আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞানের প্রথম অধ্যায় “জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়” অধ্যায়ের ‘উদ্ভিদের সাড়াপ্রদান এবং রাসায়নিক সমন্বয় হরমোন‘ বিভাগের রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি যে এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হবে।

উদ্ভিদদেহে হরমোনের সাধারণ কাজগুলি সম্পর্কে লেখো।
উদ্ভিদদেহে হরমোনের কাজ –
হরমোন উদ্ভিদদেহে শারীরবৃত্তীয় কার্য নিয়ন্ত্রকরূপে বিশেষত বৃদ্ধি সহায়করূপে যেসব ভূমিকা পালন করে তা নীচে আলোচিত হল।
অগ্র ও পার্শ্বীয় বৃদ্ধি –
উদ্ভিদের প্রাথমিক বৃদ্ধি বলতে প্রধানত কাণ্ড ও মূলের অগ্রভাগের বৃদ্ধিকেই বোঝানো হয়। অগ্রস্থ ভাজক কলার কোশের বিভাজনের দ্বারাই এই বৃদ্ধি ঘটে থাকে। একে অগ্রস্থ বৃদ্ধিও বলা হয়। এ ছাড়া, পার্শ্বীয় ভাজক কলার বিভাজনের মাধ্যমে উদ্ভিদ প্রস্থে বৃদ্ধি পায়, যা পার্শ্বীয় বৃদ্ধি নামে পরিচিত। এইভাবে ভাজক কলার বিভাজনের মাধ্যমে উদ্ভিদের বৃদ্ধি হরমোনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন – অক্সিনের প্রভাবে উদ্ভিদের অগ্রমুকুলের বৃদ্ধি ঘটে।
ফুলের প্রস্ফুটন –
উদ্ভিদের জননাঙ্গ হল ফুল। পুষ্পমুকুলের পরিস্ফুটনের মাধ্যমে ফুল ফোটে। উদ্ভিদদেহে পুষ্পমুকুলের সৃষ্টি ও তার থেকে ফুল ফোটার ক্ষেত্রে উদ্ভিদ হরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন – জিব্বেরেলিন হরমোনটি ক্যামেলিয়া, জেরানিয়াম প্রভৃতি ফুল ফুটতে সাহায্য করে। চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া প্রভৃতি ফুল ফুটতে অ্যাবসিসিক অ্যাসিড সাহায্য করে।
মুকুলোদগম –
কিছু উদ্ভিদ হরমোনের প্রভাবে কাণ্ড ও পাতার শীর্ষে থাকা অগ্রমুকুলের বৃদ্ধি হয় ও গাছটি লম্বায় বাড়ে। যেমন – অক্সিন। আবার অগ্রমুকুলের অনুপস্থিতিতে উদ্ভিদ হরমোন পাতার কক্ষে উপস্থিত কাক্ষিক মুকুলের বৃদ্ধি ঘটায় ও নতুন শাখাপ্রশাখা সৃষ্টি করে।
বীজের অঙ্কুরোদগম –
বীজের সৃষ্টির পর কিছুদিন তা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। উপযুক্ত বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ শর্তের উপস্থিতিতে এই সুপ্তাবস্থা ভঙ্গ হয় অর্থাৎ, অঙ্কুরোদগম ঘটে। যেমন – জিব্বেরেলিন।
ট্রপিক চলন –
উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রকার ট্রপিক চলন, প্রধানত ফোটোট্রপিক ও জিওট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণে হরমোন প্রধান ভূমিকা পালন করে। যেমন – অক্সিন ট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণ করে।
উদ্ভিদ হরমোনের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
উদ্ভিদ হরমোনের বৈশিষ্ট্য –
উদ্ভিদ হরমোনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ।
উৎস –
উদ্ভিদের কাণ্ড ও মূলের অগ্রভাগে উপস্থিত ভাজক কলার কোশগুলি উদ্ভিদ হরমোনের অন্যতম প্রধান উৎসস্থল। এ ছাড়া বীজপত্র, মুকুলিত কচি পাতা, ভ্রূণমূল, ভ্রূণমুকুল, বর্ধনশীল পাতার কোশ থেকেও হরমোন ক্ষরিত হয়।
পরিবহণের ধরন –
উদ্ভিদ হরমোনগুলি উৎপত্তি স্থানের নিকটবর্তী ও দূরবর্তী স্থান উভয় অঞ্চলেই কার্যকরী হয়। উদ্ভিদ হরমোন উৎসস্থল থেকে প্রধানত ব্যাপন প্রক্রিয়ায় সংবহন কলার মাধ্যমে কার্যস্থলে পরিবাহিত হয়।
কাজ –
অগ্র ও পার্শ্বীয় বৃদ্ধি, ফুলের পরিস্ফুটন, বীজের অঙ্কুরোদগম, মুকুলোদ্গম, সংবেদনশীলতা, জরারোধ প্রভৃতিতে হরমোন সাহায্য করে।
পরিণতি –
কাজের পর উদ্ভিদ হরমোনগুলি বিনষ্ট হয়। বিভিন্ন হরমোন বিভিন্ন উৎসেচক বা অন্য কোনো শর্তের প্রভাবে বিনষ্ট হয়। যেমন, অক্সিন হরমোনটি আলোর প্রভাবে বা ইনডোল অ্যাসিটিক অ্যাসিড অক্সিডেজ নামক উৎসেচকের ক্রিয়ায় বিনষ্ট হয়। জিব্বেরেলিন, জিব্বেরেলিন অক্সিডেজের ক্রিয়ায় ও সাইটোকাইনিন, সাইটোকাইনিন অক্সিডেজের ক্রিয়ায় বিনষ্ট হয়।
অক্সিনের সংজ্ঞা লেখো। অক্সিনের বৈশিষ্ট্যগুলি কী?
অক্সিন –
উদ্ভিদের অগ্রস্থ ভাজক কলা থেকে উৎপন্ন নাইট্রোজেনযুক্ত (ইনডোল বর্গযুক্ত) অম্লধর্মী বৃদ্ধি সহায়ক যে উদ্ভিদ হরমোন, মূলত নিম্নাভিমুখে পরিবাহিত হয় এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে, তাকে অক্সিন বলে।
অক্সিনের বৈশিষ্ট্য –
অক্সিন হরমোনের বৈশিষ্ট্যগুলি নীচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
- অক্সিন উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে সহায়তাকারী একপ্রকার হরমোন।
- এটি প্রধানত কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন নিয়ে গঠিত একপ্রকার জৈব অ্যাসিড।
- ট্রিপটোফ্যান নামক অ্যামিনো অ্যাসিড থেকে অক্সিন সংশ্লেষিত হয়।
- এটি উদ্ভিদের বর্ধনশীল অঙ্গ, প্রধানত ভ্রূণমুকুলাবরণী, কাণ্ড ও মূলের অগ্রস্থ ভাজক কলা থেকে উৎপন্ন হয়ে ফ্লোয়েম কলার মাধ্যমে সাধারণত নিম্নাভিমুখে পরিবাহিত হয়। তবে মূলের অগ্রভাগে উৎপন্ন অক্সিন নীচ থেকে কিছুটা ওপরের দিকে পরিবাহিত হয়।
- এই হরমোনের সংশ্লেষ সাধারণত আলোক উৎসের বিপরীতে হয়।
- এর ক্রিয়া প্রধানত মেরুবর্তী এবং এটি ক্রিয়ার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
- এটি জলে দ্রবণীয় হওয়ার ফলে ব্যাপন ক্রিয়ার মাধ্যমে সহজেই পরিবাহিত হয়।
- আলোকের উৎসের বিপরীতে অর্থাৎ অন্ধকারে অক্সিনের ক্রিয়া সর্বাধিক।
- মূলের ক্ষেত্রে স্বল্প ঘনত্বে এবং কাণ্ডের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অধিক ঘনত্বে অক্সিন কাজ করে।
উদ্ভিদদেহে অক্সিনের ভূমিকা লেখো।
অক্সিনের ভূমিকা –
উদ্ভিদদেহে অক্সিন নিম্নলিখিত ভূমিকাগুলি পালন করে।
অগ্রস্থ প্রকটতা ও পার্শ্বীয় মুকুলের বৃদ্ধি হ্রাস –
