নবম শ্রেণি – বাংলা – ব্যোমযাত্রীর ডায়রি – বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

সত্যজিৎ রায়ের লেখা ব্যোমযাত্রীর ডায়রি একটি অসাধারণ বিজ্ঞান কল্পকাহিনী। এই গল্পে একজন বাঙালি বিজ্ঞানীর মঙ্গল অভিযানের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। গল্পের মূল চরিত্র প্রফেসর আচার্য, যিনি একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী। তিনি মঙ্গল অভিযানের জন্য একটি মহাকাশযান তৈরি করেন। এই মহাকাশযানে প্রফেসর আচার্য ছাড়াও আরও তিনজন বিজ্ঞানী ছিলেন। তারা হলেন ডাঃ মৃণাল, ডাঃ সেন এবং ডাঃ রায়।

Table of Contents

গল্পটিতে মঙ্গল অভিযানের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে পৌঁছানোর পর সেখানে তারা বিভিন্ন অদ্ভুত ঘটনা দেখেন। তারা মঙ্গলের আকাশ, মাটি, গাছপালা, প্রাণী ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারেন। গল্পের শেষে বিজ্ঞানীরা মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসেন।

 বাংলা – ব্যোমযাত্রীর ডায়রি – বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

লেখকের হাতে শঙ্কুর ডায়রিটি কীভাবে এসেছিল উল্লেখ করো।

অথবা, তারক চাটুজ্যের কাছ থেকে প্রোফেসর শঙ্কুর ডায়রি প্রাপ্তির কাহিনি নিজের ভাষায় লেখো।

ডায়রি প্রাপ্তি – প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর ডায়রিটি লেখক পেয়েছিলেন জনৈক তারক চাটুজ্যের কাছ থেকে। একদিন দুপুরে অফিসে বসে তিনি যখন পুজো সংখ্যার জন্য একটা লেখার প্রুফ দেখছেন, সে সময় তারক চাটুজ্যে সেখানে আসেন এবং একটা লাল খাতা সামনে রাখেন। তাঁর কথায় সেটি ছিল — গোল্ড মাইন। এটিই শঙ্কুর ডায়রি। এর আগে এই মানুষটি কিছু গল্প ইত্যাদি এনেছেন। যতটা লেখার উৎকর্ষের জন, তার থেকেও তাঁর দারিদ্র্যের কথা ভেবে লেখক তাঁকে পাঁচ-দশ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু প্রোফেসর শঙ্কু, যিনি পনেরো বছর নিরুদ্দেশ, তাঁর ডায়রি কীভাবে তারক চাটুজ্যের কাছে গেল তা ভেবে লেখক বিস্মিত হয়ে যান। তারক চাটুজ্যে লেখককে জানান যে মাথারিয়া অঞ্চলে উল্কাপাতের খবর শুনে বাঘাছাল সংগ্রহের লোভে তিনি সেখানে যান। উল্কাপাতের জায়গায় গর্তের মধ্যে বাঘ-হরিণ কিছু না পেলেও কিছু গোসাপের ছালের সঙ্গে শঙ্কুর ডায়রিটি সেখানে পান। ডায়রিটি তিনি হাতছাড়া করতেন না এ কথা জানিয়ে বলেন যে, অর্থাভাবেই তিনি এটি দিতে এসেছেন। সব কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে না হলেও লেখক কুড়ি টাকা দিয়ে তারক চাটুজ্যের কাছ থেকে ডায়রিটি সংগ্রহ করেন।

আজ দিনের শুরুতেই একটা বিশ্রী কাণ্ড ঘটে গেল। – দিনটা কত তারিখ ছিল? বিশ্রী কাণ্ডটা কী ঘটেছিল?

