দশম শ্রেণি – বাংলা – বহুরূপী (গল্প) সুবোধ ঘোষ

সুবোধ ঘোষ রচিত বহুরূপী গল্পটি দশম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই-এ অন্তর্ভুক্ত একটি জনপ্রিয় গল্প। এই গল্পে হরিদা নামক একজন বহুরূপী চরিত্রের জীবনযাত্রা ও তার চারপাশের মানুষের সাথে তার সম্পর্কের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

হরিদা একজন প্রকৃত শিল্পী, যিনি বিভিন্ন রূপ ধারণ করে মানুষের বিনোদন দেন। তিনি একজন প্রতারকও বটে, যিনি প্রায়শই লোকেদের বোকা বানিয়ে টাকা আদায় করেন। গল্পের মূল চরিত্র হল জগদীশবাবু, যিনি হরিদার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তার বন্ধু হয়ে ওঠেন।

গল্পের মূল ভাবনা হল মানুষের জটিল মনস্তত্ত্ব। হরিদা একজন জটিল চরিত্র, যিনি একই সাথে শিল্পী, প্রতারক এবং বন্ধু। জগদীশবাবুও জটিল, কারণ তিনি একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হলেও হরিদার মতো প্রতারকের প্রতি আকৃষ্ট হন।

দশম শ্রেণি – বাংলা – বহুরূপী

লেখক পরিচিতি

ভূমিকা – বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ এক স্মরণীয় নাম। সাহিত্য জগতে তাঁর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বেশ কিছুটা দেরিতে। তিনি তাঁর মেধাশক্তি, চিন্তাচেতনা এবং অভিজ্ঞতার দ্বারা বাংলা সাহিত্যকে বিভিন্ন কালজয়ী রচনার মধ্য দিয়ে ভরিয়ে তুলেছেন।

জন্ম ও শৈশব – বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ১৪ সেপ্টেম্বর বিহারের হাজারিবাগে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের বহর গ্রামে।

শিক্ষাজীবন – সুবোধ ঘোষ হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজের ছাত্র ছিলেন। বিশিষ্ট দার্শনিক ও গবেষক মহেশ ঘোষের লাইব্রেরিতে তিনি পড়াশোনা করতেন। প্রত্নতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, এমনকি সামরিকবিদ্যায় তাঁর যথেষ্ট দক্ষতা ছিল।

কর্মজীবন ও সাহিত্যজীবন – সুবোধ ঘোষের কর্মজীবন শুরু হয় বিহারের আদিবাসী অঞ্চলে বাসের কনডাক্টর হিসেবে। এরপর সার্কাসের ক্লাউন, মুম্বাই পৌরসভার চতুর্থ শ্রেণির কাজ, চায়ের ব্যাবসা, বেকারির ব্যাবসা, মালগুদামের স্টোরকিপার প্রভৃতি কাজে তিনি তাঁর জীবনের বেশ কিছুটা সময় ব্যয় করেন। বহু পথ ঘুরে তিরিশের দশকের শেষে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকা-র রবিবাসরীয় বিভাগে সহকারী হিসেবে যোগ দেন। তাঁর লেখালেখির সময়কাল ১৯৪০ থেকে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালিতে গান্ধিজির সহচর হিসেবে তিনি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। দাঙ্গা এবং দাঙ্গা-পরবর্তী সময়ের সাম্প্রদায়িকতা, হিংস্রতা তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। সুবোধ ঘোষের প্রথম গল্প ‘অযান্ত্রিক‘। তাঁর আর-একটি বিখ্যাত গল্প ‘থির বিজুরি‘। শুধু গল্পকার হিসেবে নয়, ঔপন্যাসিক হিসেবেও তিনি প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর লেখা একটি অন্যতম উপন্যাস হল তিলাঞ্জলি (১৯৪৪)। কংগ্রেস সাহিত্যসংঘের মতাদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর এই উপন্যাসে।

বিচিত্র জীবিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল তাঁর কর্মজীবন। আনন্দবাজার পত্রিকা-র সহকারী হিসেবে তিনি যোগ দেন। ক্রমে সেখানকার সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর এবং তারপর অন্যতম সম্পাদকীয় লেখক হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা হল- ‘ভারত প্রেমকথা‘ (মহাভারতের গল্প অবলম্বনে রচিত), ‘গঙ্গোত্রী‘ (১৯৪৭), ‘ত্রিযামা‘ (১৯৫০), ‘ভালবাসার গল্প‘, ‘শতকিয়া‘ (১৯৫৮) প্রভৃতি। এ ছাড়াও তাঁর কয়েকটি গল্পসংকলন হল-‘ফসিল‘, ‘পরশুরামের কুঠার‘, ‘জতুগৃহ‘।

পুরষ্কার – সুবোধ ঘোষ তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য আনন্দ পুরস্কার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক পান।

জীবনাবসান – ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ১০ মার্চ এই বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মারা যান।

