জীববিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হল বংশগতি। বংশগতির মাধ্যমে পিতামাতার বৈশিষ্ট্যগুলি তাদের সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এই অধ্যায়ে, আমরা বংশগতির বিভিন্ন নীতি এবং কয়েকটি সাধারণ জিনগত রোগ সম্পর্কে জানব।
বংশগতি কাকে বলে বুঝিয়ে দাও।
যে প্রক্রিয়ায় পিতামাতার চারিত্রিক গুণাবলি বংশপরম্পরায় সন্তানসন্ততির দেহে সঞ্চারিত হয়, তাকে বংশগতি বলে। বংশগতির মাধ্যমে কোনো জীব অবিকল তার মতোই জীব সৃষ্টি করে। যেমন — আম গাছ থেকে আম গাছ, ছাগল থেকে ছাগল, মানুষ থেকে মানুষ জন্মায়।
মেন্ডেলের সূত্র দুটির নাম কী?
মেন্ডেলের সূত্র দুটির নাম হল — 1. পৃথকীভবনের সূত্র এবং 2. স্বাধীন বিন্যাসের সূত্র।
ড্রাইহাইব্রিড ক্রস বা দ্বিসংকর জনন কাকে বলে?
কোনো প্রজাতির দুই জোড়া বিপরীতধর্মী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দুটি জীবের মধ্যে জনন সম্পাদিত হলে, তাকে ডাইহাইব্রিড ক্রস বা দ্বিসংকর জনন বলে। যেমন — হলদে বীজপত্র ও গোলাকার বীজসম্পন্ন মটর গাছের সঙ্গে সবুজ বীজপত্র ও কুঞ্চিত বীজসম্পন্ন মটর গাছের সংকরায়ণ হল ডাইহাইব্রিড ক্রস বা দ্বিসংকর জননের উদাহরণ।
প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য বলতে কী বোঝ? উদাহরণ দাও।
প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য – একই চরিত্রের অন্তর্গত দুটি বিশুদ্ধ বিপরীত বৈশিষ্ট্যের জীবের মিলন ঘটালে প্রথম অপত্য বংশে (F1 জনুতে) যে বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশিত না হয়ে সুপ্ত থাকে ও পরে দ্বিতীয় অপত্য বংশে (F2 জনুতে) প্রকাশ পায়, তাকে প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য বলে।
উদাহরণ – বিশুদ্ধ বেগুনি ও বিশুদ্ধ সাদা ফুলযুক্ত মটর গাছের ফুলের ইতর পরাগযোগ ঘটালে F1 জনুতে সাদা ফুলযুক্ত উদ্ভিদ পাওয়া যায় না, F2 জনুতে যদিও তা আবার প্রকাশ পায়। এই সাদা ফুল বৈশিষ্ট্যটি হল প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য।
সুপ্রজননবিদ্যার জনকের পুরো নাম লেখো। কেন তাঁকে সুপ্রজননবিদ্যার জনক বলা হয়?
সুপ্রজননবিদ্যার জনক – সুপ্রজননবিদ্যার জনক হলেন গ্রেগর জোহান মেন্ডেল।
কারণ – মটর গাছ নিয়ে তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষার (1856- 1863) ওপর নির্ভর করে তিনিই সর্বপ্রথম জীবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বংশগত অনুসরণের প্রাথমিক সূত্র প্রণয়ন করেন। এই কারণে তাঁকে সুপ্রজননবিদ্যার জনক বলা হয়।
প্রকট বৈশিষ্ট্য বলতে কী বোঝ? উদাহরণ দাও।
প্রকট বৈশিষ্ট্য – একই চরিত্রের অন্তর্গত দুটি বিশুদ্ধ বিপরীত বৈশিষ্ট্যের জীবের মিলন ঘটালে প্রথম অপত্য বংশে (F1 জনুতে) যে বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশ পায়, তাকে প্রকট বৈশিষ্ট্য বলে।
উদাহরণ – বিশুদ্ধ বেগুনি ও বিশুদ্ধ সাদা ফুলযুক্ত মটর গাছের পরনিষেক ঘটালে F1 জনুতে সৃষ্ট সকল গাছ বেগুনি ফুলবিশিষ্ট হয়, অর্থাৎ বেগুনি ফুল হওয়ার বৈশিষ্ট্যটি হল প্রকট বৈশিষ্ট্য।
মনোহাইব্রিড ক্রস বা একসংকর জনন কাকে বলে?
