নবম শ্রেণি – বাংলা – ধীবর-বৃত্তান্ত – সামগ্রিক বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর


ধীবর বৃত্তান্ত একটি সংক্ষিপ্ত নাট্যাংশ যা মহাকবি কালিদাস রচিত অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ নাটকের অন্তর্ভুক্ত। এই নাট্যাংশে, একজন সাধারণ ধীবর রাজার আংটি চুরির অপবাদে অভিযুক্ত হয়। রাজশ্যালক তাকে গ্রেপ্তার করে রাজদরবারে নিয়ে যায়। সেখানে রাজা তাকে বিচার করেন এবং তার নির্দোষতা প্রমাণিত হয়। ধীবরকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং তাকে পুরস্কৃত করা হয়।

এই নাট্যাংশের মাধ্যমে কালিদাস সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, সমাজে সত্য ও ন্যায়ের জয় হয়। তিনি ধীবর চরিত্রের মাধ্যমে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। তিনি রাজশ্যালক চরিত্রের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করেছেন।

নবম শ্রেণি – বাংলা – ধীবর-বৃত্তান্ত – সামগ্রিক বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর

আংটি পাওয়ার পরে ধীবরের যে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা নিজের ভাষায় লেখো।

ধীবরের অভিজ্ঞতা – কালিদাসের ধীবর-বৃত্তান্ত নাট্যাংশে ধীবরের কাছে রাজার নাম খোদাই করা মণিখচিত আংটি দেখে নগররক্ষায় নিযুক্ত রাজার শ্যালক এবং দুজন রক্ষী পিছনে হাত বেঁধে তাকে ধরে নিয়ে আসেন। ধীবর আংটি চুরি করেনি জানালেও তাঁরা তা বিশ্বাস করেন না। প্রথম রক্ষী বিদ্রুপ করে জানতে চায়, তাকে সদ্ ব্রাহ্মণ মনে করে রাজা আংটিটা দান করেছেন কি না। ধীবর এইসময় রক্ষীদের তীব্র ব্যঙ্গবিদ্রুপের মুখে পড়ে। সে জাল, বড়শি ইত্যাদি দিয়ে মাছ ধরার কথা বললে তা নিয়েও তাকে ব্যঙ্গ শুনতে হয়। ধীবর এর প্রতিবাদ জানায়। সে রুইমাছ কাটার সময়ে মাছের পেটে আংটি পাওয়ার কথা বলে। রাজশ্যালক ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে রাজার কাছে যান। রক্ষীরা চোর ধরার পড়ার শাস্তিস্বরূপ ধীবরকে হত্যার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে পড়ে। কিন্তু শ্যালক ফিরে এসে জানান যে, ধীবর সবই সত্য কথা বলেছে এবং সে – কারণে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। শুধু তা – ই নয়, রাজা খুশি হয়ে ধীবরকে আংটির সমমূল্যের অর্থ দিয়েছেন বলেও তিনি জানান। ফলে দিনের কাজ বন্ধ হলেও ধীবরের ক্ষতি পুষিয়ে যায়। এভাবে আংটিকে কেন্দ্র করে নানান ঘাত-প্রতিঘাতের শিকার হয় ধীবর।

ধীবর-বৃত্তান্ত নাট্যদৃশ্যে ধীবরের চরিত্রকে যেভাবে পাওয়া যায় তা নিজের ভাষায় লেখো।

কথামুখ – কালিদাসের লেখা ধীবর-বৃত্তান্ত নাট্যাংশে ধীবর চরিত্রটির গুরুত্ব নাট্যাংশটির শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট হয়। কাহিনির ঘটনাপ্রবাহে ধীবর চরিত্রের নানা বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

পেশার প্রতি মর্যাদাবোধ – ধীবর চরিত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল তার নিজের পেশার প্রতি মর্যাদাবোধ। তাই রাজার শ্যালক ব্যঙ্গ করে তোর জীবিকা বেশ পবিত্র বলতে হয় দেখছি মন্তব্য করলে ধীবর দৃঢ়তার সঙ্গে বলে, এরকম বলবেন না। যে বৃত্তি নিয়ে যে মানুষ জন্মেছে, সেই বৃত্তি নিন্দনীয় (ঘৃণ্য) হলেও তা পরিত্যাগ করা উচিত নয়। ধীবরের এই উক্তি সাহস এবং আত্মমর্যাদার পরিচায়ক।

সততা – ধীবর চরিত্রের সততার দিকটিও উল্লেখযোগ্য। আংটি পাওয়ার বিষয়ে সে রাজশ্যালক এবং রক্ষীদের যা যা বলেছে পরবর্তীকালে সবই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। সততার অহংকারও ধীবরের ছিল। তাই রুই মাছের পেটের ভিতরে আংটি পাওয়ার কথা উল্লেখ করে সে বলেছে, এখন মারতে হয় মারুন, ছেড়ে দিতে হয় ছেড়ে দিন। স্পষ্টভাষী ধীবর চুরির অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়ে তার প্রতি অবিচারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে রাজশ্যালককে বলেছে, আজ আমার সংসার চলবে কীভাবে? এইভাবে ধীবর চরিত্রটিতে নিজস্বতা ফুটে উঠেছে।

