নবম শ্রেণি – বাংলা – চিঠি – স্বামী বিবেকানন্দ – সামগ্রিক বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর

স্বামী বিবেকানন্দের চিঠি গুলি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। তাঁর চিঠি গুলিতে তিনি নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, যেমন ধর্ম, দর্শন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ইত্যাদি। তাঁর চিঠি গুলি থেকে আমরা তাঁর চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি, আদর্শ ও মূল্যবোধ সম্পর্কে জানতে পারি।

Table of Contents

নবম শ্রেণি – বাংলা – চিঠি

পত্রসাহিত্য বলতে কী বোঝ? পাঠ্য চিঠি প্রবন্ধ-কে, কি পত্রসাহিত্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করা যায়? যুক্তি – সহ লেখো।

পত্রসাহিত্য – ব্যক্তিগত বা সাধারণ খবরাখবর, তথ্য ইত্যাদির গণ্ডি পেরিয়ে চিঠি প্রবন্ধতে যখন সমাজ, প্রকৃতি, কল্পনা ইত্যাদি প্রাধান্য পায় এবং তা সর্বজনীন হয়ে ওঠে তখন তা পত্রসাহিত্য হিসেবে বিবেচিত হয়। চিঠি প্রবন্ধের বিষয় যখন ব্যক্তিগত ভাবনা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চিরন্তন সত্যকেও প্রকাশ করে তখন তা সাহিত্য হয়ে ওঠে।
পাঠ্য চিঠি প্রবন্ধর পত্রসাহিত্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা – স্বামী বিবেকানন্দের বেশ কিছু চিঠি প্রবন্ধের সৃজনশীলতার গুণে সাহিত্য হয়ে উঠেছে। আলোচ্য চিঠি প্রবন্ধটি এমনই একটি দৃষ্টান্ত। এখানে ব্যক্তিগত তথ্যের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে লেখকের সমাজভাবনা এবং স্বদেশপ্রীতি। সাহিত্য সমাজের এবং মানুষের কথা বলে। স্বামীজি তৎকালীন ভারতের মানুষের দুর্দশায় ও নারীসমাজের লাঞ্ছনায় পীড়িত ছিলেন। তাই তিনি মিস নোব্‌ল্‌কে লেখেন, এদেশের দুঃখ, কুসংস্কার, দাসত্ব প্রভৃতি কী ধরনের, তা তুমি ধারণা করতে পারো না।
দারিদ্র্য, অস্পৃশ্যতা, জাতিবর্ণের বৈষম্য, শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ শাসকদের অত্যাচার ইত্যাদি থেকে ভারতবাসীর মুক্তির পথ খুঁজেছেন স্বামীজি। বিশেষত ভারতের নারীসমাজের উন্নতির জন্য মিস নোব্‌লের মতো দৃঢ়চেতা, পবিত্র নারীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন তিনি। সাধারণ মানুষের মঙ্গল তথা মানবতার মুক্তিই যে তাঁর কাম্য তা ফুটে উঠেছে পাঠ্য ‘চিঠি’ প্রবন্ধ-তে। তাই এ চিঠি প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সর্বজনীনতা ও সমাজভাবনার কারণে সাহিত্যের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়েছে।

স্বামী বিবেকানন্দ রচিত পাঠ্য চিঠি প্রবন্ধ – কে ব্যক্তিগত পত্র না সামাজিক পত্র — কোন শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা যায়?

