দশম শ্রেণি – বাংলা – প্রলয়োল্লাস – ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

প্রলয়োল্লাস কাজী নজরুল ইসলামের লেখা একটি বিখ্যাত কবিতা। কবিতাটি ১৯২২ সালে লেখা হয়েছিল। কবিতাটিতে কবি পরাধীন ভারতবর্ষের অন্ধকার রাতকে প্রলয়ের রূপে চিত্রিত করেছেন। তিনি আশা করেছেন যে প্রলয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষের অন্ধকার রাত শেষ হবে এবং নতুন সূর্যের উদয় হবে।

Table of Contents

দশম শ্রেণি – বাংলা – প্রলয়োল্লাস – ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

ওই নূতনের কেতন ওড়ে – ‘নূতনের কেতন’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সত্য ও সুন্দরের পূজারি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলায় নেমে এসেছিল অবক্ষয়ের কালো ছায়া। পরাধীনতার যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে বাঙালি সমাজ। কুসংস্কার, দাসত্ব, জড়তা এবং পরাধীনতার অবসানে কবি কালবৈশাখীরূপ নটরাজের আগমন কামনা করেছেন। ধ্বংসের মধ্য দিয়েই হবে সৃষ্টির নব-উত্থান। ‘নূতনের কেতন’ বলতে কবি তাই পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় পরাধীনতার অবসান এবং শুভদিনের আগমনকেই ইঙ্গিতবাহী করে তুলেছেন।

সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল! – ‘সিন্ধুপারের সিংহদ্বার’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন? সেখানকার আগল ভাঙার কথা বলা হয়েছে কেন?

সিন্ধুপারের সিংহদ্বার – ‘সিন্ধুপারের সিংহদ্বার’ বলতে কবি আন্দামানের সেলুলার জেলের প্রধান ফটকের কথা বলেছেন।

আগল ভাঙার কারণ – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। আর ইংরেজদের অত্যাচারও তীব্র হয়। ইংরেজরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিনাবিচারে আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দি করে রাখত। এই জেল ছিল ভারতীয়দের কাছে অত্যাচারের প্রতীক। এই কারণে ধ্বংসরূপী মহাকালই প্রলয়নেশায় মত্ত হয়ে সেই বন্দিশালার আগল ভাঙবেন বলে কবির বিশ্বাস।

আসছে এবার অনাগত প্রলয়-নেশার নৃত্য পাগল – কাকে উদ্দেশ্য করে এ কথা বলা? কথাটি তার সম্পর্কে বলা হয়েছে কেন?

উদ্দিষ্ট ব্যক্তি – উল্লিখিত অংশে যে তরুণ সম্প্রদায় ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে উদ্যত তাদের উদ্দেশ্য করে এ কথা বলা হয়েছে।

প্রলয়-নেশার নৃত্য পাগল বলার কারণ – পরাধীনতার যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-বঞ্চনা-এসব থেকে মুক্তির জন্য মানুষের সংগ্রাম ক্রমশই তীব্রতর হতে থাকে। সেই সংগ্রাম ধ্বংসকে নিশ্চিত করে। নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর তরুণ বিপ্লবী-প্রাণদের দেখলে মনে হয় তারা যেন ‘প্রলয় নেশার নৃত্য পাগল’। কারণ, জীবনকে বাজি রেখে তারা বিপ্লবের পথে এগিয়ে চলে। সমুদ্রপারে সিংহদরজার আগল ভাঙাই তাদের লক্ষ্য।

বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ংকর। – কাদের কথা বলা হয়েছে? এই ভয়ংকরের আগমনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

উদ্দিষ্ট জন – ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতার আলোচ্য অংশে ভয়ংকরের বেশে নতুনের আগমনের কথা বলা হয়েছে। এই নতুন আসলে তরুণ বিদ্রোহী শক্তি।

ভয়ংকরের আগমনের তাৎপর্য – প্রলয় নেশায় মত্ত হয়ে নৃত্যরত পাগলের মতো বিদ্রোহী শক্তির আগমন ঘটছে। তাকে প্রতিহত করার শক্তি, তার সামনে দাঁড়াবার শক্তি কারও নেই। মহাকালের ভয়ংকর মূর্তিতে অর্থাৎ শিবের ধ্বংসমূর্তিতে যেন মুক্তিদূত অর্থাৎ বিপ্লবী শক্তির আগমন ঘটছে। কালবৈশাখীর ঝড়ে উড়ছে নতুনের পতাকা, ধ্বংসের মধ্যেই সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি। ভয়ংকরের পথেই এভাবে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখেছেন কবি।

ওরে ওই হাসছে ভয়ংকর! – ভয়ংকর কে? তাঁর হাসির কারণ কী?

