মাধ্যমিক জীবনবিজ্ঞান – জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় – উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা এবং সাড়াপ্রদান – সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

উদ্দীপক: পরিবেশের যে পরিবর্তনগুলি জীবের দ্বারা শনাক্ত হয় এবং যাদের উপস্থিতিতে জীব সাড়া প্রদান করে, তাদের উদ্দীপক বলে।
উদ্দীপনা: উদ্দীপকের উপস্থিতির কারণে সৃষ্ট একপ্রকার শক্তি যা জীব অনুভব করতে পারে, তাকে উদ্দীপনা বলে।

উদ্দীপক ও উদ্দীপনার সম্পর্ক: উদ্দীপকের উপস্থিতিতেই জীবদেহে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। পরিবেশের সমস্ত জীবই কম-বেশি উদ্দীপকের উদ্দীপনায় সাড়া দেয়। অর্থাৎ, উদ্দীপক কারণ হলে উদ্দীপনা তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া।
উদ্দীপকের প্রকারভেদ: উৎস অনুযায়ী উদ্দীপক দুই প্রকার—বাহ্যিক উদ্দীপক ও অভ্যন্তরীণ উদ্দীপক।

উদ্ভিদের সংবেদনশীলতার বা সাড়া প্রদানের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল লজ্জাবতী উদ্ভিদ। লজ্জাবতী উদ্ভিদের পাতাকে স্পর্শ করলে, তার পত্রকগুলি নুয়ে পড়ে। এটি স্পর্শ উদ্দীপনায় সাড়া প্রদানের ঘটনা।

ক্রেসকোগ্রাফ: ক্রেসকোগ্রাফ (crescograph) হল বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্ৰ বসু আবিষ্কৃত একপ্রকার অত্যন্ত সংবেদনশীল যন্ত্র, যার সাহায্যে উদ্ভিদের সামান্য সাড়া প্রদানের ঘটনাও পরিমাপ করা যায়। বিজ্ঞানী বসু এই যন্ত্রের সাহায্যে লজ্জাবতী লতা ও বনচাঁড়াল উদ্ভিদের সাড়া প্রদানের পরীক্ষানিরীক্ষা করেন।

উদ্ভিদ বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ উদ্দীপকের প্রভাবে সৃষ্ট উদ্দীপনায় সাড়া প্রদান করে। সাধারণত এই সাড়া প্রদান অত্যন্ত ধীর এবং তা মূলত বৃদ্ধিঘটিত বা রসস্ফীতিজনিত হয়ে থাকে। উদ্ভিদের ক্ষেত্রে দ্রুত সাড়া প্রদানের ঘটনা প্রায় বিরল (ব্যতিক্রম – লজ্জাবতী, বনচাঁড়াল)। অধিকাংশ উদ্ভিদ একটি নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালন বা চলনের মাধ্যমে সাড়া প্রদান করে।

যে প্রক্রিয়ায় জীব এক জায়গায় স্থির থেকে উদ্দীপকের প্রভাবে সাড়া দিয়ে বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেহের কোনো অংশ সঞ্চালন করে, তাকে চলন বলে।

উদ্ভিদ চলন প্রক্রিয়াকে প্রাথমিকভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়— সামগ্রিক চলন বা গম, বক্ৰচলন

স্বতঃস্ফূর্ত বা বাহ্যিক উদ্দীপকের প্রভাবে সমগ্র উদ্ভিদ বা উদ্ভিদদেহের কোনো অংশের সামগ্রিক স্থান পরিবর্তন করাকে সামগ্রিক চলন বা গমন বলে। যেমন, ক্ল্যামাইডোমোনাস প্রভৃতি শৈবালের চলন।

মাটিতে আবদ্ধ অবস্থায় একস্থানে স্থির থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা বহিস্থ উদ্দীপকের প্রভাবে উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রকার অঙ্গ সঞ্চালনকে বক্ৰচলন বলে। যেমন—ট্রপিক চলন, ন্যাস্টিক চলন, প্রকরণ চলন ইত্যাদি।

অভ্যন্তরীণ উদ্দীপনার প্রভাবে সংঘটিত সামগ্রিক বা বক্ৰচলনকে স্বতঃস্ফূর্ত চলন বলে। যেমন – প্রকরণ চলন।

বাহ্যিক উদ্দীপকের প্রভাবে সংঘটিত সামগ্রিক বা বক্ৰচলনকে আবিষ্ট চলন বলা হয়। যেমন – ট্যাকটিক চলন, ট্রপিক চলন প্রভৃতি।

উদ্ভিদের ক্ষেত্রে উদ্দীপক নিয়ন্ত্রিত চলন প্রধানত তিন প্রকারের হয়। এগুলি হল ট্যাকটিক চলন, ট্রপিক চলন, এবং ন্যাস্টিক চলন।

