আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞানের চতুর্থ অধ্যায় “অভিব্যক্তি ও অভিযোজন” অধ্যায়ের ‘অভিব্যক্তি‘ বিভাগের উপ-অধ্যায় ‘অভিব্যক্তির ধারণা, জীবনের উৎপত্তি, অভিব্যক্তির মুখ্য ঘটনাবলি‘ -এর রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি যে এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হবে।

অভিব্যক্তির ধারণা, জীবনের উৎপত্তি, অভিব্যক্তির মুখ্য ঘটনাবলি
প্রাণ সৃষ্টির ধাপগুলি কী কী? পৃথিবীর উৎপত্তি ও তার প্রাচীন পরিবেশ সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
প্রাণ সৃষ্টির ধাপ –
হ্যালডেন-ওপারিন প্রকল্প অনুযায়ী জীবনের উৎপত্তিকে কতকগুলি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। যেমন –
- প্রথম পর্যায় – পৃথিবীর উৎপত্তি ও তার প্রাচীন পরিবেশ।
- দ্বিতীয় পর্যায় – জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তি বা কেমোজেনি।
- তৃতীয় পর্যায় – জৈবিক বিবর্তন বা বায়োজেনি।
- চতুর্থ পর্যায় – ইউক্যারিওটিক কোশের আবির্ভাব।
পৃথিবীর উৎপত্তি ও প্রাচীন পরিবেশ –
প্রায় 4.6 বিলিয়ন বছর পূর্বে মহাবিশ্বে গ্যাস ও ধূলিকণাগুলি সমন্বিত হয় সৌর নেবুলার সৃষ্টি করে। পরবর্তীকালে সৌর নেবুলা থেকেই সৌরজগৎ তথা পৃথিবী সৃষ্টি হয়। সৃষ্টির পর পৃথিবী প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন মৌলের উত্তপ্ত গ্যাসীয় পিন্ড ছিল। এই সময়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা ছিল প্রায় 5000-6000°C। পরে উত্তাপ কমার সাথে সাথে গ্যাসগুলি ঘনীভূত হয়ে বিভিন্ন স্তরে বিন্যস্ত হয়। পরবর্তীকালে পৃথিবীর উত্তাপ ক্রমশ আরও হ্রাস পায় ও জলচক্রের উৎপত্তি ঘটে। এইভাবেই পৃথিবীতে প্রথম সমুদ্রের আবির্ভাব হয়। আদি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে হাইড্রোজেন, জলীয় বাষ্প, মিথেন, অ্যামোনিয়া প্রভৃতি গ্যাস বিন্যস্ত থাকলেও, মুক্ত অক্সিজেন গ্যাস ছিল না। অর্থাৎ পরিবেশ বিজারক প্রকৃতির ছিল।
জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তির ধাপগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
অনুরূপ প্রশ্ন, জীবনের উৎপত্তিতে কেমোজেনির ধারণাটি সংক্ষেপে উল্লেখ করো।
জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তি –
প্রাচীন পৃথিবীর পরিবেশে উপস্থিত বিভিন্ন অজৈব রাসায়নিক উপাদান (মৌল ও যৌগ) থেকে জীবদেহের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ জৈব যৌগ সৃষ্টির ধারাবাহিক রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলিকে জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তি বা কেমোজেনি বলে। বিজ্ঞানী হ্যালডেন ও ওপারিন কেমোজেনির প্রধান ধাপগুলি বর্ণনা করেন। এগুলি হল –
সরল জৈব যৌগের উৎপত্তি –
পৃথিবীর উৎপত্তিকালীন তাপমাত্রা ক্রমশ কমে 1000°C হওয়ার পর বিভিন্নপ্রকার হাইড্রোকার্বন সৃষ্টি হয়। যেমন – অ্যাসিটিলিন, ইথিলিন প্রভৃতি। এগুলি আবার উত্তপ্ত বাষ্পের সঙ্গে বিক্রিয়া করে অক্সি ও হাইড্রক্সি যৌগ উৎপন্ন করে। যেমন – অ্যাসিটালডিহাইড। এই যৌগগুলি আবার C, H, O প্রভৃতি মৌল এবং অন্যান্য যৌগের সাথে বিক্রিয়া করে সরল জৈব যৌগ, যেমন – সরল শর্করা, অ্যামিনো অ্যাসিড, ফ্যাটি অ্যাসিড, পিউরিন, পিরিমিডিন ইত্যাদি তৈরি করে।
জটিল জৈব যৌগের উৎপত্তি –
সরল জৈব যৌগগুলি বিভিন্ন বিক্রিয়া দ্বারা নানা জটিল জৈব যৌগ (যেমন – জটিল কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট ও নিউক্লিক অ্যাসিড ইত্যাদি) সৃষ্টি করে। এই জটিল বিক্রিয়াগুলিতে প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দিয়েছিল সৌরশক্তি ও বজ্রপাত। প্রাচীন পৃথিবীতে প্রাণ উৎপত্তির পূর্বে, প্রথম প্রাণকণা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানগুলি সমুদ্রের উত্তপ্ত জলে অবস্থান করত। হ্যালডেনের মতে এইসব জৈব যৌগগুলি সমুদ্রের জলে মিশে ‘হট ডাইলিউট স্যুপ বা তপ্ত লঘু স্যুপ’ নামক উত্তপ্ত তরল হিসেবে অবস্থান করত। এর অপর নাম প্রিবায়োটিক স্যুপ। তাঁর মতে প্রথম প্রাণের উৎপত্তি এখানেই হয়েছিল।
কোয়াসারভেট -এর উৎপত্তি –
উৎপন্ন বৃহৎ ও জটিল জৈব গুলি পরস্পর মিলিত হয়ে কোয়াসারভেট নামক কোলয়েড কণা সৃষ্টি করে। অর্থাৎ, প্রাচীন পৃথিবীতে তপ্ত লঘু স্যুপের মতো সমুদ্রের মধ্যে সীমানা পর্দাবৃত জৈব যৌগপূর্ণ যে কোলয়েড বিন্দু বা কণা থেকে আদিকোশ বা প্রোটোসেল তৈরি হয়েছিল, তাকে কোয়াসারভেট বলে। এতে প্রোটিন, ফ্যাট, শর্করা, নিউক্লিক অ্যাসিড প্রভৃতি প্রাণ সৃষ্টির উপাদান ছিল। জীবন সৃষ্টির বিক্রিয়া এর মধ্যেই ঘটেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমেরিকান বিজ্ঞানী সিডনি ফক্স (1957) -এর মতানুসারে, প্রাচীন পৃথিবীতে সমুদ্রের মধ্যে অনেকগুলি অ্যামিনো অ্যাসিড যুক্ত হয়ে প্রথমে প্রোটিনয়েড এবং পরে মাইক্রোস্ফিয়ার তৈরি হয়। তাঁর মতে কোয়াসারভেট নয়, মাইক্রোস্ফিয়ারেই প্রথম প্রাণের উৎপত্তি ঘটে। প্রাচীন পৃথিবীতে দ্বিলিপিড পর্দাবৃত, ATP ব্যবহারে সক্ষম, বৃদ্ধি ও বিভাজনক্ষম যে জৈব গঠন থেকে বিজ্ঞানী সিডনি ফক্স প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল বলে বর্ণনা করেন, তাকে মাইক্রোস্ফিয়ার বলে। তিনি পরীক্ষাগারে অ্যামিনো অ্যাসিডকে শুষ্ক করে প্রোটিনয়েড ও পরে তাকে জলে দ্রবীভূত করে মাইক্রোস্ফিয়ার সৃষ্টি করতে সমর্থ হন।
নগ্ন জিন বা নিউক্লিক অ্যাসিডের উৎপত্তি –
মুক্ত নিউক্লিওটাইডগুলি একত্রে পলিনিউক্লিওটাইড গঠন করে, যা থেকে নিউক্লিক অ্যাসিড সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানীদের মতে প্রথম সৃষ্ট এই নিউক্লিক অ্যাসিডগুলি RNA প্রকৃতির। একে নগ্ন জিন বলে।
জীবনের উৎপত্তি সম্পর্কে মিলার এবং উরের পরীক্ষার গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতাসহ পরীক্ষা ব্যবস্থাটি সংক্ষেপে লেখো।
অনুরূপ প্রশ্ন, জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তির সংক্ষিপ্ত রূপরেখা মিলার ও উরের পরীক্ষার সাহায্যে বর্ণনা করো।
মিলার ও উরের পরীক্ষা –
জীবনের উৎপত্তি সম্পর্কিত ওপারিন ও হ্যালডেনের মতবাদের সপক্ষে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম ভলক্যানিক তড়িৎবীক্ষণ পরীক্ষা (volcanic spark discharge experiment) টি করেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী স্ট্যানলি মিলার এবং হ্যারল্ড উরে (1952)।

