দশম শ্রেণীর মাধ্যমিক ভূগোল পরীক্ষায় প্রায়ই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন হল “হিমালয়ের সর্বদক্ষিণের পর্বতশ্রেণিটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও”। এই প্রশ্নের উত্তর জানা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি ভারতের ভূপ্রকৃতি বোঝার জন্য একটি মৌলিক ধারণা।
এই ব্লগ পোস্টে, আমরা শিবালিক পর্বতমালা, হিমালয়ের দক্ষিণতম প্রান্ত, সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করব। আমরা এর অবস্থান, ভূতাত্ত্বিক গঠন, বৈশিষ্ট্য এবং ভারতের জন্য এর গুরুত্ব আলোচনা করব।
অথবা, ভারতের পার্বত্য অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির বিবরণ দাও।
অথবা, উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির বিবরণ দাও।
ভারতের ভূপ্রাকৃতিক বিভাগ
ভূপ্রকৃতি অনুসারে ভারতকে পাঁচটি প্রধান বিভাগে ভাগ করা যায়। বিভাগগুলি হল –
- উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল,
- উত্তরের সমভূমি অঞ্চল,
- উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চল,
- উপকূলের সমভূমি অঞ্চল এবং
- দ্বীপ অঞ্চল।
উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল
ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য অনুসারে এই অঞ্চলটিকে দুটি উপবিভাগে ভাগ করা যায় –
- হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল এবং
- উত্তর-পূর্ব ভারতের পার্বত্যভূমি বা পূর্বাচল।
হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল
পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশ্রেণি হিমালয়। কাশ্মীরের নাঙ্গা পর্বতশৃঙ্গ থেকে শুরু করে অরুণাচল প্রদেশের উত্তর-পূর্বদিকে অবস্থিত নামচাবারওয়া পর্বতশৃঙ্গ পর্যন্ত হিমালয়ের দৈর্ঘ্য প্রায় 2414 কিমি।
স্থানীয় বৈচিত্র্য অনুসারে দৈর্ঘ্য বরাবর হিমালয়ের তিনটি উপবিভাগ হল –
- পশ্চিম হিমালয়,
- মধ্য হিমালয় এবং
- পূর্ব হিমালয়।
পশ্চিম হিমালয় –
অবস্থান – পশ্চিমে নাঙ্গা পর্বতশৃঙ্গ থেকে পূর্বে ভারত-নেপাল সীমান্তের কালী নদী পর্যন্ত পশ্চিম হিমালয়ের বিস্তার। পশ্চিম হিমালয়ের দক্ষিণ থেকে উত্তরে চারটি পর্বতশ্রেণি দেখা যায়। যথা –
- সর্বদক্ষিণে শিবালিক বা বহিঃহিমালয়, যার গড় উচ্চতা 600-1500 মিটার।
- শিবালিকের উত্তরে রয়েছে পিরপাঞ্জাল, ধওলাধর, নাগটিববা ও মুসৌরি পর্বতশ্রেণি। এগুলি সম্মিলিতভাবে হিমাচল বা মধ্য হিমালয় নামে পরিচিত। হিমাচল হিমালয়ের গড় উচ্চতা 1500-4500 মিটার। শিবালিক এবং হিমাচল হিমালয়ের মধ্যবর্তী অংশে দুন, মারি, কাংড়া প্রভৃতি উপত্যকা দেখা যায়।
- হিমাচল হিমালয়ের উত্তরে অবস্থান করছে হিমাদ্রি বা প্রধান হিমালয়। হিমালয়ের এই অংশের গড় উচ্চতা 6000 মিটার। প্রধান হিমালয়ে অবস্থান করছে সুউচ্চ শৃঙ্গগুলি, যেমন – নাঙ্গা পর্বত (8126 মি), কামেট (7756 মি), নন্দাদেবী (7816 মি), কেদারনাথ (6940 মি), চৌখাম্বা-বদরীনাথ (7138 মি) প্রভৃতি। পিরপাঞ্জাল ও প্রধান হিমালয়ের মধ্যে অবস্থান করছে বিখ্যাত কাশ্মীর উপত্যকা (‘ভূস্বর্গ’ বা ‘প্রাচ্যের নন্দনকানন’ নামে পরিচিত)।
- প্রধান হিমালয়ের উত্তরে জাস্কর-দেওসাই পর্বত, লাদাখ রেঞ্জ ও কারাকোরাম পর্বতশ্রেণি একত্রে ট্রান্স বা টেথিস হিমালয় নামে পরিচিত। এই অংশের গড় উচ্চতাও 6000 মিটার। কারাকোরাম পর্বতের গডউইন অস্টিন বা K₂ (8611 মি) ভারতের উচ্চতম ও পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ। এ ছাড়া, গাসেরব্রুম-I বা হিডেন (8068 মি), ব্রড (8047 মি), গাসেরব্রুম-II (8035 মি) প্রভৃতি সুউচ্চ শৃঙ্গগুলিও কারাকোরাম পর্বতশ্রেণিতে অবস্থান করছে। ভারতের দীর্ঘতম হিমবাহ সিয়াচেন (76 কিমি)-সহ বিয়াফো, বালটরে প্রভৃতি হিমবাহ কারাকোরাম পর্বতশ্রেণিতে দেখা যায়।
মধ্য হিমালয় –
অবস্থান – মধ্য হিমালয় সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন রাষ্ট্র নেপালের অন্তর্গত। (এই অংশটি নেপালের অন্তর্গত হওয়ায় ভারতের ভূপ্রাকৃতিক বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হল না।)
জেনে রাখো
- মধ্য হিমালয়ের সর্বদক্ষিণে শিবালিক, চুড়িয়া পাহাড় ও দুন্ডুয়া পাহাড় বহির্হিমালয়ের অংশরূপে অবস্থান করছে। মধ্য হিমালয় নেপালে মহাভারতলেখ পর্বত নামে পরিচিত। নেপালের সর্বউত্তরে রয়েছে হিমাদ্রি বা প্রধান হিমালয়।
- পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টসহ অন্নপূর্ণা, ধবলগিরি প্রভৃতি বিখ্যাত শৃঙ্গ এখানে অবস্থিত।
- কাঠমাণ্ডু ও পোখরা প্রভৃতি উপত্যকা, সুরয তাল, ফিউয়া তাল প্রভৃতি হ্রদ, লোৎসে গণেশ প্রভৃতি হিমবাহ এবং টিপটালা, উমবাক প্রভৃতি গিরিপথ এখানে দেখা যায়।
পূর্ব হিমালয় –
অবস্থান –
নেপালের পূর্ব সীমা থেকে অরুণাচল প্রদেশের পূর্ব সীমা পর্যন্ত হিমালয় পার্বত্যভূমির নাম পূর্ব হিমালয়।
- পূর্ব হিমালয়ের সর্বদক্ষিণে শিবালিক পর্বতশ্রেণির অংশরূপে অরুণাচল প্রদেশে ডাফলা, মিরি, আবোর প্রভৃতি পাহাড়গুলি দেখা যায়।
- এই অংশে হিমালয়ের মধ্যভাগের শ্রেণিটি বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যায়। যেমন – নেপাল-পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের সিঙ্গালিলা রেঞ্জ ও ভুটানের কৃষ্ণ পর্বত। সিঙ্গালিলা রেঞ্জের সান্দাকফু (3636 মি) পশ্চিমবঙ্গের উচ্চতম শৃঙ্গ। পূর্ব হিমালয়ের সবচেয়ে উত্তরের হিমাদ্রি হিমালয়ে বেশ কয়েকটি সুউচ্চ শৃঙ্গ চোখে পড়ে। এগুলি হল ভারত-নেপাল সীমান্তে ভারতের দ্বিতীয় তথা পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা (8598 মি)। এ ছাড়া, অরুণাচল-তিব্বত সীমান্তে অবস্থিত নামচাবারওয়া, ভুটানের কুলাকাংড়ি প্রভৃতি পর্বতশৃঙ্গ এই অংশে অবস্থিত।
- নাথুলা গিরিপথ, চুম্বি, পারো, পুনখা, হা প্রভৃতি উপত্যকা, ছাঙ্গু হ্রদ এবং তিস্তা নদীর উৎপত্তিস্থল জেমু হিমবাহ এই অংশে দেখা যায়।
উত্তর-পূর্ব ভারতের পার্বত্যভূমি বা পূর্বাচল
- উত্তর-পূর্ব ভারতে, বিশেষত অরুণাচল, অসম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং অসমের কাছাড় জেলার মধ্য দিয়ে 1800 থেকে 4000 মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট পাটকই, নাগা, লুসাই প্রভৃতি পর্বতশ্রেণি বিস্তৃত হয়েছে। এই অঞ্চলটি পূর্বাচল নামে পরিচিত।
- অরুণাচল প্রদেশের মিশমি পর্বতশ্রেণির দাফাবুম পূর্বাচলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।