পত্রের ধরন – বিষয়বস্তু অনুসারে চিঠি প্রবন্ধকে নানা শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে প্রধান দুটি ভাগ হল ব্যক্তিগত পত্র ও সামাজিক পত্ৰ ৷ পাঠ্য ‘চিঠি’প্রবন্ধটি একজন ব্যক্তি স্বামী বিবেকানন্দ মিস নোব্‌লের উদ্দেশ্যে লিখেছেন। সেদিক থেকে এই চিঠি প্রবন্ধকে ব্যক্তিগত পত্র বলাই যায়। কিন্তু সব চিঠি প্রবন্ধই ব্যক্তির সঙ্গে কোনো-না-কোনোভাবে সম্পর্কিত। তবে স্বামীজির এই চিঠি প্রবন্ধটি ব্যক্তিগত স্তর অতিক্রম করে সামাজিক স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে, কারণ এই চিঠিতে উনিশ শতকীয় ভারত ও তার দুর্দশাময় সমাজের চিত্র ফুটে উঠেছে। মানবসেবার বৃহত্তর স্বার্থে এ চিঠি প্রবন্ধ লিখিত, ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়। ভারতীয় সমাজে মানবসেবার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করতে মিস নোব্‌ল্‌ এদেশে আসতে চান। এ কথা জেনে স্বামীজি তাঁকে এদেশের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতটি বোঝানোর জন্য এ চিঠি প্রবন্ধ লিখেছেন। ভারতীয়দের দাসত্ব, দুঃখদারিদ্র্য, কুসংস্কার, বর্ণবৈষম্য, অস্পৃশ্যতার কথা স্বামীজি মিস নোব্‌ল্‌কে জানিয়েছেন। শ্বেতাঙ্গদের প্রতি ভারতবাসীর মনোভাব, এখানকার আবহাওয়া ইত্যাদি সম্পর্কেও আগাম ধারণা দিতে চেয়েছেন তিনি। এ চিঠি প্রবন্ধের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা নেই, আছে ভারতীয়দের দুঃখ এবং দুঃখ থেকে মুক্তির পথ সন্ধানের প্রসঙ্গ। তাই আলোচ্য ‘চিঠি’ প্রবন্ধকে সামাজিক পত্ররূপে গ্রহণ করাই যথাযথ।

পাঠ্য চিঠি প্রবন্ধটিকে উনিশ শতকের ভারতের একটি ঐতিহাসিক ও সামাজিক দলিলরূপে গ্রহণ করা যায় কি না আলোচনা করো।

অথবা, বিবেকানন্দের চিঠি প্রবন্ধটি উনিশ শতকে ভারতের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের এক ঐতিহাসিক ভাষ্য। — আলোচনা করো।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব – পাঠ্য ‘চিঠি’ প্রবন্ধের লেখক স্বামী বিবেকানন্দ এবং প্রাপক মিস নোব্‌ল্‌-উভয়েই ঐতিহাসিক ব্যক্তি। দুজনেই ভারতের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছিলেন এবং মানবসভ্যতার ইতিহাসে অমূল্য অবদান রেখে গেছেন। অন্যদিকে, উনিশ শতকের শেষভাগে ভারতবাসীর জীবনযাত্রা, মানুষের বিশ্বাস-ধারণা, দুঃখ-বেদনা ইত্যাদির উল্লেখে একটি বিশেষ সময়ের পরিচয় আলোচ্য ‘চিঠি’ প্রবন্ধ থেকে পাওয়া যায়। তাই ‘চিঠি’ প্রবন্ধটিকে একটি ঐতিহাসিক দলিলরূপে গ্রহণ করা যায়।
অপরদিকে, যে দুর্দশাগ্রস্ত ভারতে মানবসেবার ব্রত নিয়ে মিস নোব্‌ল্‌ আসতে চান তার সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতটি এই চিঠি প্রবন্ধতে বর্ণিত হয়েছে। চিঠি প্রবন্ধটিতে স্বামীজি নোব্‌ল্‌কে জানিয়েছেন এদেশের দুঃখ, কুসংস্কার, দাসত্ব প্রভৃতির শিকড় অনেক গভীরে গাঁথা। জাতি-বর্ণের বৈষম্য, অস্পৃশ্যতা ভারতীয় জনজীবনের অভিশাপ। অন্নবস্ত্রের অভাবে এদেশের অসংখ্য নরনারী অর্ধ-ভুক্ত, অর্ধ-উলঙ্গ। নারীদের শিক্ষার সুযোগ নেই। তার ওপর রয়েছে ইংরেজ শাসকদের শোষণ অত্যাচার। ভারতীয়রা শ্বেতাঙ্গদের ভয় এবং ঘৃণা করে। শ্বেতাঙ্গরাও ঘৃণার চোখে দেখে এদেশের মানুষকে। এমনই এক সমাজে মিস নোব্‌ল্‌কে মানবসেবার কাজ করতে হবে।
সুতরাং আলোচ্য ‘চিঠি’ প্রবন্ধটিকে উনিশ শতকীয় ভারতের একটি ঐতিহাসিক ও সামাজিক দলিলরূপে চিহ্নিত করাই যায়।