অক্সিনের প্রভাবে উদ্ভিদের কাণ্ডের অগ্রমুকুল বৃদ্ধি পায় ও পার্শ্বীয় বা কাক্ষিক মুকুলগুলির বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। পার্শ্বীয় মুকুলের ওপর অগ্রমুকুলের এই প্রাধান্যকে অগ্রস্থ প্রকটতা বলে। এর ফলে কাণ্ড দৈর্ঘ্যে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু, যদি অগ্রমুকুল কেটে ফেলা হয় সেক্ষেত্রে কাক্ষিক মুকুল দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে গাছটিকে ঝোপের আকৃতি দেয়।

কোশ বিভাজন ও কোশের আকার বৃদ্ধি –
অক্সিন কোশে DNA-র পরিমাণ বৃদ্ধি করে কোশের বিভাজনে সাহায্য করে এবং কোশ বিভাজনের দ্বারা কোশের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া অক্সিন কোশপ্রাচীরকে নমনীয় করে কোশের আকার ও আয়তন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এই হরমোনের প্রভাবে পরিণত কোশে কোশ গহ্বরের সৃষ্টি হয় যার ফলে কোশ আয়তনে বৃদ্ধি পায়।
ফলের বৃদ্ধি –
নিষেকের পর ডিম্বাশয়ে অক্সিনের পরিমাণ বাড়ে। এর প্রভাবে ডিম্বক বীজে এবং ডিম্বাশয় ফলে পরিণত হয়। অনেকসময় নিষেকের পূর্বেই ডিম্বাশয়ে অক্সিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তখন ডিম্বাশয় নিষেক ছাড়াই ফলে পরিণত হয়। কিন্তু নিষেক না হওয়ায় ডিম্বক বীজে পরিণত হয় না, ফলে বীজবিহীন ফল উৎপন্ন হয়। এইভাবে নিষেক ছাড়া ফল উৎপাদনকে পার্থেনোকার্পি বলা হয়। পার্থেনোকার্পিক ফল উৎপাদনে অক্সিনের ভূমিকা আছে।
মূলের বৃদ্ধি –
অক্সিন উদ্ভিদের মূলের সৃষ্টি ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। উদ্ভিদের মূল স্বল্প পরিমাণ অক্সিনে অধিক সংবেদনশীল, অর্থাৎ অক্সিনের স্বল্প ঘনত্বে মূলের বৃদ্ধি অধিক হয়। বেশি ঘনত্বে অক্সিন মূলের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। যে ঘনত্বের অক্সিনে মূলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, সেই ঘনত্বের অক্সিনে কাণ্ডের পর্ব ও গোড়া থেকে অস্থানিক মূল সৃষ্টি হয়।
ট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণ –
উদ্ভিদের ট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণে অক্সিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদ্ভিদের ফোটোট্রপিক চলন এবং জিওট্রপিক চলন অক্সিনের অসম বণ্টনের ফলে সম্পন্ন হয়।
উদ্ভিদের ফোটোট্রপিক চলন এবং জিওট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণে অক্সিনের ভূমিকা চিত্রসহ আলোচনা করো।
অথবা, উদ্ভিদের ট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণে অক্সিন হরমোনের ভূমিকা লেখো।
ফোটোট্রপিক ও জিওট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণে অক্সিনের ভূমিকা –