উদ্দিষ্ট তারিখ – সত্যজিৎ রায় রচিত কল্পবিজ্ঞান কাহিনি ব্যোমযাত্রীর ডায়রি থেকে নেওয়া উদ্ধৃতিতে আজ বলতে ১ জানুয়ারির কথা বলা হয়েছে।
বিশ্রী কাণ্ডের বর্ণনা – নদীর তীরে রোজকার সকালের বেড়ানো শেষ করে শোয়ার ঘরে ঢুকেই প্রোফেসর শঙ্কুকে এক বিদঘুটে চেহারার লোকের মুখোমুখি হতে হয়। চমকে উঠে চিৎকার করতেই তিনি বুঝতে পারেন যে সামনের আয়নাতে তাঁরই প্রতিবিম্ব দেখেছেন তিনি। গবেষণার কাজে সবসময় মগ্ন থাকা এই বিজ্ঞানীর নিজের চেহারা নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না, তাই তাঁর আয়নারও প্রয়োজন হত না। সেই কারণেই ক্যালেন্ডার দিয়ে আয়নাটা ঢাকা ছিল। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে চমকে ওঠার মতো ঘটনাটা নির্ভীক এই বিজ্ঞানীর কাছে একটা বিশ্রী ঘটনা বলেই মনে হয়েছিল। তিনি বুঝতে পারেন যে ভৃত্য প্রহ্লাদ পুরোনো বছরের ক্যালেন্ডারটা সরিয়ে নেওয়ার জন্যই এই বিপত্তি ঘটেছে। সাতাশ বছর ধরে প্রোফেসর শঙ্কুর সঙ্গে থেকেও তাঁর স্বভাব এবং ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে প্রহ্লাদ চেনেনি বলে তার ওপর ভয়ংকর রেগে যান শঙ্কু। তাই তাঁর নস্যাস্ত্র প্রহ্লাদের ওপর প্রয়োগ করে তাকে তেত্রিশ ঘণ্টা ধরে হাঁচতে বাধ্য করেন তিনি। দীর্ঘদিন প্রহ্লাদের সঙ্গে থাকার সূত্রে তার ওপর একটা ভালোবাসার টানও তৈরি হয়েছিল শঙ্কুর। তাই তাকে লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কুর মনে কিছু অনুতাপও হয়তো হয়েছিল। সব মিলিয়ে পুরো ঘটনাটা শঙ্কুর কাছে একটা বিশ্রী ও অবাঞ্ছিত ঘটনা বলে মনে হয়েছিল।

এখন মনে হচ্ছে যে প্রথমবারের কেলেঙ্কারিটার জন্য একমাত্র প্রহ্লাদই দায়ী। — প্রহ্লাদ কে? এই কেলেঙ্কারির জন্য সে কীভাবে দায়ী ছিল?

প্রহ্লাদের পরিচয় – সত্যজিৎ রায় রচিত কল্পবিজ্ঞান কাহিনি ব্যোমযাত্রীর ডায়রির প্রধান চরিত্র বিজ্ঞানী প্রোফেসর শঙ্কুর সাতাশ বছরের ভৃত্য হল প্রহ্লাদ।
প্রহ্লাদের দায়িত্ব – প্রথমবার রকেটযাত্রার সময় ঘড়িতে দম দিতে গিয়ে প্রহ্লাদ ভুল করে ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে ফেলেছিল। এর ফলে মহাকাশযাত্রার সমস্ত ব্যবস্থাটি সাড়ে তিন ঘণ্টা পিছিয়ে পড়ে, হিসাবের গোলমাল হয়ে যায়। তাই রকেট কিছুটা উঠেই গোঁৎ খেয়ে পড়ে যায় অবিনাশবাবুর মুলোর খেতে। প্রোফেসর শঙ্কুর প্রতিবেশী এই অবিনাশবাবু ছিলেন অত্যন্ত বিষয়ী মানুষ। বিজ্ঞান না বোঝার কারণে এবং শঙ্কুর প্রতি তাঁর প্রতিবেশীসুলভ সহানুভূতি না থাকার জন্য তিনি সময়ে- অসময়ে শঙ্কুকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে ছাড়তেন না। তাই এই বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর মনে আক্ষেপ জন্মানো তো দূরের কথা, উলটে ক্ষতিপূরণবাবদ তিনি শঙ্কুর কাছ থেকে পাঁচশো টাকা দাবি করে বসেন। এই দাবিকে প্রোফেসর শঙ্কুর দিনে ডাকাতি বলে মনে হয়। কিন্তু পুরো ব্যাপারটার সূচনা যেহেতু প্রহ্লাদের মাধ্যমেই ঘটেছিল, তাই ঘটনাটিকে কেলেঙ্কারি আখ্যা দিয়ে তার জন্যও প্রহ্লাদকেই দায়ী করেছেন শঙ্কু।

প্রহ্লাদকে কেন প্রোফেসর শঙ্কু তাঁর রকেটযাত্রার সঙ্গী করেছিলেন?

