আজকের এই আর্টিকেলে আমরা অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের চতুর্থ অধ্যায় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ এর রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো অষ্টম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসে।
এ শৌর্য পরাজয় করে আনন্দ আছে। – উদ্ধৃত অংশটির প্রসঙ্গ ও তাৎপর্য আলোচনা কর।
প্রসঙ্গ – উদ্ধৃতাংশটি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক থেকে নেওয়া হয়েছে। বক্তা হলেন গ্রিক অধিপতি সেকেন্দার সাহা। সন্ধ্যাকালে সিন্ধুনদতটে উপস্থিত হয়ে সেকেন্দার সাহা যখন তার সেনাপতি সেলুকসের সঙ্গে কথোপকথনে মগ্ন হয়েছেন তখন ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের পরিচয় দিতে দিতে ভারতের আর্যপুরুষদের বীরত্বের পরিচয়ও মুগ্ধ বিস্ময়ে বর্ণনা করেন সেকেন্দার সাহা। সেই প্রসঙ্গেই তিনি উক্তিটি করেছেন।
তাৎপর্য – দিগবিজয়ে বেরিয়ে সেকেন্দার সাহা এসেছিলেন ভারতবর্ষে। অর্ধেক এশিয়া পদদলিত করে তিনি প্রথম বাধা পেয়েছেন শতদ্রুর তীরে পুরুর কাছে। সেলুকসের কাছে সেই কথাই আলোচনা করছিলেন সেকেন্দার সাহা। তিনি ভারতীয়দের শৌর্য ও শক্তির প্রকাশে মুগ্ধ হয়েছেন। ভারতীয়রা শিশুর মতো সহজসরল, তাদের মুখে শিশুর সারল্য, আবার একইসঙ্গে তারা সাহসী, বজ্রের মতো তাদের কঠিন দেহ। বীর বীরকে পরাজিত করেই খুশি হয়। প্রশ্নোক্ত উক্তির মাধ্যমে বক্তা এ কথাই বোঝাতে চান।
সম্রাট মহানুভব। – উদ্ধৃত অংশটির প্রসঙ্গ ও তাৎপর্য আলোচনা কর।
প্রসঙ্গ – প্রশ্নোক্ত উক্তিটি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নামক নাটক থেকে নেওয়া হয়েছে। গ্রিক শিবিরে সিন্ধুতটে দাঁড়িয়ে ভারতীয়দের শৌর্যের পরিচয় যখন দিচ্ছিলেন, পুরুকে মুক্তি দেওয়া প্রসঙ্গে সেলুকস প্রশ্নোক্ত কথাটি বলেছেন।
তাৎপর্য – শতদ্রুর তীরে সেকেন্দার সাহা প্রথম বাধা পান পুরুর কাছে। প্রায় অর্ধেক এশিয়া পদদলিত করেও কোথাও বাধার সম্মুখীন হননি তিনি। কিন্তু এখানে এক ভারতীয় রাজা পুরু তার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। যদিও পুরু পরাজিত হয়েছেন, তবু তার শৌর্য-বীর্যে মুগ্ধ হয়েছেন গ্রিক অধিপতি সেকেন্দার সাহা। তাই পুরুর রাজ্য তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সম্রাটের এমন কীর্তিকলাপে মহামানবীয়তা লক্ষ করেছেন সেনাপতি সেলুকস। তিনিও জানেন সেকেন্দার সাহা মহান রাজা এবং বীরের সম্মান দিতে তিনি কুণ্ঠিত নন। তাই তিনি সম্রাটকে উদ্দেশ করে প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি করেছেন।
বাধা পেলাম প্রথম – সেই শতদ্রুতীরে। – উদ্ধৃত অংশটির প্রসঙ্গ ও তাৎপর্য আলোচনা কর।
প্রসঙ্গ – প্রশ্নোক্ত অংশটি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নামক নাটক থেকে নেওয়া হয়েছে। ম্যাসিডন অধিপতি সেকেন্দার সাহা দিগবিজয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। ভারতবর্ষে তিনি প্রথম বাধা পান পুরুর কাছে। সেই প্রসঙ্গেই প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি করেন সেকেন্দার সাহা।
তাৎপর্য – প্রায় অর্ধেক এশিয়া তিনি অতিক্রম করে এসেছেন বিনা বাধায়। দূর ম্যাসিডন থেকে রাজ্য-জনপদ তৃণের মতো পদতলে দলিত করেছেন তিনি; ঝঞ্ঝার মতো ঝাপটায় শত্রুসৈন্য ধুলোর মতো উড়িয়ে দিয়েছেন; অর্ধেক এশিয়ার বুকের উপর দিয়ে তার বিজয়যান অবাধে অতিক্রম করেছে। কিন্তু সেই মহাশক্তিশালী গ্রিক সেনাও শতদ্রুতীরে পুরুর বীরত্বে বিচলিত হয়েছিল। পুরু বীরবিক্রমে সেকান্দার সাহা-র বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে পরাজয় বরণ করেছে। জয়ী হয়েও পুরুর পরাক্রমে সেকেন্দার সাহা মুগ্ধ। প্রশ্নোক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি সে – কথাই বোঝাতে চেয়েছেন।
আমি তারই প্রতিশোধ নিতে বেরিয়েছি। – উদ্ধৃত অংশটির প্রসঙ্গ ও তাৎপর্য আলোচনা কর।
প্রসঙ্গ – প্রশ্নোক্ত অংশটি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নামক নাটক থেকে নেওয়া হয়েছে। একদা সেকেন্দার সাহা সিন্ধুনদতটে সূর্যাস্তের সময় সেলুকসের সঙ্গে ভারতবর্ষের বৈচিত্র্য সম্পর্কে যখন কথোপকথন করছিলেন, তখন আন্টিগোনস এক ভারতীয় যুবককে গুপ্তচর সন্দেহে সেখানে নিয়ে এলে, সেকেন্দার সাহা-র প্রশ্নের প্রসঙ্গে যুবক প্রশ্নোক্ত কথাটি বলে।
তাৎপর্য – সেকেন্দার সাহা যুবকের অভিপ্রায় কী জানতে চাইলে যুবক জানায় যে, সে মগধের নির্বাসিত যুবরাজ চন্দ্রগুপ্ত। মহাপদ্মনন্দ তার পিতা। তার বৈমাত্রেয় ভাই ধননন্দ সিংহাসন অধিকার করে তাকে নির্বাসিত করেছে। এই মাসাবধিকাল সে সেলুকাসের কাছে গ্রিক সমরবিদ্যা শিক্ষা করেছে। গ্রিক সেনা শীঘ্র স্থান ত্যাগ করবে শুনে সে যা শিখেছে তা লিপিবদ্ধ করে রাখছিল, কেবল হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধারে সেই বিদ্যা কাজে লাগাবে এই আশাতে। অর্থাৎ নন্দ রাজাকে পরাজিত করে প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথাই চন্দ্রগুপ্ত প্রশ্নোক্ত উক্তির মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন।
যাও বীর! মুক্ত তুমি। – উদ্ধৃত অংশটির প্রসঙ্গ ও তাৎপর্য আলোচনা কর।
প্রসঙ্গ – প্রশ্নোক্ত অংশটি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নামক নাটক থেকে নেওয়া হয়েছে। আন্টিগোনস গুপ্তচর সন্দেহে চন্দ্রগুপ্তকে সেকেন্দার সাহা-র কাছে ধরে নিয়ে আসে। তারপর ঘটনাক্রমে চন্দ্রগুপ্তকে বন্দি করার নির্দেশ দেয়। সেই প্রসঙ্গেই তিনি (সেকেন্দার সাহা) উক্তিটি করেন।
তাৎপর্য – অযাচিতভাবে শিবিরে প্রবেশ করে গ্রিক সমরবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞানসংগ্রহের জন্য গ্রিক অধিপতি সেকেন্দার সাহা বন্দি করার নির্দেশ দেন চন্দ্রগুপ্তকে। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত তাতে ভীত না হয়ে সেকেন্দার সাহা-কে বুঝিয়ে দেন যে, তিনি ভীত নন এবং বধ না করে তাকে বন্দি করা সম্ভব নয়। চন্দ্রগুপ্তের এমন বীর্যবত্তার পরিচয়ে সেকেন্দার সাহা বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি তখন বলেন যে, ভারতীয় যুবককে তিনি পরীক্ষা করছিলেন মাত্র এবং তিনি তার সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়েছেন। তাই চন্দ্রগুপ্তকে তিনি মুক্ত বলে মেনে নেন ও তাকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন।
নাট্যাংশটি অবলম্বনে ঐতিহাসিক নাটকের পরিবেশ সৃষ্টিতে নাট্যকারের দক্ষতার পরিচয় দাও।
ঐতিহাসিক নাটকের পূর্ণতম রূপটি নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রতিভাস্পর্শে পরিস্ফুট হয়েছিল। তাঁর লেখা ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকের মূল চরিত্র চন্দ্রগুপ্ত ঐতিহাসিক চরিত্র। তিনি মগধের রাজকুমার ও ধননন্দের বৈমাত্রেয় ভাই। নন্দবংশ ধ্বংস করে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করলে মৌর্যবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। পাশাপাশি ম্যাসিডন অধিপতি আলেকজান্ডার, সেনাপতি সেলুকসসহ ভারত অভিযান এবং হিদাস্পিসের যুদ্ধে পুরুর পরাজয়বরণ ঘটনাটিও ঐতিহাসিক। ইতিহাসের চরিত্রগুলিই দ্বিজেন্দ্রলালের লেখনীস্পর্শে গাঢ় ও উজ্জ্বল রেখায় অঙ্কিত। ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক রচনায় নাট্যকার হিন্দু পুরাণ, কিংবদন্তি ও গ্রিক ইতিহাসের উপর নির্ভর করেছেন। ইচ্ছা করে ঐতিহাসিক বিবরণের গুরুতর ব্যতিক্রম তিনি করেননি। চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে আলেকজান্ডারের সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ। তাঁর নাটকের অন্যতম প্রধান গুণ এবং আকর্ষণক্ষমতা হল অনবদ্য ভাষা। প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে সেকেন্দার সাহা ভারতের যে অপরূপ বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের কথা বলেছেন তার বর্ণনার সাবলীলতার গুণেই তা সুখপাঠ্য। সামগ্রিক বিচারে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে ঐতিহাসিক নাটকের পরিবেশ সৃজনে নাট্যকারের দক্ষতা পরিস্ফুট হয়েছে।
নাট্যাংশে সেকেন্দার ও সেলুকস – এর পরিচয় দাও। সেকেন্দারের সংলাপে ভারত-প্রকৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপ কীভাবে ধরা পড়েছে, তা বিশ্লেষণ করো।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হল সেকেন্দার। সেকেন্দার অর্ধেক এশিয়াকে পদদলিত করে ভারতে প্রবেশ করেছেন দিগবিজয়ের বাসনা নিয়ে। ইতিহাসে তিনি আলেকজান্ডার নামেই পরিচিত। ভারতে পুরুর সঙ্গে তার ভয়ানক সংঘর্ষ ঘটে। পুরুর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে তিনি পুরুর রাজত্ব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
সেকেন্দার সাহা-র বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন সেলুকস। তিনি সম্রাট সেকেন্দারের বিশ্বস্ত সেনাপতি ছিলেন। আলেকজান্ডার ভারত ত্যাগ করে গেলে ভারতে গ্রিক রাজ্যগুলির অধিপতি হয়েছিলেন সেলুকস। পরবর্তীকালে চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সেলুকসের সংঘর্ষ হয় এবং উভয়ের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়েছিল।
সেকেন্দার সাহা-র সংলাপে ভারত-প্রকৃতির বৈচিত্র্যের প্রকাশ ঘটেছে। তার বর্ণনা থেকে পাওয়া যায় — দিনে সূর্যের প্রচণ্ড দীপ্তি যেন নীল আকাশকে পুড়িয়ে দিচ্ছে, আবার রাতে চাঁদের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না পৃথিবীকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। অগণ্য উজ্জ্বল জ্যোতিপুঞ্জে আকাশ ঝলমল করছে; বর্ষায় ঘন কৃষ্ণ মেঘপুঞ্জ গুরুগম্ভীর গর্জনে আকাশ ছেয়ে যাচ্ছে; কোথাও উদ্দাম বেগে ধেয়ে চলেছে নদীধারা, আবার কোথাও মরুভূমির তপ্ত বালুকা বিরাজ করছে; কোথাও তালীবন গর্বভরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, কোথাও আবার বিরাট বটগাছের স্নেহচ্ছায়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কোথাও জঙ্গম পর্বতের মতো মত্ত হাতি চলেছে, কোথাও অলস হিংসার মতো পড়ে আছে মহাভুজঙ্গম, আবার কোথাও শূন্যপ্রেক্ষণে চেয়ে আছে বিস্মিত হরিণ।
এমনভাবেই ভারত-প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় রূপের প্রকাশ ঘটেছে সেকেন্দারের সংলাপে।
ইতিহাসের নানান অনুষঙ্গ কীভাবে নাট্যকলেবরে বিধৃত রয়েছে তা ঘটনাধারা বিশ্লেষণ করে আলোচনা করো।
নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকটি একটি সার্থক ঐতিহাসিক নাটক। ওই নাটক থেকে গৃহীত আলোচ্য নাটকের ক্ষেত্রে চরিত্র, কাহিনির প্রেক্ষাপট, ঘটনাস্থল এ সমস্ত বর্ণনা প্রসঙ্গে নাট্যকার ইতিহাসের ঘটনাকে বিশেষ ক্ষুণ্ণ করেননি। পুরাণ ও কিংবদন্তি অনুসরণ করে লেখক চন্দ্রগুপ্তকে নীচ ও শূদ্র বংশোদ্ভূত হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। আলেকজান্ডারের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের সাক্ষাৎ, ম্যাসিডনিয়ার সম্রাট সেকেন্দার সাহা তথা আলেকজান্ডার দিগবিজয় করতে এসে এশিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত প্রবল পরাক্রমে জয়লাভ করে শতদ্রু নদীর তীরে পুরুর রাজ্য দখল করতে গিয়ে প্রথম বিরোধিতার মুখোমুখি হন। ইতিহাস-সমর্থিত এই ঘটনা ‘হিদাস্পিসের যুদ্ধ’ নামে সুপরিচিত। সেকেন্দার সাহা পুরুর শৌর্যের প্রসঙ্গে আর্যতেজ ও দর্প দেখে মুগ্ধ হয়েছেন – এই ঘটনাও ইতিহাস-প্রসিদ্ধ। চন্দ্রগুপ্ত নির্বাসিত হয়ে আলেকজান্ডারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বৈমাত্রেয় ভাই নন্দকে সিংহাসনচ্যুত করে প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্প করেন সেই ঘটনাও ইতিহাস সম্মত। নন্দবংশ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে মগধের সিংহাসনে মৌর্যবংশ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত ইতিহাসের কাহিনি অনুসারেই নাট্যকার বর্ণনা করেছেন। এমনকি চন্দ্রগুপ্তকে কেন্দ্র করে সেনাপতি সেলুকস ও আন্টিগোনসের মধ্যেকার বিরোধের বৃত্তান্তটিও ইতিহাসাশ্রিত। সিন্ধুনদতটে অবস্থানকালে ভারতের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সৌন্দর্যে আলেকজান্ডারের সেলুকসের কাছে মুগ্ধতাজ্ঞাপনও ইতিহাসে উল্লিখিত।
সুতরাং নাট্যকার ইতিহাসের মর্যাদা রক্ষা করে নাট্যকলেবর বিধৃত করেছেন।
সেকেন্দার একবার সেলুকসের প্রতি চাহিলেন – তাঁর এই ক্ষণেক দৃষ্টিপাতের কারণ কী?
প্রশ্নোক্ত অংশটি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নামক নাটক থেকে নেওয়া হয়েছে।
সিন্ধুনদতটে সন্ধ্যাসমাগমে ভারতবর্ষীয়দের আচার-ব্যবহার নিয়েও কথোপকথনে মগ্ন ছিলেন সেলুকস ও গ্রিক অধিপতি সেকেন্দার সাহা। ভারতীয়দের শৌর্য-বীর্য, বীরত্বে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছেন গ্রিক অধিপতি। সেই প্রসঙ্গে পুরুর বীরত্ব ও সাহসিকতা তাকে মুগ্ধ করেছে এবং সে-কথা তিনি সেলুকসকে বলেওছেন। ঠিক তেমন সময়েই আন্টিগোনস গুপ্তচর সন্দেহে চন্দ্রগুপ্তকে সেখানে ধরে নিয়ে আসেন। সেকেন্দার সাহা চন্দ্রগুপ্তর কাছে আগমন ও তালপাতায় লেখার হেতু জানতে চাইলে চন্দ্রগুপ্ত জানায় যে – অর্ধেক এশিয়া পদদলিত করে দুর্বার বিক্রমে যিনি ভারতে এসেছেন, যার কাছে আর্যকুলরবি পুরু পরাজিত হয়েছেন, আর্যের মহাবীর্যও যার সংঘাতে বিচলিত, কোথায় সেই শক্তি তা দেখতেই তিনি এসেছেন এবং হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করাই তার ইচ্ছা। চন্দ্রগুপ্তের কথা শুনে মুগ্ধ সেকেন্দার সাহা সেলুকসকে যেন এ কথাই চোখের ইঙ্গিতে বলতে চেয়েছিলেন যে – ভারতীয়দের বীর্যবত্তার যে পরিচয় একটু আগেই তাকে দিয়েছেন, তা চন্দ্রগুপ্তের মধ্যেই আছে। এই ইঙ্গিতকে বোঝানোর জন্য সেকেন্দার সেলুকসের প্রতি ক্ষণেক দৃষ্টি স্থাপন করেন।
নাট্যাংশ অবলম্বনে গ্রিক সম্রাট সেকেন্দারের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের পরিচয় দাও।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকের উজ্জ্বল চরিত্র হল গ্রিক অধিপতি সেকেন্দার সাহা। আলোচ্য নাট্যাংশে তার চরিত্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।
নাটকের প্রথমেই দেখি সন্ধ্যাকালে সিন্ধুনদতটে দাঁড়িয়ে তিনি ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য সম্পর্কে সেলুকসের সঙ্গে কথোপকথন করছেন। তার উক্তি থেকে ভারত-প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্যের পরিচয় পাঠক অবগত হন। শুধু তাই নয়, ভারতীয়দের সম্পর্কেও তার ধারণার প্রতিফলন ঘটেছে তার উক্তিতে। তিনি বলেছেন – ‘সৌম্য, গৌর, দীর্ঘ-কান্তি জাতি এই দেশ শাসন করছে, তাদের মুখে শিশুর সারল্য, দেহে বজ্রের শক্তি, চক্ষে সূর্যের দীপ্তি, বক্ষে বাত্যার সাহস।’ সেকেন্দারের এমন উক্তিতে সহজেই অনুমান করা যায় যে, তিনি শুধু একজন রাজাই নন, তিনি জ্ঞানী এবং দার্শনিক চেতনার অধিকারী।
বন্দি পুরুর উত্তরে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন এবং এর ফলে পুরুকে তিনি তার রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছেন। এর থেকে বোঝা যায় যে তিনি নিজে একজন বীর বলেই প্রকৃত বীরকে তিনি সম্মান জানাতেও পারেন। এই বিজয়ী রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে তার হৃদয়ের মহানুভবতার পরিচয়ও পেয়ে থাকি।
তিনি চন্দ্রগুপ্তকে প্রথমে বন্দি করার আদেশ দিয়েও সেই আদেশ প্রত্যাখান করেছেন। চন্দ্রগুপ্ত তাকে ‘ভীরু’ বলে কটূক্তি করলেও তিনি বিরক্ত হননি। আসলে তিনি তো চন্দ্রগুপ্তের সাহসিকতার পরীক্ষাই করছিলেন। চন্দ্রগুপ্তের আচরণে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন এবং তাকে বাহবা জানিয়ে বলেছেন – তুমি হৃত রাজ্য উদ্ধার করবে। তুমি দুর্জয় দিগ্বিজয়ী হবে। তার এরুপ আচরণের মাধ্যমে তার উদারতার প্রকাশ ঘটেছে।
এইভাবে আলোচ্য নাট্যাংশে সেকেন্দারের বীর, মহানুভব, উদার চরিত্রের পরিচয় পাই, যা তাকে একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।
চন্দ্রগুপ্তের প্রতি সেকেন্দারের কীরূপ মনোভাবের পরিচয় নাট্যদৃশ্যে ফুটে উঠেছে, তা উভয়ের সংলাপের আলোকে বিশ্লেষণ করো।
আলোচ্য নাট্যদৃশ্যে চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সেকেন্দারের পরিচয় ঘটে আন্টিগোনস তাকে গুপ্তচর সন্দেহে শিবিরে ধরে আনার পরে। ভারতীয়দের প্রতি সেকেন্দারের উচ্চ ধারণা ছিল, সেই ধারণাই শক্তিশালী হয় চন্দ্রগুপ্তকে দেখার ও তার সঙ্গে কথা বলার পরে। সেকেন্দার যুবক চন্দ্রগুপ্তের কাছে জানতে চায় সে তালপাতায় কি লিখছিল – সে যেন সত্য কথা বলে। চন্দ্রগুপ্ত বলে – রাজাধিরাজ! ভারতবাসী মিথ্যা কথা বলতে এখনও শিখে নাই। চন্দ্রগুপ্তের এমন উক্তিতে তার প্রতি সেকেন্দার সাহা-র আকর্ষণ বা অনুরাগ সৃষ্টি হয়। তারপরে চন্দ্রগুপ্ত জানায় সে কি লিখছিল এবং এও বলে সেলুকাসর কাছেই সে গ্রিক সমরবিদ্যা শিখছিল। চন্দ্রগুপ্তের এই সত্যবাদিতা তাকে মুগ্ধ করেছিল। সেকেন্দার প্রশ্ন করে কী অভিপ্রায়ে সে এসব শিখছিল। চন্দ্রগুপ্ত জানায়, সেকেন্দার সাহার সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্য নহে। সে আরও বলে যে হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করাই তার উদ্দেশ্য। চন্দ্রগুপ্তের এই বক্তব্যে গ্রিক অধিপতি অনুভব করেন যে, চন্দ্রগুপ্ত সত্যিই একজন বীর যুবক। নাট্যাংশের শেষদিকে সেকেন্দার চন্দ্রগুপ্তের উদ্দেশে বলেন –
তোমায় যদি বন্দি করি?
চন্দ্রগুপ্ত – কী অপরাধে সম্রাট?
সেকেন্দার – আমার শিবিরে তুমি শত্রুর গুপ্তচর হয়ে প্রবেশ করেছ, এই অপরাধে। সেকেন্দার সাহা-র এমন কথার উত্তরে চন্দ্রগুপ্ত তাকে কটূক্তি করে বলে – সেকেন্দার সাহা এত কাপুরুষ তা ভাবি নাই। সেলুকস তখন তাকে বন্দি করার হুকুম দিলে চন্দ্রগুপ্ত জানায় – সম্রাট আমায় বধ না করে বন্দি করতে পারবেন না। চন্দ্রগুপ্তের এমন সাহসী আচরণে মুগ্ধ সেকেন্দার সাহা বলেন – তুমি দুর্জয় দিগবিজয়ী হবে। যাও বীর! মুক্ত তুমি।
দুজনের সংলাপের আলোকে এ কথা বলা যায় যে চন্দ্রগুপ্ত সম্পর্কে দারুণভাবে আশাবাদী ছিলেন সেকেন্দার। তিনি চন্দ্রগুপ্তের বীর্যবত্তা, সাহসিকতায় মুগ্ধ এবং চন্দ্রগুপ্তের উজ্জ্বল ভবিতব্য সম্পর্কে তিনি নিঃসন্দিগ্ধ ছিলেন।
চন্দ্রগুপ্ত নাট্যাংশ অবলম্বনে চন্দ্রগুপ্ত চরিত্রের পরিচয় দাও।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটক ‘চন্দ্রগুপ্ত’-এর নামচরিত্র হল চন্দ্রগুপ্ত। চন্দ্রগুপ্ত মগধের রাজপুত্র। সে নন্দবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপদ্মনন্দের পুত্র এবং ধননন্দের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা। মহাপদ্মের মৃত্যুর পর ধননন্দ মগধের সিংহাসন অধিকার করেন এবং চন্দ্রগুপ্তকে নির্বাসিত করেন। নিজের রাজ্য পুনরুদ্ধারের ব্রত নিয়ে তিনি গ্রিক শিবিরে প্রবেশ করে সেলুকসের কাছে রণবিদ্যা শিক্ষা করছিলেন।
চন্দ্রগুপ্ত সাহসী ও বীর নায়ক। তাই সেকেন্দার তাকে বন্দি করার নির্দেশ দিলেও সে বলে যে তাকে বিনা যুদ্ধে অর্থাৎ হত্যা না করে বন্দি করা যাবে না। আবার প্রবল শক্তিশালী সেকেন্দার সাহাকে ব্যঙ্গ করে বলেন যে, একজন নিরাশ্রয় ভারতীয়কে তিনি এত ভয় পান। তিনি তো কাপুরুষ। চন্দ্রগুপ্তের এহেন সাহসিকতা গ্রিক অধিপতিকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি তাকে মুক্তি দিয়েছিলেন।
শিক্ষাগুরুর প্রতি চন্দ্রগুপ্তের শ্রদ্ধা গভীর। তাই আন্টিগোনস সেলুকসকে আক্রমণ করলে, ততোধিক তৎপরতার সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত সেই আক্রমণকে প্রতিহত করে গুরুকে আঘাতের হাত থেকে রক্ষা করেন।
চন্দ্রগুপ্ত বীর যুবক। প্রাচীন ভারতীয় ক্ষত্রিয়। সে মিথ্যা কথা বলে না। তাই বন্দি হয়েও সে সেকেন্দারকে শিবিরে প্রবেশ করার প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা জানিয়েছে। এইভাবে আলোচ্য নাট্যাংশে চন্দ্রগুপ্তের বীর, সাহসী, সত্যবাদী চরিত্রের প্রকাশ ঘটেছে।
সত্য সেলুকস! কী বিচিত্র এই দেশ! – বক্তার চোখে এদেশের বৈচিত্র্য কীভাবে ধরা পড়েছে – পাঠ্য নাট্যাংশ অবলম্বনে লেখো।
সিন্ধুনদতটে অস্তায়মান সূর্য যখন দিগন্তে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমে, তখন সেকেন্দার সাহা কথোপকথনে মগ্ন তারই সেনাপতি সেলুকসের সঙ্গে। তার কণ্ঠেই প্রশ্নোক্ত উক্তিটি বিবৃত হয়েছে। এ দেশে প্রকৃতি এমন, মানুষও তার চোখে বৈচিত্র্য নিয়ে ধরা দিয়েছে।
সেকেন্দার সাহা দেখেছেন – দিনে প্রচণ্ড সূর্যতাপ গাঢ় নীলাকাশকে পুড়িয়ে দিয়ে যায়; আবার রাতে শুভ্র চন্দ্রিমা তাকে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় স্নান করিয়ে দেয়। অন্ধকার রাতে অগণ্য উজ্জ্বল জ্যোতিঃপুঞ্জ আকাশকে ঝলমল করে তোলে। বর্ষায় ঘন কালো মেঘরাশি গম্ভীর গর্জনে আকাশকে ছেয়ে ফেলে। এ দেশের বিশাল নদনদী ফেনিল উদ্দামে প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলে, আবার এ দেশেরই তপ্ত মরুভূমি বালুকারাশি নিয়ে খেলা করে চলে। উত্তরে অভ্রভেদী হিমাদ্রি স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।
কোথাও গর্বভরে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে তালীবন, আবার কোথাও বিরাট স্নেহচ্ছায়া বিস্তার করে ছড়িয়ে আছে বটবৃক্ষ। কোথাও জঙ্গমপর্বতসম চলেছে মত্ত হাতি, আবার কোথাও বনমধ্যে উদাস নয়নে তাকিয়ে আছে মহাশৃঙ্গ হরিণ। সবার উপরে এ দেশ শাসন করছে সৌম্য, দীর্ঘকান্তি মানুষগণ-যাদের মুখে শিশুর সারল্য কিন্তু দেহে বজ্রের শক্তি, চোখে সূর্যের দীপ্তি আর হৃদয়ে বাত্যার সাহস।
এমন ভারতীয় প্রকৃতি ও মানবিক বৈচিত্র্য ধরা পড়েছে সেকেন্দারের চোখে।
চন্দ্রগুপ্ত নাটকটিকে ঐতিহাসিক নাটক বলা যায় কিনা আলোচনা করো।
ঐতিহাসিক নাটকে নাট্যকার নাটকের উপাদান সংগ্রহ করেন ইতিহাস থেকে। তার সঙ্গে নিজের কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি নাটক রচনা করেন। ইতিহাসের স্থান-কাল-পাত্র সেখানে উত্তমরূপে তুলে ধরা হয়। আলোচ্য দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে আমরা দেখি যে, সেকেন্দার সাহা আর সেলুকসের কথোপকথন ঘটেছে সিন্ধুনদতটে সন্ধ্যাকালে। সেকেন্দারের কথায় ভারতের বৈচিত্র্যময় পরিবেশ ও ভারতীয়দের শৌর্য-বীর্যের পরিচয় পাওয়া যায়, যা ইতিহাসের প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরেছে। চন্দ্রগুপ্তের কথায় জানা গেছে সে নন্দবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপদ্মনন্দের পুত্র এবং ধননন্দের বৈমাত্রেয় ভাই, এও জানা যায় যে ধননন্দ তাকে সিংহাসনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, বহিষ্কার করেছে অর্থাৎ নির্বাসিত করেছে। এই কাহিনি তো ইতিহাসকেই মেলে ধরেছে। পুরুর বিক্রম এবং সেকেন্দার সাহা কর্তৃক তাকে ক্ষমা প্রদর্শন অথবা সেলুকস, আন্টিগোনস চরিত্রগুলি তো ইতিহাসের পাতা থেকেই তুলে আনা হয়েছে। আর সিন্ধুনদতটে আবেগপ্রবণ সেকেন্দার, সে তো নাটকের প্রয়োজনে কল্পনার রং বিস্তার, তবে তা নাট্যকাহিনিকে ভারাক্রান্ত করেনি মোটেই। এইসব দিক থেকে আলোচনা করে দেখা যায় যে, ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকটি সার্থক ঐতিহাসিক নাটক।
আজকের এই আর্টিকেলে অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের চতুর্থ অধ্যায় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ সম্পর্কিত রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো অষ্টম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই নিবন্ধটি আপনার জন্য উপকারী হয়েছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে বা আরও সহায়তার প্রয়োজন হয়, দয়া করে টেলিগ্রামে আমার সাথে যোগাযোগ করুন। এছাড়াও, আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্টটি শেয়ার করতে ভুলবেন না, যাতে তারা উপকৃত হতে পারে। ধন্যবাদ!