পাঠ্য চিঠি প্রবন্ধটিতে স্বামী বিবেকানন্দের চরিত্রের কী পরিচয় পাওয়া যায়?

স্বামী বিবেকানন্দের লেখা পাঠ্য ‘চিঠি’ প্রবন্ধটিতে তাঁর চরিত্রের নানা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।
দূরদর্শিতা – মিস নোব্‌ল্‌ যে ভারতের, বিশেষত ভারতীয় নারীসমাজের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবেন, তা স্বামীজি বুঝেছিলেন। এবং এই কারণে তাঁকে ভারতে স্বাগত জানিয়েছেন।
বিচক্ষণতা – ভারতের জলবায়ু, সমাজকেন্দ্রিক নানা সমস্যা যে ইংল্যান্ডের থেকে আলাদা এবং নানা বাধাবিপত্তির মধ্যে মিস নোব্‌ল্‌কে কাজ করতে হবে, সে বিষয়ে তাঁকে স্বামীজি আগে থেকে সচেতন করেছেন। পরোক্ষে কর্মে ঝাঁপ দেওয়ার আগে মানসিকভাবে দৃঢ় হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
স্নেহশীলতা ও উদারতা – ভারতের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে মিস নোব্‌ল্‌ স্বামীজির সাহায্য পাবেন এবং এদেশের জন্য কাজ না করলেও বা বেদান্ত ধর্ম ত্যাগ করলেও সারাজীবন তিনি নোব্‌লের পাশে থাকবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
নারীজাতির প্রতি সম্মান – নপীড়িত ভারতীয় নারীদের শিক্ষা ও উন্নতির চিন্তা, মিস মুলারকে ‘চমৎকার মহিলা’ বলা এবং মিসেস সেভিয়ারকে ‘নারীকুলের রত্নবিশেষ’ বলে অভিহিত করার মধ্যে নারীজাতির প্রতি স্বামীজির সম্মানবোধ প্রকাশ পায়।
সমাজচেতনা ও স্বদেশপ্রীতি – প্রখরভাবে সমাজসচেতন স্বামীজি এদেশের সামাজিক ব্যাধিগুলি সম্পর্কে বিচলিত হয়েছেন। ইংরেজ কুশাসনের পাশাপাশি দুঃখদারিদ্র্য, কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদি থেকে তিনি ভারতবাসীকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন।

