মাধ্যমিক জীবনবিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – প্রাণীদেহে সাড়া প্রদান ও রাসায়নিক সমন্বয় – প্রাণী হরমোন – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞানে প্রাণীদেহে সাড়া প্রদান এবং রাসায়নিক সমন্বয় প্রধান বিষয়। প্রাণীদেহে এই কাজটি হরমোনের মাধ্যমে হয়। হরমোন হল ব্যক্তির শরীরে থাকা রক্তের একটি সাধারণ উপাদান যা শরীরের বিভিন্ন অংশে পরিস্থিতি নির্ধারণ করে এবং প্রতিক্রিয়া উত্পন্ন করে।

Table of Contents

এছাড়াও জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি পরিবেশের সাথে প্রাণীর প্রতিক্রিয়া ও প্রজননের বিভিন্ন পদক্ষেপ নির্ধারণ করে। পরিবেশে নির্ধারিত পরিমাণ খাদ্য, জল এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের উপস্থিতি জীবজগতের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সমন্বয় প্রদান করে।

শেষমেশ জীবজগতে রাসায়নিক সমন্বয় খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটি নিয়মিত প্রক্রিয়ামূলক একটি পদ্ধতি।

প্রাণী হরমোনের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।

প্রাণী হরমোনে একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য, এর মাধ্যমে সম্ভব হয় শারীরিক নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন।

প্রাণী হরমোনের বৈশিষ্ট্য

প্রাণী হরমোনের বৈশিষ্ট্যগুলি হল —

  1. উৎস – প্রাণী হরমোন অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি (endocrine gland) বা নালীবিহীন গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন অঙ্গের অন্তঃক্ষরা কোশসমষ্টি (যেমন — খাদ্যনালীর প্রাচীরগাত্র, শুক্রাশয়) থেকেও হরমোন ক্ষরিত হয়।
  2. রাসায়নিক প্রকৃতি – হরমোন সাধারণত প্রোটিন, পেপটাইড, গ্লাইকোপ্রোটিন বা স্টেরয়েডধর্মী।
  3. পরিবহণ – উৎপত্তিস্থল থেকে রক্ত ও লসিকার মাধ্যমে পরিবাহিত হয় ও লক্ষ্য অঙ্গ বা কার্যকারী অঙ্গ (targetorgan)-এ পৌঁছে।
  4. কাজ ও পরিণতি – প্রত্যেক হরমোন সাধারণত একটি নির্দিষ্ট অঙ্গের ওপর ক্রিয়া করে এবং ওই অঙ্গের সার্বিক বৃদ্ধি, বিকাশ ও কার্যকারিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। একে হরমোনটির লক্ষ্য অঙ্গ বলে। যেমন — পিটুইটারি গ্রন্থি নিঃসৃত হরমোন TSH থাইরয়েড গ্রন্থির ওপর ক্রিয়া করে তার বৃদ্ধি, বিকাশ ও কার্যকারিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণত হরমোন খুব অল্প সময়ের জন্য সক্রিয় হয়। কার্যকারিতার পর হরমোন বিনষ্ট হয় বা অন্য যৌগে পরিণত হয়, যেগুলি মূত্রের মাধ্যমে দেহের বাইরে নির্গত হয়।
  5. বাহক – প্রাণীদেহে হরমোন উৎপত্তিস্থল থেকে রাসায়নিক বার্তাকে দুতের মতো লক্ষ্য অঙ্গে বহন করে নিয়ে যায়। তাই হরমোনকে রাসায়নিক বার্তাবাহক (chemical messenger) বলা হয়।
  6. নিয়ন্ত্রণ – অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো একটি হরমোনের ক্ষরণ অপর আর একটি গ্রন্থির ক্ষরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। একে ফিডব্যাক নিয়ন্ত্রণ বলে। এক্ষেত্রে নিঃসৃত হরমোনের মাত্রার বৃদ্ধি বা হ্রাসে নিয়ন্ত্রক হরমোনের মাত্রার বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটে।

থাইরক্সিন হরমোনের নিঃসরণ-স্থান ও কাজ উল্লেখ করো।

থাইরক্সিন হরমোন থাইরয়েড গ্রন্থি দ্বারা নিঃসরণ হয়। এর মাধ্যমে শরীরের বহুগুণ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

থাইরক্সিন হরমোনের নিঃসরণ-স্থান

থাইরয়েড গ্রন্থির ফলিকিউলার কোশ থেকে থাইরক্সিন হরমোন নিঃসৃত হয়। নিঃসৃত থাইরক্সিন হরমোন ফলিকূলের কোলয়েড অংশে সঞ্চিত থাকে।

থাইরক্সিন হরমোনের নিঃসরণ-স্থান ও কাজ উল্লেখ করো।

থাইরক্সিন হরমোনের কাজ

থাইরক্সিন হরমোনের কাজগুলি এখানে আলোচনা করা হল —

  1. দেহের বৃদ্ধি, মানসিক পরিপূর্ণতা, যৌবনের লক্ষণসমূহের বহিঃপ্রকাশ, বিপাক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি হল থাইরক্সিনের প্রধান কাজ।
  2. এই হরমোন দেহের কলাকোশে অক্সিজেনের ব্যবহার বাড়িয়ে তাপ উৎপাদনে সাহায্য করে। এই কারণে থাইরক্সিনকে ক্যালোরিজেনিক হরমোন বলা হয়।
  3. থাইরক্সিন মৌল বিপাক হার (BMR) বৃদ্ধি করে।
  4. এই হরমোন অস্ত্র থেকে গ্লুকোজ শোষণ করে।রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ায়।
  5. লোহিতকণিকার পূর্ণতাপ্রাপ্তিতে থাইরক্সিনের বিশেষ ভূমিকা আছে।
  6. হৃৎস্পন্দনের হার, রক্তচাপ প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণের ওপর থাইরক্সিনের প্রভাব। আছে।
  7. ব্যাঙাচির পূর্ণাঙ্গ ব্যাং-এ রূপান্তরে (metamorphosis) থাইরক্সিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  8. স্তনগ্রস্থির দুগ্ধক্ষরণে এই হরমোন সাহায্য করে।
  9. অনেকের মতে মস্তিষ্ক ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের বৃদ্ধি ও বিকাশেও এর ভূমিকা আছে।

আরো পড়ুন, Class 10 – Life Science – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – উদ্ভিদের সাড়া প্রদান ও রাসায়নিক সমন্বয় হরমোন – উদ্ভিদদেহে অক্সিন ও চলন – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর

অ্যাড্রেনালিন হরমোনের নিঃসরণ-স্থান ও কাজ উল্লেখ করো।

অ্যাড্রেনালিন হরমোন অ্যাড্রেনাল মধ্যে থাকা ক্রোমাফিন কোশের মাধ্যমে নিঃসরণ হয়। এর মাধ্যমে জনসাধারণে জীবনশক্তি এবং জোর বা সমাধান করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

অ্যাড্রেনালিন হরমোনের নিঃসরণ-স্থান

অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির মেডালা অংশ থেকে অ্যাড্রেনালিন হরমোন নিঃসৃত হয়।

অ্যাড্রেনালিন হরমোনের কাজ

  1. অ্যাড্রেনালিন হৃৎস্পন্দন হার, হার্দ উৎপাদ ও রক্তচাপ বাড়ায়।
  2. রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ এবং BMR বৃদ্ধি করে
  3. শ্বসনের হার নিয়ন্ত্রণে অ্যাড্রেনালিনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। ফুসফুসের ব্রংকিগুলের প্রসারণের মাধ্যমে অ্যাড্রেনালিন এই কাজ করে।
  4. অ্যাড্রেনালিন তারারন্দ্র প্রসারিত হতে সাহায্য করে। এই কারণে চক্ষু পরীক্ষার সময় ডাক্তাররা অনেক সময় এই হরমোন ব্যবহার করেন।
  5. অ্যাড্রেনালিনের প্রভাবে অতিরিক্ত ঘাম নিঃসৃত হয় ও ত্বকের লোম খাড়া হয়।
  6. উত্তেজনা, ক্রোধ, ভয় প্রভৃতি অবস্থায় এই হরমোন বেশি পরিমাণে নিঃসৃত হয়ে দেহকে ওই অবস্থার মোকাবিলায় উপযোগী করে। এই কারণে অ্যাড্রেনালিনকে আপৎকালীন বা জরুরিকালীন হরমোন বলে।

গ্লুকাগন হরমোনের উৎস কী? এই হরমোনের কাজ সম্পর্কে যা জান লেখো। ইনসুলিন ও গ্লুকাগনের মধ্যে পার্থক আলোচনা করো।

গ্লুকাগন হরমোন প্রধানত প্যানক্রিয়াস থেকে নিঃসরণ হয়। এর মাধ্যমে শরীরের প্রতিরক্ষা সংক্রমণ ব্যবস্থার মাধ্যমে শরীর পরিচালিত হয়।

