আজকের এই আর্টিকেলে অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের একাদশ অধ্যায় ‘পথচলতি’ এর রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করা হবে। এই প্রশ্নগুলো অষ্টম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসে।
পাঠ্য গদ্যটির ভাবের সঙ্গে পথচলতি নামটি কতখানি সংগতিপূর্ণ হয়েছে, বিচার করো।
সকলেরই নাম থাকে – সে বস্তুজগৎ, উদ্ভিদজগৎ, প্রাণী জগৎ কিংবা গল্পকাব্যের জগৎ যাই হোক না কেন। গল্পজগতের একটি গল্প ‘পথচলতি’ নামটিকে কতটা সমর্থন করা যায়, সেটাই আমাদের আলোচ্য।
পুরো গল্পটাই মূলত পথ চলারই কাহিনি। এ পথচলা অবশ্য পথে নেমে হাঁটা নয়; একটি রাতে ট্রেনে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার কাহিনি। লেখক দেহরা-দুন এক্সপ্রেসে আফগানদের সঙ্গে এক কামরায় উঠলেন এবং কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে একেবারে মিশে গেলেন। প্রায় ষোলোজন পাঠান মর্দের সাথে ঘাম এবং হিং – এর উগ্র গন্ধকে উপেক্ষা করে রাতের আসর জমিয়ে দিলেন।
আফগান আগা সাহেবের সঙ্গে ভাববিনিময়, সাহিত্য সভার একটা জব্বর পরিবেশ সৃষ্টি করা, রাতে সুখনিদ্রায় যাওয়া, ভোরে পাঠানদের রোটা-কাবাব খাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করা, আগা সাহেবের সৌজন্য ও শিষ্টাচারে অভিভূত হয়ে লেখক শেষপর্যন্ত চলে এলেন গন্তব্যে।
সারাটা পথ ওই কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে, ওদের শরীর থেকে আসা উৎকট গন্ধকে অতিক্রম করে, ওদের অ-হিন্দুস্থানি খাবারের প্রতি একটু শুচিবায়ুগ্রস্ততা না দেখিয়ে লেখক যেন কতকগুলো দুরন্ত এবং দামাল ভিনদেশিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সারাটা পথ এক অপূর্ব আবেশে চলতে চলতে এলেন। সে চলায় আবেগের আতিশয্য ছিল কিন্তু বিরোধ ছিল না, আলোচনা ছিল কিন্তু সমালোচনা ছিল না, বর্তমান ছিল কিন্তু ভবিষ্যৎ ছিল না।
ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির যথেষ্ট পার্থক্য সত্ত্বেও একটি রেল কামরার ছোট্ট গণ্ডির ভিতর কয়েকজন ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে লেখকের যে ভাববিনিময়-তার মধ্যে এক উন্নত এবং উদার মানসিকতা-তাদের সকলকে ভুলিয়ে দিয়েছে তাদের পরিচয়, গঠন করেছে বন্ধুত্বের অঙ্গীকার। এ পথ চলায় শুধুই এক অনাবিল আনন্দের রেশ নিয়ে লেখক ফিরলেন। তাই পথ চলতে চলতেই যেহেতু লেখকের একটি রাতের কাহিনি এখানে বর্ণিত হয়েছে, তাই গল্পটির ‘পথচলতি’ নামটি সংগত কারণেই সার্থক।
পাঠ্য গদ্যাংশটি থেকে কথকের চরিত্রের কোন্ বৈশিষ্ট্যগুলি তোমার চোখে ধরা পড়েছে বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে লেখো।
লেখক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পাঠ্য গদ্যাংশ ‘পথচলতি’ থেকে কথকের চরিত্রের কতকগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্য আমাদের চোখে পড়ে। গল্পটিতে আগাগোড়াই একটি রাতে ট্রেনের পথে চলতে গিয়েই বিভিন্নজনের সঙ্গে কথকের যে ভাববিনিময় তার মধ্য থেকেই কথকের চরিত্রটি স্পষ্ট এবং জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রথমত, কথকের সাহস এবং উপস্থিত বুদ্ধির তুলনা নেই। আফগান শিক্ষিতদের ভাষা ফারসি কথক একটু-আধটু জানতেন, আর এও জানতেন আফগান পাঠানদের আপাতকঠোর দাপটের আড়ালে একটি শিশুসুলভ মনও রয়েছে। তাই যে কামরায় পাঠানদের দাপটে কেউ ভিতরে ঢোকা তো দূরের কথা, তার কাছেই ঘেঁষতে সাহস পাচ্ছে না, সেখানে কথক দু-চারটি ফারসি কথা সম্বল করে দরজা খুলে এগিয়ে গেলেন এবং বাধাপ্রাপ্ত হলেও ওই ফারসির জোরেই কিন্তু সম্মানের সঙ্গে সেখানে জায়গা করে নিলেন। অবশ্য কথকের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাঁর ব্যক্তিত্ব। তাই ওরা রীতিমতো সমীহ করতে লাগল – ‘যেন এক মস্ত আলেম এসেছে’।
সকলের সঙ্গে চলতে গেলে যে নিজের সুখস্বাচ্ছন্দ্য কিছুটা বিসর্জন দিয়ে কতকটা মানিয়ে নিয়েই চলতে হয়, কথক সেটা জানেন। তাই পাঠানদের গায়ের ঘামের এবং হিং – এর উগ্র গন্ধ তার নাককে পীড়া দিলেও কিংবা ওদের গাওয়া গজলের আতিশয্য তার কানকে এবং সক্কালবেলা ‘রোটা কাবাব’ তার চোখকে পীড়িত করলেও, তিনি কিন্তু তা হাসিমুখেই মেনে নিয়েছিলেন।
কথক ছিলেন ভীষণ আলাপী। সেখানে তার কোনো বাছবিচার নেই। বৃদ্ধ আগা সাহেবের সঙ্গে তিনি অনায়াসে গল্প জুড়ে দেন এবং সকলের সঙ্গে এতটাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যান যে, ওরাও সাময়িকভাবে কথককে ‘কাবুলি ব্যাংক’ – এর হিসাবনবিশ কেরানি বা ম্যানেজারের মর্যাদাও দিয়ে ফেলে।
সংগীতের খবরাখবর লেখক বেশ ভালোই রাখেন। তারই অনুরোধে কেউ খুশ-হাল খাঁ খট্টকের গজল গাইল, কেউ কিসসা শোনাল কথককে।
কয়েক ঘণ্টার আলাপে ওরাও লেখককে এতটাই বুঝে নিয়েছিলেন যে কথক যে ‘ভারি বিদ্বান আর বুদ্ধিমান’ এটা তারা বলাবলি করতে লাগল। শুধু ফারসি নয়, ওদের দেহাতি ভাষা পশতু-ও যে কথক ভালোই বোঝেন- এটাতেও লেখকের প্রতি ওদের শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গিয়েছিল। কথকও সকলকে আপন করে একটি রাতকে একেবারে মাতিয়ে রেখে যাত্রাপথটি সুন্দর এবং আন্তরিক করে তুলেছিলেন। এজন্য অবশ্য কথকের চরিত্রের বুদ্ধিমত্তা এবং বিচক্ষণতাও কাজ করেছিল অনেকাংশেই।
কথকের সঙ্গে কাবুলিওয়ালাদের প্রারম্ভিক কথোপকথনটি সংক্ষেপে বিবৃত করো।
পথচলতি গল্পের কথক দেহরা-দুন এক্সপ্রেস ধরার জন্য স্টেশনে এসে প্রচণ্ড ভিড়ে কোনো কামরাতেই সুবিধা করতে না পেরে শেষে তৃতীয় শ্রেণির একটি বগি ফাঁকা দেখে সেখানে গিয়েও প্রথমে নিরাশ হলেন। কতকগুলো কাবুলিওয়ালা ওই কামরা প্রায় দখল করে তাদের জবরদস্ত চেহারা এবং হুংকারে সকলকে ঠেকিয়ে রেখেছে।
কথক কিছু ফারসি কথা জানায় অসীম সাহসে ভর করে বগির ভিতরে ঢুকতে গিয়ে ওদের হুংকারের মুখে পড়লেন। ওরা পশতু ভাষায় বলল যে কথক কোথা থেকে এসেছে? কিন্তু এ কামরা শুধু পাঠানদেরই জন্য, অন্যদের নয়। কথক সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধি করে ওদের উচ্চ ও ভদ্রসমাজের ভাষা ফারসিতে বললেন, (যার বাংলা অর্থ) আমাকে জায়গা দাও, খালি একজন মানুষের জন্য। সত্যিই ওরা প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল, কিন্তু একজন অবুঝ পাঠান যখন বলল – ক্যা মাঙ্গতা? তখন লেখক ফারসিতেই বললেন – ফারসি জানো না? ফারসি বলতে পারো না? ওরা ফারসি কিছুই বুঝতে পারছে না দেখে কথক ইচ্ছা করেই নিজের গলাটা চড়িয়ে উপহাস এবং তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই বললেন ফারসিতে আফগানিস্তানের কোনো অঞ্চল থেকে তারা আসছে, যে ফারসিতে একটু কথা বলার ক্ষমতা পর্যন্ত তাদের নেই?
সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে দেখে তাদের মধ্যে একজন পাঠান ছোকরা বেরিয়ে এসে ফারসিতেই বলল যে, সে ফারসি জানে। কথক কী চায়? কথক বললেন, আমি তো বললুম, আমাকে জায়গা দাও। সে ফারসিতে বলল, কোথায় যাবে? কথক জবাব দিলেন ফারসিতেই কলকাতা শহরে যাব।
ইশারায় দলের অনুমতি পেয়ে সেই ছোকরাটি শেষপর্যন্ত বলল ফারসিতেই ‘ব্যালে, অ্যান্দর বি-অও’ – অর্থাৎ আচ্ছা, ভিতরে এসো। কথক কামরার ভিতর ঢুকে গেলেন।
কথক কেন বলেছেন যেন এক পশতু-সাহিত্য-গোষ্ঠী বা সম্মেলন লাগিয়ে দিলুম। – সেই সাহিত্য সম্মেলনের বর্ণনা দাও।
পথচলতি গল্পের কথক নিজের বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব এবং ভাষার জোরে দেহরা-দুন এক্সপ্রেসে পাঠানদের সঙ্গে জায়গা করে নিয়ে সকলের সাথে ভাববিনিময় করতে লাগলেন। হঠাৎই তিনি পাঠানদের উদ্দেশ্য করে বললেন, পশতু ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি খুশ-হাল খাঁ খট্টকের বিখ্যাত গজল তারা কেউ জানে কি না। একজন পাঠান যারপরনাই খুশি হলেন যে, পশতু ভাষার কবির সম্বন্ধেও কথকের ধারণা আছে। সে আরও উৎসাহিত হয়ে সেই বিখ্যাত কবির গজল নানান অঙ্গভঙ্গি সহকারে গাইতে লাগলেন। কথকের কানে তা অত্যন্ত কর্কশ লাগলেও অতি সহজসরল নির্বিকারচিত্তে তাকে বাহবা দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে গেলেন। এবার গজল নয়, আদম খান আর দুরখানির কিসসার কথা পাড়তেই আবার এক পাঠান উৎসাহিত হয়ে আরও কর্কশ ‘অথচ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে সেই দিল-ভাঙা কিসসা গান করে, পাঠ করে সকলকে মাতিয়ে রাখল।
গাড়ির সকলে ভুলে গেল কার কোন্ জাত, কার কী ভাষা কিংবা আচার-ব্যবহার, গোত্র। সকলে একান্ত হয়ে এতটাই গান-বাজনা, কথাবার্তা আনন্দ-হুল্লোড়ে মেতে উঠলেন যে কথকও সানন্দে লিখলেন – এইভাবে আমরা দেহরা-দুন এক্সপ্রেসের সেই থার্ড ক্লাস গাড়িখানিতে যেন এক পশতু-সাহিত্য-গোষ্ঠী বা সম্মেলন লাগিয়ে দিলুম।
পথচলতি রচনায় ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও যে সহজ বন্ধুত্ব ও উদার সমানুভূতির ছবিটি পাওয়া যায় তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করো। বর্তমান সময়ে এই বন্ধুত্ব ও সমানুভূতির প্রাসঙ্গিকতা বুঝিয়ে দাও।
ভাষা এবং সংস্কৃতির বিভিন্নতা ছিল ‘পথচলতি’ গল্পের কথকের সাথে আফগানদের। পাঠানরা পশতু ভাষায় কথা বলে, যেটা কথকের কাছে সম্পূর্ণ স্পষ্ট ছিল না। পোশাকে-আশাকে ওরা অপরিচ্ছন্ন, ঘামের এবং হিং-এর উগ্র গন্ধে ভরপুর ছিল বগিটি। ওদের খাবারদাবার, চালচলন সবই উগ্র, যা লেখককে খানিকটা আহত করলেও ব্যাহত করতে পারেনি তাঁর যাত্রাপথের সঙ্গসুখ এবং সমানভূতির সৌভাগ্যকে।
ওদের গজল গান এবং কিসসা কোন্ কবির কোন্ লেখকের বিখ্যাত – তা কথক জানতেন। তিনি কিন্তু নিজেদের বাঙালি সংস্কৃতিকে ওখানে তুলে ধরার চেষ্টাও করেননি। তিনি ওদের সংস্কৃতি দিয়েই ওদেরকে মশগুল রেখেছেন সারা পথ। ওরাও উৎসাহিত হয়েছে এদের সম্বন্ধে কথকের এত আগ্রহ দেখে। কথক একবারও বলেননি যে তিনি একজন বড়ো লেখক কিংবা গণ্যমান্য ব্যক্তি। তার আচার-ব্যবহার, ব্যক্তিত্ব এবং ওদের সঙ্গে সেবার দক্ষতাতেই সকলে বুঝে নিয়েছে যে উনি ‘ভারি বিদ্বান আর বুদ্ধিমান’। সত্যিই তিনি বৃদ্ধ আগা সাহেবের সঙ্গে একটু কথা বলেই বুঝে নিলেন যে, বাংলাদেশে তার শীতবস্ত্রের আর হিংয়ের ব্যাবসা এবং বরিশালের ভাষাটি তিনি তার মাতৃভাষার মতোই বলতে পারেন।
পাঠানরা এতটাই প্রীত ছিলেন যে, তারা লেখককে কোনো সংকোচ না করে ‘সগৌরবে’ তাদের একজন হয়ে চলতে বললেন। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে তারা বলবে যে কথক তাদের হিসাবরক্ষক, একটু সময়ের মধ্যে এতটা সম্মান বোধহয় এক বিরল দৃষ্টান্ত।
পরদিন ভোরবেলা ওদের ‘রোটা’ আর ‘কাবাব’ খেতে দেখে যে – কোনো ছুৎমার্গ বাঙালিই নাক সিটকাতে পারতেন। কিন্তু কথক সেটা খুব সাধারণভাবেই নিয়েছেন; বিরক্তি তো দূরের কথা, একটু অস্বস্তিবোধও করেননি। তা ছাড়া গাড়িতে একটা রাত থেকে গাড়ির ভিতরের উগ্র গন্ধে তার নাকটা ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
এইভাবে ভাষা ও সংস্কৃতির পার্থক্য সত্ত্বেও সকলে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে এক অভিন্ন গোষ্ঠীতে পরিণত হল।
বর্তমান সময়ে, এটি যে একেবারে বিরল দৃষ্টান্ত তা নয়, কেউ কেউ এটিকে অন্যভাবে নিতেও পারে, কিন্তু মনের উদারতা এবং সহজ সারল্য থাকলে বর্তমান সময়েও এই বন্ধুত্ব এবং সমানুভূতির প্রকাশ দেখতে পাওয়া যেতে পারে।
রেলভ্রমণের সময় অচেনা মানুষের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি রম্যরচনা লেখো। তোমার লেখাটির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ছবি আঁকো।
চমক
একবার জব্বলপুর থেকে ট্রেনে করে পিপারিয়া যাচ্ছিলাম বাবা-মায়ের সঙ্গে। গাড়িতে ছিল সেদিন প্রচণ্ড ভিড়। মধ্যপ্রদেশের সমস্ত দেহাতি লোকজন গাড়ির ভিতর একেবারে থিকথিক করছিল। যেমন বিচ্ছিরি ওদের চালচলন, তেমনি বিদঘুটে ওদের ভাষা। ওই কামরায় আরও চারজন সম্ভবত কোনো কলেজের ছাত্রীও ছিল। আমরা সকলে একসঙ্গে বসেই যাচ্ছিলাম।
দিদিগুলো এত মজা করছিল, আর হেসে হেসে লুটিয়ে পড়ছিল এ ওর ঘাড়ে, যে কী আর বলব! ওদের মজার মজার কথা শুনে এক এক সময় আমারই হাসি পেয়ে যাচ্ছিল। আমার দিকে দৃষ্টি পড়তেই ওরা আমার নাম-ধাম-স্কুল সব কিছুরই খবর নিল, আদর করে আমায় লজেন্স খেতে দিল।
প্রথমটা বুঝতে পারিনি। হঠাৎ নজরে পড়ল, ওরা ট্রেনের ভিতর কোনো বিশেষ একজনকে নিয়ে যেন হাসাহাসি করছে। তাকিয়ে দেখি সিটের এক কোণে বসে রয়েছে ওই দিদিদের বয়সিই একটি ছেলে। ছেলেটির পোশাক-আশাক, চেহারা, চুল এমনকি ওর ওই রঙচঙে জুতোটা নিয়েও ওরা মজা করতে লাগল। শুধু তাই নয়, ছেলেটিকে ‘বুনো-উদ্ভট হুতুমপ্যাঁচা’, ‘গাঁইয়া ভূত’ – ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করতে লাগল। ছেলেটি গোবেচারার মতো তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে।
দিদিগুলোর নামও ততক্ষণে জেনে গেছি – রিনিদি, উমাদি, বর্ণালিদি আর সোমাদি।
আমি একবার ছেলেটিকে দেখছি, একবার দিদিগুলোর কাণ্ডকারখানা দেখছি আর ভাবছি, ছেলেটি যদি বাংলা কথা বুঝত, তবে কী হত? আর নিজের মনেই ভাবলাম, তাহলে কী আর দিদিগুলো ওর সামনে অমন মজা করে কথা বলতো? কী বোকা রে আমি। ওতো বাঙালি না!
ছেলেটারই উলটোদিকে বসে ছিল রিনিদি। হঠাৎই রিনিদি ছেলেটিকে উদ্দেশ করে হিন্দিতে বলে উঠল – ‘পিপারিয়া স্টেশন হিঁয়াসে কিনা দূর হ্যায়?’ ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল নির্বিকারচিত্তে – ‘এই পরের স্টেশন – তার পরের স্টেশন।’ আমি চমকে উঠলাম। আর দিদিগুলো মুহূর্তের মধ্যে চুপসে গেল। হাসি তো দূরের কথা, সারাটা পথে ওরা আর-একটাও কথা বলেনি।
পথচলতি গল্পের অনুসরণে আফগানিস্তানের কাবুলিওয়ালা পাঠানদের চরিত্রচিত্রণ করো।
আফগানিস্তানের পাঠানরা এক ঐক্যবদ্ধ জাতি। গায়ের জোরে কথকের সাথে প্রথমে হম্বিতম্বি করলেও, পশতুভাষী পাঠানরা একজন বাঙালিবাবুর মুখে ওদের শিক্ষিত সমাজের ভাষা ফারসি শুনে কথককে যথেষ্ট মর্যাদা সহকারে শুধু ভিতরেই ঢুকতে দেয়নি, একটা পুরো বেঞ্চি খালি করে কথককে ছেড়ে দিয়েছে। নিজেরা ফারসি না জানলেও, ওদের দেশের ভাষাকে যে ওরা কতটা সম্মান করে এবং এক্ষেত্রে যে তাদের কোনো জাতপাতের বালাই নেই-তা সহজেই বোঝা গেল।
ওদের মধ্যে উগ্রভাব যে একটু বেশিই আছে তা ওদের দেহের ঘাম এবং হিং – এর উগ্র গন্ধ থেকেই বোঝা যায়। তবে উগ্র হলেও আলাপী অবশ্যই। বৃদ্ধ আগা সাহেব উপরে টঙের উপর বসেও কথকের সাথে দিব্যি গল্প জুড়ে দিয়েছিল।
ওদের মধ্যে একটি শিশুসুলভ মন রয়েছে। কথকের অনুরোধে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কর্কশকণ্ঠেই পশতু গজল গাইল এক পাঠান। আর – এক পাঠান গান এবং পাঠের মাধ্যমে দুরখানির মহব্বতের কিসসা শোনাল তা সে হোক না শ্রুতিকটু – তাতে ওদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
ওরা অন্যের প্রশংসা করতে জানে রীতিমতো। মাত্র কিছুক্ষণের জন্য কথককে দেখে ওঁরা বুঝেছিল যে তিনি ‘বিদ্বান আর বুদ্ধিমান’।
পাঠানরা যে কতটা নিয়মনিষ্ঠ এবং সাত্ত্বিক তা ট্রেনের মধ্যে থেকেও তাদের নমাজ পড়া এবং সারাদিন উপোসের জন্য ভোরেই ‘রোটা’ ও ‘কাবাব’ খেয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়েই বোঝা যায়। তা ছাড়া বৃদ্ধ আগা সাহেবের মালাজপের মধ্যেও ঈশ্বরচেতনার পরিচয় মেলে। শুধু তাই নয় অত্যন্ত ভদ্রতাপ্রণোদিতভাবে গতকাল রাতে কথকের ঠিকমতো ঘুম হয়েছিল কি না – এই প্রশ্নের মধ্য দিয়ে ওই বৃদ্ধ যেন মুহূর্তমধ্যে গোটা পাঠান কাবুলিওয়ালার জাতকেই অনেক উঁচুতে তুলে দিলেন। সামান্য ট্রেনের মধ্যেই এতটা ভদ্রতা-না জানি বাড়িতে গেলে ওরা কী করবে। সেইজন্যই বোধহয় কথকেরও ওদের সান্নিধ্য এতটাই ভালো লেগেছিল যে, তিনি গল্পটির শেষে বলেছেন যে ওদের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা না হলেও ওই বিশেষ রাতটির কথা তার খুব ভালোভাবেই মনে থাকবে।
প্রসঙ্গ উল্লেখ করে টীকা লেখো – কাবুলিওয়ালা, পশতু, ফারসি, আফগানিস্তান, বরিশাল, গজল, উর্দু, নমাজ।
কাবুলিওয়ালা – কথক ট্রেনের কোথাও জায়গা না পেয়ে তৃতীয় শ্রেণির বগিটি ফাঁকা দেখে সেখানে গিয়ে দেখেন সে-বগিটি কয়েকজন কাবুলিওয়ালার দখলে। এই প্রসঙ্গে ‘কাবুলি’ কথাটা এসেছে।
কাবুলদেশীয় লোক বা কাবুলের লোক হল কাবুলি। ‘কাবুলি’ থেকেই এসেছে ‘কাবুলিওয়ালা’।
পশতু – কাবুলিওয়ালা পাঠানদের মাতৃভাষার তখন যে কোনো সম্মান ছিল না সেই প্রসঙ্গে ‘পশতু’ কথাটি এসেছে।
আফগানিস্তানে পশতুনিরা পশতু ভাষায় কথা বলে। এটাই তাদের প্রথম ভাষা (First Language)। এরা আফগানিস্তানে ও পাকিস্তানে বাস করে। কান্দাহারের দুরানিরাও পশতু ভাষায় কথা বলে। এরা সুন্নি মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত।
ফারসি – ট্রেনযাত্রাকালে লেখক আফগানিস্তানের ভাষার আভিজাত্য প্রসঙ্গে ফারসি ভাষার উল্লেখ করেছেন।
ফারসি ভাষাকে পারসিক ভাষাও বলা হয়ে থাকে। এটি পারস্যের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর ভাষা থেকে উদ্ভূত। ফারসি হল মধ্য এশিয়ায় প্রচলিত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ইরানীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত একটি ভাষা।
আফগানিস্তান – ‘আফগানিস্তান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ফারসি ভাষা প্রসঙ্গে।
দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার একটি রাষ্ট্র হল আফগানিস্তান। শব্দটির অর্থ আফগান জাতির দেশ। দেশটির বৃহত্তম শহর ও রাজধানী হল কাবুল। আফগানিস্তানে বসবাসরত সবচেয়ে বড়ো জনগোষ্ঠী হল পশতু জাতি। তবে বর্তমানে আফগান বলতে শুধু পশতু নয়, জাতিনির্বিশেষে রাষ্ট্রটির সব নাগরিককেই বোঝায়। এর অধিকাংশ অঞ্চল সুউচ্চ পর্বতময় এলাকা।
বরিশাল – পাঠান বৃদ্ধ আগা সাহেবের ডেরা বাংলাদেশের পটুয়াখালি প্রসঙ্গে বরিশালের কথা স্বাভাবিকভাবেই এসেছে।
বরিশাল জেলাটি ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়। কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত শহরটির পুরোনো নাম চন্দ্রদ্বীপ। বরিশাল দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নদীবন্দর। একে ‘বাংলার ভেনিস’ বলা হয়। আগে এখানে বড়ো বড়ো শাল গাছ জন্মাত। বড়ো + শাল = বরিশাল। এভাবেই উৎপত্তি বরিশালের।
গজল – খুশ-হাল খাঁ খট্টকের গজলের প্রসঙ্গে ‘গজল’ কথাটি এসেছে।
আরব থেকে গজলের উৎপত্তি হলেও ফারসি ভাষাতেই এটি ভীষণভাবে বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীকালে উর্দু ভাষায় এটি জনপ্রিয়তা পায়। আরবি, ফারসি, পশতু, উর্দু ছাড়াও হিন্দি, পাঞ্জাবি, মারাঠি, বাংলা, এমনকি ইংরেজিতেও গজল লেখা হয়।
গজল হালকা মেজাজের লঘু শাস্ত্রীয় সংগীত। আমির খসরু এ গানের স্রষ্টা। আমির খসরু, মির্জা গালিব, গোরখপুরী গজল লেখক হিসেবে নাম করেন। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা গজল রচনার পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।
উর্দু – লেখকের সামনের বেঞ্চে বসা দুই পাঠান সহযাত্রীর লেখকের সম্পর্কে আলোচনায় লেখকের বোধগম্যতা প্রসঙ্গে ‘উর্দু’ কথাটি এসেছে।
পাকিস্তানের প্রায় এক কোটি লোক এবং ভারতের প্রায় পাঁচ কোটি লোকের মাতৃভাষা উর্দু। এ ছাড়া আফগানিস্তান শহরে এবং পারস্যেও এ ভাষা প্রচলিত। ‘উর্দু’ শব্দটি তুর্কি ‘ওর্দু’ শব্দ থেকে এসেছে-যার অর্থ হল শিবির বা ক্যাম্প। ভারতের সর্বত্রই মুসলিমরা উর্দু ভাষা ব্যবহার করে।
নমাজ – ‘পথচলতি’ গল্পের কথক পাঠানদের সঙ্গে ট্রেনে সারা রাত কাটিয়ে ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখেন ওদের মধ্যে কেউ কেউ নমাজ পড়ছে – এই প্রসঙ্গে নমাজের কথাটি এসেছে।
ইসলাম ধর্মের প্রধান উপাসনা কর্ম, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত (নির্দিষ্ট নমাজের নির্দিষ্ট সময়) নমাজ পড়া প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক। ‘নমাজ’ শব্দটি ফারসি ভাষা থেকে উদ্ভূত।
আজকের এই আর্টিকেলে অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের একাদশ অধ্যায় ‘পথচলতি’ – এর রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো অষ্টম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেগুলো পরীক্ষায় প্রায়ই আসে। আশা করি, এই নিবন্ধটি আপনার জন্য সহায়ক হয়েছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে বা অতিরিক্ত সহায়তার প্রয়োজন হয়, দয়া করে টেলিগ্রামে আমার সাথে যোগাযোগ করুন। এছাড়াও, আপনার বন্ধুদের সঙ্গে এই পোস্টটি শেয়ার করতে ভুলবেন না, যাতে তারা উপকৃত হতে পারে। ধন্যবাদ!