এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন — “শিল্পস্থাপনের কারণগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।” — নিয়ে আলোচনা করব। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায় “ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ” -এর “ভারতের শিল্প” অংশ থেকে নেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় এই প্রশ্নটি প্রায়ই আসে, তাই এটি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

শিল্পস্থাপনের কারণগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, শিল্প গড়ে ওঠার পেছনে তিনটি প্রাকৃতিক কারণ আলোচনা করো।
শিল্পস্থাপনের অনুকূল প্রাকৃতিক কারণ –
শিল্প একটি মানব নির্মিত কাঠামো। একটি নির্বাচিত স্থানের ভিত্তি কী হবে সে সম্পর্কে মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কিছু অনুকূল অবস্থা বিবেচনা করা হয়। এগুলিকে শিল্প স্থাপনের নিয়ামক বলে। সাফল্যজনকভাবে একটি শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে কতকগুলি প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক উপাদানকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হয়।
প্রাকৃতিক কারণ –
- কাঁচামাল – যে-কোনো শিল্পের প্রধান ও অন্যতম উপকরণ হল কাঁচামাল। কাঁচামালের প্রকৃতি ও বণ্টন বা প্রাপ্যতা শিল্পের অবস্থানকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। যেমন –
- কাঁচামাল বিশুদ্ধ, প্রাকৃতিক হলে শিল্পকেন্দ্র কাঁচামাল উৎসের নিকটে, বাজারে বা এই দুই -এর মধ্যবর্তী স্থানে বা অন্য কোনো স্থানে গড়ে উঠতে পারে। উদাহরণ – কার্পাস বয়ন শিল্প (মুম্বাই, কলকাতা)।
- কাঁচামাল অবিশুদ্ধ হলে শিল্পকেন্দ্র কাঁচামালের উৎসস্থলে বা তার নিকটে গড়ে ওঠে। উদাহরণ – চা শিল্প (দার্জিলিং), লৌহ-ইস্পাত শিল্প (ছোটোনাগপুর মালভূমি কেন্দ্রিক)।
- অনুসারী শিল্পগুলি সাধারণত বৃহৎ শল্পাঞ্চলে বা বাজারে গড়ে ওঠে। উদাহরণ – জামনগরকে কেন্দ্র করে বহু অনুসারী শিল্পের বিকাশ ঘটেছে।
- শক্তি বা জ্বালানি – শক্তির প্রধান উৎস কয়লা, খনিজ তেল, জলবিদ্যুৎ ও আণবিক বিদ্যুৎ। এদের প্রাপ্যতা শিল্পের অবস্থানকে প্রভাবিত করে। যেমন – অ্যালুমিনিয়াম ও কাগজ শিল্প সাধারণত জলবিদ্যুৎকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। টোকিও শিল্পাঞ্চল জলবিদ্যুৎকে, গুজরাট শিল্পাঞ্চল খনিজ তেলকে, দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চল কয়লাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
- জমি বা বিস্তীর্ণ সমতল ক্ষেত্র – শিল্পস্থাপনে কারখানা, অফিস, আবাসন, মজুত ঘর প্রভৃতি নির্মাণের জন্য বিস্তীর্ণ সমতলভূমির প্রয়োজন।
- জলের প্রাচুর্য – শিল্প স্থাপনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল জল। শিল্প শ্রমিকদের নিত্য প্রয়োজনে, আবাসনের, জনপদের, কাঁচামাল পরিষ্কার করার জন্য, বাত চুল্লি ঠান্ডা করতে, বয়ন শিল্পে বস্ত্র ব্লিচিং ও ডাইং প্রভৃতি কাজে প্রচুর বিশুদ্ধ, মৃদু জলের প্রয়োজন হয়। বিপুল জলের চাহিদা পূরণের জন্য শিল্পকেন্দ্রগুলি নদী, হ্রদ বা বড়ো জলাধারের নিকটে গড়ে ওঠে। যেমন – জামশেদপুর খরকাই-সুবর্ণরেখা নদীর সংগমস্থলে; দুর্গাপুর-দামোদর নদ; রূঢ় শিল্পাঞ্চল-রাইন ও রুঢ় নদী, হ্রদ শিল্পাঞ্চল-পঞ্চ হ্রদের জলের সহজ প্রাপ্যতার ওপর গড়ে উঠেছে।
