এখনই আমাদের Telegram Community গ্রুপে যোগ দিন।। এখানে WBBSE বোর্ডের পঞ্চম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির যেকোনো বিষয়ভিত্তিক সমস্যা শেয়ার করতে পারেন এবং একে অপরের সাহায্য করতে পারবেন। এছাড়া, কোনও সমস্যা হলে আমাদের শিক্ষকরা তা সমাধান করে দেবেন।

Telegram Logo Join Our Telegram Community

নবম শ্রেণি – বাংলা – নব নব সৃষ্টি (প্রবন্ধ) সৈয়দ মুজতবা আলী

নব নব সৃষ্টি প্রবন্ধটি সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা একটি বিখ্যাত প্রবন্ধ। এটি নবম শ্রেণীর বাংলা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রবন্ধটিতে লেখক বাংলা ভাষার বিকাশ ও সমৃদ্ধির জন্য নতুন নতুন শব্দের সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

নবম শ্রেণি – বাংলা – নব নব সৃষ্টি

লেখক পরিচিতি

ভূমিকা – পণ্ডিত, ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর সাহিত্যকীর্তির জন্য পাঠকের মনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

জন্ম এবং শৈশব – ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত ভারতের সিলেটের করিমগঞ্জে তাঁর জন্ম হয়। বাবার নাম সিকান্দার আলী।

ছাত্রজীবন – বাবার বদলির চাকরি হওয়ায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা ঘটে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনে আসেন এবং এখান থেকে সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, ফারসি, হিন্দি, গুজরাটি প্রভৃতি একাধিক ভাষা শেখেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতন থেকে তিনি বিএ ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবন – তাঁর কর্মজীবন আরম্ভ হয় আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা দিয়ে। এরপর দর্শন পড়ানোর জন্য তিনি জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। তিনি ১৯২৭-২৯ খ্রিস্টাব্দে কাবুলের একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে গবেষণার জন্য তিনি ডিফিল ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মিশরের কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে বরোদার মহারাজার আমন্ত্রণে বরোদা কলেজে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব পড়ান। এখানে আট বছর কাটানোর পর দিল্লির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। তিনি সেই সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে অতিথি অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে এখান থেকেই ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের রিডার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

সাহিত্যজীবন – শান্তিনিকেতনে পড়তে পড়তেই তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। দেশ, আনন্দবাজার, বসুমতী, সত্যযুগ প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর লেখা প্রকাশ হত। বহু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণকাহিনি, ছোটোগল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা দ্বারা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল –

  • ভ্রমণকাহিনিদেশে বিদেশে, জলেডাঙায়
  • রম্যরচনা — পঞ্চতন্ত্র, ময়ূরকণ্ঠী, প্রভৃতি
  • প্রবন্ধ —চতুরঙ্গ
  • উপন্যাস – অবিশ্বাস্য, শবনম, প্রভৃতি
  • ছোটোগল্প — চাচাকাহিনী, টুনিকাহিনী
  • গল্পমালা – রাজাউজির, ধূপছায়া, বেঁচে থাক, পুনশ্চ প্রভৃতি।

সম্মান ও স্বীকৃতি – তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি নানা পুরস্কার ও সম্মান পেয়েছেন। ১৯৪৯ – এ নরসিংহ দাস পুরস্কার পান। ১৯৬১ – তে পান আনন্দ পুরস্কার। ২০০৫-এ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক-এ ভূষিত করেছেন।

জীবনাবসান – ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি এই মহান সাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে।

উৎস

পাঠ্যাংশের প্রবন্ধটি লেখকের মাম্দোর পুনর্জন্ম প্রবন্ধের সম্পাদিত অংশ। মূল প্রবন্ধগ্রন্থটির নাম চতুরঙ্গ। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে এটি প্রকাশিত হয়।

বিষয়সংক্ষেপ

প্রাচীন যুগের অধিকাংশ ভাষাকে লেখক আত্মনির্ভরশীল এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ বলেছেন। হিব্রু, গ্রিক, আবেস্তা, সংস্কৃত এবং কিছুটা পরবর্তী যুগের আরবিও নতুন ভাষার প্রয়োজন হলে নিজ ভাণ্ডারেই প্রথমে শব্দের খোঁজ করেছে। এইসমস্ত ভাষা খুব সামান্যই বিদেশি ভাষা ব্যবহার করেছে, ফলে এই ভাষাগুলির স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে লেখক কোনো আপত্তি প্রকাশ করেননি। এই বিচার অনুযায়ী লেখক বর্তমান যুগের বাংলা এবং ইংরেজিকে অন্য ভাষার ওপর নির্ভরশীল বলেছেন। কারণ বাংলা এবং ইংরেজি প্রয়োজন ছাড়াও বিদেশি শব্দ ব্যবহার করে। পাঠান-মোগল যুগে আরবি-ফারসি শব্দের খুব বেশি প্রচলনের ফলে এই দুই ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় প্রচুর শব্দ প্রবেশ করেছে।

বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দের যোগ ও ব্যবহার ঠিক কি না এ প্রসঙ্গে লেখক খুব স্পষ্টভাবেই বলেছেন যে বিদেশি শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করবেই সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। আলু-কপির বা বিলিতি ওষুধের ব্যবহার যেমন রোজ বাড়ছে তেমনই বাংলা ভাষাতেও বিদেশি শব্দ থেকে যাবে এবং আরও নতুন শব্দের প্রবেশ ঘটবে।

হিন্দি ভাষার তরুণ সাহিত্যিকরা হিন্দি ভাষা থেকে আরবি, ফারসি, ইংরেজি ভাষার ব্যবহার বন্ধ করার প্রচেষ্টা শুরু করেছেন। তাঁদের এই চেষ্টার ফলাফল ভালো না মন্দ হবে সে-কথা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বা বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষায় অনায়াসেই বিদেশি শব্দের ব্যবহার করেছেন। এমনকি হিন্দি ভাষার বঙ্কিমচন্দ্র হিসেবে পরিচিত মুন্সি প্রেমচন্দও হিন্দি ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার করেছেন। এ প্রসঙ্গেই লেখক বলেছেন যে রচনার ভাষা তার বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভরশীল। বিষয় অনুযায়ীই বাঙালি সাহিত্যিকরা তাঁদের ভাষা বেছে নিয়েছেন। শংকরদর্শন – এর ভাষা সংস্কৃতঘেঁষা হবে, আবার মোগলাই রেস্তোরাঁর ভাষা হুতোম প্যাঁচার নকশায় ব্যবহৃত ভাষার মতোই হবে। বসুমতী পত্রিকার সম্পাদকীয়তে ভাষার গাম্ভীর্য থাকলেও বাঁকা চোখ-এর ভাষাতে রয়েছে চটুলতা ।

বাংলা ভাষায় যেসব বিদেশি শব্দ প্রবেশ করেছে তাদের মধ্যে আরবি, ফারসি এবং ইংরেজি প্রধান। স্কুল-কলেজ থেকে সংস্কৃতচর্চা বন্ধ করা উচিত নয় কারণ বাংলা ভাষায় বর্তমানেও সংস্কৃত ভাষার প্রয়োজন আছে। ইংরেজি ভাষার ক্ষেত্রেও সংস্কৃতের মতোই এ কথা প্রযোজ্য কারণ দর্শন, নন্দনশাস্ত্র এবং বিজ্ঞান বিষয়ক সাহিত্যচর্চাতে ইংরেজি ভাষার বিকল্প নেই। কারণ রেলের ইঞ্জিন চালাতে হয় কী করে তা জানার জন্য ইংরেজি ভাষারই শরণাপন্ন হতে হবে।

আরবি এবং ফারসি ভাষা ব্যাপকভাবে আর বাংলায় প্রবেশ করবে না, কারণ তরুণ বাঙালিরা ক্রমশ এই দুই ভাষার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। তবে যেসব আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় ইতিমধ্যে ঢুকে গেছে সেগুলি দীর্ঘদিন চালু থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে প্রাচীন বাংলা পড়ানো হওয়ায় তরুণ লেখক সম্প্রদায় প্রায় অচলিত আরবি-ফারসি শব্দগুলির ব্যবহার করছেন। এইরকম পরিস্থিতিতে প্রচলিত ও অপ্রচলিত ভাষার একটা হিসেবনিকেশ করেছেন লেখক।

প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় মোক্তব-মাদ্রাসাগুলিতে আরবি ভাষা পড়ানো হলেও ভারতীয় আর্যরা ফারসি ভাষার প্রতি অনেক বেশি আকৃষ্ট হন। উর্দু বা হিন্দি ভাষার মূল সুরও আরবি নয়, ফারসি ভাষার সঙ্গে যুক্ত।
আর্য ইরানি ভাষা এবং সেমিতি আরবি ভাষার লড়াইয়ে নবীন ফারসি ভাষার জন্ম হয়। ধীরে ধীরে ফারসি ভাষা মূল্যবান সাহিত্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। ফারসি ভাষার জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতে সিন্ধি, উর্দু ও কাশ্মীরি ভাষার জন্ম হয়। উর্দু কবি ইকবাল উর্দু ভাষাকে ফারসির প্রভাব থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন।

বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য পদাবলি কীর্তন। এই কাব্যের শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীমতী রাধার চরিত্রে খাঁটি বাঙালিয়ানা ফুটে উঠেছে। এ কথা ভাটিয়ালির নায়িকা, বাউলের ভক্ত, মুরশিদি গানের আশিক চরিত্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাঙালি তার ধর্ম, রাজনীতি, সাহিত্য — সর্বত্রই সত্য-শিব-সুন্দরের আরাধনা করেছে এবং সেই আরাধনায় বাধা পেলে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। এই বিদ্রোহী মনোভাব বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় জাতির ক্ষেত্রেই বর্তমান।

নামকরণ

সাহিত্যসৃষ্টির ক্ষেত্রে নামকরণের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। লেখক তাঁর নব নব সৃষ্টি রচনায় যে-কোনো সৃষ্টিকর্মের নির্মাণে যে পরীক্ষানিরীক্ষা, গ্রহণ-বর্জন থাকে তাকে দেখার চেষ্টা করেছেন। কিছু ভাষা আছে যেমন সংস্কৃত, হিব্রু, গ্রিক, আবেস্তা, এমনকি আরবি ইত্যাদি প্রাচীন ভাষাগুলি অনেকটাই আত্মনির্ভরশীল। আবার বাংলা, ইংরেজির মতো ভাষাগুলি অন্য ভাষা থেকেও শব্দ নেয়। এই শব্দরা স্থায়ীভাবে ভাষায় থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বেনামে বিদ্যাসাগর সকলেই অন্য ভাষা থেকে শব্দ নিয়ে নিজেদের সাহিত্যে ব্যবহার করেছেন। বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করেই শব্দগ্রহণ চলে। এই গ্রহণের পথে বাংলার সঙ্গে সংস্কৃত ও ইংরেজিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

তবে আরবি-ফারসির প্রভাব কিছুটা ক্ষীণ হলেও সাহিত্যে ইতিমধ্যে তারা স্থান পেয়ে যাওয়ায় এবং এখন পরীক্ষানিরীক্ষার কারণে এইসব শব্দও বাংলা ভাষায় টিকে থাকবে। এখন আবার আরবির থেকে ফারসির গ্রহণযোগ্যতা বেশি। উর্দু ও হিন্দি সাহিত্যে ফারসিরই প্রভাব থেকে লক্ষ করা যায়। ইকবালের মতো কেউ কেউ অবশ্য উর্দুকে ফারসির প্রভাব মুক্ত করতে চেষ্টা করেছেন। অন্যভাষার ওপরে নির্ভর না করেও যে সাহিত্যসৃষ্টি সফল হতে পারে তার যথার্থ উদাহরণ হল পদাবলি কীর্তন। বাঙালি হিন্দুই হোক, অথবা মুসলমান—তারা সবসময় স্বাধীনভাবে চলতে চায়—এই বিদ্রোহীসত্তা তাদের মধ্যে সবসময় কাজ করে থাকে। সব মিলিয়েই শব্দ ও ভাষাঋণ নেওয়া বা বর্জন করা এই দুই বিপরীতমুখী স্রোতেই সাহিত্য গড়ে ওঠে। সৃষ্টির সেই বিচিত্র স্বরূপকে ধরার চেষ্টা হয়েছে বলেই প্রবন্ধের নাম নব নব সৃষ্টি সার্থক হয়ে উঠেছে।

লেখক মনে করেন, বাংলা ভাষার বিকাশ ও সমৃদ্ধির জন্য নতুন নতুন শব্দের সৃষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ ও বিকশিত করা সম্ভব।

Share via:

মন্তব্য করুন