এই আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের, ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ -এর বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করবো। এখানে কবির পরিচিতি, কবিতার উৎস, কবিতার পাঠপ্রসঙ্গ, কবিতার সারসংক্ষেপ, কবিতার নামকরণ এবং এর প্রধান বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এই আর্টিকেলটি আপনাদের ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা দেবে এবং কবিতাটি ভালোভাবে বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। এছাড়া, নবম শ্রেণীর পরীক্ষায় এই অধ্যায় থেকে কবি ও কবিতার সারসংক্ষেপ সম্পর্কিত প্রশ্ন আসতে পারে, তাই এই তথ্যগুলো জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যোমযাত্রীর ডায়রি – লেখক পরিচিতি
সত্যজিৎ রায় –
- লেখক বৈশিষ্ট্য –
- প্রাঞ্জল ভাষার ব্যবহার।
- কল্পবিজ্ঞান নির্ভর রচনা।
- কিশোর সাহিত্যের নতুন দিশার সন্ধান।
- প্রথম প্রকাশ – 1961 খ্রিস্টাব্দে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার আশ্বিন-কার্তিক-অগ্রহায়ণ সংখ্যায়।
- উৎস – শঙ্কু সমগ্র।
বিষয়বস্তু –
প্রফেসার শঙ্কুর ডায়ারিটি পাওয়া যায় সুন্দরবনের মাথারিয়া অঞ্চলে পড়া একটি উল্কায় খোদিত গর্তের ঠিক মাঝখানে। ডায়ারিটা পড়ে কথক শঙ্কুর মঙ্গলযাত্রা সম্পর্কে জানতে পারেন। জানতে পারেন না মঙ্গলে প্রফেসার শঙ্কু, প্রহ্লাদ, নিউটন এবং শঙ্কুর যন্ত্রমানব বিধুশেখরের অভিজ্ঞতার কথা। তাদের উপর মঙ্গলবাসীর আক্রমণ এবং সেখান থেকে বেঁচে ফেরা। এরপর মঙ্গল থেকে নতুন একটি গ্রহ ‘টাফা’য় পৌঁছে সেখানে টাফার প্রাণীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং প্রফেসার শঙ্কুর টাফাতেই থেকে যাওয়া। এইসব কিছুরই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আছে ডায়ারিটিতে। কথক প্রথমে ভেবেছিলেন ডায়ারিটি অবিনশ্বর, কিছু পরে দেখা গেল সামান্য ভেঁয়োপিঁপড়ে ডায়ারিটি উদরসাৎ করে ফেলেছে।.
লেখক পরিচিতি –
জন্ম ও পরিচয় –
সাহিত্য ও শিল্পজগতের একজন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায়। একাধারে তিনি একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক। যদিও তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটে ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে, কিন্তু তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন উত্তর কলকাতার 100 নং গড়পাড় রোডে 1921 খ্রিস্টাব্দের 2 মে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পৌত্র এবং সুসাহিত্যিক সুকুমার রায়ের পুত্র সত্যজিতের পূর্বনাম ছিল প্রসাদ। পরে তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সত্যজিৎ।
শিক্ষা ও কর্ম –
1930 খ্রিস্টাব্দে তিনি বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে ভরতি হন এবং সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। একইসঙ্গে তাঁর সংগীত ও চলচ্চিত্রের প্রতিও আগ্রহ ছিল। 1940 খ্রিস্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনে কলাভবনে ভরতি হন এবং সেখানকার পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে কলকাতায় ফিরে এসে ‘ডিকেয় বর্মী’, ‘কালিম্পী’, ‘ফসিং’ ইত্যাদি চিত্রনাট্য লেখেন। 1947 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘Calcutta Film Society’।
কৃতিত্ব –
1961 খ্রিস্টাব্দে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিয়ে যুগ্ম সম্পাদনায় ‘সন্দেশ’ পত্রিকা পুনঃপ্রকাশ করেন। তাঁর রচিত ছোটোগল্পগুলি বিভিন্ন সংকলনে প্রকাশ পেত (‘একের পিঠে দুই’, ‘এক ডজন গপ্পো’, ‘ফটিক চাঁদ’, ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’, ‘পাহাড়ে ফেলুদা’, ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘সেরা সত্যজিৎ’ ইত্যাদি)। তাঁর সম্পাদিত ‘প্রোফেসর শঙ্কু’, ‘ফেলুদা সিরিজ’, ‘তারিনী খুড়োর গল্প’, ‘মোল্লা নাসিরুদ্দীনের গল্প’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য – ‘পথের পাঁচালি’, ‘দেবী’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘গণশত্রু’, ‘শাখা প্রশাখা’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘জন অরণ্য’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ইত্যাদি। তাঁর সৃষ্ট দুটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হল ফেলুদা ও প্রফেসার শঙ্কু। তাঁর রচিত সাহিত্যসম্ভার শুধুমাত্র শিশু সাহিত্য, কিশোর সাহিত্য বা বড়োদের সাহিত্য হিসেবে রচিত নয়; সাহিত্যের সর্বস্তরেই তাঁর বিচরণ। তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবে এবং বিজ্ঞানমনস্কতায় সাহিত্যচর্চা বা সাহিত্য রচনা করেন।
পুরস্কার –
1967 খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘প্রোফেসর শঙ্কু’ গ্রন্থটির জন্য ‘আকাদেমি পুরস্কার’ অর্জন করেন। 1973 খ্রিস্টাব্দে ‘Doctor of Letters’ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত হয়। 1974 খ্রিস্টাব্দে তাঁকে লন্ডনের ‘রয়েল কলেজ অফ আর্টস’ ‘Doctorate’ প্রদান করেন। 1976 খ্রিস্টাব্দে ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মান এবং 1978 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘Doctor of Literature’ (ডিলিট) প্রদান করা হয়। অসুস্থ ও শয্যাশায়ী অবস্থায় তিনি জীবনের শেষ সম্মানসূচক পুরস্কার ‘অস্কার’ গ্রহণ করেন।
জীবনাবসান –
এই মহান ব্যক্তিত্ব ও শিল্পী 1992 খ্রিস্টাব্দের 23 এপ্রিল হৃদযন্ত্রের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।
উৎস –
‘ব্যোমযাত্রীর ডায়ারি’ প্রোফেসর শঙ্কুর ওপর আধারিত প্রথম কল্পবিজ্ঞানমূলক গল্প। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় 1368 বঙ্গাব্দ তথা 1961 খ্রিস্টাব্দে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার আশ্বিন-কার্তিক-অগ্রহায়ণ সংখ্যায়। বলাবাহুল্য এই রচনাটির মাধ্যমে কল্পনালোভী পাঠককুলের সঙ্গে প্রোফেসর শঙ্কু চরিত্রটির প্রথম সাক্ষাৎ হয়। পরবর্তীকালে গল্পটি “শঙ্কু সমগ্র” নামক গ্রন্থে স্থান পায়।
পাঠ্যপ্রসঙ্গ –
লেখক সত্যজিৎ রায় সাহিত্যজগতে প্রবেশ করে যেমন নানা ধরনের সাহিত্যসৃজন করেছেন, তেমনই চরিত্রসৃষ্টিতে হয়ে উঠেছেন অতুলনীয়। কল্পবিজ্ঞানমূলক গল্প রচনার আখর হিসাবে প্রোফেসর শঙ্কুর আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তিনি যে গল্পটির মাধ্যমে, সেটি হল ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়ারি’। গল্পটি 1368 বঙ্গাব্দে (1961 খ্রিস্টাব্দে) ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। 1965 খ্রিস্টাব্দে শঙ্কুকাহিনি প্রথম গ্রন্থবদ্ধ হয়। প্রোফেসর শঙ্কুর পূর্ণনাম হল ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। তিনি অল্প বয়সেই বিজ্ঞানশাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে ওঠেন তাঁর অসামান্য মেধার কারণে। ক্রমে তিনি পরিচিতি লাভ করেন বিজ্ঞানী-অধ্যাপক হিসেবে। নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ কাহিনিগুলি তিনি ডায়ারির আকারে লিখে রাখতেন। তাঁর সব অভিজ্ঞতাই রোমাঞ্চকর, অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ, চমৎকারিত্বে ভরপুর। তবে তাঁর ডায়ারির ভাষা জটিল নয়। সম্পূর্ণ নির্লোভ-নিরহংকার ও একপ্রকার নিরাসক্ত ব্যক্তিত্ব প্রোফেসর শঙ্কু তাঁর ডায়ারির মধ্যে বিশ্বনাগরিক ভাবনার জগৎকে উন্মোচিত করে দেন। এর ফলে পাঠকমণ্ডলী স্বাদ পান এমন এক কল্পবিজ্ঞানজগতের যেখানে অবিশ্বাস্য নানা আবিষ্কারের জড়িয়ে থাকে চমৎকার সব গল্প। এই গল্পরসকে মস্তিষ্ক ও হৃদয় দিয়ে অনুভব করার ক্ষেত্রে শঙ্কু—কাহিনিগুলি সম্ভব কী অসম্ভব, সত্য কী মিথ্যা, এর বিচার অবান্তর বলে মনে হয়।
চরিত্র হিসেবে প্রোফেসর শঙ্কুর চরিত্রের গভীরতা যথেষ্ট। স্বয়ং স্রষ্টাও এই চরিত্রসৃষ্টিতে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। প্রধান চরিত্র ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর পিতা ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কু একজন আয়ুর্বেদ-চিকিৎসক। প্রোফেসর শঙ্কুর জন্ম 16 জুন, উচ্চতা 6 ফুট 7 ইঞ্চি, অবিবাহিত, অত্যন্ত বিজ্ঞানকর্মী। তিনি অধ্যাপনা করেছেন কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজে। গিরিডিতে তাঁর বাসস্থান।
ব্যোমযাত্রীর ডায়ারি-টি পাওয়া যায় সুন্দরবনের মাথারিয়া অঞ্চলে এসে পড়া এক উল্কাপতনের ফলে সৃষ্ট গর্তের ঠিক মাঝখানে, যার রহস্য অনন্ত। এই ডায়ারির কাগজ-কালি সবই রহস্যজনক। এর কাগজ আগুনে পোড়ে না, কুকুরে কামড়ে ছিঁড়তে পারে না, টানলে রবারের মতো স্থিতিস্থাপকতা প্রদর্শন করে। এর কালির রং ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায়। বলাবাহুল্য লেখক চরম এক রহস্যময়তার মধ্যে দিয়ে শঙ্কু চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
বিষয়সংক্ষেপ –
প্রোফেসর শঙ্কুর অসামান্য ডায়ারির মূল প্রাপক তারক চাটুজ্জে। পরে তারকবাবু এই লাল খাতাটি ঘটনাচক্রে লেখককে দেন। তিনি বলেন—সেটি নাকি ‘গোল্ড মাইন’ অর্থাৎ ‘সোনার খনি’। প্রোফেসর শঙ্কু প্রায় পনেরো বছর নিরুদ্দেশ। অনেকে মনে করে তিনি নাকি ভীষণ কোনো এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। কারও কারও মতে তিনি হয়তো গা-ঢাকা দিয়ে কোথাও একান্তে কাজ করে যাচ্ছেন, প্রয়োজনে আত্মপ্রকাশ করবেন। ডায়ারি সম্পর্কে তারকবাবুর ব্যাখ্যা, সুন্দরবনের মাথারিয়া অঞ্চলে যে প্রবল এক উল্কাপাত ঘটে, বাঘের ছাল পাওয়ার আশায় তারকবাবু সেখানে যান। কিন্তু তা না পেয়ে যখন তিনি রীতিমতো হতাশ, তখনই উল্কাপাতে সৃষ্ট গর্তের মধ্যে তিনি ওই লাল রঙের খাতাটি দেখতে পান। খাতাটিতে লেখাটি নাকি খুবই মজাদার। বেশ কিছুদিন সেটি তিনি রেখে দিয়েছিলেন। পুজোর পর খাতাটি আলমারি থেকে বের করে লেখক যখন তাতে চোখ দিলেন, তখন তাঁর বেশ খটকা লাগে। কেন-না যতদূর সম্ভব তাঁর মনে পড়ছিল, প্রথমবার যখন তিনি খাতাটি দেখেছিলেন, তখন তাঁর কালির রং ছিল সবুজ কিন্তু এখন কালির রং দেখা যাচ্ছে লাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই লাল রং হয় নীল, নীল হয় হলুদ। রং বদল চলতেই থাকে। লেখক আশ্চর্য হন। দেখা যায় ডায়ারির কাগজ কুকুরের কামড় থেকেও রক্ষা পায়, এমনকি উনুনের আঁচও তাকে পোড়াতে পারে না। স্বভাবতই লেখক ডায়ারিটার প্রতি একটা অনিবার্য আকর্ষণ অনুভব করেন। সে কারণে তিনি রাত ৩টে পর্যন্ত জেগে ডায়ারিটা পড়ে শেষ করেন। পড়ার পরেই তাঁর মনে হয়-এমন আশ্চর্য লেখা পাঠক সাধারণের হাতে তুলে দেওয়া উচিত।
1. জানুয়ারি –
শঙ্কু প্রাতভ্রমণ থেকে ফিরে আয়নায় নিজ প্রতিবিম্ব দেখে চিৎকার করে চমকে উঠলেন। নিজ প্রতিবিম্বকে তিনি চিনতে পারেন না, ক-বছরে তার চেহারা অনেক বদলেছে। আয়নার ওপর থেকে ক্যালেন্ডার সরিয়ে প্রহ্লাদই এই বিপত্তি ঘটিয়েছে বলে তিনি Snuff-gun বা নস্যাজ্জটা ওর ওপর পরীক্ষা করলেন। যার অর্থ-33 ঘণ্টার আগে ওর হাঁচি আর থামবে না।
2 জানুয়ারি –
মঙ্গলযাত্রার দিন ক্রমে এগিয়ে আসছে। রকেট নিয়ে চিন্তাও কমছে। শঙ্কু মনে জোর ও উৎসাহ পাচ্ছেন। প্রথমবারের প্রচেষ্টাটি প্রহ্লাদের ভুলে পণ্ড হয়ে যায়। ঘড়িতে দম দেওয়ার ভুলে তাঁর রকেট খানিকটা উঠেই গোঁৎ খেয়ে পড়ে যায় এবং পড়শি অবিনাশবাবুর মূলোর খেতের ওপর তা পড়ায় ভদ্রলোক 500 টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। শঙ্কু ভাবেন নতুন কোনো উদ্ভাবনে এঁকেও জব্দ করতে হবে।
5 জানুয়ারি –
প্রহ্লাদ হয়তো বোকা, কিন্তু তার একটা সহজ সাহসী ভাব আছে। তাই তাকে অভিযানে শামিল করার কথা মনে হয় শঙ্কুর। তাঁর মনে পড়ে যায়, নিতান্ত এক টিকটিকি যখন বাইকর্নিক অ্যাসিড ও প্যারাডক্সাইট পাউডারের মধ্যে প্রায় বিক্রিয়া ঘটিয়ে দিচ্ছিল, তখন এই প্রহ্লাদই বিপর্যয়ের হাত থেকে সবকিছু রক্ষা করে। অতএব তাঁর রকেট 20 মন পর্যন্ত জিনিস বইতে সক্ষম হলে 2 মন 7 সের ওজনের প্রহ্লাদকেও রকেটে নেওয়া সম্ভব।
6 জানুয়ারি –
অবিনাশবাবু রসিক, কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর ঠাট্টা শঙ্কুর কাছে অসহ্য। 500 টাকার তাগাদা দেওয়া ছাড়া তিনি যথেচ্ছ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেন। বলেন – “কী মশাই, আপনি তো চাঁদপুর না মঙ্গলপুর কোথায় চললেন।” কিংবা “আপনার ওই হাউইটা এই কালীপুজোর দিনে ছাড়ুন না।” ইত্যাদি। বলাবাহুল্য শঙ্কু অবিনাশবাবুকে খুব খাতিরদারি দেখিয়ে, চায়ে স্যাকারিনের বদলে একটা নতুন স্ব-আবিষ্কৃত বড়ি প্রয়োগ করলেন। যার ফল হল এই-তিনি প্রথমে ঘন ঘন হাই তুলবেন। তারপর গভীর ঘুমে ডুবে যাবেন এবং সেই ঘুমের মধ্যে সব অসম্ভব স্বপ্ন দেখতে থাকবেন। এটা হল অবিনাশবাবুর কৃতকর্মের শাস্তি। নিজের ওপর এই বড়ির 4 ভাগের 1 ভাগ প্রয়োগ করে, স্বপ্ন দেখার গুঁতোয় শঙ্কুর দাড়ির বাঁ দিকটা একেবারে পেকে যায়।
8 জানুয়ারি –
পোষা প্রিয় বিড়াল নিউটনকেও শঙ্কু অভিযানের সঙ্গী করতে চান বলে তার জন্য Fish Pill বানিয়ে তাকে খাওয়ালেন। সে মহাখুশি। তার জন্য পোশাক ও হেলমেট তৈরি করার কথাও ভাবলেন শঙ্কু।
10 জানুয়ারি –
শঙ্কু লক্ষ করলেন, তাঁর স্বহস্তে প্রস্তুত রোবট বিধুশেখরও হাবেভাবে অভিযানে শামিল হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। মহাকাশ অভিযানের রকেটের খোল তৈরির জন্য একটা বিশেষ কমপাউন্ড বানিয়ে তাতে ট্যানট্রাম বোরোপ্যাক্সিনেট, না একুইয়স্ ভেলোসিলিকা মেশাবেন এই নিয়ে শঙ্কু বেশ চিন্তায় ছিলেন। বিধুশেখরের বুদ্ধিমত্তার চমক শঙ্কু লক্ষ করলেন তখনই, যখন ট্যানট্রাম প্রয়োগ করতে যান তিনি। বিধু প্রবলভাবে ঘাড় নেড়ে ‘না’ করে। কিন্তু দেখা গেল ভেলোসিলিকাটা হাতে নিতেই সে ইতিবাচক ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে। পরে ভেলোসিলিকা মিশিয়ে তাঁর কাজ হয়ে গেলেও ট্যানট্রাম দিয়ে পরীক্ষা করে তিনি দেখেন, সবুজ আলো সহযোগে এক বিস্ফোরণ ঘটে।
11 জানুয়ারি –
বিধুশেখরের ব্যবহারে আশ্চর্য হলেন শঙ্কু। তাকে অনেক পরীক্ষার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন তিনি যে তাঁর তৈরি অনেক জিনিসই তাঁর হিসেবের বাইরে গিয়ে বেশি কাজ করে। বিধুর ক্ষেত্রেও হয়তো তেমনই কিছু ঘটছে। আর একটা জিনিস অনুভব করলেন, বাইরের কোনো জগতের প্রতি, মাধ্যাকর্ষণের ঠিক উলটো প্রবাহে যাওয়ার প্রতি তাঁর মধ্যে একটা অন্তরের টান অনুভূত হচ্ছে। এমন অনুভবের পিছনেও একটা ঘটনা যেন অলক্ষে কারা করেছে। বছর ১২ আগে বাগানে আরাম কেদারায় শুয়ে আরাম করছিলেন শঙ্কু। তখন উল্কাপাত চোখে পড়ছিল। উল্কা আকাশে দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়। কিন্তু একটি উল্কা দেখলেন, ক্রমে বড়ো হয়ে নীচে নেমে এসে বাগানের পশ্চিম দিকের গুলঞ্চ গাছটার পাশে প্রকাণ্ড জোনাকির মতো জ্বলতে লাগল। এটা যে স্বপ্ন নয়, তা বুঝলেন, কারণ এরপর থেকেই তাঁর মনে রকেট-ভাবনা কাজ করতে শুরু করে। পরে দেখা যায় স্বাভাবিক ফুলের বদলে বিচিত্র এক রকমের ফুল হচ্ছে ওই গুলঞ্চ গাছটায়।
12 জানুয়ারি –
মঙ্গলযাত্রা এগিয়ে এল। প্রহ্লাদের পোশাক ও হেলমেটের ব্যবস্থা হয়েছে। তার বিচিত্র রকম দেখে প্রহ্লাদ হেসে ফেলতেই দেখা গেল বিধুশেখরও হাসছে। নিউটনকে হেলমেট পরাতে স্বভাববশে সে কাচটা চেটে দিল।
21 জানুয়ারি –
বিনা বাধায় পৃথিবী ত্যাগ করলেন শঙ্কু। সবকিছু মিলে ওজন 15 মন 32 সের 3 ছটাক। পাঁচ বছরের রসদ, Fish PIII বটিকা-ইন্ডিকা ইত্যাদি নেওয়া হয়েছে। একসময় নিউটনও এই ব্যোমযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। বিধুশেখর স্থির নিষ্পলক বসে থাকে। প্রহ্লাদ রামায়ণ পড়ে।
25 জানুয়ারি –
ব্যোমযাত্রার দীর্ঘ সময়ের একঘেয়েমি কাটাতে শঙ্কু বিধুশেখরকে বাংলা শেখাতে শুরু করেন। এ বিষয়ে তার চেষ্টা আছে। তবে তার প্রাথমিক উচ্চারণ শুনে প্রহ্লাদের হাসি সে বরদাস্ত করতে পারে না। শঙ্কু তাকে যদি ‘কেমন লাগছে?’ জিজ্ঞাসা করেন, সে উচ্ছ্বাস সহকারে প্রকাশ করে বলে ‘গাগোঃ’ অর্থাৎ ‘ভালো’। দীর্ঘ মহাকাশযাত্রায় মঙ্গল ক্রমে এগিয়ে আসে। প্রহ্লাদ ‘রামায়ণ’ শেষ করে ‘মহাভারত’ ধরে। বিধুশেখরের মুখে একটা দীর্ঘ উচ্চারণ শুনে শঙ্কু তা বিশ্লেষণ করে দেখলেন, সে বলছে “ঘঙো ঘাংঙ কুঁক ঘঙা আগাঁকেকেই ককুং খণ্ডা”। অর্থাৎ ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’। শঙ্কু বিধুর স্মরণশক্তি দেখে অবাক হলেন। মঙ্গলগ্রহ বুঝি কাছাকাছি এসে পড়েছে। মঙ্গলের প্রাণসত্তা সম্পর্কে শঙ্কু নিঃসন্দেহ ছিলেন, তবে তাদের আকৃতি-প্রকৃতি, আচরণ সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। প্রহ্লাদের ধারণা যেহেতু গ্রহটার নাম ‘মঙ্গল’, তাই সেখানে কোনো ‘অমঙ্গল’ হতে পারে না।
হঠাৎ বিধু একটি কাণ্ড ঘটিয়ে বসল। যন্ত্রপাতির বোর্ডে যে হ্যান্ডেলটা টানলে রকেট উলটো দিকে যায়, সেটা টেনে দিল। শঙ্কু বিস্মিত হয়ে বিধুকে বিকল করে রাখলেন। যাত্রা আবার অব্যাহত রইল। কিন্তু বিধুর এমন আচরণের কারণটা তিনি ধরতে পারলেন না। একসময় সকলে মঙ্গলে নামলেন। লাল রঙের নদী বয়ে যাচ্ছে। জলটা যেন স্বচ্ছ পেয়ারার জেলির মতো। গাছপালা-মাটি-পাথর রবারের মতো নরম-নরম। সেখানে সবকিছুই প্রায় লাল। গাছপালার রং নীল। আকাশের রং সবুজ। আবহাওয়া একটু উয়। মাঝে মাঝে শীতবাতাস বয়ে এসে হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়। নদীর স্বচ্ছ জলটা পরীক্ষা করে দেখা গেল, তা যেন অমৃত। নিউটনও সেটি খেল।
বিধুশেখরের মেজাজ খারাপ। বোতাম টিপে তাকে চালু করে জিজ্ঞাসা করা হল- ‘কী হয়েছে, তুমি নামবে না?’ সে মাথা নেড়ে না বলায় শঙ্কু পুনরায় প্রশ্ন করলেন, ‘কেন, কী হয়েছে?’ উত্তরে বিধু শুধু বলল – ‘বিভং’ অর্থাৎ ‘বিপদ’। শঙ্কু বড়ো চিন্তান্বিত হলেন। অগত্যা বিধুকে রকেটে রেখেই শঙ্কু প্রহ্লাদ, নিউটনকে নিয়ে মঙ্গলে নেমেছিলেন।
ঘণ্টা দুয়েকের বেশি অতিক্রান্ত হয়ে গেল। মঙ্গলের একটা নিজস্ব গন্ধ শঙ্কু টের পেলেন। একটা জবর অভিজ্ঞতা এরপর শঙ্কুর অস্তিত্বকেও যেন নড়িয়ে দিল। প্রথম দিনেই হঠাৎ একটা তীব্র আঁশটে গন্ধ এবং একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলেন শঙ্কু। তারপর একটা বিকট চিৎকারে তাঁর রক্ত জল হবার উপক্রম। দেখলেন, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসা প্রহ্লাদ ডান হাতের মুঠোয় নিউটনকে ধরে এক-এক লাফে বিশ-পঁচিশ হাত অতিক্রম করে রকেটের দিকে ছুটে আসছে। আর তার পিছু নিয়েছে না মানুষ-না জন্তু-না মাছ, অথচ তাদের সবার সঙ্গে মিলযুক্ত, হাত তিনেক লম্বা কোনো একটা জীব। পা আছে, হাতের স্থানে মাছের পাখনা, বিশাল হাঁ-মুখে দাঁত নেই, কপালে প্রকাণ্ড একটা সবুজ চোখ। আর সর্বাঙ্গে মাছের মতো আঁশ। শঙ্কু প্রাণীহত্যা চান না। কিন্তু আত্মরক্ষা বড়ো কথা। প্রহ্লাদ তখন রকেটে। হঠাৎ বিধুশেখর এসে রকেট থেকে নেমে জন্তুটার সামনে রুখে দাঁড়াল। এরপরই ঘটল এক চমকপ্রদ ঘটনা। দমকা হাওয়ার সঙ্গে সেই আঁশটে গন্ধের তীব্রতা অনুভব করেই শঙ্কু ঘুরে দেখলেন আরও কমপক্ষে 200-300 একইরকম জন্তু দুলতে দুলতে রকেটের দিকে এগিয়ে আসছে। এদিকে বিধুশেখর প্রথম আসা জন্তুটাকে লোহার হাতের এক বাড়িতেই ধরাশায়ী করেছে। দূরের জন্তুগুলো কাছে এলে কী ঘটতে পারে অনুমান করে শঙ্কু কোনোমতে বিধুশেখরের বোতাম টিপে তাকে অচল করে দিলেন। কিন্তু অচল বিধুকে রকেটে তোলার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিল। শেষে বিধুকে কোমরের কাছ থেকে কোনোমতে দু-ভাগ করে রকেটে তুললেন শঙ্কু।
রকেট আবার উড়ে চলল। জ্ঞান ফেরার পর শঙ্কু অনুভব করলেন রকেটের নিয়ন্ত্রণ আর তাঁদের হাতে নেই। তাঁরা শুধু উড়ন্ত এক রকেটের যাত্রী মাত্র। একসময় সকলে ধাতস্থ হওয়ার পর বিধুশেখরকে জোড়া দিয়ে সচল করা হল। সে সংক্ষেপে বলল – ‘থ্যাঙ্ক ইউ’। এরপর বিধুশেখরের ভাষা গেল বদলে। সে এখন সাধু ভাষা ব্যবহার করে। রকেট ছুটছে। সময়ের হিসাব নেই। সামান্য কিছু রসদ মাত্র অবশিষ্ট আছে। সবাই মনমরা, কেবল বিধুশেখর আনন্দে আছে। বিড়বিড় করে ‘ঘটোৎকচবধ’ থেকে আবৃত্তি করছে। হঠাৎ বিধুশেখর বেশ জোরের সঙ্গে বলে উঠল – ‘বাহবা, বাহবা, বাহবা’। শঙ্কুর জিজ্ঞাসা – ‘কী হলো বিধুশেখর, এত ফুর্তি কীসের?’ বিধুশেখর সাধু বাংলায় উত্তর দিল – ‘গবাক্ষ উদ্ঘাটন করহ’। শঙ্কু তাই করলেন। চোখে পড়ল গবাক্ষের বাইরে ক্রম-অপস্রিয়মান দৃশ্যাবলি, যা অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য। আকাশময় কেবল বুদ্বুদ, যা ফুটছে আর ফাটছে।
শঙ্কুর এই অভাবিত জগৎ সম্পর্কে প্রায় কোনো ধারণাই নেই বলে, তিনি ওই গবাক্ষ বন্ধই করলেন না। এতেই তাঁর এক ঘাম-ছোটানো অভিজ্ঞতা হল। আকাশজুড়ে এবড়োখেবড়ো পাথরের চাঁই। তাদের গহ্বরগুলি থেকে অগ্ন্যুদ্গার হচ্ছে। আর তাদেরকে বাঁচিয়েই ছুটে চলেছে তাঁর রকেট। কিন্তু প্রতিমুহূর্তেই রকেট কলিশন এড়িয়ে নিজস্ব পথে এগিয়ে চলেছে। শঙ্কু স্বয়ং, প্রহ্লাদ, এমনকি নিউটনের মধ্যে তীব্র ভীতি সঞ্চারিত হলেও বিধুশেখরের কোনো ভূক্ষেপ নেই। তার মুখ থেকে কেবল বারবার ‘টাফা’ শব্দটি শোনা যাচ্ছে। পরে দেখা গেল আকাশের ভয়ংকর রূপ সরে গিয়ে সেখানে আবির্ভূত হয়েছে সাদা একটা জ্যোতিষ্ক, যার নাম টাফা। টাফাই হয়তো আকর্ষণ করছে তাঁর যানকে, ভাবলেন শঙ্কু। এও ভাবলেন, হয়তো তাঁদের অভিযান ব্যর্থ হবে না। বিধুর মাথায় আবার পাগলামি ভর করেছে। কেন-না সে তার কথায় হাজির করেছে এক অন্য তথ্যভাণ্ডার। তার বক্তব্য অনুসারে টাফায় নাকি সৌরজগতের প্রথম সভ্য লোকেরা বাস করে। তাদের সভ্যতাও বহু প্রাচীন। টাফার লোকেরা সবাই বৈজ্ঞানিক বলে তারা বেশ অসুবিধায় আছে। তাদের এখন কম বুদ্ধির লোক প্রয়োজন ইত্যাদি। শঙ্কু বললেন, “তা হলে ওদের প্রহ্লাদকে পেয়ে খুব সুবিধা হবে বলো।” এর উত্তর না দিয়ে, খুব হাততালি দিয়ে বিধুশেখর হাসতে থাকল বলে, শঙ্কু তার বোতাম টিগে তাকে অচল করে দিলেন।
টাফায় নামার পর শঙ্কু দেখলেন তাঁদের অভ্যর্থনা দেওয়ার জন্য যারা হাজির, মানুষের সঙ্গে তাদের মিল কমই। অনেকটা যেন অতিকায় পিঁপড়ের মতো জীবগুলির মাথা আর চোখ বড়ো, কিন্তু সেই অনুপাতে হাত-পা যথেষ্ট সরু। এদের দেখে শঙ্কু বিধুশেখরের পূর্বঘোষণার প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারলেন না। জীবগুলি তাদের আদিম বাড়িঘর, যা মাটির মধ্যে অবস্থিত, সেখানে ঢোকে-বেরোয়-বসবাস করে। কিন্তু শঙ্কুকে তারা যে থাকার ঘর দিয়েছে তা পার্থিবদের মতোই। প্রহ্লাদ-নিউটন একপ্রকার খুশি, কিন্তু বিধুশেখরের খোঁজ নেই। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। একসময় শঙ্কুও টাফার পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। এখানকার জীবকুল যে তাঁকে যথেষ্ট যত্নে রেখেছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কতদিন আর বসে বসে কাল কাটানো যায়। তিনি লক্ষ করেছেন, টাফার অধিবাসীরা বাংলা জানে। তাই তিনি একদিন একটা পিঁপড়ে-সদৃশ জীবকে বললেন – “কই হে, তোমাদের বৈজ্ঞানিক-টৈজ্ঞানিকরা সব কোথায়?” তাদের সঙ্গে একটু আলাপ হোক, এই ছিল তাঁর চাহিদা। জীবটি বলল – “ও সব বিজ্ঞানটিজ্ঞান দিয়ে আর কী হবে? যেমন আছেন থাকুন না। আমরা মাঝে মাঝে আপনার কাছে আসব। আপনার সহজ সরল কথাবার্তা শুনতে আমাদের ভারি ভালো লাগে।” শঙ্কু রেগে ও গেলেন এসব দেখে। নস্যাস্ত্রটা প্রয়োগ করলেন। কিন্তু এরা হাঁচতে পারে না বলে তাতে কোনো কাজ হল না।
শঙ্কুর এই ডায়ারিটা শেষপর্যন্ত পিঁপড়েতে উদরসাৎ করে ফেলেছিল। সুতরাং লেখকের দ্বারা তা জনসমক্ষে প্রদর্শিত করার কোনে উপায়ই ছিল না। তবে এই অবিনশ্বরপ্রায় ডায়ারি; যার কালি-কাগজ এত বৈচিত্র্যময়, যা কুকুরে ছিঁড়তে পারে না, যা আগুনে পোড়ে না, যার কাগজ সম্পূর্ণ স্থিতিস্থাপক, তা সামান্য পিঁপড়ে কী করে ধ্বংস করল-এ লেখকের কাছে এক পরম বিস্ময়।
নামকরণ –
ভূমিকা –
একদা শেকসপিয়র বলেছিলেন, নামে কী এসে যায়, গোলাপকে । যে নামেই ডাকো, সে গোলাপ। কিন্তু এ ভাবনা সর্বৈব সত্য নয়। তাঁর নিজের সাহিত্যেই নামের গুরুত্ব সংবেদনশীল হয়ে প্রকাশিত হতে দেখা যায়। সাহিত্যের নামকরণ তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার দ্বারা সাহিত্য নির্মিতিটির সঙ্গে পাঠককুলের প্রথম ভাবসেতু তৈরি হয়। একসময় ওই ক্ষুদ্র নামকরণই সমগ্র সাহিত্যরূপটির পরিচয় বহন করতে থাকে। তাই কবি-সাহিত্যিকরা তাঁদের সৃজিত সাহিত্যের নামকরণকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন; নামকরণটিকে পূর্ণমাত্রায় সংবেদনশীল করে প্রকাশ করতে তৎপর হন। নামকরণ সাধারণত বিশেষ কয়েকটি দিকের প্রতি দৃষ্টি রেখে করা হয়। কখনো-কখনো বিষয়নির্ভর নামকরণ করতে দেখা যায় সাহিত্যিকদের। আবার কখনও প্রকাশ্য সাহিত্যটির ভাবব্যঞ্জনার প্রতিও গুরুত্ব আরোপিত হতে দেখা যায় নামকরণে। কখনও যেমন কেন্দ্রীয় কোনো চরিত্র বা ঘটনা নামকরণে প্রাধান্য পায়, তেমনই দেখা যায় প্রতীকী কোনো নামকরণও আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু দেখা যায়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই উক্ত সাহিত্যরচনাটির একটা মর্মকথাকে অতিসংক্ষিপ্ত মূর্ছনা দেওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষিত হয় নামকরণে।
লেখকের অভিপ্রায় অনুযায়ী নামকরণ –
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার-কথাসাহিত্যিক সত্যজিৎ রায়ের ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ কল্পবিজ্ঞান কাহিনি। বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে এক কেন্দ্রীয় চরিত্র, যিনি আদপে এক বৈজ্ঞানিক, তাঁকে আধারিত করে গল্পটিকে এখানে বিন্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে দিনলিপির আকারে। দেখা যায় – প্রফেসার শঙ্কু তথা ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু এক ব্যোমযাত্রার পরিকল্পনা করেছেন। ‘ব্যোম’ শব্দটি মহাকাশ বা মহাশূন্যকে নির্দেশ করে, আর এই ব্যোমে যিনি যাত্রা করেন, তিনিই ব্যোমযাত্রী। এই ব্যোমযাত্রীর ডায়রি অর্থাৎ দিনলিপিটিকেই লেখক কাহিনি আকারে পরিবেশন করেছেন বলেই গল্পটির নামকরণ ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’। লেখকের অভিপ্রায়টি এখানে একেবারে স্বচ্ছ। শঙ্কু তাঁর অভিযানের উদ্যোগ করেন। প্রথমবার ব্যর্থ হন। পরে যখন তাঁর অভিযানটি সফল হয় তখন দেখা যায়, শঙ্কুর চেষ্টাকে ব্যঙ্গকারী প্রতিবেশী অবিনাশবাবুর যাবতীয় ব্যঙ্গ প্রচেষ্টায় কালি ঢেলে দিয়ে ব্যোমযাত্রী শঙ্কুর রকেট উড়ে চলে অনির্দেশের উদ্দেশে।
ডায়ারি কথা –
প্রফেসার শঙ্কুর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা ছাড়াও লেখক এখানে যে বিষয়টিকে আলাদা করে গুরুত্ব দিয়েছেন, তা হল – তাঁর ডায়ারিটি কীভাবে লেখকের হাতে এল। একসময় দেখা গেল, যে ডায়ারিটিকে প্রায় অবিনশ্বর বলে মনে হয়েছিল, যা আগুনে পোড়ে না, কুকুরে ছিঁড়তে চাইলে লক্ষিত হয় তার আশ্চর্য স্থিতিস্থাপকতা, তা কিন্তু আদপে যথেষ্ট নশ্বর। আশ্চর্য কাগজ ও অবিরত কালির রং বদলানো এই লাল ডায়ারিখানার শেষ গতি হয় পিঁপড়ের খাদ্য হিসেবে। অবশ্য লেখক তার আগে এর কাহিনিকে জনসমক্ষে প্রচারের ব্যবস্থা করে ফেলেন।
উপসংহার –
অতএব দেখা যাচ্ছে, এক রহস্যময় ব্যোমযাত্রা ও তার যাত্রী এবং তার থেকে আরও রহস্যময় তাঁর ডায়ারিটির প্রসঙ্গ এ গল্পে মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। অতএব উক্ত নামকরণ চরমভাবে সার্থক হয়ে উঠেছে, এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
এই আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের, ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ -এর বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করবো। এখানে কবির পরিচিতি, কবিতার উৎস, কবিতার পাঠপ্রসঙ্গ, কবিতার সারসংক্ষেপ, কবিতার নামকরণ এবং এর প্রধান বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই আর্টিকেলটি আপনাদের ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা দিয়েছে এবং কবিতাটি ভালোভাবে বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। এছাড়া, নবম শ্রেণীর পরীক্ষায় এই অধ্যায় থেকে কবি পরিচিতি, কবিতার নামকরণ ও কবিতার সারসংক্ষেপ সম্পর্কিত প্রশ্ন আসতে পারে, তাই এই তথ্যগুলো জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।





মন্তব্য করুন