নবম শ্রেণি – বাংলা – চিঠি – (প্রবন্ধ) স্বামী বিবেকানন্দ

চিঠি প্রবন্ধটি স্বামী বিবেকানন্দের লেখা একটি অসামান্য রচনা। এই রচনায় তিনি চিঠির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, চিঠি হল মানুষের মনের ভাব প্রকাশের একটি মাধ্যম। চিঠির মাধ্যমে আমরা আমাদের আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, স্নেহ, বন্ধুত্ব, সহানুভূতি ইত্যাদি প্রকাশ করতে পারি। চিঠির মাধ্যমে আমরা দূরবর্তী প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারি। চিঠি আমাদের মনকে প্রশান্ত করে এবং আমাদের জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে।

নবম শ্রেণি – বাংলা – চিঠি

লেখক পরিচিতি

ভূমিকা – স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন ভারতে হিন্দু নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ এবং ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে জাতীয়তাবাদী ধারণার অন্যতম প্রবক্তা। পাশ্চাত্য জগতে ভারতের সনাতন বেদান্ত ও যোগ দর্শনকে পরিচিত করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অন্যতম ভূমিকা রয়েছে।
জন্ম ও শৈশব – ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি কলকাতার সিমলা পল্লির দত্ত পরিবারে স্বামী বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বিশ্বনাথ দত্ত, মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। শৈশবে বিবেকানন্দ বীরেশ্বর বা বিলে নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর পোশাকি নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ, সন্ন্যাস গ্রহণের পর তাঁর নাম হয় স্বামী বিবেকানন্দ।
ছাত্রজীবন – কলকাতার মেট্রোপলিটন স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হন। পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ ছেড়ে দিয়ে ভরতি হন জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইন্সটিটিউশনে (বর্তমানে স্কটিশচার্চ কলেজ)। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিএ পাস করেন। তিনি আইন পড়তেও শুরু করেছিলেন, কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর আর্থিক অনটন দেখা দেওয়ায় তাঁর আইন পড়া বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রজীবনে তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি সংগীত ও ব্যায়ামেও যথেষ্ট পারদর্শিতা অর্জন করেন।
আধ্যাত্মিকতা ও কর্মজীবন – স্বামী বিবেকানন্দ যখন এফএ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন, তখন শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের ব্যক্তিত্ব তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর গুরুভাইদের সহযোগিতায় তিনি বরানগরে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ স্থাপন করেন। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরিব্রাজকরূপে ভারত ভ্রমণে বের হন। এই সময় তিনি একদিকে যেমন ভারতবর্ষ ও ভারতবাসীদের প্রত্যক্ষভাবে জানার চেষ্টা করেন, অন্যদিকে তেমনই নানান শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে শিকাগো ধর্মমহাসভায় হিন্দুধর্ম বিষয়ে বক্তৃতা দিয়ে তিনি বিদেশিদের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। তিনি বেশ কিছুকাল আমেরিকা ও ইউরোপে অবস্থান করে বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা ও আলোচনার মাধ্যমে ভারতীয় জীবনদর্শন ও চিন্তাধারা সম্পর্কে বিদেশের মানুষের ভুল ধারণা দূর করতে সচেষ্ট হন।
ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দেওয়ার সময় মিস মার্গারেট এলিজাবেথ নোব্‌লের সঙ্গে স্বামীজির পরিচয় হয়। স্বামীজির ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি সংকল্প করেন ভারতবর্ষের মানুষের জন্য কাজ করবেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে স্বামীজি নিজের দেশে ফিরে আসেন। সে বছর তিনি রামকৃষ্ণ মিশন এবং ১৮৯৯-এ বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি মিস নোব্‌ল্‌ এলেন কলকাতায়। এই শিষ্যাকে স্বামীজি নিজে গিয়ে স্বাগত জানালেন। ইনিই পরবর্তীকালে ভগিনী নিবেদিতা নামে পরিচিত হন।
সমাজসেবা – স্বামী বিবেকানন্দ সমাজসেবার যে আদর্শ স্থাপন করেছিলেন তার তুলনা মেলা ভার। তাঁর রচনা ও বক্তৃতায় দেশের যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে সমাজসেবার অনুপ্রেরণা সঞ্চারিত হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।
সাহিত্যকর্ম – স্বামী বিবেকানন্দ বাংলা ও ইংরেজিতে বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল — ভাববার কথা, পরিব্রাজক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, বর্তমান ভারত, Karmayoga, Rajayoga, Jnanayoga, Bhaktiyoga প্রভৃতি। বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে।
জীবনাবসান – ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই মাত্র ৩৯ বছর বয়সে স্বামী বিবেকানন্দ শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর জন্মদিবসটি সারা ভারতে যুব দিবস হিসেবে পালিত হয়।

উৎস

পাঠ্য চিঠি প্রবন্ধটি স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে (তৃতীয় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৭৩) আছে। এই গ্রন্থের এটি ৩৬০তম চিঠি।
উদ্‌বোধন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত পত্রাবলী- স্বামী বিবেকানন্দ গ্রন্থের ৫৮৫ পৃষ্ঠায় পাঠ্য চিঠি প্রবন্ধটি স্বামীজি ইংরেজি ভাষায় লিখেছিলেন। তাঁর ইংরেজি চিঠিগুলির আবিষ্কারক মেরি লুই বার্ক। কমপ্লিট ওয়ার্কস অব স্বামী বিবেকানন্দ বইয়ের অষ্টম খণ্ডে মূল ইংরেজি চিঠিটি পাওয়া যায়।

বিষয়সংক্ষেপ

১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই ভারতের আলমোড়া থেকে মিস মার্গারেট নোব্‌ল্‌কে লেখা চিঠিতে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁকে ভারতবর্ষে গঠনমূলক কাজ করতে আসার জন্য স্বাগত জানান। এর পাশাপাশি ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক ও সামাজিক প্রতিকূলতা, শ্বেতাঙ্গদের প্রতি ভারতীয়দের মনোভাব, ভারতীয়দের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের মনোভাব কেমন তাও তিনি জানিয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে এদেশে কাজ করতে আসার পর মিস নোব্‌লের কর্মপ্রণালী কেমন হবে সে বিষয়েও চিঠিতে আলোকপাত করেছেন স্বামীজি।
স্টার্ডি সাহেবের চিঠি পড়ে স্বামীজি জেনেছেন মিস নোব্‌ল্‌ ভারতে আসতে এবং ভারতবর্ষের পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখতে দৃঢ়সংকল্প। এ ছাড়াও স্বামীজি মিস মুলারের কাছে নোব্‌লের সম্পর্কে যা শুনেছেন, তাতে তাঁর মনে হয়েছে সমগ্র বিষয়টি নিয়ে সরাসরি মিস নোব্‌ল্‌কে চিঠি লেখাই শ্রেয়।
স্বামীজির দৃঢ়বিশ্বাস ভারতের কাজে মিস নোব্‌লের এক বিরাট ভবিষ্যৎ রয়েছে। ভারতবর্ষের নারীসমাজের উন্নতির জন্য যেরূপ নারীর প্রয়োজন, মিস নোব্‌লের উপস্থিতি সেই প্রয়োজন মেটাবে বলে তিনি আশা করেন। মিস নোব্‌লের শিক্ষা, তাঁর ঐকান্তিকতা, পবিত্র মনোভাব, অসীম ভালোবাসা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং সর্বোপরি তাঁর ধমনিতে বয়ে যাওয়া কেলটিক রক্তের জন্য তাঁকেই বিশেষ প্রয়োজন বলে স্বামীজি মনে করেন।
এদেশে কাজের জন্য মিস নোব্‌ল্‌ এসে পৌঁছোনোর আগেই স্বামীজি তাঁকে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি জানিয়েছেন। স্বামীজি তাঁকে এ কথাও জানিয়েছেন যে তিনি ভারতবর্ষে নিজের প্রভাব অনুযায়ী সবরকমভাবে নোব্‌ল্‌কে সাহায্য করবেন। কাজ শুরু করার আগে তিনি সে বিষয়ে মিস নোব্‌ল্‌কে গভীরভাবে চিন্তা করার কথা জানিয়েছেন। একইসাথে স্বামীজি মিস নোব্‌ল্‌কে লিখেছেন যদি মিস নোব্‌ল্‌ তাঁর কাজে ব্যর্থ হন কিংবা কাজে কখনও তাঁর বিরক্তি আসে, তাহলেও তিনি সবসময় স্বামীজিকে তাঁর পাশেই পাবেন।
প্রসঙ্গত স্বামীজি নোব্‌ল্‌কে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অর্থাৎ স্বাবলম্বী হওয়ার কথা জানিয়েছেন। এদেশে এসে যেন মিস নোব্‌ল্‌ কখনোই মিস মুলার কিংবা অন্য কারও আশ্রয় গ্রহণ না করেন—সে বিষয়ে তাঁকে সতর্কও করেছেন স্বামীজি। মিস মুলারের মনোভাবের সমালোচনা করে স্বামীজি জানিয়েছেন দুর্ভাগ্যক্রমে এই ধারণা ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মাথায় ঢুকেছে যে, তিনি আজন্ম নেত্রী আর দুনিয়াকে ওলটপালট করে দিতে টাকা ছাড়া অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। এই মনোভাবের কারণেই তাঁর সঙ্গে মানিয়ে চলা অসম্ভব বলে স্বামীজি মনে করেন।
এরপর চিঠি প্রবন্ধতে উঠে এসেছে সেভিয়ার দম্পতির কথা। ভারতবর্ষে এসে নারীকুলের রত্ন, স্নেহময়ী মিসেস সেভিয়ার এবং মিস্টার সেভিয়ার ভারতীয়দের ঘৃণা না করে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু তাঁরা এখনও তাঁদের কাজের পদ্ধতি স্থির করতে পারেননি। মিস নোব্‌ল্‌ ভারতে এসে তাঁর কাজে এঁদের পাশে পেতে পারেন বলে স্বামীজি জানিয়েছেন। আমেরিকার সংবাদে স্বামীজি জেনেছেন যে তাঁর দুজন বন্ধু মিস ম্যাকলাউড এবং বস্টনের মিসেস বুল আসন্ন শরৎকালে ভারত পরিভ্রমণে আসবেন। যেহেতু তাঁরা ইউরোপ হয়েই ভারতবর্ষে আসবেন। সেহেতু স্বামীজি মিস নোব্‌ল্‌কে তাঁদের সঙ্গী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এতে তাঁর দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার ক্লান্তি দূর হতে পারে। শেষে স্বামীজি আবার মিস্টার স্টার্ডির চিঠির কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, তাঁর চিঠিটি অত্যন্ত শুষ্ক এবং প্রাণহীন। লন্ডনের কাজ ব্যর্থ হওয়ায় মিস্টার স্টাডি যে যথেষ্ট হতাশ, চিঠিটি পড়ে তা বুঝতে স্বামীজির অসুবিধা হয়নি। এরপর মিস নোব্‌ল্‌কে অনন্ত ভালোবাসা জানিয়ে স্বামীজি তাঁর চিঠি শেষ করেছেন।

নামকরণ

মিস মার্গারেট নোব্‌ল্‌ ভারতবর্ষে সমাজসেবামূলক এবং গঠনমূলক কাজ করতে আসবেন, এ কথা জেনে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি নোব্‌ল্‌কে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন পরামর্শ ও নির্দেশনা দেন। এদেশে তাঁর কাজের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা, আবহাওয়ার বিরূপতা, সুখস্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ইত্যাদি যে বাধা হয়ে উঠতে পারে বিবেকানন্দ সে বিষয়ে মিস নোব্‌ল্‌কে সচেতন করেন। এদেশের মানুষের দুঃখ, কুসংস্কার, দাসত্ব ইত্যাদিও যে তাঁর কাজকে কঠিন করে তুলতে পারে সে-কথাও তিনি মিস নোব্‌লকে জানিয়ে রাখেন। তবে তিনি নিজে যে আমৃত্যু তাঁর পাশে থাকবেন সে- কথা জানাতেও বিবেকানন্দ দ্বিধা করেননি। ভারতে কাজের ক্ষেত্রে মিস নোব্‌লের যে নিজের মতো করে পরিকল্পনা করা এবং কারও দ্বারা প্রভাবিত না হওয়া উচিত সে-কথা জানিয়েও বিবেকানন্দ তাঁকে সাবধান করে দিয়েছেন। এদেশের সঙ্গে সংযোগ তৈরি হওয়া বিভিন্ন ইউরোপীয় নারীদের সম্পর্কে বিবেকানন্দ নিজের অভিমত প্রকাশ করেন। ভারতের মতো দেশে, বিশেষত নারীদের উন্নতির জন্য মিস মার্গারেট নোব্‌লের মতো মানুষের যে বিশেষ প্রয়োজন সে-কথা তাঁর চিঠি থেকে জানা যায়। তাঁর শিক্ষা, ঐকান্তিকতা, পবিত্রতা, ভালোবাসা, দৃঢ়তা ইত্যাদি তাঁকে যেভাবে গড়ে তুলেছে, ঠিক সেরকম নারী-ই যে ভারতের দরকার তাও বিবেকানন্দ স্পষ্ট করে বলেছেন। এইভাবে মিস নোব্‌লকে লেখা চিঠির মধ্য দিয়ে গোটা রচনাটিতে স্বামীজি নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাই আঙ্গিকের দিক থেকে রচনাটির চিঠি নামকরণ যথাযথ হয়েছে বলা যায়।

চিঠি হল মানুষের মনের ভাব প্রকাশের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। চিঠি আমাদের জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। তাই আমাদের সকলের উচিত চিঠির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং চিঠি লেখা ও পাঠানোর অভ্যাস গড়ে তোলা।

Share via:

মন্তব্য করুন