উৎস

সুবোধ ঘোষের গল্পসমগ্র, তৃতীয় খণ্ড থেকে ‘বহুরূপী‘ গল্পটি নেওয়া হয়েছে।

বিষয়সংক্ষেপ

বহুরূপী গল্পটি মূলত এক বহুরুপীর জীবন নিয়ে লেখা। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হরিদা শহরের সবচেয়ে ছোটো গলির মধ্যেই বাস করেন। সেখানে আড্ডাও বসে নিয়মিত। রোজকার চাকরি করতে যাওয়া হরিদার কোনোদিনই পোষাত না। তিনি ছিলেন বহুরুপী। তিনি মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন রূপ ধারণ করতেন—কখনও পাগল সাজতেন, কখনও বাউল, কোনোদিন কাপালিক, কখনও বোঁচকা কাঁধে বুড়ো কাবুলিওয়ালা, কখনও-বা পুলিশ। তাঁর এইসব রূপ দেখে অনেকেই কিছু পয়সা দিত। এটা তাঁর একরকম রোজগার ছিল। পুলিশ সেজে তিনি ঘুষও নিয়েছেন। তাঁর এইসব বহুরূপীর বেশ দেখে লোকজন বিরক্ত হত, আবার কেউ কেউ খুব আনন্দিত হত, কেউ-বা বিস্মিত হত। বহুরূপী সেজে তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন। জাগদীশবাবুর বাড়ীতে হিমালয়ের গুহানিবাসী এক সন্ন্যাসীর আগমন এবং অভ্যর্থনার কথা শুনে মোটা রকমের উপার্জনের আশায় তিনি সন্ন্যাসী সেজে জগদীশবাবুর বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

সৌম্য, শান্ত, জ্ঞানী মানুষ জগদীশবাবু। সাদা উত্তরীয়, ছোটো বহরের থান পরে এক বিরাগী মানুষের বেশ ধরে বহুরূপী হরিদা হাজির হয়েছিলেন জগদীশবাবুর বাড়িতে। তাঁর সাজপোশাক, উদাত্ত, শান্ত, উজ্জ্বল দৃষ্টি দেখে কেউ বুঝতেও পারেনি তিনি আসলে হরিদা। যখনই যে রূপ হরিদা ধারণ করতেন, তখনই তিনি সেই রূপ বা সেই চরিত্রটির সঙ্গে এতটাই একাত্ম হয়ে যেতেন যে, তাঁকে বহুরূপী বলে কেউ বুঝতেও পারত না। তিনি সত্যিই যেন মূল চরিত্রটিই হয়ে উঠতেন। এক্ষেত্রেও কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। হরিদা সত্যিই যেন বিরাগী হয়ে উঠেছিলেন। তখন তিনি ধন, যৌবন, সংসার-সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। তাই জগদীশবাবু তাঁকে তীর্থভ্রমণের জন্য টাকা দিতে চাইলেও তিনি তা ফিরিয়ে দেন। আসলে এইভাবে বহুরূপী পেশাটাকেই তিনি যোগ্য সম্মান দিয়েছিলেন। কারণ এই পেশা ছিল তাঁর ভালোবাসা।

নামকরণ

যে-কোনো সাহিত্যের ক্ষেত্রেই নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। আর এই নামকরণ সাধারণত বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক, ভাবকেন্দ্রিক বা ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে থাকে। যে-কোনো সাহিত্যের অন্তর্নিহিত ভাবও এই নামকরণের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলা হয়।

শহরের সবচেয়ে সরু গলিটার ভিতরের ছোট্ট ঘরটাই হরিদার জীবনের একমাত্র আশ্রয়। কোনো ছকে বাঁধা কাজ করতে তাঁর ভালো লাগে না। তবে তাঁর জীবনের নাটকীয় বৈচিত্র্য হল এই যে, তিনি মাঝে মাঝে বহুরুপী সাজেন। এতে সামান্য কিছু রোজগারও হয় বটে। বহুরুপী সেজে তিনি কখনও বাসস্ট্যান্ডে, কখনও বাজারে, কখনও আবার অন্য উপায় তাঁর সাজ দেখিয়ে পয়সা রোজগার করেন। বহুরুপী সাজাটাই তাঁর পেশা। এই পেশাগত বিচারে গল্পের নামকরণ যথাযথ। কিন্তু সুবোধ ঘোষ গল্প কাহিনিতে একটু বাঁক ফেরালেন জগদীশবাবুর বাড়িতে হরিদাকে এনে।

হরিদা চেয়েছিলেন কৃপণ, ধনী জগদীশবাবুর কাছ থেকে বেশি করে টাকা আদায় করবেন। সেইমতো তিনি বিরাগীর বেশে সেজেও ছিলেন ভালো। জগদীশবাবু হরিদাকে বিরাগীর বেশে দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। জগদীশবাবু বুঝতেই পারেন না যে, তাঁর বাড়িতে বিরাগী বেশে আসা লোকটা আসলে একজন বহুরূপী। উপরন্তু তিনি বিরাগী হরিদাকে একশো এক টাকার একটি থলি দিতে গেলে হরিদা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানান, বিরাগীর কোনো অর্থের প্রয়োজন নেই। ত্যাগই তাঁর জীবনের ধর্ম। অর্থাৎ বহুরুপী সাজলেও হরিদা অনুকরণীয়। চরিত্রের ঢং নষ্ট করেননি। এখানেই হরিদার বহুরূপী পেশা পাঠকদের কাছে গৌরবের হয়ে উঠেছে। তাই বলা যায় গল্পের নামকরণ কিছুটা বিষয়কেন্দ্রিক হলেও ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে উঠেছে। সেদিক থেকে গল্পের নামকরণ ‘বহুরূপী’ সার্থক হয়েছে।

বহুরূপী গল্পটি বাংলা সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ। এটি আমাদেরকে মানুষের জটিল মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে ভাবতে সাহায্য করে।

এই গল্পে আমরা বিভিন্ন সামাজিক দিকও দেখতে পাই। গরিবি, অশিক্ষা, অন্ধবিশ্বাস ইত্যাদি সমস্যা এই গল্পে ফুটে উঠেছে।

বহুরূপী গল্পটি শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় কারণ এটি রোমাঞ্চকর, হাস্যরসাত্মক এবং চিন্তাশীল। এই গল্প পড়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষাসাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারবেন।

Share via:

মন্তব্য করুন