কোনো প্রজাতির একটি চরিত্রের অন্তর্গত একজোড়া বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দুটি জীবের মধ্যে জনন সম্পাদিত হলে, তাকে মনোহাইব্রিড ক্রস বা একসংকর জনন বলে। যেমন — মটর গাছের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ লম্বা ও বিশুদ্ধ বেঁটে এই দুই বিপরীতধর্মী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে যে সংকরায়ণ হয়, তা হল একটি মনোহাইব্রিড ব্রুস বা একসংকর জনন।
জিনোটাইপ কী? উদাহরণ দাও।
জিনোটাইপ – কোনো জীবের একটি চরিত্রের জিনগত গঠনকে অ্যালিল সমন্বয় দ্বারা প্রকাশ করলে, তাকে জিনোটাইপ বলে।
উদাহরণ – মটর গাছের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ লম্বা মটর গাছের জিনগত গঠন বা জিনোটাইপ হল TT এবং বিশুদ্ধ খর্ব মটর গাছের জিনোটাইপ হল tt|
ফিনোটাইপ কী? উদাহরণ দাও।
ফিনোটাইপ – কোনো জীবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বাহ্যিক প্রকাশকে ফিনোটাইপ বলে।
উদাহরণ – মটর গাছের দৈর্ঘ্য চরিত্রটির বাহ্যিক প্রকাশ বা ফিনোটাইপ হল লম্বা ও বেঁটে।
হেটেরোজাইগাস জীব কাকে বলে?
কোনো জীবের দুটি সমসংস্থ ক্রোমোজোমে অবস্থিত একটি নির্দিষ্ট চরিত্রের অ্যালিল-দুটি ভিন্ন প্রকৃতির হলে, ওই নির্দিষ্ট চরিত্রের সাপেক্ষে সেই জীবকে হেটেরোজাইগাস জীব বা বিষমসংকর জীব বলে। যেমন — সংকর লম্বা (Tt) মটর উদ্ভিদ হেটেরোজাইগাস প্রকৃতির। কারণ, এক্ষেত্রে একই লোকাসে দুটি ভিন্ন অ্যালিল থাকে।
হোমোজাইগাস জীব কাকে বলে?
কোনো জীবের দুটি সমসংস্থ ক্রোমোজোমে একটি নির্দিষ্ট চরিত্রের অ্যালিল-দুটি একইরকম হলে, ওই নির্দিষ্ট চরিত্রের সাপেক্ষে সেই জীবকে হোমোজাইগাস জীব বা সমসংকর জীব বলে। যেমন — বিশুদ্ধ লম্বা (TT) বা বিশুদ্ধ বেঁটে (tt) বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী অ্যালিল-দুটি একই প্রকৃতির। তাই বিশুদ্ধ লম্বা বা বিশুদ্ধ বেঁটে বৈশিষ্ট্যযুক্ত জীব হল হোমোজাইগাস।
অ্যালিল বা অ্যালিলোমর্ফ কী?
সমসংস্থ ক্রোমোজোমের একই লোকাসে অবস্থিত কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী একটি জিনের ভিন্ন ভিন্ন রূপকে অ্যালিল বা অ্যালিলোমর্ফ বলা হয়। এককথায়, অ্যালিল হল একই জিনের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। যেমন — লম্বা ও খর্বাকার, সাদা ও কালো ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য নির্ধারক জিন জোড়ার একটি জিন অপরটির অ্যালিল।
মেন্ডেলের বংশগতির প্রথম সূত্রটি কী?
কোনো জীবের নির্দিষ্ট একটি চরিত্রের অন্তর্গত একজোড়া- বিপরীত বৈশিষ্ট্যের উপাদানগুলি জনিতৃ থেকে অপত্যে সঞ্ঝারিত হলেও তারা পরস্পর মিশে যায় না বরং অপত্যের গ্যামেট তৈরির সময়ে পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায়। এটিই মেন্ডেলের বংশগতির প্রথম সূত্র বা পৃথকীভবনের সূত্র।
মেন্ডেলের বংশগতির দ্বিতীয় সূত্রটি কী?