ধীবর-বৃত্তান্ত নাট্যাংশে রক্ষীগণ ও রাজশ্যালকের ভূমিকা আলোচনা করো।

রক্ষীদের ভূমিকা – কালিদাসের লেখা ধীবর বৃত্তান্ত নাট্যাংশে রাজশ্যালক এবং রক্ষীদের বেশ সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। প্রাথমিকভাবে ধীবরের কাছে আংটিটি পেয়ে তাঁরা তাকে চোর বলে মনে করেছিলেন। পিছনে হাতবাঁধা অবস্থায় যেভাবে ধীবরকে নিয়ে আসা হয় তাতে বোঝা যায়, তাঁরা তাঁদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে কতখানি আগ্রহী। ধীবরের প্রতি নিষ্ঠুর কৌতুকের পরিচয় দিয়েছেন তাঁরা। রক্ষীরা ধীবরকে বাটপাড়, গাঁটকাটা ইত্যাদি বলে সম্বোধন করেছে। রক্ষীরা ধীবরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। রাজার আদেশ আসার আগেই রক্ষীদের হয় তোকে শকুনি দিয়ে খাওয়ানো হবে, না হয় কুকুর দিয়ে খাওয়ানো হবে — এই জাতীয় মন্তব্য চরম অবিবেচনা ও অমানবিকতার পরিচয় দেয়।

রাজশ্যালকের ভূমিকা – রাজশ্যালকও ধীবরের পেশা নিয়ে ঠাট্টা করেছেন। তবে নগররক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজশ্যালককে তুলনায় কিছুটা দায়িত্ববোধসম্পন্নও মনে হয়েছে। তিনি মহারাজের আদেশের জন্য অপেক্ষা করেছেন কিংবা ধীবরকে তার কথা বলার সুযোগ দিতে চেয়েছেন। রাজার আদেশ অনুসারে ধীবরকে মুক্তি দেওয়াও রাজার প্রতি আনুগত্যের পরিচায়ক। শুধু তা-ই নয়, ধীবরের পাওয়া আংটিটি যে রাজাকে প্রিয়জনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে, তা বুঝতে পেরে তিনি ধীবরের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছেন। তিনি ধীবরকে তাঁর একজন বিশিষ্ট প্রিয় বন্ধু বলেও গ্রহণ করেছেন।

ধীবর-বৃত্তান্ত পাঠ্যাংশে নাট্যধর্মের যে প্রকাশ ঘটেছে তা আলোচনা করো।

নাট্যধর্মের প্রকার – কালিদাসের ধীবর-বৃত্তান্ত নাট্যাংশে নাট্যকার ধীবরের চরিত্রটিকে তার পেশাগত আদর্শ, সাহস এবং স্পষ্ট ভাষণের মধ্য দিয়ে জীবন্ত করে তুলেছেন। রাজশ্যালক এবং রক্ষীদের চরিত্রও যথাযথ। তাঁদের উত্তেজিত কথাবার্তা, ক্ষমতা অপপ্রয়োগের চেষ্টা, ধীবরকে তার পেশার জন্য ব্যঙ্গ করা — এসবই সমাজে নীচু শ্রেণির মানুষদের ওপর প্রভাবশালী মানুষদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার মনোভাবকে ইঙ্গিত করে। তার সঙ্গে ধীবরের আংটি পাওয়াকে কেন্দ্র করে রাজার শ্যালক এহং রক্ষীদের যে সংঘাত তার মধ্য দিয়েই নাট্যকার দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। রক্ষীরা এবং রাজার শ্যালক আংটির জন্য ধীবরকে চোর সাব্যস্ত করে। ধীবর আংটি পাওয়ার আসল ঘটনা তাঁদের জানিয়ে বলে, এখন মারতে হয় মারুন, ছেড়ে দিতে হয় ছেড়ে দিন। রক্ষীরা ধীবরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠে। এভাবেই দুটি আলাদা শ্রেণির মানুষের দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সংলাপ রচনাতেও স্বাভাবিকতা বজায় রাখা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত সংলাপের ব্যবহার কাহিনিকে গতিশীল করেছে। রক্ষীদের সংলাপে ব্যাটা বাটপাড়, গাঁটকাটা শব্দের ব্যবহার নাটকের সংলাপকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। যেভাবে নাট্যদৃশ্যের শেষে ধীবর চোর অপবাদ থেকে মুক্তি পেয়ে রাজার দ্বারা আংটির সমান দামের পুরস্কার পেয়েছে, তা কাহিনির নাটকীয় বিস্তার ঘটিয়েছে। এইভাবেই নাটকটিতে নাট্যধর্মের প্রয়োগ সার্থকভাবে লক্ষ করা যায়।

নাট্যকাহিনিতে উপস্থিত না থেকেও রাজা দুষ্মন্ত কীভাবে কাহিনিকে প্রভাবিত করেছেন তা আলোচনা করো ৷

কাহিনিতে দুষ্মন্তের প্রভাব – কালিদাসের ধীবর-বৃত্তান্ত নাট্যাংশে অনুপস্থিত থেকেও রাজা দুষ্মন্ত সমস্ত ঘটনাধারাকে নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত করেছেন। আংটি পাওয়ার বিষয়ে ধীবরের বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করে দেখতে রাজশ্যালক ও রক্ষীরা তাকে নিয়ে রাজবাড়িতে রাজার কাছে যান। বেশ কিছুটা সময় পরে তিনি রাজার আদেশ নিয়ে ফেরেন এবং রক্ষীদের জেলেটিকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।

রাজার পাঠানো পুরস্কারও রাজশ্যালক জেলেটির হাতে তুলে দেন। এইভাবেই নাট্যাংশের পরিণতি লক্ষ করা যায়। চুরির অভিযোগে বন্দি জেলেটি বহু লাঞ্ছনা, অপবাদ ও বিদ্রুপ সহ্য করার পর এভাবেই মুক্তি পায় ও রাজার কাছে পুরস্কৃত হয়।

স্বভাবত গম্ভীর প্রকৃতির রাজাকে রাজশ্যালক আংটিটা দেখালে তিনি মুহূর্তের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়েন। সেই ঘটনার উল্লেখ করে নাট্যকাহিনিতে সুকৌশলে তাঁর ফেলে আসা দিনগুলির চকিত আভাস দেওয়া হয়েছে। অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ নাটকের কাহিনি অভিজ্ঞান – স্বরূপ আংটিটির হারিয়ে যাওয়া ও সেটির ফিরে পাওয়াকে কেন্দ্র করে রচিত। ধীবর-বৃত্তান্ত নাট্যাংশটিতে রাজা চরিত্রটি সরাসরি উপস্থিত নন। কিন্তু অভিযুক্ত জেলেটিকে সুবিচার দেওয়া ও পুরস্কৃত করার মাধ্যমে তিনি উপস্থিত না থেকেও নাট্যকাহিনিতে নিজের প্রভাব ও গৌরব বজায় রেখেছেন।

রাজার কাছে ধীবরের পাওয়া আংটিটির গুরুত্ব যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো।

রাজার কাছে ধীবরের পাওয়া আংটির গুরুত্ব – ধীবর-বৃত্তান্ত নাট্যাংশটিতে শক্রাবতারবাসী এক ধীবর কীভাবে রাজার নাম খোদাই করা মণিমুক্তাখচিত একটি আংটি বিক্রি করার সময় ধরা পড়ল এবং কীভাবেই বা মুক্তি পেল, সেই বৃত্তান্ত রয়েছে। মহর্ষি কণ্বের তপোবনে শকুন্তলাকে বিয়ে করে রাজধানীতে ফেরার সময় রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে একটি আংটি উপহার দেন। দীর্ঘদিন রাজধানী থেকে কেউ শকুন্তলার খোঁজ না নেওয়ায় অস্থির শকুন্তলা দুষ্মন্তের চিন্তায় আনমনা হয়ে পড়েন এমনই সময় মহর্ষির আশ্রমে ঋষি দুর্বাসার আগমন ঘটলে স্বামীর চিন্তায় মগ্ন শকুন্তলা তাঁর উপস্থিতি খেয়াল করেন না। এই ঘটনায় অপমানিত ঋষি অভিশাপ দেন, যাঁর চিন্তায় তিনি মগ্ন, সেই ব্যক্তি তাঁকে ভুলে যাবেন। শকুন্তলার প্রিয়সখী প্রিয়ংবদার অনুরোধে ঋষি জানান, কোনো নিদর্শন দেখাতে পারলে তবেই এই শাপের প্রভাব দূর হবে। একদিন এক ধীবরের কাছ থেকে শকুন্তলাকে দেওয়া রাজার আংটিটি উদ্ধার হয় এবং রাজশ্যালক সেটি রাজার কাছে নিয়ে এলে সেই শাপের প্রভাব দূর হয়। রাজার সমস্ত ঘটনা মনে পড়ে যাওয়ায় তিনি শকুন্তলার চিন্তায় বিহ্বল হয়ে পড়েন। তাঁর যে কোনো প্রিয়জনের কথা মনে পড়েছে, রাজশ্যালকও তা বুঝতে পারেন। হারানো স্মৃতি ফিরে আসায় উচ্ছ্বসিত রাজা ধীবরকে আংটির সমান দামের অর্থ পুরস্কার হিসেবে দান করেন। রাজার কাছে আংটিটির গুরুত্ব যে কতটা তা এভাবেই নাট্যদৃশ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।

ধীবর বৃত্তান্ত একটি হাস্যরসাত্মক নাট্যাংশ হলেও, এটি একটি শিক্ষামূলক নাট্যাংশও বটে। এই নাট্যাংশ থেকে আমরা শিখতে পারি যে, সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকলে অবশেষে সাফল্য আসে।

Share via:

মন্তব্য করুন