- তা ছাড়া রাশিয়ার নিহিলিস্ট আন্দোলনও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এইসব ঘটনাপ্রবাহ ভারতে জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়ক হয়েছিল।
ভারতীয় প্রেক্ষাপট – ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর (১৭৫৭ খ্রিঃ) থেকেই নানা ঘটনাবলির ঘনঘটায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও পুরিপুষ্টতা আসে, যেমন —
ব্রিটিশ অপশাসন – ব্রিটিশ অপশাসনের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের সর্বস্তরের মানুষের মনে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল। এই অসন্তোষ থেকেই জাতীয় চেতনা জাগ্রত হতে থাকে। যার পরিণতি জাতীয়তাবাদের বিকাশ।
পাশ্চাত্য শিক্ষা – পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি বহির্বিশ্বের নানা ঘটনাবলির দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব জাগ্রত হতে থাকে।
অর্থনৈতিক শোষণ – ব্রিটিশ শাসন ও শোষণে ভারতের অর্থনৈতিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসক ভারতের অর্থনৈতিক সংকট মোচনের কোনো সুব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী মনোভাব গড়ে ওঠে।
বৈষম্যমূলক নীতি – ব্রিটিশ শাসকেরা জাতিগত দিক থেকে ভারতীয়দের তুলনায় নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। এই শাসন ব্যবস্থার প্রতি ক্ষেত্রে ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ লক্ষ্য করা যেত। এর ফলে উভয়ের মধ্যে জাতিবিদ্বেষ বাড়তে থাকে। ইলবার্ট বিল বিতর্ক ছিল। এর জ্বলন্ত উদাহরণ যা শিক্ষিত ভারতীয়দের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
সিপাহি বিদ্রোহের প্রভাব – সিপাহি বিদ্রোহের পর মহারানির তরফে যে প্রতিশ্রুতিগুলি ভারতীয়দের দেওয়া হয়েছিল তা পালন করা হয়নি। ফলে উভয়ের মধ্যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়। ভারতীয়রা নিজ দেশে পরবাসী হয়। এর ফলে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ভারতীয়দের ঘৃণা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ভারতের মনীষীদের প্রভাব – ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি ও জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসে ভারতীয়দের মনে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। এক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দয়ানন্দ সরস্বতী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ মনীষীদের রচনাবলি শিক্ষিত ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করেছিল।
সংবাদপত্র ও সাহিত্যের ভূমিকা – প্রখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ ডঃ এ. আর দেশাই – এর মতে সংবাদপত্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। ভারতের জাতীয়তাবাদের বিকাশে সাহিত্য ও নাটকের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। তখনকার দিনের নাটক ও সাহিত্যের মূল বক্তব্য ছিল দেশপ্রেম জাগ্রত করা। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সূর্যের দেশ শাহজাহানের মেবার পতন, ছাড়াও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (পদ্মিনী উপাখ্যান) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় জাতীয়তাবাদী চিন্তা ধারার পরিচয় পাওয়া যায়।
সভাসমিতি – বাংলায় জাতীয়তাবোধ উন্মেষে ঊনবিংশ শতকের গড়ে ওঠা সভাসমিতিগুলির গুরুত্ব উপেক্ষা করা যায় না। এই রাজনৈতিক সভাসমিতির চূড়ান্ত পরিণতি ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা, যা স্বাধীনতা পর্যন্ত ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয় আন্দোলন পরিচালনা করেছিল।
মূল্যায়ণ – এইভাবে উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বিভিন্ন ঘটনা ও ভাবধারার প্রভাবে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। তবে এই জাতীয়তাবাদের পশ্চাতে ছিল সর্বভারতীয় ঐক্যের চেতনা।
ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসের ভূমিকা ব্যাখ্যা করো। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অঙ্কিত ভারতমাতা চিত্রটি বিখ্যাত কেন?
প্রথম অংশ – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর উত্তর রচনাবলির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের প্রচার করেছিলেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে অমরকীর্তি হল আনন্দমঠ উপন্যাস। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রকাশিত হয়। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি ও জীববোধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্বদেশপ্রীতি।
জাতীয়তাবাদী চেতনায় আনন্দমঠ – ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষে আনন্দমঠ ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ এক জাতীয়তাবাদী উপন্যাস; কারণ —
স্বদেশপ্রেম – বঙ্কিমচন্দ্র রচিত আনন্দমঠ উপন্যাস জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে দেশবাসীর মনে স্বাদেশিকতা ও সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ধারণা সঞ্চারিত করেছিল। স্বদেশপ্রেম যে শ্রেষ্ঠধর্ম, একথা আনন্দমঠ উপন্যাসের সন্তানদলের মুখে উচ্চারিত হয়েছিল।
বন্দেমাতরম সংগীত – আনন্দমঠ উপন্যাসের বন্দেমাতরম সংগীতটি (১৮৭৫ খ্রি.) ছিল পরাধীন ভারতের জাতীয় সংগীত বিপ্লবীদের মন্ত্র। জন্মভূমিকে মাতৃরূপে কল্পনা করা এই সংগীতের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য। এই গানে বঙ্কিমচন্দ্র দেশকে ভৌগোলিক সত্তারূপে বিচার না করে একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্ররূপে দেখেছেন।
দেশমাতার আদর্শ – আনন্দমঠে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, দেশমাতা হলেন মা, দেশপ্রেম হল ধর্ম, দেশসেবা হল পূজা।
স্ববিরোধিতা – আনন্দমঠে বঙ্কিমচন্দ্র সচেতনভাবে জানিয়েছেন যে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব, ডাকাতি, দস্যুবৃত্তি হল অমলালের নামান্তর, কারণ ইংরেজ রাজত্বে সনাতন সামন্ত সমাজ অটুট থাকবে। সুতরাং ইংরাজি রাজ্যে প্রজা সুখী হইবে ও নিষ্কণ্টকে ধর্মাচরণ করিবে। যদিও এটি ছিল বিভ্রান্তিকর মন্তব্য।
দ্বিতীয় অংশ – উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভাসমিতি, জাতীয়তাবাদী সাহিত্য এবং চিত্র ও ব্যঙ্গচিত্রও ভারতের জাতীয়তাবাদে সাহায্য করেছিল। এ প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অঙ্কিত ভারতমাতা চিত্রটি ছিল খুব উল্লেখযোগ্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশীয় ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে স্বদেশি আন্দোলনকালে চিত্র অঙ্কনে এক নতুন ঘরানার সৃষ্টি করেন। তার অঙ্কিত এরূপ একটি চিত্র ছিল ভারতমাতা। এই ছবিতে দেখা যায় যে —
বিষয়বস্তু – ভারতমাতা হলেন গেরুয়া বসন পরিহিতা এক যোগিনী মূর্তি। তিনি একাধারে দেবী ও মানবী। তিনি বরাভয়দায়িনী এবং ত্যাগ ও বৈরাগ্যের মূর্ত প্রতীক। ভারতমাতার চার হাতে শোভা পাচ্ছে রুদ্রাক্ষের মালা, শুভ্রবস্ত্র, পুঁতি ও ধানশীষ। পদযুগলের চারপাশে রয়েছে শ্বেতপদ্ম।
তাৎপর্য – ভারতমাতা ছবিটির মাধ্যমে শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ২ ঠাকুর ধনধান্যপূর্ণ সমৃদ্ধশালী ভারতের ছবি তুলে ধরেন। এই ছবির মাধ্যমে ভারতের আধ্যাত্মবাদ, নারীশক্তি, ঐতিহ্য ও শস্যশ্যামল অর্থনীতির কথা ফুটে উঠেছে।
প্রভাব – বিশ শতকে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সংগঠন ও প্রসারে ভারতমাতা চিত্রটির প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য, কারণ স্বদেশি যুগে বিভিন্ন সভা, সমাবেশ-এ এই চিত্রটি সজ্জিত হত। ভগিনী নিবেদিতা’র মতে চিত্রটি ছিল জাতীয়তাবাদ প্রসারের ক্ষেত্রে প্রথম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ছবি।
উপসংহার – বাঙালির জাতীয়তা গঠন ও দেশের যুব সম্প্রদায়কে স্বদেশভক্তি, ত্যাগ ও সেবাধর্মে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যেই রচিত হয়েছিল আনন্দমঠ। আনন্দমঠের অবদান বাঙালি জাতির জাতীয় জীবন গঠনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
ভারতের জাতীয়তাবাদের উন্মেষে বিবেকানন্দের রচিত বর্তমান ভারত প্রবন্ধটির অবদান ব্যাখ্যা করো। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কীভাবে তাঁর অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক সমাজচিত্র তুলে ধরেন?
প্রথম অংশ – বিবেকানন্দ প্রকাশ্য রাজনীতি না করলেও তার বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ ভাবধারার সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদী নবভারত গঠনের আদর্শ প্রচার করেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে বর্তমান ভারত প্রবন্ধটি উল্লেখযোগ্য, যা ভারতের জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়ক হয়েছিল।
জাতীয়তাবাদ উন্মেষে বর্তমান ভারতের ভূমিকা –
স্বদেশ চেতনা – বর্তমান ভারতে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের মৃত্তিকা আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী — বল ভাই ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ। এই উক্তির মাধ্যমে বিবেকানন্দ স্বদেশ চেতনা ও দেশপ্রেম জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন।
সামাজিক সংহতি – সমাজের অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ প্রথা নিরসনের জন্য বিবেকানন্দ (বর্তমান ভারতে) বলেছেন, ভুলিও না নীচ জাতি, মুর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি-মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই। বিবেকানন্দের এই তেজোদীপ্ত বাণী বিপ্লবীদের অন্তরে গভীর প্রেরণা সৃষ্টি করেছিল।
দেশের জন্য আত্মত্যাগের আহ্বান – বর্তমান ভারতে প্রকাশ পেয়েছে, হে ভারত ভুলিও না—তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত, ভুলিও না – তোমার সমাজ যে বিরাট মহামায়ার ছায়ামাত্র। হে বীর, সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বল — আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই।
দ্বিতীয় অংশ – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠভ্রাতা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রশিল্পে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সমকালীন সমাজ ও সময়ের ছবিকে তিনি তুলির টানে ব্যঙ্গাত্মক রূপে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি ছিলেন রবি বর্মার সমকালীন চিত্রকর। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম ব্যঙ্গচিত্রকর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত প্রবাসী ও মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় গগনেন্দ্রনাথের অঙ্কিত ব্যঙ্গচিত্রগুলি প্রকাশিত হত। তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলিতে যেমন —
বিদেশি শাসনের সমালোচনা – বিদেশি শাসকদের কটাক্ষ করা হয়, একই রকমভাবে সমাজের নানা অসংগতি ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিমায় সেই চিত্রে ফুটে ওঠে।
মানব চরিত্র – ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে মাথা নোয়ানো মানুষ বা শহুরে জীবনের কৃত্রিম সাহেবিয়ানা – যে কোনো কিছুকেই তিনি বিদ্ধ করতেন তাঁর শ্লেষাত্মক কার্টুন চিত্রে। গগনেন্দ্রনাথ কোনো প্রকার তোষামোদে বিশ্বাস করতেন না। তাই তাঁর ব্যঙ্গচিত্র হয়ে উঠেছিল ঔপনিবেশিক সমাজের সমালোচনার প্রতিফলন।
দেশীয় মনীষীদের চিত্র – তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলিতে বিদেশি শাসকদের পাশাপাশি দেশীয় নেতারাও ব্যঙ্গের আওতার মধ্যে পড়েছেন। এমনকি, রবীন্দ্রনাথও তাঁর ব্যঙ্গচিত্রের বিষয় হয়েছেন। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর আবিষ্কার, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের গবেষণা, রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিমান চড়া, রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ ইত্যাদি নিয়ে কার্টুন চিত্রগুলি ইতিহাসের অমূল্য দলিল। আনন্দের কথা পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর নামে গগনেন্দ্র প্রদর্শনীশালা গড়ে তলেছে।
উপসংহার – বিবেকানন্দ বর্তমান ভারতে দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে তার মুক্তির জন্য আত্মোৎসর্গের আদর্শ তুলে ধরেছিলেন — তাতে উচ্চনীচ, ধনী-নির্ধন কেউই বাদ পড়েনি। তাঁর প্রেরণাতেই দেশপ্রেম ধর্মের বিকল্প হয়ে উঠেছিল। তাঁর আদর্শ ও চিন্তাধারার ছাপ পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলনে ছাপ ফেলেছিল।