দুই বা তার বেশি বিপরীতধর্মী যুগ্ম বৈশিষ্ট্যের উপাদানগুলি জনিতৃ থেকে অপত্য জনুতে সঞ্চারিত হলেও তারা মিশ্রিত হয় না বরং অপত্যের জননকোশ তৈরির সময়ে এরা পরস্পর থেকে পৃথক হয় এবং সম্ভাব্য সকল প্রকার সমন্বয়ে স্বাধীনভাবে জননকোশে সঞ্চারিত হয়। এটিই মেন্ডেলের বংশগতির দ্বিতীয় সূত্র বা স্বাধীন বিন্যাস সূত্র।
সংকরায়ণ কাকে বলে?
কোনো চরিত্রের সাপেক্ষে বিপরীত বৈশিষ্ট্যযুক্ত একই প্রজাতির দুটি জীবের মধ্যে যৌন জননকে সংকরায়ণ বলে। যেমন — বিশুদ্ধ লম্বা ও বিশুদ্ধ বেঁটে মটর গাছের মিলন ঘটিয়ে সংকর লম্বা মটর গাছ সৃষ্টি করার পদ্ধতি।
কোনো জীবের চরিত্র বলতে কী বোঝ?
কোনো জীবের চরিত্র বলতে বোঝায় জিন নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে। যেমন — মটর গাছের উচ্চতা হল একটি চরিত্র। এই চরিত্রের অন্তর্গত দুটি বৈশিষ্ট্য হল লম্বা ও বেঁটে। একইভাবে বীজপত্রের রং চরিত্রটির অন্তর্গত দুটি বিপরীত বৈশিষ্ট্য হল হলদে ও সবুজ।
কোনো জীবের বৈশিষ্ট্য বলতে কী বোঝ?
কোনো জীবের বাহ্যিক বিশেষত্ব বা গুণকে বলে বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি বৈশিষ্ট্য একটি অ্যালিল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন — মটর গাছের লম্বা হওয়াটি একটি বৈশিষ্ট্য। একইভাবে মটরের বীজপত্রের সবুজ বর্ণ, ফুলের বেগুনি বর্ণ প্রভৃতি হল পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্য।
বিশুদ্ধ জীব বলতে কী বোঝ?
কোনো জীব যদি বংশানুক্রমে কোনো বৈশিষ্ট্য হুবহু একইরকম বজায় রাখে, তখন সেই বৈশিষ্ট্যের জন্য জীবটিকে বিশুদ্ধ বা খাঁটি জীব বলা হয়। যেমন — মেন্ডেলের একসংকর জনন পরীক্ষায় জনিতৃ জনুর লম্বা (TT) ও বেঁটে (tt) মটর গাছ বিশুদ্ধ উদ্ভিদ।
সংকর জীব বলতে কী বোঝ?
দুটি বিশুদ্ধ বিপরীত বৈশিষ্ট্যযুক্ত জীবের যৌন জনন বা পরনিষেকের ফলে উৎপন্ন জীবটিকে সংকর জীব বলা হয়। যেমন — বিশুদ্ধ বেগুনি ফুলযুক্ত (VV) এবং বিশুদ্ধ সাদা ফুলযুক্ত (vv) মটর গাছের সংকরায়ণের ফলে সৃষ্ট বেগুনি ফুলযুক্ত মটর গাছ হল সংকর উদ্ভিদ।
জনিতৃ জনু বলতে কী বোঝ?
সংকরায়ণ পরীক্ষায় শুরুতে যে দুটি জীব নিয়ে প্রজনন করানো হয়, তাদের জনিতৃ জনু বা P জনু (P=parental) বলা হয়। যেমন — একটি একসংকর জনন পরীক্ষায় জনিতৃ জনু হল বিশুদ্ধ বেগুনি ফুলবিশিষ্ট মটর গাছ (VV) এবং বিশুদ্ধ সাদা ফুলবিশিষ্ট মটর গাছ (vv)।
প্রথম অপত্য জনু বলতে কী বোঝ?
সংকরায়ণ পরীক্ষায় জনিতৃ জনু থেকে উৎপন্ন নতুন জীবগুলিকে প্রথম অপত্য জনু বা F1 জনু (F1 =first filial) বলা হয়। যেমন — বিশুদ্ধ বেগুনি ফুলবিশিষ্ট (VV) ও বিশুদ্ধ সাদা ফুলবিশিষ্ট (vv) জনিতৃ জনু থেকে উৎপন্ন সংকর বেগুনি ফুলবিশিষ্ট (Vv) সমস্ত মটর গাছই হল প্রথম অপত্য জনু।
মেন্ডেল তার একসংকর জনন পরীক্ষায় F1 জানুতে সকল উদ্ভিদ লম্বা হওয়ার ঘটনাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?
একসংকর জনন পরীক্ষা থেকে মেন্ডেল এই সিদ্ধান্তে। উপনীত হন যে, বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবের মিলনের ফলে প্রথম অপত্য জনুতে (F1 জনুতে) প্রকট বৈশিষ্ট্যটি প্রাধান্য লাভ করে এবং কেবল সেই বৈশিষ্ট্যটিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এক্ষেত্রে দেখা যায়, মটর গাছের লম্বা হওয়ার বৈশিষ্ট্যটিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অর্থাৎ, এটি প্রকট বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। অপরদিকে, বেঁটে বৈশিষ্ট্যটির কোনো প্রকার বহিঃপ্রকাশ এখানে নেই। সুতরাং, বেঁটে গাছ প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এই সিদ্ধান্তটিকেই প্রকটতার সূত্র (law of dominance) বলে।
দ্বিসংকর পরীক্ষার F2 জনুতে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের প্রকট ও প্রচ্ছন্ন গুণাবলির বিভিন্ন সমন্বয়ের ঘটনাকে মেন্ডেল কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?
দ্বিসংকর পরীক্ষার F2 জনুতে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের (যেমন — বীজের আকার ও বীজপত্রের রং) প্রকট ও প্রচ্ছন্ন গুণাবলি সম্ভাব্য সকল সমন্বয়ে বিন্যস্ত হয়। সেখানে কেবলমাত্র প্রকটতার সূত্র মেনে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জিনগুলি কোনোক্ষেত্রেই অপর জিন দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে স্বাধীনভাবে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। মেন্ডেল একে স্বাধীন বিন্যাস সূত্র (law of independent assortment) রূপে ব্যাখ্যা করেন।
ব্যাক ক্রস (back cross) কী?
প্রথম অপত্য জনুর (F1 জনু) সংকর জীবের সঙ্গে যে- কোনো জনিতৃ জীবের (P জনু) সংকরায়ণ ঘটানোর পরীক্ষাকে ব্যাক ক্রস বলে। যেমন — সংকর লম্বা মটর উদ্ভিদের সঙ্গে বিশুদ্ধ লম্বা বা বিশুদ্ধ বেঁটে মটর উদ্ভিদের সংকরায়ণ (Tt × TT বা Tt × tt)|
বংশগতির পরীক্ষায় জনিতৃ জনুতে কালো লোম ও সাদা লোমযুক্ত গিনিপিগের মধ্যে মিলনে F1 জনুতে প্রকার গিনিপিগ উৎপন্ন হবে?
বংশগতির পরীক্ষায় জনিতৃ জনুতে কালো লোম ও সাদা লোমযুক্ত গিনিপিগ নিয়ে পরীক্ষা করলে F1 জনুতে সকল অপত্যই কালো লোমযুক্ত হয়। লোমের কালো রঙের নিয়ন্ত্রক জিনটি লোমের সাদা রং নিয়ন্ত্রক জিনকে F1 জনুতে প্রভাবিত করে ও সুপ্ত রাখে, তাকে প্রকাশিত হতে দেয় না।
একটি দীর্ঘ ও একটি খর্ব মটর উদ্ভিদের মধ্যে সংকরায়ণ দ্বারা মেন্ডেল কা সূত্রে উপনীত হন?
