দাম গল্পটি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা একটি বিখ্যাত গল্প। এই গল্পে, কথক তার ছেলেবেলার অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের কথা স্মরণ করেন। মাস্টারমশাই ছিলেন একজন অত্যন্ত কঠোর শিক্ষক। তিনি ছাত্রদের পড়াতেন ভয় দেখিয়ে। তিনি ছাত্রদের উপর শারীরিক নির্যাতনও করতেন। কথকও মাস্টারমশাইয়ের ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতেন।
গল্পের শেষে, কথক বুঝতে পারেন যে মাস্টারমশাইয়ের শিক্ষা পদ্ধতি ঠিক ছিল না। পীড়ন-তাড়ন করে শিখিয়ে কোন ফল হয় না। বরং, ছাত্রদেরকে ভালোবাসা ও সহানুভূতির সাথে শিক্ষা দেওয়া উচিত।
দাম গল্পটির নামকরণ কতটা সার্থক সংক্ষেপে আলোচনা করো।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নাম থেকে আমরা সাহিত্যকর্মটির স্বরূপ সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি করতে পারি। কথাসাহিত্যে সাধারণত নায়ক-নায়িকার নাম বা বিষয়বস্তু অনুযায়ী অথবা ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণ হয়।
লেখক দাম গল্পটিতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে অনন্য মানবিকতার আলোয় ফুটিয়ে তুলেছেন। কাহিনির কথক সুকুমার ও তাঁর সহপাঠীদের কাছে স্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাই ছিলেন বিভীষিকা- স্বরূপ। তাঁদের অঙ্কভীতিকে ছাপিয়ে যেত মাস্টারমশাইয়ের মারের ভয়। ম্যাট্রিকুলেশনের পর অঙ্ক ও মাস্টারমশাইয়ের হাত থেকে মুক্তি পেলেও সেই ভয় সুকুমারকে বহুকাল তাড়া করে ফিরেছে।
পরবর্তীকালে বাংলার অধ্যাপক সুকুমার লেখক হিসেবে অল্পবিস্তর নাম করলে একটি অনামি পত্রিকা তাঁকে বাল্যস্মৃতি লেখার প্রস্তাব দেয়। সুকুমার অঙ্কের মাস্টারমশাইকে নিয়ে তাঁর ছোটোবেলার বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা লেখেন সেই স্মৃতিকথায়। সঙ্গে ছিল লেখকসুলভ কল্পনার খাদ আর মাস্টারমশাইয়ের সমালোচনা। লেখাটির জন্য তিনি দশ টাকা পারিশ্রমিকও পান।
এর বহুকাল পর বাংলাদেশের একটি কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে প্রৌঢ় সুকুমারের সঙ্গে হঠাৎ বৃদ্ধ মাস্টারমশাইয়ের দেখা হয়। সুকুমার জানতে পারেন তাঁর লেখা অনামি পত্রিকার সেই বাল্যস্মৃতিটি এখন মাস্টারমশাইয়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী। ছাত্র তাঁর কথা মনে রেখেছে, এটাই বৃদ্ধ মাস্টারমশাইয়ের গর্ব। ছাত্রের সমালোচনাকে তিনি উদারমনে সন্তানের অধিকার বলে মেনে নিয়েছেন। সুকুমার বুঝতে পারেন কৈশোরে তিনি শুধু শাসনের ভীতিকেই বুঝেছেন, কিন্তু তার পিছনে লুকিয়ে থাকা মাস্টারমশাইয়ের স্নেহের মনোভাবটি বুঝতে পারেননি। মাস্টারমশাইয়ের পড়ানোয় হয়তো কিছু পদ্ধতিগত ভুল ছিল, কিন্তু তাঁর নিষ্ঠার কোনো অভাব ছিল না। গুরু-শিষ্য উভয়ের উপলব্ধির আলোয় এই কাহিনিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ছাত্র-শিক্ষকের মানবিক সম্পর্ক, যা আজকের যুগের দিক থেকে খুবই সময়োপযোগী। পৃথিবীতে এমন অনেক জিনিস আছে যাকে দাম দিয়ে কেনা যায় না, যেমন — স্নেহ, ভালোবাসা, মমতার সম্পর্কগুলি।
মাস্টারমশাইকে নিয়ে তাঁর ছোটোবেলার অভিজ্ঞতা বিক্রি করে সুকুমার দশ টাকা দাম পেয়েছিলেন—এটাই তাঁকে চরম আত্ম-অনুশোচনায় ভোগায়। মাস্টারমশাইয়ের উদ্দেশে করা সমালোচনা দাম দিয়ে বিক্রি করা যায়, কিন্তু তাঁর স্নেহ দাম দিয়ে কেনা যায় না। সবদিক আলোচনা করে বলা যায় যে, গভীর ব্যঞ্জনাময় দাম নামটি এই কাহিনিটির ক্ষেত্রে যথাযথক এবং সার্থক।
দাম ছোটোগল্পটি অবলম্বনে মাস্টারমশাইয়ের চরিত্র আলোচনা করো।
কথামুখ – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাম গল্পটিতে মাস্টারমশাই এক অসামান্য চরিত্রসৃষ্টি।
পাণ্ডিত্য – গল্পের কথক সুকুমারের স্কুলের মাস্টারমশাই ছিলেন অঙ্কে অসাধারণ দক্ষ। যে – কোনো জটিল অঙ্কই তিনি একবারমাত্র দেখে তক্ষুনি অনায়াসে সমাধান করে ফেলতে পারতেন।
আবেগময়তা – মাস্টারমশাই বিশ্বাস করতেন অঙ্ক ভালোবাসা ও অঙ্ক পারা প্রতিটি ছাত্রের কর্তব্য। এই আবেগের কারণেই ছাত্ররা অঙ্ক না পারলে তাঁর প্রকাণ্ড হাতের প্রচণ্ড চড় নেমে আসত তাদের পিঠে। এই জন্যই মাস্টারমশাই ছাত্রদের কাছে মূর্তিমান বিভীষিকা হয়ে উঠেছিলেন।
উদারমনা – ছাত্র সুকুমারের বাল্যস্মৃতিতে লেখা সমালোচনাকে তিনি উদারমনে সন্তানের অধিকার বলেই গ্রহণ করেছিলেন। ছাত্র তাঁকে মনে রেখেছে — এইটুকুই বৃদ্ধ মাস্টারমশাইয়ের কাছে সবথেকে বড়ো পাওয়া হয়ে উঠেছে।
সারকথা – মাস্টারমশাইয়ের মধ্যে ছাত্রদের মন এবং আগ্রহকে বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন আদর্শনিষ্ঠ, কর্তব্যপরায়ণ এবং ছাত্রদরদি শিক্ষক। তাঁর ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে সুকুমারের দেওয়া সব আঘাত তাঁর পায়ে ছাত্রের শ্রদ্ধার ফুল হয়ে ঝরে পড়েছিল।
দাম ছোটোগল্পের সুকুমার চরিত্রটি আলোচনা করো।
অথবা, আমি তাঁকে দশ টাকায় বিক্রি করেছিলুম – এই উক্তিটির আলোকে সুকুমার চরিত্রটি আলোচনা করো।
কথামুখ – দাম গল্পের কাহিনি থেকে কথক সুকুমারের চরিত্রের একাধিক বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
অঙ্কে দুর্বল – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাম ছোটোগল্পের কথক সুকুমার বরাবরই অঙ্কে দুর্বল ছিলেন। সুকুমারের কাছে স্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাই ছিলেন মূর্তিমান বিভীষিকা। ম্যাট্রিকুলেশনের পর অঙ্ক ও মাস্টারমশাইয়ের হাত থেকে রেহাই পেলেও দীর্ঘদিন দুঃস্বপ্নে সেই ভয় সুকুমারকে তাড়া করে ফিরত। পরবর্তীকালে বাংলার অধ্যাপক-লেখক সুকুমার একটি অনামি পত্রিকায় মাস্টারমশাইকে নিয়ে তাঁর বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার স্মৃতিকথা লিখেছিলেন।
আত্মসমালোচক – সুকুমার চরিত্রের সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য হল তাঁর আত্মবিশ্লেষণ। তিনি যে মাঝারি মাপের লেখক, তাঁর বক্তৃতা যে আবেগসর্বস্ব, অন্তঃসারশূন্য, অত প্রশংসা যে তাঁর প্রাপ্য নয় সবটাই তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন।
শ্রদ্ধাশীল – বহু বছর পর তাঁর স্কুলজীবনের বিভীষিকা অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা হতেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে কিন্তু সুকুমারের এতটুকু দেরি হয়নি। অঙ্কে মাস্টারমশাইয়ের পাণ্ডিত্যকেও সুকুমার মর্যাদার সঙ্গে স্বীকার করেছেন। তিনি মাস্টারমশাইকে ভয় পেয়েছেন, কিন্তু অশ্রদ্ধা করেননি।
সংবেদনশীল – সুকুমারের পরিণত মন বুঝেছে যে, এতদিন তিনি শুধু মাস্টারমশাইয়ের শাসনের ভীতিকেই উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁর স্নেহের ফল্গুধারাকে অনুভব করতে পারেননি। যে স্নেহ-মমতা ক্ষমার মহাসমুদ্র মাস্টারমশাইয়ের স্মৃতিকে তিনি দশ টাকায় বিক্রি করেছেন, সেই মানুষটির অমূল্য স্নেহ তাঁর মাথায় ঝরে পড়েছে — এই ভেবে সুকুমার আত্মগ্লানিতে জর্জরিত হন।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাম গল্পটি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের এক অসামান্য দলিল – আলোচনা করো।
অথবা, দাম গল্প অবলম্বনে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বিষয়ে তোমার মনোভাব প্রকাশ করো।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক – দাম ছোটোগল্পে লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে স্নেহ-মমতা-শ্রদ্ধার মিশেলে এক অনন্য মাত্রা দান করেছেন। সুকুমার ও তাঁর অঙ্কের মাস্টারমশাই ছাত্র ও শিক্ষকসমাজের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন।
ছোটোবেলায় সুকুমার ও তাঁর সহপাঠীদের কাছে অঙ্কের মাস্টারমশাই ছিলেন সাক্ষাৎ বিভীষিকা। অঙ্কে মানুষটির অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। তাই ছাত্ররা অঙ্ক না পারলেই তিনি ভয়ানক রেগে যেতেন আর তাদের পিঠে নেমে আসত তাঁর প্রকাণ্ড হাতের প্রচণ্ড চড়। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, কিশোর মনে ভয়ের অনুভূতিটা এতই তীব্র হয় যে, ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে তা বিষয়টিকেও মন থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়। শাসন- পীড়ন-ভীতি কোনো বিষয়কে ভালোবাসতে সাহায্য করে না। সুকুমারের সমালোচনামূলক বাল্যস্মৃতি পড়ে অনেকদিন পরে মাস্টারমশাইয়ের এই চেতনা জেগেছিল। এখানে আত্মাভিমান মাস্টারমশাইয়ের আত্মোপলব্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
অন্যদিকে সুকুমারও উপলব্ধি করেছিলেন যে, কৈশোরে তিনি মাস্টারমশাইয়ের আপাত শাসনের আড়ালে থাকা স্নেহকে অনুভব করতে পারেননি। মাস্টারমশাইয়ের পড়ানোয় হয়তো পদ্ধতিগত কিছু ত্রুটি ছিল। কিন্তু অঙ্ক শেখানোর জন্য তাঁর নিষ্ঠা ও ছাত্রদের প্রতি ভালোবাসায় কোনো অভাব ছিল না। এভাবেই শ্রদ্ধা ও স্নেহের মধ্য দিয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের চিরকালীন রূপটি গল্পে প্রকাশ পেয়েছে।
দাম গল্পটি ছোটোগল্প হিসেবে কতটা সার্থক আলোচনা করো।
কথামুখ – শুধু আয়তনের সংক্ষিপ্ততা নয়, ছোটোগল্পের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য দাম গল্পে দেখা যায়।
চরিত্রের স্বল্পতা – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাম গল্পটিতে চরিত্রের সংখ্যা খুবই কম। সুকুমার এবং তাঁর স্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাই হলেন গল্পের প্রধান দুই চরিত্র। এ ছাড়া কলেজের প্রিন্সিপাল ও কয়েকজন ছাত্রের উল্লেখ আছে, যাঁদের ভূমিকা খুবই কম।
ঘটনার ঘনঘটা বর্জিত – দাম গল্পে ঘটনারও বাহুল্য নেই। গল্প শুরু হয়েছে সুকুমার ও তাঁর সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের সম্পর্ক দিয়ে। এর বাইরে অতিরিক্ত কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই। সেই সম্পর্কেরই পরিণতিতে গল্প শেষ হয়—ফলে নিশ্চিতভাবে কাহিনিটিকে একমুখী বলা যায়।
গল্পের শেষে চমক – যখন গল্পের শেষদিকে এসে সুকুমারের সঙ্গে কথকের দেখা হয় এবং সুকুমার জানতে পারেন যে স্বয়ং মাস্টারমশাই তাঁর লেখা বাল্যস্মৃতিটি পড়েছেন, তারপরে ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্ক যেভাবে নতুন ধারণায় প্রতিষ্ঠিত হয়, তা পাঠকদের নিঃসন্দেহে চমকে দেয়।
অতৃপ্তি – মাস্টারমশাই তাঁর সব সমালোচনার আঘাত উদারমনে গ্রহণ করেছেন — এটা জানার পর সুকুমারের স্বগতোক্তি দিয়ে গল্প শেষ হয়। পাঠকের মনে একটা অতৃপ্তি থেকেই যায় এটা জানার জন্য যে, এরপর কী হল ৷
মূল্যায়ন – সব দিক বিচার করে তাই বলাই যায় যে, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাম একটি আদর্শ ছোটোগল্প।
এই গল্পের মাধ্যমে লেখক শিক্ষার প্রকৃত মূল্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের সচেতন করেছেন। তিনি আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, পড়াশোনা শুধুমাত্র বইয়ের জ্ঞান অর্জন নয়। এর সাথে ভালো চরিত্র গঠনও জড়িত।