- জলবায়ুর প্রভাব – শিল্পের প্রকৃতিকে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন – আর্দ্র জলবায়ুতে সুতিবস্ত্র বয়ন শিল্প (মুম্বাই), শুষ্ক জলবায়ুতে ময়দা শিল্প (করাচি-পাকিস্তান), রোদ ঝলমলে ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুতে চলচ্চিত্র শিল্প (হলিউড) গড়ে ওঠে। উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ুর শ্রমিকদের তুলনায় নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বেশি।

অর্থনৈতিক কারণ –
- শ্রমিক – ভারী শিল্পের বিকাশ জনবহুল অঞ্চলের নিকটবর্তী স্থানে গড়ে ওঠে। ইঞ্জিনিয়ারিং ও তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিকাশের অন্যতম কারণ উন্নত মেধাসম্পন্ন দক্ষ মানব সম্পদের প্রাপ্যতা। যেমন – বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, কলকাতা, পুনের IT শিল্প গড়ে উঠেছে উন্নত মেধাকে কেন্দ্র করে।
- পরিবহণ – পরিবহণ ব্যবস্থা শিল্পস্থাপনে অন্যতম অর্থনৈতিক কারণ। শিল্প কারখানায় প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বহন, শক্তি বা জ্বালানির জোগান, শ্রমিকদের যাতায়াত, উৎপাদিত শিল্পদ্রব্যের বাজারে বা বন্দরে প্রেরণে আধুনিক ও উন্নত সড়ক, রেল, জল ও বিমান পরিবহণ একান্ত আবশ্যক। ওয়েবারের শিল্প-স্থানিকতা তত্ত্বানুসারে ন্যূনতম পরিবহণ ব্যয়যুক্ত স্থান শিল্প গড়ে তোলার পক্ষে আদর্শ। সুলভ জলপথ পরিবহণ USA -এর হ্রদ অঞ্চলে, হাইওয়ের সুবিধার কারণে মুম্বাই থেকে পুনে পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য শিল্পের সমাবেশ ঘটেছে।
- বাজারে চাহিদা – ক্রয়ক্ষমতা সম্পন্ন অধিক জনবহুল অঞ্চলে পণ্যের চাহিদা অধিক থাকে। তাই উন্নত দেশগুলির জনবহুল অঞ্চলে অতি উন্নত বাজার ব্যবস্থার জন্য অধিক শিল্পের সমাবেশ ঘটেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বিপুল চাহিদার কারণে ভারতের চা শিল্পের বিকাশ ঘটেছে।
- মূলধন – যে-কোনো শিল্প স্থাপনে জমি কেনা থেকে আরম্ভ করে কারখানা তৈরি, যন্ত্রপাতি ক্রয়, কাঁচামাল সংগ্রহ, বিদ্যুৎব্যবস্থা, শ্রমিকের মজুরি, উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ, বিজ্ঞাপন প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রচুর মূলধনের প্রয়োজন। মূলত মূলধন বিনিয়োগ করে সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা, শিল্পপতি, ব্যাংক, বিমা প্রতিষ্ঠান। উদাহরণ – গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে কার্পাস বয়নশিল্প স্থাপন ও বিকাশে পারসি, ভাটিয়া, সিন্ধ্রি সম্প্রদায়ের মূলধন বিনিয়োগ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
- সরকারি নীতি – সরকারি নীতি দেশের শিল্পোন্নয়নের পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের শুল্কনীতি, জমি নীতি, লাইসেন্স প্রদান নীতি, দেশের নিরাপত্তা নীতি ইত্যাদির ওপর শিল্পকেন্দ্র স্থাপন ও তার বিস্তার অনেকাংশে নির্ভর করে। উদাহরণ – ব্রিটিশ সরকারের সাহায্যেই হুগলি নদীর দুই তীরে পাট শিল্পের সূচনা ও বিস্তার ঘটে। ভারত সরকারের আনুকূল্যে গুজরাট ও কর্ণাটকে শিল্পোন্নতি ঘটেছে। এ ছাড়া – প্রযুক্তিবিদ্যা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রভৃতি বিষয়গুলি শিল্পের অবস্থানকে প্রভাবিত করে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
শিল্পস্থাপনের প্রধান প্রাকৃতিক কারণগুলি কী কী?
শিল্পস্থাপনের প্রধান প্রাকৃতিক কারণগুলি হলো –
1. কাঁচামালের প্রাপ্যতা (যেমন – লৌহ-ইস্পাত শিল্প ছোটোনাগপুরে)।
2. শক্তি বা জ্বালানির উৎস (যেমন – কয়লা, জলবিদ্যুৎ, খনিজ তেল)।
3. জলের সহজলভ্যতা (যেমন – দামোদর নদীর তীরে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল)।
4. উপযুক্ত ভূমি ও জলবায়ু (যেমন – আর্দ্র জলবায়ুতে বস্ত্রশিল্পের বিকাশ)।
শিল্প গড়ে ওঠার পেছনে তিনটি প্রাকৃতিক কারণ উল্লেখ করো।
শিল্প গড়ে ওঠার তিনটি প্রাকৃতিক কারণ হলো –
1. কাঁচামালের নিকটবর্তী স্থান (যেমন – চা শিল্প দার্জিলিংয়ে)।
2. জ্বালানির সহজলভ্যতা (যেমন – কয়লা ভিত্তিক শিল্প আসানসোলে)।
3. জলের পর্যাপ্ত সরবরাহ (যেমন – জামশেদপুরে সুবর্ণরেখা নদীর জল ব্যবহার)।
শিল্পস্থাপনে জলের ভূমিকা কী?
শিল্পে জলের প্রয়োজনীয়তা –
1. উৎপাদন প্রক্রিয়ায় (যেমন – কাগজ শিল্পে কাঁচামাল পরিষ্কার করা)।
2. শীতলীকরণে (যেমন – ইস্পাত শিল্পে ব্লাস্ট ফার্নেস ঠান্ডা করা)।
3. শ্রমিকদের ব্যবহারের জন্য (পানীয় ও স্যানিটেশন)।
4. বস্ত্র শিল্পে ডাইং ও ব্লিচিংয়ের জন্য (যেমন – মুম্বাইয়ের টেক্সটাইল শিল্প)।
শিল্পস্থাপনে জলবায়ুর প্রভাব কী?
জলবায়ুর প্রভাব –
1. আর্দ্র জলবায়ু বস্ত্রশিল্পের জন্য উপযোগী (যেমন – মুম্বাই)।
2. শুষ্ক জলবায়ু ময়দা শিল্পের জন্য ভালো (যেমন – করাচি)।
3. নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বাড়ায় (যেমন – ইউরোপের শিল্পাঞ্চল)।
ভারতে শিল্পের অবস্থানকে কীভাবে পরিবহণ ব্যবস্থা প্রভাবিত করে?
পরিবহণের ভূমিকা –
1. সুলভ জলপথ (যেমন – কলকাতা বন্দর পাটশিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ)।
2. রেল ও সড়কপথ (যেমন – মুম্বাই-পুনে হাইওয়ে শিল্প বিকাশে সাহায্য করে)।
3. ন্যূনতম পরিবহণ ব্যয় (ওয়েবারের তত্ত্ব অনুযায়ী আদর্শ শিল্পস্থল নির্বাচন)।
শিল্পস্থাপনে সরকারি নীতির ভূমিকা কী?
সরকারি নীতি প্রভাব –
1. শুল্ক ও কর নীতি (যেমন – SEZ -এ কর ছাড়)।
2. জমি বরাদ্দ (যেমন – নোইডায় ইলেকট্রনিক শিল্পের জন্য জমি প্রদান)।
3. লাইসেন্সিং (যেমন – স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে লাইসেন্স রাজ ব্যবস্থা)।
শিল্পস্থাপনে শ্রমিকের ভূমিকা কী?
শ্রমিকের গুরুত্ব –
1. দক্ষ শ্রমিক (যেমন – বেঙ্গালুরুর IT শিল্পে ইঞ্জিনিয়ারদের ভূমিকা)।
2. সস্তা শ্রমশক্তি (যেমন – কলকাতায় পাটশিল্পে শ্রমিকের প্রাচুর্য)।
3. শিল্পের ধরন অনুযায়ী শ্রমিকের চাহিদা (যেমন – ভারী শিল্পে বেশি শ্রমিক প্রয়োজন)।
শিল্পের অবস্থান নির্বাচনে বাজারের ভূমিকা কী?
বাজারের প্রভাব –
1. জনবহুল অঞ্চলে চাহিদা বেশি (যেমন – দিল্লি-এনসিআর অঞ্চলে ফুটওয়্যার শিল্প)।
2. রপ্তানির সুবিধা (যেমন – সুরাটের হীরা শিল্প বৈশ্বিক বাজার কেন্দ্রিক)।
3. ক্রয়ক্ষমতা (উন্নত দেশগুলিতে উচ্চ মানের পণ্যের চাহিদা বেশি)।
এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন — “শিল্পস্থাপনের কারণগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।” — নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নটি মাধ্যমিক ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায় “ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ” -এর “ভারতের শিল্প” অংশ থেকে নেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় এই প্রশ্নটি প্রায়ই আসে, তাই এটি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা থাকলে, আমাদের সাথে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন, আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাছাড়া, নিচে আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এটি প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন