নবম শ্রেণী – ইতিহাস – ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক – বিশ্লেষণমূলক প্রশ্নোত্তর

Diptesh Khamaru

নবম শ্রেণীর ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়, “ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক” এর কিছু বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আজকের আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলি নবম শ্রেণীর পরীক্ষার জন্য বা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই প্রশ্নগুলি নবম শ্রেণীর পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হবে।

Table of Contents

নবম শ্রেণী – ইতিহাস – ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক – বিশ্লেষণমূলক প্রশ্নোত্তর

পূর্বতন সমাজ বা Ancien Regime বলতে কী বোঝো?

পূর্বতন ফরাসি সমাজের কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল —

  1. স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র – 18শ শতকে ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজবংশের অধীনে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র বিদ্যমান ছিল। এই পুরাতনতন্ত্রের ধারক ও বাহক বুরবোঁ বংশের রাজাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন চতুর্দশ লুই, পঞ্চদশ লুই, ষোড়শ লুই প্রমুখ। এঁরা নিজেদের ইচ্ছানুসারে সীমাহীন স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে দেশ শাসন করতেন।
  2. দৈব রাজতন্ত্রের ধারণা – রাজা স্বর্গীয় অধিকার নীতি অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। রাজারা নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে মনে করতেন। ফলে তাঁরা নিজেদের কাজের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিলেন না। এইভাবে স্বর্গীয় অধিকার তত্ত্বের আশ্রয় নিয়ে রাজারা অতিমাত্রায় স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিলেন।
  3. সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য –<strong>সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য -</strong> সমাজে শ্রেণিভেদ ও বৈষম্য তীব্র আকার ধারণ করেছিল। সমাজ মূলত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল – যাজক শ্রেণি, অভিজাত শ্রেণি এবং বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত, দরিদ্র ও সাঁকুলোদের নিয়ে গঠিত তৃতীয় শ্রেণি। যাজক ও অভিজাতরা ছিল বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণি এবং তৃতীয় শ্রেণি ছিল সুবিধাবঞ্চিত ও নিপীড়িত শ্রেণি।
  4. যাজক ও অভিজাতদের আধিপত্য – যাজক ও অভিজাতরা বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও সরকারকে কোনো কর দিতেন না। তৃতীয় সম্প্রদায়ের কাছ থেকে যাজকরা টাইথ বা ধর্মকর এবং অভিজাত প্রভুরা করভি বা শ্রমকরসহ বিভিন্ন প্রকার সামন্তকর আদায় করতেন।

ফরাসি বিপ্লব এই পূর্বতন সমাজব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি সবক্ষেত্রেই আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ, সামাজিক বৈষম্যের অবসান ও সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোকে অপসারিত করে ফরাসি বিপ্লব এক নবযুগের উন্মেষ ঘটিয়েছিল।

ফ্রান্সকে ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর (Museum of Economic Errors) বলা হয় কেন?

ফ্রান্সের আর্থিক অবস্থা ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। ফ্রান্সের রাজস্বব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। তা ছাড়া সরকারের অমিতব্যয়িতা, বিলাসিতা, ব্যয়সংকোচে অনিচ্ছা, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি ফ্রান্সের পরিস্থিতিকে ভয়ংকর করে তুলেছিল। এইসব কারণে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith) তৎকালীন ফ্রান্সকে ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর (Museum of Economic Errors) বলেছেন।

  1. ত্রুটিপূর্ণ করব্যবস্থা – ফ্রান্সে কর আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো ন্যায়সংগত নীতি ছিল না। অভিজাত ও যাজকরা ছিলেন ফ্রান্সের বেশিরভাগ জমির মালিক। অথচ তারা কর দিতেন সরকারের আয়ের মাত্র 4%। আর মোট রাজস্বের 96% দিতে হত দরিদ্র কৃষকদের।
  2. সরকারের বেহিসাবি অর্থব্যয় – ফ্রান্সের রাজাদের বেহিসাবি অর্থব্যয়ের ফলে ফ্রান্সের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল।
  3. যুদ্ধনীতির অযৌক্তিকতা – চতুর্দশ লুই ও পঞ্চদশ লুইয়ের আমলে বিভিন্ন যুদ্ধে যোগদানের ফলে ফ্রান্সের প্রচুর অর্থব্যয় হয়েছিল, যা ফরাসি অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়।
  4. রাজকোশে সংকট – উপরোক্ত কারণে বিপ্লব-পূর্ব ফ্রান্সের রাজকোশে সংকট দেখা যায়। ষোড়শ লুইয়ের সময়ে তুর্গো, নেকার প্রমুখ অর্থমন্ত্রী অভিজাতদের বিরোধিতায় আর্থিক সমস্যা সমাধানের কাজটি সঠিকভাবে করতে না পারায় রাজকোশ প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে।
  5. অর্থনৈতিক সংকট – জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদির ফলে প্রাক্-বিপ্লব পর্বে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে শস্যহানি ঘটলে এই সংকট আরও প্রবল হয়।

ফ্রান্সের এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় কালক্রমে ফরাসি বিপ্লব সংগঠনে ইন্ধন জুগিয়েছিল।

ফ্রান্সের করব্যবস্থা বৈষম্যমূলক ছিল কেন?

ফ্রান্সের করব্যবস্থা বৈষম্যমূলক ছিল কারণ —

  1. বৈষম্যমূলক করব্যবস্থা – ফরাসি রাজাদের সুনির্দিষ্ট কোনো রাজস্বনীতি ছিল না। বাজেটও তৈরি হত না। তাই রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। ফ্রান্সে প্রত্যক্ষ করের বোঝা দরিদ্র মানুষকেই বহন করতে হত। যাজক ও অভিজাতরা কোনো প্রকার কর দিতেন না। ফলত করভার সকলের উপর বা সব অঞ্চলের উপর সমান ছিল না। কর আদায়ের ব্যবস্থাও ছিল ত্রুটিপূর্ণ।
  2. কর প্রদানকারী – ফ্রান্সে আদায় করা মোট করের 96% কর দিতে হত তৃতীয় সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষকে। অপরদিকে মাত্র 4% কর দিত প্রথম ও দ্বিতীয় সম্প্রদায়।
  3. কর আদায় ব্যবস্থা – ফ্রান্সে কর আদায়ের ব্যবস্থাও ছিল ত্রুটিপূর্ণ। সরকার এককালীন কর আদায়ের জন্য কিছু রাজকর্মচারী (ফারমিয়ের জেনারেল) ও অভিজাতদের কর আদায়ের দায়িত্ব দিত। এই কর আদায়কারীরা প্রজাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট করের অতিরিক্ত কর আদায় করে নিত। বাড়তি কর আদায়ের জন্য তারা প্রজাদের উপর অকথ্য অত্যাচারও করত। বাণিজ্যশুল্ক আদায়কারী শুল্কবিভাগের কর্মচারীরা নানাভাবে সরকারের পাওনা আত্মসাৎ করত এবং বণিকদের উপর অত্যাচার চালাত।

এইসব কারণে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তৎকালীন ফ্রান্সকে ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর (Museum of Economic Errors) বলেও অভিহিত করেছিলেন।

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের সমাজ কয়টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল ও সেগুলি কী কী? সম্প্রদায়গুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। ফরাসি সমাজকাঠামো কেমন ছিল?

1789 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের জনসাধারণ তিনটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল –

  1. প্রথম সম্প্রদায় (First Estate)
  2. দ্বিতীয় সম্প্রদায় (Second Estate)
  3. তৃতীয় সম্প্রদায় (Third Estate)

প্রথম সম্প্রদায় (First Estate) – যাজকেরা ছিলেন প্রথম সম্প্রদায়ভুক্ত। ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার প্রায় 1% ছিলেন যাজক। এরা ভূমিকর, ধর্মকর, বিবাহকর, মৃত্যুকর প্রভৃতি আদায় করলেও সরকারকে স্বেচ্ছাকর ছাড়া অন্য কোনো কর দিতেন না। কর না দিলেও এরা রাষ্ট্রের সবরকম সুযোগসুবিধা ভোগ করতেন।

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের সমাজ কয়টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল ও সেগুলি কী কী? সম্প্রদায়গুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। ফরাসি সমাজকাঠামো কেমন ছিল ?

দ্বিতীয় সম্প্রদায় (Second Estate) – অভিজাতরা ছিলেন দ্বিতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় 1.5% ছিল অভিজাত সম্প্রদায়ভুক্ত। ফ্রান্সের মোট জমির 20% ছিল এদের দখলে। এরা প্রজাদের কাছ থেকে বিভিন্ন কর আদায় করলেও সরকারকে কোনো কর দিতেন না। এরাও ছিলেন সুবিধাভোগী শ্রেণির অন্তর্গত।

তৃতীয় সম্প্রদায় (Third Estate) – ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার 97%-এরও বেশি ছিল তৃতীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। এদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, চাকুরিজীবী, ডাক্তার, অধ্যাপক, শ্রমিক, মালিক, মজুর প্রমুখ। এঁরা রাষ্ট্র থেকে কোনো সুযোগসুবিধা পেতেন না, কিন্তু রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রকার কর দিতে বাধ্য ছিলেন। আর্থিক শোষণ থেকে মুক্তি লাভের জন্যই এরা 1789 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবে যোগ দিয়েছিলেন।

ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের সমাজকাঠামোয় প্রথম সম্প্রদায়ভুক্ত যাজকদের (Clergy) সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তর – ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ফ্রান্সের সমাজও ছিল মধ্যযুগীয় সমাজ। ফরাসি সমাজের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল শ্রেণিগত বৈষম্য।

সমাজের শ্রেণিবিভাগ –

বিপ্লব পূর্ববর্তী ফরাসি সমাজকাঠামোয় প্রথম সম্প্রদায়ভুক্ত যাজকদের (Clergy) সম্পর্কে আলোচনা করো।

প্রথম শ্রেণি – যাজক (Clergy) – ফরাসি সমাজে প্রথম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল যাজক শ্রেণি।

বিপ্লব পূর্ববর্তী ফরাসি সমাজকাঠামোয় প্রথম সম্প্রদায়ভুক্ত যাজকদের (Clergy) সম্পর্কে আলোচনা করো।

জনসংখ্যা – 1789 খ্রিস্টাব্দে যাজকদের মোট সংখ্যা ছিল 1 লক্ষ 20 হাজার। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার 1%-এরও কম।

অধিকার ও ক্ষমতা –

  • যাজকরা ছিলেন ফরাসি সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রবল প্রভাবশালী। তারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বিচার সবক্ষেত্রেই বিশেষ অধিকার ভোগ করতেন। যেমন –
    • ফ্রান্সের মোট কৃষিজমির 10% ছিল যাজকদের বা গির্জার দখলে। ফরাসি গির্জার বার্ষিক আয় ছিল 13 কোটি লিভর।
    • যাজকরা সরকারকে কোনো প্রকার কর দিতে বাধ্য ছিলেন না।
    • যাজকরা ফরাসি জনগণের কাছ থেকে টাইথ বা ধর্মকর, নামকরণকর, বিবাহকর, মৃত্যুকর প্রভৃতি আদায় করতেন।

যাজকদের শ্রেণিবিভাগ –

  • যাজকদের মধ্যেও দুটি শ্রেণি ছিল –
    1. উচ্চশ্রেণির যাজক
    2. নিম্নশ্রেণির যাজক

উচ্চশ্রেণির যাজক – উচ্চশ্রেণির যাজকদের মধ্যে ছিলেন আর্চবিশপ, বিশপ, অ্যাবট (মনাস্টরি বা মঠের অধ্যক্ষ), কার্ডিনাল প্রমুখ। এরা গির্জার আয়ের বেশিরভাগটাই ভোগ করতেন। আমোদ-প্রমোদ ও দুর্নীতিতে মগ্ন এই শ্রেণির যাজকরা নিম্নশ্রেণির যাজকদের ঘৃণা করতেন।

নিম্নশ্রেণির যাজক – নিম্নশ্রেণির যাজকদের মধ্যে ছিলেন গ্রামের সাধারণ পাদরিরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। বেতন হিসেবে এঁদের খুব সামান্য অর্থ দেওয়া হত। ব্যক্তিগত জীবনে এরা ছিলেন খুব সৎ ও নিষ্ঠাবান। 1789 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব শুরু হলে নিম্নশ্রেণির যাজকরা তৃতীয় শ্রেণির পক্ষে যোগদান করেছিলেন।

বিপ্লব পূর্ববর্তী ফরাসি সমাজে দ্বিতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত অভিজাতদের (Nobility) সম্পর্কে আলোচনা করো।

ফরাসি সমাজে দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত ছিলেন অভিজাতরা (Nobility)।

নসংখ্যা –

  • 1789 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে অভিজাতদের সংখ্যা ছিল 3 লক্ষ 50 হাজার। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার 1.5% বা দেড় ভাগ মাত্র।

ক্ষমতা ও অধিকার –

  • অভিজাতরা ছিলেন ফরাসি সমাজে সবচেয়ে প্রভাবশালী শ্রেণি। সরকারি প্রশাসন, বিচারবিভাগ ও চাকরি সবই ছিল তাদের দখলে।
  • ফ্রান্সের মোট কৃষিজমির 20% ছিল এদের দখলে। কিন্তু এর জন্য তারা সরকারকে কোনো ভূমিকর দিতেন না। উপরন্তু তারা প্রজাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর আদায় করতেন।

অভিজাতদের শ্রেণিবিভাগ –

  • অভিজাতদের মধ্যে দুটি শ্রেণি ছিল –
    1. জন্মসূত্রে অভিজাত (Nobility of the Sword)
    2. কর্মসূত্রে অভিজাত (Nobility of the Robe)
বিপ্লব পূর্ববর্তী ফরাসি সমাজে দ্বিতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত অভিজাতদের (Nobility) সম্পর্কে আলোচনা করো।

জন্মসূত্রে অভিজাত – জন্মসূত্রে অভিজাতদের দরবারি অভিজাত (Court Nobility), অসিধারী অভিজাত (Nobility of the Sword), সাবেকি অভিজাত বা নীলরক্তের অভিজাত বলা হত। এদের মধ্যে ছিলেন রাজার মন্ত্রী, সভাসদ, সেনাপতি প্রমুখ। এদের সংখ্যা ছিল মাত্র 4 হাজার। রাজদরবারের সব উচ্চপদে এদের অধিকার ছিল। এরা নিজেদের বংশকৌলীন্য নিয়ে গর্ববোধ করতেন এবং কর্মসূত্রে অভিজাতদের ও সমাজের তৃতীয় শ্রেণির মানুষদের ঘৃণা করতেন।

কর্মসূত্রে অভিজাত – সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের রাজারা অর্থের বিনিময়ে কিছু প্রশাসনিক পদ বিক্রি করেন। সমাজের তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্তরা এই পদগুলি নিয়ে অভিজাত হয়েছিলেন। এদের কর্মসূত্রে অভিজাত বা পোশাকি অভিজাত (Nobility of the Robe) বলা হত। এদের মধ্যে ছিলেন প্রশাসন, আইন এবং বিচারবিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা।

বিপ্লব পূর্ববর্তী ফরাসি সমাজে তৃতীয় সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোচনা করো।

ফরাসি সমাজে তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত ছিল যাজক ও অভিজাতরা বাদে সমগ্র ফরাসি জনগণ।

জনসংখ্যা – 1789 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই কোটি। এর মধ্যে প্রায় 96% মানুষ ছিল তৃতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত।

শ্রেণিবিভাগ – ফরাসি সমাজে তৃতীয় এস্টেট একটি সুগঠিত গোষ্ঠী ছিল না। শিক্ষিত ধনী থেকে শুরু করে সমাজের দরিদ্রতম মানুষ পর্যন্ত সকলেই ছিলেন তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত। তবে তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে অনেক উপশ্রেণি ছিল, যেমন – বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত, কৃষক, শ্রমিক, ভবঘুরে (সাঁকুলোৎ) প্রমুখ।

বুর্জোয়া (Bourgeoisie) – তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল বুর্জোয়ারা। বুর্জোয়ারা তিন ভাগে বিভক্ত ছিলেন –

  1. উচ্চ বুর্জোয়া – এই শ্রেণির মধ্যে ছিলেন বড়ো ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ব্যাংকমালিক প্রভৃতি।
  2. মধ্য বুর্জোয়া – এর মধ্যে ছিলেন চিকিৎসক, আইনজীবী, শিক্ষক, সাহিত্যিক, দার্শনিক প্রমুখ ব্যক্তিরা।
  3. নিম্ন বুর্জোয়া – এর মধ্যে ছিলেন ছোটো ব্যবসায়ী, দোকানদার, কারিগর, কৃষক, শ্রমিক প্রভৃতি।

কৃষক – তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে কৃষকরা ছিল সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার 80% ছিল কৃষক।

কৃষকদের শ্রেণিবিভাগ – কৃষকদের মধ্যে নানা ভাগ ছিল – স্বাধীন কৃষক, ভাগচাষি, খেতমজুর ও ভূমিদাস প্রভৃতি। ফরাসি সমাজে কৃষকরাই সবচেয়ে বেশি শোষিত হত। তারা সরকার, সামন্ত ও গির্জাকে নানা ধরনের কর দিতে বাধ্য হত।

থার্ড এস্টেট (Third Estate) বলতে কী বোঝায়?

পঞ্চদশ শতক থেকে সামাজিক গোষ্ঠী বোঝাতে এস্টেট (Estate) কথাটির প্রচলন শুরু হয়েছে। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের সমাজ তিনটি সম্প্রদায় বা এস্টেট (Estate)-এ বিভক্ত ছিল।

তিনটি এস্টেট –

  1. যাজক – প্রথম সম্প্রদায় বা ফার্স্ট এস্টেট।
  2. অভিজাত – দ্বিতীয় সম্প্রদায় বা সেকেন্ড এস্টেট।
  3. অন্যান্য সাধারণ মানুষ – তৃতীয় সম্প্রদায় বা থার্ড এস্টেট।

সামাজিক শ্রেণিকরণ – আবার আর্থিক অবস্থা ও সামাজিক মর্যাদার বিচারে ফরাসি সমাজ দুভাগে বিভক্ত ছিল –

  • সুবিধাভোগী শ্রেণি (Privileged Class) – এর মধ্যে ছিল যাজক ও অভিজাতরা।
  • সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণি (Non-Privileged Class) – এর মধ্যে ছিল তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষ।

থার্ড এস্টেটের জনসংখ্যা – 1789 খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার প্রায় 97% মানুষ ছিল থার্ড এস্টেটের বা তৃতীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।

থার্ড এস্টেটের স্তরবিন্যাস – থার্ড এস্টেটের মধ্যে তিনটি স্তর ছিল –

  • বুর্জোয়া (Bourgeoisie)
  • কৃষক (Peasants)
  • সাঁকুলোৎ (Sans-culottes)

থার্ড এস্টেটের গুরুত্ব – 1789 খ্রিস্টাব্দে আবে সিয়েস (Abbe Siyes) “What is the Third Estate?” নামে একটি বই লিখেছিলেন। এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন — সব, অর্থাৎ তৃতীয় সম্প্রদায় হল একটি সম্পূর্ণ জাতি।

থার্ড এস্টেট (Third Estate) বলতে কী বোঝায় ?

বুর্জোয়া (Bourgeoisie) — টীকা লেখো

বুর্জোয়া বা বুর্জোয়াসি (Bourgeoisie) কথার অর্থ হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণি। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে মেসাস বুর্জোয়াদের উদ্ভব সম্পর্কে বলেন যে, গ্রামের উদ্যমী ভাগ্যবান কৃষককুল শহরে গিয়ে শ্রমিক, কারিগর ও শিল্পদ্রব্য নির্মাতা হিসেবে বিত্তশালী হয়ে বুর্জোয়া নামে পরিচিত হয়।

শ্রেণিবিভাগ – বুর্জোয়া শ্রেণি তিন ভাগে বিভক্ত – 1. উচ্চ বুর্জোয়া, 2. মধ্য বুর্জোয়া ও 3. নিম্ন বুর্জোয়া।

উচ্চ বুর্জোয়া – ধনবান এই শ্রেণির মধ্যে ছিল পুঁজিপতি, ব্যাংকার, ঠিকাদার, পরোক্ষ কর আদায়কারী, বড়ো ব্যবসায়ী প্রমুখ।

মধ্য বুর্জোয়া – বুর্জোয়া শ্রেণির দ্বিতীয় স্তরে ছিল মধ্য বুর্জোয়া বা পেটি বুর্জোয়া। এদের মধ্যে ছিল মূলত বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী মানুষ। যেমন- শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, লেখক, সাংবাদিক, দার্শনিক, আইনজীবী, শিল্পী প্রমুখ।

নিম্ন বুর্জোয়া – বুর্জোয়া শ্রেণির তৃতীয় স্তরে ছিল নিম্ন বুর্জোয়া। এদের মধ্যে ছিল দোকানদার, কারিগর, শ্রমিক, ছোটো ব্যবসায়ী।

বুর্জোয়া শ্রেণি বিদ্যা, বুদ্ধি ও ধনবলে অভিজাতদের চেয়ে বলীয়ান ছিল, কিন্তু বংশকৌলীন্যের অভাবে সমাজে তাদের মর্যাদা ছিল কম। এই বুর্জোয়া শ্রেণি ফরাসি বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

সাঁকুলোৎ (Sans-culottes) বলতে কী বোঝায়?

সাঁকুলোৎ (Sans culottes) বলতে বোঝায় শহরের নীচুতলার দরিদ্র মানুষদের। এর আভিধানিক অর্থ হল যারা অন্তর্বাস পরে না অর্থাৎ ব্রিচেস বা কুলোং ছাড়া ট্রাউজার পরে যারা। এদের অধিকাংশই ছিল নিরক্ষর ও খেটে খাওয়া মানুষ।

এই সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল কারখানার শ্রমিক, মজুর, কারিগর, মুটে, মালি, চাকর, রাজমিস্ত্রি, কাঠুরে, জেলে, জলবাহক প্রমুখ।

সাঁকুলোৎদের জনসংখ্যা

1789 খ্রিস্টাব্দে প্যারিস শহরের অধিকাংশ মানুষ ছিল সাঁকুলোৎ সম্প্রদায়ভুক্ত।

সাঁকুলোৎ শ্রেণির বৈশিষ্ট্য

  • এরা শহরের নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করত।
  • এরা গা-গতরে কাজ করে পেট চালাত এবং কাজ না থাকলে ভিক্ষাও করত।
  • এদের মধ্যে অনেকে অসামাজিক কাজেও যুক্ত থাকত ও নানাভাবে গণ্ডগোল করত।
  • শহরের ধনী মানুষরা এদের ঘৃণা করত।
  • স্বার্থান্বেষী রাজনীতির লোকেরা এদের নানাভাবে ব্যবহার করত।

তবে বলা যায়, সাঁকুলোৎরাই 1781 খ্রিস্টাব্দের 14 জুলাই বাস্তিল দুর্গের পতন থেকে শুরু করে নানাভাবে ফরাসি বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

ফরাসি বিপ্লবে সাঁকুলোৎদের (Sans culottes) ভূমিকা কী ছিল?

সাঁকুলোৎ কথাটির আভিধানিক অর্থ হলো যারা অন্তর্বাস পরে না। শহরের নিম্নবিত্ত এইসব মানুষরা ছিল দরিদ্র ও নিরক্ষর। দিনমজুর, জলবাহক, কাঠুরে, কারিগর, শিক্ষানবিশ, মুটে, মালি, রাজমিস্ত্রি, জেলে, গৃহভৃত্য প্রমুখ সাধারণ মানুষ ছিল এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।

ফরাসি বিপ্লবে সাঁকুলোৎদের অবদান – সাঁকুলোৎসহ নিম্নবর্গের ফরাসি জনগণ বিপ্লবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। বাস্তিল দুর্গের পতনের ক্ষেত্রে সাঁকুলোৎ জনতাই প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল। এ ছাড়া রাজা ও রানিকে প্যারিসে আনা, যাজক, অভিজাত, প্রতি-বিপ্লবীদের সম্পত্তি লুঠপাটসহ বিবিধ হিংসাশ্রয়ী ও নাশকতামূলক কাজকর্মের মাধ্যমে সাঁকুলোৎরা বিপ্লবের তেজ ও গতি বৃদ্ধি করেছিল। উল্লেখ্য, সাঁকুলোৎদের অংশগ্রহণের ফলে বিপ্লব তার বুর্জোয়া চরিত্র ছেড়ে গণচরিত্র লাভ করেছিল।

সর্বোপরি সাঁকুলোৎ ও জাকোবিন দলের মৈত্রীর ফলে সংগঠিত সন্ত্রাসের শাসন বিপ্লব ও দেশকে সাময়িকভাবে রক্ষা করেছিল।

দৈব রাজতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? ফরাসি রাজতন্ত্র কি দৈব রাজতন্ত্র ছিল?

দৈব রাজতন্ত্র – যে রাজতন্ত্রে রাজারা নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে মনে করতেন, ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন এবং নিজেরা ইচ্ছানুসারে সীমাহীন স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে দেশশাসন করতেন, তাকে দৈব রাজতন্ত্র বলা হয়।

ফরাসি রাজতন্ত্র – ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজতন্ত্রকে দৈব রাজতন্ত্র বলা যায়। কারণ –

  • রাজারা ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাসী – ফ্রান্সের রাজারা ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন। ফরাসি প্রশাসনে জনগণের মতামতের কোনো মূল্য ছিল না। রাজা তাঁর কাজের জন্য কারোর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিলেন না।
  • স্বৈরাচারী শাসন – ফ্রান্সের রাজারা নিজ ইচ্ছানুসারে স্বৈরাচারের মাধ্যমে দেশশাসন করতেন। তাঁরা ছিলেন দেশের সর্বোচ্চ শাসক, আইনপ্রণেতা ও বিচারক। রাজাদের ইচ্ছাই ছিল আইন।
  • সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী – সম্রাট চতুর্দশ লুই (Louis XIV) বলেছিলেন, আমিই রাষ্ট্র (I am the State)। দাম্ভিক সম্রাট ষোড়শ লুই (Louis XVI) বলতেন, আমি যা ইচ্ছা করি তাই আইন (It is legal because I wish it)।

বিরুদ্ধ মত – ফরাসি সম্রাট দৈবক্ষমতা দাবি করলেও বাস্তবে তাঁর ক্ষমতা ছিল সীমিত। কারণ রাজকীয় ক্ষমতার উপর ফ্রান্সের 13টি প্রাদেশিক সভা বা পার্লামেন্টের সীমাহীন প্রভাব ছিল। রাজা কোনো আদেশ জারি করলে সেই আদেশকে প্রাদেশিক সভার অনুমোদন পেতে হত। অনুমোদন না পেলে তা প্রদেশে কার্যকর হত না।

প্রাদেশিক সভার সদস্য যাজক ও অভিজাতরা বিরোধিতা করলে রাজা কিছু করতে পারতেন না। সে ক্ষেত্রে রাজকীয় আইনও কার্যকর করা যেত না। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ডেভিড থমসন (David Thomson) বলেছেন যে, ফরাসি রাজতন্ত্র ছিল আসলে সামন্ত রাজতন্ত্র (The French monarchy was a feudal monarchy)।

ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে কোন্ বংশ রাজত্ব করত? বিপ্লবের জন্য এই বংশ কীভাবে দায়ী ছিল?

1789 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে বিপ্লবের সময় বুরবোঁ রাজবংশ রাজত্ব করত। ফরাসি বিপ্লবের জন্য মাঁদেলা প্রমুখ ঐতিহাসিক ফরাসি রাজতন্ত্রকেই দায়ী করেছেন। তাঁরা বুরবোঁ শাসকদের দুর্বলতা, অস্থির মনোভাব ও অদূরদর্শিতাকে এই বিপ্লবের মূল কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন।

বুরবোঁ রাজতন্ত্রের দায়িত্ব –

  • স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র – চতুর্দশ লুই (Louis XIV) থেকে ষোড়শ লুই (Louis XVI) পর্যন্ত সকল বুরবোঁ বংশীয় শাসকই ছিলেন স্বৈরাচারী। এঁদের শাসনের কোনো গণভিত্তি ছিল না।
  • রাজন্যবর্গের দুর্বলতা – রাজা চতুর্দশ লুই, পঞ্চদশ লুই প্রমুখ ছিলেন বিলাসী, অলস ও পরিশ্রমবিমুখ। শাসনকার্যে এঁদের দুর্বলতার সুযোগে রাজকর্মচারীরা দেশে যথেচ্ছাচার শুরু করেছিল।
  • প্রশাসনিক ত্রুটি – বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে বুরবোঁ শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। লেতর দ্য ক্যাশে (Lettres de cachet)-এর অপব্যবহার, ইনটেনডেন্ট (Intendent) নামক রাজস্ব আদায়কারীদের শোষণ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল।
  • বিপ্লবের অনিবার্যতা – রাজন্যবর্গের যুদ্ধনীতি, বিলাসব্যসন, অমিতব্যয়িতা প্রভৃতির ফলে বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্স চরম অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়। সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য রাজা ষোড়শ লুই তুর্গো, নেকার, ক্যালোন, ব্রিয়া প্রমুখ অর্থমন্ত্রীর সাহায্যে বিভিন্ন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু স্বার্থান্বেষী অভিজাতদের বিরোধিতার ফলে তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি স্টেটস্ জেনারেলের অধিবেশন আহ্বান করলে বিপ্লব অনিবার্য হয়ে ওঠে।

উপরোক্ত কারণগুলির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় — ফরাসি বিপ্লবের জন্য বুরবোঁ রাজবংশের নানাবিধ অযোগ্যতা অন্যতম কারণ হলেও একমাত্র কারণ নয়। সামাজিক বৈষম্য, দুর্নীতিগ্রস্ত চার্চ, স্বার্থান্বেষী অভিজাত শ্রেণি, বুর্জোয়া শ্রেণির বিপ্লবমনস্কতার সঙ্গে বুরবোঁ রাজবংশের ভূমিকা একত্রিত হয়ে 1789 খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করেছিল।

টীকা লেখো – অভিজাত বিদ্রোহ –

অথবা, অভিজাতরা কেন বিদ্রোহ করেছিল?

ষোড়শ লুই 1774 খ্রিস্টাব্দে রাজা হওয়ার পর লক্ষ করেন যে, ফ্রান্সের রাজকোশ একেবারে শূন্য হয়ে পড়েছে। তিনি তুর্গো, নেকার, ক্যালোন, ব্রিয়া প্রমুখ অর্থমন্ত্রী নিয়োগ করে এই আর্থিক সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করলে অভিজাতরা রাজার বিরোধিতা করেন।

প্রেক্ষাপট –

অভিজাতদের বিরোধিতার ফলে রাজা বাধ্য হয়ে তাদের হাত থেকে আইন এবং কর সংক্রান্ত অধিকার কেড়ে নেন। এর ফলে ফ্রান্সের নানা স্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয়।

  • অভিজাতরা অর্থমন্ত্রী ব্রিয়াঁর কর আদায় সংক্রান্ত কয়েকটি প্রস্তাব মেনে নিলেও স্ট্যাম্পকর ও ভূমিকরের প্রস্তাব বাতিল করে দেন। তারা দাবি করেন যে, একমাত্র স্টেট্স জেনারেলের কর আরোপের অধিকার আছে।
  • ষোড়শ লুই পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যের আচরণে উত্যক্ত হয়ে নিজের ভাই ডিউক অফ অর্লিয়েন্স-সহ তিনজন সদস্যকে নির্বাসিত করেন। এতে পার্লামেন্ট ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং অভিজাতরা রাজার বিরুদ্ধে কয়েকটি আইন পাস করে ইচ্ছামতো নাগরিকদের গ্রেফতার, বিচারকদের অপসারণ প্রভৃতি বিষয়ে রাজার ক্ষমতা কেড়ে নেয়।
  • পার্লামেন্টের আইনে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজা সমস্ত প্রদেশের পার্লামেন্টগুলি মুলতুবি করেন এবং 57টি নতুন বিচারালয় স্থাপন করে নিজের প্রস্তাবিত সংস্কারগুলিকে আইনে পরিণত করেন।

বিদ্রোহের সূচনা –

রাজা পার্লামেন্ট মুলতুবি করলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিজাতরা বিদ্রোহ শুরু করে দেন। রাজার বিরুদ্ধে অভিজাতদের বিদ্রোহে শীঘ্রই যাজক ও বুর্জোয়ারাও শামিল হন। ফলে অভিজাত বিদ্রোহ গণবিদ্রোহের আকার ধারণ করে। পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক সভা এই বিদ্রোহকে সমর্থন জানায়। এই অভিজাত বিদ্রোহ থেকেই 1789 খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়।

গুরুত্ব –

বুরবোঁ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অভিজাতদের বিদ্রোহ ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা। রাজা শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীদের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হন।

  • এই অভ্যুত্থানে সুবিধাভোগী শ্রেণি রাজার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। বুর্জোয়াদের সমর্থনে অভিজাত বিদ্রোহ রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়।
  • অভিজাত বিদ্রোহের চাপে রাজা স্টেট্স জেনারেলের অধিবেশন ডাকতে বাধ্য হন। ফলে রাজার স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের মর্যাদায় আঘাত লাগে।
  • রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতা ও স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

ফিজিওক্র্যাট (Physiocrats) মতবাদের প্রবক্তা কারা? এই মতবাদের মূল কথা কী?

অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে ফিজিওক্র্যাট (Physiocrats) নামে এক শ্রেণির অর্থনীতিবিদদের আবির্ভাব হয়। ফিজিওক্র্যাট কথাটির উদ্ভাবক ছিলেন নেমুর।

ফিজিওক্র্যাট (Physiocrats) মতবাদের প্রবক্তা –

ফিজিওক্র্যাট মতবাদের প্রবক্তা বা উদ্‌গাতা হলেন ফাঁসোয়া কুয়েসনে (Quesnay, 1694-1774 খ্রিস্টাব্দ)। ইংল্যান্ডে এই মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith, 1723-1790 খ্রিস্টাব্দ)। তিনি তাঁর দ্য ওয়েলথ অফ নেশনস (The Wealth of Nations) গ্রন্থে অবাধ বাণিজ্য নীতির ধারণা ব্যক্ত করেন। ফরাসি অর্থনীতিবিদরা ছিলেন তাঁর ভাবশিষ্য।

ফিজিওক্র্যাট মতবাদের মূল কথা –

  • ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ – এই মতবাদে বলা হয় মানুষ নিজেই তার স্বার্থরক্ষার সবচেয়ে বড়ো বিচারক। মানুষের অর্থনৈতিক কাজে সরকারের নিয়ন্ত্রণ অন্যায়।
  • অবাধ বাণিজ্য – এই মতবাদের মূল কথা অবাধ বাণিজ্য। এজন্য অভ্যন্তরীণ শুল্কনীতির বিরোধিতা এবং খোলাবাজার নীতিকে সমর্থন করা হয়।
  • ভূমিকর প্রদান – এই মতবাদে বলা হয়, জমি হলো সমস্ত সম্পদের উৎস। তাই প্রত্যেক জমির মালিকের ভূমিকর দেওয়া উচিত। ফ্রান্সের যাজক, অভিজাত, বুর্জোয়া সকলকেই ভূমিকর দিতে হবে।

টেনিস কোর্টের শপথ (Tennis Court Oath) — টীকা লেখো –

অথবা, টেনিস কোর্ট শপথ বলতে কী বোঝো?

ফরাসি বিপ্লবের সূচনাপর্বের অন্যতম প্রধান ঘটনা ছিল টেনিস কোর্টের শপথ। 1789 খ্রিস্টাব্দের 20 জুন ফ্রান্সের জাতীয় সভার (স্টেটস্ জেনারেল) প্রতিনিধিরা টেনিস কোর্টের মাঠে সমবেত হয়ে যে শপথগ্রহণ করেছিলেন, তা টেনিস কোর্টের শপথ নামে পরিচিত।

পটভূমি –

ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুই 1789 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় সভার অধিবেশন আহ্বান করেন। এই অধিবেশনে তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা শ্রেণিভিত্তিক ভোটদানের পরিবর্তে মাথাপিছু ভোটদানের অধিকার দাবি করেন। সম্রাট ষোড়শ লুই তৃতীয় শ্রেণির দাবি নাকচ করে দেন। তখন তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা মিরাব্যুৎ, লাফায়েৎ ও আবে সিয়েসের নেতৃত্বে পাশের টেনিস কোর্টের মাঠে সমবেত হয়ে শপথগ্রহণ করেন।

শপথ –

তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা টেনিস কোর্টের মাঠে শপথ নিয়েছিলেন যে — ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনা না করা পর্যন্ত তারা এই স্থান ত্যাগ করবেন না। তাদের দাবি ছিল —

  1. তৃতীয় শ্রেণির সদস্যদের মাথাপিছু ভোটের দাবি মেনে নিতে হবে,
  2. তাদের একটি নতুন সংবিধান রচনার অধিকার দিতে হবে।
 টাকা লেখো : টেনিস কোর্টের শপথ (Tennis Court Oath)। অথবা, 'টেনিস কোর্ট শপথ' বলতে কী বোঝো?

ফলাফল –

টেনিস কোর্টের শপথের ফলে প্রথম দুই এস্টেট গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে এবং ফরাসি জাতির নেতৃত্ব গ্রহণ করে তৃতীয় এস্টেটের প্রতিনিধিরা। তৃতীয় শ্রেণির সদস্যদের মাথাপিছু ভোট ও নতুন সংবিধান রচনার দাবি সম্রাট ষোড়শ লুই শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হন এবং 27 জুন পুনরায় জাতীয় সভার অধিবেশন আহ্বান করেন। ফলে ফরাসি বিপ্লবের পথ সুগম হয়। অনেক ঐতিহাসিক টেনিস কোর্টের শপথকে ফরাসি বিপ্লবের সূচনাপর্ব বলে অভিহিত করেছেন।

ফরাসি জনতা কেন বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে?

অথবা, বাস্তিল দুর্গের পতন (Fall of Bastille) — টীকা লেখো

বাস্তিল দুর্গ ছিল ফরাসি রাজতন্ত্রের অত্যাচারের অন্যতম কেন্দ্র। এই দুর্গে রাজতন্ত্রের বিরোধী ব্যক্তিদের বন্দি করে রাখা হত ও অত্যাচার করা হত। তাই জনগণের কাছে বাস্তিল দুর্গ ছিল ফরাসি রাজতন্ত্রের অত্যাচারের প্রতীক। 1789 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের বিদ্রোহী জনগণ বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে ধ্বংস করেছিল।

বাস্তিল দুর্গের পতনের কারণ –

খাদ্যদ্রব্যের মূল্য হ্রাস ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠা জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য প্যারিস নগর কর্তৃপক্ষ তাদের উপর আক্রমণ চালায়। সেইসঙ্গে সম্রাট ষোড়শ লুই-এর জনপ্রিয় অর্থমন্ত্রী নেকার (Necker)-কে পদচ্যুত করার সংবাদে জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ফলে শহরের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ বাধে। উম্মত্ত জনতা অধিক আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের জন্য স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে।

ফরাসি জনতা কেন বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে? অথবা, টীকা লেখো : বাস্তিল দুর্গের পতন (Fall of Bastille)

বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ ও ধ্বংস –

প্যারিস শহরের উত্তেজিত জনতা 1789 খ্রিস্টাব্দের 14 জুলাই কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গ দখল করে ধ্বংস করে দেয়। সমস্ত বন্দিরাও মুক্তি পায়।

ফলাফল –

বাস্তিল দুর্গের পতনের ফলে –

  • রাজা ষোড়শ লুই-এর স্বৈরশাসনের অবসান হয়।
  • রাজা জাতীয় পরিষদকে স্বীকৃতি দেন এবং এই সময় থেকে রাষ্ট্রের প্রকৃত ক্ষমতা আইনসভার হাতে চলে যায়।
  • ফ্রান্সের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সূচনা হয় এবং অভিজাততন্ত্রের পতন আসন্ন হয়ে ওঠে। প্রায় 20 হাজার অভিজাত দেশত্যাগী হয়।
  • বাস্তিলের পতন কৃষক বিদ্রোহে ইন্ধন জোগায়, সামন্ততন্ত্রের পতনের পথ প্রস্তুত এবং পৌরবিপ্লবেরও সূচনা করে। ঐতিহাসিক গুডউইন (Goodwin) বলেন, “বাস্তিলের পতনের মতো বিপ্লবের আর কোনো ঘটনার এত বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল না।”

উল্লেখ্য, ফরাসি বিপ্লবের সময়ের এই ঘটনাগুলো ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এসব ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি।

ফ্রান্সের বাস্তিল দুর্গের পতন গুরুত্বপূর্ণ কেন?

অথবা, ফ্রান্সের স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ ধ্বংসের গুরুত্ব কী ছিল?

ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই পুরাতনতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে জনপ্রিয় অর্থমন্ত্রী নেকারকে পদচ্যুত করে প্যারিস ও ভার্সাই-এ সেনা মোতায়েন করলে জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। 1789 খ্রিস্টাব্দের 14 জুলাই উত্তেজিত জনতা প্যারিসের কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গ দখল এবং ধ্বংস করে। বাস্তিল দুর্গের পতন ইতিহাসের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

অথবা, ফ্রান্সের স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ ধ্বংসের গুরুত্ব কী ছিল ?

গুরুত্ব –

  • বাস্তিল দুর্গ ছিল ফ্রান্সের স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক। এই বিশাল দুর্গে রাজা ও রাজতন্ত্রের বিরোধী ব্যক্তিদের বন্দি করে রাজা তাঁর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব জাহির করতেন। দার্শনিক ভলতেয়ারও রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার জন্য বাস্তিল দুর্গে বন্দি ছিলেন। বাস্তিল দুর্গের পতনের ফলে ফরাসি রাজতন্ত্রের শক্তি ও প্রতিরোধ ক্ষমতার অবসান স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
  • ফরাসি রাজতন্ত্রের গর্বের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ ধ্বংসের ঘটনা ফরাসি বিপ্লবকে অনেকগুলি ধাপ অতিক্রম করতে সাহায্য করে।
  • বাস্তিল দুর্গের পতন প্রমাণ করেছিল যে রাজধানী প্যারিসের উপর ফরাসি সম্রাটের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
  • বাস্তিল দুর্গের পতনের পর ফ্রান্সের রাজা ও অভিজাতরা তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলে।
  • বাস্তিল দুর্গের পতনের পর রাজধানী প্যারিস শহরের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে বিপ্লবীদের হাতে চলে যায়।

বিপ্লবীরা প্যারিস কমিউন (Paris Commune) গঠন করে প্যারিসে পৌরশাসন পরিচালনা করে। এর অনুকরণে ফ্রান্সের অন্যান্য শহরেও কমিউন ও পৌর পরিষদ গড়ে ওঠে।

ঐতিহাসিক গুডউইন (Goodwin) বলেছেন যে, “বাস্তিল দুর্গের পতন কেবল ফ্রান্সে নয়, বিশ্বের ইতিহাসে এক নতুন স্বাধীনতার জন্ম দিয়েছিল।” (The fall of the fortress was widely acclaimed as heralding a new birth of liberty, not only in France, but throughtout the world.)

ফ্রান্সের জাতীয় সভা (National Assembly) কীভাবে সংবিধান সভায় (Constituent Assembly) পরিণত হয়?

অথবা, জাতীয় সভা বা সংবিধান সভা কেন গঠিত হয়েছিল?

জাতীয় সভা বা সংবিধান সভা

1789 খ্রিস্টাব্দের 5 মে স্টেটস্ জেনারেলের (States General) অধিবেশন শুরু হয়। এই সময় থেকে ছয় সপ্তাহ তিনটি সম্প্রদায়ের (এস্টেটের) পৃথক পৃথক অধিবেশন হয়।

অধিবেশনের শুরু থেকেই তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা 1. তিনটি সম্প্রদায়ের যৌথ অধিবেশন ও 2. সদস্যদের মাথাপিছু ভোটের অধিকার দাবি করে।

20 জুন টেনিস কোর্টের শপথের মাধ্যমে ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনা করার কথা বলা হয়। 23 জুন রাজা তিন সম্প্রদায়ের যৌথ রাজকীয় অধিবেশন ডাকেন। এই অধিবেশনে রাজা ঘোষণা করেন- 1. তৃতীয় সম্প্রদায়ের সব দাবি অবৈধ এবং 2. তিনটি সম্প্রদায়কে পৃথক পৃথক সভাকক্ষে বসতে হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা রাজার নির্দেশ মেনে পৃথক পৃথক সভাকক্ষে চলে গেলেও তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা রাজার নির্দেশ অস্বীকার করে সেখানেই বসে থাকে। তারা ঘোষণা করেন, তৃতীয় শ্রেণির সভাই হল প্রকৃত জাতীয় সভা। 27 জুন রাজা ভীত হয়ে তিন সম্প্রদায়ের যৌথ অধিবেশন ও সদস্যদের মাথাপিছু ভোটের দাবি মেনে নেন। তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবি রাজার মেনে নেওয়ার কারণ ছিল – যাজক ও অভিজাতদের অনেক সদস্য তৃতীয় সম্প্রদায়কে সমর্থন করেছিল। এই সময় খবর রটেছিল যে রাজা তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবি না মানলে 40 হাজার সাধারণ মানুষ রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করবে। ফলে 27 জুন থেকে তিন সম্প্রদায়ের যৌথ অধিবেশন শুরু হয়।

9 জুলাই জাতীয় সভা ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনা করার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তাই 9 জুলাই থেকে জাতীয় সভা (National Assembly) জাতীয় সংবিধান সভায় (National Constituent Assembly) পরিণত হয়।

ফ্রান্সের ইতিহাসে 1789 খ্রিস্টাব্দের 4 আগস্ট কেন গুরুত্বপূর্ণ?

অথবা, ফ্রান্সে সামন্ত প্রথার (Feudalism) বিলোপ কবে ও কীভাবে হয়?

ফরাসি বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে রাজা ষোড়শ লুই তৃতীয় সম্প্রদায় তথা জাতীয় সভার উপর সংবিধান রচনার দায়িত্ব অর্পণ করলে জাতীয় সভা সংবিধান সভায় (Constituent Assembly) রূপান্তরিত হয়। সংবিধান সভা সংবিধান রচনার কাজ শুরু করার পূর্বে দুটি উল্লেখযোগ্য কাজ করে। প্রথমটি 4 আগস্টের ঘোষণা এবং দ্বিতীয়টি হল 26 আগস্টের ঘোষণা।

ফ্রান্সের ইতিহাসে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট কেন গুরুত্বপূর্ণ?

4 আগস্টের ঘোষণা

1789 খ্রিস্টাব্দের 4 আগস্ট জাতীয় সভার অধিবেশনে ফ্রান্সে সামন্ত প্রথার বিলোপ করা হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সামন্ত প্রথার অবলুপ্তির ফলে ফ্রান্সে ভূমিদাস প্রথা, বেগার শ্রম বা করভি প্রথা, সামন্ত কর, ম্যানর কর, ধর্মকর, অভিজাতদের বিশেষ অধিকার যথা সরকারি চাকুরিতে অগ্রাধিকার, আইনের হাত থেকে অব্যাহতি, বৈষম্যমূলক কর, অন্তঃশুল্ক প্রথা প্রভৃতি লোপ পায়। 4 আগস্টের ঘোষণা কার্যত ফ্রান্সে সামন্ত প্রথার মৃত্যুঘণ্টা বাজায়, ক্ষতিপূরণ সাপেক্ষে অভিজাতদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ফলে জমিদার ও গির্জার বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি কৃষকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

তবে 4 আগস্টের ঘোষণা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত ছিল না, 1789 খ্রিস্টাব্দের 7 নভেম্বর ঘোষণার দ্বারা সংবিধান সভা সেগুলি সংশোধন করে।

সংবিধান সভা (Constituent Assembly) কবে, কাদের নিয়ে গঠিত হয়? এই সভার কৃতিত্ব লেখো।

গঠন

সংবিধান সভা তৃতীয় সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে 1789 খ্রিস্টাব্দের 9 জুলাই গঠিত হয়।

সংবিধান সভার কৃতিত্ব

সংবিধান সভা ফ্রান্সের জন্য একটি সংবিধান রচনা করেছিল। তবে সংবিধান রচনার পূর্বে সংবিধান সভা দুটি উল্লেখযোগ্য কাজ করে —

সামন্ত প্রথার অবসান – 1789 খ্রিস্টাব্দের 4 আগস্ট সংবিধান সভা এক প্রস্তাবের মাধ্যমে সামন্ত প্রথার বিলুপ্তির কথা ঘোষণা করে। এর ফলে অভিজাতদের সমস্ত সুযোগসুবিধাগুলি লোপ পায়।

মানবিক ও নাগরিক অধিকারের ঘোষণা – 1789 খ্রিস্টাব্দের 26 আগস্ট সংবিধান সভা ব্যক্তি-নাগরিকের অধিকার ঘোষণা করে। এতে বলা হয় – 1. স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার এবং সব মানুষের অধিকার সমান, 2. আইনের চোখে সবাই সমান ইত্যাদি।

নতুন সংবিধান – সংবিধান সভা ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনা করেছিল। এই সংবিধানে 1. রাজার ক্ষমতা হ্রাস করে আইনসভাকে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রদান করা হয়। 2. সামন্ত প্রভুদের বিচারালয়গুলি তুলে দিয়ে বিচারবিভাগকে পুনর্গঠিত করা হয়, 3. আইন, বিচার ও শাসন বিভাগকে পৃথক করে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা হয় ইত্যাদি।

মানুষ ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণা (Declaration of the Rights of Man and the Citizen) কেন স্মরণীয়?

অথবা, মানুষ ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণায় (Declaration of the Rights of Man and the Citizen) কী বলা হয়েছে? এর গুরুত্ব কী?

অথবা, ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণা – টীকা লেখো।

ফরাসি সংবিধান সভার (Constituent Assembly) একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল 1789 খ্রিস্টাব্দের 26 আগস্ট “মানুষ ও নাগরিকের অধিকার ঘোষণা”। এই ঘোষণাপত্রটি ইংল্যান্ডের বিল অফ রাইটস (1689 খ্রি.), আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (1776 খ্রি.) এবং অষ্টাদশ শতকের দার্শনিক মতবাদের ভিত্তিতে রচিত। এটিকে 1791 খ্রিস্টাব্দের সংবিধানের ভূমিকা বা মুখবন্ধ বলা হয়।

মানুষ ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণা (Declaration of the Rights of Man and the Citizen ) কেন স্মরণীয়?

মানুষ ও নাগরিক অধিকার ঘোষণা

এই ঘোষণাপত্রে বলা হয় –

  1. মানুষের জন্মগত অধিকার হল স্বাধীনতা।
  2. আইনের চোখে সকলেই সমান।
  3. রাষ্ট্রের প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হল জনগণ।
  4. রাজপদে নিয়োগের মাপকাঠি হল যোগ্যতা – বংশমর্যাদা নয়।
  5. বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি হল মানুষের সর্বজনীন অধিকার।

সীমাবদ্ধতা

ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার ঘোষণাপত্রের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। যেমন- এতে সামাজিক সাম্য ও অর্থনৈতিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। শিক্ষার অধিকার সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। তা ছাড়া নাগরিকের অধিকারের কথা বলা হলেও তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য বিষয়ে এই ঘোষণাপত্র ছিল সম্পূর্ণ নীরব।

গুরুত্ব

কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণাপত্রের গুরুত্বকে মোটেই অস্বীকার করা যায় না। এই ঘোষণাপত্রে শুধু ফ্রান্সের জনগণ নয় — সমগ্র মানবজাতির অধিকারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। ঐতিহাসিক ওলার (Aulard) বলেছেন যে, এই ঘোষণাপত্রটি ছিল “পুরাতনতন্ত্রের মৃত্যু পরোয়ানা”। (The Declaration was a death certificate of the Old Regime)। লর্ড অ্যাকটন (Lord Acton) বলেছেন, এটি “নেপোলিয়নের সমগ্র বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী ছিল” (Stronger than all the armies of Napoleon)।

সংবিধান সভার (Constituent Assembly) কয়েকটি দুর্বলতা লেখো।

ফরাসি সংবিধান সভা গঠিত হয়েছিল 1789 খ্রিস্টাব্দে।

সংবিধান সভার দুর্বলতা

সংবিধান সভা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ও সামন্ত প্রথার অবসান ঘটিয়ে ব্যক্তি নাগরিকের অধিকার ঘোষণার মাধ্যমে ফ্রান্সের ইতিহাসে নবযুগের সূচনা করলেও এর বেশ কিছু দুর্বলতা লক্ষ করা যায়।

  1. সংবিধান সভা নাগরিকদের দু-ভাগে বিভক্ত করে কেবলমাত্র সম্পত্তিবান সক্রিয় নাগরিকদেরই ভোটাধিকার প্রদান করেছিল, যা ছিল গণতন্ত্র ও সাম্যনীতির বিরোধী।
  2. নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাদেশিক শাসক, জুরি, বিচারক প্রমুখের নিয়োগের ফলে প্রশাসনে অযোগ্য লোকের সমাগম হয়। এর ফলে শাসনব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
  3. নতুন সংবিধানে রাজা পান ক্ষমতাহীন দায়িত্ব আর আইনসভা পায় দায়িত্বহীন ক্ষমতা। এর ফলে প্রশাসন ও আইনবিভাগের মধ্যে দেখা দিয়েছিল বিশৃঙ্খলা।
  4. চার্চের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এবং আমানত হিসেবে রেখে অ্যাসাইনেট (Assignat) নামক কাগজী মুদ্রার প্রচলন করা হলে বহু ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি বিপ্লব থেকে সরে দাঁড়ান।
  5. সমগ্র ফ্রান্সকে কতকগুলি জেলা, প্রদেশ ও কমিউনে বিভক্ত করার ফলে প্রশাসনে এক ধরনের আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যবোধের সৃষ্টি হয়েছিল।

সংবিধান সভা দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষদের অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটাতে পারেনি। লেভেবর (Lefebvre)-এর ভাষায়, নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের কথা বললেও সংবিধান সভা আসলে বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্র স্থাপন করে, কিন্তু এটি ছিল প্রকৃত সরকার ব্যতীত এক প্রজাতন্ত্র। (This constitutional monarchy was a bourgeois republic but it was a republic with no real government)।

ফ্রান্সের নতুন আইনসভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয় দাও।

1791 খ্রিস্টাব্দে সংবিধান সভার কাজ শেষ হলে ওই সভা সেপ্টেম্বর মাসে ভেঙে দেওয়া হয় এবং নির্বাচনী আইন অনুসারে সক্রিয় নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে নতুন আইনসভা গঠিত হয়। 1791 খ্রিস্টাব্দের 1 অক্টোবর 744 জন সদস্যবিশিষ্ট এই আইনসভার প্রথম অধিবেশন বসে।

রাজনৈতিক দলসমূহ

নতুন আইনসভায় প্রধানত চারটি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল। যথা – 1. দক্ষিণপন্থী শাসনতান্ত্রিক দল, 2. জিরন্ডিন দল, 3. জোকোবিন দল এবং 4. মধ্যপন্থী দল।

  • দক্ষিণপন্থী শাসনতান্ত্রিক দল – ফিউল্যান্ট নামে পরিচিত এই দক্ষিণপন্থী দল আইনসভায় স্পিকারের ডানদিকে অর্থাৎ দক্ষিণদিকে বসত। এই দলের সদস্যসংখ্যা ছিল 264 জন। রাজতন্ত্র, অভিজাত সম্প্রদায় ও যাজকদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং বিপ্লব-বিরোধী এই দল সংবিধান অনুযায়ী রাজার ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখার পক্ষে ছিল। দেশত্যাগী অভিজাতদের ফিরিয়ে আনা এবং ধর্মযাজকদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াকে এই দল সমর্থন করত। বার্নাভ ছিলেন এই দলের নেতা।
  • জিরন্ডিন দল – এই গোষ্ঠীর সদস্যরা ফ্রান্সের জিরন্ড প্রদেশ থেকে আগত বলে তাদের নাম হয় জিরন্ডিস্ট। এরা স্পিকারের বামদিকে বসত বলে বামপন্থী নামেও পরিচিত ছিল। এরা প্রজাতন্ত্রী আদর্শে বিশ্বাসী ছিল। ডুমারিয়েজ ছিলেন এই দলের অন্যতম নেতা। গ্রামাঞ্চলে এই দলের ব্যাপক প্রভাব ছিল।
  • জোকোবিন দল – জোকোবিনরা ছিল উগ্র বামপন্থী দল, যারা রাজতন্ত্রবিরোধী ও প্রজাতন্ত্রের সমর্থক। এরা মাউন্টেন গোষ্ঠী নামেও পরিচিত ছিল। কারণ তারা আইনসভায় উঁচুদিকের আসনে বসত। সারা দেশে প্রায় 2000 শাখা এই দলের সংগঠনকে মজবুত করে তুলেছিল। রোবসপিয়র ছিলেন এই গোষ্ঠীর অন্যতম নেতা। কারিগর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নিম্ন বুর্জোয়ারা ছিলেন এই দলের প্রধান সমর্থক।
  • মধ্যপন্থী দল – মধ্যপন্থী দল ছিল নিরপেক্ষ। অর্থাৎ এই দলের সদস্যরা কোনো দল বা মতের সমর্থক ছিল না। এই দলের সদস্যরা আইনসভার মাঝখানে বসত এবং বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীনভাবে নিজেদের মতামত প্রকাশ করত।

আধুনিক যুগে বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী সম্পর্কে ধারণা বিপ্লবের এই চিন্তাধারা থেকেই উদ্ভূত।

ফ্রান্সে বিপ্লবী সরকারের আমলে অভ্যন্তরীণ সংকটের পটভূমি কী ছিল? এর মোকাবিলার জন্য কী ধরনের শাসন কায়েম করা হয়?

ফরাসি বিপ্লব চলাকালে ফ্রান্সের অভ্যন্তরেও বিপ্লববিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এর ফলে ফরাসি প্রজাতান্ত্রিক সরকার এক জটিল সংকটের মুখে পড়েছিল।

সংকটের কারণ

  • ফ্রান্সে দিন দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ফ্রান্স তখন মজুতদার, কালোবাজারি ও ফাটকাবাজদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। সারা দেশে চরম খাদ্যাভাবের ফলে খাদ্যের সন্ধানে অগণিত মানুষ প্যারিস শহরে ভিড় করে। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষ প্রজাতান্ত্রিক সরকারের বিরোধিতা করতে থাকে।
  • ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের সমর্থক জনগণ বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। লা-ভেন্ডি, তুলোঁ, লায়নস, মার্সেই প্রভৃতি স্থান ছিল রাজতন্ত্রীদের প্রধান ঘাঁটি। ফ্রান্সের 83টি প্রদেশ (ডিপার্টমেন্ট)-এর মধ্যে 60টি প্রদেশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে।
  • ফ্রান্সের অনেক মানুষ কর দিতে, সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকার করে। তারা ফরাসি সরকারের আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রকাশ করে। সারা দেশ বিদেশি গুপ্তচরে ছেয়ে যায়।

অভ্যন্তরীণ সংকটের মোকাবিলা

জাতীয় নেতৃবৃন্দ অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলার জন্য এক বিশেষ ধরনের কঠোর শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করেন যে, ফ্রান্সের সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ও শান্তি-শৃঙ্খলা। এর জন্য ফরাসি সরকার প্রয়োজনে ভীতি প্রদর্শন ও সন্ত্রাসের আশ্রয় নেবে।

সন্ত্রাসের শাসন

ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলার জন্য যে ভীতিপ্রদ শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়, তা সন্ত্রাসের শাসন নামে পরিচিত হয়। ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসনের নেতা ছিলেন জেকোবিন দলের রোবসপিয়র। এই সন্ত্রাসের শাসন চলেছিল 1793 খ্রিস্টাব্দের 2 জুন থেকে 1794 খ্রিস্টাব্দের 27 জুলাই পর্যন্ত।

টীকা লেখো – সন্ত্রাসের রাজত্ব (Reign of Terror) 1793-1794 খ্রি.

অথবা, ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসন-এর কারণ কী?

ফ্রান্সে রোবসপিয়র-এর নেতৃত্বে জেকোবিন দল 1793-94 খ্রিস্টাব্দে যে শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিল, তা ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্ব বা সন্ত্রাসের শাসন (Reign of Terror) নামে পরিচিত। এই সন্ত্রাসের রাজত্ব 1793 খ্রিস্টাব্দের জুন থেকে 1794 খ্রিস্টাব্দের জুলাই পর্যন্ত মোট 13 মাস ধরে চলেছিল।

পটভূমি

  • ফ্রান্সের জাতীয় মহাসভা (ন্যাশনাল কনভেনশন) 1793 খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ষোড়শ লুইকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এর ফলে ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, পর্তুগাল প্রভৃতি দেশগুলি একজোট হয়ে ফ্রান্সের বিরোধিতা করে।
  • ফ্রান্সের অভ্যন্তরে 83টি প্রদেশের মধ্যে 60টি প্রদেশে বিদ্রোহ শুরু হয়।
  • তা ছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা প্রজাতান্ত্রিক সরকারের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলে। এই অবস্থায় প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য রোবসপিয়র সন্ত্রাসের শাসন শুরু করেন।

উদ্দেশ্য

সন্ত্রাসের রাজত্বের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল –

  • ভীতি প্রদর্শন করে ফ্রান্সের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা।
  • ফ্রান্সের অভ্যন্তরে কালোবাজারি ও মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা।
  • অভিজাত ভূস্বামীদের জমি বাজেয়াপ্ত করে তা কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা।
  • বিশাল সৈন্যবাহিনী গঠন ও অস্ত্র কারখানা তৈরি করে ফ্রান্সের নিরাপত্তা ও সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।

সন্ত্রাসের ভয়াবহতা

সন্ত্রাসের রাজত্বকালে প্রায় 50 হাজার নরনারীকে গিলোটিন যন্ত্রে হত্যা করা হয়। সন্দেহের আইন (Law of Suspect) প্রায় 3 লক্ষ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। আরও অনেক মানুষ নিখোঁজ হয়ে যান – যাদের অনেককে জলে ডুবিয়ে বা অন্যভাবে হত্যা করা হয় বলে জানা যায়।

অবসান

1794 খ্রিস্টাব্দের 27 জুলাই জেকোবিন, জিরন্ডিন ও মধ্যপন্থী দলের আতঙ্কিত সদস্যরা রোবসপিয়র ও তাঁর অনুগামীদের বন্দি করে। 28 জুলাই রোবসপিয়র ও তাঁর অনুগামীদের গিলোটিন যন্ত্রে হত্যা করা হয়। ফলে সন্ত্রাসের শাসনের অবসান ঘটে।

সন্ত্রাসের রাজত্বের প্রধান সংগঠন কীরূপ ছিল?

ফরাসি বিপ্লবের সময় সন্ত্রাসের শাসনকে কার্যকরী করার জন্য সংবিধানকে নিয়মিত মুলতুবি করে রাখা হয়। জেকোবিন ক্লাব (Jacobin Club), কমিউন ছাড়াও এই শাসনব্যবস্থার প্রধান সংগঠনগুলি ছিল –

গণনিরাপত্তা সমিতি (Committee of Public Safety) – এই কমিটির হাতে ছিল যাবতীয় প্রশাসনিক ক্ষমতা। এই সমিতি নিরাপত্তার দায়দায়িত্ব, মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করা, সেনাপতি ও রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা এবং বিদেশনীতি নিয়ন্ত্রণ করত।

সাধারণ নিরাপত্তা সমিতি (Committee of General Security) – এই কমিটির হাতে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, পুলিশ বিভাগ প্রভৃতির দায়িত্ব ছিল। এই সমিতির অধীনে ছিল অসংখ্য বিপ্লবী কমিশন ও সমিতি, যারা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করত।

সন্দেহের আইন (Law of Suspect) – এই আইন অনুসারে বিপ্লববিরোধী যে-কোনো ব্যক্তিকে যে-কোনো সময় গ্রেফতার করা যেত।

বিপ্লবী বিচারালয় (Revolutionary Tribunal) – এই আদালতে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বিচার করা হত। আদালত অপরাধ যাচাই না করে, মৃত্যুদণ্ড দিতে পারত।

বিপ্লবের বধ্যভূমি (Square of Revolution) – অপরাধীদের প্রকাশ্য রাজপথ দিয়ে বিপ্লবের বধ্যভূমিতে এনে গিলোটিন (Guillotine) নামক যন্ত্রের সাহায্যে শিরশ্ছেদ করা হত।

টীকা লেখো – রোবসপিয়র (Robespierre)

ফ্রান্সে যে সন্ত্রাসের শাসন চলেছিল তার প্রধান পরিচালক ও কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন রোবসপিয়র। তিনি ছিলেন জেকোবিন দলের সর্বাপেক্ষা আদর্শবাদী, সৎ ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির নেতা। তাঁর নেতৃত্বে ফ্রান্সে 1793 খ্রিস্টাব্দের জুন থেকে 1794 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাস পর্যন্ত যে চরম সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চলেছিল, তাকে ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্ব বলা হয়।

রোবসপিয়রের উত্থানের পটভূমি

ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুই-এর প্রাণদণ্ডের পর (21 জানুয়ারি, 1793 খ্রি.) ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ক্ষেত্রে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় –

  • ফ্রান্সের অভ্যন্তরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যাভাব চরম অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করে।
  • রাজতন্ত্রের সমর্থকগণ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
  • ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ (ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, পর্তুগাল, স্পেন প্রভৃতি) শক্তিজোট গঠন করে এবং যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই অবস্থায় বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ সন্ত্রাসের শাসন শুরু করেন এবং এভাবেই রোবসপিয়রের উত্থানের পটভূমি রচিত হয়।

রোবসপিয়রের লাল সন্ত্রাস (Red Terror)

রোবসপিয়র একে একে সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করে ফ্রান্সের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। তাঁর নেতৃত্বে 1793 খ্রিস্টাব্দের 2 জুন থেকে 1794 খ্রিস্টাব্দের 27 জুলাই পর্যন্ত ফ্রান্সে চরম সন্ত্রাস চলে। গিলোটিন যন্ত্রে অসংখ্য মানুষের শিরচ্ছেদ করা হয়। ফ্রান্সের ইতিহাসে এই ঘটনা লাল সন্ত্রাস (Red Terror) নামে পরিচিত।

টাকা লেখো : রোবসপিয়র (Robespierre ) ।

রোবসপিয়রের পতন

রোবসপিয়রের সন্ত্রাসে আতঙ্কিত হয়ে ফ্রান্সের জিরন্ডিন এবং মধ্যপন্থী দলের সদস্যরা এমনকি জেকোবিন দলের বেশ কিছু সদস্য, যারা এই লাল সন্ত্রাসকে মেনে নেয়নি, তারা রোবসপিয়রকে বন্দি করে (27 জুলাই, 1794)। পরদিন অর্থাৎ 28 জুলাই গিলোটিন যন্ত্রে রোবসপিয়রের শিরচ্ছেদ করা হয়। ফলে রোবসপিয়র ও তাঁর সন্ত্রাসের শাসনের অবসান ঘটে।

ফরাসি বিপ্লবে নারীদের ভূমিকার বিবরণ দাও।

ফরাসি সমাজ ও পরিবারে পুরুষের মতো নারীর সমান অধিকার না থাকলেও ফরাসি বিপ্লবে নারীসমাজ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বিপ্লবের শুরু থেকে শেষ অবধি নারীরা ছিল পুরুষদের সঙ্গী, বন্ধু ও বিপ্লবী কাজকর্মের অংশীদার।

নারীদের ভূমিকা

ফরাসি বিপ্লবকালে ফ্রান্সের নারীদের অবদানের বিভিন্ন দিকগুলি হল —

  1. 1789 খ্রিস্টাব্দের 5 মে স্টেটস্ জেনারেলের অধিবেশন আহ্বানের মধ্য দিয়ে যে মহান ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, তাতে পুরুষদের সঙ্গে মহিলারাও যুক্ত হয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক কার্লাইল (Carlyle) তাঁর The French Revolution গ্রন্থে ফরাসি বিপ্লবে মহিলাদের অংশগ্রহণের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
  2. আবার 1789 খ্রিস্টাব্দের 14 জুলাই যখন জনতা বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে তখন বহু সাহসিনী মহিলা তাদের দুর্গ ভেঙে ফেলার জন্য উৎসাহ দিয়েছিল এবং নতুন ব্যবস্থা কার্যকর করার সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছিল।
  3. রুটির দাবিতে 5-6 অক্টোবর যে বিশাল জনতা মিছিল করে রাজা-রানিকে প্যারিসে ফেরাতে ভার্সাই গিয়েছিল, সেই মিছিলে কমপক্ষে 10 হাজার মহিলা যোগদান করেছিল এবং সেই কাজে তারা সফলও হয়েছিল, এমনকি মহিলারা অস্ত্রাগার লুণ্ঠনেও সক্রিয় ভূমিকা নেয়।
  4. 1792 খ্রিস্টাব্দের 10 আগস্ট টুইলারিস প্রাসাদ অবরোধের ক্ষেত্রে এবং ওই বছরের 21 সেপ্টেম্বর জাতীয় সম্মেলনের অধিবেশনে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদের পক্ষেও মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
  5. ফরাসি বিপ্লবকালে সংবিধানসভা বা বিপ্লবী আইনসভা ক্রীতদাসদের মুক্তিতে সচেষ্ট হলেও নারীর সামাজিক বা রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি বিষয়ে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। ফলে নারীরা পুরুষের সমানাধিকার দাবি করে।
  6. 1793 খ্রিস্টাব্দের নারীসমাজের অধিকার ও প্রজাতন্ত্রের পক্ষে প্রচার চালানোর জন্য প্যারিসে ক্লেয়ার ল্যাকম্ব ও পাওলিন লেয়ঁ বিপ্লবী প্রজাতন্ত্রী নারী সমিতি গঠন করেছিলেন।

মন্তব্য

ফরাসি বিপ্লবকালে বিপ্লবী নেতারা নারীদের রাজনৈতিক অধিকার ও যোগ্যতার প্রশ্নে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে না পারলেও এ সময়ে নারীমুক্তির যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা পরবর্তীকালে নারী সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়।

টিপু সুলতান (Tipu Sultan) ও জেকোবিন ক্লাব (Jacobin Club) বা ফরাসিদের মধ্যে সম্পর্ক কীরকম ছিল?

টিপু সুলতান ছিলেন ভারতের মহিশূর রাজ্যের শাসক হায়দার আলির পুত্র। 1782 খ্রিস্টাব্দে হায়দার আলির মৃত্যুর পর তিনি মহিশুরের শাসক হয়েছিলেন।

ভারতে ইংরেজ ও ফরাসিদের সম্পর্ক

ইংরেজ ও ফরাসিরা ভারতে ব্যবসা করার জন্য এসেছিল। ভারতে ইংরেজ ও ফরাসিরা ছিল একে অপরের শত্রু।

ফরাসিদের সঙ্গে টিপু সুলতানের সম্পর্ক

  1. 1767 খ্রিস্টাব্দে হায়দার আলির সময় থেকে ইংরেজরা মহিশূর রাজ্য দখল করার জন্য যুদ্ধ শুরু করেছিল। ফলে ইংরেজদের শত্রু ফরাসিরা ছিল মহিশূরের বন্ধু। মহিশূরের সিংহাসন লাভ করার পর টিপু সুলতান ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্যলাভে সচেষ্ট হয়েছিলেন। 1784 ও 1785 খ্রিস্টাব্দে ফরাসিদের সাহায্য চেয়ে তিনি দূত পাঠিয়েছিলেন।
  2. 1791 খ্রিস্টাব্দে টিপু সুলতান ফ্রান্সে দূত পাঠিয়ে রাজা ষোড়শ লুই-এর সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু ফ্রান্সে বিপ্লব চলার ফলে রাজা সাহায্য করতে পারেননি।
  3. তারপর ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান হয়। ফ্রান্সে বিপ্লবীদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক সরকার। টিপু সুলতান বিপ্লবী সরকারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন। জেকোবিন ক্লাবের সদস্য হয়েছিলেন তিনি। তিনি ফরাসি বিপ্লবকে সমর্থন করে রাজধানী শ্রীরাঙ্গপত্তমে “স্বাধীনতার স্মারক বৃক্ষ” (Tree of Liberty) রোপণ করেছিলেন।
  4. তিনি কাবুল, কনস্টান্টিনোপল, মরিসাসের ফরাসি ঘাঁটিতে দূত পাঠিয়েছিলেন। তবে ফরাসিদের কাছ থেকে তিনি আশানুরূপ সাহায্য পাননি।
টিপু সুলতান (Tipu Sultan) ও জেকোবিন ক্লাব (Jacobin Club) বা ফরাসিদের মধ্যে সম্পর্ক কীরকম ছিল?

মন্তব্য

অষ্টাদশ শতকে টিপু সুলতান যে সুদূর বিশ্বের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালান এবং ফরাসি বিপ্লব ও প্রজাতান্ত্রিক সরকারের প্রতি যে সমর্থন জ্ঞাপন করেন, তা তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিচয় দেয়।

ফরাসি বিপ্লবে গ্রামীণ জনতার ভূমিকা কী ছিল?

গ্রামীণ জনতার ভূমিকা

ফরাসি বিপ্লবে গ্রামীণ জনতার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। বাস্তিল দুর্গ অভিযান গ্রামের কৃষকদের উৎসাহিত করে। তারা অত্যাচারী সামন্তপ্রভূদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে, দলিলপত্র পুড়িয়ে ব্যাপক ও ভয়াবহ আন্দোলন করেছিল।

মহা আতঙ্ক

এই আন্দোলনের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল মহা আতঙ্ক (Great Fear)। প্রাণের ভয়ে শহরে পালিয়ে গিয়েছিল অনেকে। এইভাবে গ্রামাঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ সফল হয়েছিল।

ফরাসি বিপ্লবে গ্রামীণ জনতার ভূমিকা কী ছিল ?

শ্রমিকশ্রেণি

আবার লাব্রুস (Labrousse)-এর মতে, নিত্যব্যবহার্য জিনিসের দাম কমলেও দিনমজুর ও শিল্প শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি, যা তাদের বিপ্লবের পথে নিয়ে যায়।

মন্তব্য

খাদ্যাভাব, অর্থাভাব, দুর্ভিক্ষ ও অজন্মার ফলে প্রতি গ্রাম যখন বারুদের স্তূপে পরিণত হয়েছিল, তখন ফরাসি সমাজের নীচুতলার মানুষ স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্রের অত্যাচার, যাজকদের দুর্নীতি, সামন্ততন্ত্রের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ফরাসি রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের সমাধি রচনা করেছিল।

ফরাসি বিপ্লবে তথা জনচেতনায় গুজবের প্রভাব আলোচনা করো।

যে-কোনো আন্দোলন, বিপ্লব বা বিদ্রোহের মতো ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালেও অদ্ভুত ও অবাস্তব সব অভিযোগের ভিত্তিতে সাধারণ মানুষ যাজক, অভিজাত, রাজা, রানি প্রমুখের বিরুদ্ধে গুজব রটিয়ে জনচেতনা বৃদ্ধি করেছিল তথা নানাভাবে বিপ্লবকে প্রভাবিত করেছিল।

  1. 1789 খ্রিস্টাব্দের 20 জুন গুজব রটে যে, রাজা ষোড়শ লুই তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে চলেছেন। এরপরেই তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিরা স্টেটস্ জেনারেলের সভাকক্ষ বন্ধ দেখে গুজবটি সত্য বলে ভাবেন এবং টেনিস কোর্টের শপথের মাধ্যমে বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেন।
  2. আবার বাস্তিল দুর্গ আক্রমণকালে গুজব ছড়ায় যে, অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই কামানের মুখ জনতার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে জনমানসে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।
  3. জর্জ লেভেবর (Lefebvre)-এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, বাস্তিল দুর্গের পতনের পর কৃষকরা চার্চ ও সামন্তপ্রভুদের দেয় করগুলি বন্ধ করে দিলে কৃষক সমাজে গুজব ছড়ায় যে, ভূস্বামীরা গুন্ডাদের দিয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে – এর ফলে বিক্ষুব্ধ কৃষকরা আরও হিংস্র হয়ে উঠলে শেষ পর্যন্ত সংবিধান সভা সামন্ততান্ত্রিক আধিপত্যের অবসান ঘটায়।
  4. সর্বোপরি, কোবান (Cobban)-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ড (1792 খ্রি.-র 2-6 সেপ্টেম্বর) ঘটার আগে গুজব রটে যে বিদেশি সেনাদল প্যারিসের মাত্র 200 মাইল দূরে রয়েছে। তারা প্যারিসে এসে বন্দি অভিজাতদের মুক্ত করবে এবং বিপ্লবীদের উপর আঘাত হানবে – অতএব এই আতঙ্কের ফলই হল সেপ্টেম্বরের হত্যাকাণ্ড।

এইভাবে ফরাসি বিপ্লবের বিভিন্ন পর্যায়ে নানান গুজব বিপ্লবকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল।

ফরাসি বিপ্লব কীভাবে বৈদেশিক আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিল?

1793 খ্রিস্টাব্দের 21 জানুয়ারি ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদণ্ডের ফলে বৈদেশিক ব্যাপারে ফ্রান্সে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।

  1. ফ্রান্সে বিপ্লব শুরু হলে অনেক অভিজাত রাজতন্ত্রী দেশত্যাগ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয় এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রচার চালায়।
  2. ইউরোপের ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, স্পেন, পর্তুগাল, সার্ডিনিয়া, নেপলস প্রভৃতি দেশের হয়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে শক্তিজোট গঠন করে।
  3. অস্ট্রিয়ার রাজা লিওপোল্ড ছিলেন ফরাসি রাজা ষোড়শ লুইয়ের শ্যালক। তা ছাড়া স্পেন, সার্ডিনিয়া, নেপলসের রাজারা ছিলেন ফরাসি রাজের আত্মীয়। তাঁরা ফরাসি রাজের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সচেষ্ট হন।
  4. ইউরোপীয় শক্তিজোট ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এদিকে ফরাসি সেনাপতি দ্যু মুরিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে অস্ট্রিয়ার পক্ষে যোগদান করেন। শত্রুপক্ষ ফরাসি সীমানা অতিক্রম করে দ্রুত প্রবেশ করতে থাকে। ফলে নবগঠিত ফরাসি প্রজাতান্ত্রিক সরকারের তথা ফ্রান্সের নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়।

ফ্রান্সে প্রথম বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কারণ কী ছিল?

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা প্রায় একরকমই ছিল। তা সত্ত্বেও ফ্রান্সে প্রথম বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পিছনে বেশ কিছু কারণ ছিল।

কারণ

  1. রাজতন্ত্রে জ্ঞানদীপ্তির অভাব – জ্ঞানদীপ্তির পীঠস্থান হয়েও ফ্রান্সের রাজারা প্রজাকল্যাণের কোনো ব্যবস্থা করেননি এবং রাজতন্ত্রের প্রতি প্রজাদের ক্ষোভ প্রশমিত করারও কোনো চেষ্টা করেননি।
  2. অভিজাত বিদ্রোহ – ইউরোপের আর কোনো দেশের রাজাকে ষোড়শ লুইয়ের মতো অভিজাত সম্প্রদায়ের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়নি।
  3. বুর্জোয়া শ্রেণি – ইউরোপের মধ্যে সেই সময়কালে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও সুইডেনেই শুধুমাত্র বুর্জোয়া শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল। তবে ফরাসি বুর্জোয়ারা তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার সম্পর্কে অধিক সচেতন হয়ে ওঠে।
  4. দার্শনিকদের প্রভাব – ফরাসি দার্শনিকরাই পুরাতনতন্ত্রের প্রতি মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিলেন

এ ছাড়াও ছিল আর্থিক দুরবস্থা, যাকে ডেভিড থমসন (David Thomson) বৈপ্লবিক পরিস্থিতি বলে চিহ্নিত করেছেন, যার উদ্ভব একমাত্র ফ্রান্সেই ঘটেছিল।

ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লব (The Glorious Revolution) ও আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের (American War of Independence) প্রভাব সম্পর্কে লেখো।

ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লব (The Glorious Revolution)

ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লব (1688 খ্রি.) ও জন লক (John Locke)-এর চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মন্তেস্কু তাঁর রাজনৈতিক গ্রন্থগুলি লেখেন। ভলতেয়ার ইংল্যান্ডের নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে মুগ্ধ হয়ে ফরাসি রাজতন্ত্রের সমালোচনা করেন – যা ফরাসি জাতিকে বিপ্লবের প্রেরণা দান করে।

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (American War of Independence)

ফ্রান্সের উপর আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রভাব ছিল গভীর। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আমেরিকাবাসীর সাফল্য ফরাসিদের বিপ্লবে উৎসাহিত করে। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক আদর্শ সংবলিত গ্রন্থ ফ্রান্সে ক্রমশ প্রচারিত হতে থাকে। এমনকি লাফায়েৎ, লাসে, ডুমা-সহ অন্যান্য ফরাসি ঔপনিবেশিকদের পক্ষে লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ফ্রান্সের বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করে। ঐতিহাসিক কোবান (Cobban) বলেন, আমেরিকার স্বাধীনতার মূল্য ছিল ফরাসি বিপ্লব (the price to be paid for American Independence was a French Revolution)।

ফরাসি বিপ্লবের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করো।

1789 খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব অপরিসীম।

ফলাফল

  1. সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শ – ফরাসি বিপ্লবের মূল আদর্শ ছিল — সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। ফ্রান্সের গণ্ডি ছাড়িয়ে কালক্রমে এই আদর্শ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছিল।
  2. জাতীয়তাবাদের আদর্শ – ফরাসি বিপ্লবে যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল তা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে প্রভাবিত করেছিল। এই আদর্শের অনুপ্রেরণায় জার্মানি, ইটালি, গ্রিস প্রভৃতি দেশে জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
  3. প্রগতিশীল চিন্তার বিস্তার – ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা ও চিন্তার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল। রুশো, ভলতেয়ার, মন্তেস্কু প্রমুখ ফরাসি দার্শনিকদের প্রগতিশীল চিন্তা সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত হয়।
  4. গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রসার – ফরাসি বিপ্লবের ফলে গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রসার ঘটেছিল। এই বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে এবং গণতান্ত্রিক শাসন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রভৃতি গণতান্ত্রিক আদর্শগুলির দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনগণ অনুপ্রাণিত হয়েছিল।

ইউরোপ তথা বহির্বিশ্বে ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শের প্রভাব আলোচনা করো।

1789 খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্সের ঘরোয়া বিষয় হলেও তার প্রভাব কেবল ফ্রান্সের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না, পরোক্ষভাবে এই বিপ্লবের দ্বারা ইউরোপ তথা সারা বিশ্বও প্রভাবিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এই বিপ্লব ছিল মানবজাতি তথা ইতিহাসের পটপরিবর্তনের অগ্রদূত।

আদর্শের প্রভাব

  • ইংল্যান্ড – ফরাসি বিপ্লবের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে লন্ডন, ম্যাঞ্চেস্টার, লিডস প্রভৃতি শহরে প্রতিষ্ঠিত লন্ডন করেসপনডিং সোসাইটি ও ইংল্যান্ডের শ্রমজীবী সংগঠনগুলি ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়।
  • আয়ারল্যান্ড – ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আয়ারল্যান্ডে লর্ড এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড ও উলটোন-এর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়।
  • জার্মানি – জার্মানির লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শের প্রসার ঘটান ও ফ্রান্সের প্রজাতান্ত্রিক শাসনকে স্বাগত জানান। আবার জার্মানির বিভিন্ন রাজ্যে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে একাধিক সমিতি গড়ে ওঠে।
  • বলকান অঞ্চল – ঐতিহাসিক জে এ আর ম্যারিয়ট তাঁর ইস্টার্ন কোয়েস্‌চেন (Eastern Question) গ্রন্থে বলেছেন, ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে বলকান জাতীয়তাবাদ প্রখর হয়ে ওঠে।
  • অন্যান্য দেশ – আবার এই বিপ্লবের প্রভাবে বেলজিয়াম, গ্রিস, পোল্যান্ড ও ল্যাটিন আমেরিকার নানা দেশে স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে ওঠে।
  • ভারতবর্ষ – ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশের ন্যায় ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ পশ্চিম ভারতে গোপালহরি দেশমুখ, পূর্ব ভারতে ডিরোজিও, রামমোহন, দক্ষিণ ভারতে বীরেশলিঙ্গম, নারায়ণ গুরু প্রমুখের সংস্কার আন্দোলনে এবং ভারতের জাতীয়তাবাদী মুক্তিসংগ্রামেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

মন্তব্য

এ কথা সত্যি যে, ফ্রান্সের বাইরে ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন বা সাফল্য আনতে না পারলেও ফরাসি বিপ্লবের স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ ইউরোপ তথা বিশ্বে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রবাদের প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।

আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় “ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক” কিছু বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি নবম শ্রেণীর পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে আপনি আমাকে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। তাছাড়া, আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করুন যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।

JOIN US ON WHATSAPP

JOIN US ON TELEGRAM

Please Share This Article

About The Author

Related Posts

Class 9 – English – A Day in The Zoo – Question and Answer

Class 9 – English – A Day in The Zoo – Question and Answer

Tom Loses a Tooth

Class 9 – English Reference – Tom Loses a Tooth – Question and Answer

The North Ship

Class 9 – English Reference – The North Ship – Question and Answer

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

Trending Now

Class 9 – English – A Day in The Zoo – Question and Answer

Class 9 – English Reference – Tom Loses a Tooth – Question and Answer

Class 9 – English Reference – The North Ship – Question and Answer

Class 9 – English – His First Flight – Question and Answer

Class 9 – English – A Shipwrecked Sailor – Question and Answer