উদ্ভিদের ফোটোট্রপিক চলন এবং জিওট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণে অক্সিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রধানত আলোক ও অভিকর্ষের প্রভাবে অক্সিনের অসম বণ্টনের দ্বারাই ট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রিত হয়। বিজ্ঞানী ওয়েন্ট ও কোলোডনি পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেছেন, আলোর প্রভাবে অক্সিনের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। অর্থাৎ অক্সিন আলোক সংবেদনশীল। এই কারণে সর্বদা আলোর উৎসের বিপরীতে বা অন্ধকারের দিকে অক্সিনের ঘনত্ব বেশি হয়। কাণ্ডের ক্ষেত্রে বেশি ঘনত্বের অক্সিনে, আলোর বিপরীত দিকে বৃদ্ধি অর্থাৎ অন্ধকারের দিকে কোশের বিভাজন বেশি হয়। ফলে কাণ্ড আলোর দিকে এবং অভিকর্ষের বিপরীতে বেঁকে যায়। অর্থাৎ কাণ্ডে আলোক-অনুকূলবর্তী ও অভিকর্ষ-প্রতিকূলবর্তী চলন ঘটে। মূল অক্সিনের স্বল্প ঘনত্বে অধিক সংবেদনশীল। ফলে মূলের ক্ষেত্রে অক্সিনের কম ঘনত্বের দিকে, অর্থাৎ আলোর দিকে কোশ বিভাজন হার বেশি হয়। তাই মূল আলোর বিপরীত দিকে তথা অভিকর্ষের দিকে বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ মূলে আলোক-প্রতিকূলবর্তী ও অভিকর্ষ-অনুকূলবর্তী চলন দেখা যায়। এইভাবে অক্সিনের অসম বণ্টনের দ্বারা উদ্ভিদের ফোটোট্রপিক বা আলোকবৃত্তি চলন এবং জিওট্রপিক বা অভিকর্ষবৃত্তি চলন নিয়ন্ত্রিত হয়।

জিব্বেরেলিনের সংজ্ঞা ও উৎস লেখো। এর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি কী?
জিব্বেরেলিনের সংজ্ঞা ও উৎস –
সংজ্ঞা –
বীজের পরিণত বীজপত্র থেকে উৎপন্ন টারপিনয়েড গোষ্ঠীভুক্ত, নাইট্রোজেনবিহীন, অম্লধর্মী উদ্ভিদ হরমোন যা বীজের সুপ্ত দশা ভঙ্গ করতে ও অঙ্কুরোদগমে সাহায্য করে তাকে জিব্বেরেলিন বলে।
উৎস –
অঙ্কুরিত বীজ, পরিণত বীজপত্র, মুকুল, পাতার বর্ধিষ্ণু অঞ্চল প্রভৃতি থেকে জিব্বেরেলিন উৎপন্ন হয়।
জিব্বেরেলিনের বৈশিষ্ট্য –
জিব্বেরেলিন হরমোনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি এখানে সংক্ষেপে আলোচিত হল –
- এটি কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন নিয়ে গঠিত একপ্রকার নাইট্রোজেনবিহীন উদ্ভিদ হরমোন।
- এটি টারপিনয়েড গোষ্ঠীভুক্ত আম্লিক প্রকৃতির জৈবরাসায়নিক পদার্থ।
- এটি জাইলেম ও ফ্লোয়েম – উভয় কলার মাধ্যমে প্রবাহিত হতে পারে। এই কারণে জিব্বেরেলিনের প্রবাহ উভমুখী।
- এটি জলে দ্রবণীয়। তাই অতি সহজেই ব্যাপন ক্রিয়ার দ্বারা পরিবাহিত হয়।
- বীজপত্রে জিব্বেরেলিন সঞ্চয়ের হার সবথেকে বেশি।
জিব্বেরেলিনের কয়েকটি প্রকারভেদের নাম লেখো। উদ্ভিদদেহে জিব্বেরেলিনের ভূমিকা উল্লেখ করো।
জিব্বেরেলিনের প্রকারভেদ –
জিব্বেরেলিনের রাসায়নিক নাম জিব্বেরেলিক অ্যাসিড। বিভিন্নপ্রকার উদ্ভিদ থেকে প্রায় 40 প্রকার জিব্বেরেলিন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি হল GA3, GA7, GA1।
জিব্বেরেলিনের ভূমিকা –
উদ্ভিদদেহে জিব্বেরেলিনের ভূমিকাগুলি নিম্নরূপ।
মুকুল ও বীজের সুপ্তাবস্থা ভঙ্গ –
প্রতিটি বীজের একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত জীবনের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। বীজের এই দশাকে সুপ্তাবস্থা বলে। জিব্বেরেলিন মুকুলের এই সুপ্তাবস্থা দূর করে। বীজের সুপ্তাবস্থায় এর মধ্যে জিব্বেরেলিনের পরিমাণ কম থাকে। অঙ্কুরোদগমের আগে বীজে এই হরমোনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এর ফলে বীজ মধ্যস্থ α-অ্যামাইলেজ, প্রোটিয়েজ প্রভৃতি উৎসেচকের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়, যা বীজের সুপ্তাবস্থা দূর করে এবং অঙ্কুরোদগম ঘটায়।
পর্বমধ্যের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি –
জিব্বেরেলিন উদ্ভিদের কাণ্ডের পর্বমধ্যের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করে সঠিকভাবে কাণ্ডের দৈর্ঘ্যের বৃদ্ধি ঘটায়। এই হরমোন উদ্ভিদের নিবেশিত ভাজক কলাকোশের বিভাজন ঘটায়। ফলে পর্বমধ্য অংশের বৃদ্ধি ঘটে ও উদ্ভিদের দৈর্ঘ্যের বৃদ্ধি ঘটে।
ফলের বৃদ্ধি –
জিব্বেরেলিন অধিক সংখ্যক ফল উৎপাদনে এবং ফলের আকার বৃদ্ধিতে অংশগ্রহণ করে। আপেল, নাসপাতি, আঙুর প্রভৃতির ফুলের গর্ভাশয়ের কোশ বিভাজন ঘটিয়ে বীজবিহীন বা পার্থেনোকার্পিক ফল তৈরিতেও জিব্বেরেলিনের প্রয়োগ করা হয়।
পাতা ও ফুলের আয়তন বৃদ্ধি –
গাছের পাতা ও ফুলের আয়তন বৃদ্ধিতেও জিব্বেরেলিন সাহায্য করে।
সাইটোকাইনিনের সংজ্ঞা লেখো। এর বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।
সাইটোকাইনিন –
উদ্ভিদের ফল ও সস্যে উৎপন্ন নাইট্রোজেনযুক্ত পিউরিন বর্গভুক্ত ক্ষারীয় যে জৈব যৌগ মূলত উদ্ভিদের কোশ বিভাজনকে উদ্দীপিত করে, তাকে সাইটোকাইনিন বলে।
সাইটোকাইনিনের বৈশিষ্ট্য –
সাইটোকাইনিন হরমোনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করা হল –
- সাইটোকাইনিন প্রধানত নাইট্রোজেনধর্মী ক্ষারীয় প্রকৃতির জৈব যৌগ।
- এটি পিউরিন বর্গভুক্ত রাসায়নিক উপাদান।
- অক্সিনের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে কাজ করে থাকে।
- এটির পরিবহণ সবদিকে হয়। তবে উৎপত্তিস্থলে কাজ করতেও সাইটোকাইনিন সক্ষম।
- এই হরমোনটি জলে দ্রবণীয়। তাই ব্যাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সহজে পরিবাহিত হতে পারে।
- হরমোনটি উদ্ভিদকোশের সাইটোকাইনেসিসে বিশেষভাবে সাহায্য করে। এই কারণে এর নাম সাইটোকাইনিন।
সাইটোকাইনিনের উৎসগুলি লেখো। উদ্ভিদদেহে সাইটোকাইনিনের ভূমিকা লেখো।
সাইটোকাইনিনের উৎস –
সাইটোকাইনিনের উৎসগুলি হল প্রধানত উদ্ভিদের সস্য (যেমন – ডাবের জল) ও ফল। এ ছাড়া কিছু উদ্ভিদের ফল ও ফুলের নির্যাসেও সাইটোকাইনিন পাওয়া যায় (যেমন – টম্যাটো, পিচ)।
সাইটোকাইনিনের ভূমিকা –
উদ্ভিদদেহে সাইটোকাইনিনের ভূমিকাগুলি নীচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
কোশ বিভাজন ঘটানো –
সাইটোকাইনিনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল উদ্ভিদকোশের সাইটোপ্লাজমের বিভাজনে বা সাইটোকাইনেসিসে সাহায্য করা। এই হরমোন অক্সিনের সহায়তায় কোশচক্রের S দশায় DNA সংশ্লেষের মাধ্যমে মাইটোসিস কোশ বিভাজনে সাহায্য করে। নবজাত কোশের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধিতেও এর বিশেষ ভূমিকা আছে।
পার্শ্বীয় মুকুলের বৃদ্ধি ঘটানো –
সাইটোকাইনিনের অপর একটি কাজ হল পার্শ্বীয় মুকুলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করা। এই হরমোন পার্শ্বীয় মুকুল বা কাক্ষিক মুকুলের বৃদ্ধি ও পরিস্ফুরণে সাহায্য করে এবং অসংখ্য শাখাপ্রশাখা সৃষ্টির মাধ্যমে উদ্ভিদটিকে ঝোপের মতো আকৃতি দান করে।
পত্রমোচন বিলম্বিত করা –
পাতার পত্রমূলের গোড়ার কোশগুলির কোশপ্রাচীরের ক্ষয়ের কারণে পত্রমোচন হয়। সাইটোকাইনিন এই কোশগুলির কোশপ্রাচীরকে ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে, ফলে পত্রমোচন বিলম্বিত হয়।
জরা বিলম্বিতকরণ –
সাইটোকাইনিন উদ্ভিদের বার্ধক্য বা জরা বিলম্বিত করে। মূলত নিউক্লিক অ্যাসিড ও প্রোটিনের বিনাশ বিলম্বিত করে এবং নতুন প্রোটিন উৎপাদনের দ্বারা পরিপোষণে সহায়তার মাধ্যমে হরমোনটি এই কাজ করে থাকে। এই কারণে ফুলদানিতে রাখা ফুল বা পাতাবাহার গাছের শাখায় সাইটোকাইনিন প্রয়োগ করা হলে তা অনেকদিন সতেজ থাকে।
অগ্রমুকুলের বৃদ্ধি রোধ করা –
সাইটোকাইনিন, অগ্রমুকুলের অবাধ বৃদ্ধি রোধ করে এবং উদ্ভিদের দৈর্ঘ্যবৃদ্ধি বিলম্বিত করে উদ্ভিদকে ঝোপে পরিণত করে।
সংশ্লেষিত হরমোনের ভূমিকাগুলি উল্লেখ করো।
অথবা, কৃষিক্ষেত্রে কৃত্রিম হরমোনের ব্যবহার লেখো।
কৃত্রিম বা সংশ্লেষিত হরমোনের ভূমিকা –
কৃত্রিম উদ্ভিদ হরমোনগুলি কৃষিবিদ্যা, উদ্যানপালনবিদ্যা, ফলচাষ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বর্তমানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এই হরমোনগুলির কয়েকটি ভূমিকা নীচে আলোচিত হল।
শাখাকলম থেকে নতুন উদ্ভিদ সৃষ্টি –
গোলাপ, জবা, বেল প্রভৃতি যেসব উদ্ভিদে বীজ তৈরি হয় না, তাদের ক্ষেত্রে শাখাকলম নামক অঙ্গজ জনন পদ্ধতিতে উদ্ভিদাংশ ব্যবহার করে নতুন উদ্ভিদ সৃষ্টি করা যায়। সংশ্লেষিত কৃত্রিম অক্সিন, যেমন – ইনডোল বিউটাইরিক অ্যাসিড (IBA) ও ন্যাপথালিন অ্যাসিটিক অ্যাসিড (NAA) সহজেই মূল সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় বলে সজীব উদ্ভিদের কাণ্ডের টুকরো কৃত্রিম অক্সিনে ডুবিয়ে রাখা হয়। পরে সেটিকে মাটিতে রোপণ করা হলে ওই কাটা অংশ থেকে অস্থানিক মূল সৃষ্টি হয়। এইভাবে IBA ও NAA প্রয়োগ করে নতুন অপত্য উদ্ভিদ সৃষ্টি করা হয়।
অপরিণত ফলের মোচন রোধ –
আম, কলা, আঙুর ইত্যাদি ফলচাষের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল ফলের ঝরে যাওয়া বা মোচন। ফলের বৃন্তের কলাকোশে মোচনস্তর সৃষ্টি হয় বলে প্রায় 50-70% ফল পাকবার আগে ঝরে যায়। কৃত্রিম অক্সিন যেমন – 2, 4-ডাইক্লোরোফেনক্সি অ্যাসিটিক অ্যাসিড বা 2, 4-D, কৃত্রিম জিব্বেরেলিন ও কৃত্রিম সাইটোকাইনিন হরমোনগুলি ফলের বৃন্তে স্প্রে করলে মোচন ব্যাহত হয়।
আগাছা বিনাশ –
কৃষিজমিতে আগাছা সৃষ্টি হলে তা জমি থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে জমির উর্বরতা হ্রাস করে। এ ছাড়া ফসলের বহু রোগ সংক্রমণের কারণ হল আগাছা। এই জন্য বর্তমানে কৃষিজমিতে কৃত্রিম অক্সিন 2, 4-D ব্যবহৃত হয়, যা ফসলকে সুরক্ষিত রেখে কেবলমাত্র আগাছাগুলিকেই বিনষ্ট করে। এই হরমোনকে উইডিসাইড হরমোন বলে।
বীজহীন ফল উৎপাদন –
আপেল, আঙুর, টম্যাটো, পেঁপে ইত্যাদি উদ্ভিদে নিষেক না হয়ে ফল সৃষ্টি হলে তাতে বীজ তৈরি হয় না। এইরকম বীজবিহীন ফল উৎপাদনকে পার্থেনোকার্পি বলে। কৃত্রিম অক্সিন (যেমন – IBA), কৃত্রিম জিব্বেরেলিন এবং কৃত্রিম সাইটোকাইনিন ব্যবহারে বীজবিহীন ফল সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। তা ছাড়া এইসব কৃত্রিম হরমোন প্রয়োগে ফল বড়ো হয় এবং ফলের মিষ্টত্ব বৃদ্ধি পায়।
অক্সিন, জিব্বেরেলিন ও সাইটোকাইনিনের তুলনা করো।
অক্সিন, জিব্বেরেলিন ও সাইটোকাইনিনের তুলনা –
বিষয় | অক্সিন | জিব্বেরেলিন | সাইটোকাইনিন |
রাসায়নিক প্রকৃতি | ইনডোল বর্গযুক্ত। | টারপিনয়েড গোষ্ঠীভুক্ত। | পিউরিন গোষ্ঠীভুক্ত। |
N2 -এর উপস্থিতি | উপস্থিত। | অনুপস্থিত। | উপস্থিত। |
প্রবাহ অভিমুখ | নিম্নমুখী। | ঊর্ধ্বমুখী ও নিম্নমুখী। | সর্বমুখী। |
উৎস | কাণ্ড ও মূলের অগ্রস্থ ভাজক কলা। | অঙ্কুরিত চারা ও বীজপত্র। | প্রধানত বীজের সস্য। |
কোশ বিভাজন | কোশ বিভাজনে প্রভাব আছে। | কোশ বিভাজনে প্রভাব নেই। | কোশ বিভাজনে প্রভাব আছে। |
ট্রপিক চলন | ট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণ করে। | কোনো প্রভাব নেই। | কোনো প্রভাব নেই। |
মুকুলের বৃদ্ধি | অগ্র মুকুলের বৃদ্ধি ঘটায়, পার্শ্বীয় বা কাক্ষিক মুকুলের বৃদ্ধি রোধ করে। | কাক্ষিক বা পার্শ্বীয় মুকুলের বৃদ্ধি ঘটায়, অগ্র মুকুলের বৃদ্ধি হ্রাস করে। | কাক্ষিক বা পার্শ্বীয় মুকুলের বৃদ্ধি ঘটায়, অগ্র মুকুলের বৃদ্ধি রোধ করে। |
আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞানের প্রথম অধ্যায় “জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়” অধ্যায়ের ‘উদ্ভিদের সাড়াপ্রদান এবং রাসায়নিক সমন্বয় হরমোন‘ বিভাগের রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি যে এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে আপনারা আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। তাছাড়া, আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জন যার এটি প্রয়োজন হবে তার সাথে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন