মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা এবং সাড়াপ্রদান – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

Rahul

আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞানের প্রথম অধ্যায় “জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়” অধ্যায়ের ‘উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা এবং সাড়াপ্রদান‘ বিভাগের রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি যে এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হবে।

উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা এবং সাড়াপ্রদান - রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা এবং সাড়াপ্রদান – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
Contents Show

উদ্ভিদ কীভাবে পরিবেশ-পরিবর্তন শনাক্ত করে? উদাহরণের মাধ্যমে উদ্ভিদের সাড়াপ্রদানের বিষয়টি বুঝিয়ে লেখো।

উদ্ভিদের পরিবেশ-পরিবর্তন শনাক্তকরণ –

সকল জীবই উদ্দীপনার প্রভাবে কম-বেশি সংবেদনশীলতা দেখায়। আগে মনে করা হত যে, পরিবেশের কোনো পরিবর্তনই উদ্ভিদ শনাক্ত করে না। কিন্তু বাস্তবে উদ্ভিদও প্রাণীর মতোই পরিবেশের পরিবর্তন শনাক্ত করে ও তাতে সাড়াপ্রদান করে। যদিও উদ্ভিদের ক্ষেত্রে উদ্দীপকের প্রভাবে সাড়াপ্রদানের ঘটনা প্রাণীদের তুলনায় অনেক কম দেখা যায়। অধিকাংশ উদ্ভিদ একটি নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ থাকে বলে তথা গমনে অক্ষম হওয়ায়, তারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালন বা চলনের মাধমে সাড়াপ্রদান করে।

উদ্ভিদের সাড়াপ্রদানের উদাহরণ –

উদ্ভিদের সাড়াপ্রদান সাধারণত অত্যন্ত ধীর ঘটনা এবং তা মূলত উদ্ভিদ-অঙ্গের বৃদ্ধিজনিত বা রসস্ফীতিজনিত হয়ে থাকে। উদ্ভিদজগতে দ্রুত সাড়াপ্রদানের ঘটনা অত্যন্ত বিরল। উদ্ভিদের দ্রুত সাড়াপ্রদান বা সংবেদনশীলতার দুটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল –

  • লজ্জাবতী বা Mimosa pudica (মাইমোসা পুডিকা) গাছের পক্ষল যৌগিক পত্রগুলি স্পর্শ করলে তার পত্রকগুলি গুটিয়ে যায় ও নুয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে স্পর্শ বা ছোঁয়ার ফলে পত্রকের উপাধানের কোশগুলির রসস্ফীতি পরিবর্তিত হয় বা রসস্ফীতি চাপ হ্রাস পাওয়ার জন্য পত্রকগুলি পত্রকঅক্ষ বা র‍্যাকিস বরাবর নুয়ে যায়। এক্ষেত্রে স্পর্শ হল উদ্দীপক; এবং পত্রকের নুয়ে যাওয়া হল সাড়াপ্রদান।
  • বনচাঁড়াল বা Desmodium gyrans (ডেসমোডিয়াম গাইর‍্যানস) নামক গাছের ত্রিফলকযুক্ত পাতার বৃত্তের পাশের ছোটো পত্রক দুটি ক্রমাগত ওঠানামা করতে থাকে। এই চলনটি শুধুমাত্র দিনের বেলায় অভ্যন্তরীণ উদ্দীপনার প্রভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে।
স্পর্শজনিত ন্যাস্টিক চলন
স্পর্শজনিত ন্যাস্টিক চলন

উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা প্রমাণের ক্ষেত্রে জগদীশ চন্দ্র বসুর অবদান কী? বৃদ্ধিজ ও প্রকরণ চলন কাকে বলে?

জগদীশ চন্দ্র বসুর অবদান –

উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা প্রমাণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি লজ্জাবতী ও বনচাঁড়াল উদ্ভিদ দুটি নিয়ে তাদের সাড়াপ্রদান সংক্রান্ত পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। তিনি নিজের আবিষ্কৃত ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে উদ্ভিদ দুটির চলন নির্ণয় করে উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা প্রমাণ করেন। ক্রেসকোগ্রাফ একটি অত্যন্ত সুবেদী যন্ত্র যা উদ্ভিদের সামান্যতম সাড়াপ্রদানও পরিমাপ করতে পারে। এই যন্ত্রের সাহায্যে প্রাপ্ত গ্রাফ পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানী বসু আবিষ্কার করেন যে –

  • প্রাণীর মতোই, উদ্ভিদদেহেও ছন্দোবদ্ধ ক্রিয়া সম্পন্ন হয় যা উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা তথা চলন নিয়ন্ত্রণ করে,
  • বাহ্যিক বিভিন্ন উদ্দীপনা, যেমন – স্পর্শ, তাপ, ঠান্ডা, বিষ প্রভৃতি কোশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটায় যা উদ্ভিদের সাড়াপ্রদানে সাহায্য করে।

বৃদ্ধিজ চলন ও প্রকরণ চলন –

উদ্ভিদের বর্ধনশীল অংশের অসমান বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্ভিদ-অঙ্গের যে চলন সম্পন্ন হয়, তাকে বৃদ্ধিজ চলন বলে। যেমন – ক্রমাগত একই দিকে বৃদ্ধির কারণে উদ্ভিদের আকর্ষের অবলম্বনের চারপাশে পেঁচিয়ে যাওয়া। কোশের রসস্ফীতির তারতম্যের জন্য উদ্ভিদের পরিণত অংশে যে চলন দেখা যায়, তাকে প্রকরণ চলন বলে। যেমন, বনচাঁড়ালে পার্শ্বীয় পত্রকের চলন।

উদ্ভিদের চলন কাকে বলে? উদ্ভিদের বিভিন্নপ্রকার উদ্দীপক নিয়ন্ত্রিত চলন একটি ছকের সাহায্যে দেখাও।

উদ্ভিদের চলন –

যে প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ বিভিন্ন উদ্দীপকের প্রভাবে বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক স্থানে স্থির থেকে তার দেহের কোনো অংশ সঞ্চালন করে, তাকে উদ্ভিদের চলন বলে।

উদ্ভিদের ক্ষেত্রে চলন হল সাড়াপ্রদানের একটি মাধ্যম। প্রায় সমস্ত উদ্ভিদের ক্ষেত্রে চলন দেখা যায়। তবে কিছু নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদের ক্ষেত্রে সমগ্র উদ্ভিদেহের বা দেহাংশের সামগ্রিকভাবে স্থান পরিবর্তন ঘটে বা গমন ঘটে।

উদ্ভিদের উদ্দীপক নিয়ন্ত্রিত চলনের প্রকারভেদ –

উদ্দীপক নিয়ন্ত্রিত উদ্ভিদ চলন প্রধানত তিনপ্রকার, যথা –

  1. ট্যাকটিক চলন।
  2. ট্রপিক চলন।
  3. ন্যাস্টিক চলন।

এই তিনপ্রকার চলনের মধ্যে ট্যাকটিক চলন হল সামগ্রিক চলন এবং ট্রপিক ও ন্যাস্টিক চলন হল বক্রচলন।

উদ্দীপক নিয়ন্ত্রিত উদ্ভিদ চলনের প্রকারভেদগুলি নীচে ছকের সাহায্যে দেখানো হল –

উদ্ভিদের চলন
উদ্ভিদের চলন

ট্যাকটিক চলনের বৈশিষ্ট্য লেখো। ফোটোট্যাকটিক চলন বলতে কী বোঝ উদাহরণসহ লেখো।

ট্যাকটিক চলনের বৈশিষ্ট্য –

ট্যাকটিক চলনের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

  • এইপ্রকার চলনে উদ্ভিদের সামগ্রিক স্থান পরিবর্তন ঘটে, অর্থাৎ গমন সম্পন্ন হয়।
  • ট্যাকটিক চলন কোনো বহিস্থ উদ্দীপক ও তার উৎসের অভিমুখ বা গতিপথ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
  • সাধারণত অনুন্নত জলজ উদ্ভিদে ও উদ্ভিদের জননকোশে এই চলন ঘটে।
  • সিলিয়া বা ফ্ল্যাজেলা ট্যাকটিক চলনে সহায়তা করে।