বহিস্থ উদ্দীপকের প্রভাবে সমগ্র উদ্ভিদদেহের বা দেহাংশের স্থান পরিবর্তনকে আবিষ্ট সামগ্রিক চলন বা ট্যাকটিক চলন বলে। যেমন— ভলভক্স-এর আলোর দিকে যাওয়া।

আলোক উদ্দীপকের প্রভাবে সমগ্র উদ্ভিদদেহের স্থান পরিবর্তনকে ফোটোট্যাকটিক চলন বলে। যেমন—ভলভক্স আলোর উৎসের দিকে অগ্রসর হয় কিন্তু তীব্র আলো থেকে দূরে সরে যায় উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য।

উদ্ভিদ-অঙ্গের বক্ৰচলন যখন বহিস্থ উদ্দীপকের গতিপথ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন তাকে ট্রপিক চলন বা দিক্‌নির্ণীত বক্ৰচলন বলে। যেমন, কাণ্ডের আলোক উৎসের দিকে চলন।

উদ্ভিদ অঙ্গের বক্ৰ চলন যখন আলোক উৎসের গতিপথ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন তাকে ফোটোট্রপিক চলন বা আলোকবৃত্তীয় চলন বলে। যেমন—আলোক উৎসের দিকে উদ্ভিদের কাণ্ডের বৃদ্ধি, অর্থাৎ কাণ্ড আলোক অনুকূলবর্তী।

উদ্ভিদ অঙ্গের বক্ৰ চলন যখন অভিকর্ষ বল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন তাকে জিওট্রপিক চলন বা অভিকর্ষবৃত্তীয় চলন বলে। যেমন – উদ্ভিদের মূল অভিকর্ষজ টানে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হয় অর্থাৎ মূল অভিকর্ষ অনুকূলবর্তী।

উদ্ভিদ-অঙ্গের বক্ৰ চলন যখন জলের উৎসের গতিপথ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন তাকে হাইড্রোট্রপিক চলন বা জলবৃত্তীয় চলন বলে। যেমন—উদ্ভিদের মূল সর্বদা জলের উৎসের দিকে বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ মূল জল অনুকূলবর্তী।

উদ্ভিদ-অঙ্গের বক্ৰ চলন যখন উদ্দীপকের গতিপথ অনুসারে না হয়ে উদ্দীপকের তীব্রতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন তাকে ব্যাপ্তি বা ন্যাস্টিক চলন বলে। যেমন—সূর্যালোকের তীব্রতায় সূর্যমুখী ফুলের প্রস্ফুটন।

উদ্ভিদের বিটপে আলোক অনুকূলবর্তী চলন ও অভিকর্ষ প্রতিকূলবর্তী চলনের কারণে বিটপ অংশ বেঁকে ভূমির ওপরে লম্বভাবে সোজা হয়ে উঠেছে।

উদ্ভিদ অঙ্গের বক্ৰচলন যখন আলোক উদ্দীপকের তীব্রতার হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে হয়, তাকে ফোটোন্যাস্টিক চলন বলে। যেমন, দিনের বেলায় তীব্র আলোয় সূর্যমুখী ফুলের প্রস্ফুটন ও সন্ধ্যায় কম আলোয় মুদে যাওয়া।

উদ্ভিদ অঙ্গের বক্ৰচলন যখন স্পর্শ, কম্পন, ঘর্ষণ বা আঘাত প্রভৃতি উদ্দীপকের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে, তখন তাকে সিসমোন্যাস্টিক চলন বা স্পর্শ ব্যাপ্তি চলন বলে। স্পর্শের কারণে লজ্জাবতী লতার পাতার পত্রকগুলি মুদে যাওয়া এই প্রকার চলনের উদাহরণ।

বাহ্যিক পরিবেশের কোনো রাসায়নিক পদার্থের তীব্রতা বা ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে উদ্ভিদ অঙ্গের যে বক্ৰচলন হয়, তাকে কেমোন্যাস্টিক চলন বলে। বিভিন্ন পতঙ্গভূক উদ্ভিদের মধ্যে এই ধরনের চলন দেখা যায়। যেমন, ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপ-এর পাতায় পতঙ্গ বসলে পতঙ্গের প্রোটিনের প্রভাবে উদ্ভিদের পাতার পত্রফলক দুটি বন্ধ হয়ে যায়।

থার্মোন্যাস্টিক চলন: উষ্ণতা উদ্দীপকের প্রভাবে উদ্ভিদ অঙ্গের যে বক্ৰচলন হয়, তাকে থার্মোন্যাস্টিক চলন বা তাপ ব্যাপ্তি চলন বলে। যেমন, স্বাভাবিক উষ্ণতায় টিউলিপ ফুল ফোটে কিন্তু উষ্ণতা কমে গেলে ফুলগুলি মুদে যায়।

কোষের রসস্ফীতির তারতম্যের জন্য উদ্ভিদ অঙ্গের যে স্বতঃস্ফূর্ত বক্ৰচলন দেখা যায়, তাকে প্রকরণ চলন বলে। বনচাড়ালের যৌগপত্রের পার্শ্বীয় পত্রক দুটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে পর্যায়ক্রমে ওপরে ও নীচে ওঠানামা করে। এটি একপ্রকার রসস্ফীতিজনিত প্রকরণ চলন।

চলনের উদ্দেশ্যগুলি হল –
1. উদ্ভিদের মূলের অগ্রভাগে জলের অন্বেষণের জন্য চলন দেখা যায়।
2. সূর্যালোক, বাতাস ইত্যাদির সন্ধানে উদ্ভিদের কান্ড ও শাখাপ্রশাখার চলন ঘটে।
3. মাটি থেকে জল ছাড়াও খনিজ লবণের সন্ধানে মূলের বিভিন্ন দিকে চলন দেখা যায়।

উদ্ভিদের সামগ্রিক চলনে স্থান পরিবর্তন ঘটে থাকে। যেমন – ফোটোট্যাকটিক চলনে শৈবাল স্বল্প আলোর দিকে গমন করে। অঙ্গ সঞ্চালন দ্বারা স্থান পরিবর্তনকেই গমন বলে। তাই উদ্ভিদের সামগ্রিক চলন হল একপ্রকারের গমন।

উদ্ভিদের বর্ধিষ্ণু অংশের অসমান বৃদ্ধির ফলে উদ্ভিদ অঙ্গের যে চলন হয় তাকে বৃদ্ধিজ চলন বলে। যেমন – রোহিনী জাতীয় উদ্ভিদে দেখা যায়।

ট্যাকটিক চলন: বহিস্থ উদ্দীপকের প্রভাবে সমগ্র উদ্ভিদদেহের বা দেহাংশের স্থান পরিবর্তনকে ট্যাকটিক চলন বলে। যেমন – ভলভক্স-এর আলোর দিকে যাওয়া।
ফোটোট্যাকটিক চলন: আলোক উদ্দীপকের প্রভাবে সমগ্র উদ্ভিদদেহের স্থান পরিবর্তনকে ফোটোট্যাকটিক চলন বলে। যেমন- শৈবালের জুস্পোর ও জননকোশে আলোর প্রভাবে সামগ্রিক চলন বা ফোটোট্যাকটিক চলন দেখা যায়। যেমন – Volvox (ভলভক্স), Ulothrix (ইউলোথ্রিক্স), Cladophora (ক্ল্যাডোফোরা), Chlamydomonas (ক্ল্যামাইডোমোনাস) প্রভৃতি।

যখন ট্যাকটিক চলন আলোক উদ্দীপকের গতিপথের অভিমুখে সংঘটিত হয় তখন তাকে পজিটিভ ফোটোট্যাকটিক চলন বলে। যেমন – Volvox (ভলভক্স) ও অন্যান্য শৈবাল স্বল্প আলোর দিকে গমন করে, যাকে পজিটিভ ফোটোট্যাকটিক চলন বলে।

যখন ট্যাকটিক চলন আলোক উদ্দীপকের গতিপথের বিপরীত অভিমুখে সংঘটিত হয় তখন তাকে নেগেটিভ ফোটোট্যাকটিক চলন বলে। যেমন – Volvox (ভলভক্স) ও অন্যান্য শৈবালগুলি তীব্র আলোতে আলোর বিপরীতে গমন করে। একে বলে নেগেটিভ ফোটোট্যাকটিক চলন।

রাসায়নিক পদার্থ উদ্দীপকের প্রভাবে উদ্ভিদের সামগ্রিক স্থান পরিবর্তনকে বলে কেমোট্যাকটিক চলন। যেমন -Pteris (টেরিস), Dryopteris (ড্রায়োপটেরিস) – জাতীয় ফার্নের শুক্রাণু, স্ত্রীধানী নির্গত ম্যালিক অ্যাসিডের আকর্ষণে স্ত্রীধানীর দিকে গমন করে (পজিটিভ কেমোট্যাকটিক)।

নিকটিন্যাস্টি: আলোক এবং তাপ উভয়ের তীব্রতার তারতম্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত উদ্ভিদ অঙ্গের বক্র চলনকে নিকটিন্যাস্টি বা আলোক তাপব্যাপ্তি বলে।

উদাহরণ: আমরুল, বাবলা, সুসনি, তেঁতুল, শিরীষ প্রভৃতি উদ্ভিদের পাতা দিনের বেশি আলোক ও তাপে খুলে যায়, কিন্তু সন্ধ্যেবেলার মৃদু আলো ও তাপে মুদে যায়।

উষ্ণতা উদ্দীপকের তীব্রতার তারতম্যের প্রভাবে উদ্ভিদ অঙ্গের যে বক্ৰচলন হয়, তাকে থার্মোন্যাস্টিক চলন বা তাপব্যাপ্তি চলন বলে।
উদাহরণ: স্বাভাবিক উষ্ণতায় টিউলিপ ফুল ফোটে কিন্তু উষ্ণতা কমে গেলে মুদে যায়।