পাঠ্য চিঠি প্রবন্ধ অবলম্বনে স্বামী বিবেকানন্দের বিচক্ষণতা ও উদারতার পরিচয় দাও।

মিস নোব্‌ল্‌কে সতর্ক করে দেওয়া মিস্টার স্টার্ডির চিঠি প্রবন্ধ থেকে স্বামী বিবেকানন্দ যখন জেনেছেন মিস নোব্‌ল্‌ ভারতে আসতে এবং এদেশের জন্য কাজ করতে দৃঢ়সংকল্প তখন তিনি তাঁকে প্রয়োজনীয় কতকগুলো তথ্য ও উপদেশ দিয়েছেন। ইউরোপ বা আমেরিকার পরিবেশের তুলনায় ভারতের সামাজিক ও ভৌগোলিক পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা তাই সরাসরি মিস নোব্‌ল্‌কে চিঠি প্রবন্ধটি লিখে স্বামীজি তাঁকে এদেশের মানুষের জীবনযাত্রা, সামাজিক সমস্যা, বাধাবিঘ্ন আর জলবায়ু সম্পর্কে সচেতন করেছেন এবং ‘নিজের পায়ে দাঁড়াবার পরামর্শ দিয়েছেন। এতে স্বামীজির বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়।
উদারতা ও সহমর্মিতা – অন্যদিকে, স্বামীজির উদারতা প্রকাশ পায় যখন তিনি মিস নোব্‌ল্‌কে লেখেন যে, মিস নোব্‌ল্‌ ভারতবর্ষের জন্য কাজ করুন বা না করুন এবং বেদান্ত ধর্ম গ্রহণ করুন বা ত্যাগ করুন, স্বামীজি তাঁকে আজীবন সাহায্য করে যাবেন। আবার, মিস মুলারের স্বভাবের কিছু ত্রুটির কথা জেনেও স্বামীজি তাঁর সহৃদয়তার প্রশংসা করেছেন। মিসেস সেভিয়ারকে ‘নারীকুলের রত্নবিশেষ’, ‘ভালো’, ‘স্নেহময়ী’ বলে উল্লেখ করে তাঁর সঙ্গে কাজ করার জন্য তিনি নোব্‌ল্‌কে পরামর্শ দিয়েছেন। দীর্ঘ যাত্রাপথের একঘেয়েমি দূর করার জন্য স্বামীজি মিস ম্যাকলাউড ও মিসেস বুলের সহযাত্রী হয়ে নোব্‌ল্‌কে ভারতে আসার পরামর্শ দিয়েছেন। এসব ভাবনা ও সুপরামর্শের মধ্য দিয়ে স্বামীজির উদারতার পরিচয়টি স্পষ্ট হয়েছে।

পাঠ্য চিঠি প্রবন্ধটি স্বামী বিবেকানন্দ কত সাল – তারিখে কোথা থেকে কার উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন? এই চিঠি প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিত কী ছিল?

উদ্দিষ্ট স্থান ও ব্যক্তি – পাঠ্য ‘চিঠি’প্রবন্ধটি স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই ভারতবর্ষের আলমোড়া থেকে মিস নোব্‌লের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন।
চিঠির প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিত – মিস মার্গারেট এলিজাবেথ নোব্‌ল্‌ ছিলেন স্বামীজির শিষ্যাদের মধ্যে অগ্রগণ্যা। স্বামীজির অনুপ্রেরণায় তিনি ভারতে এসেছিলেন এবং এদেশের মানুষের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ভারতের নারীসমাজের কল্যাণে, স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে, স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে লন্ডনে স্বামীজির বক্তৃতা শুনে অনুপ্রাণিত হন মিস নোব্‌ল্‌। এরপর স্বামীজির অন্যান্য বক্তৃতা শুনে, তাঁর কর্মধারা ও স্বদেশের নারীদের কল্যাণের সংকল্পের কথা জেনে মিস নোব্‌ল্‌ ভারতে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই স্বামীজি তাঁকে জানান,

ভারতের জন্য, বিশেষত ভারতের নারীসমাজের জন্য, পুরুষের চেয়ে নারীর — একজন প্রকৃত সিংহীর প্রয়োজন।

মিস নোব্‌লের শিক্ষা, ঐকান্তিকতা, পবিত্রতা, ভালোবাসা, দৃঢ়তা ইত্যাদি গুণের কারণে তিনিই সেই নারী হতে পারেন। কিন্তু ভারতের জলবায়ু, জীবনযাত্রা তাঁর পক্ষে অনুকূল নয়। মানবসেবার কাজেও বাধাবিপত্তি আছে প্রচুর। এসব সত্ত্বেও মিস নোব্‌ল্‌ যদি ভারতে আসতে চান তবে স্বামীজি তাঁকে শতবার স্বাগত’ জানিয়ে আলোচ্য ‘চিঠি’ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন।