ফোটোট্যাকটিক চলন –

বাহ্যিক আলোক উদ্দীপক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যখন কোনো উদ্ভিদ বা উদ্ভিদ-অংশ সামগ্রিকভাবে স্থান পরিবর্তন করে, তখন সেই চলনকে ফোটোট্যাকটিক চলন বলে। বিভিন্ন নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদে এইপ্রকার চলন দেখা যায়। উদাহরণ – Chlamydomonas (ক্ল্যামাইডোমোনাস) ও Volvox (ভলভক্স) আলোর স্বল্প তীব্রতায় আলোক-উৎসের দিকে অগ্রসর হয়, কিন্তু উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে তীব্র আলো থেকে দূরে সরে যায়।

ফোটোট্যাকটিক চলন
ফোটোট্যাকটিক চলন

উদ্ভিদের যে-কোনো দু-ধরনের ট্রপিক চলন উদাহরণসহ আলোচনা করো।

অথবা, উদ্ভিদের ফোটোট্রপিক চলন পরীক্ষাসহ আলোচনা করো।

উদ্ভিদের ট্রপিক চলন –

উদ্ভিদের ট্রপিক চলন মূলত তিন প্রকার। যথা –

  1. ফোটোট্রপিক চলন।
  2. জিওট্রপিক চলন।
  3. হাইড্রোট্রপিক চলন।

বিভিন্ন ধরনের ট্রপিক চলন উদাহরণ সহযোগে আলোচনা করা হল।

ফোটোট্রপিক চলন –

উদ্ভিদ-অঙ্গের বক্রচলন যখন আলোর উৎসের গতিপথ বা অভিমুখ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন তাকে ফোটোট্রপিক বা আলোক-বৃত্তীয় চলন বলে। উদ্ভিদের কাণ্ড, শাখাপ্রশাখা আলোর উৎসের দিকে বৃদ্ধি পায়। তাই কাণ্ডকে আলোক-অনুকূলবর্তী বলে। অন্যদিকে, মূল আলোর উৎসের বিপরীত দিকে বৃদ্ধি পায়। তাই মূলকে আলোক-প্রতিকূলবর্তী বলে। আবার, পাতা আলোর উৎসের সাথে তির্যকভাবে বা লম্বভাবে বৃদ্ধি পায় বলে পাতাকে আলোক-তির্যকবর্তী বলা হয়।

উদাহরণ – একটি জলপূর্ণ কাচের বোতলে কর্কের সাহায্যে একটি চারাগাছ লাগানো হল। এবার বোতলসহ চারাগাছটি যদি অন্ধকার ঘরে একটি জানালার পাশে রেখে জানালার একটি পাল্লা খুলে রাখা হয় তবে কয়েকদিন পর দেখা যাবে চারাগাছের ডালপালা জানালার দিকে অর্থাৎ, আলোক-উৎসের দিকে বেঁকে গেছে। একইসঙ্গে লক্ষ করা যাবে যে, জল চারাগাছের মূল নীচের দিকে অর্থাৎ আলোক-উৎসের বিপরীতে বৃদ্ধি পায়। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিটপ অংশ আলোক-অনুকূলবর্তী ও মূল আলোক-প্রতিকূলবর্তী।

উদ্ভিদে ফোটোট্রপিক চলনের পরীক্ষা
উদ্ভিদে ফোটোট্রপিক চলনের পরীক্ষা

জিওট্রপিক চলন –

উদ্ভিদ-অঙ্গের বক্রচলন যখন অভিকর্ষের গতিপথ বা অভিমুখ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তখন তাকে জিওট্রপিক বা অভিকর্ষবৃত্তীয় চলন বলে। উদ্ভিদের মূল অভিকর্ষের দিকে এবং বিটপ অভিকর্ষের বিপরীত দিকে বৃদ্ধি পায়। তাই মূলকে অভিকর্ষ-অনুকূলবর্তী ও বিটপকে অভিকর্ষ-প্রতিকূলবর্তী বলে।

