আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ের অষ্টম অধ্যায় “উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারত: বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (1947-1964)” এর থেকে “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো দশম শ্রেণির ইউনিট টেস্ট থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা এর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চাকরি বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতেও কাজে লাগবে। এই অধ্যায় থেকে স্কুল পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই প্রশ্ন আসে, তাই এই প্রশ্নোত্তরগুলো সবাইকে সাহায্য করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। পড়ার শেষে এই অধ্যায়ের মুখ্য বিষয়গুলো আপনার আয়ত্তে চলে আসবে এবং যেকোনো পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখতে পারবেন।

1947 খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাজনের দিকে যাত্রার কয়েকটি পদক্ষেপ উল্লেখ করো।
1947 খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাজনের ভূমিকা –
দেশভাগের মধ্য দিয়ে 1947 খ্রিস্টাব্দে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। এই বিভাজনের পূর্বাভাস কিছু ঘটনা ও পদক্ষেপের মাধ্যমে পাওয়া যায়। 1947 খ্রিস্টাব্দে সেগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
1947 খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাজনের পদক্ষেপসমূহ –
1947 খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাজনের দিকে যাত্রার পদক্ষেপগুলি ছিল নিম্নরূপ –
- দাঙ্গার প্রসার – 1946 খ্রিস্টাব্দের 16 আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিন থেকে শুরু হওয়া দাঙ্গা 1947 খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে অমৃতসর, লাহোর, মুলতান, আটক, রাওয়ালপিণ্ডির দাঙ্গা বীভৎস রূপ নেয়। হিন্দু-শিখ ও মুসলিমদের একাংশ উগ্র সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে। তার প্রভাব জনগোষ্ঠীর উপর পড়ে। সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতা, সরকার – সবার এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে, অখণ্ড ভারতে এক জাতি হিসেবে পারস্পরিক সহাবস্থান আর সম্ভব নয়।
- অন্তর্বর্তীকালীন সরকার – জওহরলাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বে ভারতে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (Interim Government) গঠিত হয়েছিল, লিয়াকৎ আলি খান তার অর্থমন্ত্রী ছিলেন। অর্থমন্ত্রীর বাজেট ও শিল্পপতিদের উপর কর আরোপে নেহরু ও কংগ্রেস দল ক্ষুব্ধ হয়। কারণ এই শিল্পপতিরাই কংগ্রেসের আর্থিক উৎস ছিলেন। সরকারের কাজকর্মে কংগ্রেস-লিগ দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। নেহরু পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
- গণপরিষদ – 1946 খ্রিস্টাব্দের 9 ডিসেম্বর রাজেন্দ্র প্রসাদের সভাপতিত্বে সংবিধান সভা বা গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। মুসলিম লিগ এই অধিবেশনে যোগদান করেনি। তারা পৃথক গণপরিষদের দাবি জানায়। পরে ব্রিটিশ সরকার সেই দাবি অনুমোদন করে।
- ভাঙন পরিকল্পনা – কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বড়োলাট লর্ড ওয়াভেল একটি ভাঙন পরিকল্পনা (Break down Plan) তৈরি করেন। এই পরিকল্পনায় হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে ‘হিন্দু ভারত’ এবং মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে ‘মুসলিম ভারত’ গঠনের রূপরেখা ছিল। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তখন এই পরিকল্পনা বর্জন করলেও তাতে দেশভাগের ইঙ্গিত ও পদক্ষেপ ছিল।
- ফেব্রুয়ারি ঘোষণা – ভারতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা, নেতাদের দায়িত্বশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি 1947 খ্রিস্টাব্দের 20 ফেব্রুয়ারি একটি ঘোষণা করেন, যা ফেব্রুয়ারি ঘোষণা নামে পরিচিত। বলা হয়, 1948 খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের মধ্যে ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করবে। কোনো একটি দায়িত্বশীল সরকারকে, না হলে প্রত্যেক রাজ্যকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। সেইসঙ্গে দেশীয় রাজ্যগুলিকেও স্বাধীনতা দেওয়া হবে।
- খণ্ডীকরণ পরিকল্পনা – 1946 খ্রিস্টাব্দের 24 মার্চ বড়োলাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তরের দায়িত্ব নিয়ে ভারতে আসেন। তিনি ফেব্রুয়ারি ঘোষণার সূত্র ধরে ব্রিটিশ প্রদেশগুলিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করেন। নেহরু একে ‘বল্কান পরিকল্পনা’ বলেন। আপত্তির জন্য এই পরিকল্পনা বাতিল হলেও তাতে দেশভাগের ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট।
- 3 জুন পরিকল্পনা – 3 জুন পরিকল্পনায় বলা হয়, ডোমিনিয়ন মর্যাদার ভিত্তিতে ভারতের মুসলিমপ্রধান প্রদেশগুলি নিয়ে একটি পৃথক রাষ্ট্র (পাকিস্তান) গঠন করা যাবে। পাঞ্জাব ও বাংলার আইনসভার সদস্যরা ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রদেশ ব্যবচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেবেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও আসামের শ্রীহট্ট জেলায় পাকিস্তানভুক্তির জন্য গণভোট হবে। পাঞ্জাব ও বাংলা ব্যবচ্ছেদ ও সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি সীমানা কমিশন গঠিত হবে। দেশীয় রাজ্যগুলি নতুন ডোমিনিয়নের যে-কোনোটিতে যোগ দিতে বা স্বাধীন থাকতে পারবে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতের স্বাধীনতা আইন পাস করবে। 1947 খ্রিস্টাব্দের ৩ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক ঘোষিত এই পরিকল্পনা ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি মেনে নেয়।
1947 খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাজনের মন্তব্য –
স্বাধীনতা লাভের আগেই ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক এই সমস্ত পদক্ষেপ থেকে দেশভাগের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। অর্থাৎ দেশভাগ কেবল সময়ের অপেক্ষা ছিল মাত্র।
ভারতীয় স্বাধীনতা আইন সম্পর্কে একটি টীকা লেখো।
ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের ভূমিকা –
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের বিউপনিবেশিকরণ নীতির অঙ্গ হিসেবে ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। এই প্রক্রিয়ার অংশ ছিল মন্ত্রীমিশন পরিকল্পনা, নির্বাচন ও সংবিধান সভা গঠন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা এবং ভারতের স্বাধীনতা আইন পাস।
ভারতের স্বাধীনতা আইন –
ভারতীয়দের ক্ষমতা হস্তান্তর বা স্বাধীনতা দানের জন্য ব্রিটিশ সরকার লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ব্রিটিশ ভারতের শেষ বড়োলাট হিসেবে নিয়োগ করে। মাউন্টব্যাটেন ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে খুব দ্রুত আলোচনা করে একটি পরিকল্পনা (মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা বা 3 জুন পরিকল্পনা) তৈরি করেন। পরিকল্পনাটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয়ে (4 জুলাই, 1947 খ্রিস্টাব্দ) রাজা ষষ্ঠ জর্জের স্বাক্ষর লাভ করলে আইনে পরিণত হয় (18 জুলাই, 1947 খ্রিস্টাব্দ)।
ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের প্রধান প্রধান দিক –
এই আইনের প্রধান প্রধান দিকগুলি হল –
- নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি – এই আইন দ্বারা ধর্মের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারতকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি ডোমিনিয়নের সৃষ্টি হয়। ডোমিনিয়ন দুটি ব্রিটিশ রাজের অনুগত থাকবে এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথ (Commonwelth) -এর সদস্য হবে। তবে অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্রক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করবে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন নতুন ডোমিনিয়ন দুটির বড়োলাট হবেন যদি তাদের আইনসভার আপত্তি না থাকে।
- নতুন সংবিধান সভা গঠন – ডোমিনিয়ন দুটি নিজ নিজ সংবিধান রচনার জন্য আলাদা-আলাদা সংবিধান সভা (Constituent Assembly) গঠন করবে। যতদিন সংবিধান রচিত হবে না ততদিন 1935 খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইন অনুযায়ী ডোমিনিয়ন দুটির কাজকর্ম পরিচালিত হবে। প্রয়োজনে তারা এই আইনের পরিবর্তন করতে পারবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের পাস করা কোনো কোনো আইনের পরিপন্থীর হলে ডোমিনিয়নের আইনসভায় পাস করা আইনটি বৈধ বলে বিবেচিত হবে।
- সীমানা – পার্টিশন কাউন্সিল ও সীমানা কমিশন দ্বারা নির্ধারিত অঞ্চল নিয়ে নতুন ডোমিনিয়ন (ভারত ও পাকিস্তান) দুটির সীমানা গড়ে উঠবে।
- দেশীয় রাজ্য – ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় রাজ্যগুলির উপর থেকে ব্রিটিশ প্রভুত্বের অবসান ঘটবে। দেশীয় রাজ্যগুলি ভারত বা পাকিস্তান – যে কোনো ডোমিনিয়নে যোগ দিতে পারবে অথবা স্বাধীন থাকতে পারবে।
ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মন্তব্য –
এইভাবে প্রায় 200 বছরের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। ব্রিটিশ বিভেদ নীতির প্রথম প্রয়োগ ছিল ভারতের স্বাধীনতা আইন।
ভারত বিভাগ কি অনিবার্য ছিল?
অথবা, ভারত বিভাগের জন্য দায়ী কে?
ভারত বিভাগের ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট দ্বিখণ্ডিত ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। ভারতের অঙ্গব্যবচ্ছেদ করে গড়ে ওঠে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই ভারত বিভাজন সত্যিই অনিবার্য ছিল কি না? এটি ভারত ইতিহাসের অতি বিতর্কিত ও আলোচিত একটি বিষয়।
ভারত বিভাগের জন্য দায়ী কে? –
ভারত বিভাগের জন্য দায়ী কারা? এ প্রশ্ন অত্যন্ত বিতর্কিত। অতুল্য ঘোষ লিখেছেন, ‘এর জন্য মূলত দায়ী ছিল – প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি, দ্বিতীয় ব্রিটিশ সরকার ও তৃতীয় মুসলিম লিগ।’ রামমনোহর লোহিয়ার মতে, দেশবিভাগের ব্যাপারে কমিউনিস্ট সমর্থন পাকিস্তানের জন্ম দেয়নি, ভারত বিভাগের পরিকল্পনা করেছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। এই বিষয়ে আলোচনার নানান দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষণীয়।
- জিন্না প্রসঙ্গ – ভারত বিভাগে জিন্নার কিছুটা দায়িত্ব থাকলেও তিনিই একমাত্র দায়ী নন। সাম্প্রতিককালে পাকিস্তানি ঐতিহাসিক ডঃ আয়েশা জালাল মনে করেন যে, জিন্না সাম্প্রদায়িক ছিলেন না এবং সত্যই তিনি পাকিস্তান চাননি। জিন্না চেয়েছিলেন পাকিস্তান পরিকল্পনার মাধ্যমে মুসলিম স্বার্থ রক্ষা করতে। কিন্তু কংগ্রেস ও জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ- উভয়ের মতপার্থক্য প্রবল হয়ে ওঠে এবং জিন্না কংগ্রেসবিরোধী হয়ে ওঠেন। এ সম্পর্ক আর জোড়া লাগেনি -এর শেষ পরিণাম দেখা যায় ভারত বিভাগে।
- কংগ্রেস প্রসঙ্গ – দেশভাগের জন্য কংগ্রেসকে দায়ী করে অনেকে প্রশ্ন তুলে বলেছেন যে –
- মৌলানা আজাদ ব্যতীত আর কোনো কংগ্রেস নেতা সেভাবে দেশভাগের বিরোধিতা করেননি।
- গান্ধি যদি দেশভাগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে একাই আন্দোলনে নামতেন, তাহলে অসংখ্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়াত।
- মার্কসবাদী পণ্ডিতরা বলেন যে, এসময় কংগ্রেস যদি সমস্ত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তিকে সংহত করে একটি গণ আন্দোলন গড়ে তুলত তাহলে ভারত বিভাগ এড়ানো যেত। ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠি এই সমালোচনার উত্তরে কমিউনিস্ট পার্টিকেই বেশি করে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন যে, জাতীয় কংগ্রেস ক্রিপসের প্রস্তাবে পাকিস্তানের গন্ধ পেয়েছিল বলেই তা প্রত্যাখ্যান করেছিল।
ভারত বিভাগের সিদ্ধান্ত –
দেশভাগের জন্য পুরোপুরি কাউকেই দায়ী করা যায় না। তবে এ ব্যাপারে কেউই সামান্যতম হলেও দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেন না। তা ছাড়া সেই সময় সারা দেশ জুড়ে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হানাহানি চলছিল তা বন্ধ করার একমাত্র উপায় ছিল দেশভাগ। অন্যথায় আরও বড়ো ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল।
স্বাধীনতা লাভের পর নবগঠিত ভারতের প্রধান সমস্যাগুলি কী ছিল?
1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট সুদীর্ঘকালের লড়াই ও আত্মবলিদানের মাধ্যমে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু দীর্ঘদিন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকায় ভারত তখন সর্ব অর্থেই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে নবগঠিত ভারত নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়।
নবগঠিত ভারতের প্রধান সমস্যাসমূহ –
- সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা – ভারতের স্বাধীনতা লাভের পূর্বেই শুরু হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এই দাঙ্গা স্বাধীনতা লাভের পর চরম আকার ধারণ করে। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারান। পেন্ডেরেল মুন -এর হিসাব অনুযায়ী শুধু পশ্চিম সীমান্তে মারা গিয়েছিল 15 লক্ষ মানুষ। এ ছাড়া প্রচুর মানুষকে ধর্মান্তরিত করা হয় এবং ব্যাপক লুঠতরাজ চালানো হয়।
- উদবাস্তু সমস্যা – ভারত বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে যে সমস্যা নতুন রাষ্ট্র গঠনকারীদের সামনে বড়ো চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করেছিল, তা হল উদবাস্তু সমস্যা। পাকিস্তান থেকে ভারতবর্ষে আগত অসংখ্য শরণার্থী প্রশাসনের উপর বাড়তি জনসংখ্যার চাপ সৃষ্টি করেছিল। সেইসঙ্গে ছিল তাদের পুনর্বাসনের প্রশ্ন।
- দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি – স্বাধীনতা লাভের পর ভারত যে-সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সংক্রান্ত সমস্যা। স্বাধীনতা লাভের প্রাক্-মুহূর্তে ভারতে 562টি দেশীয় রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল; যার মধ্যে কাশ্মীর, হায়দরাবাদ, জুনাগড়ের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় রাজ্যও ছিল। এই রাজ্যগুলি স্বাধীন থাকলে বা পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত হলে ভারতের সংহতি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হত। তাই এই রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তি ভারতের কাছে অত্যন্ত জরুরি ছিল।
- খাদ্যাভাব – দেশভাগের পর বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ভারতবর্ষে প্রবেশ করায় খাদ্যাভাব তীব্র হয়ে ওঠে। এ ছাড়া 1950 খ্রিস্টাব্দে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ব্যাপকভাবে শস্যহানি হওয়ায় ভারতে খাদ্যসংকট আরও বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায় খাদ্যের সংকট থেকে মুক্তিলাভ করার উপায় খুঁজে বের করাও নবগঠিত ভারত সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে পড়ে।
- আর্থিক সংকট – দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শোষণের ফলে ভারতবর্ষ তীব্র আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে; অন্যদিকে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল উৎপাদক অঞ্চলগুলি পাকিস্তানের ভাগে পড়ায় শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে শিল্পের সঙ্গে জড়িত বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়ে।
নবগঠিত ভারতের উপসংহার –
দীর্ঘ সংগ্রামের পর বহুকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার সুখ ভারতবাসী খুব বেশি সময় ভোগ করতে পারেনি। নানান সমস্যায় সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারত জর্জরিত হয়ে পড়েছিল।
দেশীয় রাজ্য বলতে কী বোঝো? দেশীয় রাজ্যগুলির বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
দেশীয় রাজ্যের ভূমিকা –
ইংরেজ আমলে ভারতে বহুসংখ্যক দেশীয় শাসকদের দ্বারা শাসিত রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। এই সকল রাজ্যগুলি ইংরেজদের সঙ্গে চুক্তি করে অভ্যন্তরীণ শাসনের অধিকারী ছিল।
দেশীয় রাজ্য –
ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শাসকরা ইংরেজদের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এইভাবে দেশীয় শাসকরা ইংরেজ প্রভুত্ব স্বীকার করেও নিজ নিজ রাজ্য শাসন করতেন। এই রাজ্যগুলি দেশীয় রাজ্য নামে পরিচিত। সারা ভারতে মোট 562টি দেশীয় রাজ্য ছিল, যাদের আয়তন ছিল ভারতের মোট আয়তনের প্রায় 48 শতাংশ। জনসংখ্যা ছিল প্রায় 9 কোটি।
দেশীয় রাজ্যের বৈশিষ্ট্যসমূহ –
এই দেশীয় রাজ্যগুলির কতকগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
- সংখ্যাধিক্য – ভারতের স্বাধীনতা লাভের সময়কালে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রায় 600টি দেশীয় রাজ্য ছিল। সংখ্যার বিচারে অধিক দেশীয় রাজ্যগুলি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিল।
- ক্ষুদ্রায়তন – দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে মাত্র পাঁচ-ছয়টি দেশীয় রাজ্য ছিল আয়তনে বড়ো। বাকি রাজ্যগুলির বেশিরভাগই ছিল আয়তনে ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র। কোনো কোনো রাজ্য একজন ছোটো জমিদারের এলাকার সমান ছিল।
- পুরোনো শাসন পদ্ধতি – দেশীয় রাজ্যের শাসকগণ ছিলেন চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। সেখানে আইনের শাসন ছিল না। নিজের এলাকায় শাসক স্বৈরাচারী ক্ষমতা ভোগ করতেন।
- প্রজাদের দুরবস্থা – দেশীয় রাজ্যগুলির প্রজাদের অবস্থা ছিল খুব খারাপ। শাসকেরা প্রজাদের কাছ থেকে যথেচ্ছভাবে রাজস্ব আদায় করত। প্রজারা কোনোরকম বিরোধিতা করলে তাদের চরম অত্যাচার করা হত।
দেশীয় রাজ্যের উপসংহার –
দেশীয় রাজ্যগুলি শাসন, আইন, শিক্ষা সবক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। রাজাদের স্বৈরাচারী শাসন ও উন্নয়নের অভাবে দেশীয় রাজ্যগুলি মধ্যযুগীয় অবস্থাতেই থেকে গিয়েছিল।
1946-1947 খ্রিস্টাব্দে মন্ত্রীমিশনের প্রস্তাব ও ভারতীয় স্বাধীনতা আইন কীভাবে দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব গড়ে তুলেছিল?
1946-1947 খ্রিস্টাব্দে ভারত স্বাধীনতার ভূমিকা –
ভারতের স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশীয় রাজ্যের সংখ্যা ছিল 562টি। এই রাজ্যগুলি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত ছিল। তাদের সমষ্টিগত আয়তন ছিল সমগ্র ভারত ভূখণ্ডের শতকরা 48 ভাগ ও লোকসংখ্যা ছিল 9 কোটি। স্বাধীনতা লাভের পর এই বিপুল সংখ্যক রাজ্যগুলির ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে জটিলতর সমস্যার সৃষ্টি হয়।
1946-1947 খ্রিস্টাব্দে মন্ত্রীমিশনের ভূমিকা –
1946 খ্রিস্টাব্দের 16 মে মন্ত্রীমিশন ঘোষণা করে যে –
- ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর দেশীয় রাজ্যগুলির উপর থেকে ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের অবসান ঘটবে।
- স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ-শাসিত ভারত এবং দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি ইউনিয়ন গঠন করা হবে এবং পররাষ্ট্রনীতি, দেশরক্ষা প্রভৃতি কয়েকটি বিষয়ের উপর ইউনিয়ন সরকারের কর্তৃত্ব বহাল থাকবে।
- এই বিষয়গুলি ছাড়া অন্যান্য বিষয় দেশীয় রাজন্যবর্গের অধিকারভুক্ত থাকবে।

ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় স্বাধীনতা আইন-এ দেশীয় রাজ্যগুলির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার নির্দেশ ছিল না। এই আইনে বলা হয়, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের চুক্তির সমাপ্তি ঘটবে। তারা ইচ্ছা করলে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে অথবা ভারত কিংবা পাকিস্তান যে-কোনো একটি রাষ্ট্রে যোগদান করতে পারবে। ভারত বিভাগের সিদ্ধান্ত সরকারিভাবে ঘোষিত হলে বড়োলাটের রাজনৈতিক উপদেষ্টা স্যার কনরাড কর্নফিল্ড -এর উসকানিতে ভূপাল, হায়দরাবাদ, ত্রিবাঙ্কুর এবং আরও কিছু রাজ্য স্বাধীনতা ঘোষণা করতে উদ্যত হয়। এতে জাতীয় কংগ্রেস প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়।
ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের পরিণতি –
শেষপর্যন্ত তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের দৃঢ় ও অনমনীয় পদক্ষেপ, স্বরাষ্ট্রসচিব ভি পি মেননের কূটনৈতিক দক্ষতার ফলে দেশীয় রাজ্যগুলির বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতা দমিত হয়েছিল। ফলস্বরূপ দেশীয় রাজ্যগুলির প্রজাবর্গের সম্মিলিত ইচ্ছা জয়যুক্ত হয় এবং প্রায় 550টি দেশীয় রাজ্যের ভারতভুক্তি সুসম্পন্ন হয়।
ভারতে যোগদানের আগে দেশীয় রাজ্যগুলি সম্পর্কে কী কী সরকারি ঘোষণা বা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল?
দেশীয় রাজ্যের ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা লাভের সময়কালে প্রায় 600 দেশীয় রাজ্য ছিল। স্বাধীনতা লাভের আগে দেশীয় রাজ্যগুলি সম্পর্কে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
দেশীয় রাজ্যের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ –
মন্ত্রীমিশনের প্রস্তাব –
1946 খ্রিস্টাব্দে মন্ত্রীমিশনের প্রস্তাবে বলা হয় যে –
- ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর দেশীয় রাজ্যগুলির উপর থেকে ব্রিটিশ কর্তৃত্বের অবসান ঘটবে।
- ব্রিটিশ-শাসিত ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা হবে।
- প্রদেশগুলি নিজেদের শাসনতন্ত্র নিজেরাই রচনা করবে এবং ইচ্ছা করলে একই স্বার্থবিশিষ্ট প্রদেশগুলি জোট বাঁধতে পারবে।
- প্রদেশগুলিতে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রবর্তিত হবে।
- কেন্দ্রের হাতে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকবে।
মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা –
1947 খ্রিস্টাব্দের 3 জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাঁর পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যা মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা নামে পরিচিত। এতে বলা হয় –
- দেশীয় রাজ্যগুলি নিজ নিজ রাজ্যে সার্বভৌম ক্ষমতা পাবে।
- দেশীয় রাজ্যগুলি ইচ্ছা করলে ভারত বা পাকিস্তান – যে-কোনো একটি ডোমিনিয়নে যোগ দিতে পারবে।
ভারতের স্বাধীনতা আইন –
1947 খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় স্বাধীনতা আইন-এ দেশীয় রাজ্যগুলি সম্পর্কে বলা হয়, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর তাদের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের চুক্তির অবসান ঘটবে। তারা ইচ্ছা করলে স্বাধীন থাকতে পারবে অথবা ভারত বা পাকিস্তান যে-কোনো রাষ্ট্রে যোগদান করতে পারবে।
স্বাধীনতার পর দেশীয় রাজ্যের শাসকদের স্বাধীনতা সংক্রান্ত ধারণা এবং জাতীয়তাবাদী নেতাদের ধারণার বিষয়টি আলোচনা করো।
দেশীয় রাজ্যের শাসকদের স্বাধীনতা এবং জাতীয়তাবাদী নেতাদের ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়। সঙ্গে সঙ্গে এতদিনের ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলি স্বাধীনতা লাভ করে। দেশীয় শাসকেরা আবার আগের মতো স্বাধীনতা পাবে, এই আশায় তারা উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ভারতের জাতীয় সংহতি ও ঐক্যরক্ষা জাতীয়তাবাদী নেতাদের চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে। এই দুই -এর ঘাতপ্রতিঘাতে ভারতে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়কাল দারুণভাবে আলোড়িত হয়।
দেশীয় শাসকদের স্বাধীনতার ধারণা –
ভারতের দেশীয় শাসকেরা বেশিরভাগই ইংরেজদের মিত্র ছিল। শাসকেরা অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে স্বাধীন ছিল। ভারতে ইংরেজরা সাম্রাজ্য রক্ষায় এইসব দেশীয় শাসকদের সাহায্য পেয়েছিল। তাই ভারতকে স্বাধীনতা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে এই দেশীয় রাজ্যগুলিকেও স্বাধীনতা দানের কথা বলে ইংরেজ সরকার।
- মন্ত্রীমিশনের প্রস্তাব – এই প্রস্তাবে বলা হয়, স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ-শাসিত প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্য নিয়ে একটি ইউনিয়ন গঠিত হবে। এই প্রস্তাবিত ইউনিয়নে দেশীয় রাজ্যের যোগদান স্বেচ্ছাধীন হবে।
- ফেব্রুয়ারি ঘোষণা – ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলির ফেব্রুয়ারি ঘোষণায় (20 ফেব্রুয়ারি, 1947 খ্রিস্টাব্দ) দায়িত্বশীল নেতাদের হাতে বা প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছিল।
- মাউন্টব্যাটেন প্ল্যান – বড়োলাট লর্ড মাউন্টব্যাটেনের এই পরিকল্পনাতেও দেশীয় রাজ্যের স্বাধীনতার বিষয়টি ছিল।

এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশীয় রাজ্যের শাসকেরা কোনো ডোমিনিয়নে যোগ না দিয়ে নিজেরা স্বাধীন থাকার কথা চিন্তা করে।
জাতীয়তাবাদী নেতাদের ধারণা –
জাতীয়তাবাদী নেতারা মনে করেন –
- স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতির পক্ষে এই দেশীয় রাজ্যগুলি হল বাধা। তাই এগুলির ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত।
- রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকা উচিত, শাসকের হাতে নয়।
- এই রাজ্যগুলির অস্তিত্ব ভারতের স্বাধীনতাকে অর্থহীন করবে, নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে। তাই এই রাজ্যগুলির বিলুপ্তি প্রয়োজন।
দেশীয় রাজ্যের শাসকদের স্বাধীনতা এবং জাতীয়তাবাদী নেতাদের মূল্যায়ন –
এই পরস্পরবিরোধী ধারণার সংঘাতে শেষপর্যন্ত জাতীয়তাবাদী ধারণা জয়ী হয়। বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করে সংযুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করিয়ে দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারত ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কোনো কোনো দেশীয় রাজ্যকে বলপূর্বক দখল করা হয়। এভাবে জাতীয়তাবাদী নেতাদের স্বাধীনতার ধারণা বাস্তব রূপ লাভ করে।
দেশীয় রাজ্যের ভারতভুক্তি সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার ও ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মনোভাব কীরকম ছিল?
দেশীয় রাজ্যের ভারতভুক্তির ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট স্বাধীনতা লাভের পর ভারত যেসব জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সংক্রান্ত সমস্যা। স্বাধীনতা লাভের পূর্বে ভারতে দেশীয় রাজ্যের সংখ্যা ছিল 562টি। এই দেশীয় রাজ্যগুলি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। এইসব রাজ্যের মোট আয়তন ছিল ভারতের 48%। স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা এই দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি অত্যন্ত জরুরি ছিল।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের নীতি –
- ভারতীয় স্বাধীনতা আইন – ব্রিটিশ সরকার প্রণীত 1947 খ্রিস্টাব্দের ভারতীয় স্বাধীনতা আইন (Indian Independence Act, 1947)-এ দেশীয় রাজ্যগুলি সম্পর্কে বলা হয়, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে তাদের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের চুক্তির অবসান ঘটবে। তারপর তারা ইচ্ছা করলে স্বাধীন থাকতে পারবে অথবা ভারত বা পাকিস্তান – যে-কোনো একটি রাষ্ট্রে যোগদান করতে পারবে।
- এটলির ঘোষণা – কিন্তু এই বিল আলোচনার সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি এবং ব্রিটিশ অ্যাটর্নি জেনারেল স্যার হার্টলে শত্রুস স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে, ব্রিটিশ সরকার দেশীয় রাজ্যগুলির স্বাধীন অস্তিত্ব স্বীকার করবে না। এই রাজ্যগুলির উচিত ভারত বা পাকিস্তান – যে-কোনো একটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়া।
জাতীয় কংগ্রেসের মনোভাব –
1947 খ্রিস্টাব্দের 15 জুন জাতীয় কংগ্রেসের তরফে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয় যে, স্বাধীনতার পর ভারতে কোনো দেশীয় রাজ্যের স্বাধীন অস্তিত্ব জাতীয় কংগ্রেস স্বীকার করবে না।
- গান্ধিজির অভিমত – গান্ধিজি বলেন যে, কোনো দেশীয় রাজ্য যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করে তবে তা স্বাধীন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বলে বিবেচিত হবে।
- জওহরলাল নেহরুর অভিমত – জওহরলাল নেহরু ঘোষণা করেন যে, ভারতের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে কোনো দেশীয় রাজ্যের স্বাধীন অস্তিত্ব স্বীকার করা হবে না।
দেশীয় রাজ্যের ভারতভুক্তির মূল্যায়ন –
শেষপর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের ইচ্ছামতো দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এইভাবে জাতীয়তাবাদী নেতাদের স্বাধীনতার ধারণা বাস্তব রূপ লাভ করে।
দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ভারতের উদ্দেশ্যগুলি কী ছিল?
অথবা, ভারত কী কারণে দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়?
দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার ভূমিকা –
ক্লিমেন্ট এটলির ফেব্রুয়ারি ঘোষণা এবং মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনায় দেশভাগ ও স্বাধীনতা লাভের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে ভারতীয় শাসকদের দ্বারা শাসিত দেশীয় রাজ্যগুলির স্বাধীনতা লাভের সম্ভাবনাও দেখা দেয়। এইরূপ পরিস্থিতিতে দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন হয়।
দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ভারতের উদ্দেশ্যসমূহ –
বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয় –
- ঐক্য ও সংহতি রক্ষা – ভারতের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম ও মধ্যভাগে দেশীয় রাজ্যগুলি অবস্থিত ছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত এইসব দেশীয় রাজ্যগুলির সীমারেখা দীর্ঘ ছিল। এইসব রাজ্যগুলি বিভিন্ন শাসকের দ্বারা শাসিত হত। এর মধ্যে কিছু মুসলিম শাসক ছিলেন। আর বেশিরভাগ শাসক ছিলেন হিন্দু। মুসলিম জনসংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যের অস্তিত্ব থাকলেও বেশিরভাগ রাজ্যই ছিল হিন্দু জনসংখ্যাগরিষ্ঠ। এইসব বিভিন্ন ধরনের দেশীয় রাজ্য স্বাধীন হলে সদ্য স্বাধীন ভারতের স্বাধীনতা অর্থহীন হবে এবং ভারতের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন হবে – এ কথা জাতীয় নেতারা উপলব্ধি করেন। তাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির মাধ্যমে স্বাধীন ভারতের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করা।
- নিরাপত্তা – দেশীয় রাজ্যগুলির বিপুল সংখ্যা এবং তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব যেমন একদিকে ভৌগোলিক দিক থেকে ভারতীয় ঐক্য ও সংহতির পক্ষে বাধাস্বরূপ ছিল, তেমনি অন্যদিকে ভারতের নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রেও ছিল বিপজ্জনক। এতগুলি রাজ্য স্বাধীনভাবে সামরিক তৎপরতা শুরু করলে রণচাতুর্ষিক, ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে স্বাধীন ভারতের অস্তিত্ব রক্ষা সম্ভব ছিল না। এজন্য ভারতের ভৌগোলিক নিরাপত্তা রক্ষা অপর একটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।
- শক্তি সম্পদ – দেশীয় রাজ্যগুলি ভারতের মোট আয়তনের 48 শতাংশ এবং 9 কোটি জনসংখ্যার অধিকারী ছিল। বিস্তৃত রেলপথ, সড়কপথ, নদনদীর বিভিন্ন অংশ, অরণ্য, খনি, সমভূমির বিপুল অংশ দেশীয় রাজ্যগুলির অধিকারে ছিল। এই শক্তিসম্পদের উৎসগুলি স্বাধীন ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। তাই এগুলি দখল করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
- দেশভাগজনিত ক্ষতিপূরণ – দেশভাগের কারণে এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড এবং প্রায় সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা ভারত হারায়। দেশীয় রাজ্যগুলি সংযুক্ত করে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ভূখণ্ড ও জনসংখ্যা ভারত লাভ করে।
- জাতীয়তাবাদ – ভারতের জাতীয় নেতারা ‘অখণ্ড ভারত’ নীতি ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। ভারতের অভ্যন্তরে বহুসংখ্যক স্বাধীন রাষ্ট্রের উপস্থিতি এই নীতি ও আদর্শের বিরোধী ছিল। সদ্য স্বাধীন ভারতের জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি ঘটে।
- প্রজা আন্দোলন – দেশীয় রাজ্যগুলিতে স্বেচ্ছাচারী শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ব্রিটিশ সরকার স্বশাসিত প্রদেশগুলিতে বিভিন্ন শাসনসংস্কার আইন চালু করেছিল। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করে জনগণকে স্বায়ত্তশাসনের উপযোগী করে তোলা হয়। ফলে দেশীয় রাজ্যের প্রজারাও অনুরূপ সুযোগসুবিধার দাবিতে আন্দোলন করলে কংগ্রেস দল তা সমর্থন করে। স্বাধীনতার পর এই বিশাল সংখ্যক জনগণকে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রদানের জন্য দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতভুক্ত করা হয়।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের অবদান কি জার্মানির বিসমার্কের সঙ্গে তুলনীয়?
অথবা, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল কীভাবে ভারতবর্ষকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন?
অথবা, দেশীয় রাজ্যসমূহের ভারতভুক্তির ক্ষেত্রে সর্দার প্যাটেলের কী ভূমিকা ছিল?
বল্লভভাই প্যাটেলের ভূমিকা –
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ছিলেন দৃঢ় চরিত্রের মানুষ। তাঁকে ‘লৌহমানব’ (Iron Man) নামে অভিহিত করা হয়। চারিত্রিক দৃঢ়তা ও কূটনৈতিক বিচক্ষণতাকে কাজে লাগিয়ে বল্লভভাই প্যাটেল দুটি পর্যায়ে শতাধিক দেশীয় রাজ্যকে ভারতভুক্ত করেন। কোনো কোনো রাজ্য বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করে এই সিদ্ধান্ত নেয়, আবার কোনো কোনো রাজ্য জাতীয়তাবাদী মানসিকতা থেকেই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তবে বেশ কতকগুলি রাজ্য নিজের স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখে, আবার ত্রিবাঙ্কুর, ভূপাল, হায়দরাবাদ সরকারিভাবে স্বাধীন মর্যাদার দাবি জানায়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে প্যাটেল –
1947 খ্রিস্টাব্দের 27 জুন সর্দার প্যাটেল State Department -এর অতিরিক্ত দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এই বিভাগের সচিব হন ভি পি মেনন। দেশীয় রাজন্যবর্গের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ভারতীয় সংহতির পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক হতে পারে সেবিষয়ে প্যাটেল যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন।

প্যাটেলের দৃঢ়তা –
প্যাটেল প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সেইসব রাজ্যের রাজন্যবর্গের নিকট ভারতের সঙ্গে সংযুক্তির দাবি জানান, যাদের সঙ্গে ভারতবর্ষের তিনটি বিষয়ে সামঞ্জস্য রয়েছে, যেমন – পররাষ্ট্রনীতি, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ ছাড়াও তিনি প্রচ্ছন্ন হুমকি দেন যে, 15 আগস্টের পর তাঁর পক্ষে দেশীয় রাজ্যের জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভবপর হবে না। আবার একইসঙ্গে তিনি এ কথাও বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, ভারতীয় রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কী কী সুবিধা রয়েছে। দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির জন্য ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন (Instrument of Accession) নামে একটি দলিলও সম্পাদিত হয়।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতে অন্তর্ভুক্তি –
সর্দার প্যাটেলের আবেদনে সাড়া দিয়ে কতকগুলি দেশীয় রাজ্য কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়। যেমন – ভূপাল, কোচবিহার, ত্রিপুরা, মণিপুর প্রভৃতি। আবার এমন রাজ্যও ছিল যেগুলি পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, যেমন – ময়ূরভঞ্জ রাজ্য উড়িষ্যার সঙ্গে এবং বেনারস যুক্তপ্রদেশের সঙ্গে। সুতরাং বলা যেতে পারে, জুনাগড়, জম্মু ও কাশ্মীর এবং হায়দরাবাদ ছাড়া বাকি সব দেশীয় রাজ্য 1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্টের মধ্যে ভারতবর্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়।
বল্লভভাই প্যাটেলের মূল্যায়ন –
প্যাটেলের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও অনমনীয় মনোভাব, স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সচিব ভি পি মেনন -এর কূটকৌশল এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সুষ্ঠু সহযোগিতায় দেশীয় রাজ্যগুলির সংযুক্তি সহজতর হয়। প্যাটেল ও মাউন্টব্যাটেনের পরামর্শক্রমে কয়েকটি ছাড়া প্রায় সকল দেশীয় রাজ্য বিশাল ভাতা, খেতাব ও অন্যান্য সুবিধার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন (Instrument of Accession) নামক ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করে এবং ভারত ইউনিয়নে যোগদান করে। এই সংগঠকের ভূমিকা পালনের জন্য সর্দার প্যাটেলকে ‘লৌহমানব’ আখ্যা দেওয়ার পাশাপাশি জার্মানির ঐক্যবদ্ধকরণের পুরোহিত অটোভন বিসমার্কের সঙ্গেও তুলনা করা হয়। কারণ – জার্মানির সংযুক্তিকরণে বিসমার্কের যা ভূমিকা ছিল, ভারতে দেশীয় রাজ্যগুলির সংযুক্তিকরণে সর্দার প্যাটেলের সেই ভূমিকাই ছিল। বিসমার্কের ‘রক্ত ও লৌহ নীতি’-র দৃঢ়তা সর্দার প্যাটেলের প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যে লক্ষণীয়। তাই তাঁকে ‘ভারতের বিসমার্ক’ বলা হয়; যদিও তা সম্পূর্ণ যথার্থ নয়।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
দেশীয় রাজ্যের ভারতভুক্তির ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতা লাভের পর ভারত যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সংক্রান্ত সমস্যা। ভারতে ব্রিটিশ-আশ্রিত ও স্বাধীন দেশীয় রাজ্যগুলির সংখ্যা ছিল 562টি। ভারতের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কারণে এইসব রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি অত্যন্ত জরুরি ছিল।

বল্লভভাই প্যাটেল ও ভি পি মেননের অবদান –
ভারতের স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় রাজ্যগুলি তাদের স্বাধীনতা দাবি করে। এই পরিস্থিতি শক্ত হাতে মোকাবিলা করেন ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং এই কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেন তাঁর সচিব ভি পি মেনন। বল্লভভাই প্যাটেলের দৃঢ় মনোভাব ও অক্লান্ত চেষ্টার ফলে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি ঘটে। দেশীয় রাজ্যগুলি ভাতা ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা লাভের বিনিময়ে ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন (Instrument of Accession) নামে ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করে। তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তাঁর এই দায়িত্ব পালন করেন।
দেশীয় রাজ্যগুলির সংযুক্তিকরণের পদ্ধতি –
দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। যথা –
- কেন্দ্রীয় সরকার শাসিত অঞ্চলগুলির সঙ্গে দেশীয় রাজ্যগুলির সংযুক্তিকরণ।
- প্রদেশগুলির সঙ্গে দেশীয় রাজ্যগুলির সংযুক্তিকরণ। যেমন – ওড়িশা ও মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সংযুক্তি এবং বোম্বাইয়ের সঙ্গে দাক্ষিণাত্য ও গুজরাটের রাজ্যগুলির সংযুক্তি ঘটে।
- কতকগুলি রাজ্যকে নিয়ে একটি বড়ো রাজ্য গঠন।
ভারতভুক্তির পর দেশীয় রাজ্যগুলির কাঠামোবিন্যাস –
- ক-শ্রেণি (পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্তি) – 216টি দেশীয় রাজ্যকে পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। যেমন – কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে, ময়ূরভঞ্জকে উড়িষ্যার সঙ্গে, বেনারসকে যুক্তপ্রদেশের সঙ্গে, কোলাপুরকে বোম্বাই -এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
- খ-শ্রেণি (যুক্তরাজ্য গঠন) – 278টি দেশীয় রাজ্যকে নিয়ে 8টি প্রদেশ গঠন করা হয় যার মধ্যে অন্যতম হল জম্মু-কাশ্মীর, হায়দরাবাদ ও মহীশূর। অবশিষ্ট দেশীয় রাজ্যকে অন্যান্য 5টি প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এই পাঁচটি প্রদেশ হল রাজস্থান, সৌরাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন ও পেপসু।
- গ-শ্রেণি (সরাসরি কেন্দ্রের অধীনে আনা) – 61টি দেশীয় রাজ্যকে নিয়ে 10টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠন করা হয়। যেমন- দিল্লি, আজমির, ত্রিপুরা ইত্যাদি।
- ঘ-শ্রেণি – আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে পৃথক করে রাখা হয়।
ব্যতিক্রমী রাজ্য –
অধিকাংশ রাজ্য ভারতের সঙ্গে ও কিছু রাজ্য পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হলেও জুনাগড়, হায়দরাবাদ ও জম্মু-কাশ্মীর কোনো রাষ্ট্রে যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকার চেষ্টা করে। বল্লভভাই প্যাটেল দক্ষতার সঙ্গে এই রাজ্যগুলিকে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করেন।
ফরাসি ও পোর্তুগিজ উপনিবেশ –
স্বাধীনতা লাভের পরেও ভারতে কিছু ফরাসি ও পোর্তুগিজ উপনিবেশ ছিল। ফরাসি সরকার 1954 খ্রিস্টাব্দে তাদের উপনিবেশ চন্দননগর, পন্ডিচেরি, মাহে, কারিকল ভারতকে ফিরিয়ে দেয়। পোর্তুগিজ উপনিবেশ গোয়া, দমন, দিউ-কে 1961 খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার ভারতভুক্ত করে।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির মূল্যায়ন –
দেশীয় রাজ্যগুলি অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ভারত একটি বিশাল ও শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ভারতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সুদৃঢ় হয়।
ভারত সরকার কীভাবে দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতীয় ইউনিয়নে সংযুক্ত করার প্রশ্নটি সমাধান করেছিল?
অথবা, স্বাধীনতার পর দেশীয় রাজ্যগুলি কীভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়?
দেশীয় রাজ্যের ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে এবং পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে ভারত কিছু সমস্যারও সম্মুখীন হয়। এই সমস্যা হল দেশীয় রাজ্যগুলির ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত সমস্যা।
দেশীয় রাজ্য সংক্রান্ত সমস্যা –
ভারতবর্ষ সম্পূর্ণভাবে ইংরজেদের দ্বারা শাসিত ছিল না। বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য চুক্তি-সাপেক্ষে দেশীয় শাসকদের দ্বারা শাসিত ছিল। বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থিত এই রাজ্যগুলির আয়তন ছিল ভারতের 48 শতাংশ এবং জনসংখ্যা প্রায় 9 কোটি। মন্ত্রীমিশনের প্রস্তাবে (1946 খ্রিস্টাব্দ) দেশীয় রাজ্যের সমবায় ইউনিয়ন গঠন এবং সেই ইউনিয়নে যোগদান স্বেচ্ছাধীন করা হয়। এর ফলে দেশীয় রাজ্যগুলি স্বাধীন থাকতে মনস্থ করে।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি –
এই অবস্থায় বড়োলাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন -এর সহযোগিতায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল ও স্বরাষ্ট্রসচিব ভি পি মেনন সংযুক্তি দলিল (Instrument of Accession) -এর মাধ্যমে দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করেন। এক্ষেত্রে হুমকি, লোভ ও পুরস্কার এবং যুদ্ধ – এই তিন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। হুমকি, পুরস্কার ও খেতাবের ঘোষণার মাধ্যমে অধিকাংশ রাজ্য ভারতে যোগ দেয়। বাকি থেকে যায় জুনাগড়, হায়দরাবাদ, কাশ্মীর ও কিছু উপনিবেশসমূহ।
দেশীয় রাজ্যের নীতি –
ভারতের ঐক্য ও সংহতির জন্য এরপর যুদ্ধনীতি অবলম্বন করা হয়।
- জুনাগড়ের ভারতভুক্তি – 1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট জুনাগড়ের নবাব পাকিস্তানে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। নেহরু-প্যাটেলের নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী জুনাগড় দখল করে। ফলে 1948 খ্রিস্টাব্দের 20 জানুয়ারি এক গণভোটের মাধ্যমে জুনাগড় ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়।
- হায়দরাবাদের ভারতভুক্তি – নিজাম-শাসিত বিশাল দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদ নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে। ফলে স্বাধীনতার প্রশ্নে হায়দরাবাদ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। অবস্থানগত বিচারে ভারতের পক্ষে কিন্তু তা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে হায়দরাবাদ জাতিপুঞ্জে অভিযোগ জানালে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। নিজাম ভারত সরকারের চরমপত্র উপেক্ষা করলে প্যাটেলের নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী জেনারেল জয়ন্তনাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে হায়দরাবাদে প্রবেশ করে। তিন দিন যুদ্ধের পর নিজামবাহিনী পরাজিত হয় (18 সেপ্টেম্বর, 1948 খ্রিস্টাব্দ)। পরে এক গণভোট দ্বারা হায়দরাবাদ ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়।
- কাশ্মীরের ভারতভুক্তি – ভারতের উত্তরে ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্তে অবস্থিত অপর একটি দেশীয় রাজ্য হল কাশ্মীর। কাশ্মীররাজ হরি সিং স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পাক হানাদাররা কাশ্মীরে প্রবেশ করলে রাজা হরি সিং ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভারত সেই সময়ে সাহায্য করে এবং তার বিনিময়ে কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়। পাক হানাদারদের অধিকৃত অঞ্চল (কাশ্মীরের প্রায় 1/3 অংশ) নিয়ে পাকিস্তান আজাদ কাশ্মীর গঠন করে। শেষপর্যন্ত জাতিপুঞ্জের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়। কাশ্মীর অঞ্চলে ভারত ও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণরেখা (LOC) চিহ্নিত করা হয়।
- উপনিবেশসমূহের অন্তর্ভুক্তি – স্বাধীন ভারতের বেশ কিছু ফরাসি ও পোর্তুগিজ উপনিবেশ অনেক পরে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। 1954 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সরকারের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে চন্দননগর, পন্ডিচেরি, মাহে, কারিকল প্রভৃতি উপনিবেশ ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়। 1961 খ্রিস্টাব্দে সামরিক অভিযানের দ্বারা গোয়া, দমন, দিউ প্রভৃতি পোর্তুগিজ উপনিবেশগুলিকে ভারত পুনরায় দখল করে।
বল্লভভাই প্যাটেলের ভূমিকা –
স্বাধীনতার পরের 2-3 বছরের মধ্যেই অধিকাংশ দেশীয় রাজ্যকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার ক্ষেত্রে লৌহমানবের ভূমিকা নিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, অনমনীয় মনোভাব, দৃঢ় মানসিকতা এবং তাঁর দপ্তরের সচিব ভি পি মেননের কূটনৈতিক দক্ষতা ভারতের ঐক্য ও সংহতিকে সুনিশ্চিত করেছিল। ডঃ সুমিত সরকারের মতে, “ভারতের দ্রুত সমন্বয়সাধন নিশ্চিতভাবে সর্দার প্যাটেলের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব”।
দেশীয় রাজ্যের মূল্যায়ন –
এইভাবে প্রায় সকল দেশীয় রাজ্যকে একসূত্রে গেঁথে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলা সম্ভব হয়।
জুনাগড়ের ভারতভুক্তির বিষয়ে আলোচনা করো।
জুনাগড়ের ভারতভুক্তির ভূমিকা –
কাথিয়াবাড় উপদ্বীপের সৌরাষ্ট্র উপকূলে অবস্থিত একটি ছোটো দেশীয় রাজ্য হল জুনাগড়। রাজ্যটির অতীত ঐতিহ্য, অবস্থান, আর্থিক সমৃদ্ধি তাকে বিশেষ পরিচিতি দান করে।
স্বাধীনতা-উত্তর পরিস্থিতি –
- সংযুক্তি দলিল – ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর জুনাগড় বাদে কাথিয়াবাড় অঞ্চলের সব দেশীয় রাজ্য সংযুক্তি দলিল দ্বারা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
- জনসংখ্যা – জুনাগড় রাজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ জনগণ ছিল হিন্দু। কিন্তু রাজ্যের শাসক অর্থাৎ নবাব ছিলেন মুসলমান।
জুনাগড়ের কংগ্রেস নেতৃত্ব –
অন্যান্য দেশীয় রাজ্যের মতো এই রাজ্যেও কংগ্রেসের সমর্থক ছিল। রাজ্যের বাইরে বোম্বাইতে তারা সামাল দাস গান্ধির নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠন করেছিল।
জুনাগড়ের নবাবের সিদ্ধান্ত –
জুনাগড়ের নবাবের দেওয়ান ছিলেন স্যার শাহনওয়াজ ভুট্টো। তিনি মুসলিম লিগ -এর উগ্র সমর্থক ছিলেন। তাঁর প্রভাবে নবাব মুসলিম লিগের পক্ষ নিয়েছিলেন। ফলস্বরূপ, 1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট নবাব পাকিস্তানে যোগদানের সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেন।
জুনাগড়ের নবাবের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া –
এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় –
- গণ আন্দোলন – সিদ্ধান্ত ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জুনাগড় রাজ্যের হিন্দু প্রজারা বিক্ষোভ দেখায়। রাজ্যের বাইরে কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হয়।
- দেশীয় রাজ্যের চাপ – কাথিয়াবাড় অঞ্চলের অন্যান্য দেশীয় রাজ্যগুলি যারা ইতিমধ্যে ভারতে যোগ দিয়েছিল, তারা ভারত সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। তাদের বক্তব্য ছিল, এ বিষয়ে ভারত সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।
জুনাগড়ের সেনা অভিযান –
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী জুনাগড়ে প্রবেশ করে। নবাব এই সময় সপরিবারে পাকিস্তানে আশ্রয় নেন। দেওয়ান শাহনওয়াজ ভুট্টো পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করেন। জুনাগড়ের সামরিক শক্তি দুর্বল ছিল। তিনি পাকিস্তানের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক কারণে পাকিস্তানের সাহায্য পাঠানো সম্ভব ছিল না। ফলে জুনাগড়ের পরাজয় ও পতন ঘটে।
জুনাগড়ের সংযুক্তি –
1948 খ্রিস্টাব্দের 20 ফেব্রুয়ারি এরপর জুনাগড়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। এই গণভোটের দ্বারাই জুনাগড়ের ভারতভুক্তি অনুমোদিত হয় (জানুয়ারি, 1949 খ্রিস্টাব্দ)।
জুনাগড়ের ভারতভুক্তির মূল্যায়ন –
এইভাবে জুনাগড় রাজ্যের ভারতভুক্তি ঘটে। ভারতের ঐক্য ও সংহতি আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়।
কাশ্মীরের ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা করো।
কাশ্মীরের ইতিহাসের ভূমিকা –
প্রচলিত লোককথা অনুযায়ী কাশ্মীর কথাটির আক্ষরিক অর্থ শুষ্কভূমি। কলহনের লেখা ‘রাজতরঙ্গিনী’ নামক কাশ্মীরের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, একসময় কাশ্মীরে কার্কোট নাগ বংশের রাজারা রাজত্ব করতেন।
কাশ্মীরের ব্রাহ্মণ বসতি –
রাজতরঙ্গিনী অনুযায়ী একসময় কাশ্মীর উপত্যকায় ছিল প্রচুর হ্রদ। পুরাণ থেকে জানা যায়, কাশ্মীর এলাকায় একসময় ব্রাহ্মণেরা বাস করতেন। তবে পরবর্তীকালে এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ও শৈব ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে।
কাশ্মীরে মধ্যযুগে মুসলিম শাসন –
মধ্যযুগে কাশ্মীরে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম ধর্মেরও ব্যাপক প্রসার ঘটে। এসময় জম্মু ও লাদাখ অঞ্চল বাদ দিয়ে সমগ্র কাশ্মীর এলাকায় মুসলিমরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। 1349 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শাহ মির কাশ্মীরে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন, যা অন্তত 500 বছর স্থায়ি হয়েছিল।
মুঘল শাসন ও দুরানি আধিপত্য –
1526 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1771 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাশ্মীরে মুঘল আধিপত্য বজায় ছিল। এরপর উপজাতি দুরানি বংশের নেতাদের আধিপত্য এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়।
কাশ্মীরের পরিবর্তিত শাসনাধিকার –
1820 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ পাঞ্জাবের শিখ ধর্মাবলম্বী মহারাজা রণজিৎ সিংহ দুরানি বংশের শাসনের অবসান ঘটিয়ে কাশ্মীর দখল করেন। অন্যদিকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কাশ্মীর দখল করে এবং 1846 খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীরকে জম্মুর হিন্দুরাজা গুলাব সিং -এর কাছে বিক্রি করে দেয়। এর পরবর্তীকালে প্রায় এক শতাব্দী ও তার বেশিকাল ধরে কাশ্মীর শাসিত হতে থাকে হিন্দুরাজাদের দ্বারা। 1925 খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীরের মহারাজা হন ইন্দর মহিন্দর হরি সিং বা হরি সিং।
কাশ্মীরের গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় রাজ্য –
ঔপনিবেশিক শাসনকালে কাশ্মীর ব্রিটিশদের অনুগত থাকায় ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের সময়ে কাশ্মীর হয়ে ওঠে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় রাজ্য।
পাকিস্তানের কাশ্মীর আক্রমণ –
এই অবস্থায় 1947 খ্রিস্টাব্দের 22 অক্টোবর পাকিস্তানের মদতপুষ্ট হানাদার বাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে হত্যা, লুঠ ও নির্যাতন-সহ ব্যাপক হিংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু করে। মহারাজা হরি সিং রাজধানী শ্রীনগর থেকে পালিয়ে এসে 24 অক্টোবর ভারত সরকারের কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভারত সরকার জানায় যে, মহারাজা ভারতভুক্তির দলিলে (Instrument of Accession) স্বাক্ষর করলে তবেই ভারত কাশ্মীরে সেনা পাঠাবে।
কাশ্মীরের ভারতভুক্তি –
মহারাজা হরি সিং 1947 খ্রিস্টাব্দের 26 অক্টোবর ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করলে কাশ্মীরের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্স তা সমর্থন করে। 31 অক্টোবর কাশ্মীরে ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা শেখ আবদুল্লার নেতৃত্বে আপৎকালীন শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।
কীভাবে কাশ্মীর সমস্যার সৃষ্টি হয়?
অথবা, কাশ্মীর সমস্যার বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করো।
কাশ্মীর সমস্যার ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির সমস্যা। এর মধ্যে সবচেয়ে জটিল সমস্যা সৃষ্টি হয় কাশ্মীরের ভারতভুক্তি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে যে সমস্যার আজ পর্যন্ত সুষ্ঠু সমাধান করা সম্ভব হয়নি।
কাশ্মীর সমস্যার সূচনা –
ভারতের স্বাধীনতা লাভের সময় কাশ্মীরের রাজা ছিলেন হরি সিং। ভারত ও পাকিস্তান নিজ নিজ দেশে হরি সিং-কে যোগদানের আবেদন জানান। কিন্তু মহারাজা হরি সিং কোনো দেশে যোগদান না করে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র থাকার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন।
অপরদিকে কাশ্মীরের প্রধান রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্স -এর নেতা শেখ আবদুল্লা কাশ্মীরের ভারতভুক্তির জন্য আন্দোলন করেন।

পাকিস্তানের কাশ্মীর আক্রমণ –
এই অবস্থায় 1947 খ্রিস্টাব্দের 22 অক্টোবর পাকিস্তানের মদতপুষ্ট হানাদার বাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে হত্যা, লুঠ ও নির্যাতন-সহ ব্যাপক হিংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু করে। এই অবস্থায় মহারাজা হরি সিং রাজধানী শ্রীনগর থেকে পালিয়ে এসে 24 অক্টোবর ভারত সরকারের কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভারত সরকার জানায় যে, মহারাজা ভারতভুক্তির দলিলে (Instrument of Accession) স্বাক্ষর করলে তবেই ভারত কাশ্মীরে সেনা পাঠাবে।
কাশ্মীরের ভারতভুক্তি –
মহারাজা হরি সিং 26 অক্টোবর ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করলে কাশ্মীরের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্স তা সমর্থন করে।
ভারতীয় সেনার অভিযান –
26 অক্টোবরের মধ্যে পাক হানাদার বাহিনী শ্রীনগরের 40 মাইলের মধ্যে এসে পৌঁছোয়। 27 অক্টোবর প্রায় 100টি বিমানে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে অবতরণ করে। তারা হানাদারদের বিতাড়িত করে কাশ্মীরের দুই-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড উদ্ধার করে। 31 অক্টোবর কাশ্মীরে শেখ আবদুল্লার নেতৃত্বে আপৎকালীন শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।
এর বিরোধিতা করে পাকিস্তান তার দখলীকৃত কাশ্মীরে আজাদ কাশ্মীর নামে একটি সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠা করে।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে কাশ্মীর সমস্যা –
লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পরামর্শে ভারত 1947 খ্রিস্টাব্দের 31 ডিসেম্বর জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর সমস্যা উত্থাপন করে। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর 1948 খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে নিরাপত্তা পরিষদ কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে।
কাশ্মীর সমস্যার মূল্যায়ন –
1948 খ্রিস্টাব্দের 31 ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদ কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি সীমারেখা (LOC) চিহ্নিত করে। ফলে পাক হানাদার অধিকৃত কাশ্মীর পাকিস্তানের দখলে থেকে যায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কাশ্মীর সমস্যার কোনো সুষ্ঠু সমাধান হয়নি।
কাশ্মীর বিতর্কে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ভূমিকা কী ছিল?
কাশ্মীর বিতর্কের ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়। ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী দেশীয় রাজ্যগুলির স্বাধীন থাকার অধিকার ছিল। এই অধিকারবলে দেশীয় রাজ্য কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং স্বাধীনতা বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু রাজ্যটি মুসলিম অধ্যুষিত এবং পাকিস্তানের প্রতিবেশী হওয়ার জন্য পাকিস্তান কাশ্মীর দখলে আগ্রহী হয়। পাকহানা কাশ্মীরের ভারতভুক্তি সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে।
কাশ্মীর বিতর্কে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের –
কাশ্মীর বিতর্কে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্বে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সমস্যাসমাধানের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। এগুলি ছিল নিম্নরূপ –
- যুদ্ধবিরতি – পাকিস্তান কাশ্মীর দখলের জন্য পাঠান উপজাতি হানাদারদের পাঠায়। এই হানাদাররা কাশ্মীরের বহু অঞ্চল দখল করে রাজধানী শ্রীনগরের উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়। আত্মরক্ষার জন্য কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করেন। ভারত সরকার সমস্যাটি সমাধানের জন্য সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে আবেদন জানায়। জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভায় কাশ্মীর প্রশ্নে বিতর্ক শুরু হলে পাকিস্তানের প্রতিনিধি স্যার জাফরুল্লা খান বলেন, কাশ্মীরে প্রবেশ করেছে পাঠান উপজাতিরা, তারা বেসরকারি ব্যক্তি। তাই এই ঘটনার জন্য পাকিস্তান সরকার কোনোভাবে দায়ী নয়। যেহেতু পাক সেনাবাহিনী এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয় তাই পাকিস্তান আক্রমণকারী নয়। এর বিরুদ্ধে ভারতীয় প্রতিনিধি বলেন, যেহেতু এই হানাদাররা পাকিস্তান থেকে কাশ্মীরে প্রবেশ করেছে তাই এই ঘটনার জন্য পাকিস্তান দায়ী। এরপর ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরে পৌঁছোলে পাকবাহিনী হানাদারদের সঙ্গে যোগ দেয়। এর ফলস্বরূপ ভারত-পাক যুদ্ধ শুরু হয়। তখন জাতিপুঞ্জ কাশ্মীরে প্রতিনিধি পাঠায় এবং যুদ্ধ বন্ধ করে (31 ডিসেম্বর, 1948 খ্রিস্টাব্দ)।
- গণভোটের প্রস্তাব গ্রহণ – এরপর কাশ্মীর সমস্যাসমাধানের জন্য জাতিপুঞ্জ কোরিয়া ও ভিয়েতনাম -এর অনুকরণে কাশ্মীরে গণভোট গ্রহণের প্রস্তাব পাস করে। অ্যাডমিরাল নিমিজ-কে গণভোট গ্রহণের দায়িত্ব দেয়।
- কমিশন প্রেরণ – কাশ্মীরে হানাদার প্রবেশ বন্ধ করা, দুই দেশের সৈন্য অপসারণ করা, স্থিতাবস্থা বজায় রাখা, গণভোটের উপযুক্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ম্যাকনাটেন, গার্নার জেরিং কমিশন পাঠায়।
- LOC নির্ধারণ – দুই দেশ সৈন্য অপসারণ না করায় এবং গণভোট গৃহীত না হওয়ায় পাক-অধিকৃত ও ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মধ্যে নিয়ন্ত্রণরেখা (Line of Control) চিহ্নিত করে। এই সীমারেখা বরাবর জাতিপুঞ্জের প্রতীক চিহ্নিত কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে।
কাশ্মীর বিতর্কে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মন্তব্য –
কাশ্মীর সমস্যাটি জাতিপুঞ্জের বিভিন্ন সভায় আলোচিত হওয়ায় একটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়। দ্বিপাক্ষিক আলোচনার দ্বারা সমস্যাসমাধানের বহু চেষ্টা হলেও তার আজ অবধি সুষ্ঠু সমাধান হয়নি।
হায়দরাবাদের ভারতভুক্তি সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, হায়দরাবাদ রাজ্যটি কীভাবে ভারতভুক্ত হয়েছিল?
হায়দরাবাদের ভারতভুক্তির ভূমিকা –
ভারত ভূখণ্ড দ্বারা বেষ্টিত 82 হাজার বর্গমাইল এলাকাবিশিষ্ট হায়দরাবাদ রাজ্যটি ছিল ভারতের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ দেশীয় রাজ্য। এই রাজ্যের 87 শতাংশ প্রজা ছিল হিন্দু এবং শাসক নিজাম ছিলেন মুসলিম। নিজামের অপশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা লাভের পর হায়দরাবাদকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নিজাম ওসমান আলি খানের কাছে ভারত সরকার আবেদন করে। কিন্তু নিজাম হায়দরাবাদের জনগণ ও ভারত সরকারের কথায় কর্ণপাত না করে স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ভারতের নিরাপত্তা ও সংহতির কারণে হায়দরাবাদের স্বাধীনতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।
হায়দরাবাদের ভারতভুক্তির নিজামের কার্যকলাপ –
এই সময় নিজাম মজলিস-ইত্তিহাদ- উল-মুসলিমিন নামে এক উগ্র সাম্প্রদায়িক ও ভারতবিদ্বেষী সংস্থার নেতা কাশিম রিজভির কুপরামর্শে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। নিজাম রিজভির নেতৃত্বে ও সামরিক বাহিনীর মদতে রাজাকার নামে একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক সশস্ত্র দাঙ্গাবাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনী ভারত সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের উপর অত্যাচার চালাতে থাকে। এখানে পাকিস্তান থেকে অস্ত্রশস্ত্র আসতে থাকে এবং রিজভি মুসলিম জনগণকে জেহাদ ঘোষণার আহ্বান জানান।

হায়দরাবাদে বিদ্রোহ –
- 1946 খ্রিস্টাব্দে হায়দরাবাদ রাজ্যের তেলেঙ্গানার কৃষকরা নিজামের কুশাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে।
- 1947 খ্রিস্টাব্দের 7 আগস্ট হায়দরাবাদ রাজ্য কংগ্রেস প্রশাসনের গণতন্ত্রীকরণের জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করে। নিজাম 20 হাজার সত্যাগ্রহীকে বন্দি করে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে।
হায়দরাবাদের ভারতভুক্তি –
এই সময় পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠলে 1948 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত সরকার নিজামকে এক চরমপত্র দেয়। ভারত সরকার অন্যান্য দাবির সঙ্গে অত্যাচারী রাজাকার বাহিনী ভেঙে দেওয়ার দাবি জানায়। নিজাম ভারতের দাবি উপেক্ষা করলে 1948 খ্রিস্টাব্দের 13 সেপ্টেম্বর জেনারেল জয়ন্তনাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দরাবাদে প্রবেশ করে। ভারত 18 সেপ্টেম্বর হায়দরাবাদ রাজ্য দখল করে। 1949 খ্রিস্টাব্দে নিজাম ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করেন। 1950 খ্রিস্টাব্দের 26 জানুয়ারি হায়দরাবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতভুক্ত হয়।

হায়দরাবাদের ভারতভুক্তির মূল্যায়ন –
হায়দরাবাদের ভারতভুক্তি ভারতের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি ছিল। 1956 খ্রিস্টাব্দে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের সময় হায়দরাবাদ রাজ্যকে তিনটি অংশে ভাগ করা হয় এবং এই অংশগুলিকে অন্ধ্র, বোম্বাই ও মহীশূর রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। হায়দরাবাদ রাজ্যের ভারতভুক্তি প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র বলেছেন, ‘হায়দরাবাদের ঘটনা ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার জয় সূচিত করে।’ কারণ হায়দরাবাদ ও অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানরা নিজামের শাসনের বিরুদ্ধে ভারত সরকারকে সমর্থন করে।
কীভাবে ফরাসি ও পোর্তুগিজ উপনিবেশগুলির ভারতভুক্তি ঘটে?
ফরাসি ও পোর্তুগিজ উপনিবেশের ভারতভুক্তির ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতে অন্তর্ভুক্তি ছাড়াও ফরাসি ও পোর্তুগিজ উপনিবেশগুলির ভারতভুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এইসব উপনিবেশগুলির মধ্যে চন্দননগর, মাহে, কারিকল, পন্ডিচেরি ইত্যাদি ছিল ফরাসি উপনিবেশ। অপরদিকে পোর্তুগিজ উপনিবেশগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল – দমন, দিউ, দাদরা ও নগর হাভেলি। এগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার বিশেষ প্রয়োজন ছিল।
ফরাসি উপনিবেশগুলির ভারতভুক্তি –
1948 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে বলা হয় যে, ভারত ভূখণ্ডে অবস্থিত ফরাসি উপনিবেশগুলির ভারতভুক্তি হবে কি না তা ঠিক হবে গণভোটের মাধ্যমে। এর ফলে –
- 1949 খ্রিস্টাব্দে চন্দননগর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
- 1954 খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে পন্ডিচেরি ও কারিকল গণভোটের মাধ্যমে ভারতে যোগ দেয়।
পোর্তুগিজ উপনিবেশগুলির ভারতভুক্তি –
- 1954 খ্রিস্টাব্দে আজাদ গোমন্তক দল বিদ্রোহের মাধ্যমে দাদরা ও নগর হাভেলির ক্ষমতা দখল করে। এগুলিকে ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত করার বিশেষ প্রয়োজন ছিল।
- 1961 খ্রিস্টাব্দে দাদরা ও নগর হাভেলিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রূপে ঘোষণা করা হয়। তবে গোয়ার ভারতভুক্তির দাবিকে পোর্তুগাল কঠোর হাতে দমন করে।
- এমতাবস্থায় জেনারেল জয়ন্তনাথ চৌধুরী-র নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী 1961 খ্রিস্টাব্দে গোয়া আক্রমণ করে এবং পরাজিত গোয়া ভারতভুক্তির চুক্তিস্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এরপর দমন ও দিউ ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়।
ফরাসি ও পোর্তুগিজ উপনিবেশের ভারতভুক্তির উপসংহার –
এইভাবে ফরাসি ও পোর্তুগিজ উপনিবেশগুলির ভারতভুক্তি সম্পূর্ণ হয়।
সীমানা কমিশন ও তার রিপোর্টের ভিত্তিতে পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাজনের প্রসঙ্গটি বিশ্লেষণ করো।
পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাজনের ভূমিকা –
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে দেশভাগ -এর ঘটনা জড়িত ছিল। এই দেশভাগ প্রক্রিয়ার অংশ ছিল পাঞ্জাব ও বাংলা প্রদেশ ভাগ করা। মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুসারে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ -এর সভাপতিত্বে গঠিত সীমানা কমিশন পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগ করে।
সীমানা কমিশন –
মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনায় ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে ভাগ করে ‘ডোমিনিয়ন’ মর্যাদাসম্পন্ন দুটি রাষ্ট্র (ভারত ও পাকিস্তান) প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। এই দেশভাগ প্রক্রিয়ার অংশ ছিল পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগ। কারণ – এই প্রদেশ দুটি শিখ ও মুসলিম এবং হিন্দু ও মুসলিম অধ্যুষিত ছিল। এজন্য দুই প্রদেশের বিভাজন ও দুই রাষ্ট্রের সীমা নির্ধারণের জন্য একটি সীমানা কমিশন (Boundary Commission) গঠনের কথা বলা হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা পাস করলে (4 জুলাই, 1947 খ্রিস্টাব্দ) একটি সীমানা কমিশন গঠিত হয়। স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ এই কমিশনের সভাপতি হন।
সীমানা কমিশনের রিপোর্ট –
ভারত ভাগ করে পাকিস্তান (পূর্ব ও পশ্চিম) প্রতিষ্ঠা ও সীমানা নির্ধারণের জন্য সীমানা কমিশন পাঞ্জাব ও বাংলা দুই অঞ্চলে আলাদা আলাদাভাবে কাজ শুরু করে। মাত্র ছয় সপ্তাহ সময়ের মধ্যে কমিশন রিপোর্ট তৈরি করে। এই রিপোর্টের ভিত্তি ছিল জনগণনা (1941 খ্রিস্টাব্দ), জেলা-ব্লক ও মৌজাওয়াড়ি জনবিন্যাস, হিন্দু-মুসলিম-শিখ প্রভৃতি ধর্মীয় গোষ্ঠীর বসবাস, প্রাকৃতিক সীমারেখা – যেমন, নদী, শাখা ও উপনদী, জলাভূমি, পাহাড়-পর্বত, বনভূমি, মরুভূমি, পথ-পরিবহণ (রেল ও সড়ক), প্রশাসনিক কেন্দ্র জেলা-শহর, ব্লক, থানা, ইউনিয়ন প্রভৃতি।
সীমানা কমিশনের রিপোর্ট কার্যকর –
এই সমস্ত উপাদানের ভিত্তিতে সীমানা কমিশন রিপোর্ট তৈরি ও পেশ করে। এর দ্বারা ব্রিটিশ আমলের প্রাদেশিক সীমানা বজায় থাকে। বোম্বাই প্রদেশ ও সিন্ধু প্রদেশের সীমানা, রাজস্থান ও সিন্ধু প্রদেশের সীমানা আন্তর্জাতিক সীমানা হয়। এর সঙ্গে বিভাজিত পাঞ্জাবের মুসলিম-প্রধান পশ্চিম অংশ (লাহোর-সহ) পশ্চিম পাকিস্তান নামে পরিচিত হয়। আর দেশীয় রাজ্য ত্রিপুরা-বাংলা সীমানা, শ্রীহট্ট জেলা বাদে আসাম-বাংলা সীমানা ইত্যাদি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ব সীমানা এবং বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের হিন্দু অধ্যুষিত জেলাগুলির পূর্ব সীমানা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিম সীমানা নির্ধারিত হয়। কলকাতা পশ্চিমবাংলায় থাকে।
- পাঞ্জাব – ধর্মের ভিত্তিতে পাঞ্জাব আইনসভার সদস্যরা প্রদেশের বিভাজন করেন। অবিভক্ত পাঞ্জাবের 62 শতাংশ অঞ্চল ও 60 শতাংশ জনগণ (মুসলিম) নিয়ে পশ্চিম পাঞ্জাব এবং 38 শতাংশ অঞ্চল ও 40 শতাংশ জনগণ (শিখ ও হিন্দু) নিয়ে পূর্ব পাঞ্জাব – এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়। পশ্চিম পাঞ্জাব পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে এবং পূর্ব পাঞ্জাব ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়। পশ্চিম পাঞ্জাবে 45 লক্ষ এবং পূর্ব পাঞ্জাবে 60 লক্ষ সংখ্যালঘু থেকে যায়।
- বাংলা – পাঞ্জাবের মতো বাংলার আইনসভার সদস্যরা ধর্মের ভিত্তিতে প্রদেশ বিভাজনে সম্মতি দেন। অবিভক্ত বাংলার 36 শতাংশ অঞ্চল ও 35 শতাংশ জনগণ নিয়ে পশ্চিমবাংলা এবং 64 শতাংশ অঞ্চল ও 65 শতাংশ জনগণ নিয়ে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান গড়ে ওঠে। এর সঙ্গে শ্রীহট্ট জেলা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। পূর্ব বাংলায় 22 শতাংশ এবং পশ্চিমবাংলায় 19 শতাংশ সংখ্যালঘু থেকে যায়।
সীমানা কমিশনের বিতর্ক –
লাহোরের উপর ভারত দাবি জানালে কলকাতার উপর পাকিস্তান দাবি জানায়। শেষে লাহোর পাকিস্তান এবং কলকাতা ভারত লাভ করে। পূর্ব পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলা এবং পশ্চিমবাংলার মালদহ, নদীয়া ও মুরশিদাবাদ জেলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তা ভারতের অংশ হয়। একইভাবে পূর্ব পাকিস্তানের খুলনা, চট্টগ্রাম জেলা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তা পাকিস্তানে থাকে।
এই সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে অনেক অভিযোগ ওঠে। জওহরলাল নেহরু-সহ অন্যান্য নেতারা সীমানা কমিশনের কাজ সম্পর্কে বড়োলাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন -এর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ও হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেন। কিন্তু বড়োলাট কোনো অভিযোগের প্রতিকার করেননি।
সীমানা কমিশনের মন্তব্য –
পেশায় আইনজীবী, ভারত সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের কাজকর্মে বহু ত্রুটি থাকলেও খুব কম সময়ের মধ্যে এই দুরূহ কাজটি তিনি সম্পূর্ণ করেন। অনেক ছিটমহল সৃষ্টি হলেও বিনিময়ের মাধ্যমে তার সমাধানের চেষ্টা হয়।
কী কারণে পাঞ্জাব দ্বিধাবিভক্ত হয়?
পাঞ্জাব বিভাগের ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। ভারত বিভাজনের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। সেই সূত্রে পাঞ্জাব প্রদেশ বিভক্ত হয়।
পাঞ্জাব বিভাগের কারণ –
- মুসলিম প্রাধান্য – পাঞ্জাব প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে মুসলিমরা সংখ্যায় বেশি ছিল। আর পূর্বাঞ্চলে শিখ ও হিন্দুরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।
- রাজনৈতিক সংকট – 1946 খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে পাঞ্জাব বিধানসভার 175টি আসনের মধ্যে মুসলিম লিগ 79টি আসনে জয়ী হয়। ইউনিয়নিস্ট পার্টি 10টি আসনে জয়ী হয়। কংগ্রেস ও আকালি দল উল্লেখযোগ্য আসন পায়। খিজির হায়াৎ খানের জোট সরকার (ইউনিয়নিস্ট, কংগ্রেস, আকালি) মুসলিম লিগের অনাস্থার ফলে ক্ষমতা হারায়।
- দাঙ্গাহাঙ্গামা – 1946-1947 খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তীব্র হয়ে ওঠে। অসংখ্য মানুষের জীবনহানি ঘটে এবং সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
- বিধায়কদের সম্পত্তি – এই পরিস্থিতিতে মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুসারে পাঞ্জাব বিধানসভার বিধায়করা প্রদেশের বিভাজনের পক্ষে ভোট দেন।
পাঞ্জাব বিভাগের মন্তব্য –
এই সমস্ত বিভিন্ন কারণ পাঞ্জাব বিভাজনের জন্য দায়ী ছিল। সিরিল র্যাডক্লিফ সীমানা কমিশনের মাধ্যমে পাঞ্জাব ভাগ করেন।
দেশবিভাগ (1947 খ্রিস্টাব্দ) জনিত উদবাস্তু সমস্যা – সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো।
অথবা, 1947 খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের পরবর্তীকালে ভারতে উদবাস্তু সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করো।
দেশবিভাগ (1947 খ্রিস্টাব্দ) জনিত উদবাস্তু সমস্যার ভূমিকা –
1946 খ্রিস্টাব্দের 16 আগস্ট মুসলিম লিগ -এর প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও উদবাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়। 1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট দেশভাগ ও ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর উদবাস্তু সমস্যা প্রবল আকার ধারণ করে।
দেশবিভাগ (1947 খ্রিস্টাব্দ) জনিত উদবাস্তু সমস্যা –
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ভারতে উদবাস্তু সমস্যার কারণ ও প্রকৃতি ছিল নিম্নরূপ –
- দেশভাগ – ভারত বিভক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। ভারতবিভাজনের অংশ হিসেবে পাঞ্জাব ও বাংলা বিভক্ত হয়। ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন হওয়ায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিম পাঞ্জাবের শিখরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। একইভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলায় হিন্দুরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। এ ছাড়া সিন্ধু প্রদেশের হিন্দুরা সংখ্যালঘু ছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নিরাপত্তার অভাববোধের জন্য তারা ভারতে উদবাস্তু হয়ে চলে আসে। এদের সংখ্যা ছিল প্রায় 2 কোটি।
- ভারতের জনসংখ্যাবৃদ্ধি – দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় 1 কোটি মানুষ উদবাস্তু হয়ে পড়ে। এরা পায়ে হেঁটে, গোরুর গাড়িতে, ট্রেনে, নৌকায় বিভিন্নভাবে পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসে। এর ফলে ভারতের জনসংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে।
- আশ্রয়দান – পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা বিপুল সংখ্যক উদবাস্তুদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা ছিল প্রথম কাজ। উদবাস্তুরা বড়ো-ছোটো রেলস্টেশনে, ফাঁকা জায়গায় থাকতে শুরু করে। যাদের সঙ্গে কিছু অস্থাবর সম্পদ (টাকা, সোনা) ছিল তারা বাড়ি কিনে নেয় বা বাড়ি ভাড়া করে। যাদের তেমন কিছুই ছিল না তারা দিনের বেলা কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়াত, জনমজুরের কাজ করত আর রাতে স্টেশন চত্বরে বা ফাঁকা জায়গায় থাকত।
- ত্রাণ ও পুনর্বাসন – পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী ভারতের রাজ্যগুলিতে উদবাস্তুরা আশ্রয় নেয়। এর ফলে স্থানীয় জনসংখ্যার উপর চাপ পড়ে ও বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। এজন্য কেন্দ্রীয় সরকার উদবাস্তু সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে ত্রাণ ও পুনর্বাসন নীতি গ্রহণ করে। পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লি, রাজস্থান, পশ্চিমবাংলা, আসাম ও ত্রিপুরায় সরকারি উদ্যোগে আশ্রয় শিবির, খাদ্য সরবরাহ, অর্থ সাহায্য ও নিরাপত্তা দেওয়া হয়। তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
- অর্থনৈতিক সমস্যা – উদবাস্তুরা আসার ফলে তাদের খাওয়াপরা ও কর্মসংস্থান করার জন্য ভারতের অর্থনীতিতে প্রবল চাপ পড়ে। উদবাস্তুদের চাপ সামলানোর জন্য ভারত সরকারকে বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়।
- স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধ – ভারতে আসা উদবাস্তুদের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের নানারকম বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। তারা স্থানীয় জনগণের কাজে ভাগ বসিয়েছিল। তা ছাড়া তাদের ধর্ম, ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ এক হলেও সংস্কৃতিগত পার্থক্য ছিল। এর ফলে পাকিস্তান থেকে আগত মানুষদের সঙ্গে বাংলা ও পাঞ্জাবের মানুষের মেলবন্ধন ঘটেনি। উভয়ের পৃথক সত্তা বজায় ছিল।
- আন্তঃডোমিনিয়ন সম্মেলন – উদবাস্তু সমস্যার ভয়াবহতার জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরকারি স্তরে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (এপ্রিল, 1948 খ্রিস্টাব্দ)। হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা এবং দাঙ্গা না হওয়া এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল।
- দিল্লি চুক্তি – 1947 খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের পর পাকিস্তান থেকে উদবাস্তু স্রোত ভারতে প্রবেশ করতে থাকে। এই উদবাস্তু স্রোত নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নেহরু ও লিয়াকৎ আলি খানের মধ্যে দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় (এপ্রিল, 1950 খ্রিস্টাব্দ)। সংখ্যালঘুদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকা, প্রতিকার প্রার্থনা, দাঙ্গা রোধ করা, উদবাস্তু হতে না দেওয়া, দেশত্যাগীদের সম্পত্তি-সহ আসার ক্ষেত্রে আইনগত সাহায্য করা এই চুক্তির বিষয়বস্তু ছিল। এইভাবে ভারতে উদবাস্তু সমস্যার ভয়াবহতা সৃষ্টি হয়।
দেশভাগ – পরবর্তী সময়ে ভারতের উদবাস্তু সমস্যার ক্ষেত্রে দু-ধরনের নীতি ছিল কেন?
দেশভাগের পর উদবাস্তু সমস্যার ভূমিকা –
দেশভাগের ফলে বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের হিন্দু-শিখ সম্প্রদায়ের মানুষরা উদবাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। ফলে উদবাস্তু সমস্যা প্রবল আকার ধারণ করে। উদবাস্তু সমস্যার ক্ষেত্রে দু-ধরনের নীতি গ্রহণের কারণ –
পাঞ্জাব –
- পুনর্বাসন – পশ্চিম ভারতের মুসলমানরা প্রচুর জমি-বাড়ি ফেলে পশ্চিম পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। ফলে সেখানকার হিন্দু-শিখ উদবাস্তুদের মধ্যে তা বণ্টন করা সম্ভব হয়। পূর্ব পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমেও বহু মানুষকে পুনর্বাসন দেওয়া হয়।
- ত্রাণ – দোকানপাট, আবাসন, ব্যাবসাবাণিজ্য গড়ে তোলার জন্য সরকারি সাহায্য দেওয়া হয়।
- নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তি – উদবাস্তু স্রোত নিয়ন্ত্রণের জন্য যে নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে তা ফলপ্রসূ হয়।
বাংলা –
- পূনর্বাসন – পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু উদবাস্তুরা ভাষাগত মিল ও অন্যান্য কারণে আসাম, ত্রিপুরার চেয়ে পশ্চিমবাংলায় বেশি সংখ্যায় আশ্রয় নেয়। উদবাস্তুর চাপ বেশি থাকায় আন্দামান ও দণ্ডকারণ্যে বহু মানুষকে পাঠানো হয়। ফলে তাদের মধ্যে জমি বণ্টন করা হয়নি।
- ত্রাণ – পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় আবাসন প্রকল্প, কলোনি (অশোকনগর, কল্যাণী, দুর্গাপুর) গড়ে তোলেন। শিল্পে, সরকারি কাজে কর্মীনিয়োগের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সাহায্যের পরিমাণ ছিল প্রয়োজনের তুলনায় কম।
- উদবাস্তু স্রোত – নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তি বাংলায় ফলপ্রসূ না হওয়ায় উদবাস্তু স্রোত অব্যাহত থাকে।
দেশভাগের পর উদবাস্তু সমস্যার মন্তব্য –
এই সমস্ত কারণে দেশভাগের পর উদবাস্তু সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে দুই অঞ্চলে (পাঞ্জাব ও বাংলা) দুই ধরনের নীতি দেখা যায়।
পাকিস্তান থেকে পাঞ্জাবে আগত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনের বিষয়টি পর্যালোচনা করো।
পাকিস্তান থেকে পাঞ্জাবে আগত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনের ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট বিভাজনের মাধ্যমে ভারত স্বাধীন হয়। পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধুপ্রদেশ, বালুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান গঠিত হয়। সাম্প্রদায়িক হানাহানির কারণে এখানকার শিখ ও হিন্দুরা ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব ও তার পাশাপাশি অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। এইরূপ পরিস্থিতিতে সরকার এদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে।
পাকিস্তান থেকে পাঞ্জাবে আগত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন –
পাকিস্তান থেকে পাঞ্জাবে আসা উদবাস্তুদের পুনর্বাসনের কাজ সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত হয়।
জমি বণ্টন –
পূর্ব পাঞ্জাব ও পাশাপাশি অঞ্চলের মুসলমানরা নিজেদের জমিজমা, সম্পত্তি ফেলে পাকিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেই জমি পাকিস্তান থেকে আসা উদবাস্তুদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এই উদবাস্তুদের একটি বড়ো অংশ ছিল কৃষিজীবী। প্রথমে প্রতিটি কৃষক পরিবারকে 4 হেক্টর বা 10 একর জমি দেওয়ার কথা হয়। বীজ ও কৃষি উপকরণ কেনার জন্য ঋণদানের ব্যবস্থা করা হয়।
জমি বণ্টনের ক্ষেত্রে মাপকাঠি স্থির হয়, যেন প্রতিটি পরিবারের সারা বছরের প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন করা যায়। এজন্য সেচের সুবিধা এবং জমির উৎপাদিকা শক্তি বিবেচনা করা হয়। এই হিসাব করে প্রথম 1,50,000 হেক্টর জমি এবং পরে আরও 1,00,000 হেক্টর জমি উদবাস্তুদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।
উদবাস্তুদের মধ্যে যারা কারিগর ও ব্যবসায়ী ছিলেন তাদের ব্যাবসা ও পেশাগত সুবিধার জন্য ঋণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।

আবাসন –
পূর্ব পাঞ্জাব ও তার পাশাপাশি অঞ্চলের মুসলমানরা তাদের বাড়ি ফেলে রেখে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তান থেকে আসা উদবাস্তুদের মধ্যে সেই বাড়িগুলি বণ্টন করা হয়। এ ছাড়া কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান কো-অপারেটিভ ইউনিয়ন (Indian Co-operative Union) এবং সরকারি পূর্তবিভাগ উদবাস্তুদের জন্য আবাসন তৈরি শুরু করে। গড়ে ওঠে ফরিদাবাদ শহর। দোকান-বাজার তৈরি হয় এবং ছোটো ছোটো কারখানা গড়ে তোলা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় উদবাস্তু কলোনি গড়ে ওঠে।
পাকিস্তান থেকে পাঞ্জাবে আগত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনের মূল্যায়ন –
এইভাবে পাকিস্তান থেকে আসা উদবাস্তুদের পাঞ্জাব অঞ্চলে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। তাদের জীবন আবার কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে। ছিন্নমূল হয়েও আবার তারা ভারতীয় জনজীবনের মূল স্রোতে মিশে যায়। এক্ষেত্রে সর্দার তারলোক সিং, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় ও ভারত সরকারের বিশেষ ভূমিকা ছিল।
স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর পশ্চিম ভারতে উদবাস্তু সমস্যার সমাধানে সর্দার তারলোক সিং ও কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়ের কী ভূমিকা ছিল?
স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর পশ্চিম ভারতে উদবাস্তু সমস্যার ভূমিকা –
ভারত বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে যে সমস্যা নতুন রাষ্ট্রগঠনকারীদের সামনে বড়ো চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করেছিল, তা হল উদবাস্তু সমস্যা। পাকিস্তান থেকে ভারতবর্ষে আগত জনগোষ্ঠী প্রশাসনের উপর বাড়তি জনসংখ্যার চাপ সৃষ্টি করেছিল। সেইসঙ্গে ছিল এদের পুনর্বাসনের প্রশ্ন। পাঞ্জাব এবং বাংলা মূলত এই দুটি রাজ্যের ক্ষেত্রেই উদবাস্তু সমস্যা দেখা দেয়। পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে উদবাস্তুদের একটা বড়ো অংশ ছিল কৃষিজীবী। কাজেই এদের পুনর্বাসনের সঙ্গে জমিপ্রদানের প্রশ্নটিও যুক্ত ছিল। শুরুতে প্রতিটি কৃষক পরিবারকে 4 হেক্টর জমি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। শস্যের বীজ এবং কৃষির উপকরণ কেনার জন্য ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। জমিতে চাষবাস শুরু হয় এবং একইসঙ্গে স্থায়ী জমির জন্য আবেদন গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়।
তারলোক সিং -এর ভূমিকা –
পাঞ্জাবে উদবাস্তু পুনর্বাসনের সমগ্র বিষয়টি পরিচালিত হয় সর্দার তারলোক সিং -এর নির্দেশনায়। জমির উৎপাদিকা শক্তি, সেচব্যবস্থার সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করে তিনি জমির পরিমাণ নির্ধারণ করেন, যাতে একর প্রতি 10 থেকে 12 মন চাল উৎপাদিত হতে পারে। 1949 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর নাগাদ তারলোক সিং -এর নেতৃত্বে 1,50,000 হেক্টর জমি বণ্টন করা সম্ভব হয়েছিল। প্রায় 1,00,000 হেক্টর পরিমাণ জমি পুনরায় প্রদান করা হয়। কিছু অসুবিধা থাকলেও নিজেদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় তারা পূর্ব পাঞ্জাবে কৃষির অগ্রগতি ও প্রসার ঘটিয়ে জনজীবনকে পুনরায় কর্মমুখী করে তুলেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও হারিয়ে ফেলার একটা বেদনা কার্যত সর্বব্যাপী ছিল।

কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকা –
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদবাস্তুদের একটা বড়ো অংশ ছিল কৃষিজীবী। এদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার নতুন শহর গড়ে তোলে। দিল্লির কাছাকাছি ফরিদাবাদে একটি শহর গড়ে ওঠে। কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান কো-অপারেটিভ ইউনিয়ন (Indian Co-operative Union) সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ ছাড়া সরকারি পূর্তবিভাগও এদের বাসস্থান গড়ে তোলার ব্যাপারে সচেষ্ট হয়। কিন্তু সরকারি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তীব্র আকার নেয়। এর ফলে জওহরলাল নেহরু একটি সমাধান সূত্র দেন এবং এই সূত্র অনুযায়ী স্থির হয় যে, উদবাস্তুরা নিজেদের উদ্যোগে 40% বাসস্থান গড়ে তুলবে এবং বাকি অংশ সরকারি পূর্তবিভাগের উদ্যোগে গড়ে উঠবে। ইন্ডিয়ান কো-অপারেটিভ ইউনিয়ন (Indian Co-operative Union) -এর উদ্যোগে দোকানপাট এবং ছোটোখাটো উৎপাদনকেন্দ্র গড়ে উঠতে শুরু করে।

পাকিস্তান থেকে পাঞ্জাবে আগত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনের মূল্যায়ন –
দেশভাগ বা পার্টিশনের পর দিল্লিতে প্রায় 5 লক্ষ উদবাস্তুর আগমন ঘটে। তারা কার্যত শহরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন উদবাস্তু ক্যাম্প গড়ে ওঠে। এ ছাড়া স্কুল-কলেজ, মন্দির, গুরুদোয়ারা, ধর্মশালাগুলিতে অস্থায়ী বাসস্থান গড়ে তোলে। কালক্রমে এইসব উদবাস্তুদের বসবাসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কলোনি গড়ে ওঠে। এইভাবে ছিন্নমূল উদবাস্তুদের পুনরায় জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্দার তারলোক সিং ও কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
কলকাতায় উদবাস্তু পুনর্বাসন সমস্যা বিষয়ে পর্যালোচনা করো।
কলকাতায় উদবাস্তু পুনর্বাসন সমস্যার ভূমিকা –
স্বাধীনতার পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদবাস্তু জনস্রোত পশ্চিমবাংলাকে প্লাবিত করে। কলকাতা শহরেও তার প্রভাব পড়ে। পুনর্বাসন সমস্যা প্রবল হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত ও সরকারি উদ্যোগে এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হয়।
কলকাতায় উদবাস্তু পুনর্বাসন সমস্যা –
কলকাতা শহর ঘনবসতিপূর্ণ ছিল। তার উপর লক্ষ লক্ষ উদবাস্তুর আগমনের ফলে শহরের পরিবেশ দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাই পুনর্বাসন সমস্যা দেখা দেয়।
কলকাতায় উদবাস্তু পুনর্বাসন সমস্যার ব্যক্তিগত উদ্যোগ –
- ভাড়াবাড়ি – ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট (Indian Statistical Institute) -এর সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেসব উদবাস্তু এসেছিলেন তাদের একটা অংশের (35 শতাংশ) বেঁচে থাকার মতো সম্পদ সঙ্গে (টাকা, সোনা) ছিল। তারা মধ্যবিত্ত পাড়ায় ভাড়াবাড়িতে বসবাস শুরু করেন অথবা তারা জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি করেন বা বাড়ি কিনে নেন। এভাবে ঢাকুরিয়া, নিউ আলিপুর অঞ্চলে মধ্যবিত্ত উদবাস্তুদের বসতি গড়ে ওঠে।
- জবরদখল – দরিদ্র উদবাস্তু বেসরকারি পতিত জমি দখল করে বাসস্থান গড়ে তোলে। এই দখলদারি নিয়ে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে তাদের বিবাদ দেখা দেয়। শেষপর্যন্ত উদবাস্তু ওই অঞ্চল দখলে সক্ষম হয় এবং নাম রাখে বিজয়গড়। এই দৃষ্টান্তে যাদবপুর, কসবা, সন্তোষপুর, গড়িয়া, বেহালায় এইরকম কলোনি গড়ে ওঠে। 1949 খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব কলকাতায় এই ধরনের আরও 46টি কলোনি তৈরি হয়।
কলকাতায় উদবাস্তু পুনর্বাসন সমস্যার সরকারি উদ্যোগ –
উদবাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য ভারত সরকার নানান উদ্যোগ গ্রহণ করে। 1950 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় পুনর্বাসন মন্ত্রকের শাখা সচিবালয় খোলা হয়। এই দপ্তরে প্রায় 2,00,000 উদবাস্তু সাহায্যের জন্য আবেদন করে। সরকার 75,000 উদবাস্তুকে ত্রাণশিবিরে আশ্রয় দেয়। স্থায়ী পুনর্বাসন না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এরপর প্রতি মাসে 10,000 উদবাস্তুর পুনর্বাসন দেওয়া হয়। কলকাতায় আবাসন প্রকল্প গড়ে ওঠে। কলকাতার সংলগ্ন অঞ্চলে বহু সংখ্যক কলোনি তৈরি করা হয়।
কলকাতায় উদবাস্তু পুনর্বাসন সমস্যার মূল্যায়ন –
এইভাবে বিভিন্ন অসুবিধা ও ত্রুটিবিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও কলকাতা অঞ্চলে পুনর্বাসন সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হয়।
উদবাস্তু সমস্যা পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ও অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলেছিল?
উদবাস্তু সমস্যা পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ও অর্থনীতির ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। বাংলা ভাগ হয় এবং পূর্ব বাংলাকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হয়। আতঙ্ক ও সাম্প্রদায়িক হানাহানির কারণে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা বেশিরভাগ পশ্চিমবাংলায় আশ্রয় নেয়। এই বিপুল সংখ্যক উদবাস্তুর চাপ পশ্চিমবাংলার সমাজ ও অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।
উদবাস্তু সমস্যা পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ও অর্থনীতির প্রভাব –
বিপুল সংখ্যক উদবাস্তুর আগমনের ফলে পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ও অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব পড়েছিল।
সামাজিক প্রভাব –
উদবাস্তুরা পশ্চিমবাংলার সীমান্তবর্তী জেলা চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, মুরশিদাবাদ, মালদহ, দিনাজপুরে বসতি স্থাপন করে। ট্রেনযোগে এসে তারা বিভিন্ন রেলস্টেশনে আশ্রয় নেয়। তারপর স্টেশনসংলগ্ন এলাকা বা পাশের ফাঁকা জমি জবরদখল করে বসতি স্থাপন করে। সরকারি পতিত জমিও তারা দখল করে নেয়। এসব ঘটনার জন্য স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে তাদের বিবাদ হয়। সরকার ত্রাণশিবির খোলে। কলকাতা ও তার পাশাপাশি এলাকায় 46টি কলোনি গড়ে তোলা হয়। সরকারি ব্যয়ে কলকাতায় আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা হয়। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কল্যাণী, দুর্গাপুর প্রভৃতি নগরী গড়ে তোলেন। অশোকনগর, হাবড়া, যাদবপুর, সন্তোষপুর, গড়িয়া ইত্যাদি অঞ্চল উদ্দ্বাস্তু সমস্যা সমাধানকল্পেই গড়ে ওঠে।
এই উদবাস্তুরা হিন্দু ছিল। পশ্চিমবাংলায় তারা আসার ফলে হিন্দু জনসংখ্যা বেড়ে যায়। অন্যদিকে মুসলমান জনগণের আনুপাতিক হার কমে যায়।
এই উদবাস্তুদের প্রয়োজনে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। শহরাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সান্ধ্যকালীন পঠনপাঠন শুরু হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।
উদবাস্তুদের ধর্ম, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস ও পোশাক-পরিচ্ছদ এক হলেও পশ্চিমবাংলার হিন্দুসমাজের সঙ্গে তাদের সেভাবে মেলবন্ধন ঘটেনি। ফলে দুটো সমাজ ও সংস্কৃতি স্বতন্ত্র ধারায় চলতে থাকে।

অর্থনৈতিক প্রভাব –
এই উদবাস্তুদের মধ্যে যারা দরিদ্র ছিল তারা গ্রামাঞ্চলে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন পেশায় এবং শহরাঞ্চলে মজুরিভিত্তিক শিল্পশ্রমিক, দোকানকর্মী ও অন্যান্য কাজে লিপ্ত হয়। মধ্যবিত্তরা সরকারি আনুকূল্যে বিভিন্ন চাকরিলাভ করে। কেউ কেউ ব্যাবসা শুরু করে। হাওড়া, হুগলি ও কলকাতা শিল্পাঞ্চলবিকশিত হয়।
উদবাস্তু সমস্যা পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ও অর্থনীতির মূল্যায়ন –
এইভাবে উদবাস্তু সমস্যা পশ্চিমবাংলার সমাজ ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছিল, যার ফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
উদবাস্তু স্রোত কী?
উদবাস্তু স্রোত – দেশভাগ ঘোষিত হলে পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিমবাংলায় উদবাস্তুরা আসতে শুরু করে। সরকারি তথ্য থেকে জানা যায়, 1946 খ্রিস্টাব্দে 14,000, 1947 খ্রিস্টাব্দে 2,58,000, 1948 খ্রিস্টাব্দে 5,90,000, 1949 খ্রিস্টাব্দে 1,82,000 উদবাস্তু পশ্চিমবাংলায় আশ্রয় নেয়। প্রফুল্ল চক্রবর্তীর (The Marginal Men -এর রচয়িতা) মতে, 1948 খ্রিস্টাব্দের জুন মাস পর্যন্ত উদবাস্তুর সংখ্যা ছিল 1.1 মিলিয়ন বা 11 লক্ষ। বিধানচন্দ্র রায় -এর মতে, 1949 খ্রিস্টাব্দের শেষ নাগাদ উদবাস্তুর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় 16 লক্ষ।
উদবাস্তু পুনর্বাসন সমস্যা পাঞ্জাবের তুলনায় বাংলায় বেশি অনুভূত হয় কেন?
উদবাস্তু পুনর্বাসন সমস্যা – পাঞ্জাব ও বাংলার ভূমিকা –
ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে দেশভাগের ঘটনা জড়িত। দেশভাগের অংশ ছিল পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগ। এই ভাগাভাগির ফলে উদবাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং তার সঙ্গে আসে পুনর্বাসন সমস্যা। উদবাস্তু পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে পাঞ্জাবের তুলনায় বাংলার সমস্যা বেশি ছিল।
উদবাস্তু পুনর্বাসন সমস্যা – পাঞ্জাব ও বাংলা –
- সংখ্যা – উদবাস্তু পুনর্বাসন সমস্যার ক্ষেত্রে উদবাস্তু সংখ্যা একটি বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। পাঞ্জাব ভাগের ফলে পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে প্রায় 45 লক্ষ উদবাস্তু ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। এই নির্দিষ্ট সংখ্যক উদবাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়। অন্যদিকে পূর্ব বাংলা (পাকিস্তান) থেকে পশ্চিমবাংলায় অনেক বেশি উদবাস্তু এসেছিল। 1947-1951 খ্রিস্টাব্দ সময়কালে প্রায় 51 লক্ষ, 1960-1961 খ্রিস্টাব্দে প্রায় 10 লক্ষ, 1965 খ্রিস্টাব্দে প্রায় 10 লক্ষ এবং 1971 খ্রিস্টাব্দে প্রায় 25 লক্ষ উদবাস্তু ভারতে আশ্রয় নেয়। বেসরকারিভাবে আরও অনেক উদবাস্তু এসেছিল, যার মোট সংখ্যা ছিল 1 কোটি প্রায়। এই সংখ্যার বেশিরভাগ পশ্চিমবাংলায় আশ্রয় নেয়। এই বিপুল সংখ্যক উদবাস্তুদের পুনর্বাসন সরকারি উদ্যোগে সম্ভব হয়নি।
- ধারাবাহিকতা – উদবাস্তু পুনর্বাসন সমস্যা বাংলায় বেশি অনুভূত হওয়ার অপর একটি কারণ ছিল উদবাস্তুদের ধারাবাহিকভাবে আগমন। দেশভাগের পর পাঞ্জাবে 2 বছরের মধ্যে উদবাস্তুদের আসা শেষ হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে আর কোনো দাঙ্গা না ঘটায় নতুন করে কেউ উদবাস্তু হয়ে ভারতে আসেনি। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে 1947-1971 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে এবং তার পরেও ধারাবাহিকভাবে উদবাস্তু স্রোত পশ্চিমবাংলায় প্রবেশ করে।
- জমি-বাড়ি – পাঞ্জাব ভাগের পর পূর্ব পাঞ্জাবের 60 লক্ষ মুসলিম তাদের 4,70,000 একর কৃষিজমি ও বাড়ি ফেলে পশ্চিম পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। একইভাবে পশ্চিম পাঞ্জাবের 45 লক্ষ হিন্দু ও শিখ তাদের 6,70,000 একর জমি ও বাড়ি ফেলে ভারতে আশ্রয় নেয়। এর ফলে প্রত্যেক উদবাস্তু পরিবার কৃষিজমি (10 একর) ও বাড়ি পায়। অন্যদিকে পশ্চিমবাংলা থেকে কমসংখ্যক মুসলিম পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের জমি ও বাড়ি ফেলে যাওয়ার সংখ্যা আরও কম ছিল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা বিপুল সংখ্যক উদবাস্তুদের তাই আশ্রয় ও কর্মসংস্থানের প্রবল সমস্যা হয়।
- সরকারি উদ্যোগ – ভারত সরকারের উদ্যোগে যে ‘ত্রাণ ও পুনর্বাসন’ কার্যক্রম গৃহীত হয়, সেক্ষেত্রে পাঞ্জাব বেশি গুরুত্ব পায়। 1947-1952 খ্রিস্টাব্দ সময়কালে সরকারি উদ্যোগে আবাসন প্রকল্প, কলোনি, শহর (ফরিদাবাদ), ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প, ব্যাবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে উদবাস্তু পুনর্বাসন করা হয়। অন্যদিকে সীমিত, ত্রাণনির্ভর ভারত সরকারের উদ্যোগ উদবাস্তুদের হতাশ ও ক্ষুব্ধ করে। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় -এর উদ্যোগে আবাসন, শহর (কল্যাণী, দুর্গাপুর) কলোনি, শিল্পাঞ্চলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। সরকারি ঋণদানের ব্যবস্থাও করা হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত।
উদবাস্তু পুনর্বাসন সমস্যা – পাঞ্জাব ও বাংলার মন্তব্য –
এই সমস্ত কারণে পাঞ্জাবের তুলনায় বাংলায় উদবাস্তু পুনর্বাসন সমস্যা বেশি অনুভূত হয়।
উদবাস্তু সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে পাঞ্জাব ও পশ্চিম বাংলার ক্ষেত্রে কী ধরনের পার্থক্য ছিল?
উদবাস্তু সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে পাঞ্জাব ও পশ্চিম বাংলার ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্বে দেশভাগের পর ভারতে উদবাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানসংলগ্ন ভারতের পাঞ্জাব ও পশ্চিমবাংলায় উদবাস্তু সমস্যা ছিল তীব্র। ভারত সরকার এই সমস্যাসমাধানের জন্য যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল, তা পাঞ্জাব ও পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে এক ছিল না।
পাঞ্জাব ও পশ্চিম বাংলার ক্ষেত্রে পার্থক্যসমূহ –
- জন হস্তান্তরের পার্থক্য – পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে জন হস্তান্তর ও সম্পত্তির বিনিময় করা হয়েছিল। ফলে পাঞ্জাবের উদবাস্তু সমস্যার সমাধান অনেক সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে তা হয়নি।
- আগমনের সময়সীমা – পাঞ্জাবে উদবাস্তুদের আগমন ঘটেছিল মাত্র দু-বছরই কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে আগত উদবাস্তুদের স্রোত দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে অব্যাহত ছিল।
- আশ্রয়ের সমস্যা – পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে ভারতে আগত উদবাস্তুরা শুধু পূর্ব পাঞ্জাবে নয়, দিল্লি, রাজস্থানে আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদবাস্তু পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের উপর বিপুল চাপ সৃষ্টি হয়।
- সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণ – ভারত সরকার পাঞ্জাব ও পশ্চিমবাংলার উদবাস্তু সমস্যাসমাধানের ক্ষেত্রে বিমাতৃসুলভ আচরণ করে। পাঞ্জাবের উদবাস্তুদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল কিন্তু বাংলার উদবাস্তুদের জন্য তা করা হয়নি।
স্বাধীন ভারত সরকার উদবাস্তু সমস্যার সমাধানে কী ধরনের উদ্যোগ নেয়?
স্বাধীন ভারত সরকার উদবাস্তু সমস্যার ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের আগে থেকেই উদবাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়। দেশভাগের সময় ও পরে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়। পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক উদবাস্তু ভারতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য সদ্য স্বাধীন ভারতের উপর প্রবল চাপ পড়ে। তবুও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, পাঞ্জাব ও পশ্চিমবাংলার রাজ্য সরকার এবং আসাম ও ত্রিপুরা সরকার ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্প গ্রহণ করে উদবাস্তু সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়।
স্বাধীন ভারত সরকারের উদ্যোগ –
পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক শিখ ও হিন্দু উদবাস্তু ভারতে আশ্রয় নেয়। এই সমস্যা ক্রমে ভয়াবহ রূপ নেয়। এই সমস্যাসমাধানের জন্য ভারত সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। যথা –
ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তর –
উদবাস্তু সমস্যার সমাধানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ‘পুনর্বাসন নীতি’ ঘোষণা করেন। তাঁর উদ্যোগে কেন্দ্রীয় সরকার ‘ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তর’ খোলে। উদবাস্তু সমস্যাসমাধানের জন্য এই দপ্তর বিভিন্ন প্রকল্প চালু করে।
- আশ্রয় শিবির – পাকিস্তান থেকে আসা উদবাস্তুরা রেলস্টেশন, ফাঁকা জায়গায় থাকতে শুরু করে। সরকারি উদ্যোগে তাদের জন্য আশ্রয় শিবির (অস্থায়ী তাঁবু) তৈরি করা হয়। এই আশ্রয় শিবিরে থাকাকালীন সময়ে উদবাস্তুদের সরকারি কার্ড দেওয়া হয়। উদবাস্তুদের নাম, পরিচয় নথিভুক্ত করা এবং এখানে সরকারি খরচে উদবাস্তুদের খাদ্য সরবরাহ করা হয়। উদবাস্তুদের জন্য ছিল উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থাও।
- গৃহনির্মাণ – আশ্রয় শিবিরের নথিভুক্ত উদবাস্তুদের জন্য আবাসন প্রকল্প অনুযায়ী সরকারি জমিতে আবাসন তৈরি হয়। ফরিদাবাদ, কল্যাণী, দুর্গাপুর, অশোকনগর, সন্তোষপুর প্রভৃতি শহর গড়ে তোলা হয়। আবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে গৃহনির্মাণের জন্য সরকারি অর্থসাহায্য বা ঋণদানও করা হয়। ইন্ডিয়ান কো-অপারেটিভ ইউনিয়ন আবাসন প্রকল্প চালু করে।
- কর্মসংস্থান – সরকার নথিভুক্ত উদবাস্তুদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে। যারা কারিগরি শ্রমিক ছিলেন তাদের শিল্পকারখানায় নিয়োগ করা হয়। তাদের জন্য নতুন ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প গড়ে তোলা হয়। যারা লেখাপড়া জানতেন, তাদের সরকারি আনুকূল্যে বিভিন্ন সরকারি চাকরি দেওয়া হয়। শিল্প ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন কলেজে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু হয়। ব্যাবসাবাণিজ্যের জন্য উদবাস্তুদের কো-অপারেটিভ গঠন করে সরকারি ঋণ দেওয়া হয়। বিভিন্ন বাণিজ্য এলাকা গড়ে তোলে সরকার। জন বিনিময় ও সম্পত্তি বিনিময় ব্যবস্থার দ্বারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা উদবাস্তুদের (বিশেষত শিখ) মধ্যে ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যাওয়া মুসলিমদের জমি ও বাড়িগুলি বণ্টন করা হয়।
স্বাধীন ভারত সরকার উদবাস্তু সমস্যার নাগরিকত্ব দান –
নথিভুক্ত উদবাস্তুদের ভারত সরকার ভারতীয় নাগরিকত্ব দান করে। তাদের রেশন কার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
স্বাধীন ভারত সরকার উদবাস্তু সমস্যার আন্তঃডোমিনিয়ন সম্মেলন –
1948 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরকারি স্তরে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল – হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা, দাঙ্গা বাঁধতে না দওয়া, উদবাস্তু স্রোত বন্ধ করা ইত্যাদি।
স্বাধীন ভারত সরকার উদবাস্তু সমস্যার দিল্লি চুক্তি –
1950 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে জওহরলাল নেহরু ও লিয়াকৎ আলি খান দিল্লিতে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর বিষয়বস্তু ছিল – সংখ্যালঘুরা নিজ নিজ রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবে। তারা নিজ সরকারের কাছে সমস্যার প্রতিকার প্রার্থনা করবে। কোনো সংখ্যালঘু দেশত্যাগ করতে চাইলে সরকার আইনগতভাবে সাহায্য করবে।
স্বাধীন ভারত সরকার উদবাস্তু সমস্যার মন্তব্য –
সদ্য স্বাধীন ভারতের কাছে উদবাস্তু সমস্যা বিরাট চাপ সৃষ্টি করে। আর্থিক সংকটের জন্য এই ত্রাণ ও পুনর্বাসনের গতি ছিল ধীর।
স্মৃতিকথাকে কীভাবে উদবাস্তু সমস্যার ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যায়?
অথবা, আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় দেশভাগ বিষয়টি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় দেশভাগের ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত ভারত বিভক্ত হয়ে স্বাধীন ভারত ও স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। একদল মানুষ দেশভাগে খুশি হলেও এর ফলে অসংখ্য মানুষকে উদবাস্তু সমস্যার নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। সমকালীন মানুষের আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় দেশভাগের যন্ত্রণার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। ফলে সেগুলি আধুনিক ইতিহাসচর্চার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদানরূপে বিবেচিত হয়।
দেশভাগ বিষয়ক আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা ও অন্যান্য গ্রন্থ –
দেশভাগ বিষয়ক আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা ও অন্যান্য গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
- শ্রী হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘উদবাস্তু’। লেখক পশ্চিমবাংলার উদবাস্তু কমিশনার ছিলেন। এটি মূলত তাঁর স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ।
- দক্ষিণারঞ্জন বসুর লেখা স্মৃতিকথা হল ‘ছেড়ে আসা গ্রাম’।
- নীরদচন্দ্র চৌধুরী রচিত গ্রন্থ ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ (Autobiography of an Unknown Indian)।
- জ্যোতির্ময়ী দেবীর লেখা ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’।
- চৌধুরী খালিকুজ্জামানের লেখা ‘পাথওয়ে টু পাকিস্তান’ (Pathway to Pakistan)।
- ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের ‘পাকিস্তান অর দ্য পার্টিশান অফ ইন্ডিয়া’ (Pakistan or the Partition of India)।
- খুশবন্ত সিং -এর লেখা ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ (Train to Pakistan)।
- প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তীর লেখা ‘দ্য মার্জিনাল মেন’ (The Marginal Men) ইত্যাদি।

আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় দেশভাগের বর্ণনা –
এই গ্রন্থগুলি থেকে দেশভাগ সংক্রান্ত আনন্দ, দুঃখ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হত্যা, লুঠতরাজ এবং উদবাস্তুদের যন্ত্রণাময় জীবনের কথা জানা যায়।
- অনেকে আশা করেছিল দেশ স্বাধীন হলে মানুষের আর দুঃখদুর্দশা বলে কিছু থাকবে না। চালের দাম কম হবে, সবাই খেয়েপরে আনন্দে বাঁচতে পারবে।
- দেশ স্বাধীন হল। মানুষ আনন্দে মেতে উঠল।
- কিন্তু অসংখ্য মানুষের মনে স্বাধীনতার আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। তারা ‘নিজ ভূমে পরবাসী’ হয়ে গেল- উদবাস্তু হয়ে নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে অজানা-অচেনা জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হল। অদ্ভুত বেদনা ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হল তারা।
- স্বার্থান্বেষী একদল মানুষ জমিজমা, ঘরবাড়ি, সম্পত্তির লোভে ধর্মের দোহাই দিয়ে খুন, নারীনির্যাতন ও সম্পত্তি লুঠতরাজে মেতে উঠল।
- এর মধ্যেও উদবাস্তুদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, বিভিন্নভাবে মানুষের মানবিকতা ও মূল্যবোধের চিত্রও ফুটে উঠেছে।
আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় দেশভাগের মূল্যায়ন –
ভারতীয়দের কাছে দেশভাগ একটি মিশ্র অনুভূতির ঘটনা। যে অবর্ণনীয় দুঃখদুর্দশার যৎসামান্য অংশ লিখিত আকারে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথারূপে আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়েছে তা সত্যিই বেদনাদায়ক।
নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি বলতে কী বোঝো?
নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তির ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দে ভারত ভাগের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান থেকে প্রায় 1 কোটি মানুষ উদবাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নিলে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারত নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়।
নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তি (দিল্লি চুক্তি) –
উদবাস্তু সমস্যার সমাধানের জন্য তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলি খান -এর মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। 1950 খ্রিস্টাব্দের 8 এপ্রিল জওহরলাল নেহরু ও লিয়াকৎ আলির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় – যেটি নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তিতে স্থির হয় –

- সংখ্যালঘুরা যে রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার করবে তারা সেই রাষ্ট্রের কাছেই নানা সমস্যার প্রতিকার চাইবে।
- পূর্ববাংলা, পশ্চিমবাংলা ও আসাম থেকে যদি কেউ অন্য দেশে শরণার্থী হতে চায় তবে তাকে সাহায্য করতে হবে।
- ভারত ও পাকিস্তান – উভয়েই উদবাস্তু সমস্যার কারণ ও উদবাস্তুদের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য অনুসন্ধান কমিটি ও সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করবে।
- পূর্ববাংলা ও পশ্চিমববাংলার মন্ত্রীসভায় সংখ্যালঘু প্রতিনিধি রাখতে হবে।
নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তির প্রতিক্রিয়া –
এই চুক্তি অনেককেই হতাশ করে। এই কারণে নেহরুর মন্ত্রীসভা থেকে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ডঃ ক্ষিতিশচন্দ্র নিয়োগী পদত্যাগ করেন। তাঁরা মনে করেছিলেন, এই চুক্তি যথেষ্ট কঠোর নয় এবং এর ফলে উদবাস্তু সমস্যার সমাধান হবে না।

নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তির ফলাফল –
নেহরু উদবাস্তু সমস্যার গুরুত্ব বুঝে স্বাধীনতার প্রথম 5 বছর উদবাস্তুদের পুনর্বাসনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাই এই পাঁচ বছরকে ‘পুনর্বাসনের যুগ’ বলা হয়। 1947 থেকে 1971 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থী আসার ফলে পশ্চিমবাংলার অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতিতে প্রবল প্রভাব পড়ে। ভারতে তীব্র খাদ্যসংকটের সৃষ্টি হয়।
উদবাস্তু সমস্যার সমাধান ও দিল্লি চুক্তির মধ্যে কী সম্পর্ক ছিল, তা বিশ্লেষণ করো।
উদবাস্তু সমস্যার সমাধান ও দিল্লি চুক্তির ভূমিকা –
দেশভাগ ও ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে উদবাস্তু সমস্যা ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কিন্তু তার আগে থেকেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামার কারণে উদবাস্তু সমস্যা সৃষ্টি হয়। দেশভাগের সময় উদবাস্তু সমস্যা প্রবল হয়ে ওঠে। দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নিরাপত্তার অভাবের জন্য উদবাস্তু স্রোত অব্যাহত থাকে। এই উদবাস্তু স্রোত বন্ধ করার জন্য দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু সমস্যাসমাধানে তা কার্যকর হয়নি।
উদবাস্তু সমস্যার সমাধান ও দিল্লি চুক্তির সম্পর্ক –
সমাধান উদ্যোগ-ত্রাণ ও পুনর্বাসন –
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশভাগের জন্য বিপুল সংখ্যক সংখ্যালঘু ছিন্নমূল হয়ে ভারত থেকে পাকিস্তানে ও পাকিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় নেয়। এরাই উদবাস্তু নামে পরিচিত। ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার উদবাস্তু সমস্যার সমাধানের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। উদবাস্তুদের জন্য আশ্রয় শিবির তৈরি করা, খাদ্য সরবরাহ, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, পরিচয়পত্র দান, নাগরিকত্ব দান, কলোনি ও আবাসন তৈরি, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রভৃতির মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এইভাবে প্রায় এক কোটি উদবাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়।
সমাধান উদ্যোগ-কূটনৈতিক পদক্ষেপ –
- ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচির মাধ্যমে উদবাস্তু সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পাকিস্তান থেকে উদবাস্তু স্রোত বন্ধ হয়নি। এইজন্য ভারত সরকার কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আন্তঃডোমিনিয়ন কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে। এই কনফারেন্সের লক্ষ্য ছিল হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা, যাতে পুনরায় দাঙ্গার পরিবেশ সৃষ্টি না হয় তা দেখা। কিন্তু তা সত্ত্বেও দাঙ্গা ঘটে। আর সংখ্যালঘুরা উদবাস্তু হয়ে ভারতে আসতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উদবাস্তু আসা বন্ধ হলেও পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগমন অব্যাহত থাকে।
- দিল্লি চুক্তি – উদবাস্তু সমস্যার সমাধানের জন্য আর – একটি কূটনৈতিক পদক্ষেপ ছিল দিল্লি চুক্তি। এই চুক্তি ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যথাক্রমে জওহরলাল নেহরু ও লিয়াকৎ আলি খানের মধ্যে সম্পাদিত হয়। এজন্য এই চুক্তি নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তি নামেও পরিচিত (8 এপ্রিল, 1950 খ্রিস্টাব্দ)। এই চুক্তিতে স্থির হয় –
- ভারত ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা নিজ নিজ রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবে ও কোনো সমস্যা হলে তার প্রতিকার চাইবে।
- পূর্ব পাকিস্তানের কোনো সংখ্যালঘু ভারতে আশ্রয় চাইলে বা আসাম ও পশ্চিমবাংলার কোনো সংখ্যালঘু পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় চাইলে আইনগতভাবে তাকে সাহায্য দেওয়া হবে।
- দাঙ্গার কারণ ও দাঙ্গা রোধ করার জন্য অনুসন্ধান ও শান্তি কমিটি গড়ে তোলা হবে।
পারস্পরিক সম্পর্ক –
পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ যাতে উদবাস্তু না হয় এবং দলে দলে তাদের যাতে ভারতে আসতে না হয় তার জন্য এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সংখ্যালঘুদের মনে আস্থা সৃষ্টির জন্য সংখ্যালঘু মন্ত্রী নিয়োগ, দাঙ্গা রোধ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা প্রভৃতি পদক্ষেপ উদবাস্তু হওয়ার কারণগুলি দূর করার চেষ্টা করে। আইনগত সাহায্যের ব্যবস্থা নিরাপত্তার আশ্বাস জোগায়।
উদবাস্তু সমস্যার সমাধান ও দিল্লি চুক্তির মন্তব্য –
উদবাস্তু সমস্যাসমাধানের জন্য উদবাস্তু স্রোত বন্ধ করার প্রয়োজন ছিল। সেই উদবাস্তু স্রোত বন্ধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এই চুক্তির পরেও দাঙ্গা হয় আর দলে দলে উদবাস্তুরা ভারতে আসে। তাই বলা যায়, এই চুক্তি সমস্যাসমাধানে কার্যকর হয়নি।
স্বাধীনতার পরে ভাষার ভিত্তিতে ভারত কীভাবে পুনর্গঠিত হয়েছিল?
অথবা, স্বাধীন ভারতের কোথায় কোথায় ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিতে আন্দোলন হয়?
ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিতে আন্দোলনের ভূমিকা –
ভারতবর্ষ একটি বিশাল দেশ। এখানে বহু ভাষাভাষী মানুষ পাশাপাশি বসবাস করে। ব্রিটিশ আমলের রাজ্যসীমানা স্বাধীন ভারতের পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য বদলাতে হয়। এর অন্যতম কারণ ছিল ভাষা ও সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে রাজ্যসীমা পরিবর্তনের আন্দোলন।
ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিতে আন্দোলন –
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রশাসনিক কাজে স্থানীয় ভাষার ব্যবহার করলে সুবিধা হবে – এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ভারতের বিভিন্ন অংশে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে ওঠে।
আন্দোলনের পটভূমি –
1948 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের জয়পুর অধিবেশনে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের আলোচনার সাপেক্ষে বিচারপতি এস কেদর -এর নেতৃত্বে দর কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশন ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের বিরোধিতা করলে সারা ভারত জুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।
অন্ধ্র অঞ্চলে আন্দোলন –
ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের ক্ষেত্রে প্রথম তামিল ভাষা অধ্যুষিত মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি থেকে তেলুগু ভাষাভাষী অন্ধ্র অঞ্চলকে পৃথকীকরণের দাবি ওঠে। এই দাবিকে গুরুত্ব না দিলে গান্ধিবাদী নেতা পাত্তি শ্রীরামালু অনশন শুরু করেন (19 অক্টোবর, 1952 খ্রিস্টাব্দ)। 58 দিন অনশনের পর তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অন্ধ্র ভাষামঞ্চের নেতৃত্বে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির 11টি জেলায় বিক্ষোভ শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার 1952 খ্রিস্টাব্দের 18 ডিসেম্বর অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। তামিলভাষীদের নিয়ে তামিলনাড়ু এবং তেলুগুভাষীদের নিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ গঠিত হয় 1 অক্টোবর, 1953 খ্রিস্টাব্দে।

বোম্বাই প্রেসিডেন্সি –
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের (1953 খ্রিস্টাব্দ) সুপারিশের ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠন আইন পাস হয় 1956 খ্রিস্টাব্দে। এরপর বোম্বাই প্রেসিডেন্সির সংযুক্ত মহারাষ্ট্র সমিতি এবং মহা গুজরাট জনতা পরিষদ যথাক্রমে মারাঠিভাষী ও গুজরাটিভাষী রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন করে। গণ আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে এবং মুখ্যমন্ত্রী মোরারজি দেশাই পদত্যাগ করেন। বহু আলোচনার পর ভারত সরকার 1960 খ্রিস্টাব্দের মে মাসে বোম্বাই প্রেসিডেন্সিকে ভাগ করে মহারাষ্ট্র ও গুজরাট রাজ্য সৃষ্টি করে।

কেরল –
মালাবার জেলাকে ত্রিবাঙ্কুর ও কোচিনের সঙ্গে যুক্ত করে কেরল রাজ্য গঠন করা হয়।
পাঞ্জাব –
পাঞ্জাবের শিখরা গুরুমুখীভাষী (পাঞ্জাবি) অঞ্চল নিয়ে পাঞ্জাবের সীমানা নির্ধারণ করতে চেয়েছিল। আকালি দল এই দাবিকে সমর্থন জানায়। জনসংঘ হিন্দি ভাষা ও হিন্দুদের সমর্থন করে। শেষে গুরুমুখী, হিন্দি ও পাহাড়ি ভাষার ভিত্তিতে যথাক্রমে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ গঠিত হয় ও রাজ্যসীমা নির্ধারিত হয় 1966 খ্রিস্টাব্দে।
ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিতে আন্দোলনের মূল্যায়ন –
এইভাবে ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার দাবিতে রাজ্য গঠনের জন্য গণ আন্দোলন শুরু হয়। সরকারের সদিচ্ছায় নতুন রাজ্যের সৃষ্টি হয় এবং পুরোনো রাজ্যের সীমানা পরিবর্তিত হয়।
পাত্তি শ্রীরামালু কেন স্মরণীয়? তাঁর মৃত্যু ভারতে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে?
পাত্তি শ্রীরামালুর ভূমিকা –
ভারত একটি বহু ভাষাভাষী দেশ। ব্রিটিশ আমলের প্রাদেশিক সীমানা স্বাধীন ভারতের পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য বদলাতে হয়। এর অন্যতম কারণ ছিল ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের আন্দোলন।
পাত্তি শ্রীরামালু স্মরণীয় হওয়ার কারণ –
- গান্ধিবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী – পাত্তি শ্রীরামালু ছিলেন একজন বিশিষ্ট গান্ধিবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী।
- অন্ধ্রপ্রদেশের দাবি – তিনি মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির তেলুগুভাষী 11টি জেলা নিয়ে পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের দাবি জানান এবং অন্ধ্র ভাষামঞ্চ আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেন।
- অনশনে প্রাণত্যাগ – পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশের দাবিতে তিনি 58 দিন (1952 খ্রিস্টাব্দের 19 অক্টোবর 15 ডিসেম্বর) অনশন করে প্রাণত্যাগ করেন। এজন্য তিনি ‘অমরজীবী’ ও অন্ধ্রপ্রদেশের দাবিতে প্রথম শহিদ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
পাত্তি শ্রীরামালুর প্রতিক্রিয়া –
- অন্ধ্রপ্রদেশ গঠন – শ্রীরামালুর মৃত্যুর (15 ডিসেম্বর, 1952 খ্রিস্টাব্দ) পর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় (18 ডিসেম্বর, 1952 খ্রিস্টাব্দ) এবং 1 অক্টোবর, 1953 খ্রিস্টাব্দে তা কার্যকর হয়।
- রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন – এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সৈয়দ ফজল আলি, হৃদয়নাথ কুঞ্জরু, কে এম পানিক্কর-কে নিয়ে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন করে (ডিসেম্বর, 1953 খ্রিস্টাব্দ)।
- অন্যান্য রাজ্য গঠনের প্রভাব – এই ঘটনা পরে মহারাষ্ট্র ও গুজরাট এবং পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও হিমাচল প্রদেশ গঠনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
পাত্তি শ্রীরামালুর মন্তব্য –
শ্রীরামালুর এই আন্দোলন ভাষাভিত্তিক বিভিন্ন রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়ার সূচনা করে।
ভারতের রাজ্য পুনর্গঠনকালে কোন্ কোন্ বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল?
ভারতের রাজ্য পুনর্গঠনের ভূমিকা –
ব্রিটিশ-শাসিত প্রদেশ ও চিফ কমিশনার-শাসিত অঞ্চলগুলি বহু ভাষাভাষী ছিল। স্বাধীন ভারতে দেশীয় রাজ্যগুলি যুক্ত হওয়ায় বিভিন্ন প্রদেশ ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাষাগত বৈচিত্র্য আরও বেড়ে যায়। বিভিন্ন প্রদেশে জনগোষ্ঠীগত বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া প্রদেশগুলি আর্থিক দিক থেকে স্বয়ম্ভর ছিল না। রাজ্য পুনর্গঠনকালে এই বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ভারতের রাজ্য পুনর্গঠনের বিষয়সমূহ –
- ভাষা – তেলুগুভাষী অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন এবং পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ (1953 খ্রিস্টাব্দ) গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠিত হয় (1953 খ্রিস্টাব্দ)। স্বাভাবিকভাবে কমিশন ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ বা রাজ্যগুলির সীমানা পুনর্গঠনের সুপারিশ করে। ভারত সরকার জনগণের ভাবাবেগকে মর্যাদা ও গুরুত্ব দান করে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে এক রাজ্যের কিছু অংশ পাশের রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। এভাবে রাজ্যগুলি সম্পূর্ণ ভাষাভিত্তিক না হলেও প্রধান ভাষাভিত্তিক হয়ে ওঠে।
- জনগোষ্ঠী – ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে একাধিক উপজাতি বিদ্রোহ ঘটেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার একদিকে দমননীতির আশ্রয় নেয় এবং অন্যদিকে বিদ্রোহ বা প্রতিরোধ সংগ্রামের মূল কারণ দূর করার চেষ্টা করে। যেমন – সাঁওতাল উপজাতিদের জন্য সাঁওতাল পরগনা গঠন, মুন্ডাদের জন্য ছোটোনাগপুর দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি গঠন, কোল ও ভিলদের জন্য স্বতন্ত্র এলাকা নির্দিষ্ট করা, পাঠান উপজাতিদের নিয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ গঠন প্রভৃতি। রাজ্য পুনর্গঠনকালে এই বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়।
- আর্থিক কারণ – স্বাধীন ভারতের বেশিরভাগ প্রদেশ বা রাজ্য আর্থিক দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। কোনো কোনো রাজ্য কৃষিপ্রধান, আবার কোনো রাজ্য অরণ্যসংকুল, মালভূমি, মরুভূমি খনিজসমৃদ্ধ অথবা পর্বতসংকুল ছিল। এইসব রাজ্য যাতে নির্ভরশীল না হয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে সেদিকে লক্ষ রাখা হয়।
- পূর্বতন সীমানা – ব্রিটিশ আমলে যে প্রাদেশিক চিফ কমিশনার – শাসিত অঞ্চল বা জেলা সীমানা ছিল, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা বজায় রেখে কিছু রদবদল করা হয়। কোনো রাজ্যের একটি বা দুটি জেলা পাশের রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। ছোটো ছোটো এককগুলির সীমা বজায় রাখার বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করে।
ভারতের রাজ্য পুনর্গঠনের মন্তব্য –
রাজ্য পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসকালে ভাষা প্রধান ভিত্তি হলেও বহু সমস্যার সৃষ্টি হয়। এজন্য একাধিকবার রাজ্য পুনর্গঠন করতে হয়।
ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠনের উদ্যোগ ও বিতর্ক সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠনের ভূমিকা –
ভারত বহু ভাষাভাষী মানুষের দেশ। কিন্তু ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল প্রথম দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতভুক্ত করার কাজে সর্বাধিক সচেষ্ট হন। এর ফলে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামো সুদৃঢ় হয়, কিন্তু অচিরেই আর-এক সমস্যার সৃষ্টি হয় – তা হল ভাষার সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের ভাবনাচিন্তাও শুরু হয়।
ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের পটভূমি –
ভারত স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল।
- 1917 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন এবং 1920 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
- 1928 খ্রিস্টাব্দে নেহরু কমিটির রিপোর্টে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগুলিকে ভাগ করার কথা অনুমোদিত হয়।

ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠনে দর কমিশন –
ভারতে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন কতখানি কাম্য তা অনুসন্ধানের জন্য 1948 খ্রিস্টাব্দে গণপরিষদ একটি ভাষাভিত্তিক প্রদেশ কমিশন নিয়োগ করে। এই কমিশনের নেতৃত্ব দেন বিচারপতি এস কে দর (S K Dar)। তাই একে দর কমিশন বলা হয়।
ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠনে দর কমিশনের রিপোর্ট –
অনেক অনুসন্ধানের পর দর কমিশন 10 ডিসেম্বর তার রিপোর্ট পেশ করে। এতে বলা হয় –
- ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠন করা হলে জাতীয় ঐক্য নষ্ট হতে পারে।
- প্রশাসনিক দিক থেকেও তা হবে অসুবিধাজনক।
- এমনকি প্রাদেশিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠনে গণপরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ –
দর কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে গণপরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় যে, সংবিধানে রাজ্য পুনর্গঠনের ভাষাগত সূত্র রাখা হবে না।
ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠনের পরবর্তী পরিস্থিতি –
কিন্তু এতে বিরোধের মীমাংসা হয় না। দক্ষিণ ভারতে ভাষাভিত্তিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি পট্টভি সীতারামাইয়া বিচারপতি এস কে দরের রিপোর্টে সন্তুষ্ট ছিলেন না।

ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠনে জে ভি পি (JVP) কমিটি –
দর কমিশনের রিপোর্ট পেশের 8 দিন পর জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল ও পট্টভি সীতারামাইয়াকে নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। একে জেভিপি (JVP) কমিটি বলে।
- 1949 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে জে ভি পি কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।
- জে ভি পি কমিটির রিপোর্টেও ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের বিরোধিতা করা হয়। তবে বলা হয়, যেখানে জনগণের প্রবল চাপ থাকবে সেখানে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন করা যেতে পারে।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন কেন গঠিত হয়?
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের ভূমিকা –
ভারতে বহু ভাষাভাষী মানুষ পাশাপাশি বসবাস করে। তাই প্রশাসনিক ও অন্যান্য কারণে রাজ্য পুনর্গঠন প্রয়োজনীয় ছিল। ভাষা-সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে অন্ধ্র, পাঞ্জাব প্রভৃতি রাজ্যে আন্দোলন শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন করে।

রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কারণ –
বিভিন্ন কারণে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গড়ে ওঠে। যেমন –
- রাজ্যসীমা – ইংরেজ আমলে রাজ্যগুলির সীমা গড়ে উঠেছিল প্রশাসনিক সুবিধা অনুসারে। স্বাধীন ভারতে তাই তার পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল।
- দেশীয় রাজ্যের সংযুক্তি – ভারতের বহু দেশীয় রাজ্য পার্শ্ববর্তী প্রদেশগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে রাজ্যসীমা বিন্যাসের দরকার হয়।
- অন্ধ আন্দোলন – তামিল অধ্যুষিত মাদ্রাজ অঞ্চল থেকে তেলুগু হয়। অধ্যুষিত অন্ধ্রের পৃথকীকরণের দাবি ওঠে। স্বাধীনতা সংগ্রামী পাত্তি শ্রীরামালু এই দাবিতে 58 দিন অনশন করে প্রাণত্যাগ করেন। এর ফলে ব্যাপক গণ আন্দোলন সংগঠিত হয়।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন –
পাত্তি শ্রীরামালুর আন্দোলনের ফলে সরকার 1953 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন করে। সৈয়দ ফজল আলি (সভাপতি), হৃদয়নাথ কুঞ্জরু, কে এম পানিক্কর এই কমিশনের সদস্য হন। 1955 খ্রিস্টাব্দে তদন্ত শেষে কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভারত সরকার 1956 খ্রিস্টাব্দে রাজ্য পুনর্গঠন আইন পাস করে।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের মূল্যায়ন –
এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ভারতের রাজ্যসীমার পরিবর্তন হয়। ফলে অনেক নতুন রাজ্যের সৃষ্টি হয়। ক্ষোভ-বিদ্বেষ থাকলেও বলা যায়, তৎকালীন পরিস্থিতিতে এই কাজ ছিল যথাযথ।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ও আইন (1953-1955 খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে আলোচনা করো।
রাজ্য পুনর্গঠনের ভূমিকা –
স্বাধীনতা লাভের পর ভারত সরকারের প্রধান কাজ ছিল দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতভুক্ত করা। দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্ত হওয়ার পর ভাষা সংক্রান্ত সমস্যা সৃষ্টি হয়। এই সমস্যাসমাধানের জন্য ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। 1948 খ্রিস্টাব্দের দর কমিশন ও জে ভি পি কমিটি-র রিপোর্টে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠন সমস্যার পুরোপুরি সমাধান সম্ভব হয়নি। নতুনভাবে রাজ্যের সীমানা নির্ধারণের জন্য তাই রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন করা হয়।

রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন –
ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু 1953 খ্রিস্টাব্দের 22 ডিসেম্বর রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন (States Reorganisation Commission) গঠন করেন।
- এই কমিশন গঠিত হয়েছিল সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ ফজল আলির নেতৃত্বে। এই কমিশনের অপর দুই সদস্য ছিলেন কে এম পানিক্কর ও হৃদয়নাথ কুঞ্জরু।
- এই কমিশন 1955 খ্রিস্টাব্দে তার রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টে ভারতকে 16টি রাজ্য ও 3টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করার সুপারিশ করা হয়।
রাজ্য পুনর্গঠন আইন –
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সুপারিশগুলিকে কিছু পরিমার্জনা করে 1956 খ্রিস্টাব্দে ‘রাজ্য পুনর্গঠন আইন’ (States Reorganisation Act) পাস হয়। এই আইনে ভারতকে 14টি রাজ্য ও 6টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এই আইনের মূল বক্তব্য ছিল –
- বিহারের পুরুলিয়াকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে, হায়দরাবাদ রাজ্যের তেলেঙ্গানা অঞ্চলকে অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
- মালাবার জেলাকে ত্রিবাজ্জুর ও কোচিনের সঙ্গে যুক্ত করে কেরল রাজ্য গঠন করা হয়।
- মধ্যপ্রদেশ নামে একটি নতুন রাজ্য গঠন করা হয় ইত্যাদি।
রাজ্য পুনর্গঠনের মূল্যায়ন –
ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের ফলে –
- ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য সুদৃঢ় হয়।
- ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও জাতীয় সংহতি শক্তিশালী হয়।
তবে এ কথাও ঠিক যে, রাজ্য পুনর্গঠনের মাধ্যমে ভারতের সব সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়নি।
1964 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্বাধীন ভারতে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
স্বাধীন ভারতে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের ভূমিকা –
স্বাধীনতা লাভের পর ভারতে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের জন্য দর কমিশন (1948 খ্রিস্টাব্দ) এবং জেভিপি কমিটি (1948 খ্রিস্টাব্দ) নিযুক্ত হয়। এই কমিশন ও কমিটি ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের বিরোধিতা করে। ব্রিটিশ আমলে রাজ্যজয় ও প্রশাসনিক সুবিধার জন্য গড়ে ওঠা রাজ্যসীমার সঙ্গে বহুসংখ্যক দেশীয় রাজ্য যুক্ত হয়। এ ছাড়া অন্যান্য কারণে রাজ্যগুলিতে সমস্যা দেখা দিলে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন করে।
স্বাধীন ভারতে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন –
- দর কমিশন – স্বাধীনতার অনেক আগে জাতীয় কংগ্রেস ভাষাভিত্তিক রাজ্য কমিটি গঠন করেছিল। স্বাধীনতার পর ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি এস কে দর -এর নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে (17 জুন, 1948 খ্রিস্টাব্দ)। দর কমিশন তার প্রতিবেদনে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের বিরোধিতা করে।
- জে ডি পি কমিটি – জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল ও পট্টভি সীতারামাইয়া-কে নিয়ে গঠিত এই কমিটি (1948-1849 খ্রিস্টাব্দ) ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের বিষয়টি খতিয়ে দেখে। কিন্তু আঞ্চলিকতা বৃদ্ধির আশঙ্কায় এই কমিটিও দর কমিশনের অনুরূপ মত প্রকাশ করে।
- অন্ধ্র আন্দোলন – অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির মধ্যে প্রথম তেলুগুভাষী অন্ধ্র অঞ্চলে পৃথক রাজ্যের দাবি ওঠে। তামিল অধ্যুষিত মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি থেকে তেলুগুভাষী অঞ্চল নিয়ে পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশের দাবিতে বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী পাত্তি শ্রীরামালু 58 দিন অনশন করে প্রাণত্যাগ করেন (অক্টোবর, 1952 খ্রিস্টাব্দ)। এরপর অন্ধ্র অঞ্চলে গণ আন্দোলন শুরু হয়। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় সরকার পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ গঠন করে (1 অক্টোবর, 1953 খ্রিস্টাব্দ)।
- ভাষাভিত্তিক রাজ্য কমিশন – অন্ধ্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন করে (1953 খ্রিস্টাব্দ)। এই কমিশনের সভাপতি ছিলেন সৈয়দ ফজল আলি এবং সদস্য ছিলেন কে এম পানিক্কর ও হৃদয়নাথ কুঞ্জরু। 1955 খ্রিস্টাব্দে এই কমিশন তার প্রতিবেদন পেশ করে। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পার্লামেন্টে রাজ্য পুনর্গঠন আইন পাস হয় (1956 খ্রিস্টাব্দ)। এই আইন অনুসারে 14টি ভাষাভিত্তিক রাজ্য এবং 2টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল সৃষ্টি হয়।
- বোম্বাই প্রেসিডেন্সি – বোম্বাই প্রেসিডেন্সি রাজ্য পুনর্গঠন আইনের এক্তিয়ার বহির্ভূত ছিল। বোম্বাই প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত গুজরাট ও মহারাষ্ট্র পৃথক প্রদেশ গঠনের দাবি তোলে। সংযুক্ত মহারাষ্ট্র সমিতি মারাঠিভাষীদের নিয়ে বোম্বাই শহর-সহ পৃথক মহারাষ্ট্র প্রদেশের জন্য আন্দোলন শুরু করে। একইভাবে মহা গুজরাট জনতা পরিষদ গুজরাটিভাষীদের নিয়ে বোম্বাই শহর-সহ পৃথক গুজরাট প্রদেশের দাবিতে আন্দোলনে নামে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোরারজি দেশাই এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী সি ডি দেশমুখ জনমতের চাপে পদত্যাগ করেন। বহু আলোচনার পর কেন্দ্রীয় সরকার মহারাষ্ট্র ও গুজরাট নামে দুটি পৃথক রাজ্য গঠন করে (মে, 1960 খ্রিস্টাব্দ)। বোম্বাই শহর মহারাষ্ট্রের রাজধানী হয় এবং গুজরাটের নতুন রাজধানী হয় আহমেদাবাদ (পরে গান্ধিনগর)।
- নাগাল্যান্ড – নাগাল্যান্ডে পৃথক রাজ্যের দাবিতে গণ আন্দোলন না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার নাগাল্যান্ডকে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দান করে (1963 খ্রিস্টাব্দ)।
- পাঞ্জাব – পাঞ্জাবের শিখরা গুরুমুখীভাষী (পাঞ্জাবি) অঞ্চল নিয়ে পাঞ্জাবের সীমানা নির্ধারণ করার জন্য এক আন্দোলন গড়ে তোলে। তারা সিং -এর নেতৃত্বে আকালি দল এই আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। জনসংঘ হিন্দিভাষী ও হিন্দুদের সমর্থন করে। শেষে 1966 খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবকে বিভক্ত করে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও হিমাচল প্রদেশ গঠিত হয়।
স্বাধীন ভারতে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের মন্তব্য –
এইভাবে বিভিন্ন পুরোনো রাজ্য ভেঙে নতুন নতুন রাজ্য গড়ে ওঠে। রাজ্যগুলির সীমানা বদলে যায়।
ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন সম্পর্কে বোম্বাই প্রদেশের মানুষেরা কী দাবি করেছিলেন? তাদের দাবি কি স্বীকৃত হয়েছিল?
ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের ভূমিকা –
ভারত স্বাধীন হওয়ার অল্পকাল পর (1952 খ্রিস্টাব্দ) মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির তামিলভাষী অঞ্চল থেকে তেলুগুভাষী অঞ্চল পৃথক করে অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের দাবি ওঠে এবং তা সফল হয়। এই দৃষ্টান্ত মহারাষ্ট্র ও গুজরাট অনুসরণ করে।
ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন সম্পর্কে বোম্বাই প্রদেশের মানুষের দাবি –
1953 খ্রিস্টাব্দে গঠিত রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন 1956 খ্রিস্টাব্দে রাজ্য পুনর্গঠন আইন পাস করে। এর দ্বারা বৃহত্তর বোম্বাই প্রদেশ গঠিত হয়। কিছুকালের মধ্যে সংযুক্ত মহারাষ্ট্র সমিতি এবং মহা গুজরাট জনতা পরিষদ মারাঠিভাষী ও গুজরাটিভাষী রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন করে। দুই ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়।
ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের দারিপূরণ –
এই সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী মোরারজি দেশাই পদত্যাগ করেন। তখন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিরা স্থানীয় মানুষ ও নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করেন। দীর্ঘ আলোচনার পর জনগণের দাবি মেনে নিয়ে বোম্বাই প্রদেশকে বিভক্ত করে মহারাষ্ট্র ও গুজরাট রাজ্যের সৃষ্টি করা হয় (মে, 1960 খ্রিস্টাব্দ)। বোম্বাই মহারাষ্ট্রের এবং আহমেদাবাদ (পরে গান্ধিনগর) গুজরাটের নতুন প্রাদেশিক রাজধানী হয়।
ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের উপসংহার –
পাত্তি শ্রীরামালু পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যে পথের দিশা দেখান সেই পথ অনুসরণ করে অনেক রাজ্য আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সফল হয়।
সরকারি ভাষা আইন – টীকা লেখো।
সরকারি ভাষা আইনের ভূমিকা –
স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের সরকারি ভাষা কী হবে তা নিয়ে দীর্ঘদিন আলোচনা হয়েছে। 1950 খ্রিস্টাব্দ থেকে এ বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হলেও সরকারি ভাষা হিসেবে কোনো একটি ভাষাকে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
সরকারি ভাষা আইনের প্রাথমিক পদক্ষেপ –
1950 খ্রিস্টাব্দে সংবিধানে দেবনাগরী অক্ষরে হিন্দি ভাষাকে ‘সরকারি ভাষা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। 1955 খ্রিস্টাব্দে গঠিত সরকারি ভাষা কমিশনও হিন্দি ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে অ-হিন্দিভাষী বিভিন্ন রাজ্যে প্রবল বিরোধিতা শুরু হয়।
সরকারি ভাষা আইন পাস –
সরকারি ভাষা হিসেবে হিন্দি ভাষার বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার 1963 খ্রিস্টাব্দে সরকারি ভাষা আইন পাস করে।
সরকারি ভাষা আইনের ধারা –
1963 খ্রিস্টাব্দের সরকারি ভাষা আইনে বলা হয় –
- 1965 খ্রিস্টাব্দের পরেও সরকারি কাজকর্মে হিন্দি ভাষার সঙ্গে ইংরেজি ভাষা চালু থাকবে।
- রাজ্যের জন্য সরকারি ভাষা কী হবে তা রাজ্য বিধানসভাগুলি ঠিক করবে।
সরকারি ভাষা আইনের অষ্টম তফশিল –
1963 খ্রিস্টাব্দের সরকারি ভাষা আইন অনুসারে বিভিন্ন রাজ্য, বিধানসভা তাদের সরকারি ভাষা নির্দিষ্ট করে। ফলে 1964 খ্রিস্টাব্দে ‘সরকারি ভাষা’ হিসেবে অষ্টম তফশিলে 14টি ভাষা স্থান পায়। এগুলি হল – অসমিয়া, বাংলা, গুজরাটি, হিন্দি, কন্নড়, কাশ্মীরি, মালয়ালম্, মারাঠি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, সংস্কৃত, তামিল, তেলুগু ও উর্দু।
সংবিধানে স্বীকৃত ভাষাসমূহ (1964 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) কীভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
সংবিধানে স্বীকৃত ভাষাসমূহের ভূমিকা –
ভারত বহু ভাষাভাষী একটি দেশ। অন্যান্য বৈচিত্র্যের মতো ভাষার ক্ষেত্রেও ভারতে বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়।
সরকারি ভাষা কমিশন –
- 1955 খ্রিস্টাব্দে সরকারি ভাষা কমিশন গঠিত হয়।
- 1956 খ্রিস্টাব্দে সরকারি ভাষা কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে সুপারিশ করা হয় যে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাজকর্মে হিন্দি ভাষা বেশি করে ইংরেজি ভাষার জায়গা দখল করুক, যাতে 1965 খ্রিস্টাব্দে চূড়ান্ত পরিবর্তন ঘটতে পারে। কিন্তু ভাষা কমিশনের দুই সদস্য পশ্চিমবঙ্গের অধ্যাপক সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও তামিলনাড়ুর পি সুব্বারায়ান এর বিরোধিতা করেন।
- সরকারি ভাষা সম্পর্কে বলা হয় –
- দেবনাগরী লিপিযুক্ত ও আন্তর্জাতিক চিহ্নযুক্ত হিন্দি ভাষা হবে ভারতের সরকারি ভাষা।
- ইংরেজি ভাষা 1965 খ্রিস্টাব্দ (26 জানুয়ারি) পর্যন্ত আগের মতো ব্যবহৃত হবে। তারপর ধাপে ধাপে ইংরেজির জায়গা নেবে হিন্দি।
- রাজ্যস্তরে সরকারি ভাষা নিয়ে রাজ্য বিধানসভা সিদ্ধান্ত নেবে।
- কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারি ভাষা হবে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের এবং এক রাজ্যের সঙ্গে অন্য রাজ্যের সরকারের যোগাযোগের ভাষা।

অ-হিন্দিভাষী রাজ্যে বিরোধিতা –
সরকারি ভাষা কমিশনের সিদ্ধান্তে দক্ষিণ ভারতে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়। নেহরু দক্ষিণ ভারতের জনগণকে বলেন যে, ‘তাঁরা যদি হিন্দি শিখতে না-চান, তো শিখবেন না।’
সরকারি ভাষা আইন পাস –
নেহরুর আশ্বাসের অনুসরণে 1963 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় পার্লামেন্টে সরকারি ভাষা আইন পাস হয়। এই আইনের উদ্দেশ্য হল – 1965 খ্রিস্টাব্দের পর ইংরেজি ভাষার ব্যবহারের উপর সংবিধান আরোপিত বিধিনিষেধ দূর করা।
সংবিধান স্বীকৃত ভাষা –
রাজ্যের সরকারি ভাষা কী হবে তা রাজ্য বিধানসভাগুলি নির্ধারণের অধিকার পায়। বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা তাদের সরকারি ভাষা নির্দিষ্ট করে। 1964 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফশিলে ‘সরকারি ভাষা’ হিসেবে 14টি ভাষা স্বীকৃতি পায়। এই ভাষাগুলি হল –
- অসমিয়া,
- বাংলা,
- গুজরাটি,
- হিন্দি,
- কন্নড়,
- কাশ্মীরি,
- মালয়ালম্,
- মারাঠি,
- ওড়িয়া,
- পাঞ্জাবি,
- সংস্কৃত,
- তামিল,
- তেলুগু,
- উর্দু।
- 2002 খ্রিস্টাব্দে সংবিধানের অষ্টম তফশিলে –
- কোঙ্কনি,
- মণিপুরি,
- নেপালি এবং
- সিন্ধি ভাষা,
- সরকারি ভাষার স্বীকৃতি পায়।
- 2004 খ্রিস্টাব্দে –
- বোরো,
- ডোগরি, ও
- মৈথিলি এবং
- সাঁওতালি ভাষাও স্বীকৃতি পায়।
সংবিধানে স্বীকৃত ভাষাসমূহের মূল্যায়ন –
এর ফলস্বরূপ বর্তমানে সংবিধানস্বীকৃত ভারতীয় ভাষার সংখ্যা হল 22। তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এর বাইরে ইংরেজি ভাষা ‘সরকারি ভাষা’ হিসেবে স্বীকৃত।
ভারতে সরকারি ভাষা নির্ধারণ বিষয়ক বিতর্ক সম্পর্কে আলোচনা করো।
ভারতে সরকারি ভাষা নির্ধারণ বিষয়ক বিতর্কের ভূমিকা –
স্বাধীনতা লাভের পর ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনকে কেন্দ্র করে যেমন বিতর্কের ও প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়, তেমনি সরকারি ভাষানীতিকে কেন্দ্র করেও বিতর্ক ও প্রতিবাদী আন্দোলন দেখা দেয়। সরকারি ভাষা কমিশন গঠন, ভাষা আইন পাস করে শেষপর্যন্ত পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়।
সরকারি ভাষা নির্ধারণ বিষয়ক বিতর্ক –
স্বাধীন ভারতের সংবিধানের অষ্টম তফশিলের (Schedule-VIII) সতেরো নং অংশে (Part-XVII) 343, 344(1), 351 নং ধারায় (Article) সরকারি ভাষানীতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই ব্যাখ্যা থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে।
- হিন্দি প্রাধান্য – সংবিধানের 343 ধারায় বলা হয়েছে, হিন্দি ভারতের সরকারি ভাষা হিসেবে বিবেচিত হবে। সংবিধান চালু হওয়ার পর 15 বছর পর্যন্ত ইংরেজি ভাষাতেই সরকারি কাজকর্ম চলবে। ফলে অ-হিন্দিভাষী রাজ্য ও জনগণের মধ্যে ক্ষোভ জমতে শুরু করে।
- ভাষা কমিশন – 1955 খ্রিস্টাব্দে বি জি খের -এর সভাপতিত্বে ভাষা কমিশন গঠিত হয়। 1956 খ্রিস্টাব্দে এই কমিশন প্রথম প্রতিবেদন পেশ করে। কমিশন হিন্দি ভাষাকে গুরুত্ব দান করলেও হিন্দি ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব নয় বলে মত প্রকাশ করে। 1957 খ্রিস্টাব্দে কমিশনের দ্বিতীয় প্রতিবেদনেও একই মত প্রকাশ করা হয়।
- ভাষাবিরোধ – 1960 খ্রিস্টাব্দে অ-হিন্দিভাষীদের হিন্দিবিরোধিতা প্রকাশ্যে আসে। তামিলনাড়ু, আসাম, পাঞ্জাবে ভাষাবিরোধকে কেন্দ্র করে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। তামিলনাড়ুতে গণবিক্ষোভ ব্যাপকতা লাভ করে এবং সহিংস হয়ে ওঠে। পুলিশের গুলিতে আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের মৃত্যু ঘটে। এই পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এক পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। বলা হয়, হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজি সরকারি ভাষা থাকবে। একইসঙ্গে প্রাদেশিক ভাষাও মান্যতা পাবে।
- ভাষা আইন – কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুরজারিলাল নন্দ পার্লামেন্টের লোকসভায় সরকারি ভাষা বিল (The official Language Bill) পেশ করেন (13 এপ্রিল, 1963 খ্রিস্টাব্দ)। অনেক আলাপ-আলোচনার পর বিল (Bill)টি পাস হয়ে আইনে পরিণত হয় 1963 খ্রিস্টাব্দে। অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে এই আইনের বিরোধিতা আবার শুরু হয়। এই আইনে 14টি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এগুলি হল – অসমিয়া, বাংলা, ওড়িয়া, গুজরাটি, মারাঠি, কাশ্মীরি, তামিল, তেলুগু, মালয়ালাম্, কন্নড়, হিন্দি, গুরমুখী পাঞ্জাবি, উর্দু ও সংস্কৃত। এই আইনে বলা হয়, 1965 খ্রিস্টাব্দের 26 জানুয়ারির পরেও ভারত ইউনিয়নের এবং পার্লামেন্টের সমস্ত কাজে হিন্দির সঙ্গে ইংরেজি ভাষাও ব্যবহৃত হবে।
- প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা – 1965 খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ঘোষণা করেন, দেশের মানুষ যতদিন চাইবে ততদিন ‘পরিবর্ত ভাষা’ হিসেবে ইংরেজি চালু থাকবে। যেদিন অ-হিন্দিভাষী মানুষেরা ইংরেজি ভাষার বদলে হিন্দি ভাষা চাইবে তখন পরিবর্তন করা হবে।
- সংশোধনী – 1963 খ্রিস্টাব্দের ভাষা আইনের একটি সংশোধনী পাস হয় (ডিসেম্বর, 1967 খ্রিস্টাব্দ)। বলা হয়, হিন্দি ও ইংরেজি মাধ্যমে সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলি অনুষ্ঠিত হবে।
ভারতে সরকারি ভাষা নির্ধারণ বিষয়ক বিতর্কের মন্তব্য –
এইভাবে সরকারি ভাষা নির্ধারণকে কেন্দ্র করে বিতর্ক ও বিরোধের সৃষ্টি হয়।
ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দিকে কেন গ্রহণ করা হল?
হিন্দিকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে গ্রহণ করার ভূমিকা –
ব্রিটিশ ভারতে সরকারি কাজের ভাষা ও শাসক- আমলাদের ভাষা ছিল ইংরেজি। স্বাধীন ভারতে ইংরেজি ভাষা চালু থাকলেও ‘জাতীয়’ বা ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে হিন্দিকে গ্রহণ করা হয়। সংবিধানের অষ্টম তফশিলের সতেরোতম অংশের 343, 344(1), 351 নং ধারায় ভাষা বিষয়ে সূত্র দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে হিন্দি ভারতের ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে বিবেচিত হবে।
হিন্দিকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে গ্রহণ করার কারণ –
- ভাষাগত প্রাধান্য – ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলি বহুভাষী ছিল। স্বাধীন ভারতে এই প্রদেশ ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির সঙ্গে বহুসংখ্যক দেশীয় রাজ্য যুক্ত হয়। এর ফলে প্রদেশ ও অঞ্চলগুলির ভাষাগত বৈচিত্র্য বেড়ে যায়। এই অবস্থায় আঞ্চলিক ভাষাগুলি কোনো কোনো প্রদেশে প্রধান ভাষা হলেও তার পাশের প্রদেশে অপ্রধান ভাষা হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে হিন্দি ভাষা ব্যতিক্রম ছিল। এই ভাষা উত্তর ভারতের কয়েকটি প্রদেশের প্রধান ভাষা ছিল। ভারতের মোট জনসংখ্যার বিচারে এই ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি।
- সাধারণের বোধগম্য – হিন্দি ভাষা উত্তর ভারতের প্রধান ভাষা হলেও ভারতের সব জায়গায় এই ভাষার প্রচলন ছিল। এই ভাষা সহজসরল। এই ভাষা শেখা ও কথা বলার জন্য বই পড়ার দরকার হয় না, শুনে শুনেই এই ভাষা শেখা ও বলা যায়। এই ভাষা গান্ধিজি, জওহরলাল নেহরু-সহ বেশিরভাগ জাতীয় নেতাদের প্রিয় ভাষা ছিল।
- ভাষাতাত্ত্বিক আবেদন – ভারতের প্রধান প্রধান ভাষাগুলি সংস্কৃত ভাষা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। সংস্কৃত ও প্রাকৃত লিপির সংমিশ্রণে দেবনাগরী লিপির সৃষ্টি হয়। এই লিপি পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। হিন্দুধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে এই লিপি ও ভাষার ব্যবহার হয়। এই দেবনাগরী লিপির বিবর্তিত রূপ হল – হিন্দি, সংস্কৃত। দেবনাগরী ও হিন্দি ভাষার শব্দবন্ধ ও লিপিগত মিল আছে। হিন্দুধর্মপ্রধান ভারতে এই ভাষা ও লিপির আবেদন থাকবে- এ কথা অনুমান করা হয়। এই কারণেই ভারতীয় সংবিধানের দেবনাগরী লিপির সংস্করণ করা হয়।
- সরকারি ভাষা – 1835 খ্রিস্টাব্দে সরকারি কাজে ফারসি ভাষার বদলে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার চালু হয়। তারপর ব্রিটিশ সরকার বিহারের আদালতে ও সরকারি কাজে দেবনাগরী লিপির ব্যবহার চালু করে। ক্রমে তা অন্যান্য হিন্দিভাষী অঞ্চলে প্রসারিত হয়। সুতরাং ব্রিটিশ আমলেই ইংরেজি ভাষার বিকল্প হয়ে উঠেছিল হিন্দি ভাষা।
- জাতীয়তাবাদ – ভারতবর্ষ হিন্দুস্তান নামে পরিচিত ছিল। দেশভাগের পর পাকিস্তান সৃষ্টি হলে হিন্দুস্তান নামটির ব্যাপক প্রচলন হয়। ভারতের বেশিরভাগ মানুষ হিন্দু। ভারতের ভাষাগুলির মধ্যে প্রধান হল – হিন্দি। সদ্য স্বাধীন ভারতে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটাতে ও তা দৃঢ় করতে হিন্দি ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
হিন্দিকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে গ্রহণ করার মন্তব্য –
এই সমস্ত কারণ ছাড়াও সংবিধান সভার ভোটাভুটিতে হিন্দিকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ও দেশভাগ সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করো।
ভূমিকা –
ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশভাগের মূল ভিত্তি ছিল মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা (3 জুন, 1947 খ্রিস্টাব্দ)। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এট্লীর ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত ঘোষণার পরেই লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতের বড়লাট পদে নিযুক্ত হয়ে আসেন (24 মার্চ, 1947 খ্রিস্টাব্দ)।
পরিকল্পনা –
জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর মাউন্টব্যাটেন ‘ভারত বিভাগ’ সংক্রান্ত পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যা মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা নামে পরিচিত (3 জুন, 1947 খ্রিস্টাব্দ)।
মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা –
মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল —
- পাকিস্তান গঠন – ভারতের মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলিকে নিয়ে পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করে পাকিস্তান নামক একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা যেতে পারে। বাংলা ও পাঞ্জাবের ভাগের জন্য একটি সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠিত হবে।
- গণভোট – উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বালুচিস্তানের লোকেরা গণভোটের মাধ্যমে এই নবগঠিত রাষ্ট্রে যোগদানের প্রশ্নের মীমাংসা করবে। আসামের অন্তর্গত সিলেট জেলা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবে কিনা তা গণভোটের মাধ্যমে ঠিক করা হবে।
- স্বাধীনতা আইন – ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট শীঘ্রই আইন প্রণয়ন করবে। 1948 খ্রিস্টাব্দের জুনের পরিবর্তে 1947 খ্রিস্টাব্দের 15ই আগস্ট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।
উপসংহার –
মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারত বিভাজন ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। স্বাভাবিক কারণেই মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা মুসলিম লিগ ও জাতীয় কংগ্রেস মেনে নিয়েছিল। দাঙ্গা-হাঙ্গামা বিধ্বস্ত পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে অখণ্ড ভারতীয় আদর্শে বিশ্বাসী কংগ্রেস এই প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হয়। ঐতিহাসিক এস. আর. মেহরোত্রার মতে, ভারতবিভাগে সম্মত হয়ে কংগ্রেস নেতাগণ অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকারক বিকল্পটি পছন্দ করেছিলেন, (“In agreeing to the partition of India, Congress leaders chose the lesser evil.”) অন্যথায় দাসত্ব, গৃহযুদ্ধ বা নৈরাজ্য ভারতকে গ্রাস করত।
ভারতীয় স্বাধীনতা আইন সম্পর্কে একটি টীকা লেখো।
ভূমিকা –
লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভারত বিভাজন পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি স্পষ্ট হলেও চূড়ান্ত হয়নি। তা চূড়ান্ত হয়েছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আইনে (18ই জুলাই, 1947 খ্রিস্টাব্দ)।
ভারতীয় স্বাধীনতা আইন –
1947 খ্রিস্টাব্দের জুলাই-এ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় স্বাধীনতা বিল পাস হয় এবং ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জর্জের স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে তা আইনে পরিণত হয় (18ই জুলাই, 1947 খ্রিস্টাব্দ)। এই আইনের বিভিন্ন দিকগুলি হল —
- দুটি রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ – 1947 খ্রিস্টাব্দের 15ই আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করবে এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবে।
- দুটি রাষ্ট্রের এলাকা – ভারত ডোমিনিয়নের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে বোম্বাই, মাদ্রাজ, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, পূর্ব-পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের মুসলমান-অধ্যুষিত জেলাগুলি (সিলেট) বাদে আসাম, দিল্লি, আজমীর ও কুর্গ। পাকিস্তানের মধ্যে থাকবে পশ্চিম পাকিস্তান অঞ্চল (সিন্ধুপ্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান) ও পূর্ব বাংলা (পূর্ব পাকিস্তান), এবং আসামের শ্রীহট্ট জেলা।
- স্বতন্ত্র শাসনতন্ত্র গঠন – উভয় ডোমিনিয়নের গণ-পরিষদ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র বা সংবিধান রচনা করবে। যতদিন পর্যন্ত নতুন শাসনতন্ত্র বলবৎ হচ্ছে না, ততদিন এই দুইটি রাষ্ট্রই 1935 খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন দ্বারা (কিছু রদবদল করে) শাসিত হবে।
- দেশীয় রাজ্যের ভবিষ্যৎ – 1947 খ্রিস্টাব্দের 15ই আগস্ট থেকে ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির ওপর ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের অবসান হবে। এই রাজ্যগুলি নিজেদের পছন্দমতো ভারত অথবা পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগদানের অধিকার পাবে অথবা স্বাধীন থাকবে।
উপসংহার –
মাউন্টব্যাটেন একটু ধৈর্য ধরে অগ্রসর হলে হয়তো ভারত বিভাজন এড়ানো যেত। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের মধ্যে একমাত্র মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ভারত বিভাগের তীব্র বিরোধিতা করেন। ‘India Wins Freedom’ গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেছেন যে, দেশ বিভাগের ফলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভবপর ছিল না এবং কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা গৃহীত হলে ভারতের ঐক্য ও শান্তি উভয়ই বজায় থাকত।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির কারণগুলি বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা –
ভারতের স্বাধীনতালাভের পূর্বে দু’ধরনের রাজ্য ছিল যথা — ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশ এবং ব্রিটিশ কর্তৃত্বাধীন দেশীয় রাজ্য। দেশীয় রাজ্যগুলি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ছিল স্বশাসনের অধিকারী ; তাই এই রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্তি ছিল জরুরি।
ভারতভুক্তির কারণ –
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির কারণ হল –
- রাজ্যগুলির গুরুত্ব – ভারতে দেশীয় রাজ্যগুলির সংখ্যা ছিল 562টি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই রাজ্যগুলি ছিল সমগ্র ভারত-ভূখণ্ডের 48 শতাংশ এবং এই রাজ্যগুলির লোক সংখ্যা ছিল 9 কোটি।
- জাতীয়তাবাদী আদর্শ – ভারতের জাতীয় স্তরের নেতারা অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তাঁরা ভারত ভূ-খণ্ডের ভেতরে কোনো বিচ্ছিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নিতে রাজি ছিলেন না।
- জনগণের আকাঙ্ক্ষা – দেশীয় রাজ্যগুলি ছিল মধ্যযুগীয় ভাবধারা যুক্ত রাজতান্ত্রিক রাজ্য এবং এখানে ছিল স্বৈরাচারী শাসন ও সমাজ ছিল কুসংস্কারাগ্রস্ত। তাই এখানের তথাকথিত প্রজাদের অধিকাংশ এই অবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিল।
- প্রজা আন্দোলন – গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার দাবিতে ‘প্রজা মণ্ডল’ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। দেশীয় রাজ্যগুলিতে ভারতের জাতীয় নেতৃবর্গ ও কংগ্রেসের পক্ষে এই দাবিকে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। এই সমস্যার সমাধান ছিল রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি।
উপসংহার –
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণ ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ধরে রাখা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতির পক্ষে ছিল জরুরি। একারণেই সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সম্পূর্ণ হয়।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা –
ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতা, জাতীয় ঐক্য এবং প্রগতি ও পুনর্নির্মাণের জন্য দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণ করা হয়। ভারতের ‘লৌহ মানব’ রূপে পরিচিত সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ছিলেন এক্ষেত্রে প্রধান কৃতিত্বের অধিকারী।
প্রক্রিয়া –
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণে যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা হল –
- সংযুক্তিকরণ – বেশ কিছু দেশীয় রাজ্যকে পার্শ্ববর্তী ভারতীয় প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় উড়িষ্যা ও মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি, বোম্বাইয়ের সঙ্গে দক্ষিণাত্য ও গুজরাটের রাজ্যগুলিকে সংযুক্ত করা হয়। আবার গাড়োয়াল, রামপুর ও বেনারসকে উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে, কুচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে, খাসি পার্বত্য অঞ্চলকে আসামের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। মাদ্রাজের রাজ্যগুলিকে মাদ্রাজের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
- বৃহৎ যুক্তরাজ্য গঠন – দেশীয় রাজ্যগুলির বেশ কয়েকটি রাজ্যকে সংযুক্ত করে এক একটি বৃহৎ যুক্তরাজ্য গঠন করা হয়, যেমন — রাজস্থানের যুক্তরাজ্য, পাটিয়ালা ও পূর্ব পাঞ্জাব রাজ্য সংঘ (পেপসু), মধ্য ভারত যুক্তরাজ্য, বিন্ধ্যপ্রদেশ যুক্তরাজ্য ও ত্রিপুরা।
- কেন্দ্রীয় শাসনাধীন – বেশ কিছু রাজ্যকে কেন্দ্রীয় সরকার শাসিত এলাকার সঙ্গে যুক্ত করা হয় বা কেন্দ্রীয় শাসনাধীনে আনা হয়। হিমাচলপ্রদেশ, কচ্ছ, বিলাসপুর, ভোপাল, ত্রিপুরা ও মণিপুরকে কেন্দ্রীয় শাসনাধীনে আনা হয়।
উপসংহার –
সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, মোট 552টি দেশীয় রাজ্যের মধ্যে 216টি দেশীয় রাজ্যকে পার্শ্ববর্তী প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, 275টি দেশীয় রাজ্যকে পাঁচটি যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত করা হয় এবং 61টি রাজ্যকে কেন্দ্রীয় শাসনাধীনে আনা হয়।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলি কী ছিল?
ভূমিকা –
ভারতে প্রাক্-স্বাধীনতাপর্বে দু’ধরনের রাজ্য ছিল, যথা — ব্রিটিশশাসিত প্রদেশ এবং ব্রিটিশ কর্তৃত্বাধীন দেশীয় রাজ্য। বিভিন্ন সমস্যা অতিক্রম করে ভারত দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতভুক্ত করেছিল।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণের সমস্যাসমূহ –
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলি হল –
- বিক্ষিপ্ত সমস্যা – দেশীয় রাজ্যগুলি ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এরকম বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা রাজ্যগুলির মধ্যে ভূপাল, হায়দরাবাদ, ত্রিবাঙ্কুরসহ বেশ কিছু রাজ্য স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল।
- জাতীয়তাবাদী আদর্শে বাধা – অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আদর্শ দ্বারা পরিচালিত ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দেশীয় রাজ্যগুলির স্বাধীন থাকার মনোভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জওহরলাল নেহরু ঘোষণা করেন যে, ভারতের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে কোনো স্বাধীন দেশীয় রাজ্যের অস্তিত্ব স্বীকার করা যাবে না।
- প্রজা বিদ্রোহের আশঙ্কা – দেশীয় রাজ্যগুলি রাজতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক ও পশ্চাদপদ ছিল। তাই এই রাজ্যগুলির প্রজারা গণতান্ত্রিক ও উন্নত ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে উৎসুক ছিল। দেশীয় রাজ্যগুলিতে প্রজা বিদ্রোহের আশঙ্কাও দেখা দেয়।
- বিশেষ সমস্যা – 1948 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে হায়দরাবাদ ও জুনাগড় ব্যতীত অন্যান্য রাজ্যগুলি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। বিভিন্ন জটিলতার কারণে সমগ্র কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে ভারত সরকার ব্যর্থ হয়; কাশ্মীর সমস্যা আজও বর্তমান।
উপসংহার –
উপরোক্ত সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল কূটনীতি ও শক্তি প্রয়োগ করে দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতভুক্ত করেন।
কাশ্মীরের ভারতভুক্তিকরণ সমস্যাকে তুমি কীভাবে বিশ্লেষণ করবে?
ভূমিকা –
ভারতের স্বাধীনতালাভের প্রাক্কালে 562 টিরও বেশি দেশীয় রাজ্য ছিল এবং এগুলির অধিকাংশই ভারতে যোগ দিলেও জুনাগড়, হায়দরাবাদ, কাশ্মীর যোগ দেয়নি। শুধু তাই নয়, কাশ্মীর এক দীর্ঘসূত্রী সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
কাশ্মীর সমস্যার প্রেক্ষাপট –
কাশ্মীর সমস্যার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—
- হরি সিং-এর সিদ্ধান্ত – কাশ্মীর রাজ্য ছিল স্বাধীন এবং এই রাজ্যের রাজা হরি সিং ছিলেন হিন্দু, কিন্তু তাঁর অধিকাংশ প্রজাই ছিল মুসলিম। হরি সিং প্রথমদিকে ভারত বা পাকিস্তান কোনো রাষ্ট্রেই যোগ না দিয়ে তার স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট হন।
- পাকিস্তানের প্রচেষ্টা – রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কাশ্মীর ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। তাই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মহম্মদ আলি জিন্না কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে সচেষ্ট হন।
- শেখ আবদুল্লার ভূমিকা – কাশ্মীরের প্রধান রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের সভাপতি শেখ আবদুল্লা কাশ্মীরের ভারতভুক্তির পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে তুলেছিলেন।
- পাকিস্তানি আক্রমণ – পাকিস্তানের মদতপুষ্ট হানাদারগণ কাশ্মীর রাজ্য আক্রমণ করে উরি, বারমুলা প্রভৃতি স্থান দখল করে (22 অক্টোবর, 1947 খ্রিস্টাব্দ)।
উপসংহার –
উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য চেয়ে পাঠান। কিন্তু ভারত সরকার মহারাজা হরি সিং-কে শর্ত দেন যে, তিনি যদি ভারতভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করেন তবেই ভারত সামরিক সাহায্য প্রদান করবে। এই অবস্থায় মহারাজা হরি সিং শর্তসাপেক্ষে ভারতে যোগদান করেন (26 অক্টোবর, 1947 খ্রিস্টাব্দ)।
কাশ্মীর সমস্যার প্রকৃতি ও প্রভাব আলোচনা করো।
ভূমিকা –
ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে সমস্যাবহুল দেশীয় রাজ্যটি হল কাশ্মীর। ঘটনা পরম্পরায় কাশ্মীর ভারতে যোগদান করলেও কাশ্মীর নিজেই ভারতের কাছে একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
কাশ্মীর সমস্যার প্রকৃতি –
- পাকিস্তানি আক্রমণ – স্বাধীন রাজ্যরূপে কাশ্মীর রাজ্যের একটি ঐতিহ্য ছিল। তাই কাশ্মীর রাজা হরি সিং ভারত অথবা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন। ইতিমধ্যে পাকিস্তান-মদতপুষ্ট হানাদারগণ কাশ্মীর রাজ্য আক্রমণ করলে হরি সিং ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভারত সরকার শর্তসাপেক্ষে হরি সিং-কে সামরিক সাহায্য করলে হরি সিং ভারতের সঙ্গে যোগ দেন (26 অক্টোবর, 1947 খ্রিস্টাব্দ)।
- ‘আজাদ কাশ্মীর’ – কাশ্মীর রাজা হরি সিং-এর সামরিক সাহায্যের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীর থেকে পাক হানাদারদের বিতাড়ন করে। এরপর পাকিস্তান সুপরিকল্পিতভাবে ছদ্মবেশে পাক সেনাবাহিনীকে কাশ্মীরে প্রেরণ করলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি (1 জানুয়ারি, 1949 খ্রিস্টাব্দ) ঘটলেও কাশ্মীরের একটি অংশ পাকিস্তানের দখলে রয়ে যায়, যা ‘আজাদ কাশ্মীর’ নামে পরিচিত।
কাশ্মীর সমস্যার প্রভাব –
- অভ্যন্তরীণ প্রভাব – কাশ্মীর 1956 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় ইউনিয়নের একটি রাজ্যে পরিণত হয়।
- আন্তর্জাতিক প্রভাব – কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে একাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই সমস্যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে।
দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে জুনাগড়, হায়দরাবাদ ও কাশ্মীর রাজ্য কীভাবে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা –
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ সমস্যা ছিল জুনাগড়, হায়দরাবাদ রাজ্যের ভারতভুক্তির সমস্যা এবং কাশ্মীর সমস্যা। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল দাবাবোর্ডের সঙ্গে তুলনা করে বলেন— “হায়দরাবাদ রাজা, জুনাগড় বোড়ে এবং কাশ্মীর রানি”।
বিশেষ সমস্যা –
- জুনাগড় রাজ্য – কাথিয়াবাড় উপদ্বীপে অবস্থিত জুনাগড় রাজ্যের নবাব মুসলিম হলেও তার 80 শতাংশ প্রজা ছিল হিন্দু। জুনাগড় নবাব পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত (14 আগস্ট, 1947 খ্রিস্টাব্দ) গ্রহণ করলে জুনাগড় রাজ্যে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়। কাথিয়াবাড়ের কয়েকটি রাজ্যের আবেদনের ভিত্তিতে ভারত সেখানে সৈন্যদল প্রেরণ করে। শেষ পর্যন্ত গণভোটের ভিত্তিতে (ফেব্রুয়ারি, 1948 খ্রিস্টাব্দ) জুনাগড় রাজ্য ভারতে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে মত দেয় এবং তা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় (1949 খ্রিস্টাব্দ)।
- হায়দরাবাদ – হায়দ্রাবাদ শাসক নিজাম উসমান আলি খান বিভিন্নভাবে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে ও ভারত সরকারের নির্দেশ অমান্য করতে সচেষ্ট হয়। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল জয়ন্তনাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে “অপারেশন পোলো” পরিচালিত হয় এবং ভারতীয় বাহিনী হায়দরাবাদ দখল করে (17 সেপ্টেম্বর, 1948 খ্রিস্টাব্দ)। পরের বছর নিজাম একটি চুক্তির মাধ্যমে ভারতভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করে এবং 1950 খ্রিস্টাব্দের 26 জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে হায়দরাবাদ ভারত-ভুক্ত হয়।
- কাশ্মীর – স্বাধীন রাজ্যরূপে কাশ্মীর রাজ্যের উপস্থিতির ঐতিহ্য ছিল। তাই কাশ্মীর রাজা হরি সিং ভারত অথবা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন। ইতিমধ্যে পাকিস্তান-মদতপুষ্ট হানাদারগণ কাশ্মীর রাজ্য আক্রমণ করলে হরি সিং ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভারত সরকার শর্তসাপেক্ষে হরি সিং-কে সামরিক সাহায্য করলে হরি সিং ভারতের সঙ্গে যোগ দেন (26 অক্টোবর, 1947 খ্রিস্টাব্দ)।
উপসংহার –
দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে এই তিনটি রাজ্যের মধ্যে জুনাগড় ও হায়দরাবাদ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু কাশ্মীর সমস্যার আপাত সমাধান হলেও তা ভারতের জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
হায়দ্রাবাদ ভারতভুক্তির প্রেক্ষাপট আলোচনা করো।
ভূমিকা –
ভারতের স্বাধীনতালাভের প্রাক্কালে ভারতের অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণ সমস্যা। এক্ষেত্রে প্রধানতম সমস্যা ছিল হায়দরাবাদ ও কাশ্মীর সমস্যা।
হায়দ্রাবাদ –
হায়দরাবাদ শাসক নিজাম উসমান আলি খান মুসলমান হলেও সেখানকার জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল হিন্দু। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা ভারতে যোগদানের পক্ষপাতী হলেও নিজাম হায়দ্রাবাদ স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট হন। পাশাপাশি ভারতবিরোধী কার্যকলাপেরও সূচনা করেন। তিনি কাসিম রিজভি নামক একজন উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির প্রভাবে একটি উগ্রপন্থী সাম্প্রদায়িক বাহিনী ‘রাজাকার’ গঠন করেন। এই বাহিনী হায়দ্রাবাদ অভ্যন্তরে হিন্দু জনসাধারণের উপর অত্যাচার চালায়।
হায়দ্রাবাদ ভারতভুক্তি –
হায়দ্রাবাদ শাসক বিভিন্নভাবে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে ও ভারত সরকারের নির্দেশ অমান্য করতে সচেষ্ট হয়। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল জয়ন্তনাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন পোলো’ পরিচালিত হয় এবং ভারতীয় বাহিনী হায়দরাবাদ দখল করে (17 সেপ্টেম্বর, 1948 খ্রিস্টাব্দ)। পরবর্তীতে নিজাম ভারতভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করেন এবং 1950 খ্রিস্টাব্দের 26 জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে হায়দরাবাদ ভারত-ভুক্ত হয়।
গুরুত্ব –
আনুষ্ঠানিকভাবে হায়দ্রাবাদ ভারতের অন্তর্ভুক্তি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কারণ—
- হায়দ্রাবাদ মুসলিমসহ ভারতের অন্যান্য স্থানের মুসলিমরা নিজামবিরোধী আন্দোলনে ভারত সরকারের নীতিকে সমর্থন জানায়। তাই হায়দ্রাবাদ অন্তর্ভুক্তি ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার সূচনা করে।
- ভারতীয় সেনাবাহিনী নিজামের সেনাদল ও ‘রাজাকার’ বাহিনীকে দমনের পাশাপাশি তেলেঙ্গানার সংগ্রামী কৃষকদের দমন করে। ফলে এই অঞ্চল পূর্বাপেক্ষা নিরাপদ হয়ে ওঠে।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির প্রভাব আলোচনা করো।
ভূমিকা –
প্রাক্-স্বাধীনতা পর্বে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত অন্তর্ভুক্তিকরণ সমস্যা ছিল প্রধানতম সমস্যা। মূলত সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের উদ্যোগেই দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সম্পন্ন হয় এবং ভারত সমস্যামুক্ত হয়।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির প্রভাব –
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রভাববিস্তারকারী ঘটনা। কারণ —
- ভৌগোলিক ঐক্যরক্ষা – ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোটো-বড়ো রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির ফলে ভারতের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ঐক্য সম্পন্ন হয়।
- অর্থনৈতিক উন্নতি – দেশীয় রাজ্যগুলি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ছিল পশ্চাদপদ এবং রাজতান্ত্রিক। তাই ভারতের সর্বত্র একই ধরনের অর্থনৈতিক নীতি ও গণতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ধর্মনিরপেক্ষতা – দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি শক্তিশালী হয়। উদাহরণস্বরূপ, জুনাগড়, হায়দরাবাদ ও কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে হায়দ্রাবাদ নিজামবিরোধী বা জুনাগড়ের নবাববিরোধী আন্দোলনের সপক্ষে অথবা কাশ্মীরে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলমানগণ ভারত সরকারকেই সমর্থন করে।
- বৈচিত্র্য রক্ষা – ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির ফলে ভারতীয় ঐতিহ্য, বৈচিত্র্য ও ঐক্য অক্ষুণ্ণ থাকে। তা ছাড়া দেশীয় রাজ্যগুলির সিংহভাগ শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভারতে যোগদান না করলে গৃহযুদ্ধ ছিল অবশ্যম্ভাবী। তাই দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তির ঘটনা ভারতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে।
উপসংহার –
এভাবে দেখা যায় যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি ভারতের অখণ্ড জাতীয়তাবাদের আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করলেও দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিকরণ ভারতের জাতীয় আদর্শ ও সংস্কৃতিকে জোরদার করে তুলেছিল।
সীমানা কমিশন ও তার রিপোর্টের ভিত্তিতে পাঞ্জাব ও বঙ্গবিভাজনের প্রসঙ্গটি বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা –
মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক ভারত-বিভাজনের প্রস্তাবের পাশাপাশি পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাজনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই উদ্দেশ্যে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের নেতৃত্বে ও সভাপতিত্বে দুটি সীমানা কমিশন গঠিত হয় (জুন, 1947 খ্রিস্টাব্দ)।
সীমানা বিভাজনের ভিত্তি –
শিখ ও মুসলিম অধ্যুষিত পাঞ্জাব ও মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাকে বিভাজনের জন্য সিরিল র্যাডক্লিফের কাছে কোনো ‘মডেল’ ছিল না। তা ছাড়া র্যাডক্লিফের নেতৃত্বে গঠিত সীমানা কমিশন বঙ্গ ও পাঞ্জাব সীমানা বিভাগের জন্য মাত্র ছয় সপ্তাহ সময় পেয়েছিল। এই স্বল্প সময়ে রিপোর্ট তৈরির জন্য তিনি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস ও প্রাকৃতিক সীমারেখারূপে নদীকেই বিভাজনরেখারূপে গুরুত্ব দেন। এ ছাড়া অন্যান্য ভিত্তিগুলি হল প্রাকৃতিক সম্পদ, রেল ও বাস যোগাযোগ, প্রশাসনিক কেন্দ্র ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপরেও ভিত্তি করে তিনি তাঁর রিপোর্ট তৈরি করেন।
সীমানা বিতর্ক –
কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরু গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেনকে র্যাডক্লিফের সীমানা বিভাজন সংক্রান্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বললেও মাউন্টব্যাটেন তা করেননি। তবে র্যাডক্লিফের উপর পাঞ্জাব সম্পর্কে শিখ ও মুসলিমদের একটি অদৃশ্য চাপ ছিল। বিভিন্ন ধরনের সাম্প্রদায়িক গুজবও ছড়িয়ে পড়ে।
রিপোর্ট পেশ –
র্যাডক্লিফ মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে সীমানা কমিশনের রিপোর্ট পেশ করেন (17 আগস্ট 1947 খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর এই রিপোর্টে বাংলাকে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে বিভক্ত করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে আসে কলকাতাসহ 36 শতাংশ এলাকা ও 35 শতাংশ অধিবাসী। আবার মুসলমানদের 16 শতাংশ পড়ে পশ্চিমবঙ্গে এবং হিন্দুদের 42 শতাংশ পড়ে পূর্ববঙ্গে। অন্যদিকে পাঞ্জাবকে পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিম পাঞ্জাবে বিভক্ত করা হয়। পূর্ব পাঞ্জাবে আসে সমগ্র পাঞ্জাবের 38 শতাংশ এলাকা ও মোট জনসংখ্যার 40 শতাংশ।
উপসংহার –
র্যাডক্লিফ রিপোর্ট ছিল অতি কঠিন, অপ্রিয় ও বিবেকহীন। তাঁর এই রিপোর্টের ভিত্তিতেই ভারত বিভাজন বাস্তবরূপ পায় এবং উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভব হয়। তাই এই রিপোর্ট এক সমস্যার সমাধান করতে অন্য এক সমস্যার সৃষ্টি করে।
ভারতে 1947 – এর পরবর্তীকালে উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভব কিভাবে হয়েছিল?
ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাজন এবং একইসঙ্গে পাঞ্জাব ও বঙ্গবিভাজনের ঘটনা ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যার সূচনা করেছিল। ভারত সরকারের কাছে উদ্বাস্তু সমস্যা ছিল এক বড়ো সমস্যা।
উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভবের কারণ –
ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভবের বহুবিধ কারণ ছিল। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
- দেশভাগ – লর্ড মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক মুসলিম লিগের পাকিস্তান দাবি মেনে নিয়ে ভাষা ও ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাজন ছিল উদ্বাস্তু সমস্যার মূল কারণ। এর ফলে ভারতের সীমান্ত বরাবর পাকিস্তানের হিন্দু ও শিখরা নিজেদের বসবাড়ি, জমি-জমা ছেড়ে ভারতে চলে আসতে থাকে।
- বঙ্গ ও পাঞ্জাব বিভাজন – স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের নেতৃত্বে গঠিত সীমানা কমিশনের রিপোর্টে বঙ্গকে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ এবং পাঞ্জাবকে পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিম পাঞ্জাবে বিভক্ত করা হয়। এই বিভাজনের ফলে পূর্ববঙ্গে বা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা এবং পশ্চিম পাঞ্জাবের শিখরা ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়।
- নিরাপত্তার অভাব – উদ্বাস্তু হয়ে হিন্দু ও শিখদের ভারতে চলে আসার মূল কারণ ছিল দেশভাগজনিত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, হিংসা ও নিরাপত্তার অভাববোধ। পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দুরা নিরাপত্তার কারণেই ভারতে চলে আসে। একইভাবে ভারত থেকে মুসলমানরা চলে যায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে।
- ধর্ম ও সংস্কৃতি – ভারতে উদ্বাস্তুদের আগমনের পশ্চাতে ধর্ম ও সংস্কৃতিরও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু-মুসলিম পাশাপাশি বাস করলেও দেশভাগের প্রাক্কালে ও পরবর্তীকালে এই দুই ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে বহুযোজন দূরত্ব তৈরি হয়। তাই সমধর্মী ধর্ম ও সংস্কৃতির টানেই হিন্দু ও শিখরা ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসে।
উপসংহার –
এভাবে দেখা যায় যে, উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভবের পশ্চাতে ছিল রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হিংসা, নিরাপত্তার অভাব ও নিরাপদ আশ্রয় অনুসন্ধান প্রভৃতি।
উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে ভারত সরকারের উদ্যোগ বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা –
ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের স্রোত ছিল পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গমুখী। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আসা উদ্বাস্তুরা পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লি, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা কলকাতা ও কলকাতা সন্নিহিত চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, মুরশিদাবাদ, মালদা, দিনাজপুর প্রভৃতি স্থানে আশ্রয় নেয়।
সরকারের উদ্যোগ –
উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে ভারত সরকারের উদ্যোগের বিভিন্ন দিকগুলি হল —
- পুনর্বাসন নীতি – ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উদ্বাস্তু সমস্যার ব্যাপকতা উপলব্ধি করেন এবং এই ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের নীতির ওপর গুরুত্ব দেন। তাই স্বাধীনতার প্রথম পাঁচ বছর ‘পুনর্বাসনের যুগ’ নামে পরিচিত।
- উদ্বাস্তু শিবির – উদ্বাস্তুদের বাসস্থান, আহার ও নিরাপত্তাদানের জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর সংখ্যক অস্থায়ী বাসস্থান বা শিবির তৈরি করা হয়। এই শিবিরগুলিতে নথিভুক্ত উদ্বাস্তুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব ও সরকারি সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।
- সরকারি সাহায্য – গ্রামীণ স্তরের উদ্বাস্তুদের জমিদান, কৃষিঋণ ও গৃহনির্মাণে ভর্তুকি বা সরকারি সাহায্য দেওয়া হয়। অন্যদিকে শহরাঞ্চলে উদ্বাস্তুদের জন্য শিল্প ও কারিগরি শিক্ষা প্রদান ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করা হয়।
- দিল্লি চুক্তি – ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের সঙ্গে যৌথ চুক্তিতে আবদ্ধ হন (8 এপ্রিল, 1950 খ্রিস্টাব্দ) যা নেহরু-লিয়াকত চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তিতে বলা হয় যে, সংখ্যালঘুরা যে যার রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবে এবং তার কাছেই প্রতিকার চাইবে। ভবিষ্যৎ দাঙ্গা প্রতিহতকরণের ব্যবস্থা করা হবে এবং উদ্বাস্তুদের নিজের দেশে প্রত্যাবর্তনে উৎসাহদান করা হবে।
উপসংহার –
উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে ভারত সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও তা ছিল মূলত দিল্লি ও পূর্ব পাঞ্জাব নির্ভর। পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু সমস্যা অবহেলিত হয়েছিল। তাছাড়া উদ্বাস্তু শিবিরগুলি ছিল শহর থেকে দূরে এবং অধিকাংশক্ষেত্রেই সেখানে পানীয় জল, শৌচালয় বা ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবাও ছিল না।
উদ্বাস্তু সমস্যার ক্ষেত্রে পাঞ্জাব ও বাংলার পার্থক্যগুলি কী ছিল তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা –
1947 খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাজন এবং একইসঙ্গে পাঞ্জাব ও বঙ্গ বিভাজনের ঘটনা ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যার সূচনা করেছিল। ভারত সরকারের কাছে উদ্বাস্তু সমস্যা ছিল এক বড়ো সমস্যা।
পার্থক্য –
পাঞ্জাব বিভাজনের সঙ্গে বাংলা বিভাজনের বেশ কিছু মিল থাকলেও পার্থক্য ছিল বেশি, যেমন—
- জনহস্তান্তর – পাঞ্জাব বিভাজনের ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের মধ্যে জনহস্তান্তর ও সম্পত্তির বিনিময় করা হলেও বাংলার ক্ষেত্রে তা হয়নি।
- আগমন – পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে পূর্ব পাঞ্জাবে উদ্বাস্তুদের আগমন ঘটেছিল দু’বছর ধরে। কিন্তু বাংলায় তা ছিল ধারাবাহিক।
- আশ্রয়স্থান – ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের স্রোত ছিল পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গমুখী। পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আসা উদ্বাস্তুরা পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লি, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা কলকাতা ও কলকাতা সন্নিহিত চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, মুরশিদাবাদ, মালদা, দিনাজপুর প্রভৃতি স্থানে আশ্রয় নেয়।
- ভাষাগত সমস্যা – পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের ভাষাগত সমস্যা না থাকার কারণে পাঞ্জাবি ও সিন্ধি উদ্বাস্তুরা দিল্লি, হরিয়ানা, হিমাচলপ্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারলেও পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত বাংলা ভাষী উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম ছাড়া অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করতে পারেনি।
উপসংহার –
উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় — জওহরলাল নেহরু বাংলার উদ্বাস্তু সমস্যা অপেক্ষা পাঞ্জাবে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে অধিক গুরুত্ব দেন। তাঁর কথায়, পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু উদ্বাস্তুদের পশ্চিমমুখী যাত্রার মূল কারণ ছিল ‘নিছক কাল্পনিক ভয়’।
উউদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান ও দিল্লি চুক্তির মধ্যে কী সম্পর্ক ছিল তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা –
উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয় এবং এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক দিক ছিল নেহরু-লিয়াকত চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি (8 এপ্রিল, 1950 খ্রিস্টাব্দ)।
প্রেক্ষাপট –
স্বাধীনতালাভের পরবর্তী দু’বছরের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে উদ্বাস্তুদের আগমন বন্ধ হয়ে যায়। তবে মহাত্মা গান্ধির হত্যার পরেও সাম্প্রদায়িক সমস্যা বা অন্যান্য কারণকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হ্রাস পায়নি। সর্বোপরি পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের আগমন হ্রাস পায়নি। এই প্রেক্ষাপটেই জওহরলাল নেহরু পাকিস্তানকে পালটা চাপ প্রদানের নীতি গ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের সঙ্গে দিল্লি চুক্তি সম্পাদন করেন।
শর্ত –
দিল্লি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী:
- ভারত ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা নিজ নিজ রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থেকে নিজের রাষ্ট্রের কাছেই সমস্যার প্রতিকার চাইবে।
- পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম থেকে কোনো নাগরিক অন্য দেশে শরণার্থী হতে চাইলে তাকে সাহায্য করা হবে।
- সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণ অনুসন্ধান ও ভবিষ্যৎ দাঙ্গা প্রতিহতকরণের জন্য অনুসন্ধান কমিটি ও সংখ্যালঘু কমিটি গঠন করা হবে।
- পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রীসভায় সংখ্যালঘু প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করা হবে।
সমালোচনা –
দিল্লি চুক্তি উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে যথাযথ বা কঠোর ছিল না। তাই এই চুক্তি অনেকের কাছেই ছিল হতাশাজনক। এই চুক্তির প্রতিবাদে জওহরলাল নেহরুর মন্ত্রীসভার সদস্য ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ডঃ ক্ষিতিশ চন্দ্র নিয়োগী মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এই চুক্তির বাস্তবায়ন বিষয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়।
স্মৃতিকথায় দেশভাগ কীভাবে দেশভাগ সম্পর্কিত ইতিহাসচর্চায় নতুন উপাদান সরবরাহ করেছে তা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকা –
দেশভাগ সম্পর্কিত ইতিহাসচর্চায় সরকারি নথিপত্রের পাশাপাশি 1970-এর দশক থেকে ‘আত্মজীবনী’ ও ‘স্মৃতিকথা’কেও উপাদানরূপে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। ‘স্মৃতি’ হল এক জটিল মনস্তত্ত্ব; বর্তমানের প্রেক্ষিতে অতীতের ঘটনাগুলি হাতড়ে হাতড়ে যা মনে করা যায় তাই হল স্মৃতি। তাই দেশভাগের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা উদ্বাস্তু বা প্রত্যক্ষদর্শীদের ‘স্মৃতিকথা’র ভিত্তিতে এ সম্পর্কিত অনেক অজানা ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের স্মৃতি –
কথোপকথন বা লেখনীর মাধ্যমে ‘স্মৃতিকথা’য় দেশভাগের ইতিহাসকে তুলে ধরা হয়, যেমন –
- দেশের স্মৃতি – উদ্বাস্তুদের অনেকেই তাঁদের পূর্ববর্তী দেশ বা মাতৃভূমির স্মৃতিচারণ করে থাকে। এই স্মৃতিতে নিজেদের ফেলে আসা ঘর-বাড়ি, জমি-জায়গা, গাছপালা, বন্ধু-বান্ধব, খাওয়া-দাওয়া, আবহাওয়া-জলবায়ুর কথা প্রতিফলিত হয়।
- দেশভাগের স্মৃতি – লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভারত-বিভাজন, স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের বঙ্গ ও পাঞ্জাব সীমান্ত নির্ধারণের সময় থেকেই পূর্ববঙ্গের হিন্দু ও পশ্চিম পাঞ্জাবের শিখদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। সর্বক্ষণ তাঁদের তাড়া করত কী হয় কী হয় আতঙ্ক। স্মৃতিকথায় এই আতঙ্কের প্রতিফলন পাওয়া যায়।
- দেশ পরিত্যাগের স্মৃতি – হিংসা ও অত্যাচারের সম্মুখীন হয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করে অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসা, উদ্বাস্তু শিবিরে থাকা বা এদেশে জমি-বাড়ি কিনে নতুনভাবে বসবাস শুরুর কথা বা জীবন সংগ্রামের কথা জানা যায়।
- ত্রাণ ও পুনর্বাসনের স্মৃতি – ভারত সরকার কর্তৃক উদ্বাস্তুদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কথা জানা যায়। এক্ষেত্রে বাংলা অপেক্ষা দিল্লিই অগ্রাধিকার পেয়েছিল। বাংলার উদ্বাস্তুদের যে পুনর্বাসন ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল তা কলকাতার নিকটবর্তী স্থানে ছিল না। এই ক্যাম্পগুলিতে পানীয় জল ও শৌচাগারের সমস্যার কথা, কলহের কথা, পুলিশি অত্যাচারের কথা জানা যায়।
উপসংহার –
স্মৃতিকথা’ নির্ভর ইতিহাস সবক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে দেশভাগের ফলে যেহেতু বিশাল সংখ্যক শিখ ও হিন্দুকে উদ্বাস্তুরূপে ভারতে আসতে হয়েছিল সেক্ষেত্রে অনেকের স্মৃতির ভিত্তিতে একটি সাধারণ ইতিহাস রচনা করা যেতেই পারে।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ও আইন – টীকা লেখো।
ভূমিকা –
দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতে অন্তর্ভুক্তিকরণ করে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সমস্যার সমাধান করা হলেও 1950 -এর দশকে রাজ্য পুনর্গঠন সংক্রান্ত সমস্যার উদ্ভব হয়। এই উদ্দেশ্যে গঠিত হয় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ও আইন (1953-1956)।
প্রেক্ষাপট –
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠনের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে,
- কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি – স্বাধীনতার পূর্বে কংগ্রেস প্রচার করেছিল যে, স্বাধীনতার পরবর্তীকালে প্রতিটি প্রধান ভাষাগোষ্ঠীর জন্য পৃথক পৃথক ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠিত হবে। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতালাভের পর ভারতের জাতীয় সংহতি ও প্রশাসনিক কারণে কংগ্রেস ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের বিরোধিতা করে। এমনকী কংগ্রেসের দলের সদস্যদের নিয়ে গঠিত জে. ভি. পি. রিপোর্টে (1948 খ্রিস্টাব্দ) ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের বিষয়টি থামিয়ে রাখা হয়।
- অন্ধ্রপ্রদেশের গঠন – তেলুগু ভাষীদের জন্য পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠিত হলে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের দাবি ওঠে। এরই প্রেক্ষাপটে ফজল আলির নেতৃত্বে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠিত হয় (আগস্ট, 1953 খ্রিস্টাব্দ)। রাজ্য পুনর্গঠন করা হবে কি না বা হলেও এর ভিত্তি কী হবে, কত সংখ্যক রাজ্য পুনর্গঠিত হবে বা রাজ্য পুনর্গঠনের সুফল-কুফল আলোচনা করে সুপারিশ করা ছিল এর প্রধান কাজ।
রিপোর্ট পেশ –
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন অনেক আলাপ-আলোচনার পর 1955 খ্রিস্টাব্দের 30 সেপ্টেম্বর তাদের রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টে বলা হয় যে,
- ইতিপূর্বে গঠিত প্রথম (A), দ্বিতীয় (B) ও তৃতীয় (C) শ্রেণির রাজ্যগুলি বিলোপ করে শুধুমাত্র ‘রাজ্য’ ও ‘কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল’রূপে ভারতকে পুনর্গঠন করতে হবে।
- উপজাতি অধ্যুষিত এলাকাগুলির ওপর গুরুত্ব প্রদানের পরিবর্তে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠন করতে হবে। তবে বোম্বাই ও পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে এই নীতি প্রযুক্ত হবে না।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের রিপোর্ট কিছু সংশোধনের পর ভারতীয় সংসদের অনুমোদন লাভ করে এবং তা রাজ্য পুনর্গঠন আইনরূপে কার্যকর হয় (নভেম্বর, 1956 খ্রিস্টাব্দ)। এই আইনে 14টি রাজ্য ও 6টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠনের কথা বলা হয়।
ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কীভাবে সম্পন্ন হয়েছিল তা আলোচনা করা।
ভূমিকা –
ভারতে দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তি বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করেছিল এবং এই রাজ্যগুলির সীমানা কী হবে অথবা রাজ্যগুলি ভাষাভিত্তিক বা উপজাতিভিত্তিক রাজ্য হবে কিনা সে সম্পর্কে বিতর্ক দেখা দেয়। স্বাধীন তেলুগু ভাষাভিত্তিক অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠন এই বিতর্কে ইন্ধন জোগায়।
ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন –
ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ও আইনের ভিত্তিতে 16টি প্রদেশ ও 3টি কেন্দ্রশাসিত রাজ্য গঠনের কথা বলা হয়। এই আইনের ভিত্তিতে
- হায়দরাবাদ থেকে তেলেঙ্গানাকে বিচ্ছিন্ন করে অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
- মালাবার ও ত্রিবাঙ্কুর কোচিনকে যুক্ত করে গঠন করা হয় কেরালা।
- কন্নড় ভাষী অঞ্চলগুলিকে মহীশূরের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
- কচ্ছ, সৌরাষ্ট্র ও হায়দ্রাবাদ মারাঠী ভাষী অঞ্চলের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় বৃহত্তর বোম্বাই প্রদেশ।
- বিহারের পূর্ণিয়া জেলার কিছু অংশ ও পুরুলিয়াকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
প্রতিক্রিয়া –
এভাবে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠিত হলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিক্রিয়ার সূচনা হয় এবং ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের দাবি আরও জোরালো হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত
- বোম্বাই-প্রদেশকে দু’ভাগ করে মারাঠি ভাষী মহারাষ্ট্র ও গুজরাটি ভাষী গুজরাট রাজ্য তৈরি করা হয়। 1960 খ্রিস্টাব্দে।
- পাঞ্জাব প্রদেশকে ভেঙে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা নামক দুটি রাজ্য তৈরি করা হয় (1966 খ্রিস্টাব্দ)।
গুরুত্ব –
ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের ফলে কয়েকটি ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গড়ে ওঠে, যেমন অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি। এর ফলে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী গুরুত্ব লাভ করে। তবে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠন ভারতের জাতীয় সংহতির পক্ষে আপাত ক্ষতিকারক হলেও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গিতে তা ক্ষতিকারক ছিল না।
উপসংহার –
তাই ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন ছিল। রাজ্য পুনর্গঠনের এক যুক্তিসংগত পদক্ষেপ। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের বিষয়টি বেশ কিছু জটিলতারও সৃষ্টি করেছিল।
আজকের আর্টিকেলে আমরা দশম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের অষ্টম অধ্যায় “উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারত: বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (1947-1964)” এর “বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন” থেকে পরীক্ষায় আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো দশম শ্রেণির মাধ্যমিক পরীক্ষা, এমনকি চাকরি বা যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যও উপযোগী। কারণ, এই অধ্যায়ের প্রশ্ন প্রায়ই বিভিন্ন পরীক্ষায় কমন আসে।
আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদি কোনো প্রশ্ন, মতামত বা সাহায্যের প্রয়োজন হয়, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন কিংবা টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন—আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।
ধন্যবাদ সবাইকে।
মন্তব্য করুন