মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতের কৃষক, শ্রমিক, ও বামপন্থী আন্দোলন – বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা – বিশ্লেষণমূলক প্রশ্নোত্ত

বিংশ শতাব্দীতে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলনগুলিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই আন্দোলনগুলি ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

Table of Contents

মাধ্যমিক ইতিহাস – বিশ শতকের ভারতের কৃষক, শ্রমিক, ও বামপন্থী আন্দোলন

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রতি কৃষক শ্রেণির আগ্রহ ছিল না কেন?

ভূমিকা – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী তথা স্বদেশী আন্দোলন চলাকালীন ১৯০৫-০৮ খ্রিস্টাব্দে মোতিহারি জেলার কৃষক আন্দোলনকে বাদ দিলে আর কোথাও সেরকম কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়নি। নানা কারণে কৃষক শ্রেণি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন থেকে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিল।

অনীহার কারণ – স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি কৃষক শ্রেণির অনীহার কারণগুলি হল —

কৃষি কর্মসূচীর অভাব – এই আন্দোলনে কোনো কৃষি কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় নি। খাজনা হ্রাস, ভূমিস্বত্ব আইন সংরক্ষণ জাতীয় কোনো দাবি স্বদেশী নেতারা করেননি। এইসব কৃষি কর্মসূচীর অভাবেই কৃষক শ্রেণি স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

উচ্চবিত্তদের নেতৃত্ব – এই আন্দোলন শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল, এই আন্দোলনকে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও নেতারা সচেতন-উদাসীনতা দেখিয়েছিলেন।

জোতদার-জমিদার ঘেঁষানীতি – স্বদেশী নেতাদের ধারণা হয়েছিল যে, উচ্চবিত্ত ও জমিদার শ্রেণির সাহায্যপুষ্ট এই আন্দোলনে কৃষি কর্মসূচী সংযোজন করলে জমিদাররা অসন্তুষ্ট হবেন। তাই তাঁরা জোতদার-জমিদার ঘেঁষা নীতিতেই আস্থা রাখেন।

দূরদর্শিতার অভাব – ভারত কৃষি প্রধান দেশ এবং দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশই কৃষক। এই কৃষক শ্রেণি ব্যতীত কোনো আন্দোলনই যে সফল হতে পারে না — এই চিরন্তন সত্যকে স্বদেশীনেতারা উপেক্ষা করে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। অদূরদর্শিতার কারণেই কৃষক শ্রেণিকে এই আন্দোলনে তাঁরা শামিল করতে পারেননি।

কৃষকদের প্রতি উদাসীনতা – আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সচেতনভাবেই কৃষক শ্রেণিকে আন্দোলনে শরিক করে নেওয়ার ক্ষেত্রে উদাসীন ছিলেন।

উপসংহার – উপরিউক্ত কারণে কৃষক শ্রেণি এই আন্দোলনে যোগদান করেননি। ঐতিহাসিক সুমিত সরকার বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের অসাফল্য ও অস্থায়িত্বের জন্য এই আন্দোলনের প্রতি কৃষক শ্রেণির অনীহার কথা বলেছেন।

সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের পূর্বে গান্ধীজি পরিচালিত কৃষক আন্দোলনের বিবরণ দাও।

ভূমিকা – ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরেই গান্ধিজি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেননি। এইসময় মহাত্মা গান্ধি কয়েকটি আঞ্চলিক কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যথা —

  • বিহারে চম্পারণ সত্যাগ্রহ এবং
  • গুজরাটের খেদা সত্যাগ্রহ।

চম্পারণ সত্যাগ্রহ – বিহারের চম্পারণ জেলায় নীলচাষীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি চম্পারণ সত্যাগ্রহ শুরু করেন। চম্পারণে নীলকর সাহেবরা তিনকাঠিয়া প্রথায় কৃষকদের নীলচাষ করতে এবং উৎপাদিত নীল নির্দিষ্ট দামে তাদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করত। এভাবে নীলকর সাহেবরা চাষীদের ওপর অবাধ শোষণ চালাত। কিষাণনেতা রাজকুমার শুক্লার অনুরোধে গান্ধিজি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ, ব্রজকিশোর প্রসাদ, অধ্যাপক কৃপালিনী, মহাদেব দেশাই প্রমুখদের সঙ্গে নিয়ে চম্পারণে যান এবং কৃষকদের নিয়ে চম্পারণ সত্যাগ্রহ শুরু করেন। সরকার এই আন্দোলনের চাপে একটি অনুসন্ধান কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয় — যার অন্যতম সদস্য ছিলেন গান্ধিজি স্বয়ং।

খেদা সত্যাগ্রহ – গুজরাটের খেদা জেলার কৃষকদের নিয়ে রাজস্ব বৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি খেদা সত্যাগ্রহ শুরু করেন। এখানকার কৃষকরা ধান ও গমচাষের পাশাপাশি তামাক ও তুলোচাষ করত। ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি জনিত কারণে কৃষকরা খাজনা হ্রাসের দাবি তোলেন। সরকার সাড়া না দেওয়ায় গান্ধিজি মোহনলাল পান্ডা, বল্লভভাই প্যাটেল, ইন্দুলাল যাজ্ঞিক প্রমুখ নেতাদের নিয়ে খেদার কৃষকদের একত্রিত করে বয়কট সত্যাগ্রহ শুরু করে। এর ফলে খাজনা দেওয়ার জন্য কৃষকদের ওপর চাপ বন্ধ হয়।

চম্পারণ ও খেদা আন্দোলনের ফলে

  • গান্ধিজির নেতৃত্বের প্রতি দেশবাসীর আস্থা অর্জন। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, চম্পারণের আন্দোলনের ফলে কৃষকদের মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং গান্ধিজির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
  • এই আন্দোলনের সাফল্য সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে তাঁর উত্থানের পথ প্রশস্ত করে।

সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের আগে গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত আমেদাবা সত্যাগ্রহের বর্ণনা দাও।

ভূমিকা – সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের আগে গান্ধিজির নেতৃত্বে আমেদাবাদ সুতাকল শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে যে শ্রমিক সত্যাগ্রহ আন্দোলন হয়, তা আমেদাবাদ সত্যাগ্রহ নামে খ্যাত।

সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের আগে গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত আমেদাবা সত্যাগ্রহের বর্ণনা দাও।

আমেদাবাদ সত্যাগ্রহ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে আমেদাবাদের শ্রমিকদের মধ্যে নানা অসন্তোষ জমা হচ্ছিল। বারবার বেতন বৃদ্ধির দাবিতে সোচ্চার হলেও সরকার নীরব থাকে। এদিকে মালিক পক্ষও শ্রমিকদের দাবি মেটাতে অস্বীকৃত হন। এমতাবস্থায় ৫০ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের ধর্মঘটে শামিল হয়ে গান্ধীজি অনশন শুরু করেন — যা ছিল ভারতে গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত প্রথম অনশন সত্যাগ্রহ। সারা ভারতে এর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তিনদিনের মধ্যেই মালিক পক্ষ শ্রমিকদের দাবি মেনে নিয়ে ৩৫ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি করে। এই আন্দোলনের সাফল্য শহরের শ্রমিকদের কাছেও গান্ধিজিকে জনপ্রিয় করে তোলে।

গুরুত্ব –

আমেদাবাদ সত্যাগ্রহের গুরুত্বগুলি হল

  • শ্রমিক নেতা হিসেবে গান্ধিজির উত্থান ঘটে এবং তিনিই প্রথম শ্রমিক শ্রেণির প্রিয় নেতা হয়ে ওঠেন।
  • রাজনীতিতে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে অনশন একটা নতুন হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
  • গান্ধিজির প্রভাবে মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষ মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষালাভ করে।
  • গান্ধিজি শ্রমিক শ্রেণিকে নিয়ম নিষ্ঠা মেনে কর্তব্যপরায়ণ হয়ে সংঘবদ্ধ হওয়ার পথ দেখিয়েছিলেন।
  • মালিকপক্ষও গান্ধিজির ওপর আস্থা রাখার পন্থা খুঁজে পায়।