উত্তরের সমভূমি অঞ্চল
হিমালয় পর্বতমালা এবং দক্ষিণ ভারতের উপদ্বীপীয় মালভূমির মধ্যে অবস্থিত বিশাল সমতল ভূমি অঞ্চলকে উত্তরের সমভূমি অঞ্চল বলা হয়। সিন্ধু, গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র নদী এবং তাদের অসংখ্য উপনদী ও শাখানদী দীর্ঘকাল ধরে পলি জমা করে এই সমতল ভূমি গঠন করেছে। এই অঞ্চলটি ভারত তথা বিশ্বের বৃহত্তম নদী-নির্মিত সমভূমি অঞ্চল।
এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি সমতল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। ভূপ্রকৃতির তারতম্য অনুযায়ী, এই বিশাল সমভূমি অঞ্চলকে এক সময় চার ভাগে ভাগ করা হত:
ভাবর অঞ্চল
- হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত।
- নদীবাহিত নুড়ি, পাথর প্রভৃতি সঞ্চিত ঈষৎ ঢেউখেলানো ভূমি।
- পাহাড়ি নদী থেকে আসা পলি ও প্রস্তরকণা পলিবাহিত জলের সাথে প্রবাহিত হয়ে ভাবর অঞ্চল তৈরি করে।
- বনভূমি ও ঝোপঝাড়ে আচ্ছাদিত।
তরাই অঞ্চল
- ভাবর অঞ্চলের দক্ষিণে অবস্থিত।
- নবীন পলিগঠিত অপেক্ষাকৃত নিম্নভূমি অঞ্চল।
- হিমালয় থেকে নেমে আসা নদীগুলি প্রচুর পলি বহন করে তরাই অঞ্চল তৈরি করে।
- ঘন জঙ্গল ও উর্বর কৃষিভূমি সমৃদ্ধ।
ভাঙ্গর অঞ্চল
- গঙ্গা সমভূমির প্লাবন অববাহিকায় অবস্থিত।
- প্রাচীন পলি সঞ্চিত হয়ে যে ধাপযুক্ত ভূমি গঠিত হয়েছে, তাকে ভাঙ্গর অঞ্চল বলা হয়।
- প্লাবনের সময় নদীর পানি পলি সঞ্চয় করে ভাঙ্গর তৈরি করে।
- উঁচু-নিচু ভূমি, কৃষি উপযোগী।
খাদার অঞ্চল
- ভাঙ্গর অঞ্চলের পরে অবস্থিত নিম্নভূমি এলাকা।
- একেবারে নতুন পলিগঠিত ভূমি।
- উত্তরপ্রদেশে খাদার ও পাঞ্জাবে বেট নামে পরিচিত।
- প্রতি বছর প্লাবনের সময় নদী নতুন পলি সঞ্চয় করে খাদার তৈরি করে।
- অত্যন্ত উর্বর কৃষিভূমি।
উত্তরের সমভূমি অঞ্চলের গুরুত্ব
কৃষিক্ষেত্রে
- সমভূমি অঞ্চলের মাটি নদী-বাহিত পলি দ্বারা পুষ্ট, যা কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত উর্বর করে তোলে।
- প্রচুর সূর্যালোক এবং মৌসুমী বৃষ্টিপাত এই অঞ্চলকে কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদনের জন্য আদর্শ করে তোলে।
- ধান, গম, পাট, তুলা, আখ, সয়াবিন – সমভূমি অঞ্চলে উৎপাদিত প্রধান ফসল।
পরিবহন ব্যবস্থায়
- সমতল ভূ-প্রকৃতির কারণে সমভূমি অঞ্চলে সড়ক, রেলপথ, বিমানবন্দর নির্মাণ করা সহজ ও সহজলভ্য।
- জলপথ পরিবহন ব্যবস্থাও এই অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা মানুষ ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সুবিধা প্রদান করে।
শিল্পায়নে
- উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা এবং কাঁচামাল সংগ্রহের সুবিধার কারণে সমভূমি অঞ্চলে শিল্প স্থাপন করা হয়।
- লৌহ-ইস্পাত, তৈরি পোশাক, রাসায়নিক, ইলেকট্রনিক – এই অঞ্চলের প্রধান শিল্প।
- শিল্পের বিকাশ সুযোগ সৃষ্টি করে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখে।
জনসংখ্যায়
- জীবিকা অর্জনের সুযোগ বেশি থাকায় সমভূমি অঞ্চলে জনসংখ্যা ঘন।
- কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, পরিষেবা – এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবিকা।
- উন্নত জীবনযাত্রার মান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা এই অঞ্চলকে আকর্ষণীয় করে তোলে।
সাংস্কৃতিক উন্নয়নে
- জীবিকা অনায়াসসাধ্য বলে সমভূমি অঞ্চলের মানুষ সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শিল্পচর্চায় বেশি মনোযোগ দিতে পারে।
- সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য।
- শিল্পকলা, সাহিত্য, সঙ্গীত, নাট্য – এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সম্পদ।
উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চল
উত্তরের সমতল ভূমি থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চলটি পশ্চিমে আরবল্লি পর্বতমালা এবং পূর্বে রাজমহল পাহাড় দ্বারা আবদ্ধ। উত্তরের দিকে, এটি গঙ্গা সমভূমির সাথে এবং দক্ষিণে উপকূলীয় সমভূমির সাথে মিলিত হয়।
ভূপ্রকৃতি
উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চলটি একাধিক ক্ষয়প্রাপ্ত মালভূমি এবং ছোটো ছোটো পাহাড় নিয়ে গঠিত। প্রাচীন আগ্নেয় শিলা এবং রূপান্তরিত শিলা, বিশেষ করে নিস এবং সিস্ট শিলা, এই অঞ্চলের মূল গঠনশিলা। ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে, এটি একটি শিল্ড মালভূমি হিসেবে বিবেচিত হয়।
ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে, উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চলকে তিনটি প্রধান অংশে ভাগ করা যায়
- মধ্যভারতের উচ্চভূমি
- পূর্বভারতের উচ্চভূমি
- দাক্ষিণাত্য মালভূমি
মধ্যভারতের উচ্চভূমি
অবস্থান
- মধ্যভারতের উচ্চভূমি পশ্চিমে আরাবল্লি পর্বত, পূর্বে শোন নদী অববাহিকা, উত্তরে গঙ্গা সমভূমি এবং দক্ষিণে দাক্ষিণাত্য মালভূমি অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত।
- এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা ২০০ থেকে ৫০০ মিটার।
ভূপ্রকৃতি
- মধ্যভারতের উচ্চভূমি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত:
- আরাবল্লি পর্বত: উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত, ভারতের প্রাচীনতম পর্বত। গুরুশিখর (১,৭২২ মিটার) সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।
- রাজস্থান উচ্চভূমি: আরাবল্লি পর্বতের পূর্বে অবস্থিত, মারওয়াড় মালভূমি নামেও পরিচিত।
- মধ্য ভারতের পাথার অঞ্চল: রাজস্থান উচ্চভূমির পূর্বে অবস্থিত, ঢেউ খেলানো ভূপ্রকৃতি।
- বুন্দেলখন্ড মালভূমি: পাথার অঞ্চলের পূর্বে অবস্থিত, গ্রানাইট ও নিস শিলা দ্বারা গঠিত, মেসা ভূভাগ।
- বিন্ধ্য পর্বত: নর্মদা নদীর উত্তরে অবস্থিত, প্রাচীন স্তুপ পর্বত, সমতল শীর্ষ এবং সিঁড়ির মতো ধার।
- মালব মালভূমি: বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরে অবস্থিত, লাভা দ্বারা গঠিত, উঁচুনীচু এবং ঢেউ খেলানো ভূপ্রকৃতি।
- রেওয়া মালভূমি: মালব মালভূমির পূর্বে অবস্থিত, ঢেউ খেলানো এবং লাভা দ্বারা গঠিত।
গুরুত্ব
- খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ: লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, তামা, অ্যালুমিনিয়াম।
- কৃষিক্ষেত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ: ধান, গম, জোয়ার, বাজরা, তুলা।
- জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ: নর্মদা, তাপী, সোন নদী।
- বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের আবাসস্থল।
পূর্বভারতের উচ্চভূমি
দাক্ষিণাত্য মালভূমির উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত ক্ষয়প্রাপ্ত মালভূমি ও উচ্চভূমিগুলিকে একত্রে পূর্ব ভারতের উচ্চভূমি বলে। এই অঞ্চলটি তার বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতি, খনিজ সম্পদ এবং বনজ সম্পদের জন্য পরিচিত।
ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য
ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে পূর্ব ভারতের উচ্চভূমি অঞ্চলকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়:
1. বাঘেলখণ্ড মালভূমি
- পূর্ব ভারতের উচ্চভূমি অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিমে শোন নদীর দক্ষিণে অবস্থিত।
- প্রাচীন ভঙ্গিল পর্বতের ক্ষয়প্রাপ্ত অংশবিশেষ।
- গ্রানাইট ও প্রাচীন পাললিক শিলায় গঠিত ভঙ্গিল পার্বত্য অঞ্চল।
2. ছোটোনাগপুর মালভূমি
- বাঘেলখন্ড মালভূমির পূর্ব দিকে রাচি, হাজারিবাগ ও কোডার্মা মালভূমি নিয়ে এই অঞ্চলটি গঠিত।
- ছোটোনাগপুরের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ পরেশনাথ পাহাড় (উচ্চতা ১,৩৬৬ মিটার)।
- ‘পাট অঞ্চল’ নামেও পরিচিত।
- রাঁচি মালভূমির উত্তর দিক দিয়ে দামোদর নদ প্রবাহিত হয়েছে।
- হাজারিবাগ মালভূমি রাচি মালভূমির উত্তরে অবস্থিত।
3. রাজমহল পাহাড়
- রাচি মালভূমির উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত।
- ব্যাসল্ট শিলা দ্বারা গঠিত।
4. ছত্রিশগড় ক্ষেত্র
- মহানদী অববাহিকার ছত্রিশগড় ক্ষেত্র অঞ্চলটির আকৃতি অনেকটা সরার মত।
5. দণ্ডকারণ্য উচ্চভূমি
- ছত্রিশগড়ের দক্ষিণে অবস্থিত।
- কালাহান্ডি ও কোরাপুট মালভূমি নিয়ে গঠিত।
6. গড়জাত পাহাড়
- রাঁচি মালভূমির দক্ষিণে ও মহানদীর পূর্ব দিকে বোনাই, কেওনঝাড়, সিমলিপাল প্রভৃতি পাহাড় নিয়ে গড়জাত পাহাড় অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে।
দাক্ষিণাত্য মালভূমি
দাক্ষিণাত্য মালভূমি, ভারতের দক্ষিণে অবস্থিত একটি ত্রিভুজ আকৃতির মালভূমি, যা উত্তরে বিন্ধ্য পর্বত, পূর্বে পূর্বঘাট এবং পশ্চিমে পশ্চিমঘাট দ্বারা বেষ্টিত। নর্মদা নদী এই মালভূমির উত্তর সীমানা নির্ধারণ করে।
বৈশিষ্ট্য
- ভূপ্রকৃতি
- দাক্ষিণাত্য মালভূমি ভারতের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ভূখণ্ড, যা ‘গণ্ডোয়ানাল্যান্ড’ নামক প্রাচীন মহাদেশের অংশ ছিল।
- এই মালভূমি পশ্চিম দিকে উঁচু এবং পূর্ব দিকে ক্রমশ ঢালু হয়ে গেছে।
- পশ্চিম ঘাট এবং পূর্বঘাট পর্বত দুটি ভারতের দক্ষিণে অবস্থিত নীলগিরি পর্বতে পরস্পর মিলিত হয়েছে।
- রাজ্য
- মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ু ভারতের এই চারটি রাজ্য দাক্ষিণাত্য মালভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত।
- ভাগ
- দাক্ষিণাত্য মালভূমি অঞ্চলকে পার্বত্য অংশ এবং মালভূমি অংশ – এই দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।
উপকূলীয় সমভূমি অঞ্চল
দক্ষিণ ভারতের পূর্বদিকে বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিমদিকে আরব সাগরের উপকূল বরাবর প্রসারিত দুটি সংকীর্ণ সমভূমি অঞ্চলকে উপকূলীয় সমভূমি বলা হয়। এই অঞ্চলগুলিকে তাদের অবস্থান অনুসারে দুটি ভাগে ভাগ করা যায় –
- পূর্ব উপকূলীয় সমভূমি
- পশ্চিম উপকূলীয় সমভূমি
পূর্ব উপকূলীয় সমভূমি
ভারতের পূর্বদিকে বঙ্গোপসাগরের তীরে বিস্তৃত অঞ্চলটি পূর্ব উপকূলীয় সমভূমি নামে পরিচিত। প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং গড়ে ১০০ কিলোমিটার প্রশস্ত এই সমভূমি দুটি ভাগে বিভক্ত: উত্তর সরকার উপকূল এবং করমণ্ডল উপকূল।
উত্তর সরকার উপকূল
- সুবর্ণরেখা নদীর মোহনা থেকে কৃষ্ণা নদীর বদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত।
- ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত।
- উল্লেখযোগ্য হ্রদ: চিল্কা, কোলেরু (ওড়িশা), পুলিকট (অন্ধ্রপ্রদেশ)।
করমণ্ডল উপকূল
- কৃষ্ণা নদীর বদ্বীপ থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত।
- তামিলনাড়ু রাজ্যে অবস্থিত।
- দক্ষিণে কুমারিকা অন্তরীপ অবস্থিত।
পূর্ব উপকূলীয় সমভূমির বৈশিষ্ট্য
- পূর্ব উপকূলীয় সমভূমি অত্যন্ত উর্বর এবং কৃষিকাজের জন্য উপযোগী।
- ধান, আখ, নারকেল, তামিলনাড়ুর চা, কফি ইত্যাদি এখানকার প্রধান ফসল।
- খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ, লোহা, মাইকা এবং চুনাপাথর।
- বন্দর, শিল্প এবং পর্যটন এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দ্বীপ অঞ্চল
ভারতের উপকূলে দুটি মহাসাগরের ঢেউয়ে ভেসে বেড়ায় অসংখ্য দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পূর্বে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে জন্ম নেওয়া দ্বীপপুঞ্জের সারি, আরব সাগরের দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবাল প্রাচীরের মুক্তার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দ্বীপ – এই দ্বীপপুঞ্জগুলি ভারতের সমুদ্রসৈকত রত্ন।
বঙ্গোপসাগরের দ্বীপপুঞ্জ
বঙ্গোপসাগরে ১০° উত্তর অক্ষাংশে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জ দুটি ভাগে বিভক্ত: আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। এই দ্বীপগুলি ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে মায়ানমারের আরাকান পর্বতমালার ডুবে যাওয়া অংশ, যা পূর্ব দিকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা ও জাভা পর্যন্ত প্রসারিত।
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ
- প্রধান দ্বীপ: উত্তর আন্দামান, মধ্য আন্দামান, দক্ষিণ আন্দামান, ক্ষুদ্র আন্দামান
- সর্বোচ্চ শৃঙ্গ: স্যাডেল পিক (৭৩৮ মিটার)
- বিশেষ দ্বীপ: ব্যারেন ও নারকোনডাম (সুপ্ত আগ্নেয়গিরি)
নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ
- প্রধান দ্বীপ: কার নিকোবর, বৃহৎ নিকোবর
- উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গ: মাউন্ট খুলিয়ার (৬৪০ মিটার)
- বিশেষ স্থান: ইন্দিরা পয়েন্ট (ভারতের দক্ষিণতম বিন্দু)
