এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন — “ভারতকে মৃত্তিকা অঞ্চলে ভাগ করে প্রত্যেকটির পরিচয় দাও।” — নিয়ে আলোচনা করব। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায় “ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশ” -এর “ভারতের মৃত্তিকা” অংশ থেকে নেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় এই প্রশ্নটি প্রায়ই আসে, তাই এটি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতকে মৃত্তিকা অঞ্চলে ভাগ করে প্রত্যেকটির পরিচয় দাও।
অথবা, ভারতে পলিমাটির বণ্টন এবং বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
অথবা, ভারতের পলিমৃত্তিকা ও কৃষ্ণ মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
ভারতের মৃত্তিকা অঞ্চল –
ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে অজৈব ও জৈব পদার্থ সমন্বিত যে কোমল আস্তরণ বা আবরণ রয়েছে অর্থাৎ যার ওপর সহজেই গাছপালা জন্মায় তাকে মৃত্তিকা বলে। জলধারণ ক্ষমতা, জৈব ও অজৈব পদার্থের পার্থক্য প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে ভারতের কৃষি গবেষণা সংস্থা ভারতের মৃত্তিকাকে মোট 27টি ভাগে ভাগ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মৃত্তিকাগুলি হল –
কৃষ্ণ মৃত্তিকা –
- অবস্থান – সমগ্র মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর কিছু কিছু অংশে এই জাতীয় মৃত্তিকা দেখা যায়। ভারতের মোট আয়তনের 17 শতাংশ স্থানে এই মৃত্তিকার বিস্তার রয়েছে।
- উৎপত্তি – মূলত ব্যাসল্ট শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে এই মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়েছে।
- বৈশিষ্ট্য –
- মৃত্তিকার দানা সূক্ষ্ম ও ঘন সন্নিবিষ্ট হয়।
- মন্টমরিলোনাইট জাতীয় কাদার ভাগ বেশি থাকে।
- চুন, পটাশ, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, লৌহ দ্বারা সমৃদ্ধ।
- জলধারণ ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি। এই মৃত্তিকার রং কালো।
- উৎপন্ন ফসল – এই মৃত্তিকায় কার্পাস তুলার চাষ বেশি হয় বলে একে কৃষ্ণ কার্পাস মৃত্তিকা ও রেগুর মৃত্তিকা বলে। এ ছাড়াও গম, জোয়ার, বাজরা, রাগি, ইক্ষু, তামাক, তৈলবীজ প্রভৃতির চাষও ভালো হয়।
লোহিত মৃত্তিকা –
- অবস্থান – কৃষ্ণ মৃত্তিকা অঞ্চল বাদ দিয়ে সমগ্র দাক্ষিণাত্য মালভূমি এবং ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের স্থানে স্থানে এই মৃত্তিকা দেখা যায়। ভারতের মোট আয়তনের 11 শতাংশ স্থানে এই মৃত্তিকার অবস্থান দেখা যায়।
- উৎপত্তি – প্রধানত গ্রানাইট ও নিস জাতীয় শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে এই মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়।
- বৈশিষ্ট্য –
- অম্লতা ও বালুকার পরিমাণ বেশি।
- বেশি পরিমাণে ফেরাস অক্সাইডের উপস্থিতির জন্য এই মাটির রং লাল।
- সচ্ছিদ্র ও হালকা গঠন।
- জলধারণ ক্ষমতা কম।
- দ্রবণীয় লবণের পরিমাণ কম।
- ধৌত প্রক্রিয়া অধিক সংঘটিত হওয়ায় ওপরের স্তরের নাইট্রোজেন, ফসফরাস, চুন প্রভৃতি নিম্নগামী হয়।
