নবম শ্রেণীর বাংলা পাঠ্যপুস্তকের একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প হল রাধারাণী। এই গল্পটি রচনা করেছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯২ সালে।
গল্পটিতে ফুটে উঠেছে এক অসহায় নারীর জীবন সংগ্রাম। রাধারাণী নামের এক তরুণী তার স্বামীর মৃত্যুর পর তার চার সন্তানকে নিয়ে কীভাবে জীবন যুদ্ধে টিকে থাকে, সেই গল্পই এই রাধারাণী।
রাধারাণী গল্পাংশে রাধারাণীর চরিত্রকে যেভাবে পাওয়া যায় তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো।
শুরুর কথা – বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারাণী গল্পাংশের নামকরণই কাহিনিতে রাধারাণী চরিত্রের গুরুত্বকে বুঝিয়ে দেয়। রাধারাণী চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে চোখে পড়ে —
দায়িত্ববোধ – বয়সের তুলনায় রাধারাণী ছিল অত্যন্ত দায়িত্ব-বোধসম্পন্ন। তাই অসুস্থ মায়ের পথ্যের অর্থসংগ্রহের জন্য মালা গেঁথে একা-একাই সে সেই মালা রথের মেলায় বিক্রি করতে গিয়েছিল।
মাতৃভক্তি – মায়ের পথ্যের জন্য মালা বেচতে যাওয়া শুধু রাধারাণীর দায়িত্ববোধেরই নয়, তার মাতৃভক্তিরও পরিচায়ক। দ্বিধা সত্ত্বেও মায়ের কথাতেই সে রুক্মিণীকুমারের কাছে মালা বিক্রি করে পাওয়া অতিরিক্ত অর্থগ্রহণে রাজি হয়।
নীতিবোধ ও সততা – তার নৈতিকতাবোধের জন্যই রুক্মিণীকুমারের রেখে যাওয়া নোটটিও রাধারাণী ভাঙায় না; সৎ বলেই তা ফেরত দেওয়ার কথা ভাবে।
বিবেচনাবোধ – অন্ধকারে হাত ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসা সেই উপকারী মানুষটির কাছ থেকে মালার দাম নেওয়া উচিত হবে কিনা তা নিয়ে রাধারাণীর যে সংশয় তা তার কৃতজ্ঞতা-বোধেরই পরিচায়ক।
সেবাপরায়ণতা – বাজারে যাওয়া, তেল আনা, রান্না করা, মাকে খেতে দেওয়া, ঘর পরিষ্কার করা — রাধারাণীর এইসব কাজকর্ম থেকে বোঝা যায় ঘরের কাজে এবং সেবাযত্নেও সে যথেষ্ট দক্ষ ছিল। এভাবেই রাধারাণী নিজ চরিত্রগুণে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
রাধারাণী গল্পাংশের পথিক চরিত্রটি আলোচনা করো।
শুরুর কথা – বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারাণী গল্পাংশের শেষে জানা যায়, পথিকের নাম রুক্মিণীকুমার। বৃষ্টিতে পণ্ড হয়ে যাওয়া রথের মেলা থেকে ফেরার পথে রাধারাণীর সঙ্গে তার আলাপ। তার চরিত্রের যে বিশেষত্বগুলি আমাদের চোখে পড়ে, সেগুলি হল —
দয়ালু ও পরোপকারী – পথিকটি বৃষ্টি-ভেজা, অন্ধকার, পিছল পথে রাধারাণীকে হাত ধরে বাড়ি পৌঁছে দেয়। রাধারাণীর প্রয়োজন ও তার বিক্রি না হওয়া মালার কথা শুনে পথিক সেই মালাটিও কিনে নেয়। শুধু তাই নয়, মূল্য হিসেবে পয়সার বদলে তাকে টাকা দেয়। রাধারাণীর পরার আর কাপড় নেই শুনে পদ্মলোচন সাহার দোকানে কাপড়ের দাম দিয়ে, তা রাধারাণীকে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশও দিয়ে যায় সেই পথিক। এসবই তার পরোপকারী, উদারমনা স্বভাবকে স্পষ্ট করে।
আত্মপ্রচারবিমুখ – রুক্মিণীকুমার উপকার করলেও সে কখনোই তা সরাসরি জানতে দেয়নি। এমনকি রাধারাণীদের আর্থিক অবস্থার কথা জানতে পেরে সবার অজান্তেই তার ঘরে নোটখানি রেখে গেছে।
বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন – রুক্মিণীকুমার ছিল বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন। তাই রাধারাণীর ঘরে ফেলে-যাওয়া নোটটিকে কেউ যাতে চোরা নোট বলতে না পারে, সেজন্য তাতে দাতা ও প্রাপকের নামটি লিখে রেখে যান।
রাধারাণী গল্পাংশে রাধারাণী চরিত্রটি পথিকের দ্বারা যে যে ভাবে উপকৃত হয়েছে তা নিজের ভাষায় লেখো।
কথামুখ – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রাধারাণী গল্পাংশে রাধারাণীর অসহায়তা এবং বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত পথিক চরিত্রটি প্রবলভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনভাবে এই সাহায্যের চেষ্টা লক্ষ করা যায় —
পথপ্রদর্শন ও নিরাপত্তাদান – প্রবল বৃষ্টিতে মেলা পণ্ড হয়ে রাধারাণী যখন একা একা অন্ধকার পথে ফিরছিল তখনই তার সঙ্গে পাথকের আলাপ হয়। ভীতসন্ত্রস্ত রাধারাণীকে আশ্বস্ত করে, তার হাত ধরে তাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেয় সে।
অর্থসাহায্য – রাধারাণীর কাছে তার দুরবস্থা এবং মালা বিক্রি না করতে পারার কথা জেনে পথিক মালাটি চার পয়সায় কিনে নেয় এবং অন্ধকার পথে পয়সার বদলে তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করে। উপরন্তু সে একটি নোট রাধারাণীর ঘরের মেঝেতে ফেলে যায়, যা রাধারাণী ঘর ঝাঁট দিতে গিয়ে উদ্ধার করে।
বস্ত্রসাহায্য – রাধারাণীর কাছেই তার কাপড়ের অভাবের কথা শুনে চলে যাওয়ার সময়ে পথিকটি কাপড়ের ব্যবসায়ী পদ্মলোচন সাহার দোকানে একজোড়া শান্তিপুরি কাপড়ের দাম মিটিয়ে তা রাধারাণীদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
এইভাবে একাধিক উপায়ে পথিক ভদ্রলোক, নোটে লেখা নাম থেকে যার নাম জানা যায় রুক্মিণীকুমার রায়, রাধারাণীকে সাহায্য করতে উদ্যোগী হয়েছে।
রাধারাণী রচনাংশ অবলম্বনে সেকালের সমাজজীবনের পরিচয় দাও।
কথামুখ – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রাধারাণী রচনাংশটি কোনো সামাজিক সমস্যা ও সংকটকে অবলম্বন করে রচিত না হলেও কাহিনির প্রেক্ষাপটে সমাজ উঁকি দিয়েছে বারেবারেই। সম্পত্তিজনিত বিবাদ – রাধারাণীর মা-র নিঃস্ব হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ কিংবা মামলা-মোকদ্দমা তখন যথেষ্টই ছিল। গ্রামবাংলার ছবি – রথের মেলা উপলক্ষ্যে লোকের ভিড় গ্রামবাংলারই জীবন্ত ছবি। দরিদ্রতা – দারিদ্র্য কত কষ্টকর হতে পারে তার পরিচয় পাওয়া যায় যখন রাধারাণীদের খাবার জোটে না, কিংবা রাধারাণী জানায় তার দুটি ভিন্ন কাপড় নেই, ভিজে কাপড়ে থাকতেই সে অভ্যস্ত। অসৎ ব্যাবসাবৃত্তি – কাপড়ের ব্যবসায়ী পদ্মলোচন সাহা অসৎ ব্যাবসাবৃত্তির প্রতীক হয়ে থাকে, যে চার টাকার কাপড় আট টাকা সাড়ে চোদ্দো আনায় বিক্রি করে। মেয়েদের অবস্থা – মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার যে চল ছিল তা বোঝা যায় যখন রাধারাণী সম্পর্কে লেখক বলেন — রাধারাণী বড়োঘরের মেয়ে, একটু অক্ষরপরিচয় ছিল। শেষের কথা – রাধারাণী এবং তার মায়ের রুক্মিণীকুমার রায়ের রেখে যাওয়া নোট তুলে রাখার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় পদ্মলোচনের মতো অসৎ চরিত্রের বিপরীতে সৎ এবং আদর্শবাদী মানুষও তখন সমাজে যথেষ্ট ছিল।
নবম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যপুস্তকের শেষ অধ্যায় হল রাধারাণী। এই অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কল্পনার রাধারাণীর চরিত্রটি তুলে ধরেছেন। রাধারাণী একজন সুন্দরী, ভক্তিময়ী এবং ঈশ্বরের প্রতি অনুরক্ত নারী। তিনি কৃষ্ণের প্রেমে মগ্ন এবং তার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত।
রাধারাণীর চরিত্রটি রবীন্দ্রনাথের নারী চেতনার প্রতিফলন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে নারীরাও পুরুষের মতোই ঈশ্বরের প্রতি অনুরক্ত হতে পারে এবং তাদেরও জীবনে আধ্যাত্মিক উন্নতি অর্জনের অধিকার রয়েছে।
রাধারাণী অধ্যায়টি বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নারী চেতনার প্রতিফলন এবং বাংলা ভাষার একটি অনন্য সৃষ্টি।