নব নব সৃষ্টি প্রবন্ধটি সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা একটি প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে তিনি বাংলা ভাষার বিকাশ ও উন্নয়নের কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, বাংলা ভাষা একটি জীবন্ত ভাষা এবং এটি ক্রমাগত পরিবর্তিত ও বিকশিত হচ্ছে। এই পরিবর্তন ও বিকাশের জন্য নতুন নতুন শব্দের প্রয়োজন হয়। তাই তিনি বাংলা ভাষায় নতুন নতুন শব্দ সৃষ্টির পক্ষে মত দিয়েছেন।
সংস্কৃত ভাষা আত্মনির্ভরশীল – কেন সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে এ কথা বলা হয়েছে?
সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে এ কথা বলার কারণ – সৈয়দ মুজতবা আলী সংস্কৃত ভাষাকে আত্মনির্ভরশীল ভাষা বলেছেন। তাঁর মতে, কোনো নতুন চিন্তা, অনুভূতির প্রকাশের জন্য নতুন শব্দের প্রয়োজন হলে সংস্কৃত ভাষা তা অন্য ভাষা থেকে ধার করার কথা কখনোই ভাবে না। পরিবর্তে নিজের শব্দভাণ্ডারে এমন কোনো ধাতু বা শব্দ খোঁজ করে যার সামান্য অদলবদল করে কিংবা পুরোনো ধাতু দিয়েই নতুন শব্দটি তৈরি করা যেতে পারে। এই কারণেই সংস্কৃতকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং আত্মনির্ভরশীল ভাষা বলা হয়েছে।
বিদেশি শব্দ নেওয়া ভালো না মন্দ সে প্রশ্ন অবান্তর – কেন লেখক এ কথা বলেছেন আলোচনা করো।
এ কথা বলার কারণ – বাংলা ভাষা কখনোই আত্মনির্ভরশীল নয়। পাঠান ও মোগল যুগে আইন-আদালত ইত্যাদি প্রসঙ্গে প্রচুর আরবি ও ফারসি শব্দ গ্রহণ করা হয়েছে। পরবর্তী যুগে ইংরেজি ভাষা থেকেও এই শব্দ নেওয়া হয়েছে। তার পরিমাণ এতটাই বেশি যে, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অর্থ হয় না। লেখকের মতে, শিক্ষার মাধ্যমরূপে ইংরেজিকে বর্জন করে বাংলা গ্রহণ করার পরে এই প্রবণতা আরও বাড়বে। ফলে বিদেশি শব্দের আমদানি করার ভাবনা যখন বন্ধ করা যাবে না, সেক্ষেত্রে তার ভালোমন্দ নিয়ে ভাবা নিতান্তই অর্থহীন।
বাংলা সাহিত্যে বিদেশি শব্দ ব্যবহারের যে দৃষ্টান্ত লেখক দিয়েছেন তা নিজের ভাষায় লেখো।
বিদেশি শব্দ ব্যবহারে লেখকের দেওয়া দৃষ্টান্ত – লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা ভাষার বিখ্যাত সাহিত্যিকদের মধ্যে বিদেশি শব্দগ্রহণের ঝোঁক লক্ষ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ আব্রু, ইজ্জৎ, ইমান ইত্যাদি শব্দ অনায়াসে ব্যবহার করেছেন। নজরুল ইসলামও তাঁর সাহিত্যে ইনকিলাব, শহিদ – এর মতো প্রচুর শব্দ ব্যবহার করেছেন। বিদ্যাসাগর তাঁর বেনামিতে লেখা রচনায় প্রচুর আরবি, ফারসির ব্যবহার ঘটিয়েছেন। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আরবি- ফারসির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করাকে আহাম্মুখী বলে মনে করতেন।
আমরা অন্যতম প্রধান খাদ্য থেকে বঞ্চিত হব। — কোন্ প্রসঙ্গে কথাটি বলা হয়েছে আলোচনা করো।
অথবা, স্কুল থেকে সংস্কৃতচর্চা উঠিয়ে না দেওয়ার কারণ প্রসঙ্গে বক্তা কী বলেছেন?
প্রসঙ্গকথা – বাংলা ভাষায় অন্য ভাষার শব্দের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক সংস্কৃত ভাষার প্রভাব বিষয়ে আলোচ্য মন্তব্যটি করেছেন। সংস্কৃত ভাষার চর্চা এদেশে ছিল এবং সে কারণে প্রচুর সংস্কৃত শব্দ বাংলায় ঢুকেছে, যার ধারা এখনও বজায় রয়েছে। স্কুল-কলেজ থেকে সংস্কৃতচর্চা যে সম্পূর্ণ উঠে যায়নি তার কারণ বাংলায় এখনও অনেক সংস্কৃত শব্দের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলা ভাষার খাদ্যের অন্যতম প্রধান উৎসই হল সংস্কৃত।
সুতরাং ইংরেজি চর্চা বন্ধ করার সময় এখনও আসেনি। — কেন লেখক এ কথা বলেছেন আলোচনা করো।
এ কথা বলার কারণ – লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত নব নব সৃষ্টি রচনাংশ থেকে আলোচ্য উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে। লেখকের মতে, ইংরেজি শব্দকে এড়িয়ে সাহিত্য রচনা বাংলা ভাষার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিশেষত দর্শন, নন্দনশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র ইত্যাদিতে প্রয়োজনীয় বাংলা শব্দের অভাব রয়েছে। উদাহরণ দিয়ে লেখক বলেছেন যে রেলের ইঞ্জিন কী করে চালাতে হয় সে সম্বন্ধে বাংলায় কোনো বই নেই। পারিভাষিক শব্দের প্রয়োজনে তাই ইংরেজিরই দ্বারস্থ হতে হবে।
উদুর্তে কবি ইকবালই এ তত্ত্ব সম্যক হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। — কীসের কথা বলা হয়েছে? ইকবাল এ কারণে কী করেছিলেন?
তত্ত্বের উল্লেখ – ভারতীয় মক্তব ও মাদ্রাসাগুলিতে প্রচুর পরিমাণে আরবি ভাষা পড়ানো বা চর্চা করা হলেও, ভারতীয় আর্যরা ফারসি ভাষার সৌন্দর্যে বেশি অভিভূত হয়েছিলেন। তাই উর্দু সাহিত্যের মূলসুর ফারসির সঙ্গে বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। একসময় ইরানে যেরকম আর্য-ইরানি ভাষা ও সেমিতি-আরবি ভাষার সংঘর্ষে নবীন ফারসি ভাষার জন্ম হয়েছিল, ভারতেও সেভাবেই সিন্ধি, উর্দু এবং কাশ্মীরি সাহিত্যের সৃষ্টি হয়, কিন্তু যে – কোনো কারণেই হোক এই তিনটি ভাষা ফারসির মতো নব নব সৃষ্টি দিয়ে ঐশ্বর্যশালী সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেনি। এই তত্ত্বই ইকবাল উপলব্ধি করেছিলেন।
ইকবালের পদক্ষেপ – ইকবাল এসব বুঝে নতুন সৃষ্টির মাধ্যমে উর্দুকে ফারসির অনুকরণ থেকে কিছুটা মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যসৃষ্টি তার পদাবলি কীর্তনে। এই পদাবলি কীর্তনের কোন্ বৈশিষ্ট্যের দিকে লেখক ইঙ্গিত করেছেন?
উদ্দিষ্ট পদাবলি কীর্তনের বৈশিষ্ট্যের প্রতি লেখকের ইঙ্গিত – লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর মতে, পদাবলি সাহিত্যের প্রাণ আর দেহ দুটোই খাঁটি বাঙালি। এই সাহিত্যে শুধু যে মহাভারত-এর শ্রীকৃষ্ণ বাংলায় কানু হয়ে উঠেছেন তাই নয়, রাধাও হয়ে উঠেছেন একেবারে খাঁটি বাঙালি মেয়ে। ভাটিয়ালির নায়িকা, বাউলের ভক্ত, মুরশিদিয়ার আশিক আর পদাবলির রাধা একই চরিত্র হয়ে উঠেছেন।
বাঙালি চরিত্রে বিদ্রোহ বিদ্যমান। — প্রসঙ্গ নির্দেশ করে লেখক যা বোঝাতে চেয়েছেন লেখো।
প্রসঙ্গ-সহ লেখকের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা – সৈয়দ মুজতবা আলীর মতে রাজনীতি, ধর্ম, সাহিত্য — যখনই বাঙালি সত্য, শিব ও সুন্দরের সন্ধান পেয়েছে তখনই তা গ্রহণ করতে চেয়েছে। আর গতানুগতিকতা বা প্রাচীন ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে কেউ সেই প্রচেষ্টায় বাধা দিতে গেলে বাঙালি জাতি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। আবার সেই বিদ্রোহ উচ্ছৃঙ্খলতায় পরিণত হলে সুন্দরের পূজারি বাঙালিরা তার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করেছে। আর এই বিদ্রোহে বাঙালি মুসলমানরাও যোগ দিয়েছে। তার কারণ ধর্ম বদলে গেলেও জাতিসত্তা একই থেকে যায়।
এ বিদ্রোহ বাঙালি হিন্দুর ভিতরই সীমাবদ্ধ নয়। – মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করো।
উৎস – লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর নব নব সৃষ্টি রচনায় বাঙালি চরিত্রে বিদ্রোহের অস্তিত্ব লক্ষ করেছেন।
ব্যাখ্যা – তাঁর মতে রাজনীতি, ধর্ম, সাহিত্য ইত্যাদি যে ক্ষেত্রেই সে সত্য-শিব-সুন্দরের সন্ধান পেয়েছে সেখানেই তা গ্রহণ করতে চেয়েছে। আর ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে যদি কেউ তাতে বাধা দিতে চায় বাঙালি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। আর এই বিদ্রোহ বাঙালি হিন্দুর একচেটিয়া নয়, বাঙালি মুসলমানও একই কাজে তৎপর। কারণ, লেখক মনে করতেন — ধর্ম বদলালেও জাতির চরিত্র বদলায় না।
সৈয়দ মুজতবা আলীর নব নব সৃষ্টি প্রবন্ধে তিনি বাংলা ভাষার বিবর্তন ও পরিবর্তনের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি মনে করেন, বাংলা ভাষা একটি জীবন্ত ভাষা এবং এটি ক্রমাগত পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হচ্ছে। এই পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের জন্য বিভিন্ন কারণের অবদান রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষা থেকে শব্দঋণ গ্রহণ।
মুজতবা আলী মনে করেন, বাংলা ভাষার বিকাশের জন্য সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষা থেকে শব্দঋণ গ্রহণ অপরিহার্য। তিনি বলেন, সংস্কৃত ভাষা বাংলা ভাষার মাতৃভাষা এবং ইংরেজি ভাষা একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। তাই এই দুটি ভাষা থেকে শব্দঋণ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলা ভাষার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করা সম্ভব।