একটি দীর্ঘ ও একটি খর্ব মটর উদ্ভিদের মধ্যে সংকরায়ণ যারা মেন্ডেল যে সূত্রে উপনীত হন, তা হল পৃথকীভবন সূত্র। এই সুত্রানুসারে পিতামাতার জনন মাতৃকোশে অবস্থিত বিপরীতধর্মী গুণাবলি প্রথম অপত্য জনুতে (F1) সঞ্চারিত হলেও তাদের মধ্যে কোনো মিশ্রণ ঘটে না। এরপর অপত্য জনু যখন গ্যামেট উৎপাদন করে তখন এই বিপরীতধর্মী গুণাবলি পরস্পরের থেকে পৃথক হয়ে যায়। এটিই মেন্ডেলের প্রথম সূত্র।
টেস্ট ক্রস (test cross) কী?
প্রথম অপত্য জনুর (F1 জনু) সংকর জীবের সঙ্গে বিশুদ্ধ প্রচ্ছন্ন জিনোটাইপযুক্ত জনিতৃ জীবের (P জনু) সংকরায়ণ ঘটানোর পরীক্ষাকে টেস্ট ক্রস বলে। কোনো বিশেষ অপত্য জীবের জিনোটাইপ নির্ণয় করার উদ্দেশ্যে এই টেস্ট ক্রস করা হয়ে থাকে। যেমন — মেন্ডেলের একসংকর জনন পরীক্ষায় F1 – এ প্রাপ্ত সংকর লম্বা মটর উদ্ভিদের সঙ্গে বিশুদ্ধ বেঁটে মটর উদ্ভিদের সংকরায়ণ (Tt × tt)।
টেস্ট ক্রস একপ্রকার ব্যাক ক্রস – ব্যাখ্যা করো।
প্রথম অপত্য জনুর জীবের সঙ্গে যে-কোনো একটি জনিতৃ জীবের ক্রস করানো হলে, তাকে ব্যাক ক্রস বলে। যেমন — মেন্ডেলের একসংকর জনন পরীক্ষার ক্ষেত্রে সংকর লম্বা গাছের সাথে বিশুদ্ধ লম্বা অথবা বিশুদ্ধ বেঁটে গাছের সংকরায়ণ (Tt × TT বা Tt × tt)। ব্যাক ক্রসে যখন প্রচ্ছন্ন জীব ব্যবহৃত হয় কেবল তখন সেই ক্রসকে বলে টেস্ট ক্রস। এক্ষেত্রে সংকর লম্বা গাছের সাথে বিশুদ্ধ বেঁটে গাছের সংকরায়ণ (Te × tt) ঘটে। তাই বলা যায় যে, টেস্ট ক্রস প্রকৃতপক্ষে হল একপ্রকার ব্যাক ক্রস।
RrYy জিনোটাইপবিশিষ্ট একটি গোল-হলদে বীজের মটর গাছ থেকে মিয়োসিস কোশ বিভাজনের ফলে কী কী প্রকারের গ্যামেট উৎপন্ন হতে পারে?
RrYy জিনোটাইপবিশিষ্ট একটি গোল-হলদে বীজের মটর গাছ থেকে মিয়োসিস কোশ বিভাজনের ফলে RY, Ry, rY, ry — এই চার প্রকারের গ্যামেট উৎপন্ন হতে পারে।
প্রাণীর ক্ষেত্রে এবং উদ্ভিদের ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ প্রকটতার একটি উদাহরণ দাও।
প্রাণীর ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ প্রকটতার উদাহরণ – একটি বিশুদ্ধ কালো (হোমোজাইগাস) অ্যান্ডালুসিয়ান মুরগির সঙ্গে একটি বিশুদ্ধ সাদা (হোমোজাইগাস) মোরগের সংকরায়ণ ঘটানো হলে প্রথম অপত্য জনুর (F1 জনুর) মুরগিগুলি সব নীল রঙের হয়।
উদ্ভিদের ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ প্রকটতার উদাহরণ – একটি সন্ধ্যামালতীর লাল ও সাদা ফুলযুক্ত উদ্ভিদের মধ্যে সংকরায়ণ ঘটানো হলে প্রথম অপত্য জনুতে লাল ও সাদা ফুলের বদলে গোলাপি ফুলযুক্ত উদ্ভিদ তৈরি হয়।
চেকার বোর্ড বলতে কী বোঝ?
যে-কোনো ধরনের ক্রস লিখে প্রকাশ করার সবচেয়ে প্রচলিত, সুবিধাজনক, বিজ্ঞানসম্মত ও নিয়মনিষ্ঠ পদ্ধতিকে চেকার বোর্ড বলা হয়। বিজ্ঞানী রেজিনাল্ড ক্রামডাল পানেট এই পদ্ধতিটি প্রবর্তন করেন বলে একে পানেট বর্গ-ও বলা হয়। এক্ষেত্রে, একটি বক্সের মাধ্যমে সমস্ত ধরনের গ্যামেটের সকল প্রকার সমন্বয় প্রকাশ করা যায়।
মটর গাছের যে-কোনো দুটি চরিত্রের সাপেক্ষে বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
দৈর্ঘ্য চরিত্রের সাপেক্ষে লম্বা ও বেঁটে এবং ফুলের রং চরিত্রের সাপেক্ষে বেগুনি ও সাদা হল দুটি বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্য।
TT এবং tt জিনোটাইপ দুটির ফিনোটাইপ কী হবে? পুরুষ ও স্ত্রী দেহকোশের ক্রোমোজোমের বিন্যাস লেখো।
TT — লম্বা, tt — বেঁটে।
পুরুষ — 44A + XY, স্ত্রী — 44A + XX
মহিলাদের কেন হোমোগ্যামেটিক লিঙ্গ বলা হয়?
মহিলাদের জিনোটাইপ XX বলে কেবলমাত্র একপ্রকার গ্যামেট বা ডিম্বাণু (X ক্রোমোজোম বহনকারী) উৎপন্ন হতে পারে। এই কারণে মহিলাদের হোমোগ্যামেটিক লিঙ্গ বলা হয়।
পুরুষদের কেন হেটেরোগ্যামেটিক লিঙ্গ বলা হয়?
পুরুষের জিনোটাইপ XY বলে তাদের দেহে দুই প্রকার গ্যামেট বা শুক্রাণু তৈরি হয়। যেমন — X ও Y ক্রোমোজোম বহনকারী শুক্রাণু। এই কারণে পুরুষদের হেটেরোগ্যামেটিক লিঙ্গ বলা হয়।
মিউল্যাটো (Mulatto) কী?
বিশুদ্ধ শ্বেতকায় এবং বিশুদ্ধ অশ্বেতকায় স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে যৌন জননের ফলে সৃষ্ট সাদা ও কালোর মাঝামাঝি বর্ণের সন্তানদের বলে মিউল্যাটো।
গিনিপিগের দ্বিসংকর জননের পরীক্ষায় F2 জনুতে কত প্রকার ও কী কী ফিনোটাইপ পাওয়া যায়?
বিশুদ্ধ কালো ও খর্ব লোমযুক্ত এবং বিশুদ্ধ সাদা ও দীর্ঘ লোমযুক্ত গিনিপিগের দ্বিসংকর জনন পরীক্ষায় F2 জনুতে চারটি ফিনোটাইপ পাওয়া যায়। এগুলি হল — কালো ও খর্ব লোমযুক্ত, কালো ও দীর্ঘ লোমযুক্ত, সাদা ও খর্ব লোমযুক্ত এবং সাদা ও দীর্ঘ লোমযুক্ত।
জিনোম কাকে বলে?
ডিপ্লয়েড ক্রোমোজোমসম্পন্ন (2n) জীবের প্রতিটি হ্যাপ্লয়েড (n) ক্রোমোজোম সেটে বিন্যস্ত জিনগুলিকে একত্রে জিনোম বলে। অর্থাৎ, জননকোশের বা গ্যামেটের হ্যাপ্লয়েড ক্রোমোজোমের সমস্ত জিনকে একত্রে জিনোম বলে। এগুলি গ্যামেটের মাধ্যমে জনিতৃ জীব থেকে অপত্যের দেহে সঞ্চারিত হয়।
লিঙ্গ সংযোজিত জিন কাকে বলে?
জীবের যৌন ক্রোমোজোমে অবস্থিত দেহজ বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী জিন যা গ্যামেটের মাধ্যমে এক জনু থেকে পরবর্তী জনুতে সঞ্চারিত হয়, তাদের লিঙ্গ সংযোজিত জিন বলে।এগুলি দুই প্রকারের হয়। X ক্রোমোজোমে অবস্থিত জিনগুলিকে বলে X-সংযোজিত এবং Y ক্রোমোজোমে অবস্থিত জিনসমূহকে বলে Y-সংযোজিত বা হোল্যানড্রিক জিন।
মানব সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের ক্ষেত্রে পিতা ও মাতার ভূমিকা কীরূপ?
মানব সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের ক্ষেত্রে মাতার ক্রোমোজোমগত ভূমিকা থাকে না। কারণ মাতা কেবলমাত্র একপ্রকাব গ্যামেট (X ক্রোমোজোমযুক্ত) উৎপাদন করতে পারেন। পিতার কোশে দু-প্রকার যৌন ক্রোমোজোম অবস্থিত এবং তিনি দুই প্রকার গ্যামেট (X অথবা Y ক্রোমোজোমযুক্ত) উৎপাদনে সক্ষম। অর্থাৎ, X অথবা Y ক্রোমোজোম দানের মাধ্যমে লিঙ্গ নির্ধারণে পিতার ক্রোমোজোমগত ভূমিকাই প্রধান।
মানব সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণে পিতার ভূমিকা কীরূপ?
পিতার শুক্রাণুতে X অথবা Y যে-কোনো একটি ক্রোমোজোম থাকে। পিতার X ক্রোমোজোমযুক্ত শুক্রাণু নিষেকে অংশ নিলে সন্তান স্ত্রীলিঙ্গযুক্ত হয়। অপরদিকে পিতার Y ক্রোমোজোমযুক্ত শুক্রাণু নিযেকে অংশ নিলে সন্তান পুংলিঙ্গযুক্ত হয়। এক্ষেত্রে মাতার ডিম্বাণু সর্বদাই X ক্রোমোজোমযুক্ত বলে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণে তাঁর ক্রোমোজোমগত ভূমিকা নিষ্ক্রিয় হয়।
কোনো পুরুষের X ক্রোমোজোম বহনকারী একটি শুক্রাণু যদি কোনো স্ত্রীলোকের একটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে তাহলে নিষেকের ফলে উৎপন্ন ভ্রূণাণুটি কোন্ লিঙ্গের সন্তানের জন্ম দেবে?
কোনো পুরুষের X ক্রোমোজোম বহনকারী শুক্রাণু কোনো স্ত্রীলোকের ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করলে উৎপন্ন ভ্রূণাণুটি স্ত্রীলিঙ্গযুক্ত সন্তানের জন্ম দেবে। এক্ষেত্রে সন্তানের যৌন ক্রোমোজোম দুটি হবে XX।
আরও পড়ুন,
- মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – বংশগতি এবং কয়েকটি সাধারণ জিনগত রোগ – বংশগতি – মেন্ডেলের একসংকর জনন – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
- মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – বংশগতি এবং কয়েকটি সাধারণ জিনগত রোগ – বংশগতি – রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
- মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান – বংশগতি এবং কয়েকটি সাধারণ জিনগত রোগ – কয়েকটি সাধারণ জিনগত রোগ – সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
মানুষের কয়েকটি প্রকট ও প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
মানুষের কয়েকটি প্রকট ও প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য হল —
প্রকট বৈশিষ্ট্য | প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য |
বাদামি চোখ | নীল চোখ |
গাঢ় কালো চুল | হালকা কালো চুল |
কোঁকড়ানো চুল | সোজা চুল |
বংশগতি এবং জিনগত রোগ সম্পর্কে জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই জিনগত রোগগুলি পরিবারের জন্য ভারী মানসিক এবং আরোগ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
তবে এই রোগগুলির বৈশিষ্ট্য হল এদের মূল কারণ জিনগত হওয়া যেখানে একজন ব্যক্তি এই রোগটি আক্রান্ত হলে তার সন্তানও একই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
তাই সম্পর্কিত পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখতে হবে এবং এই রোগগুলি পরিবার পরিকল্পনা করার সময় বিশেষ বিবেচনা করতে হবে।
বংশগতি হল একটি জটিল প্রক্রিয়া যা জীবের বৈশিষ্ট্যগুলিকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত করে। এই অধ্যায়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বংশগতির মূলনীতিগুলি, একসংকর ও দ্বিসংকর জনন, প্রকরণ ও জিনগত রোগ সম্পর্কে জানতে পারে।