উপসংহার – শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে আমেদাবাদ সত্যাগ্রহ স্বর্ণক্ষরে লেখা থাকবে। গান্ধিজির পূর্বে ইংরেজী শিক্ষিত কোনো ভারতীয় নেতা কৃষক-শ্রমিক কল্যাণে এগিয়ে আসেননি। তাই গান্ধিজি তাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে এগিয়ে এসেছিলেন যার ফলে তিনি জনগণের একচ্ছত্র নেতৃত্ব লাভে সক্ষম হন।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।

ভূমিকা – বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বা স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৫-১৯১১ খ্রি.) ছিল ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের সূচনাকাল। এই সময় থেকেই পেশাদারী আন্দোলনকারী এবং শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। যার প্রতিফলন পড়ে স্বদেশী আন্দোলনে শ্রমিকদের অংশগ্রহণে।

নেতৃবৃন্দ – বিশ শতকের গোড়া থেকেই লালা লাজপত রায়, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতারা শ্রমিকদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। স্বদেশী যুগে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার জন্য — কুসুম রায় চৌধুরী, অপূর্ব কুমার ঘোষ, অশ্বিনী কুমার ব্যানার্জি, প্রেমতোষ বসু আত্মনিয়োগ করেন।

শ্রমিক আন্দোলন – স্বদেশী আন্দোলনকে উপলক্ষ্য করে জাতীয়তাবাদী নেতাদের নেতৃত্বে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘট শুরু হয়। জাতীয়তাবাদী নেতারা শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দাবীর প্রতি সমর্থন জানায়।

বাংলা – বঙ্গভঙ্গের দিন (১৬ অক্টোবর, ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ) হাওড়ার বার্ন কোম্পানির ১২ হাজার শ্রমিক বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ধর্মঘট শুরু করে। কলকাতায় প্রিন্টার্স অ্যান্ড কম্পোপ্রিন্টার্স লীগ গঠিত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলপথের কর্মীরা চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে আন্দোলনে শামিল হয়। বাংলায় পাটকলগুলিতেও ধর্মঘট চলে।

তামিলনাড়ু – তামিলনাড়ুর তুতিকোরিণে বাড়তি মজুরির দাবিতে চিদাম্বরম পিল্লাই-এর নেতৃত্বে ধর্মঘট শুরু হয়। চিদাম্বরম পিল্লাই গ্রেপ্তার হলে শ্রমিকরা দাঙ্গা বাধায়।

বোম্বাই – বোম্বাইও এই আন্দোলন থেকে পিছিয়ে ছিল না। সেখানেও তিলকের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বস্ত্রকলগুলিতে ধর্মঘট শুরু হয়। পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের খণ্ডযুদ্ধ হয়। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই – এ ৮ হাজার শ্রমিক ধর্মঘটে শামিল হয়।

অন্যান্য স্থানে – কানপুর ও আমেদাবাদেও ধর্মঘটের দ্বারা শ্রমিকরা আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। জামালপুরেও রেলওয়ে ওয়ার্কশপে ধর্মঘট শুরু হয়।

উপসংহার – ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্রের মতে, শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে স্বদেশী আন্দোলন ছিল একটি দিকচিহ্ন। অন্যদিকে ঐতিহাসিক সুমিত সরকারের মতে, বঙ্গভঙ্গ কালে বাংলায় কোনো যথার্থ রাজনৈতিক ধর্মঘট ঘটেনি।

অসহযোগ আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলনের বিবরণ দাও।

অথবা, অসহযোগ আন্দোলনে কৃষক শ্রেণির অবদান আলোচনা করো।

ভূমিকা – অসহযোগ আন্দোলন শুধু শহুরে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণিও এই আন্দোলনে শামিল হয়ে অসহযোগ
আন্দোলনকে গণ আন্দোলনে পরিণত করে।

বাংলা কৃষকদের ভূমিকা – বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় কৃষকরা অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। এর মধ্যে মেদিনীপুর জেলা ছিল অন্যতম। কংগ্রেস নেতা বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে মেদিনীপুরের কৃষকরা সরকারকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে এক ইউনিয়ন বোর্ড বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে। সরকার দমন পীড়ন চালিয়েও কৃষক ঐক্যকে ভাঙ্গতে পারে নি। বাংলার পাবনা, বগুড়া, বীরভূমের রামপুরহাটে সরকারী জমি-জরিপের কাজ বয়কট করা হয়। কুমিল্লা, রাজশাহী, রংপুর এবং দিনাজপুরের মুসলিম কৃষকরাও অসহযোগ আন্দোলনে শামিল হয়। দিকু শোষণের বিরুদ্ধে বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রামের আদিবাসীরাও আন্দোলনে যোগ দেয়।

অযোধ্যা – দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব অযোধ্যায় বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনের সংগঠিত হয় (১৯২০ খ্রিস্টাব্দ)। ক্রমে তা রায়বেরিলি, প্রতাপগড়, ফৈজাবাদ ও সুলতান পুরে ছড়িয়ে পড়ে। উত্তর অযোধ্যায় ১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দে মাদারি পাশির নেতৃত্বে একা আন্দোলনেও অসহযোগ সত্যাগ্রহের প্রতি সমর্থন উচ্চারিত হয়েছিল।

অন্ধ্রপ্রদেশে কৃষক আন্দোলন – অন্ধ্রপ্রদেশের রায়চোটি তালুক (কুড়াপ্পা) ও পালান্ড তালুকে (গুন্টুর রেখা) যে সত্যাগ্রহ অনুষ্ঠিত হয়, তাতেও খাজনা হ্রাস ও অরণ্য আইন বাতিলের দাবিতে কৃষকরা আন্দোলনে সমবেত হয়।

বিহারে কৃষক আন্দোলন – বিহারে জমিদারদের জুলুম ও বাড়তি খানার বিরুদ্ধে কৃষকরা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। দ্বারভাঙ্গা, ভাগলপুর, মজঃফরপুর, পুর্নিয়া, মুঙ্গের প্রভৃতি অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

কেরালার মালাবার অঞ্চল – অসহযোগ আন্দোলনের সময় খিলাফৎ ও কংগ্রেসী নেতাদের কাছে অনুপ্রেরণা পেয়ে মালাবারের মোপলা কৃষকরা কৃষক আন্দোলনের জিগির তোলেন।

উপসংহার – অসহযোগ আন্দোলনের সময় বেশ কিছু কৃষক আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং এগুলির সঙ্গে গান্ধিবাদী জাতীয় আন্দোলনের যোগসূত্র ছিল না।

একা আন্দোলন (১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দ) – টীকা লেখো।

১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস ও খিলাফতি নেতাদের উদ্যোগে এবং মাদারি পাশির নেতৃত্বে হরদৌই, সীতাপুর, বারাচ, বারবাঁকী জেলায় যে কৃষক আন্দোলন শুরু হয়, তা একা বা একতা আন্দোলন নামে পরিচিত।

নামকরণ – এই আন্দোলন একা আন্দোলন নামে পরিচিত — কারণ আন্দোলনকারীরা ঐক্যবদ্ধ (একতা) থাকার জন্য প্রতিজ্ঞাগ্রহণ করে। তবে ধর্মীয় ভাবাবেগও তাদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে সাহায্য করেছিল।

একা আন্দোলনের কর্মসূচী/শপথ পাঠ – কৃষকরা মাটিতে গর্ত করে জল রেখে তাতে গঙ্গাজল বলে মনে করত এবং সেই জল ছুঁয়ে তারা নিম্নে বর্ণিত শপথ গ্রহণ করত।

  • জমি বেদখল হলে তারা জমি ছাড়বে না
  • রেকর্ডভুক্ত নির্দিষ্ট খাজনা ছাড়া অতিরিক্ত কিছু দেওয়া হবে না
  • রসিদ ছাড়া খাজনা দেওয়া হবে না
  • বাটাই বা শস্যের ভাগ দ্বারা খাজনা না দিলে টাকায় খাজনা দেওয়া হবে
  • বেগার প্রথা বন্ধ করা হবে
  • গ্রামে সংঘটিত বিবাদ, পঞ্চায়েতে মীমাংসা করা হবে
  • যে কোনো পরিস্থিতিতে কৃষকদের মধ্যে একতা রক্ষা করতে হবে।

জাতীয় কংগ্রেস ও একা আন্দোলন – প্রাথমিক পর্যায়ে কংগ্রেস ও খিলাফতি নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পরবর্তীতে একা আন্দোলন কংগ্রেস নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে। পথে চলা শুরু করে। মাদারি পাশি ও অন্যান্য অনুন্নত শ্রেণির কিষাণ নেতা এই আন্দোলনকে তাঁদের নিজস্ব পথে পরিচালিত করেন। ফলে কংগ্রেস এই আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

একা আন্দোলনে হিংসার প্রকাশ – একা আন্দোলন ক্রমে হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। কুমায়ুন অঞ্চলের সংরক্ষিত অরণ্য জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। জমিদার ও তালুকদারদের গৃহ আক্রান্ত হয়। ফলে সরকার দমননীতি প্রয়োগ করে একা আন্দোলন দমন করে।

উপসংহার – পরিশেষে বলা যায় যে, কংগ্রেস ও খিলাফতি নেতাদের উদ্যোগেই একা কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয় এবং মাদারি পার্শির নেতৃত্বে কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নেয়। এই আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত কৃষক বিদ্রোহ।

কেরালার মালাবার অঞ্চলের মোপলা বিদ্রোহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো।

ভূমিকা – অসহযোগ আন্দোলনের সময় উত্তাল কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল কেরালার মালাবার অঞ্চল। মালাবারের মোপলারা ছিল মুসলিম কৃষক সম্প্রদায়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মোপলারা জমিদার শ্রেণির সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে এক সংগঠিত পৃথক আন্দোলন গড়ে তোলে যা মোপলা বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

বিদ্রোহের ব্যাপকতা – খিলাফতের প্রভাবে মালাবারের চির-অস্থির মোপালারা খিলাফত শব্দটিকে জমিদার বিরোধী বিদ্রোহের প্রতীক রূপে গ্রহণ করে। মোপলাদের আক্রমণে বহু জমিদার বাড়ী থানা, সরকারী দপ্তর আক্রান্ত হয় এবং এই অঞ্চল থেকে সাময়িকভাবে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ ঘটে। মালাবারের বহু স্থানে খিলাফতি সাধারণতন্ত্র স্থাপিত হয়। ইয়াকুব হাসান, আলি মুসলিয়ার ছিলেন উল্লেখযোগ্য নেতা।

বিদ্রোহের চরিত্র – মালাবার অঞ্চলের অধিকাংশ জমিদারই ছিলেন জাতিতে হিন্দু। ফলে হিন্দু জমিদাররা আক্রান্ত হতে থাকে। এর ফলে ক্রমে মোপলা বিদ্রোহ ক্রমান্বয়ে সাম্প্রদায়িক রূপ পরিগ্রহ করে। মোপলা বিদ্রোহ ছিল মূলতঃ কৃষক বিদ্রোহ কিন্তু ধর্মান্ধতার দরুণ তা সাম্প্রদায়িক চরিত্র ধারণ করে। ধর্মান্ধতার কারণে ক্রমে সাধারণ হিন্দুদের ওপরও আঘাত আসে। প্রায় ৬০০ হিন্দু নিহত হয় এবং ২৫০০ হিন্দুকে বলপূর্বক ধর্মান্তকরণ করা হয়। মোপলা নেতা বুন মহম্মদ শত চেষ্টা করেও এই প্রবণতা দূর করতে পারেননি।

ব্যর্থতা – সরকার সামরিক আইন জারি করে মোপলা বিদ্রোহ দমন করে। প্রায় ২৩৩৭ জন মোপলা নিহত হয়।

উপসংহার – খিলাফত ও কংগ্রেসের নেতাদের কাছ থেকেই মোপলা বিদ্রোহের প্রাথমিক প্রেরণা এসেছিল। অবশ্য নেতারা অহিংসপথে আন্দোলনের পক্ষাপাতী ছিলেন। কিন্তু মোপলা বিদ্রোহ পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িক রূপ পরিগ্রহ করলে কংগ্রেস ও খিলাফতরা আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

বারদৌলি সত্যাগ্রহ (১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ) – টীকা লেখো।

গুজরাটের সুরাট জেলার বারদৌলি তালুকে সরকার ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ৩০ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধির কথা ঘোষণা করলে এখানকার হিন্দু ও মুসলমান কৃষকরা কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে যে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করে, তা বারদৌলি সত্যাগ্রহ নামে খ্যাত।

বারদৌলি সত্যাগ্রহ (১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ) - টীকা লেখো।

বারদৌলি সত্যাগ্রহ ও বল্লভভাই প্যাটেল –

খাজনা বন্ধ – ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে বল্লভভাই প্যাটেল বারদৌলিতে আসেন এবং কৃষকদের খাজনা বন্ধ করার শপথ নিতে নির্দেশ দেন। হিন্দু কৃষকরা গীতা এবং মুসলিম কৃষকরা কোরাণ ছুঁয়ে শপথ নেয় যে, সরকার প্রচলিত হারে খাজনা নিতে রাজী না হলে খাজনা প্রদান বন্ধ করা হবে। এরপর বারদৌলি সত্যাগ্রহ অর্থ শুরু হয়।

১৩টি অঞ্চল – প্যাটেল বারদৌলি তালুককে ১৩টি অঞ্চলে ভাগ করে প্রতিটি অঞ্চলে অভিজ্ঞ নেতার হাতে আন্দোলন পরিচালনার ভার দেন। বারদৌলি থেকে সত্যাগ্রহ পত্রিকা প্রকাশ করা হয়।

আন্দোলনে বাইরের সমর্থন – বারদৌলির কৃষকদের সমর্থনে বোম্বাই প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক আন্দোলনের হুমকি দেওয়া হয়। সর্বস্তরের মানুষ এই সত্যাগ্রহকে শামিল হয়েছিল।

মহিলা নেতৃবৃন্দ – মধুবেন প্যাটেল, মণিবেন প্যাটেল, ভক্তিবাদ, শারদা মেহতা প্রমুখ দেশপ্রেমী নারীরা বারদৌলি সত্যাগ্রহে শামিল হয়। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে যে, বারদৌলির মহিলারা বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে অভিভূত হয়ে তাঁকে সর্দার অভিধায় ভূষিত করেছিলেন।

উপসংহার – আন্দোলনের ব্যাপকতায় সরকার বিচলিত হয়ে একটি তদন্ত কমিশন বসাতে বাধ্য হয়। এই কমিশন রিপোর্ট দেয় যে, এই খাজনা বৃদ্ধি ছিল অন্যায় ও অবিবেচনাপ্রসূত কাজ। এই কমিশন ৬.০৩ শতাংশ খাজনা বৃদ্ধি অনুমোদন করে। অবশেষে কৃষকরাও এই সংশোধিত হারে খাজনা দিতে সম্মত হলে বারদৌলি সত্যাগ্রহের পরিসমাপ্তি ঘটে।

আইন অমান্য আন্দোলনে কৃষক শ্রেণির ভূমিকা কী রূপ ছিল?

ভূমিকা – আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির তেমন উৎসাহ লক্ষ্য করা না গেলেও কৃষকরা বিপুল সংখ্যায় এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে তা পুষিয়ে দেয়। এই সময় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জঙ্গী কৃষক আন্দোলন দানা বাঁধে। বামপন্থী মনোভাবাপন্ন কংগ্রেসের সমাজতান্ত্রিক নেতারা এই সব আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

কৃষক শ্রেণি ও আইন অমান্য আন্দোলন – ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ কৃষক শ্রেণিকে জঙ্গী আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাদের মধ্যে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে চেতনা জাগ্রত হয়। কৃষকদের খাজনা বন্ধকে কংগ্রেসের কর্মসূচীর অন্তর্গত করা হয়।

উত্তরপ্রদেশের কিষাণ আন্দোলন – উত্তরপ্রদেশে কিষাণ আন্দোলনের সমর্থন ছাড়া আইন অমান্য আন্দোলনকে গণআন্দোলনে পরিণত করা কঠিন ছিল। সরকারী খাজনা বন্ধ করার মধ্য দিয়েই উত্তরপ্রদেশে কিষাণ আন্দোলন শুরু হয়। জমিদার ও তালুকদারদেরও খাজনা বন্ধ করা হয়। রায়বেরিলি, আগ্রা, বারঝাকি প্রভৃতি জেলায় আন্দোলন প্রসারিত হয়। জওহরলাল নেহরু এই কিষাণ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

গুজরাটের কিষাণ আন্দোলন – গুজরাটের সুরাট ও খেদা অঞ্চলের কৃষকরা খাজনা বন্ধ করে দেয়। সরকারী দমননীতি থেকে রক্ষা পেতে তারা প্রতিবেশি বরোদা রাজ্যে আশ্রয় নেয়। বহু কৃষকের জমি নীলামে বিক্রি হয়।

বাংলার কিষাণ আন্দোলন – বাংলার কিশোরগঞ্জে কৃষক আন্দোলন শুরু হয়। বাংলায় চৌকিদারী কর বন্ধ করা হয়।

অন্যান্য স্থানে – এছাড়াও পাঞ্জাবে জলসেচ কর ও ভূমিরাজস্ব হ্রাসের দাবী জানানো হয়, বিহারে যদুনন্দন শর্মার নেতৃত্বে কিষাণ আন্দোলন, কৃয়া জেলায় খাজনা বন্ধের আন্দোলন প্রভৃতি ছিল আইন অমান্য আন্দোলনের সময় উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলন।

উপসংহার – আইন অমান্য আন্দোলনে কৃষকদের শামিল করে কংগ্রেসী নেতারা কৃষক আন্দোলনকে সর্বদাই সীমার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত রাখতেন এভাবে কৃষক আন্দোলনের স্বয়ংক্রিয় ও চরমপন্থী চরিত্র গ্রহণে বাধাদান করেন।

আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির ভূমিকা কীরূপ ছিল?

ভূমিকা – অসহযোগ আন্দোলনের সময় শ্রমিক শ্রেণি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু আইন অমান্য আন্দোলনে বিশেষ স্থান ও সময় ছাড়া শ্রমিকরা এই আন্দোলনে উৎসাহ দেখায়নি।

শ্রমিক বিমুখতার কারণ – আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকদের যোগ না দেওয়ার কারণগুলি হল —

  • আইন অমান্য আন্দোলনের প্রাক্কালে কমিউনিস্ট পরিচালিত গিরনী কামগর শ্রমিকদের ধর্মঘটসহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের শ্রমিক ধর্মঘটে বিফলতা জনিত হতাশা
  • ছাঁটাইয়ের ফলে শ্রমিকরা শক্তিহীন হয়ে পড়ে
  • আন্দোলনে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে কোনো সবুজ সংকেত না দেওয়া।

শ্রমিকদের ভূমিকা – আইন অমান্য আন্দোলনে শ্রমিকদের যোগদানের বিভিন্ন দিকগুলি হল —

কমিউনিস্ট পার্টির নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও শ্রমিকরা সম্পূর্ণরূপে উদাসীন থাকতে পারেননি। মহারাষ্ট্রের শোলাপুরে শ্রমিক হাঙ্গামা প্রমাণ করে যে, শ্রমিকরা পূর্ণস্বরাজের দাবীর মূল্য উপলব্ধি করতে পেরেছে। আইন অমান্য আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বোম্বাই বন্দরে শ্রমিক আন্দোলনের ফলে প্রায় ৩০ কোটি টাকা মূল্যের বিদেশি পণ্য বাজারে আটকে পড়ে। বোম্বাই-এ ব্রিটিশ পরিচালিত অনেক সুতাকল বন্ধ হয়ে যায়। আইন অমান্য আন্দোলন শুরুর দিন অর্থাৎ ৬ এপ্রিল ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই-এ জি. আই. পি. রেলওয়ে মেনস্ ইউনিয়নের শ্রমিকরা সত্যাগ্রহ শুরু করে। এই সময়ে করাচির বন্দর শ্রমিকরা, কলকাতার পরিবহন ও কারখানার শ্রমিকরা এবং মাদ্রাজের শিল্পশ্রমিকরা ব্রিটিশ বিরোধী ধর্মঘটে অংশ নিয়েছিলেন।

উপসংহার – পরিশেষে বলা যায় যে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভারতের সর্বত্র শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত না হলেও কোথাও কোথাও শ্রমিকরা আইন অমান্য আন্দোলনের পূর্ণস্বরাজের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। অন্যদিকে কমিউনিস্টরা জাতীয় আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

সর্বভারতীয় কিষাণ সভা (১৯৩৬ খ্রি:) – টীকা লেখো।

বিশ শতকের ত্রিশের দশকে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্ট দল কিষাণ আন্দোলনগুলি পরিচালনা করে। সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টদের যৌথ প্রচেষ্টায় ফলশ্রুতি হল সর্বভারতীয় বা নিখিল ভারত কিষাণ সভা গঠন।

সর্বভারতীয় কিষাণ সভা গঠন – অধ্যাপক এন. জি. রঙ্গের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কিষাণ সংগঠনের (১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ) লখনউ অধিবেশনে সর্বভারতীয় কিষাণসভা গঠিত হয়। বিহারের বিখ্যাত কিষাণনেতা স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী ছিলেন সর্বভারতীয় কিষাণ সভার প্রথম সভাপতি এবং এন. জি. রঙ্গ ছিলেন প্রথম সাধারণ সম্পাদক। জয়প্রকাশ নারায়ণ, রাম মনোহর লোহিয়া, ইন্দুলাল যাজ্ঞিক, নাম্বুদ্রিপাদ এই কিষাণ সভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

সর্ব ভারতীয় কিষাণ সভা গঠনের উদ্দেশ্যে – ইন্দুলাল যাজ্ঞিক কিষাণ বুলেটিনে এই সভার উদ্দেশ্য ঘোষণা করেন। এই সভার উদ্দেশ্যগুলি হল —

  • কৃষকদের অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক অসাম্য দূর করা
  • জমিদারী প্রথার বিলোপ
  • কৃষিঋণ মুকুব বা কৃষকের গৃহীত ঋণ পরিশোধের জন্য বিলম্বিত ব্যবস্থা
  • বেগার শ্রমের বিলোপ
  • ভূমিহীনদের ভূমিদান
  • কৃষকের জমিতে স্থায়ী স্বত্ব প্রদান
  • অরণ্যের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

গুরুত্ব – সর্বভারতীয় কিষাণ সভা গঠনের মধ্য দিয়ে কৃষক শ্রেণি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ শুরু করে। দেশের মুক্তি সংগ্রামে ভারতীয় জনগণের বৃহত্তম অংশ শামিল হওয়ার সুযোগ পায়। রুশ ঐতিহাসিক জি. কটোভস্কির মতে, ভারতের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে সর্বভারতীয় কিষাণ সভার প্রতিষ্ঠা একটি স্মরণীয় ঘটনা।

উপসংহার – সর্বভারতীয় কিষাণ সভা গঠনের ফলে কিষাণ আন্দোলনে নবপ্রাণের সঞ্চার ঘটে।

বিশ শতকের ৪০-এর দশকে সংগঠিত বাংলার তেভাগা আন্দোলনের বিবরণ দাও।

ভূমিকা – ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিষাণসভার উদ্যোগে এবং কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়।

তেভাগার দাবীসমূহ – কমিউনিস্ট দলের নেতৃত্বে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিষাণসভা ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তেভাগা আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। তেভাগার দাবীসমূহগুলি হল —

  • উৎপন্ন ফসলের ২/৩ ভাগ কৃষকের প্রাপ্য মালিক পাবে ১/৩ অংশ।
  • জমিতে ভাগচাষীকে দখলিস্বত্ব দিতে হবে
  • ১২(১/২) শতাংশ এর বেশি সুদ মহাজন বা জমিদাররা দাবী করতেপারবে না
  • কোনো কাজে কর (আবওয়াব) আদায় দি করা যাবে না
  • ফসলের ভাগ নিয়ে রসিদ দিতে হবে
  • ভাগচাষীর খামারে ধান তুলতে হবে
  • আধি নয়, তেভাগা চাই, কর্জ ধানের সুদ নাই
  • ১ মনে ৫ সের – এর বেশি সুদ নেওয়া যাবে না।

বিস্তৃতি – তেভাগা আন্দোলন বাংলার প্রায় সব জেলায় শুরু হয়েছিল, দিনাজপুর, ময়মনসিং, কাকদ্বীপ, রংপুর, বগুড়া, জলপাইগুড়ি যশোর ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। খুলনা জেলায় স্লোগান ওঠে, লাঙল যার, জমি তার। দিনাজপুরের আদিবাসী কৃষকরা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বাংলার প্রায় ৬০ লক্ষ কৃষক এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই বিদ্রোহের চরিত্রগত স্বাতন্ত্র্য উল্লেখ করে ঐতিহাসক ধনাগারে লিখেছেন, It was the first consciously attempted revolt by a politicsed Peasantry in Indian History.

নেতৃবৃন্দ – তেভাগা আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য নেতা, নেত্রীরা হলেন — গুরুদাস তালুকদার, ভবানী সেন, অবনী রায়, ভবানী সেন, চারু মজুমদার, সমর গাঙ্গুলী, সুশীল সেন, জলপাইগুড়ির রাজবংশী বৃদ্ধা মহিলা বুড়িমা প্রমুখ।

উপসংহার – সরকারের কঠোর দমননীতি, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, সার্বিক ঐক্যের অভাব ইত্যাদি কারণে আন্দোলন। ব্যর্থ হলেও পরবর্তীকালে বর্গাদার আইন, বাংলা ভূমিস্বত্ব আইন, জমিদারী উচ্ছেদ প্রসঙ্গে তেভাগা আন্দোলনের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না।

পুন্নাপ্রা-ভায়লার গণসংগ্রাম (১৯৪৬ খ্রি:) – টীকা লেখো।

ভূমিকা ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের পুন্নাপ্রা-ভায়লার অঞ্চলের কৃষক ও শ্রমিকরা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তীব্র আন্দোলন শুরু করে যা পুন্নাপ্রাভায়লার গণসংগ্রাম নামে পরিচিত।

আন্দোলনের কারণ – রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেই ত্রিবাঙ্কুরের হত দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকরা গণসংগ্রামে শামিল হয়েছিল। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর খাদ্যাভাব ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং রাজার স্বৈরাচারী শাসন ও শোষণে কৃষক ও শ্রমিকদের দুর্দশা চরমে ওঠে। অপরদিকে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের দেওয়ান কর্তৃক ত্রিবাঙ্কুরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত না করে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে রাখার বাসনা–সেখানকার জনগণকে খেপিয়ে তুলেছিল। জনগণ চেয়েছিল স্বাধীন ভারতের নাগরিক হতে। অথচ দেওয়ান সি. পি. রামস্বামী আয়ার এই রাজ্যটি কে স্বাধীন রাখার জন্য মার্কিন ধাঁচে এক সংবিধান রচনা করেন।

আন্দোলনের নেতৃত্ববর্গ – বামপন্থী নেতা কে. সি. জর্জ ও টি. ভি. টমাস পুন্নাপ্রা-ভায়লার গণ সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁদের নেতৃত্বে স্লোগান ওঠে – দেওয়ানের শাসন খতম করো ; স্বাধীন ত্রিবাঙ্কুর ও মার্কিন মডেল আরব সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দাও।

পুন্নাপ্রার যুদ্ধ – কমিউনিস্টরা ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন মডেলের সংবিধানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার শুরু করেন। তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী ত্রিবাঙ্কুর সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরাপাকড় শুরু করে। কমিউনিস্ট নেতৃত্বে কৃষকরা আত্মরক্ষার তাগিদে বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নিয়ে প্রতিরোধ শুরু করেন। আলেপ্পে শেরতেলিতে একটি সাধারণ রাজনৈতিক ধর্মঘট শুরু হয়। পুন্নাপ্পা পুলিশ ফাঁড়ি অক্রান্ত হয়, পুলিশি অত্যাচারও চরমে ওঠে।

ভায়লারের যুদ্ধ – আলেপ্পে শেরতেলিতে রাজনৈতিক ধর্মঘটের কারণে — সমগ্র রাজ্যে সামরিক আইন জারি করা হয়। ২৭ অক্টোবর সেনাবাহিনি প্রায় ৮০০ কমিউনিস্টকে নিধন করে তাদের সদর দপ্তর ভায়লার দখল করে।

ত্রিবাঙ্কুরের ভারত চুক্তি – ত্রিবাঙ্কুরের দেওয়ান গান্ধিজিকে জানান যে, ত্রিবাঙ্কুর স্বাধীন থাকবে। গান্ধি বিরক্ত হয়ে বলে, কোনো রাজা যদি বলে যে চিরদিন স্বাধীন ছিল ও ভবিষ্যতে থাকবে তবে সেটা অত্যন্ত ভুল হবে, অশোভন হবে। এই সময় এক অজ্ঞাত আততায়ীর দ্বারা ছুরিকাহত হয়ে দেওয়ান রামস্বামী আয়ার ত্রিবাঙ্কুরের ভারতভুক্তিতে সেই করেন।

উপসংহার – তাই কমিউনিস্টদের কাছে বীর শহীদদের গৌরবময় আত্মবলিদানের আজ এক নাম পুন্নাপ্রা – ভায়লার।

তেলেঙ্গানা আন্দোলনের ওপর একটি টীকা লেখো।

ভূমিকা – স্বাধীনতার প্রাক্কালে হায়দরাবাদ রাজ্যের তেলেঙ্গানায়, কমিউনিস্ট পরিচালিত সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন তেলেঙ্গানা আন্দোলন নামে পরিচিত। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যভাগ থেকে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলেছিল।

অঞ্চলগুলির পরিচয় – ভারতের মানচিত্রের পূর্বদিকে ৯টি তেলেগু ভাষাভাষি জেলা নিয়ে এই তেলেঙ্গানা অঞ্চল গড়ে উঠেছে। এই জেলাগুলি হল — ওয়ারাঙ্গাল, নালগোল্ডা, মেহবুবনগর, হায়দরাবাদ, আদিলাবাদ, করিমনগর ও নিজামাবাদ প্রভৃতি। ইংরেজ আমলে নিজাম শাসিত এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

আন্দোলনের কারণ –

  • নিজামের অত্যাচার – নিজাম শাসিত হায়দরাবাদ রাজ্যটি ছিল স্বৈরাশাসনের কেন্দ্র, নিজাম-এর শাসন ছিল মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের অনুরূপ।
  • জমিদারদের কর – কৃষকদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো খাজনা আদায় করা হত। এছাড়া হরিজনদের কাছ থেকে ভেট্টি নামক বাধ্যতামূলক শ্রমকর আদায় করা হত। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে জমিদারদের বাড়তি কর দিতে হত।

আন্দোলনের বিস্তৃতি – ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জুলাই লালগোন্ডায় প্রথম বিদ্রোহ শুরু হলে ধীরে ধীরে তা ওয়ারাঙ্গল, খাম্বাস ও অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। কমিউনিস্ট পরিচালিত এই দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র আন্দোলনে তিন হাজার গ্রামের প্রায় ৩০ লক্ষ দরিদ্র কৃষক অংশ নিয়েছিল। পি সি. সুন্দরাইয়া, রবিনারায়ণ রেড্ডি, ইয়েলো রেড্ডি প্রমুখরা ছিলেন তেলেঙ্গানা আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব।

গুরুত্ব – তেলেঙ্গানা আন্দোলন ছিল প্রথম সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন — যা কৃষকদের সংগ্রামশীল চরিত্রের এক বড়ো দৃষ্টান্ত। অধ্যাপক সুনীল সেনের ভাষায় তেলেঙ্গানা আন্দোলনের বিজয় স্বীকার্য। নিজামের শাসকের অবসান হল। পুরোনো স্বৈরতন্ত্র ধ্বংস হল। হায়দরাবাদ ভারত ইউনিয়নে যোগ দিল।

সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস – টীকা লেখো।

ভূমিকা – ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে শ্রমিকদের সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে দেশব্যাপী সারা ভারতশ্রমিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকেই জন্ম নেয় সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (AITUC)।

পটভূমি – ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের অমৃতসর অধিবেশনে প্রথম শ্রমিকদের প্রশ্নকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয় এবং প্রতিটি প্রাদেশিক সংগঠনকে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। নাগপুর অধিবেশনে (১৯২০ খ্রি:) ও গয়া অধিবেশনে শ্রমিক আন্দোলনকে গুরুত্ব দিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে পরিচালনার জন্য গঠিত হয় একটি বিশেষ কমিটি।

সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস - টীকা লেখো।

সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন গঠন – ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ৩০ অক্টোবর মাদ্রাজে সারা ভারত শ্রমিক সম্মেলনে ১৮টি শ্রমিক। ইউনিয়নের ৮০৬ জন প্রতিনিধি যোগদান করে। এর ফলশ্রুতি হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে গঠিত হয় শ্রমিকদের জন্য নিজস্ব সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন (AITUC) সংগঠন। লালা লাজপত রায় এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন এবং সম্পাদক ছিলেন দেওয়ান চমনলাল। জোসেফ ব্যপ্তিস্তা ছিলেন সহসভাপতি।

কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি – জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের মধ্যে লালা লাজপত রায়, চিত্তরঞ্জন দাস প্রমুখ নেতৃবর্গ সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন। লাজপত রায় তাঁর ভাষণে সাম্রাজ্যবাদের অশুভ পরিণাম সম্পর্কে মালিকপক্ষকে সতর্ক করেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সংগঠনটিকে কংগ্রেসের কাছাকাছি রাখতে তিনি ইচ্ছুক ছিলেন।

দ্বিতীয় অধিবেশন – AITUC-র দ্বিতীয় অধিবেশনে দেওয়ান চমনলাল স্বরাজ সম্পর্কিত প্রস্তাব উপস্থাপন করার সময় মন্তব্য করেন যে, এই স্বরাজ পুঁজিপতিদের জন্য নয় ; তা শ্রমিকদের মঙ্গলের জন্যই অর্জন করতে হবে (It was to be a swaraj not for the capitalist, but for the wokers.)।

উপসংহার – মহাত্মাগান্ধি শ্রমিক সংগঠনের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ দেখান নি। তিনি অর্থনৈতিক কারণে পুঁজিপতিদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলারই পক্ষপাতী ছিলেন। কাজেই শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে জাতীয় কংগ্রেসের এই জটিল দৃষ্টিভঙ্গীর পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিক শ্রেণিও কখনো কখনো জাতীয় আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল। তবুও একথা অনস্বীকার্য যে, সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভারতীয় শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পেজেন্টস্ পার্টি – টীকা লেখো।

অসহযোগ আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন স্তিমিত হয়ে

ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পেজেন্টস্ পার্টি - টীকা লেখো।

যায়। এইরূপ পরিস্থিতিতে ভারতে গণকমিউনিস্ট শ্রমিক ও কৃষকদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠে — ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি।

ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি গঠন – শ্রমিক-কৃষকদের লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে দি লেবার পেজেন্টস্ স্বরাজ পার্টি অব দ্য ন্যাশনাল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে এই পার্টির নাম পরিবর্তন করে মুজাফ্ফর আহমেদ, কবি নজরুল ইসলাম, এস. এ. ডাঙ্গে, কুতুবউদ্দিন আহমেদ এবং হেমন্ত কুমার সরকারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে পেজেন্টস্ এ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টি। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় এর নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ওয়াকার্স এ্যান্ড পেজেন্টস্ পার্টি (Workers and Peasants Party) আত্মপ্রকাশ করে।

উদ্দেশ্য – ওয়াকার্স এ্যান্ড পেজেন্টস্ পার্টির উদ্দেশ্যগুলি হল —

  • শ্রমিকদের কাজের সময় সীমা নির্ধারণ
  • বাক্ স্বাধীনতা অর্জন
  • সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অর্জন
  • জমিদারী প্রথার বিলোপ সাধন এবং
  • সর্বনিম্ন মজুরি আইন প্রবর্তন ইত্যাদি।

এই সংগঠনটি তার উদ্দেশ্য পুরণের লক্ষ্যে যে আন্দোলনগুলি চালিয়েছিল, জাতীয় কংগ্রেসও সেইসব আন্দোলনের প্রতি পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে সহানুভূতি দেখিয়েছিল। কলকাতার ধাঁচে পরবর্তীকালে পাঞ্জাব ও বোম্বাই সমেত আরো অন্যান্য অঞ্চলে এইরূপ সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। তবে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে সংগঠনটি সফলতা পেলেও কৃষকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সাফল্য ছিল ক্ষীণ।

বখস্ত আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

ভূমিকা – বিহারে বখস্ত জমি বলতে বোঝাত জমিদারদের খাস জমি। ১৯৩০-র মন্দার দরুণ যে জমির খাজনা বাকি পড়েছিল জমিদাররা সেই জমিগুলিকে বাজেয়াপ্ত করে খাস জমিতে পরিণত করে। বিহারের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বখস্ত জমি থেকে প্রজাদের উচ্ছেদ শুরু হলে শুরু হয় বখস্ত আন্দোলন। সহজানন্দ সরস্বতী বিহার কিষাণ সভা গঠনের মাধ্যমে জমিদার বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন।

প্রেক্ষাপট – ফসলের একাংশ খাজনা দিয়ে প্রজারা এই জমিচাষ করত। জমিদারদের প্রবণতা ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তহীন জমিগুলিকে বখস্ত বা খাস জমিতে পরিণত করা। বখস্ত জমি থেকে প্রজাদের উচ্ছেদ শুরু হলে গয়া, মুঙ্গের, পাটনা ও ছোটোনাগপুরে কৃষক বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে।

কংগ্রেসী মন্ত্রীসভার ঘোষণা – ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বিহারে কংগ্রেসী মন্ত্রীসভা একটি আইন দ্বারা স্থির করেন যে, বকেয়া খাজনার দায়ে যেসব জমি নীলাম করা হয়, সেই নীলামের অর্ধেক টাকা দিলে মূল চাষীকে জমি ফেরত দেওয়া হবে। এই আইনে সন্তুষ্ট না হয়ে বামপন্থীরা বখস্ত জমির জন্য আন্দোলন চালাতে থাকে। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে পাটনায় প্রায় কুড়ি হাজার কৃষক বিক্ষোভ আন্দোলনে শামিল হয়।

আন্দোলনকারীদের দাবী – আন্দোলনকারীদের স্লোগান ছিল, আমাদের রুটি দাও, আমরা ক্ষুধার্ত,সমস্ত কৃষিঋণ মুকুব করতে হবে,জমিদারী প্রথা ধ্বংস হোক, প্রজাদের উচ্ছেদ করা চলবে না ইত্যাদি।

আন্দোলনের বিস্তার – আন্দোলন গোটা বিহারে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিহারের কিষাণনেতা সহজানন্দকে কংগ্রেস কমিটি বিক্ষুব্ধ এলাকা পরিদর্শনে নিষেধ করে। সহজানন্দ বখস্ত আন্দোলনে কংগ্রেসের ভূমিকার নিন্দা করেন।

ব্যর্থতা – ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে সরকারী দমননীতির চাপে বখস্ত আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। অনেক জায়গায় জমিদারদের লাঠিয়ালের সঙ্গে কৃষকদের সংঘর্ষ হয়। তাছাড়া কংগ্রেসের সঙ্গে এই আন্দোলনের কোনো সংযোগ না থাকায় আন্দোলনের সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ ছিল।

মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৯ খ্রি:) – টীকা লেখো।

ভূমিকা – ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ ব্রিটিশ উত্তর সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৩২জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেপ্তার করে তাঁদের বিরুদ্ধে যে মামলা রুজু করা হয়, তা শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা নামে খ্যাত।

প্রেক্ষাপট – ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনা, কমিউনিস্ট পার্টি গঠন এবং শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক পরিপক্কতার ফলে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে থেকে শ্রমিক আন্দোলন জঙ্গী চরিত্র ধারণ করে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এস. এ. ডাঙ্গে, মিরাজকর প্রমুখ শ্রমিক নেতার নেতৃত্বে বোম্বাই গিরনী কামগার ইউনিয়নের দেড় লক্ষ শ্রমিক ছ’মাস ব্যাপী বোম্বাই-এর বস্ত্ৰকলে ধর্মঘট চালায়। এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে Public Safety Act এবং Trade disputes Act (এপ্রিল ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ) প্রণয়ন করা হল। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিক আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া।

প্রতিক্রিয়া – ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে AITUC-র ঝরিয়া অধিবেশনে এই আইনের তীব্র নিন্দা করা হয়। কলকাতা প্রকাশিত বিশ্বমিত্র পত্রিকা এই বিলটিকে ধিক্কার জানায়, গণবাণী পত্রিকায় লেখা হল, বিলটি শ্রমিকের চিরন্তন দাসত্বের সূচনা করছে।

নেতাদের গ্রেপ্তার – (১৯২৯ খ্রি:) ২০ মার্চ Public Safety Act এবং Trade Disputes Act – এর দ্বারা ৩২ জন শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- মুজাফ্ফর আহমেদ, এস. ভি. ঘাটে, এস. এ. ভাঙ্গে, পি. সি. যোশী, মিরাজকর, ধরনী গোস্বামী, গঙ্গাধর অধিকারী প্রমুখ।

পরিণতি – দীর্ঘ সাড়ে চার বছর মামলা চলার পর মোট ২৭জন বন্দীর বিভিন্ন মেয়াদে অত্যাধিক কঠোর দন্ডাদেশ হয়। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৩ আগস্ট এই মামলা সমাপ্ত হয়। ব্রিটিশ শ্রমিক দল এই মামলার রায়কে Judicial Scandal বলে নিন্দা করে।

কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের উদ্ভব কিভাবে হয়?

ভূমিকা – বিশ শতকের দ্বিতীয় শতক থেকেই ভারতের কংগ্রেসের অভ্যন্তরে একটি বামপন্থী মনোভাবাপন্ন গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে — যার ফলশ্রুতিরূপে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

প্রেক্ষাপট – কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের উদ্ভবের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে

  • রুশ বিপ্লবের প্রভাব ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রাধান্য
  • অসহযোগ আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা
  • শ্রমিক-কৃষক ও সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুদর্শায় কংগ্রেস নেতৃত্বের উদাসীনতা
  • কমিউনিস্ট কার্য কলাপের প্রভাব
  • সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসুর প্রভাব
  • আইন অমান্য আন্দোলনের ব্যর্থতা প্রভৃতি কারণে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে একটি বামপন্থী গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে।

কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল গঠন – ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে পাটনায় আচার্য নরেন্দ্রদেবের সভাপতিত্বে সর্বভারতীয় সমাজতন্ত্রী সম্মেলনে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল গঠনের প্রস্তাব নেওয়া হয়। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ২৩ অক্টোবর বোম্বাই-এ আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল আত্মপ্রকাশ করে।

নেতৃত্ববৃন্দ – আচার্য নরেন্দ্রদেব, জয়প্রকাশ নারায়ণ, অচ্যুত পটবর্ধন, রাম মনোহর লোহিয়া, ইউসুফ মেহের আলি, মিনু মাসানি প্রমুখরা ছিলেন কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের মুখ্য সঞ্চালক।

উদ্দেশ্য – এই দলের মুখ্য উদ্দেশ্যগুলি ছিল –

  • স্বাধীনতার জন্য জাতীয় সংগ্রামকে ভারতের প্রাথমিক সংগ্রামে পরিণত করে
  • জাতীয়তাবাদ সমাজতন্ত্রের পথে একটি প্রয়োজনীয় পর্যায়
  • সমাজতন্ত্রী হিসেবে ভারতীয় কংগ্রেসের মধ্য থেকে কাজ করা, কারণ কংগ্রেস একটি নেতৃত্বদানকারী প্রাথমিক সংগঠন। আদতে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে থেকে বামপন্থী শক্তিকে সুদৃঢ় করা।

কর্মসূচী – কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীদলের কর্মসূচীগুলি হল —

  • জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী এবং শ্রমিক স্বার্থবিরোধী আইনকে বাতিল করতে হবে
  • স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের অপরাধে জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া কৃষক ও চাষীর জমি ফেরত দিতে হবে
  • অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে
  • ধর্মঘট, পিকেটিং ও ইউনিয়ন গঠনের অধিকার দিতে হবে
  • জমিদারি ও তালুকদারি প্রথার বিলোপ ঘটাতে হবে, এবং
  • মতামত প্রকাশের অধিকার দিতে হবে।

উপসংহার – ১৯৪২ সালের ভারতছাড়ো আন্দোলনে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী অপ্রত্যাশিত সাহায্য করেছিল। তাদের মধ্যে নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল।

ভারতছাড়ো আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির অংশগ্রহণ কীরূপ ছিল?

ভূমিকা – ১৯৪২-র ভারতছাড়ো আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং একটি প্রকৃত গণআন্দোলন। এই আন্দোলনে কৃষক শ্রেণি অভূতপূর্ব খাড়া দিয়েছিল। সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও শ্রমিক শ্রেণিকে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখা যায়নি।

কৃষক শ্রেণির ভূমিকা – ভারতছাড়ো আন্দোলনে কৃষক সম্প্রদায়ের যোগদান এই আন্দোলনকে জঙ্গী চরিত্রদান করে। কৃষক আন্দোলনের ব্যপকতার বিভিন্ন দিকগুলি হল —

  • আসাম, বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি স্থানের কৃষকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যোগ দেয়।
  • বহু স্থানে কৃষকরা সরকারি খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। বাংলার বিভিন্ন জেলায় কৃষক আন্দোলন গণ বিদ্রোহের চরিত্র গ্রহণ করে।
  • মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার-গঠনের মাধ্যমে কৃষকরা সমান্তরাল সরকার পরিচালনা করতে থাকে।

শ্রমিক শ্রেণির ভূমিকা – ১৯৪২-র ভারতছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে ভারতের কমিউনিস্ট দল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে রাতারাতি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধের পরিবর্তে জনযুদ্ধ বলে ঘোষণা করে এবং নীতিগত কারণে ভারতছাড়ো আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। ব্যক্তিগত বিবেকের তাড়নায় কোনো কোনো কমিউনিস্টকর্মী ভারতছাড়ো আন্দোলনে বেসরকারীভাবে ব্যক্তিগত সমর্থন জানায়। তারই একটি অংশ ছিল শ্রমিক শ্রেণি।

শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপকতা

  • গান্ধিজি ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে কারারুদ্ধ করার প্রতিবাদে বোম্বাই, নাগপুর, আমেদাবাদ প্রভৃতি শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকরা এক সপ্তাহ ধরে ধর্মঘট ও কর্মবিরতি পালন করে।
  • জামশেদপুরে লৌহ ইস্পাত কারখানায় দুই মাস ধরে ধর্মঘট পালন করা হয়।

উপসংহার – ব্রিটিশ সরকার ভারতছাড়ো আন্দোলনের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টিকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। তাই কমিউনিস্ট পরিচালিত শ্রমিক আন্দোলনের ভূমিকা আশাব্যঞ্জক না হলেও কৃষক শ্রেণির অভূতপূর্ব সাড়া-শ্রমিক শ্রেণির কিছু অংশের অনীহাকে পুষিয়ে দিয়েছিল। তবে অধ্যাপক আদিত্য মুখার্জীর মতে, পার্টির লাইন আলাদা হওয়া সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ কমিউনিস্ট কর্মীরা ভারতছাড়ো আন্দোলন সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।

মানবেন্দ্রনাথ রায় (১৮৮৬-১৯৫৪) – টীকা লেখো।

ভূমিকা – ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য — যিনি এম. এন. রায় (মানবেন্দ্রনাথ রায়) নামেই বেশি পরিচিত। বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে পড়াকালীন ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদান করেন।

তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল বাঘাযতীনের নির্দেশে জার্মানীর কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রামের উদ্দেশ্য বাটাভিয়ায় যান। সেখান থেকে আমেরিকা হয়ে মেক্সিকোতে পৌঁছান এবং সেখানে মিখাইল বোরোদিন নামে এক বলশেভিক নেতার সংস্পর্শে আসেন ও মার্কসবাদ দীক্ষা নেন। অতঃপর ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে লেনিনের আমন্ত্রণে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সম্মেলনে ভারতের পক্ষ থেকে যোগ দেন। এখানেই ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর এম. এন. রায় অবনী মুখার্জী প্রমুখ নেতাদের নিয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে আত্মপ্রকাশ করে। যা পরের বছরই কমিনটার্ন-এর স্বীকৃতি লাভ করে।

মানবেন্দ্রনাথ রায় (১৮৮৬-১৯৫৪) - টীকা লেখো।

ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনে ভূমিকা – ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের পূর্বেই কিছু বিপ্লবী নিজ প্রচেষ্টায় কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গঠনের চেষ্টা করেন। এম. এন. রায় তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের স্থাপনের জন্য নলিনীগুপ্ত ও শওকত উসমানীকে ভারতে পাঠান। অসহযোগ আন্দোলনের হতাশাকে কাজে লাগিয়ে মানবেন্দ্রনাথ রায় ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন জোরদার করার উদ্যোগ নেন।

কমিউনিস্ট আন্দোলনে পরিচালনায় রণকৌশল – ভারতে কমিউনিস্ট দলকে শক্ত ভীতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি দ্বিস্তর আন্দোলনের কথা তুলে ধরেন —

  • জাতীয় আন্দোলনে যোগদানের মাধ্যমে আইনগত ও বৈধভাবে আন্দোলন করা
  • গোপনে শ্রমিক-কৃষক সংগঠন দ্বারা দলের নিজস্ব ভিত্তি শক্ত করা।

মূল্যায়ণ – মানবেন্দ্রনাথ রায়ের উদ্যোগেই ভারতের নানা প্রান্তে সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী মানুষজনের সহযোগিতায় কমিউনিস্ট পার্টির শাখা গড়ে ওঠে। যার চূড়ান্ত পরিণতি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কানপুরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা। এই কমিউনিস্ট নেতা ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি পরলোক গমন করেন।

ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।

ভূমিকা – ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কানপুরে মুজাফ্ফর আহমেদ-এর নেতৃত্বে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয় — যা শ্রমিক কৃষক আন্দোলনে একটি নতুন ধারা সংযোজন করে।

প্রেক্ষাপট – মানবেন্দ্র রায়ের উদ্যোগে উৎসাহিত হয়ে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ, লাহোর প্রভৃতি শহরে স্থানীয় সাম্যবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের সহযোগিতায় কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। বোম্বাই-এ. এস. এ. ডাঙ্গে, কলকাতায় মুজাফ্ফর আহমেদ, লাহোরে গুলাম হোসেন, মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার প্রমুখের নেতৃত্বে একাধিক কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এস. বি. ঘাটে ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট দলের প্রথম সাধারণ সম্পাদক।

জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ – এম. এন. রায় অত্যন্ত চতুরভাবে দলের দুটি ভাবমূর্তি গঠন করেন। একটি হল জাতীয় আন্দোলনের মূলস্রোতে যোগদান দ্বারা আইনগত ও বৈধভাবে আন্দোলন করা। অপরটি হল – গোপনে শ্রমিক-কৃষক সংগঠন দ্বারা দলের নিজস্ব ভিত্তি শক্ত করা।

মূল্যায়ণ – তবে নানা পরিস্থিতির চাপে বাধ্য-বাধকতার কারণে কমিউনিস্টরা জাতীয় আন্দোলন থেকে বিশেষত ভারতছাড়ো আন্দোলনে নিজেদেরকে গুটিয়ে রেখেছিল। তবে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে কমিউনিস্ট আদর্শ বেশ কিছুটা জাগরণ ঘটাতে পেরেছিল।

কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী প্রবণতা বৃদ্ধির নিদর্শন হিসেবে ত্রিপুরী কংগ্রেসের অধিবেশন গুরুত্বপূর্ণ কেন?

ভূমিকা – কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশনে (১৯৩৯ খ্রি:) বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে মতাদর্শগত বিরোধ চরমে ওঠে। এই অধিবেশনে বামপন্থীরা কোণঠাসা হয় এবং দক্ষিণ পন্থীদের একাধিপত্য বজায় থাকে।

প্রেক্ষাপট – গান্ধিজি ছিলেন কংগ্রেসের অবিংসবাদী নেতা নেহরুর কথায়, তাঁর (গান্ধিজি) কৃপাধন্য থেকে বঞ্চিত হওয়া মানে রাজনৈতিক অপমৃত্যু। কিন্তু সেই গান্ধীজির আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয়বারের জন্য কংগ্রেস সভাপতি পদে প্রার্থী হন। সভাপতি পদের নির্বাচনে সুভাষচন্দ্র গান্ধীজি মনোনীত দলীয় দক্ষিণপন্থী প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে ২০৩টি ভোটের (১৫৮০-১৩৭৭) ব্যবধানে পরাজিত করেন।

প্রতিক্রিয়া – সুভাষচন্দ্র বসুর জয়লাভে গান্ধিজি কড়া প্রতিক্রিয়া গান্ধিজি ব্যক্ত করেন। ফলতঃ কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতারা সুভাষচন্দ্রের বিরোধিতা এবং তাঁর প্রতি অসহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে। গান্ধিজিও সভাপতি হিসেবে সুভাষচন্দ্রের ক্ষমতা কাটছাঁট শুরু করলেন। এইরূপ পরিস্থিতিতে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে (২৯ এপ্রিল, ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ) সভাপতি পদে ইস্তফা দেন। অতঃপর ৩মে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি নতুন বামপন্থী দল গঠন করেন।

গুরুত্ব –

  • কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশন বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ, যেমন — কংগ্রেস ভাঙ্গনের মুখে পড়ে
  • ত্রিপুরী অধিবেশনের পর থেকে কংগ্রেসি রাজনীতিতে গান্ধীজির একাধিকপত্য প্রতিষ্ঠিত ও সুদৃঢ় হয়,
  • কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী শক্তিগুলিকে সুসংহত করার আশা বিলীন হয়।

বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলনগুলি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই আন্দোলনগুলি ভারতের জনগণকে স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে।

Share via:

মন্তব্য করুন