পরীক্ষা ব্যবস্থা –
এই পরীক্ষার জন্য বিজ্ঞানীদ্বয় একটি বিশেষ যন্ত্র তৈরি করেন। প্রাচীন পৃথিবীর পরিবেশ সৃষ্টির জন্য উপকরণ হিসেবে তারা মিথেন, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন ও জলীয় বাষ্প নেন। তাঁদের তৈরি যন্ত্রটিতে দুটি ফ্লাস্ক বর্তমান। এর মধ্যে বড়ো ফ্লাস্ক (5L) টিতে মিথেন, অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন গ্যস মিশ্রণ 2 : 2 : 1 আয়তন অনুপাতে নেওয়া হয়; ছোটো ফ্লাস্ক (500 ml) টিতে জল রাখা হয়। বার্নারের সাহায্যে জল ফোটানো হয়। ফ্লাস্ক দুটি পরস্পর একটি কাচের টিউব দ্বারা যুক্ত থাকে, যার মাধ্যমে ছোটো ফ্লাস্কের ফুটন্ত জল থেকে জলীয় বাষ্প বড়ো ফ্লাস্কে প্রবেশ করে। বড়ো ফ্লাস্কটিতে টাংস্টেন নির্মিত তড়িদ্দ্বার দ্বারা 75,000 ভোল্টের উচ্চ তড়িৎমোক্ষণ করা হয় (প্রাচীন পৃথিবীর বজ্রপাতের মতো)। গ্যাস মিশ্রণটি এরপর বড়ো ফ্লাস্ক থেকে নির্গত হলে তাকে একটি নলের মধ্যে দিয়ে চালনা করা হয়। এরপর ঠান্ডা জলপ্রবাহ দ্বারা মিশ্রণটিকে ঘনীভূত করে সংগ্রহ করা হয়। সমগ্র ব্যবস্থাপনাটি এক সপ্তাহ ধরে চালনা করা হয়।
পর্যবেক্ষণ –
পরীক্ষায় প্রাপ্ত রাসায়নিক পদার্থগুলির বিশ্লেষণের দ্বারা মিলার ও উরে 5টি অ্যামিনো অ্যাসিড পান। এগুলি হল গ্লাইসিন, আলফা অ্যালানিন, বিটা অ্যালানিন, অ্যাসপারটিক অ্যাসিড ও আলফা অ্যামিনোবিউটাইরিক অ্যাসিড। পরবর্তী সময়কালে মিলার -এর ছাত্র জেফ্রি বাডা ও অন্যান্যরা (2008) প্রায় 20টি অ্যামিনো অ্যাসিড ও অন্যান্য জৈব অ্যাসিড ওই পরীক্ষাব্যবস্থা থেকে আবিষ্কার করেন।
সিদ্ধান্ত –
এই পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রাচীন পৃথিবীতে অক্সিজেনবিহীন বিজারক পরিবেশে বজ্রপাত, অতিবেগুনি রশ্মি বা অগ্ন্যুৎপাতের তাপশক্তির উপস্থিতিতে জলীয় বাষ্প, মিথেন, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন প্রভৃতির বিক্রিয়ার ফলে জটিল যৌগের সৃষ্টি হয়। এই পরীক্ষায় প্রাপ্ত অ্যামিনো অ্যাসিড জীবের কোশে পাওয়া যায়। এগুলি জীবদেহ গঠনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
মিলার-উরের পরীক্ষার গুরুত্ব –
মিলার ও উরের পরীক্ষা অ্যাবায়োজেনেসিস তত্ত্বকে সমর্থন করে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী প্রায় 3.7 বিলিয়ন বছর আগে অজৈব উপাদান থেকে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁদের পরীক্ষা হ্যালডেন-ওপারিন তত্ত্বকেও সমর্থন করে।
মিলার-উরে পরীক্ষার সীমাবদ্ধতা –
- অ্যামিনো অ্যাসিড অজৈব উপাদান থেকে তৈরি হলেও তারা কীভাবে সমন্বিত হয়ে জীবন তৈরি করে তার ব্যাখ্যা পরীক্ষাটি দিতে পারেনি।
- বর্তমানে বহু বিজ্ঞানী মনে করেন যে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে প্রাচীন পরিবেশে CO₂ যথেষ্ট মাত্রায় ছিল। তাই তাঁদের মতে সেই জারক পরিবেশে মিলার ও উরে -এর পরীক্ষালব্ধ অ্যামিনো অ্যাসিডগুলি নাও পাওয়া যেতে পারত।
অভিব্যক্তির মুখ্য ঘটনাসমূহ একটি পর্যায়চিত্রের মাধ্যমে দেখাও।
অভিব্যক্তির মুখ্য ঘটনাসমূহ –
সভ্যতার সৃষ্টিকাল থেকেই পৃথিবীর উৎপত্তি ও প্রাণের উৎপত্তি অত্যন্ত রহস্যময় ও জটিল প্রক্রিয়া। বিভিন্ন বিজ্ঞানী বিভিন্ন সময়ে এই রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেন। এইসব বিজ্ঞানীদের মতবাদ ও ধারণা থেকে পৃথিবী এবং প্রাণের উৎপত্তি ও জীবের অভিব্যক্তি সম্পর্কিত কিছু তথ্য জানা সম্ভব। অভিব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ নীচে পর্যায়চিত্রের মাধ্যমে দেওয়া হল।

ল্যামার্কের বিবর্তন তত্ত্বের মূল বক্তব্যগুলির উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করো।
বিবর্তন সম্পর্কিত ল্যামার্কের মতবাদ –
ল্যামার্ক 1809 সালে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ফিলজফি জুলজিক (Philosophie Zoologique) -এ বিবর্তনের বিজ্ঞানভিত্তিক মতবাদ প্রকাশ করেন। তাঁর মতবাদকে ল্যামার্কবাদ বা ল্যামার্কিজম বলে। ল্যামার্কের বিবর্তন তত্ত্বের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি হল –
অভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ শক্তি –
জীবনের অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রভাবে জীবের সমগ্র দেহ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আকার বৃদ্ধি পায়।
চাহিদা থেকে নতুন অঙ্গের সৃষ্টি –
পরিবেশের পরিবর্তন সকল জীবকে প্রভাবিত করে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন চাহিদার সৃষ্টি হয়। এই চাহিদার ফলে নতুন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সৃষ্টি হয়।
ব্যবহার ও অব্যবহারের সূত্র –
ল্যামার্কের মতে, জীবদেহের কোনো অঙ্গ ক্রমাগত ব্যবহৃত হতে থাকলে অঙ্গটি শক্তিশালী, সবল ও সুগঠিত হয়, পক্ষান্তরে জীবদেহের কোনো অঙ্গ দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকলে সেটি ক্রমশ দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় হয় ও অবশেষে অবলুপ্ত হয়ে যায়।
ব্যবহারের সপক্ষে উদাহরণ – বহুকাল আগে জিরাফের গলা ছোটো ছিল। কিন্তু কালক্রমে উঁচু গাছের পাতা খাদ্যরূপে গ্রহণের চেষ্টায় গলাটি ক্রমশ লম্বা হয়ে গেছে। এটি ব্যবহারের সপক্ষে প্রমাণ দেয়।
অব্যবহারের সপক্ষে উদাহরণ – মানুষের পূর্বপুরুষের ল্যাজ ক্রমাগত অব্যবহারের ফলে আজ নিষ্ক্রিয় অঙ্গ কক্সিসে পরিণত হয়েছে। অতীতে উটপাখির ডানা সক্রিয় থাকলেও বংশপরম্পরায় অব্যবহারের ফলে তা নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এগুলি অব্যবহারের সপক্ষে যুক্তি দেয়।

অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ –
ল্যামার্ক এই সূত্রে বলেন – আপন প্রচেষ্টায় জীবদ্দশায় যেসব বৈশিষ্ট্য জীব অর্জন করে, সেইসব বৈশিষ্ট্য পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে, অর্থাৎ এক জনু থেকে অপর জনুতে সঞ্চারিত হয়। এককথায়, জীবের অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ ঘটে। যেমন – বহুকাল আগে জিরাফের গলা ছোটো ছিল। কিন্তু কালক্রমে উঁচু গাছের পাতা আহরণের চেষ্টায় তা ক্রমশ লম্বা হয়েছে। এই লম্বা গলার বৈশিষ্ট্যটি বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে আজকের লম্বা গলাযুক্ত জিরাফের আবির্ভাব হয়েছে।
নতুন প্রজাতির উদ্ভব –
অর্জিত গুণাবলি বংশপরম্পরায় বাহিত হওয়ার ফলে অনেকগুলি প্রজন্ম বাদে প্রজাতির মধ্যে পরিবর্তন আসে এবং অবশেষে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। ল্যামার্কের মতে এটাই হল বিবর্তনের মূল পদ্ধতি।
যোগ্যতমের উদবর্তন বলতে কী বোঝ? লুপ্তপ্রায় অঙ্গ কীভাবে উৎপন্ন হয়, তা উদাহরণ সহযোগে লেখো।
যোগ্যতমের উদবর্তন –
যোগ্যতম হল বহুর মধ্যে যে যোগ্য, আর উদবর্তন হল জীবনসংগ্রামে বা প্রাকৃতিক নির্বাচনে টিকে থাকা। প্রকৃতির প্রতিকূল পরিবেশে অবিরাম সংগ্রামের মাধ্যমে অভিযোজিত হয়ে অনুকূল প্রকরণ সৃষ্টির মাধ্যমে কিছু জীব নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। আবার কিছু জীব প্রতিকূল প্রকরণের জন্য পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ, জীবনসংগ্রামে জয়ী যোগ্যতম জীবই বেঁচে থাকে। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন ধারণার ব্যাখ্যায় হারবার্ট স্পেনসার প্রথম ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’ কথাটির ব্যবহার করেন।
যোগ্যতমের উদবর্তনের উদাহরণ – অনুকূল প্রকরণ সৃষ্টির জন্য লম্বা গলাযুক্ত জিরাফ আজও টিকে রয়েছে। অন্যদিকে প্রতিকূল প্রকরণের জন্য খর্ব গলাযুক্ত জিরাফ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
লুপ্তপ্রায় অঙ্গের উৎপত্তি –
পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জীবদেহের সুগঠিত এবং একদা সক্রিয় থাকা কোনো কোনো অঙ্গের কর্মক্ষমতা লোপ পেয়ে দুর্বল ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে নিষ্ক্রিয় বা লুপ্তপ্রায় অঙ্গের উৎপত্তি ঘটায়।
প্রাণীর লুপ্তপ্রায় অঙ্গের উদহারণ – মানুষের বহিঃকর্ণ নাড়ানোর পেশি, চোখের উপপল্লব, অ্যাপেনডিক্স ইত্যাদি, তিমির শ্রোণিচক্রের অস্থি, উটপাখির ডানা ইত্যাদি।
উদ্ভিদের লুপ্তপ্রায় অঙ্গের উদহারণ – ভূনিম্নস্থ কান্ডের শল্কপত্র, বেনেবউ ও স্বর্ণলতার দেহে অবস্থিত আঁশের মতো পাতা, শতমূলী গাছের গর্ভকেশর, নারকেল গাছের তিনটি গর্ভকেশরের মধ্যে দুটি বন্ধ্যা গর্ভকেশর, কালকাসুন্দার বন্ধ্যা পুংকেশর বা স্ট্যামিনোড ইত্যাদি।
অর্জিত গুণাবলির বংশানুসরণ উদাহরণসহ বোঝাও। ল্যামার্কের মতবাদের প্রধান ত্রুটিগুলি কী?
অর্জিত গুণাবলির বংশানুসরণ –
যে কয়েকটি প্রধান প্রতিপাদ্যের ওপর ভিত্তি করে ল্যামার্কবাদ গঠিত সেগুলির একটি হল ‘অর্জিত গুণাবলির বংশানুসরণ’। পরিবেশের প্রভাবে অভিযোজনের মাধ্যমে জীব যেসব বৈশিষ্ট্য অর্জন করে সেইসব বৈশিষ্ট্য বংশানুক্রমে সন্তানসন্ততির দেহে সঞ্চারিত হয়। অর্জিত লক্ষণের বংশপরম্পরায় সঞ্চারণকেই বলা হয় অর্জিত গুণাবলির বংশানুসরণ।
উদাহরণ – বহুকাল আগে জিরাফের গলা ছোটো ছিল। কিন্তু কালক্রমে উঁচু গাছের পাতা আহরণের চেষ্টার ফলে গলাটি ক্রমশ লম্বা হতে থাকে। এই লম্বা গলার বৈশিষ্ট্যটি বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে আজকের লম্বা গলাযুক্ত জিরাফের আবির্ভাব হয়েছে।
ল্যামার্কের মতবাদের প্রধান ত্রুটি –
- ল্যামার্কের মতবাদের প্রথম প্রতিপাদ্যটি সার্বজনীন নয়। কারণ অনেকক্ষেত্রেই অভিব্যক্তির ধারায় অঙ্গের ক্ষুদ্র হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, বড়ো হয় না।
- দ্বিতীয় প্রতিপাদ্যটিও সত্য নয়, কারণ, পরিবেশের কিছুটা প্রভাব থাকলেও জীবের অন্তর্নিহিত চাহিদার দ্বারা কোনো নতুন অঙ্গ সৃষ্টি হতে পারে না। যেমন – একটি স্থলজ জীব খুব ভালোভাবে চাইলেও জলে বসবাসকারী জীবের অঙ্গ তাতে সৃষ্টি হয় না।
- ল্যামার্কের তৃতীয় প্রতিপাদ্যের কিছুটা সত্যতা রয়েছে, যদিও আমরা জানি যে, কোনো জীবের হৃৎপিণ্ড সবসময় সচল থাকলেও তা বড়ো ও সুগঠিত হয় না।
- ল্যামার্কের তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য বা ‘অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ’ সর্বৈবভাবে সত্য নয়। অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ তখনই ঘটে যখন তা জননকোশের দ্বারা সঞ্চারিত হয়। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী ওয়াইসম্যানের পরীক্ষা উল্লেখ্য।
বিজ্ঞানী ওয়াইসম্যান তাঁর জার্মপ্লাজমবাদে বলেন, জীবদ্দশায় অর্জিত গুণাবলি বংশপরম্পায় সঞ্চারিত হয় না। বংশগত বৈশিষ্ট্য কেবল জননকোশের মাধ্যমেই সঞ্চারিত হয়। তিনি পুরুষ ও স্ত্রী ইঁদুরের ল্যাজ পরপর 5 জনু ধরে 68টি সাদা ইঁদুরের ক্ষেত্রে কেটে এবং তাদের মধ্যে জনন ঘটিয়ে প্রমাণ করেন, কোনো ক্ষেত্রেই ল্যাজহীন ইঁদুর জন্মায় না। ড্রসোফিলা মাছিকে অন্ধকার ঘরে রেখে 60 জনু ধরে তাদের ভিতর জনন ঘটানো হলেও দেখা যায়, কোনো ক্ষেত্রেই দৃষ্টিশক্তিহীন মাছি জন্মায় না। এইসব প্রমাণ থেকে ল্যামার্কের ‘অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ’ সূত্রটি বাতিল বলে বিবেচিত হয়। এটি ল্যামার্কের মতবাদের প্রধান দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত।
বিবর্তনের সপক্ষে ডারউইনের মতবাদ সম্বন্ধে আলোচনা করো।
বিবর্তন সম্পর্কিত ডারউইনের মতবাদ –
ডারউইন 1859 খ্রিস্টাব্দে অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস বাই মিনস অফ ন্যাচারাল সিলেকশন (On the Origin of Species by means of Natural Selection) গ্রন্থে জৈব অভিব্যক্তি বা বিবর্তনের ব্যাখ্যা করে যে মতবাদ প্রকাশ করেন, তাকেই ডারউইনবাদ বা ডারউইনিজম বা প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদ বলা হয়। ডারউইনের মতবাদের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি হল –
অত্যধিক মাত্রায় বংশবৃদ্ধি –
ডারউইনের মতে জীবের সহজাত বৈশিষ্ট্য হল অত্যধিক হারে বংশবৃদ্ধি করা। ডারউইন লক্ষ করেন জীবের সংখ্যা বৃদ্ধি জ্যামিতিক হারে ঘটে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় – একটি স্ত্রী স্যামন মাছ একটি প্রজনন ঋতুতে প্রায় তিন কোটি ডিম পাড়ে। একটি ঝিনুক এক বছরে প্রায় 6 মিলিয়ন ডিম্বাণু উৎপাদন করে।
সীমিত খাদ্য ও বাসস্থান –
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে খাদ্যের উৎপাদন ও পৃথিবীর আয়তন বৃদ্ধি পায় না। জীবের সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও তার বসবাসের স্থান এবং জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের সংকট দেখা দেবে।
অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম –
একদিকে অত্যধিক জন্মের বা বংশবৃদ্ধির হার, অন্যদিকে খাদ্য ও বাসস্থান সীমিত হওয়ায় প্রতি মুহূর্তে জীবকে বেঁচে থাকার জন্য কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। একে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম বলা হয়। এই সংগ্রাম মূলত তিন প্রকার –
অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম – খাদ্য, বাসস্থান প্রভৃতির জন্য একই প্রজাতির জীবগোষ্ঠীর মধ্যে সংগ্রাম হয় কারণ তারা একই প্রকৃতির খাদ্য ও বাসস্থান ব্যবহার করে।

আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম – খাদ্য, বাসস্থান প্রভৃতির জন্য বিভিন্ন প্রজাতির জীবগোষ্ঠীর মধ্যেও সংগ্রাম হয়ে থাকে।

পরিবেশগত সংগ্রাম – প্রতিটি জীবকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পরিবেশগত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। অত্যধিক বা কম আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং বন্যা, খরা, ভূমিকম্প প্রভৃতি দুর্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিটি জীবকে সংগ্রাম করতে হয়।

প্রকরণ বা ভ্যারিয়েশন ও তার বংশানুসরণ –
ডারউইনের মতে, পৃথিবীতে যে কোনো দুটি জীব কখনোই অবিকল একই রকমের হতে পারে না, কিছু-না-কিছু পার্থক্য অবশ্যই থাকবে। এই পার্থক্যকেই ভ্যারিয়েশন বা প্রকরণ বা ভেদ বলে। অনুকূল প্রকরণ (favourable variation) জীবনসংগ্রামে জীবকে সাহায্য করে। অপরদিকে প্রতিকূল প্রকরণ জীবের বিলুপ্তির কারণ হয়।
প্রাকৃতিক নির্বাচন ও যোগ্যতমের উদবর্তন –
ডারউইনের মতে, জীবনসংগ্রামের ফলে উদ্ভূত প্রকরণগুলির মধ্যে কিছু অনুকূল ও কিছু প্রকরণ প্রতিকূল হয়। অনুকূল প্রকরণগুলি জীবকে অভিযোজনে সহায়তা করে কিন্তু প্রতিকূল প্রকরণগুলি অভিযোজনে সহায়তা করতে পারে না। ফলে প্রতিকূল প্রকরণযুক্ত জীব ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয় এবং অনুকূল প্রকরণযুক্ত জীব পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য নির্বাচিত হয়। একে যোগ্যতমের উদবর্তন বলে। প্রকৃতি উপযুক্ত প্রকরণযুক্ত জীবকে টিকে থাকার জন্য নির্বাচন করে। একে প্রাকৃতিক নির্বাচন বলা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বিজ্ঞানী হারবার্ট স্পেনসার সর্বপ্রথম ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’ (survival of the fittest) কথাটি প্রস্তাব করেন। ডারউইন পরবর্তীকালে তাঁর তত্ত্বের মধ্যে কথাটি অত্যন্ত সংযতভাবে ব্যবহার করেন।
নতুন প্রজাতির উৎপত্তি –
একটি বিশেষ জীবগোষ্ঠীর মধ্যে অনুকূল প্রকরণগুলি পুঞ্জীভূত হওয়ায় বেশকিছু প্রজন্ম পরে পূর্বপুরুষ ও উত্তরপুরুষের মধ্যে অনেক বেশি বৈসাদৃশ্য দেখা দেয়। এর ফলে কালক্রমে একটি নতুন প্রজাতির উৎপত্তি ঘটে।
জিরাফের লম্বা গ্রীবা সম্পর্কে ল্যামার্ক ও ডারউইনের মতবাদ সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, একটি উপযুক্ত উদাহরণের সাহায্যে ডারউইন প্রস্তাবিত প্রাকৃতিক নির্বাচন পদ্ধতিটি ব্যাখ্যা করো।
অথবা, জিরাফের গলা লম্বা সর্ম্পকে মতবাদ ব্যাখ্যা করো।
জিরাফের লম্বা গ্রীবা সম্পর্কে ল্যামার্কের মত –
ল্যামার্কের মতে, বহুকাল আগে জিরাফের গলা ছোটো ছিল। কিন্তু কালক্রমে উঁচু গাছের পাতা আহরণের চেষ্টার ফলে গলাটি ক্রমশ লম্বা হয়ে গেছে। অর্থাৎ গলার অধিক ব্যবহারের এ ঘটনা ঘটে। এক প্রজন্মের জিরাফের অর্জিত বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। আবার এই প্রজন্মের অর্জিত বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। এইভাবে এই লম্বা গলার বৈশিষ্ট্যটি বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে আজকের লম্বা গলাযুক্ত জিরাফের আবির্ভাব ঘটেছে।

জিরাফের লম্বা গ্রীবা সম্পর্কে ডারউইনের মত –
চার্লস ডারউইনের মতে, জিরাফের পূর্বপুরুষের গলা ছিল বিভিন্ন আকৃতির, কারও লম্বা, কারও মাঝারি এবং কারও আবার ছোটো। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সংগ্রাম লক্ষ করা যায়। লম্বা গ্রীবাযুক্ত জিরাফরা অধিক খাদ্যগ্রহণ করতে সক্ষম হওয়ায় অধিক প্রজননের সুযোগ পায় ফলে অনেক বেশি সংখ্যক অপত্য সৃষ্টি করে। অর্থাৎ তাদের প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটে। অন্যদিকে ছোটো গ্রীবাযুক্ত জিরাফরা খেতে না পেয়ে মারা যাওয়ায় বংশবিস্তারে সক্ষম হয় না। ফলে ক্রমশ লম্বা গ্রীবাযুক্ত জিরাফের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় অর্থাৎ যোগ্যতমের উদবর্তন ঘটে। একই সঙ্গে ছোটো গ্রীবার জিরাফরা সংখ্যায় কমতে থাকে। এই যোগ্যতম লম্বা গ্রীবাযুক্ত জিরাফগুলি নতুন প্রজাতির সৃষ্টি করে।

প্রাকৃতিক নির্বাচন বলতে কী বোঝ? ডারউইন -এর তত্ত্বের ত্রুটিগুলি উল্লেখ করো।
প্রাকৃতিক নির্বাচন –
প্রকৃতির দ্বারা জীবজগতের মধ্যে উপযুক্ত জীবের নির্বাচনকেই প্রাকৃতিক নির্বাচন বলে। জীবনসংগ্রামে জয়ী যোগ্যতম জীবে উদবর্তিত হবার মাধ্যমেই এটি ঘটে থাকে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়ে জীবনসংগ্রামে জয়ী হতে হলে জীবকে কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হয়। জীবের এই অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলি পরিবেশের সাপেক্ষে অনুকূল ও প্রতিকূল দুই-ই হতে পারে। অনুকূল বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবগুলির পৃথিবীতে টিকে থাকে ও প্রকৃতিতে তাদেরই নির্বাচন ঘটে। প্রতিটি জীবের বৈশিষ্ট্যগত এই পার্থক্যকেই ডারউইন প্রকরণ বলেন। এই প্রসঙ্গে ডারউইন বলেন যে, অনুকূল প্রকরণ-সমন্বিত জীবেরা প্রকৃতির দ্বারা নির্বাচিত হয়ে জীবনসংগ্রামে বেঁচে থাকে। পক্ষান্তরে, প্রতিকূল প্রকরণ-সমন্বিত জীবেরা অযোগ্য বিবেচিত হওয়ায় ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়।
ডারউইনতত্ত্বের ত্রুটি –
- নতুন প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে ডারউইন প্রকরণের কথা বলেছেন কিন্তু প্রকরণের উৎপত্তি সম্পর্কে কোনো বৈজ্ঞানিক ধারণা দিতে পারেননি। তাঁর মতে, প্রকৃতি থেকে জীবের বিকাশকালে প্রকরণ সঞ্চারিত হয়। প্রকরণ সৃষ্টিতে জিনগত বৈচিত্র্য সঞ্চারণ সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল না।
- ডারউইন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকরণের ওপর গুরুত্ব দেন। অথচ নতুন প্রজাতির উৎপত্তির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র প্রকরণের বিশেষ ভূমিকা নেই। ডারউইন মিউটেশনের ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি। মিউটেশনকে তিনি নিছকই ‘প্রকৃতির খেলা’ বলে উপেক্ষা করেছেন।
- প্রাকৃতিক নির্বাচনের থেকে প্রকরণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রকরণ সৃষ্টির কারণগুলিই প্রধানত অভিব্যক্তির জন্য দায়ী, কিন্তু ডারউইন এ সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারেননি। তিনি যোগ্যতমের উদ্ধর্তন নিয়ে ভেবেছিলেন কিন্তু যোগ্যতমের আবির্ভাব নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
- ডারউইনের ধারণা অনুযায়ী কোনো জীবের বা জীবের কোনো অঙ্গের অতিবৃদ্ধি বিবর্তনের সহায়ক। কিন্তু বাস্তবে কোনো কোনো জীবে এরূপ অতিবৃদ্ধিযুক্ত অঙ্গ জীবের বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
- ডারউইন দেহজ প্রকরণ এবং জননগত প্রকরণের সম্পর্কে কোনো ধারণা দেননি।
- অনেক সময় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বা অন্য কোনো কারণে অনুপযুক্ত জীবের সাথে সাথে যোগ্যতমেরাও মারা যায়, সুতরাং জীবের মৃত্যু বা বিলুপ্তিতে অনেক সময় প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হয় না।
অভিব্যক্তির মতবাদের সপক্ষে প্রমাণ
জীবাশ্ম বা ফসিল কাকে বলে? ঘোড়ার বিবর্তনঘটিত প্রমাণের ক্ষেত্রে জীবাশ্মের গুরুত্ব আলোচনা করো।
জীবাশ্ম –
পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রাচীন পাললিক শিলাস্তরে যুগ যুগ ধরে সংরক্ষিত অধুনালুপ্ত উদ্ভিদ কিংবা প্রাণীদেহের সামগ্রিক বা আংশিক প্রস্তরীভূত রূপ বা ছাপকে জীবাশ্ম বা ফসিল বলে। যেমন – Archaeopteryx (আরকিওপটেরিক্স) -এর জীবাশ্ম।
ঘোড়ার বিবর্তনঘটিত প্রমাণের ক্ষেত্রে জীবাশ্মের গুরুত্ব –
জীবাশ্ম অভিব্যক্তি বা বিবর্তনের সপক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। বিশেষত ঘোড়ার জীবাশ্মের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এক্ষেত্রে প্রতিটি যুগের ঘোড়ার জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এই কারণে ঘোড়ার উৎপত্তি ও ক্রমবিবর্তন সম্পূর্ণরূপে জানা সম্ভব হয়েছে। এই জীবাশ্মগুলি থেকে জানা যায় যে আজ থেকে প্রায় 55 মিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবীতে প্রথম ঘোড়ার আবির্ভাব হয়। এর নাম ছিল Eohippus (ইওহিপ্পাস)। একে ঊষাকালের ঘোড়া বলা হয়। এরা আকারে ছোটো ছিল এবং এদের পা ক্ষুদ্র ও আঙুলযুক্ত ছিল। তৎকালীন বনজ পরিবেশে অভিযোজনের জন্য তাদের আকৃতি এরূপ ছিল। এরপর, ধীরে ধীরে তৃণভূমি সৃষ্টি হয় ও ঘোড়ার বাসস্থান পরিবর্তিত হয়। এর সাথে সাথে ঘোড়ার বিবর্তন হতে থাকে। তারা ক্রমশ আকারে বড়ো ও সবল পা-যুক্ত হয়ে ওঠে। ঘোড়ার বিবর্তনের ক্রম হল –
ইওহিপ্পাস → মেসোহিপ্পাস → মেরিচিপ্পাস → প্লিওহিপ্পাস → ইকুয়াস
জীবাশ্ম পর্যবেক্ষণ করে ঘোড়ার বিবর্তনঘটিত যে বৈশিষ্ট্যগুলি পাওয়া যায় তা এখানে আলোচনা করা হল –
- দেহ আকৃতির ক্রমিক বৃদ্ধির মাধ্যমে মাত্র 11 ইঞ্চির (28cm) Eohippus (ইওহিপ্পাস) থেকে প্রায় 60 ইঞ্চির (150 cm) Equus (ইকুয়াস) -এর উৎপত্তি হয়েছে।
- দৌড়ের জন্য অগ্রপদ এবং পশ্চাত্পদের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি হয়েছে।
- উভয় পদেরই আঙুলের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ও একটি আঙুলের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ বৃদ্ধি পেয়ে তা ক্ষুরে পরিণত হয়েছে।
- গ্রীবার দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি হয়েছে।
- মস্তিষ্কের সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার অংশের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে ও প্রাণীটি বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে। দাঁতের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হল – নিম্নচুড় (low crowned) পেষকদন্তের (molar teeth) উচ্চচূড়ে রূপান্তর (high crowned) হয়ে ঘাস খাওয়ার উপযোগী হয়ে উঠেছে। এইভাবে জীবাশ্ম থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঘোড়ার বিবর্তন সম্পর্কিত প্রমাণ পাওয়া যায়। এর থেকে আরও জানা যায়, কীভাবে আদিকালের ঘোড়া থেকে আধুনিক ঘোড়ার উৎপত্তি হল এবং কীভাবে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে তাদের বিবর্তন ঘটল।
ঘোড়ার বিবর্তন সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, অভিব্যক্তির সপক্ষে জীবাশ্মঘটিত প্রমাণরূপে ঘোড়ার উদাহরণ ব্যাখ্যা করো।
ঘোড়ার বিবর্তন –
ঘোড়ার বিবর্তন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় – ঘোড়া তার প্রথম পূর্বপুরুষ Eohippus (ইওহিপ্পাস) থেকে পরপর আরও তিনটি দশা অতিক্রম করে আধুনিক কালের ঘোড়া অর্থাৎ Equus (ইকুয়াস) -এ উপনীত হয়েছে। প্রতিটি যুগের ঘোড়ার জীবাশ্ম পাওয়া গেছে বলে এদের বিবর্তনের সম্পূর্ণ ইতিহাস জানা সম্ভব হয়েছে। নীচে বিবর্তনের প্রতিটি পর্যায়ে প্রাপ্ত ঘোড়ার জীবাশ্মের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল।

দশা | বৈশিষ্ট্য |
Eohippus (ইওহিপ্পাস) | ঘোড়ার আদি পূর্বপুরুষ। প্রায় 55 মিলিয়ন বছর আগে (ইওসিন ইপকে) এই ঘোড়া পৃথিবীতে বসবাস করত। এদের উচ্চতা ছিল প্রায় 11-12 ইঞ্চি (28cm)। এদের সামনের পায়ে 4টি ও পেছনের পায়ে 3টি করে আঙুল ছিল। এদের শরীরের তুলনায় মাথা ও হাত-পা ছোটো ছিল। এদের ঊষাকালের ঘোড়া বলা হয়। |
Mesohippus (মেসোহিপ্পাস) | Eohippus (ইওহিপ্পাস) -এর পরে এসেছিল Mesohippus (মেসোহিপ্পাস), প্রায় 40 মিলিয়ন বছর আগে (অলিগোসিন ইপকে)। এদের উচ্চতা ছিল প্রায় 24 ইঞ্চি (60cm)। এইসময় তৃণভূমির সৃষ্টি হয়, তাই দৌড়োনোর সুবিধার জন্য এদের অগ্রপদের একটি আঙুল হ্রাস পায়। অর্থাৎ এদের সামনের এবং পেছনের পায়ে 3টি করে আঙুল ছিল। এই আঙুলগুলি মাটি স্পর্শ করতে পারত। এদের অন্তর্বর্তী ঘোড়া বলা হয়। |
Merychipuus (মেরিচিপ্পাস) | Mesohippus (মেসোহিপ্পাস) -এর পরে প্রায় 25 মিলিয়ন বছর আগে (মায়োসিন ইপকে) ঘোড়ার যে পূর্বপুরুষটি এসেছিল তার নাম Merychipuus (মেরিচিপ্পাস)। এদের উচ্চতা ছিল প্রায় 40 ইঞ্চি (100cm)। এদের সামনের এবং পেছনের পায়ে 3টি করে আঙুল থাকলেও, শুধু মাঝের আঙুলই মাটি স্পর্শ করত না। এদের পায়ের তৃতীয় আঙুলটি লম্বা ও চওড়ায় বৃদ্ধি পেয়ে ক্ষুরের সৃষ্টি হয়। এদের গ্রীবা অংশও বৃদ্ধি পায়। এদের রোমন্থক ঘোড়া বলা হয়। |
Pliohippus (প্লিওহিপ্পাস) | Merychipuus (মেরিচিপ্পাস) -এর পরে প্রায় 10 মিলিয়ন বছর পূর্বে (প্লিওসিন ইপকে) এসেছিল Pliohippus (প্লিওহিপ্পাস)। এদের উচ্চতা ছিল প্রায় 50 ইঞ্চি (108cm)। এদের উভয় পায়ে 3টি করে আঙুল থাকলেও সবকটি আঙুল মাটি স্পর্শ করতে পারত না। মাঝের আঙুলটি বৃদ্ধি পায় এবং বাকি আঙুলগুলি ক্ষুদ্র হয়ে এদের তৃতীয় অঙুলের দু-পাশে বিন্যস্ত থাকত। এরা প্রথম এক আঙুলযুক্ত ঘোড়া। এরা আকারে ছোটো হলেও প্রায় বর্তমান ঘোড়ার মতো দেখতে ছিল। |
Equus (ইকুয়াস) | Pliohippus (প্লিওহিপ্পাস) পর্যায়ের পরে আজ থেকে 10 লক্ষ বছর পূর্বে (প্লিস্টোসিন ইপকে) আবির্ভূত হয়েছে Equus (ইকুয়াস)। এদের আধুনিক ঘোড়া বলা হয়। এদের উচ্চতা প্রায় 60 ইঞ্চি (150cm)। এদের পাশের আঙুলগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ছোটো হয়েছে। এদের পায়ে ক্ষুর দ্বারা আবৃত একটি মাত্র শক্ত আঙুল দেখা যায়। এদের গ্রীবার দৈর্ঘ্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। |
প্রাণী ও উদ্ভিদের সমসংস্থ অঙ্গ কীভাবে জৈব অভিব্যক্তির সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে কাজ করে তা বুঝিয়ে দাও।
অংশ প্রশ্ন, মানুষের হাত, ঘোড়ার অগ্রপদ, পাখির ডানা, তিমির ফ্লিপারকে সমসংস্থ অঙ্গ কেন বলে?
জৈব অভিব্যক্তির সমসংস্থ অঙ্গঘটিত প্রমাণ –
যেসব অঙ্গ উৎপত্তিগত ও গঠনগত দিক থেকে এক হলেও কার্যগত দিক থেকে ভিন্ন তাদের সমসংস্থ অঙ্গ বলে।
প্রাণীর ক্ষেত্রে সমসংস্থ অঙ্গ –
বিড়াল, মানুষ প্রভৃতি প্রাণীর অগ্রপদের কাজ বিভিন্ন প্রকার। কিন্তু এদের প্রত্যেকের অগ্রপদ গঠনগতভাবে মোটামুটিভাবে একই ধরনের। বিভিন্ন পরিবেশে থাকার দরুন এদের অগ্রপদের পরিবর্তন ঘটেছে। পাখির বা বাদুড়ের অগ্রপদ (ডানা) ওড়ার জন্য, তিমির অগ্রপদ (ফ্লিপার) সাঁতার কাটার জন্য, ঘোড়া বা বিড়ালের অগ্রপদ দৌড়োনোর ও হাঁটার জন্য, মানুষের অগ্রপদ (হাত) সৃজনশীল কাজের জন্য বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু এদের গঠন বিশ্লেষণ করে দেখা যায় প্রত্যেক অগ্রপদেই হিউমেরাস, রেডিয়াস ও আলনা, কারপাল, মেটাকারপাল, ফ্যালানজেস ইত্যাদি অস্থি আছে। এ ছাড়া অগ্রপদের নির্দিষ্ট পেশি, স্নায়ুবিন্যাসও প্রত্যেকের ক্ষেত্রে একইরকম হয়ে থাকে। এর থেকে প্রমাণিত হয়, সব মেরুদণ্ডী প্রাণী একই প্রকার উদবংশীয় জীব থেকে সৃষ্ট হয়েছে। নীচে বিভিন্ন প্রাণীর সমসংস্থ অঙ্গগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ সারণির আকারে দেওয়া হল।


