আজকের এই আর্টিকেলে আমরা অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় ‘অদ্ভুত আতিথেয়তা’-এর বিষয়সংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করবো। এই বিষয়সংক্ষেপ অষ্টম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি প্রায়ই পরীক্ষায় আসে।
অদ্ভুত আতিথেয়তা অধ্যায়ের লেখক পরিচিতি
১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা হলেন ভগবতী দেবী। ঈশ্বরচন্দ্রের বাল্য ও কৈশোর কেটেছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। তিনি প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন গ্রামের পাঠশালায়। নয় বছর বয়সে তিনি গ্রামের প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভরতি হন। কাব্য, অলংকার, বেদান্ত, স্মৃতি, জ্যোতিষ ও ন্যায়শাস্ত্রে অগাধ পান্ডিত্যের পরিচয় দিয়ে তিনি ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন। ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর মাত্র ২১ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রধান অধ্যাপক হন। পরবর্তীকালে ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষপদ তিনি লাভ করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি প্রায় ২০টি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বালিকাদের জন্য তিনি প্রায় ৩০টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। তিনি শুধু একজন শিক্ষাসংস্কারক নন, তিনি সমাজসংস্কারকও ছিলেন। নারীজাতির দুর্গতিমোচনের জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। তাঁরই অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই বিধবাবিবাহ আইন বিধিবদ্ধ হয়। বাংলা গদ্যসাহিত্যে তাঁর দান অবিস্মরণীয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বাংলা গদ্যের ‘প্রথম যথার্থ শিল্পী’ আখ্যায় সম্মানিত করেছেন। তাঁর রচিত অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’, ‘শকুন্তলা’, ‘সীতার বনবাস’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’। তাঁর মৌলিক রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘বোধোদয়’, ‘কথামালা’, ‘বর্ণপরিচয়’, ‘আখ্যানমঞ্জরী’, ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’। এ ছাড়াও সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য-বিষয়ক, সমাজ-বিষয়ক বহু প্রবন্ধ ও পুস্তিকা তিনি রচনা করেছেন। স্কুল পরিদর্শকরূপে তিনি হাওড়া, হুগলি, মেদিনীপুর, ২৪ পরগনার বহু গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছেন। শিক্ষা ও সমাজসংস্কারক এবং বাংলা গদ্যশিল্পের জনকরূপে তিনি চিরস্মরণীয়। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই বিদ্যাসাগর দেহত্যাগ করেন।
অদ্ভুত আতিথেয়তা অধ্যায়ের উৎস
অদ্ভুত আতিথেয়তা গল্পটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘আখ্যানমঞ্জরী’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
অদ্ভুত আতিথেয়তা অধ্যায়ের পাঠপ্রসঙ্গ
আতিথেয়তা এক পরম মানবীয় গুণ। বর্তমানে মানুষের মন থেকে এই গুণটি ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অথচ ভারতীয়রা ছোটোবেলা থেকেই এই গুণটির সঙ্গে পরিচিত হয়। বিপদে-আপদে মানুষ অনেক সময় আতিথ্য প্রার্থনা করে, তখন শত্রু মিত্র বিবেচনা না করে আশ্রিতকে সমাদর করার শিক্ষাই দিয়েছে প্রাচীন ভারতীয় মুনিঋষিগণ। যে ব্যক্তি আতিথেয়তা দান করেন, তিনি মনের প্রশান্তি প্রাপ্ত হন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘অদ্ভুত আতিথেয়তা’ গল্পে সে প্রসঙ্গেই আলোচনা করা হয়েছে।
অদ্ভুত আতিথেয়তা অধ্যায়ের বিষয়সংক্ষেপ
একদা আরবদের সঙ্গে মুরদের যুদ্ধ হয়েছিল। আরব সেনারা বহুদূর পর্যন্ত এক মুর সেনাকে অনুসরণ করলে সেই সেনাপতি দ্রুত বেগে পলায়ন করে। কিন্তু শেষে দিগভ্রম হয়ে বিপক্ষ শিবিরের সামনে ক্লান্ত ও অবসন্ন শরীরে উপস্থিত হন। কিছুক্ষণ পরে তিনি এক আরব সেনাপতির তাঁবুর সামনে উপস্থিত হয়ে, তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। আতিথেয়তার ব্যাপারে আরবদের সমতুল্য কেউ নেই। শত্রুকেও তারা যথাসাধ্য আতিথেয়তা করেন। আরব সেনাপতি আগত মুর সেনাকে ক্লান্ত ও ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর দেখে তার আহারাদির ব্যবস্থা করেন। তারা বন্ধুভাবে কথোপকথনে মগ্ন হন। তারা পরস্পর পরস্পরের ও তাদের পূর্বপুরুষদের সাহস, পরাক্রম প্রভৃতির পরিচয় দিতে থাকেন। এমন সময় হঠাৎই আরব সেনাপতি বিবর্ণ মুখে সেখান থেকে প্রস্থান করেন এবং কিছুক্ষণ পরেই নিজের অসুস্থতার সংবাদ পাঠিয়ে মুর সেনাপতিকে জানান যে তার আহার ও শয্যা তৈরি আছে, তিনি যেন আহার করে শয়ন করেন। তার ঘোড়াও ক্লান্ত, হতবীর্য হয়েছে, তাই পরের দিন সকালে তার জন্য তেজস্বী ঘোড়া সাজিয়ে রাখা হবে তাঁবুর সামনে। সেই সময় আবার দুজনের সাক্ষাৎ হবে এবং মুর সেনাপতি যাতে নিজ স্থানে পৌঁছোতে পারেন, তার ব্যবস্থাও তিনি করে দেবেন।
মুর সেনাপতি আশ্রয়দাতার এমন আচরণের কোনো কারণ বুঝতে না পেরে সন্দিগ্ধ মনেই শয়ন করেন। প্রভাতে আরব সেনাপতির লোকজন এসে তার নিদ্রাভঙ্গ করায় এবং তারা বলে যে মুর সেনাপতির ফিরে যাওয়ার সময় উপস্থিত হয়েছে। মুর সেনাপতি শিবিরের দ্বারদেশে উপস্থিত হয়ে দেখেন আরব সেনাপতি ঘোড়ার মুখরশ্মি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছেন। মুর সেনাপতিকে দেখামাত্র আরব সেনাপতি তাকে ঘোড়ায় আরোহণ করিয়ে দ্রুত বিপক্ষশিবির ত্যাগ করতে বলেন; তিনি আরও বলেন যে, এখানে তার (মুর সেনাপতির) সবথেকে বড়ো শত্রু তিনিই (আরব সেনাপতি)। কারণ কথোপকথনের সময় আরব সেনাপতি জানতে পেরেছেন মুর সেনাপতিই তার পিতার প্রাণহত্যার আদেশ দিয়েছিলেন এবং সে – কথা শুনে আরব সেনাপতি প্রতিজ্ঞা করেছেন সূর্যোদয় হলেই তিনি পিতৃহন্তার প্রাণনাশে প্রবৃত্ত হবেন। তাই মুর সেনাপতি যেন দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করেন। এরপর আরব সেনাপতি অতিথি সম্ভাষণ ও করমর্দন করে বিদায় জানান।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই আরব সেনাপতি শত্রুকে করায়ত্ত করতে প্রবৃত্ত হন। তবে সামান্য সময়ের সুযোগেই দ্রুত গতিসম্পন্ন ঘোড়ায় ধাবমান হয়ে মুর সেনাপতি ততক্ষণে স্বপক্ষীয় সেনাশিবিরে অর্থাৎ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। আরব সেনাপতি তা দেখতে পান এবং বৈরসাধন সংকল্প সফল হবে না বুঝতে পেরে নিজের শিবিরের উদ্দেশে প্রত্যাগমন করেন।
অদ্ভুত আতিথেয়তা অধ্যায়ের নামকরণ
সাহিত্যের একটি অন্যতম প্রধান উপাদান নামকরণ। নামকরণের মাধ্যমেই রচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আগাম ধারণা করা যায়। এবার আলোচনা করে দেখা যাক যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘অদ্ভুত আতিথেয়তা’ গল্পের নামকরণটি কতটা সার্থক।
একদা যুদ্ধক্লান্ত এক মুর সেনাপতি ভুলক্রমে শত্রু আরব সেনাপতির শিবিরের সামনে উপস্থিত হন এবং তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। আরব সেনাপতিও তাকে বিনা দ্বিধায় আতিথ্য দানে প্রস্তুত হয়ে, তার সাধ্যমতো আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। এরপর বন্ধুভাবে দুই সেনাপতির কথোপকথনে আরব সেনাপতি। জানতে পারেন যে, মুর সেনাপতি তার পিতৃহন্তা। কিন্তু এ কথা জেনেও আরব সেনাপতি মুর সেনাপতির কোনো ক্ষতি করলেন না, বরং তার আহার ও নিদ্রার ব্যবস্থা করে দেন। প্রভাতে বিদায় দেওয়ার সময় আরব সেনাপতি মুর সেনাপতিকে জানান যে – মুর সেনাপতিই তার পিতৃহন্তা, ফলে তিনি তার চরম শত্রু এবং সূর্যোদয়ের পরেই তিনি তাকে সংহার করার চেষ্টা করবেন।
গল্পটিতে আমরা দেখলাম যে, বিপক্ষ সেনা জেনেও আরব সেনাপতি মুর সেনাপতির আতিথেয়তা পালন করেছেন। আবার যখন তিনি জানলেন যে মুর সেনাপতিই তার পিতৃহন্তা, তখনও তিনি তাকে হত্যা করার চেষ্টা তো করলেনই না-বরং তার আহার-নিদ্রার সুব্যবস্থাও করে দেন এবং আতিথেয়তার চরম নিদর্শন স্থাপন করেন। আতিথেয়তার এমন উদাহরণ বিরল। সাধারণত এটা আশা করা যায় না যে, চরম শত্রুকে কেউ সমাদরে আতিথ্য দান করছেন। আবার সে যদি পিতৃহন্তা হয়, তাহলে তো সে আতিথ্য আশা করাটাই অন্যায়। অথচ আরব সেনাপতি সেই আতিথেয়তাই করেছেন মুর সেনাপতির প্রতি এবং তিনি আতিথেয়তার এক অদ্ভুত নিদর্শন স্থাপন করেছেন। গল্পটির মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে এমন ধরনের আতিথেয়তা। তাই গল্পটির কাহিনিধর্মী নামকরণ ‘অদ্ভুত আতিথেয়েতা’ সম্পূর্ণ সার্থক বলে মনে করি।
অদ্ভুত আতিথেয়তা অধ্যায়ের শব্দার্থ ও টীকা
একদা – কোনো এক সময়ে। মুর – (ইং-Moor) উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার কৃষ্ণকায় মুসলমান জাতিবিশেষ। সংগ্রাম – যুদ্ধ। বিরত – ক্ষান্ত। স্বপক্ষীয় – নিজের দলের। শিবির – অস্থায়ী বাসস্থান। দিকভ্রম – দিক নির্ণয়ে ভুল হওয়া। শিবিরসন্নিবেশস্থানে – তাঁবুর কাছাকাছি জায়গায়। সন্নিবেশ – নিকটবর্তী। অশ্বপৃষ্ঠে – ঘোড়ার পিঠে। কিয়ৎক্ষণ – কিছুক্ষণ। পটমণ্ডপদ্বারে – তাঁবুর (কাপড়ের তৈরি) দরজায়। তুল্য – তুলনীয়। আলয় – গৃহ। সাধ্যানুসারে – নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী। পরিচর্যা – সেবা। অণুমাত্র – সামান্য। বিদ্বেষ প্রদর্শন – অপ্রীতির বা শত্রুতার ভাব দেখানো। বিপক্ষতাচরণ – বিপক্ষের মতো আচরণ। তৎক্ষণাৎ – তক্ষুনি। প্রার্থিত – প্রার্থনা করা হয়েছে এমন। ক্ষুৎপিপাসা – ক্ষুধা-তৃষ্না। উদ্যোগ – চেষ্টা। ক্ষুন্নিবৃত্তি – ক্ষুধার নিবৃত্তি। উপবিষ্ট – বসা; আসীন। পরাক্রম – শৌর্য-বীর্য। সহসা – হঠাৎ। হতবীর্য – দুর্বল; ক্লান্ত; পরিশ্রান্ত; অশক্ত। প্রত্যুষে – প্রভাতে। দণ্ডায়মান – দাঁড়িয়ে থাকা। সত্বর – দ্রুত। তদবিষয়ে – সেই বিষয়ে। মর্মগ্রহ – তাৎপর্য। সন্দিহান চিত্তে – সন্দিগ্ধ মনে। শয়ন – শোওয়া। গাত্রোত্থান – উঠে দাঁড়ানো। মুখপ্রক্ষালন – মুখ ধোয়া। রজনী – রাত্রি। যৎকালে – যখন। স্বীয় – নিজ। শ্রবণমাত্র – শোনামাত্র। বৈরসাধন – বিরোধিতা; শত্রুতা। পিতৃহন্তা – পিতৃঘাতক। অপগত – বিগত; চলে গেছে এমন। নিমিত্ত – জন্য। করমর্দন – হাত মেলানো। তদীয় – তার। কতিপয় – কিছু। নির্বিঘ্ন – বাধাহীন। সবিশেষ – বিশেষের সহিত। স্বপক্ষ – নিজ পক্ষ। প্রবিষ্ট – প্রবেশ। অতঃপর – তারপর। সংকল্প – প্রতিজ্ঞা। প্রতিগমন – ফিরে যাওয়া।
আজকের এই আর্টিকেলে অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় ‘অদ্ভুত আতিথেয়তা’–এর বিষয়সংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছি। এই বিষয়সংক্ষেপ অষ্টম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই নিবন্ধটি আপনার জন্য সহায়ক হয়েছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে বা আরও সহায়তার প্রয়োজন হয়, তাহলে আপনি টেলিগ্রামে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনার বন্ধুদের সঙ্গে এই পোস্টটি শেয়ার করতে ভুলবেন না, যাতে তারা উপকৃত হতে পারে। ধন্যবাদ!