আজকের আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভৌতবিজ্ঞানের পঞ্চম অধ্যায় ‘আলো’ এর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সংক্ষেপে আলোচনা করব। এই অধ্যায় মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখান থেকে পরীক্ষায় নিয়মিত প্রশ্ন আসে। আশা করছি, এই আর্টিকেলটি আপনাদের পড়াশোনায় সহায়ক হবে।
গোলীয় দর্পণ – কোনো প্রতিফলক তল যদি কোনো গোলকের অংশবিশেষ হয়, তবে তাকে গোলীয় দর্পণ বলা হয়।
গোলীয় দর্পণ দু-ধরনের হতে পারে –
- অবতল দর্পণ (concave mirror) ও
- উত্তল দর্পণ (convex mirror)।
অবতল দর্পণ – যে গোলীয় দর্পণের ভিতরের অবতল পৃষ্ঠ, প্রতিফলক হিসেবে কাজ করে তাকে অবতল দর্পণ বলা হয়।
উত্তল দর্পণ – যে গোলীয় দর্পণের বাইরের উত্তল পৃষ্ঠ, প্রতিফলক হিসেবে কাজ করে তাকে উত্তল দর্পণ বলা হয়।
গোলীয় দর্পণের বক্রতা কেন্দ্র – কোনো গোলীয় দর্পণ যে গোলকের অংশ তার কেন্দ্রকে বক্রতা কেন্দ্র বলা হয়।
গোলীয় দর্পণের বক্রতা ব্যাসার্ধ – কোনো গোলীয় দর্পণ যে গোলকের অংশ সেই গোলকের ব্যাসার্ধকে ওই গোলীয় দর্পণের বক্রতা ব্যাসার্ধ বলা হয়।
গোলীয় দর্পণের প্রধান অক্ষ – কোনো গোলীয় দর্পণের মেরু ও বক্রতা কেন্দ্রগামী সরলরেখাকে প্রধান অক্ষ বলা হয়।
উপাক্ষীয় রশ্মি – কোনো গোলীয় দর্পণের মেরুর খুব নিকটবর্তী অংশে আপতিত এবং প্রধান অক্ষের সঙ্গে খুব কম নতিবিশিষ্ট রশ্মিকে উপাক্ষীয় রশ্মি বলা হয়।
অবতল দর্পণের মুখ্য ফোকাস – ক্ষুদ্র উন্মেষযুক্ত কোনো অবতল দর্পণের প্রধান অক্ষের সঙ্গে সমান্তরালভাবে আপতিত রশ্মিগুচ্ছ, দর্পণ দ্বারা প্রতিফলনের পর প্রধান অক্ষের ওপর একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে মিলিত হয়, সেই নির্দিষ্ট বিন্দুটিকে অবতল দর্পণের মুখ্য ফোকাস বলা হয়।
উত্তল দর্পণের মুখ্য ফোকাস – ক্ষুদ্র উন্মেষযুক্ত কোনো উত্তল দর্পণের প্রধান অক্ষের সঙ্গে সমান্তরালভাবে আপতিত রশ্মিগুচ্ছ, দর্পণ দ্বারা প্রতিফলনের পর প্রধান অক্ষের ওপর একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে অপসৃত হচ্ছে বলে মনে হয়, সেই নির্দিষ্ট বিন্দুটিকে উত্তল দর্পণের মুখ্য ফোকাস বলা হয়।
গোলীয় দর্পণের ফোকাস তল – গোলীয় দর্পণের প্রধান অক্ষের সঙ্গে লম্ব ও মুখ্য ফোকাস বিন্দুগামী সমতলকে ফোকাস তল বলা হয়।
কোনো গোলীয় দর্পণের ফোকাস দূরত্ব ও বক্রতা ব্যাসার্ধ যথাক্রমে f ও r হলে, f = r/2।
গোলীয় দর্পণের প্রধান অক্ষের সমান্তরালভাবে আপতিত রশ্মি দর্পণ দ্বারা প্রতিফলনের পরে অবতল দর্পণের ক্ষেত্রে মুখ্য ফোকাসের মধ্য দিয়ে যায় এবং উত্তল দর্পণের ক্ষেত্রে মুখ্য ফোকাস থেকে অপসৃত হচ্ছে বলে মনে হয়। গোলীয় দর্পণের মুখ্য ফোকাসগামী (অবতল দর্পণের ক্ষেত্রে) বা মুখ্য ফোকাসের দিকে পরিচালিত আপতিত রশ্মি (উত্তল দর্পণের ক্ষেত্রে) দর্পণ দ্বারা প্রতিফলনের পর প্রধান অক্ষের সমান্তরালভাবে যায়।
গোলীয় দর্পণের বক্রতা কেন্দ্রগামী (অবতল দর্পণের ক্ষেত্রে) বা বক্রতা কেন্দ্রের দিকে পরিচালিত রশ্মি (উত্তল দর্পণের ক্ষেত্রে) দর্পণের ওপর লম্বভাবে আপতিত হয়ে প্রতিফলনের পর একই পথে ফিরে যায়।
কোনো অবতল দর্পণে –
- বস্তু দূরত্ব 2f-এর বেশি হলে বা বস্তু বক্রতা কেন্দ্র থেকে দূরে থাকলে খর্বকায় সদবিম্ব গঠিত হয়।
- বস্তু দূরত্ব 2f-এর সমান হলে বা বস্তু বক্রতা কেন্দ্রে থাকলে সমান সাইজের সদবিম্ব গঠিত হয়।
- বস্তু দূরত্ব f-এর বেশি কিন্তু 2f-এর কম হলে বা বস্তু ফোকাস ও বক্রতা কেন্দ্রের মাঝে কোথাও অবস্থিত হলে বিবর্ধিত সদবিম্ব গঠিত হয়।
- বস্তু দূরত্ব f-এর কম বা মেরু ও মুখ্য ফোকাসের মধ্যে অবস্থিত হলে বিবর্ধিত অসদবিম্ব গঠিত হয়।
আলোর প্রতিসরণ – আলোকরশ্মি কোনো স্বচ্ছ ও সমসত্ত্ব মাধ্যম থেকে অন্য কোনো স্বচ্ছ ও সমসত্ত্ব মাধ্যমে প্রবেশ করার সময় দুই মাধ্যমের বিভেদতলে তির্যকভাবে আপতিত হলে, দুই মাধ্যমের বিভেদতলে আলোকরশ্মির অভিমুখের পরিবর্তন হয়, এই ঘটনাকে আলোর প্রতিসরণ বলা হয়।
প্রতিসরণের প্রথম সূত্র – আপতিত রশ্মি, প্রতিসৃত রশ্মি ও আপতন বিন্দুতে দুই মাধ্যমের বিভেদতলের ওপর অঙ্কিত অভিলম্ব একই সমতলে থাকে।
দ্বিতীয় সূত্র – দুটি নির্দিষ্ট মাধ্যম ও নির্দিষ্ট বর্ণের আলোক-রশ্মির প্রতিসরণের ক্ষেত্রে আপতন কোণের sine ও প্রতিসরণ কোণের sine-এর অনুপাত ধ্রুবক হয়।
আলোকরশ্মি দুই মাধ্যমের বিভেদতলে লম্বভাবে আপতিত হলে sin i = sin r / μ₂ সূত্রটি প্রযোজ্য নয়। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় মাধ্যমে আলোকরশ্মির অভিমুখের কোনো পরিবর্তন হয় না কিন্তু দ্বিতীয় মাধ্যমে আলোকরশ্মির গতিবেগের পরিবর্তন হয়।
আয়তাকার কাচের স্ল্যাবের একপাশে কোনো আলোকরশ্মি আপতিত হলে, আলোকরশ্মি ফলকের মধ্য দিয়ে গিয়ে যখন অপর পৃষ্ঠ থেকে নির্গত হবে তখন আপতিত রশ্মি ও নির্গত রশ্মি পরস্পরের সমান্তরাল হয়।
কোনো প্রিজমের প্রতিসারক কোণ A। প্রিজমের একটি প্রতিসারক তলে কোনো আলোকরশ্মি i1 কোণে আপতিত হয়ে প্রিজমের মধ্য দিয়ে গিয়ে অপর প্রতিসারক তল থেকে i2 কোণে নির্গত হলে চ্যুতিকোণ, D = i1 + i2 – A। প্রিজমের প্রথম প্রতিসারক তলে আলোকরশ্মির প্রতিসরণ কোণ = r1 ও দ্বিতীয় প্রতিসারক তলে আপতন কোণ = r2 হলে, A = r1 + r2।
কোনো নির্দিষ্ট প্রিজমের ক্ষেত্রে আপতন কোণের মান বাড়াতে থাকলে প্রথমে চ্যুতিকোণ কমতে থাকে এবং আপতন কোণের একটি নির্দিষ্ট মানে চ্যুতিকোণ ন্যূনতম হয়। আপতন কোণের মান এরপর বাড়ালে চ্যুতিকোণ বাড়তে থাকে।
লেন্স – লেন্স হল দুটি গোলীয় তল বা একটি গোলীয় তল এবং একটি সমতল দ্বারা সীমাবদ্ধ স্বচ্ছ প্রতিসারক মাধ্যম।
উত্তল লেন্স – যে লেন্সের মাঝের অংশটি মোটা ও প্রান্তের দিক ক্রমশ সরু, তাকে উত্তল লেন্স বলা হয়।
অবতল লেন্স – যে লেন্সের মাঝের অংশটি সরু ও প্রান্তের দিক ক্রমশ মোটা, তাকে অবতল লেন্স বলা হয়।
লেন্সের আলোককেন্দ্র – পাতলা লেন্সের ক্ষেত্রে আলোককেন্দ্র হল প্রধান অক্ষের ওপর অবস্থিত এমন একটি বিন্দু যার মধ্য দিয়ে আলোকরশ্মি গেলে তার কোনোরকম চ্যুতি হয় না, অর্থাৎ আলোকরশ্মি সোজাপথে লেন্সের ভিতর দিয়ে চলে যায়।
সমান্তরাল রশ্মিগুচ্ছকে উত্তল লেন্স অভিসারী রশ্মিগুচ্ছে ও অবতল লেন্স অপসারী রশ্মিগুচ্ছে রূপান্তরিত করে।
লেন্সের মুখ্য ফোকাস – লেন্সের প্রধান অক্ষের সমান্তরালভাবে আপতিত সমান্তরাল রশ্মিগুচ্ছ লেন্স দ্বারা প্রতিসরণের পর উত্তল লেন্সের ক্ষেত্রে প্রধান অক্ষের ওপর একটি বিন্দুতে মিলিত হয় এবং অবতল লেন্সের ক্ষেত্রে প্রধান অক্ষের ওপর একটি বিন্দু থেকে অপসৃত হচ্ছে বলে মনে হয়। এই বিন্দুকে লেন্সের মুখ্য ফোকাস বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি লেন্সের দ্বিতীয় মুখ্য ফোকাস। যদিও লেন্সের মুখ্য ফোকাস বলতে সাধারণত দ্বিতীয় মুখ্য ফোকাসকেই বোঝায়।
উত্তল লেন্সের সামনে –
- কোনো বস্তুকে ফোকাস দূরত্বের দ্বিগুণ বা 2f অপেক্ষা বেশি দূরত্বে রাখলে খর্বকায় সদবিম্ব গঠিত হয়।
- কোনো বস্তুকে ফোকাস দূরত্বের দ্বিগুণ বা 2f দূরত্বে রাখলে সমান সাইজের সদবিম্ব গঠিত হয়।
- কোনো বস্তুকে ফোকাস দূরত্বের চেয়ে বেশি কিন্তু দ্বিগুণ ফোকাস দূরত্বের চেয়ে কম দূরত্বে রাখলে বিবর্ধিত সদবিম্ব গঠিত হয়।
- কোনো বস্তুকে ফোকাস দূরত্ব অপেক্ষা কম দূরত্বে রাখলে বিবর্ধিত অসদবিম্ব গঠিত হয়।
- অবতল লেন্স সর্বদা কোনো বস্তুর খর্বকায় অসদবিম্ব গঠন করে।
লেন্সে রৈখিক বিবর্ধন – লেন্সের প্রধান অক্ষের সঙ্গে লম্বভাবে অবস্থিত কোনো বস্তুর প্রতিবিম্বের উচ্চতা ও বস্তুর উচ্চতার অনুপাতকে রৈখিক বিবর্ধন বলা হয়।
একটি সরল ক্যামেরার বিভিন্ন অংশগুলি হল –
- আলোক নিরুদ্ধ বাক্স,
- অভিলক্ষ্য,
- ডায়াফ্রাম,
- শাটার,
- পর্দা।
চোখের উপযোজন – চোখের যে ক্ষমতার জন্য সিলিয়ারি মাংসপেশির সাসপেন্সরি বন্ধনীর সংকোচন ও প্রসারণ করে, চক্ষুলেন্সের ফোকাস দৈর্ঘ্যের বৃদ্ধি ও হ্রাস করে, দূরের ও কাছের বস্তুর প্রতিবিম্ব রেটিনায় গঠিত হয় তাকে চোখের উপযোজন বলা হয়।
নিকট বিন্দু ও দূর বিন্দু – উপযোজন প্রয়োগ করে চোখ সর্বাপেক্ষা নিকটতম যে বিন্দু পর্যন্ত একটি বস্তুকে স্পষ্টভাবে দেখতে পায় তাকে চোখের নিকট বিন্দু বলা হয়। আবার উপযোজন প্রয়োগ না করে চোখ থেকে সর্বাপেক্ষা দূরের যে বিন্দুতে একটি বস্তুকে স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায় তাকে চোখের দূর বিন্দু বলা হয়। সুস্থ চোখের নিকট বিন্দুর দূরত্ব প্রায় 25 সেন্টিমিটার এবং দূর বিন্দু অসীমে অবস্থিত হয়।
আলোর বিচ্ছুরণ – বহুবর্ণী বা কোনো যৌগিক আলোকরশ্মি কোনো প্রতিসারকের মধ্য দিয়ে গেলে বিভিন্ন বর্ণে ভেঙে যায়। এই ঘটনাকে আলোর বিচ্ছুরণ বলা হয়। রামধনু হল আলোর বিচ্ছুরণের একটি প্রাকৃতিক দৃষ্টান্ত।
দৃশ্যমান বর্ণালি – যে সমস্ত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য 4000Å থেকে 8000Å -এর মধ্যে, সেই আলোগুলি আমাদের চোখে দর্শনের অনুভূতি জাগায়। এই পাল্লার আলোই হল দৃশ্যমান বর্ণালি।
কোনো অস্বচ্ছ বস্তু সূর্যালোকে থাকলে ওই বস্তু যে বর্ণের আলোকে প্রতিফলিত করে, বস্তুকে সেই রঙের বলে মনে হয়। যদি বস্তু একাধিক বর্ণের আলো প্রতিফলিত করে, তাহলে ওই বর্ণগুলির মিশ্রণে যে বর্ণের উৎপত্তি হয়, বস্তুর বর্ণও সেটাই মনে হয়।
আবার কোনো স্বচ্ছ বস্তু যেমন – বায়ু, জল, কাচ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে যে বর্ণের আলো সংবাহিত হয়, বস্তুকে সেই রঙের মনে হয়।
তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ঊর্ধ্বক্রমানুসারে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ – γ-রশ্মি, X-রশ্মি, অতিবেগুনি রশ্মি, দৃশ্যমান আলো, অবলোহিত তরঙ্গ, মাইক্রোতরঙ্গ, রেডিয়ো তরঙ্গ।
আলোর বিক্ষেপণ – আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তুলনায় ছোটো কোনো বস্তুকণা যেমন – ধূলিকণা বা গ্যাস অণুর ওপর আলোকরশ্মি আপতিত হলে ওই কণা আলোকরশ্মিকে শোষণ করে ও কণাটি ওই শক্তিকে একই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গে চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। এই ঘটনাকে আলোর বিক্ষেপণ বলা হয়।
বিজ্ঞানী র্যালে প্রমাণ করেন যে, বিক্ষেপিত আলোর তীব্রতা, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চতুর্থ ঘাতের বিপরীতানুপাতিক (I ∝ 1/λ⁴)।
আজকের আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভৌতবিজ্ঞানের পঞ্চম অধ্যায় ‘আলো’ বিষয়ের সংক্ষেপ আলোচনা করেছি। এই আলোচনা মাধ্যমিক ও চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রায়ই এই ধরনের প্রশ্ন পরীক্ষায় আসতে দেখা যায়। আশা করি, আর্টিকেলটি আপনার জন্য সহায়ক হয়েছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকে, টেলিগ্রামে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা যথাসম্ভব উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। এছাড়া, পোস্টটি আপনার প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না, যারা এর উপকার পেতে পারেন। ধন্যবাদ।