প্রহ্লাদকে সঙ্গী করার কারণ – সত্যজিৎ রায় রচিত ব্যোমযাত্রীর ডায়রি কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র বিজ্ঞানী প্রোফেসর শঙ্কুর ভৃত্য প্রহ্লাদ ছিল বেশ বোকা। তবে বোকা হলেও তার সাহসের অভাব ছিল না। প্রোফেসর শঙ্কু বিশ্বাস করতেন, বুদ্ধিমানরা যে কাজ করতে ভয় পায়, বোকারা অনেকসময়ই সেইসব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। প্রোফেসর শঙ্কুর মতে, যাদের বুদ্ধি কম হয়, তাদের সাহস বেশি হয়, কারণ ভয় পাওয়ার কারণটা ভেবে বের করতেও তাদের সময় লাগে। এর প্রমাণও পেয়েছিলেন প্রোফেসর শঙ্কু। একবার কড়িকাঠ থেকে পড়ে একটা টিকটিকি প্রোফেসর শঙ্কুর বাইকর্নিল অ্যাসিডের শিশি উলটে দিয়েছিল। অ্যাসিড গড়িয়ে প্যারাডক্সাইট পাউডারের স্তূপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। দুটির সংস্পর্শে সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটবে, এটা ভেবেই হতভম্ব শঙ্কুর হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রহ্লাদ গামছা দিয়ে অ্যাসিড মুছে ফেলে। এই ঘটনা থেকে শঙ্কুর মনে হয়েছিল, কোনো দুঃসাহসিক অভিযানে শুধু বুদ্ধিমান লোকেরই প্রয়োজন হয় না, কমবুদ্ধিসম্পন্ন হলেও সাহসী মানুষেরই প্রয়োজন হয়। তা ছাড়া, প্রহ্লাদের ওজন দু-মন সাত সের হওয়ায় মহাকাশযানে তাকে ঠাঁই না দেওয়ারও কোনো কারণ ছিল না। সবমিলিয়ে শঙ্কুর মনে হয়েছিল মহাকাশ অভিযানে প্রহ্লাদকে সঙ্গী করলে ভালোই হবে।

সেই চোখ-ধাঁধানো সবুজ আলো আর বিস্ফোরণের বিকট শব্দ কোনোদিন ভলবো না। — ব্যোমযাত্রীর ডায়রি কাহিনিতে উল্লিখিত এই ঘটনাটি কী লেখো।

ঘটনার বিবরণ – সত্যজিৎ রায় রচিত কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি ব্যোমযাত্রীর ডায়রি থেকে আলোচ্য উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলযাত্রার বিবরণ – মঙ্গলযাত্রার উদ্দেশ্যে প্রোফেসর শঙ্কু যখন রকেটের পরিকল্পনা করছিলেন তখন অনেক গবেষণার পর তিনি ব্যাঙের ছাতা, সাপের খোলস, কচ্ছপের ডিমের খোলা ইত্যাদি মিশিয়ে একটা মিশ্রণ তৈরি করেছিলেন। এই মিশ্রণের সঙ্গে তিনি ট্যানট্রাম বোরোপ্যাক্সিনেট অথবা একুইয়স্ ভেলোসিলিকা মেশানোর পরিকল্পনা করছিলেন। রোবট বিধুশেখরের অদ্ভূত আচরণ – যখন তিনি ওই মিশ্রণে ট্যানট্রাম মেশাতে যাচ্ছিলেন, সেইসময় তাঁর তৈরি রোবট বিধুশেখর ধাতব শব্দ করে মাথা নাড়তে শুরু করে-খুব জোর দিয়ে বারণ করতে গেলে মানুষে যেভাবে মাথা নাড়ে ঠিক সেইরকম। বিধুশেখর তাঁর তৈরি যন্ত্র যার নিজস্ব বুদ্ধি বা চিন্তাশক্তি কিছুই থাকার কথা নয়। তাই বিধুশেখরের এই ব্যতিক্রমী আচরণ প্রোফেসর শঙ্কুকে বিচলিত করে। এরপর যখন তিনি ভেলোসিলিকাটা হাতে নিয়ে মেশাতে যাবেন তখন পুনরায় বিধুশেখর মাথা নাড়ে যা হ্যাঁ-বাচক। শেষের ঘটনা – শেষপর্যন্ত ভেলোসিলিকা মিশিয়েই ধাতুটি তৈরি হয়। কিন্তু পরে ট্যানট্রাম দিয়ে ওই পরীক্ষাটি করতে গিয়েই চোখ-ধাঁধানো সবুজ আলো আর বিকট শব্দে যে বিস্ফোরণ ঘটে তাকে কোনওদিনও ভুলবো না বলেছেন প্রোফেসর শঙ্কু।

একটা বিশেষ দিন থেকে এটা আমি অনুভব করে আসছি। সেই দিনটার কথা আজও বেশ মনে আছে। — বক্তা কে? কোন্ বিশেষ দিন থেকে তিনি কী অনুভব করে আসছেন? 

বক্তার পরিচয় – সত্যজিৎ রায় রচিত ব্যোমযাত্রীর ডায়রি শীর্ষক কল্পবিজ্ঞান কাহিনি থেকে উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে। আলোচ্য অংশের বক্তা হলেন প্রোফেসর শঙ্কু।
বক্তার অনুভব – উদ্ধৃতিটিতে উল্লিখিত বিশেষ দিনটি ছিল আশ্বিন মাসের। প্রোফেসর শঙ্কু আশ্বিন-কার্তিক মাসে তাঁর বাড়ির বাগানে রোজ রাত্রে খাওয়ার পর আরামকেদারায় শুয়ে বেশ কিছু সময় উপভোগ করতেন। এই দুই মাসে উল্কাপাত বেশি হওয়ায় এক ঘণ্টায় অন্তত আট- দশটা উল্কাপাত রোজ দেখতেন তিনি।
মঙ্গলযাত্রার দশ-বারো বছর আগে এইরকম একদিন রাত্রে হঠাৎ একটি উল্কা তাঁর দিকে ছুটে আসে এবং তাঁর বাগানের পশ্চিম দিকের গোলঞ্চ গাছের পাশে প্রকাণ্ড জোনাকির মতো জ্বলতে থাকে। এই আশ্চর্য ঘটনাটি স্বপ্নের ভেতর ঘটলেও এর জন্য তাঁর মনে দুটি বিষয়ে খটকা লাগে। এর প্রথমটি হল, এরপর থেকেই তিনি রকেট নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। আর দ্বিতীয়টি হল তাঁর সেই গোলঞ্চ গাছ, যা সেদিন থেকেই এক নতুন ধরনের ফুল দিতে শুরু করে। সেই ফুলে ছিল আঙুলের মতো পাঁচটা করে ঝোলা পাপড়ি, আর সেটা দিনের বেলায় কালো কিন্তু রাত্রে ফসফরাসের মতো জ্বলত। ফুলগুলি হাওয়ায় দোলা খেলে মনে হত হাতছানি দিয়ে কেউ ডাকছে।

মঙ্গল যে কত অমঙ্গল হতে পারে, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। — প্রোফেসর শঙ্কুর এই আক্ষেপের কারণ বুঝিয়ে দাও।

প্রোফেসর শঙ্কুর আক্ষেপের কারণ – সত্যজিৎ রায় রচিত ব্যোমযাত্রীর ডায়রি নামক কল্পবিজ্ঞানের কাহিনিতে প্রোফেসর শঙ্কুর সদলবলে মঙ্গলগ্রহে পৌঁছোনোর প্রথম দিনেই তাঁদের এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা হয়।
অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা – সূর্যের আলোয় চারিদিক ঘুরে দেখবেন বলে ভাবছিলেন প্রোফেসর শঙ্কু। এমন সময় তিনি একটা আঁশটে গন্ধ পান। পাশাপাশি তিন্তিড়ি আওয়াজের অদ্ভুত শব্দও তাঁর কানে আসে। এসময়ই তিনি দেখেন, তাঁর ভৃত্য প্রহ্লাদ বিকট চিৎকার করে নিউটনকে হাতে নিয়ে রকেটের দিকে ছুটছে। জন্তুর আক্রমণ – লম্বায় প্রায় তিন হাত, পা-ওয়ালা, হাতের বদলে মাছের মতো ডানা, বিরাট মাথা, দন্তহীন হাঁ, একটা প্রকাণ্ড সবুজ চোখ এবং সর্বাঙ্গে মাছের মতো আঁশবিশিষ্ট একটি অদ্ভুত জন্তু তাদের পিছু নিয়েছে। শঙ্কু তক্ষুনি তাঁর সবচেয়ে সাংঘাতিক অস্ত্র নিয়ে জন্তুটির পিছু নেন। প্রহ্লাদ কোনোমতে রকেটে উঠে গেলেও বিধুশেখর জন্তুটির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ইতিমধ্যে প্রায় দু- তিনশো জন্তু রকেটের দিকে এগিয়ে আসে। রকেটের সামনে প্রথম আসা জন্তুটিকে বিধুশেখর কুপোকাত করে দেয়। কিন্তু অসংখ্য জন্তুর সঙ্গে যুদ্ধের ফল মারাত্মক হবে ভেবে শঙ্কু বিধুশেখরকে অচল করে দেন। বুদ্ধিবলে প্রাণরক্ষা – বুদ্ধি প্রয়োগ করে বিধুশেখরকে দুটি ভাগে ভাগ করে নিয়ে কোনোক্রমে মহাকাশযানে পৌঁছোন শঙ্কু। এভাবেই মঙ্গলীয় জন্তুদের হাত থেকে বেঁচে যান তাঁরা। এই ঘটনার কথা লিখতে গিয়েই শঙ্কু উল্লিখিত আক্ষেপ করেছেন।

প্রোফেসর শঙ্কুরা কীভাবে মঙ্গলীয় সৈন্যদের কবলে পড়েছিলেন? কীভাবে তারা মুক্তি পেয়েছিলেন?

মঙ্গলীয় সৈন্যদের কবলে পড়া – সেনা আক্রমণ – ব্যোমযাত্রীর ডায়রি গল্পে প্রোফেসর শঙ্কুদের ওপরে মঙ্গলীয় সৈন্যদের আক্রমণের ঘটনাটা ঘটেছিল মঙ্গলে অবতরণের পরে প্রথম দিনই। অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা – সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে টিলার উপরে উঠে যখন প্রোফেসর শঙ্কু জায়গাটা ভালো করে ঘুরে দেখার পরিকল্পনা করছেন সেইসময় একটা আঁশটে গন্ধ আর একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পান তিনি। আওয়াজের উৎস খুঁজতে গিয়ে এক বিকট চিৎকার তাঁর কানে আসে। আর দেখেন প্রহ্লাদ ডান হাতের মুঠোয় নিউটনকে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে রকেটের দিকে যাচ্ছে।না মানুষ, না জন্তু, না মাছ-এমন জন্তুর পিছু নেওয়া – তার পিছু নিয়েছে যে জিনিসটা সেটা মানুষও নয়, জন্তুও নয়, মাছও নয়। শঙ্কু প্রহ্লাদকে রক্ষার জন্য জন্তুটিকে অনুসরণ করেন। পরে জানা যায় নদীর ধারে নিউটন এরকম একটা জন্তুকে কামড়ে দেওয়াতেই নাকি এই তাড়া করা। জন্তুটা ধীর গতি হওয়ায় প্রহ্লাদ রকেটে উঠে পড়তে সক্ষম হয়।
যেভাবে মুক্তিলাভ – বিধুশেখরের কেরামতি – বিধুশেখর রকেট থেকে নেমে জন্তুটাকে রুখে দাঁড়ায়। এমন সময় একটা দমকা হাওয়ার সঙ্গে আঁশটে গন্ধ পেয়ে দেখা যায় বিকট ঝিঁ ঝিঁ-র মতো শব্দ করে আরও দু-তিনশো জন্তু রকেটের দিকে এগিয়ে আসছে। বিধুশেখর লোহার হাতের এক আঘাতে পিছু নেওয়া জন্তুটাকে মাটিতে ফেলে দেয়। মঙ্গলীয় সেনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া – বেগতিক বুঝে বিধুশেখরকে বোতাম টিপে বন্ধ করে কোনোরকমে দু-ভাগ করে তাকে প্রহ্লাদের সাহায্যে টেনে রকেটে তোলেন শঙ্কু। হাজারখানেক মঙ্গলীয় সৈন্য তখন পঞ্চাশ গজের মধ্যে। তারপরে কেবিনের দরজা বন্ধ করেই শঙ্কু জ্ঞান হারান। জ্ঞান ফিরতে দেখেন রকেট উড়ে চলেছে।

ঘটনাটা ঘটল প্রথম দিনই। — ঘটনাটির বর্ণনা দাও।

উল্লিখিত ঘটনা – মঙ্গলগ্রহে পৌঁছানোর পরে প্রথম দিনেই এক বিভীষিকাময় ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় প্রোফেসর শঙ্কু ও তাঁর সঙ্গীদের। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্কু ভাবছিলেন যে টিলার উপরে উঠে জায়গাটা দেখবেন। এরকম সময় আঁশটে গন্ধ আর একটা অদ্ভুত শব্দ তিনি শুনতে পেলেন। শঙ্কু ওই আওয়াজের উৎস খুঁজতে শুরু করলে এক বিকট চিৎকার শোনেন এবং দেখেন যে, হাতের মুঠোয় নিউটনকে ধরে প্রহ্লাদ উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে রকেটের দিকে। তার পিছু নিয়েছে এক অদ্ভুত জীব যেটি মানুষ, জন্তু এবং মাছ তিনটির কোনোটাই নয়, কিন্তু তিনেরই মিশেল। প্রহ্লাদকে বাঁচানোর জন্য শঙ্কু অস্ত্র হাতে জন্তুটাকে অনুসরণ করেন। প্রহ্লাদ অবশ্য নিরাপদে রকেটে উঠে যায়। কিন্তু বিধুশেখর রকেট থেকে নেমে জন্তুটার মুখোমুখি দাঁড়ায়। এদিকে আরও দু-তিনশো জন্তু তাদের দিকে আসতে থাকে। বিধুশেখরের হাতের এক আঘাতে অনুসরণ করে আসা জন্তুটি মাটিতে পড়ে যায়। শঙ্কু তাকে আটকাতে চেষ্টা করেন। শেষপর্যন্ত শঙ্কু বোতাম টিপে বিধুশেখরকে অচল করেন। তারপর তাকে দু-ভাগ করে রকেটের দরজায় কাছে নিয়ে আসেন। ততক্ষণে প্রায় হাজার মঙ্গলীয় সৈন্য জড়ো হয়েছে দেখা যায়। প্রহ্লাদের সাহায্যে বিধুশেখরকে কেবিনে তুলে দরজা বন্ধ করে দেন। তারপরেই শঙ্কু জ্ঞান হারান। জ্ঞান ফিরলে দেখেন রকেট উড়ে চলেছে।

আমরা দু’ঘন্টা হলো মঙ্গলগ্রহে নেমেছি। — ব্যোমযাত্রীর ডায়রি গল্প অবলম্বনে মঙ্গলগ্রহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

মঙ্গলগ্রহের বিবরণ – ১৩ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে এক মাসেরও বেশি সময় পরে নিজস্ব উদ্ভাবিত রকেটে প্রোফেসর শঙ্কু তাঁর সঙ্গী প্রহ্লাদ, বিধুশেখর এবং নিউটনকে নিয়ে মঙ্গলগ্রহে পৌঁছান। সেখানে গাছপালা, মাটি, পাথর সবই নরম রবারের মতো। সামনে বিশ হাত দূরে একটা লাল নদী বয়ে যাচ্ছিল, যার জল স্বচ্ছ পেয়ারার জেলির মতো। নদীর জল লাল হওয়ায় আকাশ থেকে নদীগুলোকে লাল সুতোর মতো দেখায়। ঘাস, গাছপালার রং সবুজের বদলে নীল, আর আকাশ নীলের বদলে সবুজ। কোনো প্রাণীর সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। আবহাওয়া ঠান্ডা তো নয়ই, বরং গরমের দিকে। কিন্তু মধ্যে মধ্যে বয়ে আসা বাতাস হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। নদীর জলে অমৃতের স্বাদ, তা শরীর এবং মনর সমস্ত ক্লান্তিকে দূর করে দেয়। যদিও এর পরেই মঙ্গলগ্রহের বিভীষিকার সঙ্গে শঙ্কুর পরিচয় ঘটে। এরা হল মঙ্গলগ্রহের প্রাণী। তারা মানুষ বা জন্তু বা মাছ কোনোটাই নয়। অথচ এই তিনের সঙ্গেই কিছু মিল আছে। জন্তুটি লম্বায় প্রায় তিন হাত, এদের পা থাকলেও হাতের বদলে রয়েছে ডানা, মুখ দন্ডহীন। সংখ্যায় দু-তিনশো এরকম জন্তুর হাত থেকে কোনোরকমে নিজেদের রক্ষা করে পালাতে সমর্থ হয়েছিলেন প্রোফেসর শঙ্কু এবং তাঁর সঙ্গীরা।

কেবল একটা ঝলমলে সাদা গ্রহ নির্মল নিষ্কলঙ্ক একটি চাঁদের মতো আমাদের দিকে চেয়ে আছে। — এই গ্রহটির নাম কী? এই গ্রহে প্রোফেসর শঙ্কুদের কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল?

অথবা,টাফায় প্রোফেসর শঙ্কুর অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে বর্ণনা করো।

উদ্দিষ্ট গ্রহ – সত্যজিৎ রায় রচিত কল্পবিজ্ঞান কাহিনি ব্যোমযাত্রীর ডায়রি থেকে উদ্ধৃত অংশটিতে যে গ্রহটিকে বোঝানো হয়েছে তার নাম টাফা।
টাফায় প্রোফেসর শঙ্কুর অভিজ্ঞতা – টাফা সম্বন্ধে বিধুশেখরের দেওয়া তথ্য – টাফা গ্রহটি সম্পর্কে প্রোফেসর শঙ্কুর তৈরি রোবট বিধুশেখর বলেছিল যে, সেখানে সৌরজগতের প্রথম সভ্য লোকেরা বাস করে। সে আরও বলেছিল, পৃথিবীর থেকেও প্রাচীন এই সভ্যতাটির সবাই নাকি অতি বুদ্ধিমান জীব। একসঙ্গে এত বুদ্ধিমান লোক সেখানে থাকায় সমস্যা হচ্ছে। তাই তারা কম বুদ্ধিসম্পন্ন লোক এনে টাফায় বাস করাচ্ছে। টাফায় শঙ্কুর অভ্যর্থনা – রকেট থেকে নামার পর বিরাট মাথা, চোখ ও সরু হাত-পা-ওয়ালা পিঁপড়েজাতীয় প্রাণীরা প্রোফেসর শঙ্কুদের অভ্যর্থনা জানায়। শঙ্কু দেখলেন, টাফার প্রাণীদের কোনো ঘরবাড়ি নেই, তারা মাটির ভিতরের গর্তে বসবাস করে। ঘটনাবিহীন এবং সাধারণ গ্রহ – ঘটনাবিহীন এবং অত্যন্ত সাধারণ গ্রহ টাফায় পৌঁছে প্রোফেসর শঙ্কু তাঁর ডায়রি লেখাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। টাফার প্রাণীরা এতটাই আদিম অবস্থায় ছিল যে তারাই প্রোফেসর শঙ্কুর থেকে কিছু আদায় করে নিতে চেয়েছিল। টাফার নিম্নস্তরের প্রাণীরা মানুষের মতো হাঁচতেও জানত না, তাই তাদের ওপর প্রোফেসর শঙ্কুর নস্যাস্ত্রের প্রয়োগও বৃথা যায় ৷

এর আগে বিধুশেখরের কথা না শুনে ঠকেছি। — কোন্ প্রসঙ্গে কথাটি বলা হয়েছে? তার কথা শুনে কী হয়েছিল?

প্রসঙ্গ – ব্যোমযাত্রীর ডায়রি গল্পে মঙ্গলগ্রহ থেকে চলে আসার সময়ে রকেটের মধ্যে প্রোফেসর শঙ্কু বিধুশেখরের বোতাম টিপে তাকে চালু করে দেন। তারপর বিধুশেখর শঙ্কুর সঙ্গে স্পষ্ট মানুষের ভাষায় কথা বলা শুরু করে। তবে তা সাধু ভাষা। ঘটোৎকচ বধের অংশ আবৃত্তি করতে করতে বিধুশেখর হঠাৎ তা থামিয়ে বলে ওঠে – বাহবা, বাহবা, বাহবা। বিধুশেখরের এই ফুর্তির কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলে ওঠে – গবাক্ষ উদ্ঘাটন করহ। তার এই নির্দেশ প্রসঙ্গেই শঙ্কু আলোচ্য মন্তব্যটি করেছেন।
কথা শোনার পরিণতি – বিধুশেখরের নির্দেশ অমান্য না করে প্রোফেসর শঙ্কু জানলাটা খুলে দেন। আর তা খুলতেই চোখ ঝলসানো দৃশ্য তাঁকে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ করে দেয়। দৃষ্টি ফিরে এলে দেখলেন যে এক অদ্ভুত অবিশ্বাস্য জগতের মধ্য দিয়ে তাঁরা উড়ে চলেছেন। যত দূর চোখ যায় আকাশময় কেবল বুদবুদ ফুটছে আর ফাটছে। মুহূর্তে মুহূর্তে দৃশ্য পালটে যাচ্ছে। সাপের মতো আলো নানাদিকে ছুটে যাচ্ছে। শঙ্কুর মনে হয় এ যেন সৌরজগতের কোনও বাদশাহের উৎসবে আতসবাজির খেলা।

সত্যজিৎ রায়ের ব্যোমযাত্রীর ডায়রি একটি অসাধারণ বিজ্ঞান কল্পকাহিনী। এই গল্পে একজন বাঙালি বিজ্ঞানীর মঙ্গল অভিযানের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। গল্পের মূল চরিত্র প্রফেসর আচার্য, যিনি একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী। তিনি মঙ্গল অভিযানের জন্য একটি মহাকাশযান তৈরি করেন। এই মহাকাশযানে প্রফেসর আচার্য ছাড়াও আরও তিনজন বিজ্ঞানী ছিলেন। তারা হলেন ডাঃ মৃণাল, ডাঃ সেন এবং ডাঃ রায়।

গল্পটিতে মঙ্গল অভিযানের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে পৌঁছানোর পর সেখানে তারা বিভিন্ন অদ্ভুত ঘটনা দেখেন। তারা মঙ্গলের আকাশ, মাটি, গাছপালা, প্রাণী ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারেন। গল্পের শেষে বিজ্ঞানীরা মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসেন।

গল্পটির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এটি একটি অত্যন্ত সৃজনশীল ও চিন্তাশীল রচনা। গল্পটিতে বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর মৌলিক উপাদানগুলির সমন্বয় ঘটেছে। গল্পের আখ্যান, চরিত্রচিত্রণ, বর্ণনাভঙ্গি ইত্যাদি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে রচিত হয়েছে।

গল্পটির আখ্যান অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও উত্তেজনাপূর্ণ। গল্পের শুরু থেকেই পাঠকদের মনে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানীরা মঙ্গল অভিযানে বেরিয়ে পড়ার পর থেকেই গল্পের ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়। গল্পের শেষ পর্যন্ত পাঠকদের কৌতূহল বজায় থাকে।

গল্পের চরিত্রগুলি অত্যন্ত বাস্তবধর্মী ও প্রাণবন্ত। প্রফেসর আচার্য একজন সাহসী ও দূরদর্শী বিজ্ঞানী। ডাঃ মৃণাল, ডাঃ সেন এবং ডাঃ রায়ও অত্যন্ত দক্ষ ও যোগ্য বিজ্ঞানী। গল্পের অন্যান্য চরিত্রগুলিও যথাযথভাবে রচিত হয়েছে।

গল্পের বর্ণনাভঙ্গি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। গল্পের বিভিন্ন ঘটনা ও দৃশ্যগুলি অত্যন্ত সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। গল্পের আকাশ, মাটি, গাছপালা, প্রাণী ইত্যাদির বর্ণনা পাঠকদের মনের মধ্যে একটি বাস্তব পরিবেশ সৃষ্টি করে।

সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে, ব্যোমযাত্রীর ডায়রি একটি অত্যন্ত সৃজনশীল ও চিন্তাশীল বিজ্ঞান কল্পকাহিনী। এই গল্পটি বাংলা সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ।

Share via:

মন্তব্য করুন