এই আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের, ‘কর্ভাস’ -এর বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করবো। এখানে কবির পরিচিতি, কবিতার উৎস, কবিতার পাঠপ্রসঙ্গ, কবিতার সারসংক্ষেপ, কবিতার নামকরণ এবং এর প্রধান বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এই আর্টিকেলটি আপনাদের ‘কর্ভাস’ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা দেবে এবং কবিতাটি ভালোভাবে বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। এছাড়া, নবম শ্রেণীর পরীক্ষায় এই অধ্যায় থেকে কবি ও কবিতার সারসংক্ষেপ সম্পর্কিত প্রশ্ন আসতে পারে, তাই এই তথ্যগুলো জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সত্যজিৎ রায় (1921 খ্রিস্টাব্দ – 1992 খ্রিস্টাব্দ)
লেখক বৈশিষ্ট্য – বাংলা কিশোর সাহিত্যের নতুন দিশারি, কল্পবিজ্ঞান আশ্রিত গল্পরচনা, সহজ সরল ভাষা ব্যবহার এবং যুক্তি পরম্পরায় কাহিনি নির্মাণ।
কর্ভাস –
- প্রকাশকাল – 1379 বঙ্গাব্দের পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা।
- উৎস – শঙ্কু সমগ্র।
- বিষয়বস্তু – প্রফেসার শঙ্কুর পাখি সম্পর্কে কৌতূহল শৈশব থেকেই। দেশের চড়ুই, ঘুঘু ইত্যাদি পাখি কিংবা বিদেশি ম্যালি-ফাউল, গ্রিব প্রভৃতি পাখির অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা তাঁর পাখি বিষয়ে ঔৎসুক্য বাড়িয়ে তোলে। তাই তিনি পাখির মস্তিষ্কে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি সঞ্চারিত করার উদ্দেশ্যে অরনিথন যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রের সাহায্যে কর্ভাস নামে এক কাককে প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনি চিলির রাজধানী সানতিয়াগোতে বিশ্ব পক্ষীবিজ্ঞানীদের সম্মেলনে যোগ দেন। সেখানে কর্ভাসের অসাধারণ ডিমস্ট্রেশনের খবর স্থানীয় দৈনিক পত্রে প্রকাশিত হয়। তখন চিলির বিখ্যাত জাদুকর আর্গাস শঙ্কুর কাছে কর্ভাসকে কিনতে চায়। কিন্তু শঙ্কু রাজি না হলে সে কর্ভাসকে শঙ্কুর অনুপস্থিতিতে হোটেলের ঘর থেকে চুরি করে। অবশেষে দুঃসাহসিক অভিযানের শেষে শঙ্কু কর্ভাসকে উদ্ধার করেন।
লেখক পরিচিতি –
‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ পাঠটির লেখক পরিচিতি দেখে নাও।
উৎস –
1379 বঙ্গাব্দের পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা-তে ‘কর্ভাস’ গল্পটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে গল্পটি ‘সাবাস প্রোফেসর শঙ্কু’ নামক গ্রন্থে স্থান পায়। এই কাহিনিটি ‘শঙ্কু সমগ্র’ গ্রন্থেও স্থান পেয়েছে।
পাঠপ্রসঙ্গ –
বৈজ্ঞানিক-অধ্যাপক প্রফেসার শঙ্কুর আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যে ডিটেকটিভ ও কল্পবিজ্ঞানধর্মী কাহিনিবলয়ে বৌদ্ধিক তরঙ্গ তুলেছিল। বস্তুত সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে সায়েন্স ফিকশান ও গোয়েন্দা কাহিনিধারা দৃঢ় ও কঠিন ভিত্তির উপর স্থাপিত হয়।
বিশ্বের প্রায় 21টি দেশে অভিযান ও ভ্রমণের কাহিনি 40টি ডায়ারিতে লিপিবদ্ধ হয়, তৈরি হয় শঙ্কু সিরিজের বিখ্যাত গল্পমালা। এই সিরিজের উল্লেখযোগ্য বইগুলি হল – ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও হাড়’, ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ম্যাকাও’, ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু’, ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও গোরিলা’, ‘মরুরহস্য’, ‘কর্ভাস’, ‘একশৃঙ্গ অভিযান’, ‘মনরো দ্বীপের রহস্য’, ‘কম্প’, ‘শঙ্কুর কঙ্গো অভিযান’, ‘আশ্চর্য জন্তু’, ‘নেফ্রুদেৎ-এর সমাধি’, ‘শঙ্কুর পরলোকচর্চা’, ‘শঙ্কু ও ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’, ‘ইনটেলেকট্রন’ (অসমাপ্ত), ‘ডেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা’ (অসমাপ্ত) ইত্যাদি।
চির অকৃতদার প্রফেসার শঙ্কুর পূর্ণ নাম ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু, যিনি তিলু নামেই নিকটজনের কাছে পরিচিত ছিলেন। তাঁর পিতা ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কু, পিতামহ বটুকেশ্বর শঙ্কু। বটুকেশ্বর ছিলেন ধানবাদ-গিরিডি অঞ্চলে পরিচিত তান্ত্রিক সাধু। আর পিতা ত্রিপুরেশ্বর ওই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দরিদ্র মানুষগুলোর আয়ুর্বেদ চিকিৎসা করে অসহায় মানুষগুলোর কাছে ‘ধন্বন্তরি’ হয়ে ওঠেন। এরূপ পারিবারিক ঐতিহ্য -এর মধ্যে বড়ো হন বিজ্ঞানী-গবেষক প্রফেসার শঙ্কু। তাঁর সঙ্গী ছিল বিশ্বস্ত যুবক ভৃত্য প্রহ্লাদ আর তার বহুদিনের প্রিয় সাথি বিড়াল নিউটন। পিতার মৃত্যুর পর এদের সঙ্গী করেই শঙ্কু তাঁর বাকি জীবন নিবিড় গবেষণা আর সত্যানুসন্ধানের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন।
সেই মনোজিজ্ঞাসার অসামান্য ফসল হল ‘কর্ভাস’ গল্পটি। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র শঙ্কু পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যায় ডবল সাম্মানিকসহ স্নাতক হয়েছিলেন। তাঁর পাখি বিষয়ে গভীর জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধানের অপূর্ব গবেষণালব্ধ ফল হল ‘কর্ভাস’।
বিষয়সংক্ষেপ –
প্রফেসার শঙ্কু একাই থাকেন বিড়াল নিউটন আর তাঁর ভৃত্য প্রহ্লাদকে সঙ্গে করে। পাখি সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল ছিল বহুকালের। বালক বেলাতেই বাড়ির পোষা ময়নাকে তিনি একশোর বেশি বাংলা শব্দ পরিস্কার উচ্চারণ করতে শিখিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পোষ্য নিউটনের পাখি সম্পর্কে অনীহার কারণে এতদিন পাখিদের বুদ্ধি বিচক্ষণতা সম্পর্কে কিছুটা উদাসীন থাকতে হয়েছিল প্রফেসার শঙ্কুকে। সেই পরিবারের ময়না পোষার সময় থেকেই। দেশের চড়ুই, ঘুঘু, টিয়া, কাক তো ছিলই; বিদেশি পাখি ম্যালি-ফাউল, ম্যাকাও, গ্রিব ইত্যাদি পাখির বিস্ময়কর বুদ্ধি ও সহজাত ক্ষমতা তাঁর ঔৎসুক্যকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। পাখিদের বিচিত্র আচরণে তিনি বিস্মিত হতেন, তাদের বুদ্ধির তীক্ষ্ণতায় হতেন হতবাক। তিনি ঠিক করেছিলেন মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি তাদের মস্তিষ্কে সঞ্চারিত করবেন। তাই তিনি তৈরি করেছিলেন দুই প্রকোষ্ঠের বিশেষ খাঁচা ‘অরনিথন’। গবেষণাগারের জানলায় খাবারের লোভে আসা কাক-চড়ুই-শালিক-পায়রা-ঘুঘু-টিয়া-বুলবুলি ইত্যাদির মধ্যে একটি সাধারণ কাককে শঙ্কুর অন্যরকম মনে হয়েছিল। একদিন গবেষণাগারের জানলা দিয়ে সেই কাক একেবারে সেই খাঁচার ভিতর ঢুকে পড়ে অনেকটা কৌতূহল মেটাতেই। সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে ঘটে যায় লক্ষণীয় পরিবর্তন। শঙ্কু এরপর শুরু করেন প্রশিক্ষণ। কাক তথা কর্ভাস শিখতে থাকে বাংলা, ইংরেজি, সংখ্যা ইত্যাদি। ইতিমধ্যে বিশ্ব-পক্ষীসম্মেলন শুরু হয় দক্ষিণ আমেরিকার চিলির রাজধানী শহর সানতিয়াগোতে। পক্ষীবিজ্ঞানী বন্ধু রিউফাস গ্রেনফেলের সাহায্যে সেখানে শঙ্কু নিয়ে যান প্রশিক্ষিত কর্ভাসকে। সম্মেলনে আগত অতিথিদের সামনে সিনিয়র শঙ্কু বক্তব্য বিষয়ের ডিমনসট্রেশন দেন দীর্ঘ এক ঘণ্টা ধরে। আর সেই বক্তৃতাকালে কর্ভাস পাশের টেবিলে গুরুর দেওয়া শিক্ষা শরীরী বিভঙ্গের মাধ্যমে দেখিয়ে সকলকে স্তম্ভিত করে দেয়। সেই সম্মেলনে হাজির বিশ্বখ্যাত চিলিয়ান জাদুকর আর্গাস প্রলুব্ধ হয় পাখিটির প্রতি। সে পাখিটিকে কিনে নিতে চাইলে শঙ্কু জানান কর্ভাস তার শিষ্য, বন্ধু, সন্তানতুল্য। তাই কিছুতেই তিনি কর্ভাসকে দিতে পারবেন না, শতমূল্যের বিনিময়েও না। অগাধ বিত্তের অধিকারী চতুর ম্যাজিশিয়ান আর্গাস অবশেষে শঙ্কুর হোটেলের কর্মীদের হিপনোটাইজ করে কর্ভাসকে নিয়ে পালিয়ে যায়। সম্মেলনের কর্তাব্যক্তি কোভারুবিয়াসের ব্যবস্থাপনায় বন্ধু গ্রেনফেল আর দুই সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে শঙ্কু আর্গাসের পিছনে ধাওয়া করেন। তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় চরমতম উৎকণ্ঠার মধ্যে আর্গাস অস্ত্র ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আর বিজ্ঞানী-গবেষক প্রফেসার শঙ্কু ফিরে পান তাঁর প্রাণের প্রিয় কর্ভাসকে।
নামকরণ –
ভূমিকা –
সাহিত্যের নামকরণ এক অবশ্যম্ভাবী অঙ্গ, যার মাধ্যমে সাহিত্যিক তাঁর সৃষ্টিকে পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন আর পাঠক এই শিরোনামের মাধ্যমে মূল বিষয়ের একটা আভাস পান। খুব সচেতনভাবে সত্যজিৎ রায় তাঁর গল্পের নামকরণ করেছেন ‘কর্ভাস’। এই নামকরণটি চরিত্রকেন্দ্রিক। ‘কর্ভাস’ হল কাক জাতীয় পাখির লাতিন নাম। বস্তুত কর্ভাস তথা একটি সাধারণ কাককে কেন্দ্র করে এই গল্পে উন্মোচিত হয়েছে প্রফেসার শঙ্কুর পক্ষীবিষয়ক কৌতূহল, তাঁর বিদেশযাত্রার কথা, চতুর জাদুকর আর্গাসের ভয়ংকর লোভ ইত্যাদি বিষয়।
বিষয়বস্তু –
পাখির বিচিত্র আচার-আচরণ বিজ্ঞানী প্রফেসারকে বরাবর বিস্মিত করত। সেই বিস্ময়ের সন্ধানে তিনি নির্মাণ করেন ‘অরনিথন’ যন্ত্রটি, যার দ্বারা পাখির মস্তিষ্কে মানবের বুদ্ধিবৃত্তির সঞ্চার ঘটানো যায়। তাঁর সেই গবেষণাগারে একটা সাধারণ কাক তথা কর্ভাস এসে সেই খাঁচার মধ্যে ঢুকলে তার প্রশিক্ষণ পর্ব শুরু হয়। শঙ্কু তার উপর মানব বুদ্ধিবৃত্তি সঞ্চার করার চেষ্টা করেন। কর্ভাস সহজেই বাংলা, ইংরেজি ভাষা আর ছোটো ছোটো সংখ্যা শিখে নেয়।
কর্ভাসকেন্দ্রিক গল্প –
অধিগত শিক্ষার বিষয়গুলি কর্ভাস নানান অঙ্গভঙ্গি করে জানায়। হাবভাবে সব প্রকাশ করতে পারে। সেই কর্ভাসকে নিয়ে শঙ্কু পাড়ি দেন সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে বিশ্ব পক্ষীসম্মেলনে। তাঁর প্রবন্ধ আর কর্ভাসের বিভঙ্গ সমাগত অতিথিদের মুগ্ধ করে। কর্ভাসে আকৃষ্ট হয়ে বিখ্যাত জাদুকর আর্গাস বহু অর্থের বিনিময়ে সেই কর্ভাসের মালিক হতে চায়। কিন্তু এতকালের এই সম্পর্ক, প্রাণবন্ধু কর্ভাসকে শঙ্কু হারাতে চান না। তখন ধূর্ত লোভী জাদুকর আর্গাস তাকে চুরি করে পালিয়ে যায়। গোয়েন্দাগিরির সফল প্রয়োগে শঙ্কু অবশেষে উদ্ধার করেন কর্ভাসকে। অর্থাৎ সমগ্র গল্পটি কর্ভাসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, আর তার জন্য শঙ্কুর পক্ষীপ্রীতির চমৎকার নিদর্শন প্রতিষ্ঠা পায়। তাই নামকরণে লাতিন এই শব্দের প্রয়োগে গোয়েন্দা গল্পের অনুষঙ্গে হেঁয়ালি তৈরি হয় বলে গল্পের ‘কর্ভাস’ নামকরণ চরিত্রকেন্দ্রিক নামকরণ হিসেবে সার্থক ও সুপ্রযুক্ত হয়েছে।
এই আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের, ‘কর্ভাস’ -এর বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করবো। এখানে কবির পরিচিতি, কবিতার উৎস, কবিতার পাঠপ্রসঙ্গ, কবিতার সারসংক্ষেপ, কবিতার নামকরণ এবং এর প্রধান বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই আর্টিকেলটি আপনাদের ‘কর্ভাস’ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা দিয়েছে এবং কবিতাটি ভালোভাবে বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। এছাড়া, নবম শ্রেণীর পরীক্ষায় এই অধ্যায় থেকে কবি পরিচিতি, কবিতার নামকরণ ও কবিতার সারসংক্ষেপ সম্পর্কিত প্রশ্ন আসতে পারে, তাই এই তথ্যগুলো জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।





মন্তব্য করুন