ভয়ংকরের স্বরূপ – ‘ভয়ংকর’ বলতে ধ্বংসরূপী মহাকাল বা শিবকেই বোঝানো হয়েছে, যা আসলে তরুণ বিপ্লবী শক্তির প্রতীক।

হাসির কারণ – শিব একাধারে ধ্বংস ও সৃষ্টির প্রতীক। ধ্বংসরূপী শিব সংহারক। ভয়ংকর তাঁর রুদ্ররূপ। বিকট অট্টহাসি হেসে তিনি জীর্ণ- পুরাতন এবং যা-কিছু অসুন্দর, তা বিনাশ করেন। তাঁর আগমনে প্রলয় ঘটে, সৃষ্টি হয় নতুনের। একইভাবে তরুণ বিপ্লবী শক্তিও স্বাধীনতার লক্ষ্যে ধ্বংসের উন্মাদনায় মেতে ওঠে। তাদের মুখে থাকে ভয়ংকরের হাসি যা কোনো কিছুকেই ভয় পায় না।

ঝাপটা মেরে গগন দুলায়। – কে ঝাপটা মেরে গগন দুলায়? গগন দোলানোর নেপথ্যে তার কী উদ্দেশ্য নিহিত?

উদ্দিষ্ট ব্যক্তি – মহাকালরূপী শিব ঝাপটা মেরে গগন দুলিয়ে দেন।

উদ্দেশ্য – ধ্বংসের দেবতা শিব বড়ো ভয়ংকর। তাঁর আগমন পৃথিবীতে প্রলয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাঁর জটাভার দুলে উঠলে আকাশ-বাতাস-সহ সমগ্র পৃথিবী কেঁপে ওঠে। যাবতীয় জীর্ণতা দূর হয় তাঁর আগমনে। তারপরই নতুন সৃষ্টির প্রকাশ ঘটে পৃথিবীতে। এই ঝাপটা আসলে পুরাতন অচলায়তনকে ভাঙার আঘাত। শক্তি ও সাহসের প্রচণ্ডতা নিয়ে তরুণ বিপ্লবী শক্তি পুরোনো ব্যবস্থাকে ভাঙার লক্ষ্যে এই আঘাত করে।

সর্বনাশী জ্বালামুখী ধূমকেতু তার চামর চুলায়। — কোন্ প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছে লেখো।

প্রসঙ্গ – সংগ্রামের পথ কখনও ফুলে ঢাকা নয়। স্বাধীনতার জন্য মানুষের যে সংগ্রাম, তার পথ তৈরি হয় মৃত্যু আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। যে কারণে কবি তাঁর কল্পনায় বিশ্বপিতার কোলে রক্তমাখা তরবারি দেখেছেন। সুন্দরের বা নতুনের কোনো শান্ত, সৌম্য মূর্তি এখানে বর্ণিত হয়নি। নতুনের প্রলয় রূপই বর্ণিত হয়েছে। সর্বনাশের রূপ ধরে সুন্দরের সেই আগমনকে বর্ণনা করতে গিয়েই কবি বলেছেন, ধূমকেতু যেন তার ‘চামর চুলায়’ অর্থাৎ পুচ্ছ নাচায়।

অট্টরোলের হট্টগোলে স্তব্ধ চরাচর। – সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করো।

প্রসঙ্গ – মহাকালের আগমনে প্রলয়-বিক্ষুব্ধ পৃথিবীর কথা উল্লেখ প্রসঙ্গে ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় কবি আলোচ্য মন্তব্যটি করেছেন।

ব্যাখ্যা – মহাকালরূপী শিব ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছেন। তাঁর প্রলয়- তাণ্ডবে সমগ্র বিশ্ব কেঁপে ওঠে। বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন। কালবৈশাখী ঝড়ের রূপ ধরে তিনি আসেন নবসৃষ্টির বার্তা নিয়ে। তাঁর আওয়াজে মুখরিত আকাশ-বাতাস। ঠিক সেভাবেই যৌবনের উদ্দীপনায় চারপাশকে চমকে দিয়ে বিপ্লবীশক্তির আগমন ঘটে।

দ্বাদশ রবির বহ্নিজ্বালা ভয়াল তাহার নয়নকটায়, – ‘দ্বাদশ রবি’ কী? মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করো।

দ্বাদশ রবি – উল্লিখিত অংশে দ্বাদশ রবি বলতে সূর্যের বারোটি রূপ সবিতা, আদিত্য, বিবস্বান, অর্যমা, পুষা, ত্বষ্টা, ভগ, ধাতা, বরুণ, মিত্র, পর্জ্জন্য এবং বিষ্ণুকে বোঝানো হয়েছে।

ব্যাখ্যা – শিবের তৃতীয় নয়নে রুদ্র মূর্তিতে থাকে ‘দ্বাদশ রবির’ সম্মিলিত তেজ। সেরকমই মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো আগুন যেন বিপ্লবের বার্তাবাহকের চোখে দেখা যায়। যা কিছু জীর্ণ অসুন্দর তাকে পুড়িয়ে নতুনের প্রতিষ্ঠা ঘটানোই তাদের লক্ষ্য। দুর্যোগের ঘনঘটায়, ভয়াবহতার উচ্ছ্বাসে প্রকৃতির ভয়ংকররূপে যেন নতুনের জয়ধ্বনি ঘোষিত হয়।

বিশ্বমায়ের আসন তারই বিপুল বাহুর পর। — বিশ্বমা কে? কার বাহুর ওপর, কেন তাঁর আসন?

বিশ্বমা – বিশ্বমা বলতে কবি এই বিশাল পৃথিবীকেই বুঝিয়েছেন।

অধিষ্ঠান – প্রলয়ংকর শিব বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে অসুন্দরকে ধ্বংস করে সুন্দরের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পৃথিবীতে আনেন শান্তিসুখের বার্তা। তাঁর বিশাল বাহুর ওপরই বিশ্বমাতার স্থান। কেন-না, মহাকালই হলেন এই মহাবিশ্বের রক্ষাকর্তা। তিনিই যাবতীয় বিপ্লব থেকে বিশ্বমা-কে রক্ষা করে চলেছেন। সেই কারণেই কবি মনে করেছেন মহাকালরূপী শিবের বিপুল বাহুর ওপর জগজ্জননীর অবস্থান।

মাভৈঃ মাভৈঃ! জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে। – ‘মাভৈঃ’ কথাটির অর্থ কী? প্রলয় ঘনিয়ে আসা সত্ত্বেও কবি ‘মাভৈঃ মাভৈঃ’ বলেছেন কেন?

অর্থ – ‘মাভৈঃ’ কথাটির অর্থ ভয় কোরো না।

মাভৈঃ – বলার কারণ – ধ্বংসের মধ্যেই থাকে সৃষ্টির বীজ। জড়তাগ্রস্ত সমাজকে নাড়া দিলে তবেই তার মধ্যে লুকানো প্রাণ জেগে ওঠে। রুদ্ররূপী শিব ধ্বংসের ত্রিশূল হাতে আবির্ভূত হন। তাঁর আগমনে জগতে তৈরি হয় প্রলয়ের পরিবেশ। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে জীবকুল। কিন্তু এই ধ্বংসের মধ্যেই আছে সৃষ্টির আশ্বাস। এই কারণেই কবি ‘মাভৈঃ মাভৈঃ’ বলে উল্লাস প্রকাশ করেছেন।

জরায়-মরা মুমূর্ষুদের প্রাণ-লুকানো ওই বিনাশে! – ‘জরায়-মরা মুমূর্ষু’ কারা? উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

জরায়-মরা মুমূর্ষু-দের পরিচয় – ‘জরায়-মরা মুমূর্ষু’ বলতে পুরোনো জীর্ণ সমাজে বসবাসকারীদের বোঝানো হয়েছে।

তাৎপর্য বিশ্লেষণ – রুদ্ররূপী মহাকাল শিবের কর্মপন্থা বর্ণনা করতে গিয়ে কবি আলোচ্য প্রসঙ্গটির উল্লেখ করেছেন। মহাকাল শিব ধ্বংসরূপী কালবৈশাখীর রূপ ধরে আসেন। তাঁর তান্ডবে পৃথিবীর জরাজীর্ণ সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর ঘটে নতুনের আগমন। জড়তাগ্রস্ত মৃতপ্রায় জীবজগৎ নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। তাই কবি বলেছেন রুদ্ররূপী শিবের ধ্বংসমূর্তির পিছনেই রয়েছে সৃষ্টির মহামন্ত্র।

এবার মহানিশার শেষে/আসবে ঊষা অরুণ হেসে – ‘মহানিশা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? মন্তব্যটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

অথবা, এবার মহানিশার শেষে/আসবে ঊষা অরুণ হেসে – ‘মহানিশা’ কী? এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে কবি কীসের ইঙ্গিত দিয়েছেন?

মহানিশা – ‘মহানিশা’ বলতে কবি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে অন্ধকারময় অবস্থাকে বোঝাতে চেয়েছেন।

তাৎপর্য বিশ্লেষণ – পৃথিবীজুড়ে কবি নজরুল স্থিতাবস্থার ভাঙন লক্ষ করেছেন। পরাধীনতা এবং সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার মধ্য দিয়ে যে অন্ধকার নেমে এসেছে তার অবসান ঘটবে, সভ্যতার নতুন সুর্যোদয় ঘটবে, কবি এরকমটাই প্রত্যাশা করেছেন। মহাদেব ধ্বংসের দেবতা হলেও তাঁর কপালে থাকে চাঁদ। একইভাবে ধ্বংসের মধ্যে সুন্দরকে বারবার প্রত্যক্ষ করেছেন বলেই কবির প্রত্যাশা যে, সেই চাঁদের আলোয় ঘর ভরে যাবে।

দিগম্বরের জটায় হাসে শিশু-চাঁদের কর – প্রসঙ্গটি উল্লেখের কারণ লেখো।

প্রসঙ্গটি উল্লেখের কারণ – ‘দিগম্বর’ অর্থাৎ মহাদেব নটরাজ মূর্তিতে ধ্বংসের তাণ্ডব সৃষ্টি করেন। কিন্তু তা আসলে সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্যই। দিগম্বরের তৃতীয় নেত্রের উপরে থাকে চাঁদ, যা সবহারানো রূপের মধ্যে সুন্দরের প্রতিষ্ঠা করে। স্বাধীনতা ও সমাজ রূপান্তরের স্বপ্ন দেখা কবি এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন কারণ, বিপ্লবের পথে ধ্বংস অনিবার্য হলেও তা আসলে সুন্দরের অভিষেককেই নিশ্চিত করে। কবি কল্পনা করেছেন, ওই চাঁদের আলোই অন্ধকারে পথ দেখাবে।

দিগম্বরের জটায় হাসে শিশু-চাঁদের কর – দিগম্বর কে? ‘শিশু চাঁদের কর’-এর হাসার অর্থটি বুঝিয়ে দাও।

দিগম্বরের পরিচয় – উল্লিখিত অংশে ‘দিগম্বর’ বলতে মহাদেবকে বোঝানো হয়েছে।

তাৎপর্য – মহাদেবের কপালে তৃতীয় নেত্ররূপে অর্ধচন্দ্র শোভা পায়। এই অর্ধচন্দ্রই বসনহীন জটাশোভিত সর্বত্যাগী মহাদেবের শরীরে অসাধারণ সৌন্দর্য নিয়ে আসে। এই চাঁদ অসম্পূর্ণ তাই কবি তাকে বলেছেন শিশু চাঁদ। একইভাবে বিপ্লবের কারণে যে ধ্বংসের আগমন ঘটে, তার মধ্যে শিশু চাঁদের হাসির মতো থেকে যায় স্বাধীনতার স্বপ্ন। অন্যায় অত্যাচারের অবসানে সমাজে সুন্দরের প্রতিষ্ঠা ঘটবে-এটাই | শিশু চাঁদের হাসির মতো ক্রমশ আভাসিত হচ্ছে চারপাশে।

ক্ষুরের দাপট তারায় লেগে উল্কা ছুটায় নীল খিলানে! – উদ্ধৃতিটির অন্তর্নিহিত অর্থ বিশ্লেষণ করো।

  • উৎস – উদ্ধৃতাংশটি কাজী নজরুল ইসলামের ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতার অন্তর্গত।
  • প্রসঙ্গ – মহাকালরূপী শিবের আগমন প্রসঙ্গে উদ্ধৃতিটির উপস্থাপন করা হয়েছে।
  • অন্তর্নিহিত অর্থ – কবি কল্পনা করেছেন মহাকালের রথের ঘোড়া দুরন্তবেগে ছুটে চলেছে। তার খুরের আঘাতে আকাশের তারা থেকে উল্কা খসে পড়ছে। গম্বুজ আকৃতির আকাশটাকে কবি অট্টালিকার খিলানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সেখানে রক্ত-তড়িৎ-চাবুক দিয়ে আঘাত করে মহাকালের রথের সারথি দুরন্ত গতিতে এগিয়ে আসছেন। এক অপূর্ব চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবি এইভাবে মহাকালের আগমনকে ফুটিয়ে তুলেছেন।

এই তো রে তার আসার সময় ওই রথঘর্ঘর – কার আসার কথা বলা হয়েছে? মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করো।

যার আসার কথা বলা হয়েছে – উল্লিখিত অংশে মহাকালের রথের সারথির প্রতীকে নবীন বিপ্লবীশক্তির কথা বলা হয়েছে।

মন্তব্যটির ব্যাখ্যা – যা কিছু জরাজীর্ণ, প্রগতিবিরোধী, স্বাধীনতার পরিপন্থী সেই সব কিছুর অবসান চেয়েছেন কবি। মানুষের দেবতাকে এখানে অন্ধকার কারাগারে বেঁধে রাখা হয়েছে। কিন্তু তার মুক্তির সময় এসে গেছে। মহাকালের রথের সারথি বিদ্যুৎগ্রুপ চাবুক দিয়ে জীর্ণ পুরাতনকে আঘাত করে চলেছে। ঝড়-তুফানের মধ্য দিয়ে যেন তাঁর অশ্বের হ্রেষাধ্বনিও জেগে ওঠে। বিপ্লবীশক্তির আগমন, প্রতিবাদ এবং প্রত্যাঘাতই যেন এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়।

ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? – ধ্বংসকে ভয় না পাওয়ার কারণটি বুঝিয়ে দাও।

রুদ্র মূর্তিতে শিবের আগমন ঘটে। কিন্তু সে আগমন আসলে অসুন্দরের বিনাশ ঘটানোর জন্য। ঠিক একইভাবে ধ্বংসের বার্তা বয়ে প্রলয়ের নেশায় উন্মত্ত বিপ্লবী তরুণদের আবির্ভাব ঘটে। ধ্বংসের সেই প্রচণ্ডতায় মানুষ শিহরিত হয়। কিন্তু কবির মতে, এই প্রলয় আসলে সৃষ্টির যন্ত্রণা। সমাজে যা কিছু জীবনহারা এবং অসুন্দর তার অবসান ঘটাতেই এই বিপ্লবী শক্তির আগমন। তাই ধ্বংস দেখে ভয় পাওয়ার কোনো এই প্রয়োজন নেই বলে কবি মনে করেছেন।

আসছে নবীন-জীবনহারা অ-সুন্দরে করতে ছেদন। – কথাটির মধ্য দিয়ে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন?

অথবা, আসছে নবীন-জীবনহারা অ-সুন্দরে করতে ছেদন! – উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য লেখো।

স্বাধীনতা ও সমাজ রূপান্তরের জন্য কবি নবীন বিপ্লবীশক্তির আগমন প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রলয়ের মধ্য দিয়ে ধ্বংসের রূপ ধরে তার আবির্ভাব ঘটছে। কিন্তু সেই ধ্বংসের মধ্যেই রয়েছে সৃষ্টির সম্ভাবনা। ভাঙার মধ্য দিয়েই গড়ার প্রতিশ্রুতি থাকে। ধ্বংস যদি না-ই হয়, তবে সৃষ্টি কোনোদিন সম্ভবপর এ হয়ে উঠতে পারে না। চিরসুন্দরের এভাবেই আবির্ভাব ঘটে। তাই নবীনের এরূপ ধ্বংস-উন্মাদনা আসলে জীবনবিমুখ অসুন্দরকে দূর করার জন্য।

প্রলয় বয়েও আসছে হেসে / মধুর হেসে। – কার আগমনের কথা বলা হয়েছে? প্রলয় বয়েও তার হাসির কারণ কী?

যার আগমনের কথা বলা হয়েছে – আলোচ্য উদ্ধৃতিতে ধ্বংসরূপী শিবের আগমনের কথা বলা হয়েছে।

হাসির কারণ – শিব রক্ষক ও সংহারক। সংহারকরূপী শিব ভয়ংকর। তিনি তখন প্রলয়দেবতা। তাঁর জটাভার দুলে উঠলে সারা পৃথিবী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। যা-কিছু জরাজীর্ণ, অসুন্দর, তা সবই তিনি পাগলা ভোলার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ধ্বংস করেন। কিন্তু এই ধ্বংসের পিছনে লুকিয়ে থাকে নতুন সৃষ্টির আশ্বাস। এই কারণেই প্রলয় ধ্বংস বয়ে আনলেও আপন সৃষ্টির আনন্দে মহাকালের মধুর হাসি ধ্বনিত হয়।

ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চিরসুন্দর। – ‘সে’ কে? ভেঙে আবার গড়ার বিষয়টি বুঝিয়ে দাও।

সে-র পরিচয় – উল্লিখিত অংশে ‘সে’ বলতে আপাতভাবে মহাদেবের কথা বলা হলেও তাঁর প্রতীকে দেশের তরুণ বিপ্লবীদের কথা বলা হয়েছে।

ভাঙা-গড়ার বিষয় – মহাদেব তাঁর রুদ্র মূর্তিতে অসুন্দরের বিনাশ ঘটিয়ে সুন্দরের প্রতিষ্ঠা করেন। একইভাবে দেশের তরুণ বিপ্লবীরাও ধ্বংসের প্রচণ্ডতা নিয়ে আবির্ভূত হয়। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকারকে আঘাত করাই তাদের লক্ষ্য। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেই ধ্বংসের তাণ্ডবকে সহ্য করতে পারে না। অথচ তার আড়ালেই রয়েছে স্বাধীনতার স্বপ্ন, নতুনের প্রতিষ্ঠা। কবি তাই একে কাল-ভয়ংকরের বেশে সুন্দরের আগমন বলে উল্লেখ করেছেন।

ওই ভাঙা-গড়া খেলা যে তার কিসের তবে ডর? – কবির এই মন্তব্যটিতে কোন্ ইঙ্গিত পাওয়া যায়?

অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই কখনও শান্তির পথে হতে পারে না। ভয়ংকর মূর্তিতেই সুন্দরের অভিষেক হয়। বাস্তবজীবনেও ধ্বংসের মধ্যেই থাকে সৃষ্টির বীজ। তাই ভাঙন দেখে ভয় না পেয়ে জয়ধ্বনি করা প্রয়োজন। কারণ, ভয়ানকের মধ্য দিয়ে অভয়ের প্রতিষ্ঠা ঘটে। সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। ভয়ংকরের বেশে সুন্দরের আগমনকে স্বাগত জানানোর কথাই এখানে কবি বলেছেন।

বধূরা প্রদীপ তুলে ধর। – কবি বধূদের প্রদীপ তুলে ধরতে আহবান করেছেন কেন?

চিরসুন্দরের পূজারি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিদ্রোহী চেতনায় উপলব্ধি করেছেন প্রলয়দেবের আগমন। জীর্ণ সমাজের অচলায়তন ভেঙে মহাকাল শিব সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠা করবেন। একইভাবে তরুণ বিপ্লবী শক্তি শাসকের দুর্গে আঘাত করে স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা করবে। ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যারা সুন্দরের প্রতিষ্ঠা করবে তাদের স্বাগত জানানোর জন্যই কবি প্রদীপ তুলে ধরতে বলেছেন। তাদের আগমনেই দেশ ও সমাজের বদল নিশ্চিত হবে।

প্রলয়োল্লাস কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের একটি অমর কীর্তি। এ কবিতাটি আজও আমাদেরকে বিদ্রোহী হতে এবং নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে অনুপ্রাণিত করে।

Share via:

মন্তব্য করুন