স্বামী বিবেকানন্দ লিখিত পাঠ্য চিঠি প্রবন্ধর বিষয়বস্তু আলোচনা করো।

বিষয়বস্তু – লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে মিস নোব্‌লের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। স্বামীজির বক্তৃতায় তিনি অনুপ্রাণিত হন। পরবর্তীকালে ইংরেজ ভক্ত মি. স্টার্ডির চিঠি প্রবন্ধ থেকে স্বামীজি জেনেছেন যে, মিস নোব্‌ল্‌‘ভারতে এসে সবকিছু চাক্ষুষ দেখতে দৃঢ়সংকল্প’। মিস মুলারের কাছ থেকে স্বামীজি নোব্‌লের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে জেনেছেন। কিন্তু ভারতের সামগ্রিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি ইউরোপ-আমেরিকার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ, ইংরেজ প্রভুর দাসত্ব আর প্রবল দারিদ্র্য প্রভৃতি এখানকার মানুষদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। এদেশের আবহাওয়াও উষ্ণপ্রধান। এসব জেনেও যদি মিস নোব্‌ল্‌ ভারতের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে চান, তাহলে সেখানে তার সামনে এক বিরাট ভবিষ্যৎ রয়েছে। বিশেষ করে ভারতীয় নারীসমাজ তাঁর দ্বারা অসীম উপকৃত হতে পারে। তাঁর মতো শিক্ষিতা, একনিষ্ঠ পবিত্র, প্রেমময়ী, দৃঢ়চেতা এবং সুপ্রাচীন কেলটিক সভ্যতাজাত উন্নত চরিত্রের নারীকে এদেশের প্রয়োজন। এদেশে এসে স্বনির্ভর হয়ে তাঁকে কাজ করতে হবে। তাঁর পাশে স্বামীজি আমরণ থাকবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এইসব, তথ্য ও মতামত জানিয়ে মিস নোব্‌ল্‌কে স্বামীজি সরাসরি চিঠি প্রবন্ধটি লিখেছেন।
এ ছাড়া কয়েকজন ইউরোপীয় ব্যক্তির চরিত্র বিশ্লেষণ ও কর্মপদ্ধতি এই চিঠি প্রবন্ধটিতে আলোচনা করেছেন লেখক। তারপর তিনি মিস নোব্‌ল্‌ এদেশে এলে তাঁর কী কাজ হবে সে বিষয়েও নির্দেশ দিয়েছেন।

কল্যাণীয়া মিস নোব্‌ল্‌ – এই সম্বোধন থেকে শুরু করে আমাকে আমরণ তোমার পাশেই পাবে – এরূপ আশ্বাসে মিস নোব্‌লের প্রতি স্বামীজির যে স্নেহশীলতা প্রকাশ পেয়েছে তা সংক্ষেপে লেখো।

স্নেহশীলতার প্রকাশ – মিস নোব্‌ল্‌ ভারতে আসার প্রায় মাস ছয়েক আগে স্বামীজি মি. স্টার্ডির চিঠি প্রবন্ধতে জেনেছিলেন নোব্‌ল্‌ এদেশে আসতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তখন তিনি এই তরুণীকে লিখলেন, তোমাকে খোলাখুলি বলছি, এখন আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে, ভারতের কাজে তোমার এক বিরাট ভবিষ্যৎ রয়েছে। ভারতের জলবায়ু আর কাজের পরিবেশের সঙ্গে বিদেশিনি নোব্‌ল্‌ মানিয়ে নিতে পারবেন কি না – এই চিন্তা ছিল স্বামীজির। তাই তিনি তাঁর চিঠি প্রবন্ধটিতে মিস মার্গারেট নোব্‌ল্‌কে এখানকার বাধাবিঘ্নময় পরিবেশ এবং সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে আগে থেকে সচেতন করে দিয়েছেন। এখানে এসে কারও ছত্রছায়ায় না থেকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন নোব্‌ল্‌কে আর বলেছেন কাজে নামার আগে ভালো করে ভেবে নিতে। স্বামীজি জানিয়েছেন, এদেশে তাঁর যতটুকু প্রভাব আছে তা দিয়ে তিনি নোবলের কাজে যথাসাধ্য সাহায্য করবেন। এদেশে কাজ করতে করতে যদি মিস নোব্‌লের বিরক্তি আসে, যদি তিনি কাজে বিফল হন এবং ভারতের জন্য আর কাজ না করতে চান, বেদান্ত ধর্ম ত্যাগও করেন তবুও তাঁর প্রতি স্বামীজির দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে না বলে স্বামীজি জানান। — আমার দিক থেকে নিশ্চয় জেনো যে, আমাকে আমরণ তোমার পাশেই পাবে। আশ্বাসে বিশ্বাসে ভরসায় নির্ভরতায় এভাবেই মিস নোব্‌লের প্রতি স্বামীজির অকৃত্রিম স্নেহ প্রকাশ পেয়েছে সমগ্র চিঠি প্রবন্ধটিতে।

স্বামী বিবেকানন্দের লেখা চিঠি প্রবন্ধটি থেকে মিস ম্যাকলাউড এবং মিস মুলার সম্পর্কে যা জানা যায় লেখো।

মিস ম্যাকলাউড – ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই আলমোড়া থেকে স্বামী বিবেকানন্দ মিস নোব্‌ল্‌কে যে চিঠি প্রবন্ধটি লিখেছিলেন তাতে মিস ম্যাকলাউড এবং মিস মুলারের প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। মিস জোসেফাইন ম্যাকলাউড ছিলেন স্বামীজির ইউরোপীয় ভক্তদের মধ্যে অন্যতমা। আমেরিকার সংবাদে স্বামীজি জেনেছেন, মিস ম্যাকলাউড ও মিসেস বুল সে বছর শরৎকালেই ভারত পরিভ্রমণে আসছেন। ‘পারি ফ্যাশনের’ অর্থাৎ প্যারিসের ফ্যাশন অনুযায়ী তৈরি পোশাকে ম্যাকলাউডকে লন্ডনে মিস নোব্‌ল্‌ দেখেছেন। সেই ম্যাকলাউডদের সঙ্গেই মিস নোব্‌ল্‌কে ভারতে আসার পরামর্শ দিয়েছেন স্বামীজি।
মিস মুলার – মিস মুলার এমনিতে চমৎকার মহিলা, কিন্তু তাঁর ধারণা তিনি আজন্ম নেত্রী এবং দুনিয়াটা বদলে দিতে টাকা ছাড়া আর কিছুর প্রয়োজন নেই। তাঁর নিজের, নোব্‌লের এবং আমেরিকা-ইউরোপ থেকে আগত বন্ধুদের জন্য তিনি কলকাতায় একটা বাড়ি ভাড়া নিতে চান। এদিক থেকে তাকে সহৃদয় ও অমায়িক বলা যায়। অন্যদিকে, মানসিকভাবে তিনি খুব অস্থির এবং তাঁর মেজাজ অত্যন্ত রুক্ষ। তাঁর সঙ্গে দূর থেকে বন্ধুত্ব করাই ভালো বলে মনে করেছেন স্বামীজি। ভারতে এসে তাঁর সঙ্গে মিস নোব্‌ল্‌ মানিয়ে চলতে পারবেন না। তাই স্বামীজির পরামর্শ মিস মুলার বা অন্য কারও আশ্রয়ে না থেকে মিস নোব্‌ল্‌ যেন কার্যক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হন।

পাঠ্য চিঠি প্রবন্ধ থেকে মিসেস সেভিয়ার ও মিসেস বুল সম্পর্কে কী জানা যায়?

মিসেস সেভিয়ার পাঠ্য চিঠি প্রবন্ধর-তে স্বামী বিবেকানন্দ মিসেস সেভিয়ারকে ‘নারীকুলের রত্নবিশেষ’ বলেছেন। ‘এত ভালো, এত স্নেহময়ী তিনি’ কথাগুলির মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতি স্বামীজির অত্যন্ত উচ্চ ধারণাই প্রকাশ পায়। এই স্নেহশীলা নারী এবং তাঁর স্বামী ইংরেজ হওয়া সত্ত্বেও অন্য ইংরেজদের মতো ভারতীয়দের ঘৃণা করেন না। তাঁরা এদেশে এসেছেন মানুষের সেবার মনোভাব নিয়ে, কর্তৃত্ব ফলানোর কোনো ইচ্ছা বা মানসিকতা তাঁদের নেই। মিসেস সেভিয়ার বেদান্ত ধর্ম প্রচারের কাজে নিবেদিত ছিলেন আজীবন। আলোচ্য ‘চিঠি’ প্রবন্ধ রচনার সময়ে এদেশে কাজের বিষয়ে মিসেস সেভিয়ারের কোনো নির্দিষ্ট কার্যপ্রণালী গড়ে ওঠেনি। তাই মিস নোব্‌ল্‌ ভারতের কাজে তাঁকে সহকর্মীরূপে পেলে উভয়েরই সুবিধা হবে বলে স্বামীজি জানিয়েছেন।
মিসেস বুল – মিসেস সারা বুলও ছিলেন স্বামীজির অন্যতমা শিষ্যা। স্বামীজি তাঁকে কোনো কোনো চিঠি প্রবন্ধতে ‘মা’বা ‘ধীরামাতা’ বলে সম্বোধন করেছেন। ইনিও অত্যন্ত স্নেহশীলা রমণী। স্বামীজি যখন আমেরিকায় ছিলেন তখন তিনি বস্টনের বাসিন্দা মিসেস বুলের কাছ থেকে বিশেষ উপকার পেয়েছিলেন। স্বামীজি খবর পেয়েছিলেন, মিস ম্যাকলাউডের সঙ্গে মিসেস বুল শরৎকালে ইউরোপ হয়ে ভারতে আসছেন। দীর্ঘপথের একঘেয়েমি দূর করতে স্বামীজি মিস নোব্‌ল্‌কে মিসেস বুল এবং মিস ম্যাকলাউডের সঙ্গে এদেশে আসার পরামর্শ দিয়েছেন।

নবম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যপুস্তকের চিঠি প্রবন্ধ অধ্যায়ে স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ছয়টি চিঠি প্রবন্ধের সামগ্রিক বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর আলোচনা করা হয়েছে। এই প্রশ্নোত্তরগুলি শিক্ষার্থীদের স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাভাবনা ও দর্শন সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা প্রদান করে।

চিঠিগুলির মধ্যে পাওয়া যায় স্বামী বিবেকানন্দের হিন্দু ধর্ম ও বেদান্ত দর্শনের প্রতি গভীর আস্থা। তিনি হিন্দু ধর্মকে সমগ্র মানবতার ধর্ম বলে মনে করতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে হিন্দু ধর্মের শিক্ষাগুলি সমস্ত মানুষের জন্য প্রযোজ্য। তিনি বেদান্ত দর্শনের মাধ্যমে মানুষের আধ্যাত্মিক মুক্তির পথ নির্দেশ করেছিলেন।

স্বামী বিবেকানন্দের চিঠিগুলিতে মানবতাবাদী চেতনারও প্রকাশ পায়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সকল মানুষ সমান এবং সকলেরই উন্নত হওয়ার অধিকার রয়েছে। তিনি সকল জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

স্বামী বিবেকানন্দের চিঠিগুলি আজও প্রাসঙ্গিক। তাঁর চিন্তাভাবনা ও দর্শন আমাদেরকে আমাদের জীবনে সত্য, ন্যায় ও ধার্মিকতার পথে চলতে অনুপ্রাণিত করে।

উপসংহার

নবম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যপুস্তকের চিঠি প্রবন্ধ অধ্যায়ের সামগ্রিক বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তরগুলি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এই প্রশ্নোত্তরগুলি শিক্ষার্থীদের স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাভাবনা ও দর্শন সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা প্রদান করে এবং তাদেরকে একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করে।

Share via:

মন্তব্য করুন