নীল বিদ্রোহ কেন ঘটেছিল? এই বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য লেখো।

Rahul

এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন “নীল বিদ্রোহ কেন ঘটেছিল? এই বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো। নিয়ে আলোচনা করব। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাস পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই “নীল বিদ্রোহ কেন ঘটেছিল? এই বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো।“ প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাসের তৃতীয় অধ্যায় “প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ“ -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়।

নীল বিদ্রোহ কেন ঘটেছিল? এই বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো।
Contents Show

নীল বিদ্রোহ কেন ঘটেছিল?

মহাবিদ্রোহের রণধ্বনি দমিত হতে না হতেই ভারতীয় কৃষক সমাজের অসন্তোষের লাভা-বহ্নি নতুন ছিদ্র পথে নির্গত হতে শুরু করে। মহা-বিদ্রোহত্তোর বাংলা তথা ভারতের কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে 1859-’60 খ্রিস্টাব্দের নীল বিদ্রোহ এক স্বতন্ত্র স্থানের অধিকারী।

পূর্বকথা –

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শিল্পবিপ্লবের সুবাদে ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পে প্রভূত অগ্রগতি ঘটে। এর সূত্রে ভারতে কোম্পানির প্রত্যক্ষ মদতে এবং নীলকরদের পরিচালনায় গড়ে ওঠে জবরদস্তিমূলক নীলচাষ ও লাভজনক নীল-বাণিজ্য। ইতিহাস-সূত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, 1777 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বণিক লুই বোনার্ড চন্দননগরে প্রথমে নীলচাষ শুরু করেন। তারপর ইংরেজ বণিক কার্ল ব্ল্যাম ভারতে প্রথম নীল শিল্প গড়ে তোলেন। ক্রমে ইস ইন্ডিয়া কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্যে নীল হয়ে ওঠে অন্যতম প্রধান দ্রব্য।

নীলবিদ্রোহের কারণ –

দাঁদন প্রথা –

নীলকররা নিজের জমিতে নীলচাষ (এলাকা চাষ) অপেক্ষা কৃষকের জমিতে নীলচাষ (বে-এলাকা চাষ) বেশি লাভজনক মনে করে দরিদ্র চাষিকে বিঘা প্রতি মাত্র দুই টাকা দাঁদন দিয়ে তার সর্বোৎকৃষ্ট জমিতে নীলচাষে বাধ্য করত এবং উৎপন্ন নীল নীলকরদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করত। ফলে কৃষকের স্বাধীনতা ও মুনাফা দুই-ই কমে যেত।

নীল বিদ্রোহ কেন ঘটেছিল? এই বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো।

পঞ্চম আইন –

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক 1830 খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম আইন জারি করে নীলকরদের সঙ্গে নীলচাষিদের চুক্তিভঙ্গ করাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেন। ফলে নীলকর সাহেবরা চাষিদের ওপর অত্যাচার করার আইনি বৈধতা পায়।

লাভজনক চাষে বাধা –

জমিতে ধান, তামাক, কলাই প্রভৃতির চাষ-লাভজনক হলেও চাষিদের বলপূর্বক নীলচাষে বাধ্য করা হত।

নীলকরদের অত্যাচার –

নীলচাষে অরাজি কৃষকের ওপর নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচার-প্রহার, হত্যা, গৃহদাহ, বলপূর্বক আটক, স্ত্রী-কন্যাদের ওপর লাঞ্ছনা কৃষক সমাজকে বিদ্রোহের পথে পরিচালিত করেছিল।

পূর্ববর্তী বিদ্রোহগুলির প্রভাব –

পূর্ববর্তী বিভিন্ন কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহ এবং সর্বোপরি মহাবিদ্রোহের মহান প্রেরণা নীলচাষিদের বিদ্রোহে অনুপ্রাণিত করেছিল।

উপরিউক্ত কারণগুলির ফলস্বরূপ 1859 খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে নদিয়ার কৃষ্ণনগরের চৌগাছা গ্রামে বিদ্রোহের বহ্নিশিখা জ্বলে ওঠে।

নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো।

ইতিহাস সূত্র পর্যালোচনায় নীলবিদ্রোহের একগুচ্ছ বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে।

নীলবিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য –

গণসংগ্রাম – নীল বিদ্রোহ ছিল প্রকৃত অর্থেই গণসংগ্রাম। এই বিদ্রোহের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম কৃষক, জমিদার, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অমৃতবাজার পত্রিকায় শিশিরকুমার ঘোষ লেখেন – ‘নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম ভারতবাসীকে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছিল।’

শিক্ষিত সমাজের অংশগ্রহণ –

শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ নীলবিদ্রোহে পরোক্ষ নেতৃত্ব দানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সমকালীন পত্র-পত্রিকায় নীলকরদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সমাচার চন্দ্রিকা, সমাচার দর্পণ, তত্ত্ববোধিনী প্রভৃতি সংবাদপত্র এবং তাদের। সম্পাদকেরা বিদ্রোহের খবরাখবর নিয়মিত তুলে ধরেন। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ইংরেজি সাপ্তাহিক হিন্দু প্যাট্রিয়ট নীলচাষিদের মুখপত্রে পরিণত হয়। বাঙালির রঙ্গমঞ্চেও সেদিন লেগেছিল প্রতিবাদের সুর। নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র রচনা করেন ‘নীলদর্পণ’। আর মাইকেল মধুসূদন এর ইংরেজি ভাষান্তর ঘটিয়ে এবং ভারত প্রেমিক খ্রিস্টান পাদ্রী জেমস লঙ্ তা নিজের নামে প্রকাশ করে শ্বেতাঙ্গ সমাজের কাছে নীলচাষিদের অশ্রুসজল কাহিনি তুলে ধরেন।

নিম্নবর্গের মানুষের নেতৃত্ব –

জমিদার শ্রেণির একাংশ এই বিদ্রোহের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকলেও বিদ্রোহের মূল নেতৃত্ব উঠে এসেছিল কৃষক-সমাজের মধ্য থেকেই। কাদের মোল্লা, বিষুচরণ বিশ্বাস, দিগম্বর বিশ্বাস প্রমুখ নিম্নবর্গের মানুষের হাতেই ছিল বিদ্রোহের রথের রশি।

বিদ্রোহের সফলতা –

ভারতে অগণিত কৃষক বিদ্রোহের ভিড়ে নীল বিদ্রোহের সফলতা অন্যান্য বিদ্রোহকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। বিদ্রোহের ব্যাপকতায় বাধ্য হয়ে সরকার 1860 সালে ‘নীল কমিশন’ গঠন করে এবং নীলচাষকে নীলচাষিদের ইচ্ছাধীন বিষয়ে পরিণত করে। এই বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে, ঐক্যবদ্ধ গণ আন্দোলনের কাছে স্বৈরাচার মাথানত করতে বাধ্য।

ধর্মঘটের প্রথম নজির – নীল বিদ্রোহ ছিল ভারত ইতিহাসে ধর্মঘটের প্রথম নজির। নীলচাষ করতে অস্বীকার করে নীলচাষিরা গান্ধিজির জন্মের বহুপূর্বেই ধর্মঘটের সফল নজির সৃষ্টি করেছিল।

মূল্যায়ন –

অমৃতবাজার পত্রিকার মতে, ‘এই বিদ্রোহ অর্ধমৃত বাঙালির শিরায় স্বাধীনতার উয় শোণিত প্রবাহিত করে।’

কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর

নীল বিদ্রোহ কী এবং এটি কখন ঘটেছিল?

নীল বিদ্রোহ ছিল বাংলার কৃষকদের নীলকর ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে একটি গণ-আন্দোলন। এটি 1859-1860 সালে সংঘটিত হয়েছিল।

নীল বিদ্রোহের প্রধান কারণ কী ছিল?

নীল বিদ্রোহের প্রধান কারণ –
1. দাঁদন প্রথা – নীলকররা কৃষকদের নামমাত্র মূল্যে (বিঘা প্রতি 2 টাকা) জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য করত।
2. পঞ্চম আইন (1830) – চুক্তি ভঙ্গ করলে কৃষকদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়।
3. অন্য ফসল চাষে বাধা – লাভজনক ধান, তামাকের পরিবর্তে নীলচাষে বাধ্য করা হতো।
4. নীলকরদের অত্যাচার – শারীরিক নির্যাতন, জমি দখল ও নারীদের ওপর অত্যাচার।

নীল বিদ্রোহ কোথায় শুরু হয়েছিল?

1859 সালে নদিয়ার (বর্তমানে নদিয়া-কুষ্টিয়া অঞ্চল) চৌগাছা গ্রামে প্রথম নীল বিদ্রোহের সূচনা হয়।

নীল বিদ্রোহের নেতৃত্ব কে দিয়েছিলেন?

1. কৃষক নেতা – বিষুচরণ বিশ্বাস, দিগম্বর বিশ্বাস, কাদের মোল্লা প্রমুখ।
2. শিক্ষিত মধ্যবিত্ত – হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা), দীনবন্ধু মিত্র (নীলদর্পণ নাটক)।

নীল বিদ্রোহে শিক্ষিত সমাজের ভূমিকা কী ছিল?

নীল বিদ্রোহে শিক্ষিত সমাজের ভূমিকা
1. সংবাদপত্র (হিন্দু প্যাট্রিয়ট, অমৃতবাজার পত্রিকা) ও নাটক (নীলদর্পণ) এর মাধ্যমে নীলকরদের অত্যাচার জনসমক্ষে তুলে ধরা হয়।
2. মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও পাদ্রী জেমস লঙ নীলদর্পণ ইংরেজিতে অনুবাদ করে ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

নীল বিদ্রোহের ফলাফল কী ছিল?

নীল বিদ্রোহের ফলাফল
1. ব্রিটিশ সরকার নীল কমিশন গঠন করে।
2. নীলচাষ কৃষকদের ইচ্ছাধীন করা হয়।
3. নীলকরদের অত্যাচার কমে যায় এবং বাংলায় নীলশিল্প ধ্বংস হয়।

নীল বিদ্রোহের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কী?

নীল বিদ্রোহের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
1. এটি ছিল ভারতের প্রথম সফল কৃষক আন্দোলন।
2. গণ-আন্দোলন ও সংবাদপত্রের শক্তির প্রকাশ ঘটে।
3. পরবর্তী স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপ্রেরণা দেয়।

নীলদর্পণ নাটকের ভূমিকা কী ছিল?

দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকে নীলকরদের অত্যাচার ফুটে উঠেছিল। এটি ইংরেজিতে অনূদিত হলে ব্রিটিশ সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

নীল বিদ্রোহ ও মহাবিদ্রোহ (1857) এর মধ্যে সম্পর্ক কী?

মহাবিদ্রোহের (1857) পরেই নীল বিদ্রোহ (1859) ঘটে। উভয়ই ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, তবে নীল বিদ্রোহ ছিল মূলত কৃষক-কেন্দ্রিক ও অহিংস।


এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন “নীল বিদ্রোহ কেন ঘটেছিল? এই বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো।” নিয়ে আলোচনা করেছি। এই “নীল বিদ্রোহ কেন ঘটেছিল? এই বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো।” প্রশ্নটি মাধ্যমিক ইতিহাসের তৃতীয় অধ্যায় “প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ” -এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে, আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।

Please Share This Article

Related Posts

দেশীয় রাজ্য বলতে কী বোঝো? দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে ভারত সরকার কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল?

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে ভারত সরকার কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল?

ভারত-বিভাজনের অনিবার্যতার কারণ বিশ্লেষণ করো।

ভারত বিভাজনের অনিবার্যতার কারণ বিশ্লেষণ করো।

দেশীয় রাজ্যগুলি সম্পর্কে জাতীয় কংগ্রেসের মনোভাব ঠিক কী ছিল, তাই নিয়ে আলোচনা করো।

দেশীয় রাজ্যগুলি সম্পর্কে জাতীয় কংগ্রেসের মনোভাব আলোচনা করো।

About The Author

Rahul

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

"SolutionWbbse" শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনলাইন অধ্যয়ন প্ল্যাটফর্ম। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য গাইডলাইন, এবং বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সাহায্য প্রদান করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সকল বিষয়ের শিক্ষণীয় উপকরণ সহজেই সকল শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Editor Picks

উত্তর ভারতের নদনদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে ভারত সরকার কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল?

ভারত বিভাজনের অনিবার্যতার কারণ বিশ্লেষণ করো।

ভাঙ্গর ও খাদার বলতে কি বোঝো? ভাঙ্গর ও খাদারের মধ্যে পার্থক্য

দেশীয় রাজ্যগুলি সম্পর্কে জাতীয় কংগ্রেসের মনোভাব আলোচনা করো।