উদাহরণ – একটি ভিজে ব্লটিং পেপারে একটি অঙ্কুরিত বীজকে পিনের সাহায্যে আটকে ব্লটিং পেপারটিকে একটি দড়ির সাহায্যে অন্ধকার ঘরে খাড়াভাবে ঝুলিয়ে রেখে দেওয়া হল। এর কয়েকদিন পরে দেখা যাবে অঙ্কুরিত বীজের ভ্রূণমূল নীচের দিকে ও ভ্রূণমুকুল ওপরের দিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরীক্ষা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ভ্রূণমূল অভিকর্ষের অনুকূলবর্তী এবং ভ্রূণমুকুল অভিকর্ষের প্রতিকূলবর্তী।

উদ্ভিদে জিওট্রপিক চলনের পরীক্ষা
উদ্ভিদে জিওট্রপিক চলনের পরীক্ষা

হাইড্রোট্রপিক চলন –

উদ্ভিদ-অঙ্গের বক্রচলন যখন জলের উৎসের গতিপথ বা অভিমুখ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন তাকে হাইড্রোট্রপিক চলন বা জলবৃত্তীয় চলন বলে। উদ্ভিদের মূলের চলন জলের উৎসের দিকে হয়। তাই মূলকে জল-অনকূলবর্তী এবং বিটপ জলের উৎসের বিপরীত দিকে বৃদ্ধি পায়। তাই বিটপকে জল-প্রতিকূলবর্তী বলে।

উদাহরণ – একটি চালুনিতে কাঠের ভিজে গুঁড়োর ওপর কতকগুলি সতেজ ছোলার বীজ রেখে ঝুলিয়ে দিলে কয়েকদিন পর বীজগুলি অঙ্কুরিত হয়ে অভিকর্ষবৃত্তির কারণে ভ্রূণমূলগুলিকে চালুনির বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখা যাবে। এভাবে আরও কয়েকদিন রেখে দিলে দেখা যাবে, ভ্রূণমূলগুলি আবার চালুনির ভিতর ঢুকে যায়। এর থেকে প্রমাণিত হয়, ভ্রূণমূলগুলি প্রথমে চালুনির বাইরে অভিকর্ষের টানে নীচের দিকে ঝুলতে থাকে এবং পরে সেগুলি জলের উৎসের দিকে বেঁকে আবার চালুনির ভিতর প্রবেশ করে। অর্থাৎ প্রমাণিত হয় যে, মূলের মধ্যে অনুকূল জলবৃত্তীয় চলন দেখা যায়।

উদ্ভিদে হাইড্রোট্রপিক চলনের পরীক্ষা
উদ্ভিদে হাইড্রোট্রপিক চলনের পরীক্ষা

[শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে এখানে তিনপ্রকার ট্রপিক চলনই উদাহরণ সহযোগে আলোচনা করা হল। পরীক্ষায় এই প্রশ্নের উত্তরে শুধুমাত্র দুইপ্রকার ট্রপিক চলন সম্পর্কে লিখতে হবে।]

আলো ও অভিকর্ষ বল উদ্ভিদের চলনকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে?

আলো ও অভিকর্ষ বল দ্বারা উদ্ভিদের চলন নিয়ন্ত্রণ –

উদ্ভিদ-চলন নিয়ন্ত্রণকারী দুটি অন্যতম উদ্দীপক হল আলো ও অভিকর্ষ বল। নীচে এই দুটি উদ্দীপকের ভূমিকা উল্লেখ করা হল –

  1. আলোর দ্বারা উদ্ভিদের চলন নিয়ন্ত্রণ।
  2. অভিকর্ষ বল দ্বারা উদ্ভিদের চলন নিয়ন্ত্রণ।

আলোর দ্বারা উদ্ভিদের চলন নিয়ন্ত্রণ –

উদ্ভিদ-অঙ্গের ট্রপিক চলন আলোক-উৎসের দিক-নির্ভর হয়। এই ধরনের চলনকে আলোকবর্তী চলন বা ফোটোট্রপিজম বলে। উদ্ভিদের কাণ্ড ও শাখাপ্রশাখা আলোর উৎসের দিকে বৃদ্ধি পায়। তাই উদ্ভিদের কাণ্ডকে আলোক-অনুকূলবর্তী বলে। অপরদিকে, উদ্ভিদের মূল আলোক-উৎসের বিপরীত দিকে বৃদ্ধি পায়, তাই মূলকে আলোক-প্রতিকূলবর্তী বলে। উদ্ভিদের পাতা আলোক-উৎসের সাথে লম্বভাবে বৃদ্ধি পায়, তাই এদের আলোক-তির্যকবর্তী বলা হয়। অক্সিন নামক উদ্ভিদ-হরমোন এই ধরনের চলন নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া Chlamydomonas (ক্ল‍্যামাইডোমোনাস), Volvox (ভলভক্স) প্রভৃতি নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদের ক্ষেত্রে আলোক-উৎসের অভিমুখে সামগ্রিক স্থান পরিবর্তন ঘটে, যা ফোটোট্যাকটিক চলন নামে পরিচিত। আবার, আলোর তীব্রতার দ্বারাও উদ্ভিদ চলন নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এইপ্রকার চলনকে ফোটোন্যাস্টিক চলন বলে। পদ্ম, সূর্যমুখী প্রভৃতি ফুলের তীব্র আলোতে ফোটা ও সূর্যাস্তের সাথে সাথে বুজে যাওয়া এই ধরনের ফোটোন্যাস্টিক চলনের উদাহরণ।

অভিকর্ষ বল দ্বারা উদ্ভিদের চলন নিয়ন্ত্রণ –

অভিকর্ষ বলের প্রভাবে উদ্ভিদ-অঙ্গের চলনকে অভিকর্ষবৃত্তীয় চলন বা জিওট্রপিজম বলে। উদ্ভিদের মূল অভিকর্ষের দিকে এবং বিটপ অভিকর্ষের বিপরীত দিকে ধাবিত হয়। এই কারণে মূলকে অভিকর্ষ-অনুকূলবর্তী ও কাণ্ডকে অভিকর্ষ-প্রতিকূলবর্তী বলা হয়। এ ছাড়া, উদ্ভিদের পার্শ্বীয় মূল পৃথিবীর ভরকেন্দ্র বা অভিকর্ষের উৎসের সাথে লম্বভাবে বৃদ্ধি পায়, তাই এদের অভিকর্ষ-তির্যকবর্তী বলা হয়। এইপ্রকার চলনেও অক্সিনের ভূমিকা অপরিসীম।

ট্রপিক চলন ও ন্যাস্টিক চলনের বৈশিষ্ট্য লেখো।

ট্রপিক চলনের বৈশিষ্ট্য –

ট্রপিক চলনের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

  • এইপ্রকার চলন উদ্ভিদ-অঙ্গের বক্রতা সৃষ্টির মাধ্যমে ঘটে।
  • বিভিন্ন প্রকার বহিস্থ উদ্দীপক, যেমন – আলো, জল, অভিকর্ষ প্রভৃতির গতিপথ বা উৎস দ্বারা এই চলন নিয়ন্ত্রিত হয়।
  • ট্রপিক চলন উদ্ভিদের বর্ধনশীল অঙ্গ, যেমন – মূল, কাণ্ড, শাখাপ্রশাখা প্রভৃতিতে ঘটে থাকে।
  • ট্রপিক চলনে হরমোনের প্রভাবে উদ্ভিদ-অঙ্গের বৃদ্ধি ঘটে, তাই একে বৃদ্ধিজনিত আবিষ্ট বক্রচলন বলে।

ন্যাস্টিক চলনের বৈশিষ্ট্য –

ন্যাস্টিক চলনের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

  • এইপ্রকার চলন বহিস্থ উদ্দীপকের প্রভাবে রসস্ফীতি জনিত তারতম্যের দ্বারা উদ্ভিদ-অঙ্গের বক্রতা সৃষ্টির মাধ্যমে ঘটে।
  • আলো, উষ্ণতা, স্পর্শ বা আঘাত, রাসায়নিক পদার্থ প্রভৃতি উদ্দীপকের প্রভাবে এইপ্রকার চলন ঘটে।
  • ন্যাস্টিক চলন উদ্দীপকের তীব্রতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

উদ্ভিদের বিভিন্নপ্রকার ন্যাস্টিক চলন সংক্ষেপে বর্ণনা করো।

ন্যাস্টিক চলনের প্রকারভেদ –

ন্যাস্টিক চলন বিভিন্ন প্রকারের হয়। যেমন –

  1. ফোটোন্যাস্টিক চলন।
  2. থার্মোন্যাস্টিক চলন।
  3. সিসমোন্যাস্টিক চলন।
  4. কেমোন্যাস্টিক চলন।
  5. নিকটিন্যাস্টিক চলন।

প্রধান পাঁচপ্রকার ন্যাস্টিক চলন সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল।

ফোটোন্যাস্টিক চলন –

আলোকের তীব্রতার হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে উদ্ভিদ-অঙ্গের যে বক্রচলন হয়, তাকে ফোটোন্যাস্টি বা ফোটোন্যাস্টিক চলন বলে। যেমন – সূর্যমুখী ফুল দিনের বেলায় আলোর তীব্রতার পরিপ্রেক্ষিতে দিক পরিবর্তন করে। আবার, বেল ফুল সূর্যালোকে বুজে যায় এবং রাতে ফোটে।

থার্মোন্যাস্টিক চলন –

তাপমাত্রার তীব্রতার ওপর নির্ভর করে উদ্ভিদ-অঙ্গের যে বক্রচলন হয়, তাকে থার্মোন্যাস্টি বা থার্মোন্যাস্টিক চলন বলে। যেমন – টিউলিপ ফুল স্বাভাবিক উষ্ণতায় ফোটে, কিন্তু উষ্ণতা হ্রাস পেলে ফুলের পাপড়ি বন্ধ হয়ে যায়।

সিসমোন্যাস্টিক চলন –

স্পর্শ, কম্পন, ঘর্ষণ, আঘাত প্রভৃতির মতো বিভিন্ন উদ্দীপকের তীব্রতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত উদ্ভিদ-অঙ্গের বক্রচলনকে সিসমোন্যাস্টি বা সিসমোন্যাস্টিক চলন বলে। যেমন – লজ্জাবতীর পাতার পত্রকগুলি আলতোভাবে স্পর্শ করলে তা বন্ধ হয়ে যায় এবং স্পর্শ জোরালো হলে সমগ্র পাতা নুয়ে পড়ে। আবার, স্পর্শ সরিয়ে নিলে লজ্জাবতীর পত্রক খুলে যায়।

সিসমোন্যাস্টিক চলন
সিসমোন্যাস্টিক চলন

কেমোন্যাস্টিক চলন –

রাসায়নিক পদার্থের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে উদ্ভিদ-অঙ্গের যে বক্রচলন সম্পন্ন হয়, তাকে কেমোন্যাস্টি বা কেমোন্যাস্টিক চলন বলে। যেমন – ইথার, ক্লোরোফর্ম প্রভৃতি রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে উদ্ভিদের কচি আকর্ষ বেঁকে যায়। সূর্যশিশিরের পত্রফলকের ওপর পতঙ্গ বসলে কর্ষিকাগুলি বেঁকে গিয়ে পতঙ্গকে ঘিরে ফেলে।

নিকটিন্যাস্টিক চলন –

উদ্ভিদ-অঙ্গের বক্রচলন যখন আলোক ও উষ্ণতা উভয়ের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে, তখন তাকে নিকটিন্যাস্টিক চলন বলে। যেমন – আমরুল, বাবলা, শিরিষ প্রভৃতি গাছের পাতার পত্রকগুলি দিনের বেলা আলো ও তাপের প্রভাবে খুলে যায় ও বিকেল থেকে সন্ধ্যার অন্ধকারে ও নিম্ন তাপমাত্রায় বন্ধ হয়ে যায়। [নিকটিন্যাস্টিক চলন সিলেবাস বহির্ভূত। শিক্ষার্থীদের জ্ঞাতার্থে এখানে উল্লেখ করা হল।]

ট্যাকটিক, ট্রপিক ও ন্যাস্টিক চলনের মধ্যে তুলনা করো।

ট্যাকটিক, ট্রপিক ও ন্যাস্টিক চলনের তুলনা গুলি হলো –

বিষয়ট্যাকটিক চলনট্রপিক চলনন্যাস্টিক চলন
প্রধান বৈশিষ্ট্যবাহ্যিক উদ্দীপকের প্রভাবে সামগ্রিক উদ্ভিদদেহের স্থান পরিবর্তন।বাহ্যিক উদ্দীপকের গতিপথ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত উদ্ভিদ-অঙ্গের বক্রচলন।বাহ্যিক উদ্দীপকের তীব্রতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত উদ্ভিদ-অঙ্গের বক্রচলন।
উদ্দীপকের প্রভাবউদ্দীপকের উৎসের গতিপথ ও তীব্রতা দ্বারা প্রভাবিত হয়।কেবলমাত্র উদ্দীপকের উৎসের গতিপথ দ্বারা প্রভাবিত হয়।কেবলমাত্র উদ্দীপকের উৎসের তীব্রতা দ্বারা প্রভাবিত হয়।
উদ্ভিদের চলন অঙ্গসমগ্র উদ্ভিদদেহ বা দেহাংশ।অপরিণত বর্ধনশীল অঙ্গ।পরিণত উদ্ভিদ দেহাংশ।
অঙ্গের বৃদ্ধিঅঙ্গের বৃদ্ধি ঘটে না।অঙ্গের বৃদ্ধি ঘটে।অঙ্গের বৃদ্ধি ঘটে না।
অক্সিন হরমোনের প্রভাবঅক্সিন হরমোনের কোনো প্রভাব নেই।অক্সিন হরমোনের বিশেষ প্রভাব আছে।অক্সিন হরমোনের কোনো প্রভাব নেই।
উদাহরণম্যালিক অ্যাসিডের প্রভাবে উদ্দীপিত হয়ে মস ও ফার্নের শুক্রাণুর চলন (কেমোট্যাকটিক চলন)।আলোক-উৎসের দিকে কাণ্ডের চলন (ফোটোট্রপিজম)।সূর্যালোকের অধিক তীব্রতায় সূর্যমুখী ফুলের ফোটা কিংবা কম তীব্রতায় বুজে যাওয়া (ফোটোন্যাস্টিক চলন)।

আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞানের প্রথম অধ্যায় “জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়” অধ্যায়ের ‘উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা এবং সাড়াপ্রদান‘ বিভাগের রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি যে এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে আপনারা আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। তাছাড়া, আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জন যার এটি প্রয়োজন হবে তার সাথে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

Please Share This Article

Related Posts

উদ্ভিদের সাড়াপ্রদান এবং রাসায়নিক সমন্বয়-হরমোন – সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

মাধ্যমিক – জীবন বিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – উদ্ভিদের সাড়াপ্রদান এবং রাসায়নিক সমন্বয় হরমোন – সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

উদ্ভিদের সাড়াপ্রদান এবং রাসায়নিক সমন্বয়-হরমোন – বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – উদ্ভিদের সাড়াপ্রদান এবং রাসায়নিক সমন্বয় হরমোন – বিষয়সংক্ষেপ

উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা এবং সাড়াপ্রদান – অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা এবং সাড়াপ্রদান – অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

About The Author

Rahul

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

মাধ্যমিক – জীবন বিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – উদ্ভিদের সাড়াপ্রদান এবং রাসায়নিক সমন্বয় হরমোন – সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – উদ্ভিদের সাড়াপ্রদান এবং রাসায়নিক সমন্বয় হরমোন – বিষয়সংক্ষেপ

মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা এবং সাড়াপ্রদান – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা এবং সাড়াপ্রদান – অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা এবং সাড়াপ্রদান – বিষয়সংক্ষেপ