গ্লুকাগনের উৎস

মানবদেহে অগ্ন্যাশয়ের অন্তর্গত আইলেটস্ অফ ল্যাঙ্গারহ্যান্সের আলফা কোশ (a cell) থেকে গ্লুকাগন নামক হরমোন সম্প্রতি ও নিঃসৃত হয়।

গ্লুকাগনের কাজ

মানবদেহে গ্লুকাগন প্রধান যে কাজগুলি সম্পন্ন করে, সেগুলি এখানে আলোচনা করা হল —

1. রক্তে শর্করার (গ্লুকোজের) হ্রাস পেলে যকৃতে সঞ্চিত গ্লাইকোজেনকে ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত করে। এই গ্লুকোজ রক্তে মুক্ত হয় ও তার ফলে রকে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য, এই হরমোন পেশির গ্লাইকোজেনকে ভাঙতে সাহায্য করে না। 2. রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস পেলে গ্লুকাগন বিভিন্ন নন-কার্বোহাইড্রেট, যেমন — প্রোটিন ও ফ্যাট থেকে গ্লুকোজের সংশ্লেষ বৃদ্ধি করে। 3. বলাকোশে মুকোজের জারণ মাত্রা হ্রাস করে ও ফ্যাটের ভাঙন বাড়িয়ে দেয়।

ইনসুলিন ও গ্লুকাগনের পার্থক্য

বিষয় ইনসুলিনগ্লুকাগন
1. উৎসঅগ্ন্যাশয়ের আইলেটস্ অফ ল্যাঙ্গারহ্যান্সের β-কোশ।অগ্ন্যাশয়ের আইলেটস্ অফ ল্যাঙ্গারহ্যান্সের α-কোশ।
2. কাজরক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়লে গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেনে পরিণত করে, গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে।এটি ইনসুলিনের বিপরীত ক্রিয়া করে। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ হ্রাস পেলে, গ্লাইকোজেন, প্রোটিন, ফ্যাট ইত্যাদির জারণ দ্বারা গ্লুকোজ প্রস্তুত করে রক্তে এর পরিমাণ বাড়ায়।

হাইপোথ্যালামাস নিঃসৃত পাঁচটি হরমোনের নাম ও তাদের কাজ লেখো।

হাইপোথালামাস মানব দেহে মধ্যে একটি ক্ষুদ্র এলাকা যা মহাশক্তি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে বিভিন্ন হরমোন নিয়ন্ত্রিত হয় যা শরীরের বিভিন্ন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।

হাইপোথ্যালামাস নিঃসৃত হরমোন

হাইপোথ্যালামাস থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ হরমোন নিঃসৃত হয়। এরা প্রধানত পিটুইটারি গ্রন্থির ক্ষরণকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি হরমোনের নাম হল GHRH বা গ্রোথ হরমোন রেগুলেটিং হরমোন, GnRH বা গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন, PRH বা প্রোল্যাকটিন রিলিজিং হরমোন, TRH বা থাইরোট্রপিন রিলিজিং হরমোন এবং CRH বা কর্টিকোট্রপিন রিলিজিং হরমোন।

হাইপোথ্যালামাস নিঃসৃত হরমোনের কাজ

হাইপোথ্যালামাস থেকে নিঃসৃত হরমোনগুলির কাজ নিম্নরূপ।

  • GHRH বা গ্রোথ হরমোন রিলিজিং হরমোন – অগ্র পিটুইটারি থেকে গ্রোথ হরমোনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
  • GnRH বা গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন – অগ্র পিটুইটারি থেকে গোনাডোট্রপিক হরমোনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
  • PRH বা প্রোল্যাকটিন রিলিজিং হরমোন – অগ্র পিটুইটারি থেকে প্রোল্যাকটিনের ক্ষরণ ত্বরান্বিত করে।
  • TRH বা থাইরোট্রপিন রিলিজিং হরমোন – অগ্র পিটুইটারি থেকে থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
  • CRH বা কটিকোট্রপিন রিলিজিং হরমোন – অগ্র পিটুইটারি থেকে ACTH-এর ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে।

মাধ্যমিক জীবনবিজ্ঞানে জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় প্রাণীদেহে হরমোনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রাণীদেহে হরমোন সাড়া প্রদান করে এর বিভিন্ন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। হরমোনের রাসায়নিক সমন্বয় এবং পরিমাণ সঠিক হলে প্রাণী স্বাস্থ্যবান থাকে এবং অবসান কালে পূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে।

Share via:

মন্তব্য করুন