- উৎপন্ন ফসল – জলসেচের সুবিধাযুক্ত স্থানে ধান, জোয়ার, বাজরা, ডাল, ইক্ষু, তৈলবীজ প্রভৃতি চাষ হয়। তবে উর্বরতা কম থাকায় হেক্টর প্রতি ফসল উৎপাদন কম।
ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা –
- অবস্থান – অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ও ওড়িশার বিভিন্ন স্থানে এবং পশ্চিমঘাট পর্বতের কর্ণাটক ও মালাবার উপকূলের উঁচু অংশে এই মৃত্তিকা দেখা যায়। ভারতের মোট আয়তনের 8 শতাংশ স্থানে এই মৃত্তিকা বিস্তৃত।
- উৎপত্তি – দীর্ঘসময় একটানা বৃষ্টিপাতের কারণে ভৌম জলস্তর ভূপৃষ্ঠের নিকটে আসার পর বেশ কয়েকমাস একটানা শুষ্ক ঋতু চললে এই মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়।
- বৈশিষ্ট্য –
- ব্যাপক ধৌত প্রক্রিয়ায় লবণকণা ভূপৃষ্ঠের নীচে চলে যায়।
- এই মৃত্তিকায় লৌহ কণার উপস্থিতি অধিক।
- জলধারণ ক্ষমতা অত্যন্ত কম।
- শুষ্ক ঋতুতে মাটি কঠিন হয়ে পড়ে। এই মৃত্তিকা ইটের মতো লাল বর্ণের হয় বলে এর নামকরণ হয়েছে ল্যাটেরাইট।
- উৎপন্ন ফসল – সেচযুক্ত অঞ্চলে রাসায়নিক ও জৈবসার প্রয়োগের মাধ্যমে ধান, ডাল, জোয়ার, বাজরা, তৈলবীজের চাষ হয়।

উপকূলীয় মৃত্তিকা –
- অবস্থান – উপকূল সংলগ্ন সমভূমিতে এই মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়েছে।
- উৎপত্তি – সমুদ্রতরঙ্গ ও নদীবাহিত পলির সঞ্চয়ে এই মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়েছে।
- বৈশিষ্ট্য –
- এই মৃত্তিকা ক্ষারকীয় প্রকৃতির।
- মৃত্তিকায় লবণের ভাগ বেশি থাকে।
- ফসফরাস ও নাইট্রোজেন প্রায় থাকে না।
- জলধারণ ক্ষমতা খুব কম।
- উৎপন্ন ফসল – প্রধানত সুপারি, নারিকেল প্রভৃতির চাষ হয়।
বদ্বীপ অঞ্চলের মৃত্তিকা –
- অবস্থান – গোদাবরী, মহানদী প্রভৃতি নদীর বদ্বীপ ও গুজরাটের কচ্ছের রান এলাকায় এই মৃত্তিকা দেখা যায়।
- উৎপত্তি – নদীবাহিত সূক্ষ্ম পলির দ্বারা এই মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়েছে।
- বৈশিষ্ট্য –
- এই মৃত্তিকায় কাদার ভাগ বেশি।
- এই মৃত্তিকার কণাগুলি অত্যন্ত সূক্ষ্ম।
- মৃত্তিকা সাধারণত দোআঁশ প্রকৃতির।
- উৎপন্ন ফসল – ধান, পাট, ইক্ষু, জোয়ার প্রভৃতি পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপন্ন হয়।
পলি মৃত্তিকা –
- অবস্থান – উত্তর ভারতের উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, অসম, বিহার, পশ্চিমবঙ্গে এই মৃত্তিকা দেখা যায়। ভারতের মোট আয়তনের 46 শতাংশ স্থানে এই মৃত্তিকা দেখা যায়।
- উৎপত্তি – সিন্ধু, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং এদের উপনদীগুলির পলির সঞ্চয়ে এই মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়েছে।
- বৈশিষ্ট্য –
- এই মৃত্তিকা কাঁকরবিহীন হালকা রং বিশিষ্ট।
- প্রতি বছর বন্যার কারণে নতুন পলির সঞ্চয় হয় এবং মৃত্তিকা উর্বর হয়।
- নদী থেকে নতুন দূরবর্তী উঁচু স্থানের প্রাচীন পলিকে ভাঙ্গর এবং নিকটবর্তী নতুন পলিকে খাদার বলে।
- ধৌত প্রক্রিয়া বেশি হওয়ায় ফসফেট ও নাইট্রোজেন কম থাকে।
- মৃত্তিকার ওপরের স্তরে চুন জাতীয় পদার্থ বেশি থাকে।
- উৎপন্ন ফসল – পলি মাটিতে ধান, পাট, গম, ইক্ষু ও ডাল চাষ ভালো হয়।
পার্বত্য মৃত্তিকা –
পার্বত্য মৃত্তিকাকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –
পার্বত্য অরণ্য মৃত্তিকা –
- অবস্থান – পূর্ব ও পশ্চিম হিমালয় এবং নীলগিরি পর্বতের নানা স্থানে এই মৃত্তিকা দেখা যায়।
- বৈশিষ্ট্য –
- জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি।
- অধিকাংশ মৃত্তিকা পডসল জাতীয় ও ধূসর বাদামি বর্ণের।
- অম্লতার পরিমাণ বেশি।
- তবে পূর্ব হিমালয়ে অম্লতার পরিমাণ কম।
- উৎপন্ন ফসল – এই মাটিতে আলু, চা, লেবু প্রভৃতির চাষ ভালো হয়।
পার্বত্য তৃণভূমির মৃত্তিকা –
- অবস্থান – পার্বত্য অংশের কম বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে এই মৃত্তিকা দেখা যায়।
- বৈশিষ্ট্য –
- কাশ্মীরে এই মৃত্তিকাকে মার্গ বলে।
- উত্তরপ্রদেশে একে বুগিয়াল বলে।
- এই মৃত্তিকাও বাদামি বর্ণের হয়।
- উৎপন্ন ফসল – এই মাটিতে চা, লেবু, আলু প্রভৃতির চাষ হয়।
তরাই মৃত্তিকা –
- অবস্থান – পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপ্রদেশের হিমালয় পর্বতের পাদদেশের সংকীর্ণ অংশে এই মৃত্তিকা দেখা যায়।
- বৈশিষ্ট্য –
- নদীবাহিত পলির সঙ্গে প্রস্তর খণ্ডের সংমিশ্রণ দেখা যায়।
- গভীর তরাই মৃত্তিকা কিছুটা উর্বর প্রকৃতির।
- উপবিভাগ – তরাই মৃত্তিকা দু-ধরনের –
- সূক্ষ্ম বালুকাযুক্ত তরাই মৃত্তিকা।
- প্রস্তরখণ্ডযুক্ত ভাবর মৃত্তিকা।
- উৎপন্ন ফসল – ধান, ইক্ষু ও সামান্য গম চাষ হয়।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
ভারতের প্রধান মৃত্তিকা অঞ্চলগুলি কী কী?
ভারতের প্রধান মৃত্তিকা অঞ্চলগুলি হলো –
1. পলি মৃত্তিকা (উত্তর ভারতের সমভূমি)।
2. কৃষ্ণ মৃত্তিকা (দাক্ষিণাত্য মালভূমি)।
3. লোহিত মৃত্তিকা (দক্ষিণ ও পূর্ব ভারত)।
4. ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা (উচ্চ বৃষ্টিপাত ও শুষ্ক অঞ্চল)।
5. উপকূলীয় মৃত্তিকা (সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল)।
6. বদ্বীপ অঞ্চলের মৃত্তিকা (গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ)।
7. পার্বত্য মৃত্তিকা (হিমালয় ও অন্যান্য পর্বত অঞ্চল)।
পলি মৃত্তিকার প্রকারভেদ কী?
1. খাদার (নতুন পলি) – নদীর কাছাকাছি, বার্ষিক পলি সঞ্চয় হয়।
2. ভাঙ্গর (পুরানো পলি) – নদী থেকে দূরে, কম উর্বর।
পলি মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য কী?
1. উর্বরতা – প্রতি বছর নতুন পলি সঞ্চয়ের কারণে খুব উর্বর।
2. গঠন – বালি, পলি ও কাদার মিশ্রণ।
3. রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য – চুন বেশি, নাইট্রোজেন ও ফসফরাস কম।
পলি মৃত্তিকায় কী কী ফসল চাষ হয়?
ধান, পাট, গম, ইক্ষু, ডাল, তৈলবীজ।
এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন — “ভারতকে মৃত্তিকা অঞ্চলে ভাগ করে প্রত্যেকটির পরিচয় দাও।” — নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায় “ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশ” -এর “ভারতের মৃত্তিকা” অংশ থেকে নেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় এই প্রশ্নটি প্রায়ই আসে, তাই এটি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে, আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন