নোঙর কবিতায় কবি অজিত দত্ত জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন। কবিতার শুরুতে কবি একটি জাহাজের কথা বলেছেন, যা সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে যাত্রা করছে। জাহাজের যাত্রীরা সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে নিরাপদভাবে গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়। তাই জাহাজের নোঙরকে সমুদ্রের তলদেশে শক্ত করে বাঁধা হয়। নোঙর জাহাজকে সমুদ্রের ঢেউয়ের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
কবি এই জাহাজের নোঙরকে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে তুলনা করেছেন। জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আমাদেরকে জীবনের উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে নিরাপদভাবে গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। তাই আমাদের জীবনে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকা উচিত।
নোঙর কবিতাটির নামকরণ কতটা ব্যঞ্জনাধর্মী আলোচনা করো।
শিরোনামে কবিতার মূলভাব বা ব্যঞ্জনার আভাস পাওয়া যায়। অজিত দত্তের নোঙর কবিতাটির নামকরণও সেই দিক দিয়ে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
কবি নৌকা নিয়ে সুদূর সমুদ্রে পাড়ি দিতে চান, কিন্তু কখন যেন তাঁর নৌকার নোঙর পড়ে গেছে কূলের ধারে —
পাড়ি দিতে দূর সিন্ধুপারে
নোঙর গিয়েছে পড়ে তটের কিনারে।
তাই মাস্তুলে পাল বেঁধে দাঁড় টানলেও নৌকা এগোয় না।
মানুষের জীবনও নৌকার মতো — সৃষ্টিশীল মন সমস্ত বন্ধন ছিঁড়ে চলে যেতে চান বাস্তব থেকে অনেক দূরের জগতে। কিন্তু সম্পর্কের, কর্মের, দায়িত্ব – কর্তব্যবোধের নোঙরে তা বাঁধা পড়ে থাকে। কবির সৃষ্টিশীল মনেও এমন সংঘাত চলে আজীবন। তাঁর কবিসত্তা দৈনন্দিন জীবনযাপনের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিতে চায় না। তা সীমা থেকে বেরোনোর জন্য ছটফট করে।
ফারসি শব্দ লঙ্গর থেকে আসা নোঙর শব্দটির অর্থ নৌকা বেঁধে রাখার ভারী বস্তুবিশেষ। আলোচ্য কবিতাতেও নোঙর হয়ে উঠেছে জীবনের বন্ধনের প্রতিশব্দ। তাই শিরোনামটি অত্যন্ত ব্যঞ্জনাধর্মী এবং যথাযথ
নোঙর কবিতাটির মর্মার্থ নিজের ভাষায় লেখো।
স্বপ্ন-ইচ্ছা-কল্পনার প্রতীক – শাদা মেঘ কালো পাহাড় কাব্যসংকলনের অন্তর্গত নোঙর কবিতায় অজিত দত্ত তাঁর অতৃপ্তির কথা বলেছেন। কবির সৃষ্টিশীল মন পাড়ি দিতে চেয়েছে সুদূর কোনো দেশে। কিন্তু তটভূমির কাছে তাঁর অজান্তে নৌকার নোঙর পড়ে গেছে। কবির জীবনের নানা স্বপ্ন-ইচ্ছে-কল্পনার প্রতীক হয়ে জোয়ারের ঢেউগুলি তাঁর নৌকায় আঘাত করে সমুদ্রের দিকে ছুটে চলে যায় । ভাটার টানে খানিকবাদেই সেই প্রবল স্রোত দুর্বল হয়ে পড়ে। বাস্তবরূপী তটের কাছে এই জীবনটাও যেন জোয়ারভাটায় বাঁধা। কখনও আশার জোয়ার, কখনও নিরাশার ভাটা। কবি বৃথা জেনেও সারারাত একনাগাড়ে দাঁড় টেনে চলেন।
সুদূরের হাতছানি – কবির সৃষ্টিশীল মন এক জায়গায় বাঁধা পড়ে থাকতে চায় না। কিন্তু কবি সাংসারিক মানুষ। জীবন – জীবিকার শর্তে তাঁকে গণ্ডিবদ্ধ হয়ে থাকতে হয়। নানা ধরনের সম্পর্কের বন্ধন, কাজের বন্ধন, দায়িত্ব – কর্তব্যের বেড়াজাল কবির জীবন-নৌকাকে নোঙরের কাছিতে বেঁধে রেখেছে। তবু সুদূরের হাতছানি তাঁকে উতলা করে, বৃথা চেষ্টার ব্যর্থতা তাঁকে হতাশ করে।
শেষের কথা – এভাবেই একজন সৃষ্টিশীল মানুষ বাস্তব ও কল্পনার সংঘাতে অবিরাম ক্ষতবিক্ষত হন।
নোঙর কবিতায় কবিজীবনের অপূর্ণতার বেদনা কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে, বিশ্লেষণ করো।
কল্পনাময় রোমান্টিক মন – কবি অজিত দত্তের ছিল কল্পনাময় এক রোমান্টিক মন। অচেনা-অজানা সুদূর তাঁকে হাতছানি দেয়, আকুল করে তোলে। কিন্তু তাঁর জীবন-নৌকা তটের কিনারে নোঙরে বাঁধা পড়েছে। সংসারের বিভিন্ন দায়িত্ব-কর্তব্যে তাঁর দৈনন্দিন জীবন আবদ্ধ। তাই কবির আক্ষেপ —
পাড়ি দিতে দূর সিন্ধুপারে
নোঙর গিয়েছে পড়ে তটের কিনারে।
সারারাত মিছে দাঁড় টানি,
মিছে দাঁড় টানি।
স্রোতের বিদ্রুপ – জোয়ারের ঢেউগুলি যেন কবির স্বপ্ন-ইচ্ছে-কল্পনার প্রতীক হয়ে নৌকায় মাথা ঠুকে সমুদ্রে চলে যায়। প্রতিবার দাঁড় টানায় কবি শোনেন স্রোতের বিদ্রুপ। বাস্তবের তটে জীবিকার তাগিদ, সম্পর্কের মায়া আর হাজার প্রয়োজনীয় কাজের বন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা কবির এই জীবনতরি। তাই মন চাইলেও কবি সাংসারিক বন্ধন ছিন্ন করে সুদূরের আহ্বানে নৌকা ভাসাতে পারেন না। তাই কবি বেদনাভরা কণ্ঠে বলে ওঠেন —
যতই না দাঁড় টানি, যতই মাস্তুলে বাঁধি পাল,
নোঙরের কাছি বাঁধা তবু এ নৌকা চিরকাল।
শেষের কথা – কবিমনের চাওয়া পাওয়ার মধ্যে এই ফারাক এবং জীবনের অপূর্ণতার বেদনা আলোচ্য কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে।
নোঙর কবিতা অবলম্বনে কবির রোমান্টিক মনের পরিচয় দাও।
শুরুর কথা – রোমান্টিক কবিরা বাস্তবজগতের বাইরে নিজস্ব কল্পনার জগৎ গড়ে তোলেন এবং সেখানেই বিচরণ করতে ভালোবাসেন।
জীবনের প্রতীক হিসেবে নোঙর – নোঙর কবিতাটিতেও সারারাত দাঁড় টেনে কবি তাঁর জীবনতরিকে সেই কল্পনার জগতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যান। কবির জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা কল্পনার প্রতীক জোয়ারের ঢেউগুলি তাঁর মনের দরজায় মাথা ঠুকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। আলোচ্য কবিতাটিতে সংসারের মায়াজালে আবদ্ধ, কর্মজীবনের বেড়াজালে আটকে – পড়া কবির জীবনের প্রতীক হিসেবে নোঙর – এর প্রসঙ্গ এসেছে। কবির মন চাইলেও সেই বাঁধন থেকে তাঁর মুক্তি মেলে না। তাই কবি বলেছেন —
নোঙর গিয়েছে পড়ে তটের কিনারে।
সুদূরের হাতছানি – অনন্তের আহ্বান, সুদূরের হাতছানি কবিকে অস্থির করে রাখে। সারারাত কবি কল্পনার জগতে জাল বুনে চলেন। মিছে এই জাল বোনা, বৃথা এই দাঁড় টানা জেনেও কবি অবিরাম টেনে চলেন দাঁড়। বাস্তবে নৌকা তাঁকে কোথাও নিয়ে যায় না। সংসারের হাজার কর্মের বন্ধন তাঁকে বন্দি করে রাখে। ফলে চির-অতৃপ্ত থেকে যায় কবির হৃদয় । এই চির-অতৃপ্তিই রোমান্টিকতার প্রধান লক্ষণ। নোঙর কবিতায় প্রকাশিত কবিমন তাই আদ্যন্ত রোমান্টিক।
নোঙর একটি প্রতীকী কবিতা — আলোচনা করো।
শুরুর কথা – প্রতীককে ইংরেজিতে বলে Symbol। চিহ্ন যখন মনের ভাবকে প্রকাশ করে, তখন তাকে বলে প্রতীক।
হৃদয়ের অনুভূতির ব্যঞ্জনা – কবি অজিত দত্তর নোঙর কবিতায় নানা প্রতীকে হৃদয়ের অনুভূতির ব্যঞ্জনা ধরা পড়েছে। নোঙর -কে তিনি বন্ধনের প্রতীকরূপে আর পরিচিত বাস্তবজগৎকে নদীর তটের প্রতীকরূপে ব্যবহার করেছেন।
আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক – বাস্তব প্রয়োজনের জগতের বাইরের জগৎকে তিনি দূর সিন্ধুপার বা সপ্তসিন্ধুপার বলে অভিহিত করেছেন। সেই বহুদূর কাল্পনিক জগতে পাড়ি দিতে চেয়েও কবির জীবন-নৌকা নোঙরে বাঁধা পড়েছে। জোয়ারের ঢেউগুলি কবির জীবনের স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। নৌকায় মাথা ঠুকে অর্থাৎ কবির মনের দরজায় মাথা ঠুকে ব্যর্থ হয়ে তারা সমুদ্রের দিকে ছুটে যায়। সেই দূর সমুদ্রে পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন কবিও | সম্পর্কের সূত্র – কাছি যেন বাস্তবজীবনের নানা সম্পর্কের সূত্র – জোয়ারভাটা হল জীবনের উত্থানপতন, আশা-নিরাশার প্রতীক। নোঙর যেমন স্থিতি বা বন্ধন, তেমনি স্রোত হল গতির প্রতীক।
সৃষ্টি সম্পদের প্রতীক – বাণিজ্য, পণ্য এগুলি হল লাভক্ষতিময় জীবন- জীবিকা ও সৃষ্টিসম্পদের প্রতীক। এভাবেই প্রতীকের সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে কবিতার ব্যঞ্জনা। তাই সবদিক বিচার করে নোঙর – কে একটি আদর্শ প্রতীকী কবিতা বলা যায়।
নোঙর কবিতায় স্থিতি ও গতির চিত্র কীভাবে ধরা পড়েছে বুঝিয়ে দাও।
কথামুখ – কবি অজিত দত্ত নোঙর কবিতায় জীবনের সীমা-অসীমের, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির পটভূমিতে স্থিতি ও গতির চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।
গতির প্রবণতা – তটের কিনারে রয়েছে একটি নিশ্চল নৌকা। কবি এই নৌকা নিয়ে পাড়ি দিতে চান সুদূর সাতসমুদ্রপারে। কবির এই চাওয়ার মধ্যে গতির প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কিন্তু নৌকার নোঙর জলের গভীরে গাঁথা। তাই এ-নৌকা স্থির।
স্বপ্নবিলাসী মন – নৌকা যেমন তটের কাছে নোঙরে বাঁধা পড়ে আছে, তেমনই কবির স্বপ্নবিলাসী মনও সাংসারিক দায়দায়িত্বে বাঁধা পড়ে গেছে। এই দায়িত্ব-কর্তব্যের বাঁধন কবির জীবননৌকাকে নোঙরের কাছিতে বেঁধে রেখেছে।
কল্পনা জগতের হাতছানি – কিন্তু সুদূরের মুক্তজীবন, উন্মুক্ত প্রকৃতি, অজানা মায়াবী কল্পনার জগৎ তাঁকে প্রতিনিয়ত হাতছানি দেয়। কবি সংসারজীবনে বাঁধা পড়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর রোমান্টিক মন সর্বদাই বহুদূরে চলে যেতে যায়। স্থিতি আর গতির দ্বন্দ্বে কবির হৃদয় ক্ষতবিক্ষত। তাই কবির আকুল হৃদয়ের আক্ষেপ —
নোঙর কখন জানি পড়ে গেছে তটের কিনারে।
সারারাত তবু দাঁড় টানি,
তবু দাঁড় টানি।।
শেষের কথা – কবি যতই দাঁড় টানুন আর মাস্তুলে বাঁধুন পাল, চিরকালের জন্য তাঁর নৌকা বাঁধা পড়ে গেছে বাস্তব সংসারের ঘাটে। এভাবেই আলোচ্য কবিতায় স্থিতি ও গতির চিত্র ধরা পড়েছে।
অজিত দত্তের নোঙর কবিতাটি একটি রূপকধর্মী কবিতা। কবিতায় নোঙরকে জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বা আদর্শের প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে। কবি মনে করেন, জীবনে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে জীবনের পথ চলতে হবে। নোঙরহীন নৌকা যেমন সমুদ্রে হারিয়ে যায়, তেমনি লক্ষ্যহীন মানুষও জীবনে হতাশ ও বিচ্যুত হয়।
কবিতায় কবি আরও বলেন, জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম ও সংগ্রাম করতে হয়। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কোনও প্রতিবন্ধকতাকে আত্মবিশ্বাসের সাথে মোকাবেলা করতে হবে। নোঙরহীন নৌকা যেমন সমুদ্রের ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যায়, তেমনি লক্ষ্যহীন মানুষও জীবনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে হারিয়ে যায়।