উদ্ভিদের ক্ষেত্রে সমসংস্থ অঙ্গ –
উদ্ভিদের ক্ষেত্রে সমসংস্থ অঙ্গগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ সারণির আকারে দেওয়া হল।


উপরোক্ত উদাহরণগুলি থেকে বোঝা যায় বিভিন্ন জীবগুলি উৎপত্তিগতভাবে এক হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে অভিযোজিত হওয়ার কারণে তাদের কাজ ও বহিরাকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে। সুতরাং বলা যায় যে, একই উদ্বংশীয় জীব থেকে উদ্ভূত জানগোষ্ঠী বিভিন্ন পরিবেশে অভিযোজনের কারণে কার্যগত ও বাহ্যিক গঠনগত দিক থেকে বিভিন্ন হয়। অর্থাৎ, সমসংস্থ অঙ্গ সাধারণভাবে অপসারী পিবর্তনকে চিহ্নিত করে।
সমবৃত্তীয় অঙ্গ কীভাবে জৈব অভিব্যক্তির সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে কাজ করে, উদ্ভিদ ও প্রাণীর উদাহরণের সাহায্যে লেখো।
জৈব অভিব্যক্তির সমবৃত্তীয় অঙ্গঘটিত প্রমাণ –
যেসব অঙ্গ উৎপত্তি ও গঠনগত দিক থেকে ভিন্ন হলেও কার্যগত দিক থেকে এক, তাদের সমবৃত্তীয় অঙ্গ বলা হয়।
প্রাণীর সমবৃত্তীয় অঙ্গ –
পতঙ্গ ও পাখির ডানা ওড়ার জন্য ব্যবহৃত হলেও এদের উৎপত্তি ও গঠনগত দিক থেকে কোনো সাদৃশ্য নেই।

পতঙ্গের ডানা কিউটিক্স বা বহিঃকঙ্কালের প্রসারিত অংশ, অন্যদিকে পাখির ডানা পালক আবৃত অগ্রপদ বিশেষ। প্রাণীর অপর একটি সমবৃত্তীয় অঙ্গ হল মৌমাছি ও কাঁকড়াবিছের হুল। কার্যগতভাবে এরা উভয়ক্ষেত্রেই আত্মরক্ষায় সাহায্য করে, তবে এদের গঠন পৃথক। মৌমাছির হুল পরিবর্তিত ওভিপোজিটার ও কাঁকড়াবিছের হুল হল অন্তিম উদর খন্ডকের রূপান্তর।

উদ্ভিদের সমবৃত্তীয় অঙ্গ –
মটর গাছের পাতার আকর্ষ ও ঝুমকোলতার কাণ্ডের আকর্ষ একইরকম কাজ করলেও এরা উৎপত্তি ও গঠনগতভাবে ভিন্ন। মটর গাছের আকর্ষ রূপান্তরিত পাতা ও ঝুমকোলতার আকর্ষ হল রূপান্তরিত শাখা। অর্থাৎ একই পরিবেশে বসবাস ও একই ক্রিয়াকলাপের জন্য এরূপ সমবৃত্তীয় অঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে বেল ও ফণীমনসার আত্মরক্ষায় সাহায্য করলেও প্রথমটি পরিবর্তিত শাখা ও দ্বিতীয়টি পাতার রূপান্তর বিশেষ। নীচে সারণির আকারে বিভিন্ন উদ্ভিদের সমবৃত্তীয় অঙ্গগুলি দেওয়া হল।

উপরোক্ত উদাহরণগুলি থেকে বোঝা যায় যে নানারকম জীব একই পরিবেশে একইরকমভাবে অভিযোজিত হয় ও তার ফলে তাদের মধ্যে আপাত কার্যগত মিল সৃষ্টি হয়। সমবৃত্তীয় অঙ্গ অভিসারী বিবর্তনকে প্রমাণ করে।
নিষ্ক্রিয় অঙ্গ কাকে বলে? বিবর্তনের সপক্ষে নিষ্ক্রিয় বা লুপ্তপ্রায় অঙ্গঘটিত প্রমাণ আলোচনা করো।
নিষ্ক্রিয় অঙ্গ –
যে সমস্ত অঙ্গ কোনো জীবের পূর্বপুরুষের দেহে এবং তাদের নিকট সম্পর্কিত অন্য জীবের দেহে সক্রিয় এবং কর্মক্ষম অবস্থায় থাকলেও, সংশ্লিষ্ট জীবটির দেহে ক্রমাগত অব্যবহারের ফলে কর্মক্ষমতা হারিয়ে নিষ্ক্রিয় ও ক্ষয়প্রাপ্ত অঙ্গে পরিণত হয়েছে, তাদের নিষ্ক্রিয় অঙ্গ বা লুপ্তপ্রায় অঙ্গ বলে।
বিবর্তনের সপক্ষে নিষ্ক্রিয় অঙ্গঘটিত প্রমাণ –
- ঘোড়া, গিনিপিগ প্রভৃতি তৃণভোজী প্রাণীর পৌষ্টিকতন্ত্রের ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদন্ত্রের সংযোগস্থলে অবস্থিত সিকাম একটি সক্রিয় অঙ্গ যা মানুষের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রাকার নিষ্ক্রিয় ভারমিফর্ম অ্যাপেনডিক্সে পরিণত হয়েছে। সিকামের কাজ হল তৃণভোজী প্রাণীদের সেলুলোজ জাতীয় খাদ্যের পরিপাকে সাহায্য করা। মানুষের খাদ্যে সেলুলোজের পরিমাণ কম থাকায় অব্যবহারজনিত কারণে এটি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।
- বানরের দেহের সক্রিয় ল্যাজ মানুষের ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডের শেষপ্রান্তে ক্ষুদ্র ও নিষ্ক্রিয় কক্সিস-রূপে অবস্থান করে।
- মানুষের চোখের উপপল্লব বা তৃতীয় পল্লব, বহিঃকর্ণের পেশি, উদরের খন্ডিত পেশি, তৃতীয় পেষক দন্ড প্রভৃতি হল আরও কয়েকটি লুপ্তপ্রায় অঙ্গের উদাহরণ।
- পাখিদের মধ্যেও লুপ্তপ্রায় অঙ্গের প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন – উটপাখি, এমু, কিউই প্রভৃতি পাখির ডানা নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হয়েছে।
- আদা, হলুদ প্রভৃতির উদ্ভিদের ভূনিম্নস্থ কাণ্ডের শল্কপত্র, কালকাসুন্দা উদ্ভিদের বন্ধ্যা পুংকেশর বা স্ট্যামিনোড উদ্ভিদের নিষ্ক্রিয় অঙ্গ।

নিষ্ক্রিয় অঙ্গের উপস্থিতি থেকে বোঝা যায় যে নিষ্ক্রিয় অঙ্গযুক্ত জীব, ওই একই প্রকৃতির সক্রিয় অঙ্গযুক্ত উদ্বংশীয় জীব থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এটি বিবর্তনবাদকেই সমর্থন করে।
বিবর্তন বা জৈব অভিব্যক্তির সপক্ষে হৃৎপিণ্ড ঘটিত প্রমাণ ও বিবর্তনগত গুরুত্ব চিত্রসহ আলোচনা করো।
অথবা, বিভিন্ন মেরুদণ্ডী প্রাণীর হৃদপ্রকোষ্ঠের সংখ্যা, অধিক O₂ অধিক CO₂ যুক্ত রক্তের মিশ্রণ সম্বন্ধে তুলনামূলক আলোচনা করো। এর অভিব্যক্তির গুরুত্ব আলোচনা করো।
অনুরূপ প্রশ্ন, হৃৎপিণ্ডের তুলনামূলক অঙ্গসংস্থান কীভাবে অভিব্যক্তি মতবাদের সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে কাজ করে?
জৈব অভিব্যক্তির সপক্ষে হৃৎপিণ্ড ঘটিত প্রমাণ –
মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পক্ষী ও স্তন্যপায়ী প্রভৃতি বিভিন্ন মেরুদণ্ডী শ্রেণির প্রাণীগুলির ক্ষেত্রে হৃৎপিন্ডের গঠনগত জটিলতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। যথা – মাছের হৃৎপিণ্ডে দুটি প্রকোষ্ঠ দেখা যায়, একটি অলিন্দ ও একটি নিলয়। এইজন্য মাছের হৃৎপিন্ডের মধ্যে দিয়ে কেবলমাত্র কম অক্সিজেন-যুক্ত রক্ত (বা অধিক কার্বন ডাইঅক্সাইড-যুক্ত রক্ত) প্রবাহিত হয়। উভচর শ্রেণির

প্রাণীর হৃৎপিণ্ডে তিনটি প্রকোষ্ঠ থাকে। এগুলি হল দুটি অলিন্দ ও একটি নিলয়। ব্যাঙের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র নিলয়ে অধিক অক্সিজেন-যুক্ত ও কম অক্সিজেন-যুক্ত রক্তের সামান্য মিশ্রণ ঘটে। অর্থাৎ, এটি তুলনামূলকভাবে উন্নত হৃৎপিণ্ড। সরীসৃপ শ্রেণির প্রাণীর হৃৎপিন্ডে আরও উন্নতি দেখা যায় (ব্যতিক্রম কুমির)। এদের হৃৎপিণ্ডে অসম্পূর্ণ চারটি প্রকোষ্ঠ থাকে, এগুলি হল দুটি অলিন্দ ও অসম্পূর্ণভাবে বিভক্ত দুটি নিলয়। নিলয়ে অসম্পূর্ণ আন্তঃনিলয় প্রাচীর থাকে বলে সরীসৃপের হৃৎপিণ্ডে অধিক অক্সিজেন-যুক্ত এবং কম অক্সিজেন-যুক্ত রক্তের মিশ্রণ অপেক্ষাকৃত কম হয়। পাখি ও স্তন্যপায়ীদের হৃৎপিণ্ড সম্পূর্ণরূপে চারটি প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট হয়। ফলে এদের হৃৎপিণ্ডে অধিক অক্সিজেন-যুক্ত রক্ত ও কম অক্সিজেন-যুক্ত রক্ত একেবারেই মিশতে পারে না। অর্থাৎ, এদের হৃৎপিণ্ড সবচেয়ে উন্নত।
বিবর্তনগত গুরুত্ব –
জৈব অভিব্যক্তির সপক্ষে হৃৎপিণ্ডঘটিত প্রমাণের বিবর্তনগত গুরত্ব নীচে আলোচনা করা হল। উপরোক্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীগুলির হৃৎপিণ্ডের মৌলিক গঠন এক, যদিও তা ক্রমশ জটিল হয়েছে। অর্থাৎ, একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তনের পথে ক্রমশ জটিল জীবগুলির উৎপত্তি ঘটেছে। মাছ, উভচর, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলি অভিব্যক্তির পথে মেরুদন্ডী প্রাণীর বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি বিশেষ। হৃৎপিণ্ডের গঠনগত ও কার্যগত বিকাশ অনুযায়ী পৃথিবীতে এদের আগমন ক্রম বোঝা যায়। অর্থাৎ, এদের আগমনের ক্রম হল –
মাছ → উভচর → সরীসৃপ → পাখি ও স্তন্যপায়ী
হৃৎপিন্ডের এই ক্রম পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মেরুদণ্ডী প্রাণীর ক্রমবিকাশের যে ধারা বোঝা যায়, তা হল –
জলজ জীবন → উভচর জীবন → পূর্ণস্থলচর জীবন
জৈব বিবর্তনের সপক্ষে ভ্রুনতত্ত্বগত প্রমাণ সংক্ষেপে আলোচনা করো।
জৈব বিবর্তনের সপক্ষে ভ্রুণতত্ত্বগত প্রমাণ –
মৎস, উভচর, সরীসৃপ, পক্ষী এবং স্তন্যপায়ী প্রভৃতি শ্রেণির প্রাণীর ভ্রুণের বৃদ্ধি এবং ক্রমিক পর্যায় পর্যবেক্ষণ করলে প্রথম দিকে তাদের মধ্যে বহু সাদৃশ্য পাওয়া যায়, যার থেকে প্রমাণিত হয় যে এরা একই সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। যেমন –
- এগুলির প্রত্যেকটির জাইগোট একটি মাত্র কোশ দিয়ে গঠিত।
- জাইগোট মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয়ে বহুকোশী ব্লাস্টুলা গঠন করে।
- পরবর্তী পর্যায়ে ব্লাস্টুলা থেকে গ্যাস্টুলার আবির্ভাব ঘটে।
- এদের প্রত্যেকের দেহ তিনটি স্তরবিশিষ্ট।
মৎস্য, উভচর, পক্ষী ও স্তন্যপায়ী শ্রেণির ভ্রুণের বিকাশ বিশ্লেষণ করলে মূলত, দুটি বিষয়ের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এই সাদৃশ্যগুলি হল –
গলবিলীয় বহিস্থ ফুলকা খাঁজ ও অন্তঃস্থ যুগ্ম ফুলকাথলি –
প্রতিটি শ্রেণির ভ্রুণের প্রাথমিক পর্যায়ে গলবিলীয় বহিস্থ ফুলকা খাঁজ দেখা যায়। মাথার নীচে পার্শ্বীয়ভাবে এই খাঁজ উপস্থিত থাকে। প্রকৃতপক্ষে, ভ্রুনে গলবিলের ভিতরের দিকে অন্তত্ত্বক স্ফীত হয়ে যুগ্ম ফুলকাথলি গঠন করে, যার ফলে বাইরের দিকে বহিস্থ ফুলকা খাঁজ তৈরি হয়। এদের একত্রে গলবিলীয় যন্ত্র বলা হয়। এর থেকে পরবর্তীকালে মাছের দেহে ফুলকা তৈরি হয়। স্থলজ প্রাণীর দেহে ফুলকার প্রয়োজন থাকে না, তাই এদের দেহে ওই অংশ পরিবর্তিত হয়ে প্যারাথাইরয়েড, থাইমাস ও থাইরয়েড গ্রন্থি গঠিত হয়।

ল্যাজ-সদৃশ গঠন ও মায়োটম পেশি –
প্রত্যেক মেরুদণ্ডী প্রাণীর ভ্রুণে প্রাথমিক অবস্থায় ল্যাজ-সদৃশ গঠন ও তাতে মায়োটম পেশির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এর বিন্যাসে যে সাদৃশ্য দেখা যায় তা এই প্রাণীগুলির মধ্যে অভিব্যক্তিগত সম্পর্ক প্রমাণ করে।
আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞানের চতুর্থ অধ্যায় “অভিব্যক্তি ও অভিযোজন” অধ্যায়ের ‘অভিব্যক্তি‘ বিভাগের উপ-অধ্যায় ‘অভিব্যক্তির ধারণা, জীবনের উৎপত্তি, অভিব্যক্তির মুখ্য ঘটনাবলি‘ -এর রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি যে এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে আপনারা আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। তাছাড়া, আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জন যার এটি প্রয়োজন হবে তার সাথে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন