আজকের আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের ষষ্ঠ অধ্যায় “ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ” এর ‘ভারতের জনসংখ্যা’ বিভাগ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন-উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত সহায়ক। কারণ, এই ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই মাধ্যমিক এবং চাকরির পরীক্ষায় দেখা যায়। আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
ভারতে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণগুলি আলোচনা করো।
অথবা, ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণগুলি কী কী?
বিগত কয়েকটি দশকে ভারতে জনসংখ্যা অত্যন্ত দ্রুত হারে বেড়েছে। এই দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণগুলি হল –
- উচ্চ জন্মহার – ভারতে জন্মহার খুব বেশি। 2011 সালে ভারতে জন্মহার ছিল প্রতি হাজারে 24.8 জন। শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, দারিদ্র্য, কুসংস্কার, ধর্মের প্রভাব, বাল্যবিবাহ প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে ভারতে জন্মহার খুব বেশি থাকে।
- মৃত্যুহার কমে যাওয়া – বিগত কয়েক দশকে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার কল্যাণে ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতির কারণে মৃত্যুহার যথেষ্ট পরিমাণে কমে গেছে। এ ছাড়া, যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হওয়ায় দুর্ভিক্ষ, খরা বা বন্যাপীড়িত অঞ্চলে মহামারি ও অনাহারজনিত মৃত্যুর সংখ্যাও যথেষ্ট কমেছে। মৃত্যুহার কমে যাওয়ায় জনসংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। 2011 সালে ভারতে মৃত্যুহার ছিল প্রতি হাজারে মাত্র ৪ জন।
- বিপুল সংখ্যায় শরণার্থীদের আগমন – দেশ বিভাগের পরবর্তী দশকগুলিতে প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে বিপুল সংখ্যায় শরণার্থী ভারতে চলে আসায় এখানকার জনসংখ্যা দ্রুত বেড়েছে।
- অর্থনৈতিক মানোন্নয়ন ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি – বিগত কয়েক দশকে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্প-ব্যবস্থার বিকাশ প্রভৃতি ভারতবাসীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সাহায্য করেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম পূর্বাভাস অনেক ক্ষেত্রে জীবন ও ধনসম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সাহায্য করেছে। এগুলি পরোক্ষভাবে ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
হিমাচল প্রদেশ কেন বিরল জনবসতি অঞ্চলের অন্তর্গত?
ভারতের অন্যতম বিরল জনবসতি অঞ্চলের অন্তর্গত একটি রাজ্য হলো হিমাচল প্রদেশ। 2011 সালের জনগণনা অনুসারে, সমগ্র রাজ্যটির জনসংখ্যা মাত্র 68,56,509 জন এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র 123 জন। রাজ্যটিতে এ ধরনের বিরল জনবসতির কারণগুলি হলো –
- বন্ধুর ও পর্বতময় ভূপ্রকৃতি – হিমাচল প্রদেশের অধিকাংশ এলাকা বন্ধুর এবং পর্বতময়। এই অঞ্চলে কৃষিযোগ্য ভূমির পরিমাণ খুবই কম, যা কৃষিকাজে বিশেষ অসুবিধা সৃষ্টি করে।
- অনুর্বর মৃত্তিকা – ঢালু ভূমিরূপের কারণে বেশিরভাগ স্থানে মৃত্তিকা অগভীর এবং অনুর্বর। এই ধরনের মৃত্তিকায় ফসল ভালোভাবে জন্মায় না, যা কৃষির জন্য প্রতিকূল।
- শীতল জলবায়ু – হিমাচল প্রদেশের জলবায়ু অত্যন্ত শীতল, বিশেষ করে শীতকালে। এই শীতল আবহাওয়া জীবনধারণের জন্য অনুপযুক্ত, যা জনবসতির ঘনত্বকে প্রভাবিত করে।
- শিল্পের কাঁচামাল ও শক্তিসম্পদের অভাব – রাজ্যে খনিজ কাঁচামাল ও শক্তিসম্পদের অভাবে শিল্পের বিকাশ সম্ভব হয়নি, যা অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে সীমিত করে এবং জনসংখ্যার ঘনত্বকে প্রভাবিত করে।
- অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা – হিমাচল প্রদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত, যা রাজ্যটিকে বিরল জনবসতি অঞ্চলে পরিণত করেছে। এর ফলে অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সংযোগ এবং পরিবহন ব্যবস্থা দুর্বল।
ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা সম্বন্ধে আলোচনা করো।
ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ। ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রাক-স্বাধীনতা যুগে যথেষ্ট কম ছিল, কিন্তু স্বাধীনোত্তর যুগে জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। ভারতের মোট জনসংখ্যা 1901 থেকে 1951 সালের মধ্যে 23.84 কোটি থেকে বেড়ে হয় 36.11 কোটি। অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধে জনসংখ্যা বাড়ে মাত্র 12.27 কোটি। এই সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও ছিল খুব কম, দশক পিছু সর্বনিম্ন 0.31 শতাংশ (1911-1921) থেকে সর্বোচ্চ 14.22 শতাংশ (1931-1941)।
এরপর ভারতের মোট জনসংখ্যা 1951 থেকে 2001 সালের মধ্যে 36.11 কোটি থেকে বেড়ে 102.9 কোটিতে পৌঁছায়। অর্থাৎ, পরবর্তী অর্ধশতকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি, প্রায় 66.89 কোটি। এই সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও ছিল খুবই বেশি, দশক পিছু সর্বনিম্ন 21.64 শতাংশ (1951-1961) থেকে সর্বোচ্চ 24.66 শতাংশ (1971-1981)।
2001-2011 সালের মধ্যে ভারতের জনসংখ্যা 18.15 কোটি বেড়েছে। এর ফলে ভারতের মোট জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে 121.02 কোটি। এই সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল 17.64 শতাংশ। উল্লেখযোগ্যভাবে, 1991 থেকে 2001 সালের মধ্যে ভারতের জনসংখ্যা যতটা বেড়েছে, তা পাকিস্তানের (বিশ্বের ষষ্ঠ সর্বাধিক জনবহুল দেশ) মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। এ থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, ভারতের জনসংখ্যা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে।
ভারতে অতিরিক্ত ঘনবসতির কারণ কী কী?
ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ (প্রথম চীন)। 2011 সালের জনগণনা অনুযায়ী, ভারতের জনসংখ্যা প্রায় 121 কোটি 2 লক্ষ এবং জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে 382 জন। ভারতে অতি ঘনবসতির প্রধান কারণগুলো নিম্নরূপ –
- সমতল ভূপ্রকৃতি – উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ সমভূমি এবং উপকূলীয় সমভূমিগুলি কৃষিকাজ, পরিবহণ ব্যবস্থা এবং শিল্পে উন্নত। ফলে এইসব অঞ্চলে বেশি জনবসতি দেখা যায়।
- অনুকূল জলবায়ু – ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চল ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ুর অধীনে। উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাত মধ্যম প্রকৃতির, যা কৃষি উৎপাদন ও শিল্প স্থাপনের পক্ষে অনুকূল। এ কারণে এইসব অঞ্চলে জনবসতি বেশি।
- উর্বর মৃত্তিকা – ভারতের সমভূমি অঞ্চলগুলি পলিগঠিত, ফলে এখানকার মৃত্তিকা অত্যন্ত উর্বর। তাই এই কৃষি সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোতে ঘন জনবসতি লক্ষ করা যায়।
- জলের প্রাচুর্য – ভারতের প্রধান নদীগুলি থেকে সেচ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, মৎস্যচাষ এবং জলপথ পরিবহণের সুবিধা পাওয়া যায়। তাই নদীতীরবর্তী অঞ্চলে ঘন জনবসতি গড়ে ওঠে।
- অর্থনৈতিক কারণ – খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ অঞ্চল এবং শিল্পকেন্দ্রগুলোতে জীবিকার্জনের সুযোগ বেশি থাকায়, সেখানে ঘন জনবসতি গড়ে ওঠে।
2011 সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতের জনবণ্টনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
2011 সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতের জনবণ্টনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল —
- ভারতের সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য হল উত্তরপ্রদেশ (জনসংখ্যা 19 কোটি 95 লক্ষ)।
- সবচেয়ে জনবিরল রাজ্য হল সিকিম (জনসংখ্যা 6 লক্ষ 4 হাজার)।
- জাতীয় রাজধানী অঞ্চল দিল্লির জনসংখ্যা 1 কোটি 68 লক্ষ এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পুদুচেরির জনসংখ্যা 12 লক্ষ 44 হাজার।
- পশ্চিমবঙ্গ ভারতের চতুর্থ জনবহুল রাজ্য (জনসংখ্যা 9 কোটি 13 লক্ষ)।
- ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাস করে গঙ্গা সমভূমি অঞ্চলে, যা ভারতের মোট ভৌগোলিক আয়তনের মাত্র এক-নবমাংশ।
- ভারতের রাজস্থানের মরু অঞ্চল ও হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল সর্বাপেক্ষা জনবিরল।
- ভারতে মোট জনসংখ্যার প্রায় 31.2 শতাংশ শহরে এবং বাকি 68.8 শতাংশ গ্রামে (2011) বাস করে।
2011 সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতের জনঘনত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
2011 সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতের জনঘনত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল —
- প্রতি বর্গকিমিতে ভারতের জনঘনত্ব 382 জন।
- রাজ্যগুলির মধ্যে বিহারের জনঘনত্ব সবচেয়ে বেশি — 1102 জন প্রতি বর্গকিমিতে।
- রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম জনঘনত্ব দেখা যায় অরুণাচল প্রদেশে — 17 জন প্রতি বর্গকিমিতে।
- কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনঘনত্ব দেখা যায় দিল্লিতে (জাতীয় রাজধানী অঞ্চল) — প্রতি বর্গকিমিতে 11297 জন।
- অন্যান্য কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে চণ্ডীগড়ের জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিমিতে 9252 জন এবং সবচেয়ে কম জনঘনত্ব দেখা যায় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে — প্রতি বর্গকিমিতে 46 জন।
অরুণাচল প্রদেশের জনঘনত্ব কম কেন?
ভারতের সব রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে অরুণাচল প্রদেশের জনবসতির ঘনত্ব সবচেয়ে কম। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র 17 জন লোক বসবাস করে। এই রাজ্যটির জনঘনত্ব কম হওয়ার পিছনে বেশ কিছু প্রাকৃতিক ও আর্থ-সামাজিক কারণ রয়েছে, যেমন —
- বন্ধুর ও পর্বতময় ভূপ্রকৃতি – এখানকার ভূমি বন্ধুর এবং পর্বতময়, ফলে অর্থনৈতিক কাজকর্ম গড়ে তুলতে অসুবিধা হয়।
- অনুর্বর মৃত্তিকা – ঢালু ভূপ্রকৃতির জন্য অধিকাংশ স্থানের মৃত্তিকা অগভীর এবং অনুর্বর, ফলে কৃষিকাজ ভালো হয় না।
- প্রতিকূল জলবায়ু – এখানকার জলবায়ু শীতল এবং আর্দ্র প্রকৃতির, যা জীবনধারণের জন্য উপযুক্ত নয়।
- গভীর অরণ্য – ভূমির অধিকাংশ অংশ গভীর অরণ্যে ঢাকা, যা মানুষের জীবনযাত্রায় প্রতিকূল প্রভাব ফেলে।
- শিল্পের কাঁচামাল ও শক্তিসম্পদের অভাব – কাঁচামাল ও শক্তিসম্পদের অভাবে এখানে শিল্পের বিকাশ সম্ভব হয়নি।
- অনুন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা – এই অঞ্চলের সড়ক, রেলপথ, বিমান ও জলপথের পরিবহণ ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল।
জনঘনত্ব কাকে বলে?
ভূপৃষ্ঠের কোনো অঞ্চলের মানুষের বণ্টনগত তারতম্যের সূচক হল জনঘনত্ব। কোনো দেশ বা অঞ্চলের মোট জনসংখ্যাকে ওই অঞ্চলের মোট জমির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করলে যে অনুপাত পাওয়া যায়, তাকে জনঘনত্ব বলে।
উদাহরণ – 2011 সালে ভারতের জনসংখ্যা ছিল 121.02 কোটি এবং ভারতের আয়তন 32.87 লক্ষ বর্গকিমি। সুতরাং, ভারতের জনঘনত্ব হল 382 জন/বর্গকিমি।
হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল জনবিরল ভৌগোলিক কারণ ব্যাখ্যা করো।
হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিরল এবং অতিবিরল জনবসতি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এখানকার গড় জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিমিতে 100 জনেরও কম। এই অঞ্চলটি জনবিরল হওয়ার কারণগুলি হল —
- উঁচুনীচু পর্বতময় ভূপ্রকৃতি – হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের বেশিরভাগ স্থানের ভূপ্রকৃতি পর্বতময় ও বন্ধুর, ফলে অর্থনৈতিক কাজকর্ম গড়ে তোলা কঠিন।
- অনুর্বর মৃত্তিকা – বেশিরভাগ মৃত্তিকা অনুর্বর এবং অগভীর, যা কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত নয়।
- শীতল জলবায়ু – শীতকালীন জলবায়ু জীবনধারণের পক্ষে সুবিধাজনক নয়।
- অরণ্যের অবস্থান – এই অঞ্চলের 90% ভূমিই অরণ্যে ঢাকা, যা জীবনধারণের পক্ষে উপযুক্ত নয়।
- অনুন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা – বন্ধুর ভূপ্রকৃতির জন্য পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত নয়, ফলে এই অঞ্চলটি জনবিরল।
- শিল্পের কাঁচামাল ও শক্তিসম্পদের অভাব – প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার কারণে বনজ ও খনিজ সম্পদ সংগ্রহ করা যায় না এবং কাঁচামালের অভাবে শিল্পের বিকাশ সম্ভব হয়নি।
গাঙ্গেয় সমভূমি অত্যন্ত জনবহুল কেন?
গাঙ্গেয় সমভূমি ভারতের সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল। এখানকার গড় জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিমিতে 500 জনের বেশি। যেসব কারণের জন্য অঞ্চলটি অত্যন্ত জনবহুল, সেগুলি হলো –
- সমতল ভূপ্রকৃতি – গাঙ্গেয় সমভূমির ভূমির বন্ধুরতা একেবারেই নেই। সমতল ভূমি কৃষিকাজ, পরিবহণ ও শিল্পস্থাপনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে।
- অনুকূল জলবায়ু – এই অঞ্চলের উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাত মধ্যম প্রকৃতির। এই ধরনের জলবায়ু কৃষিকাজ ও অধিবাসীদের জীবনধারণের পক্ষে অনুকূল।
- উর্বর মৃত্তিকা – এখানকার মৃত্তিকা খুব উর্বর। এই মৃত্তিকায় ধান, গম, পাট, আখ, তৈলবীজসহ বিভিন্ন শস্যের উৎপাদন খুব বেশি হয়।
- উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা – ভূমি যথেষ্ট সমতল হওয়ায় সড়ক ও রেল পরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত। সমগ্র অঞ্চলটিতে যোগাযোগ ব্যবস্থারও যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে, যা অধিক জনবসতি গড়ে তোলার পক্ষে সহায়ক।
- শক্তির প্রাচুর্য – এই অঞ্চলটিতে বেশ কয়েকটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এই শক্তি কেন্দ্রগুলি কৃষি ও শিল্পের প্রসার ঘটাতে সাহায্য করেছে, যার ফলে সমগ্র অঞ্চলটি জনবহুল হয়েছে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিরতা জনঘনত্বকে প্রভাবিত করে – ব্যাখ্যা করো।
কোনো অঞ্চলের জনসংখ্যার ঘনত্ব যেসব বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়, সেগুলির মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিরতা অন্যতম।
- সামাজিক অবস্থা – সামাজিক অবস্থা দ্বারা জনঘনত্বের তারতম্য প্রভাবিত হয়। সামাজিক অবস্থার প্রভাবগুলি ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক এই দুই দিক থেকে দেখা যেতে পারে। ধর্মীয় কারণে বহিরাগতদের আগমনের ফলে জনঘনত্ব বেড়ে যায়। আবার সাংস্কৃতিক শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কারিগরি বিদ্যার উন্নতির সাথে নতুন নতুন সম্পদ সৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ে। ফলে জনঘনত্ব বৃদ্ধি পায়।
- রাজনৈতিক স্থিরতা – 1947 সালে ভারত ভাগের পর পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে, ভারতবর্ষে তখন তুলনামূলকভাবে রাজনৈতিক স্থিরতা ছিল। তাই পূর্ববঙ্গ থেকে বহু মানুষ সীমানা পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় প্রবেশ করে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার জনঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে যে অঞ্চল থেকে মানুষের আগমন ঘটে সেখানে জনঘনত্ব হ্রাস পায়। যেসব অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিরতা থাকে, সেখানে মানুষ বসবাসের জন্য চলে আসে। ফলে জনঘনত্ব বৃদ্ধি পায়।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ভারতে মৃত্যুহার দ্রুত হ্রাস পাওয়ার কারণগুলি লেখো।
স্বাধীনতার আগে ভারতে মৃত্যুহার ছিল প্রতি হাজারে 30-এর কাছাকাছি অথবা তার বেশি। 2011 সালে তা কমে হয় 7 জন। ভারতে মৃত্যুহার দ্রুত হ্রাস পাওয়ার পিছনে কিছু কারণ বর্তমান। যেমন –
- উন্নত চিকিৎসার সুবিধা – চিকিৎসার সুবিধা এবং আর্থিক সংগতির ওপর মৃত্যুহার অনেকাংশে নির্ভর করে। স্বাধীনতার পর ভারতে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটেছে। মাথাপিছু চিকিৎসকের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি চিকিৎসা পরিসেবার মানও পূর্বাপেক্ষা অনেক উন্নত হয়েছে।
- উন্নত জীবনযাত্রার মান – মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় জীবনযাত্রার মানের অনেক উন্নতি ঘটেছে। ফলে ভারতীয়দের পক্ষে বেশি করে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে।
- শিক্ষা ও সচেতনতার প্রসার বৃদ্ধি – শিক্ষার হার ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে মানুষ স্বাস্থ্য সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন হয়েছে।
- কুসংস্কার দূর: মানুষের মধ্যে রোগ সম্পর্কে বিভিন্ন কুসংস্কার দূর হচ্ছে। মানুষ ওঝা, গুনিনের পরিবর্তে ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছে।
ভারতে জনসংখ্যা বণ্টনের তারতম্যের কারণ হিসেবে নদনদীর প্রভাব লেখো।
মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজন হলো জল। পৃথিবীর জনবসতি লক্ষ করলে দেখা যায় যে, অধিকাংশ বসতি পানীয় জলকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। কৃষিকাজে জলের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। প্রয়োজনমতো এবং সময়মতো জল পাওয়া খুব দরকার। এই কারণে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়। ভারতের জনঘনত্বের বণ্টন লক্ষ করলে দেখা যায় উত্তর ভারতের গঙ্গা, সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্র এবং দক্ষিণ ভারতের মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী প্রভৃতি নদী উপত্যকায় জনঘনত্ব বেশি। যেসব কারণে ভারতে নদী-উপত্যকা অঞ্চলে জনঘনত্ব বেশি দেখা যায়, সেগুলি হলো:
- নদী থেকে কৃষির জন্য জলসেচের সুবিধা রয়েছে।
- নদী পরিবহণে সাহায্য করে।
- নদী থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
- নদী থেকে পানীয় জল পাওয়া যায়।
- নদীকে কেন্দ্র করে মৎস্যচাষ করা হয়।
- নদী জলনিকাশের একটি অন্যতম মাধ্যম।
- নদীর দুই তীরবর্তী পলিগঠিত অঞ্চল কৃষিকাজের অন্যতম সহায়ক।
ভারতে অধিক জন্মহারের কারণ কী?
ভারতে জন্মহার অধিক, অনেক ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত। 2011 সালের জনগণনা অনুসারে ভারতে জন্মহার ছিল প্রতি হাজারে 21 জন। ভারতে অধিক জন্মহারের কারণ হলো:
- স্বল্প শিক্ষার হার – এই দেশে এখনও 26% মানুষ শিক্ষার আলো পায়নি। যার ফলে জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে সুচারুরূপে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
- বাল্যবিবাহ – ছেলে বা মেয়েদের অল্প বয়সে বিবাহ হলে তাদের সন্তান ধারণক্ষমতার সময়সীমা অনেক বেশি হয়। ভারতে 18 বছর পূর্ণ হওয়ার অনেক আগেই বহু মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়।
- ধর্মীয় কারণ – ধর্মীয় কারণ জন্ম নিয়ন্ত্রণে নানাপ্রকার বিধিনিষেধ আরোপ করে।
- মেয়েদের সামাজিক মর্যাদা – ভারতের মতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের সামাজিক মর্যাদা প্রায় থাকে না। তাই মেয়েরাও অনেক সময় পরিবারের চাপে জন্ম নিয়ন্ত্রণে উৎসাহিত হয় না।
- সচেতনতার অভাব – ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে জন্ম নিয়ন্ত্রণে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতার বেশ অভাব রয়েছে।
- সরকারি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাব – এই দেশের সরকার জন্ম নিয়ন্ত্রণে খুব বেশি পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। অল্প কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও তার সঠিক বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে।
- উচ্চ মৃত্যুহার: উচ্চ মৃত্যুহারও পরোক্ষভাবে জন্মহার বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
ভারতকে কি জনাকীর্ণ দেশ বলা যায়?
জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতের স্থান বিশ্বে দ্বিতীয় (চীন প্রথম)। 2011 সালের জনগণনা অনুসারে ভারতের জনসংখ্যা 121 কোটি 1 লক্ষ 93 হাজার 422 জন। ভারতের মোট জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার 17.5 শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি 6 জন বিশ্ববাসীর মধ্যে 1 জন ভারতীয়। অথচ বিশ্বের মোট স্থলভাগের মাত্র 2.42 শতাংশ ভূমি ভারতের দখলে। এ থেকে বোঝা যায়, ভারতের জনসংখ্যা অত্যন্ত বেশি এবং দেশের জমির ওপর জনসংখ্যার চাপ অত্যধিক। যদিও চীনের জনসংখ্যা (2011 সালে) প্রায় 134 কোটি, অর্থাৎ ভারতের তুলনায় 13 কোটি বেশি, তবে আয়তনে চীন ভারতের প্রায় তিনগুণ। ভারতে শুধু মোট জনসংখ্যাই বেশি নয়, বরং ভারতের বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও খুব বেশি (1.764%), যেখানে চীনের বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মাত্র 0.5 শতাংশ। 2001 থেকে 2011 সালের মধ্যে, মাত্র দশ বছরে, ভারতের জনসংখ্যা বেড়েছে 18 কোটিরও বেশি, অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় 1 কোটি 40 লক্ষ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং এ থেকে বলা যায়, ভারতে জমির ওপর জনসংখ্যার চাপ অত্যন্ত বেশি এবং ভারত প্রকৃতপক্ষে একটি জনাকীর্ণ দেশ।
ভারতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রধান সমস্যাগুলি কী কী?
ভারতে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে প্রধান যে সমস্যাগুলি দেখা দিচ্ছে তা হলো —
- খাদ্যদ্রব্যের উচ্চ মূল্য – ভারতে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে না। ফলে খাদ্যদ্রব্যের ক্রমবর্ধমান মূল্য একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
- বসবাসের সমস্যা – অধিক জনসংখ্যা এদেশে তীব্র আবাসন সমস্যার সৃষ্টি করেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য শহরাঞ্চলে বসবাসের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে।
- বেকারত্ব – অর্ধশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে বেকারত্বের হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে কর্মহীনতা দেশে একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
- চিকিৎসা সমস্যা – জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ভারতে চিকিৎসার সুব্যবস্থা একটি প্রধান সমস্যা হয়ে উঠেছে। বহু মানুষ হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমে স্থান না পেয়ে বা যথাযথ চিকিৎসার অভাবে বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারাচ্ছেন।
- দারিদ্র্য – জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে যদি সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি না পায়, তবে দারিদ্র্যতা বৃদ্ধি পায়।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে ধারণযোগ্য উন্নয়নের সম্পর্ক কতখানি?
ধারণযোগ্য উন্নয়ন হল এমন একটি উন্নয়ন যেখানে ভবিষ্যতের সব মানুষের চাহিদা মিটিয়ে দীর্ঘস্থায়ী কল্যাণ নিশ্চিত করা হয়। ধারণযোগ্য উন্নয়নের পাঁচটি উপাদান হল —
- সামাজিক বিকাশ
- অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
- সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি
- বাস্তুতান্ত্রিক ক্রমোন্নতি
- ভৌগোলিক অবস্থার উন্নতি
ভারতের মতো দেশে যেখানে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে যদি ধারণযোগ্য উন্নয়ন নিশ্চিত করা না যায়, তবে এই বিপুল জনসংখ্যা চরম দারিদ্র্য এবং অপুষ্টির শিকার হবে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ধারণযোগ্য উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা সৃষ্টি করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জল, বায়ু, শক্তি, বনভূমি, বাস্তুতন্ত্র, খাদ্যদ্রব্য এবং পুষ্টির মতো গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়। মানুষ কেবল সম্পদ ভোগ করে না, তারা প্রচুর বর্জ্যও উৎপাদন করে। পৃথিবীতে যেভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে, পরবর্তী পাঁচ হাজার বছর পর মোট জনসংখ্যার ওজন পৃথিবীর ওজনের সমান হবে, যা বাস্তবে অসম্ভব। 1951 সালে ভারতের জনসংখ্যা ছিল প্রায় 36.11 কোটি। সেই সময় ধান উৎপাদন হয়েছে 3.46 কোটি টন, গম 0.64 কোটি টন, এবং সেচযুক্ত জমির পরিমাণ ছিল 2.7 কোটি হেক্টর। 2011 সালে ভারতের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে 121.02 কোটি। এসময় ধান উৎপাদন বেড়ে হয়েছে 15 কোটি টন, গম 8.68 কোটি টন, এবং সেচযুক্ত জমির পরিমাণ 10.4 কোটি হেক্টর। অর্থাৎ জনসংখ্যার বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষি উৎপাদনও বেড়েছে, যা সকলের জন্য খাদ্যের সংস্থান নিশ্চিত করেছে। এটাও এক ধরনের ধারণযোগ্য উন্নয়ন।
এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের ষষ্ঠ অধ্যায় “ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ” – এর ‘ভারতের জনসংখ্যা’ অংশ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন-উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে, কারণ এ ধরনের প্রশ্ন প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই পোস্টটি আপনার পড়াশোনার প্রস্তুতিতে সহায়ক হয়েছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে বা কোনো কিছু পরিষ্কার না হয়, আপনি টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোস্টটি শেয়ার করতে ভুলবেন না, যাদের এটি উপকারে আসতে পারে। ধন্যবাদ!