- আন্দামান ও নিকোবর ছাড়াও বঙ্গোপসাগরে আরও অনেক দ্বীপ আছে, কিন্তু সেগুলো আয়তনে ছোট এবং পানিশূন্য হওয়ায় জনবসতিহীন।
বঙ্গোপসাগরের দ্বীপপুঞ্জগুলির গুরুত্ব
- প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: ঘন জঙ্গল, মনোরম সমুদ্র সৈকত, বৈচিত্র্যময় প্রাণীজগত
- বৈজ্ঞানিক গবেষণা: জীববৈচিত্র্য, ভূতত্ত্ব, সমুদ্রতত্ত্ব
- পর্যটন: অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম, ইকো-ট্যুরিজম, স্কুবা ডাইভিং
- কৌশলগত অবস্থান: সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য
আরব সাগরের দ্বীপপুঞ্জ
ভারতের পশ্চিম উপকূলে, কেরালার মনোরম মালাবার উপকূল থেকে 324 কিলোমিটার দূরে বিক্ষিপ্ত 36টি ছোট্ট প্রবাল দ্বীপের সমাহার লাক্ষাদ্বীপ। প্রবাল প্রাচীরের আলিঙ্গনে বন্দি এই দ্বীপপুঞ্জ তার অপার সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য এবং অনন্য সংস্কৃতির জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে।
লাক্ষাদ্বীপের মোট আয়তন মাত্র 32 বর্গ কিলোমিটার। এই ক্ষুদ্র আয়তনের মধ্যে মিনিকয় দ্বীপ সবচেয়ে বড়, যার আয়তন 4.50 বর্গ কিলোমিটার। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, কোটি কোটি বছর ধরে আরব সাগরের প্রবাল প্রাণীদের মৃত দেহাবশেষ স্তরে স্তরে জমা হয়ে আরবল্লী পর্বতমালার সম্প্রসারিত অংশের উপরে এই অপূর্ব দ্বীপপুঞ্জের সৃষ্টি হয়েছে।
দ্বীপপুঞ্জের গুরুত্ব
দ্বীপপুঞ্জ হলো সমুদ্রের বুকে অবস্থিত ছোট বড় দ্বীপের সমষ্টি। ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, প্রাকৃতিক সম্পদ, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির দিক থেকে দ্বীপপুঞ্জগুলির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
- জীবিকা নির্বাহ: দ্বীপপুঞ্জের ঘন বনভূমি মূল্যবান কাঠ ও বনজ সম্পদ সরবরাহ করে যা স্থানীয়দের জীবিকা অর্জনে সহায়ক। এছাড়াও, মৎস্যশিকার দ্বীপবাসীদের আরেকটি প্রধান জীবিকা।
- অর্থনৈতিক উন্নয়ন: দ্বীপ অঞ্চলের কাঠের প্রাচুর্য কাঠ শিল্পের উন্নয়নে সহায়তা করে। নারিকেল, সুপারি ও তাল জাতীয় গাছের চাষও দ্বীপপুঞ্জের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- পর্যটন: বর্তমানে দ্বীপপুঞ্জগুলিতে পর্যটনশিল্পের যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে। মনোরম পরিবেশ, সুন্দর সমুদ্র সৈকত এবং অনন্য সংস্কৃতি দ্বীপপুঞ্জগুলিকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে।
- প্রাকৃতিক সম্পদ: পার্শ্ববর্তী সমুদ্র থেকে মূল্যবান রত্ন ও মৎস আহরণ করা সম্ভব।
- অর্থনৈতিক নির্ভরতা: নিজস্ব অর্থনীতি গড়ে না ওঠায় দ্বীপপুঞ্জগুলিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল ভূখণ্ডের উপর নির্ভর করতে হয়।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি: দ্বীপপুঞ্জগুলি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বেশি থাকে।
শিবালিক পর্বতমালা ভারতের ভূপ্রকৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ খণ্ড, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রের আবাসস্থল। এটি ভূমিধ্বস প্রতিরোধ, জল সরবরাহ, খনিজ সম্পদ এবং পর্যটনে অবদান রাখে।