মাধ্যমিক ভূগোল – ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশ – ভারতের জলসম্পদ – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

আজকের এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায় “ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশ” এর অন্তর্ভুক্ত ভারতের ভূপ্রকৃতি বিভাগের কিছু রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য, অথবা যদি আপনি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হবে।

Table of Contents

মাধ্যমিক ভূগোল - ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশ - ভারতের জলসম্পদ - রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের নদনদীর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি তুলনা করো

অথবা, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের নদনদীর তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তাদের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য নিরূপণ করো।

উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের নদনদীর সাদৃশ্যগুলি হল:

  1. উত্তর ভারতের অধিকাংশ নদী (যেমন — গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি) যেমন বঙ্গোপসাগরে পড়েছে, তেমনি দক্ষিণ ভারতেরও অধিকাংশ নদী (যেমন — কৃষ্ণা, কাবেরী, গোদাবরী প্রভৃতি) বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।
  2. উত্তর ভারতের কিছু নদী (যেমন — সিন্ধু) আরব সাগরে মিশেছে তেমনই দক্ষিণ ভারতেরও কিছু নদী (যেমন — নর্মদা, তাপ্তী) আরব সাগরে মিশেছে।
  3. উত্তর ভারতের নদনদীগুলির (যেমন — গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র) যেমন বদ্বীপ রয়েছে, তেমনি দক্ষিণ ভারতের নদীগুলির (যেমন — কৃষ্ণা, কাবেরী, গোদাবরী) ও বদ্বীপ রয়েছে।

উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের নদনদীর বৈসাদৃশ্যগুলি হল:

বিষয়উত্তর ভারতের নদনদীদক্ষিণ ভারতের নদনদী
নিত্যবহতাসুউচ্চ হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে উৎপন্ন বলে নদীগুলি বৃষ্টির জল ও বরফগলা জলে পুষ্ট, তাই সারাবছর নদীগুলিতে জল থাকে অর্থাৎ নদীগুলি নিত্যবহ।বেশিরভাগই বৃষ্টির জলে পুষ্ট। এজন্য শুষ্ক ঋতুতে নদীতে জলের পরিমাণ যথেষ্ট হ্রাস পায়। তাই নদীগুলি নিত্যবহ নয়।
গতিপথের স্পষ্টতানদীগুলির উচ্চগতি, মধ্যগতি ও নিম্নগতির গতিপথের অধিকাংশই সুস্পষ্ট।বিভিন্ন পর্যায় অস্পষ্ট এবং তার মধ্যে সমতাও নেই।
নদীর গতিপথের প্রকৃতিনদীগুলির অধিকাংশ নবীন এবং সমভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় প্রায়ই গতিপথ পরিবর্তন করে। এজন্য গতিপথে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখা যায়।নদীগুলি প্রাচীন এবং গতিপথ পরিবর্তন করে না। এজন্য গতিপথে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ সৃষ্টি হয় না।
নদীর প্রবাহপথে নির্মিত খাতনদীগুলি অনেকটা পথ পার্বত্য অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে নদীর খাত খুব গভীর (সঙ্কীর্ণ ‘V’ আকৃতির)।পার্বত্য উপত্যকার দৈর্ঘ্য কম এবং পার্বত্য অঞ্চলে নদীর খাত বিশেষ গভীর নয়।
নদীর দৈর্ঘ্যনদীগুলি দৈর্ঘ্যে খুব বড়ো।নদীগুলি দৈর্ঘ্যে অপেক্ষাকৃত ছোটো।
পলি সঞ্চয়পার্বত্য অঞ্চলে এগুলি খরস্রোতা। এজন্য ভূমিক্ষয় করে বেশি এবং ক্ষয়িত পদার্থগুলি সমভূমিতে সঞ্চয় করে।নদীগুলি প্রাচীন কেলাসিত শিলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে নদীগুলির ক্ষয় করার ক্ষমতা যথেষ্ট কম। তাই এই নদীগুলির সমভূমিতে সঞ্চয়ের পরিমাণও কম হয়।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনপার্বত্য অঞ্চল ছাড়া সমভূমিতে নদীর স্রোত কম বলে নদীগুলি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুকূল নয়।অধিকাংশ পথ মালভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত বলে বেশিরভাগ নদী জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের উপযোগী।
জলসেচের সুবিধানদীগুলিতে সারাবছর জল থাকে বলে জলসেচের সুবিধা হয়।বাঁধ দিয়ে জল ধরে না রাখলে সারাবছর জলসেচ করা যায় না।
নাব্যতানদীগুলিতে সারাবছর জল থাকে এবং সমভূমিতে নদীর গতি কম, এজন্য নৌপরিবহণের উপযোগী।সারাবছর জল থাকে না এবং মালভূমির জন্য খরস্রোতা। তাই এরা নৌপরিবহণযোগ্য নয়।
উপনদী ও শাখানদীর সংখ্যাদীর্ঘ নদীগুলির উপনদী ও শাখানদী অনেক। নদীগুলির উপত্যকায় মৃত্তিকার গভীরতা খুব বেশি।দীর্ঘ নদীগুলির উপনদী ও শাখানদী কম। নদীগুলির উপত্যকায় মৃত্তিকা অগভীর।
বদ্বীপ সৃষ্টিপ্রতিটি নদী মোহানায় সুবিশাল বদ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে।নদীগুলির মোহানায় গঠিত বদ্বীপের আয়তন ক্ষুদ্র। নর্মদা ও তাপ্তীর মোহানায় বদ্বীপ সৃষ্টি হয়নি।

ভারতের প্রধান নদনদীগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো

উত্তর ভারতের নদনদী

নদনদীদৈর্ঘ্যউৎপত্তিস্থলপতনস্থলগতিপথের রাজ্যউপনদীগতিপথের প্রধান শহর
গঙ্গা2525 কিমি। ভারতে দৈর্ঘ্য 2517 কিমিগঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ তুষারগুহাবঙ্গোপসাগরউত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গবামতীর — ঘর্ঘরা, রামগঙ্গা, গণ্ডক, কোশী। ডানতীর — যমুনা, সোন প্রভৃতি।হৃষীকেশ, হরিদ্বার, কানপুর, এলাহাবাদ, বারাণসী, গাজিপুর, পাটনা, ভাগলপুর, কলকাতা।
সিন্ধু2880 কিমি। ভারতে দৈর্ঘ্য 1114 কিমিমানস সরোবরের কাছে সেঙ্গে খাবাব প্রস্রবণআরব সাগরভারতে কেবলমাত্র জম্মু ও কাশ্মীরবামতীর — বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, শতদ্রু, ইরাবতী, বিপাশা। ডানতীর — শিয়ক, গিলগিট, শিগার প্রভৃতি।স্কার্দু, বুঞ্জি, চিলাস।
ব্ৰহ্মপুত্ৰ2900 কিমি। ভারতে দৈর্ঘ্য 916 কিমি।মানস সরোবরের কাছে চেমায়ুং দুং হিমবাহবঙ্গোপসাগরভারতে কেবলমাত্র অরুণাচল প্রদেশ ও আসামবামতীর — বুড়ি, ডিহিং, কোপিলি, ধানসিরি (দক্ষিণ)। ডানতীর — সুবনসিরি, সংকোশ, মানস, তিস্তা প্রভৃতি।ডিব্ৰুগড়, তেজপুর, গোয়ালপাড়া, গুয়াহাটি, ধুবড়ি।

দক্ষিণ ভারতের নদনদী

নদনদীদৈর্ঘ্যউৎপত্তিস্থলপতনস্থলগতিপথের রাজ্যউপনদীগতিপথের প্রধান শহর
মহানদী851 কিমিছত্তিশগড়ের সিহাওয়ার উচ্চভূমিবঙ্গোপসাগরছত্তিশগড় ও ওডিশাশিবনাথ, হাসদো, ইব, ব্রাক্ষ্মণী, বৈতরণী প্রভৃতি।সম্বলপুর, টিকারপাড়া, কটক।
গোদাবরী1465 কিমিপশ্চিমঘাট পর্বতের ত্রিম্বকেশ্বর (নাসিক)বঙ্গোপসাগরমহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা, ছত্তিশগড় ও অন্ধ্রপ্রদেশইন্দ্রাবতী, প্রাণহিতা, মঞ্জিরা প্রভৃতি।নাসিক, নানদেদ, ভদ্রাচলম, রাজামুন্দ্রি, আদিলাবাদ, করিমনগর, নরসাপুরম।
কৃষ্ণা1400 কিমিপশ্চিমঘাট পর্বতের মহাবালেশ্বরবঙ্গোপসাগরমহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশভীমা, কয়না, মালপ্রভা, তুঙ্গভদ্রা, ঘাটপ্রভা, মুসি প্রভৃতি।সাঙ্গলি, বিজয়ওয়াড়া।
কাবেরী400 কিমিপশ্চিমঘাট পর্বতের ব্রহ্মগিরি পাহাড়বঙ্গোপসাগরকর্ণাটক ও তামিলনাড়ুহেমবতী, অর্কাবতী, ইরোড, ভবানী, অমরাবতী প্রভৃতিশ্রীরঙ্গম, তিরুচিরাপল্লি, ইরোড।
নর্মদা1312 কিমিমহাকাল পর্বতের অমরকণ্টকখাম্বাত উপসাগরমধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও গুজরাতবরণা, ওরসাং প্রভৃতি।ওমকারেশ্বর, হোসাঙ্গাবাদ, ভারুচ।
তাপ্তী724 কিমিসাতপুরা পর্বতের মুলতাইখাম্বাত উপসাগরমহারাষ্ট্র ও গুজরাতগিরনা, পূর্ণা, ভাগুর, পান্জারা প্রভৃতি।

উত্তর ভারতের তিনটি নদনদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। নদীগুলির গতিপথের বর্ণনা করো।

উত্তর ভারতের প্রধান তিনটি নদনদী

উত্তর ভারতের নদনদীর মধ্যে প্রধান হল গঙ্গা, সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্র।

গঙ্গা – গঙ্গানদীর মোট দৈর্ঘ্য 2525 কিমি। গঙ্গা ভারতের প্রধান নদী। এই নদীর গতিপথকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়:

  1. উচ্চগতি – উৎস থেকে হরিদ্বার পর্যন্ত গঙ্গার প্রবাহপথ উচ্চগতি নামে পরিচিত। উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুন হিমালয়ের অন্তর্গত গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ তুষারগুহা থেকে গঙ্গা নদীর উৎপত্তি। উৎসের কাছে এর নাম ভাগীরথী। রুদ্রপ্রয়াগের কাছে মন্দাকিনী ও দেবপ্রয়াগের কাছে এর অন্যতম প্রধান উপনদী অলকনন্দার সঙ্গে মিলিত হয়ে ভাগীরথী গঙ্গা নামে পরিচিত হয়েছে।
  2. মধ্যগতি – হরিদ্বারের কাছে পার্বত্য প্রবাহ অতিক্রম করে গঙ্গা সমভূমিতে প্রবেশ করেছে। গঙ্গার সুদীর্ঘ গতিপথে ডানদিক থেকে যমুনা ও সোন এবং বামদিক থেকে গোমতী, ঘর্ঘরা, রামগঙ্গা, গণ্ডক, কোশী প্রভৃতি উপনদী এসে পড়েছে। গঙ্গার এইসব উপনদীর মধ্যে যমুনা সর্বপ্রধান। যমুনোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে যমুনা নদী এলাহাবাদের কাছে গঙ্গানদীতে পড়েছে। চম্বল, বেতোয়া, কেন, সারদা প্রভৃতি যমুনার ডানতীরের উল্লেখযোগ্য উপনদী। হরিদ্বারের পর থেকে ঝাড়খণ্ডের রাজমহল পাহাড় পর্যন্ত প্রবাহপথ গঙ্গার মধ্যগতি নামে পরিচিত।
  3. নিম্নগতি – (a) রাজমহল পাহাড়ের পর থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহনা পর্যন্ত গঙ্গার প্রবাহপথ নিম্নগতি নামে পরিচিত। রাজমহল পাহাড়ের কাছে এসে গঙ্গা পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। (b) গঙ্গা মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ানের কাছে এসে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। (c) প্রধান শাখাটি প্রথমে পদ্মা ও পরে মেঘনা নামে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। (d) দ্বিতীয় শাখাটি ভাগীরথী-হুগলি নামে পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। (e) ভাগীরথী-হুগলি নদীর গতিপথে অজয়, দামোদর, কংসাবতী, রূপনারায়ণ, রসুলপুর প্রভৃতি নদী ডানতীরস্থ উপনদী হিসেবে এবং জলঙ্গি, মাথাভাঙ্গা, চূর্ণি প্রভৃতি নদী বামতীরস্থ উপনদী হিসেবে এসে মিশেছে। (f) মোহনার কাছে এসে গঙ্গানদী পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ সৃষ্টি করেছে।
গঙ্গা নদীর প্রবাহ পথ

সিন্ধু – উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রধান নদী সিন্ধু (দৈর্ঘ্য 2880 কিমি, ভারতে 1114 কিমি)। তিব্বতের মানস সরোবর হ্রদের কাছে সেঙ্গে খাবাব ঝরনা থেকে উৎপন্ন হয়ে সিন্ধুনদ জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নাঙ্গা পর্বতের কাছে দক্ষিণমুখী হয়ে পাকিস্তানের ওপর দিয়ে আরব সাগরে (করাচির দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে) পড়েছে। সিন্ধুর বামতীরের উপনদীগুলির মধ্যে পাঁচটি প্রধান। এগুলি হল- শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তা বা ঝিলাম। এই নদীগুলি জম্মু ও কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ ও পাঞ্জাবের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সিন্ধুর ডানতীরের প্রধান উপনদীগুলি হল কাশ্মীরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত শিয়ক, গিলগিট, শিগার প্রভৃতি। সিন্ধুনদ লাদাখ পর্বতশ্রেণি অতিক্রম করার পর একটি সুগভীর গিরিখাতের সৃষ্টি করে ধীরে ধীরে সমভূমিতে প্রবেশ করেছে। মোহনার কাছে সিন্ধুর একটি ছোটো বদ্বীপ দেখা যায়।

সিন্ধুনদের প্রবাহপথ

ব্রহ্মপুত্র – উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রধান নদ ব্রহ্মপুত্র (দৈর্ঘ্য 2900 কিমি, ভারতে 916 কিমি)।

  • তিব্বতের রাক্ষসতাল-মানস সরোবরের প্রায় 90 কিমি দক্ষিণ-পূর্বে চেমায়ুং-দুং নামক হিমবাহ থেকে ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি।
  • সেখান থেকে প্রথমে সাংপো নামে তিব্বত মালভূমির ওপর দিয়ে পূর্বদিক বরাবর প্রায় 1500 কিমি প্রবাহিত হওয়ার পর নামচাবারওয়া শৃঙ্গের কাছে দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে বাঁক নিয়ে ডিহং নামে অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশ করেছে।
  • অসমের সাদিয়ার কাছে ডিবং ও লোহিত নদী ডিহং-এর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
  • এরপর ডিহং, ডিবং এবং লোহিত-এই তিনটি নদীর মিলিত প্রবাহ ব্রহ্মপুত্র নামে পশ্চিমমুখী হয়ে অসমের ওপর দিয়ে ধুবড়ি পর্যন্ত বয়ে গিয়ে দক্ষিণমুখী হয়ে যমুনা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
  • তারপর গোয়ালন্দের কাছে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে শেষে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।
  • অসম উপত্যকায় ব্রহ্মপুত্র বিনুনির মতো এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়েছে বলে নদীখাতে অনেক বালুচর বা দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে। জোরহাটের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদে গঠিত মাজুলি দ্বীপটি ভারতের বৃহত্তম নদীদ্বীপ।
  • ব্রহ্মপুত্রের ডানতীরের উপনদীগুলির মধ্যে সুবনসিরি, কামেং বা জিয়া ভরেলি, মানস, সংকোশ এবং বামতীরের উপনদীগুলির মধ্যে ধানসিরি, কোপিলি, বুড়ি ডিহিং প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
ব্রহ্মাপুত্র নদের প্রবাহপথ

ভারতের প্রধান হ্রদগুলির বিবরণ দাও।

ভারতের প্রধান প্রধান হ্রদ

উত্তর ভারতে অসংখ্য এবং দক্ষিণ ভারতে কিছু সংখ্যক ছোট-বড় নানা প্রকার হ্রদ দেখা যায়। জলের আস্বাদ অনুসারে ভারতের হ্রদগুলি দুই প্রকারের। যেমন –

স্বাদু জলের হ্রদ: ভারতের স্বাদু বা সুপেয় জলের হ্রদগুলির অধিকাংশই হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে দেখা যায়। এখানে উষ্ণতা সারাবছর কম থাকায় হ্রদগুলি থেকে বাষ্পীভবনের হার খুব কম। এ ছাড়া, কিছু কিছু হ্রদ বরফগলা জলেও পুষ্ট। এসব কারণে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে উলার, ডাল, নৈনিতাল, ভীমতাল, সাততাল, পুনাতাল, রূপকুণ্ড, গুরুদোংমার প্রভৃতি মিষ্টি জলের হ্রদগুলির সৃষ্টি হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের উলার ভারতের বৃহত্তম স্বাদু জলের হ্রদ। সিকিম রাজ্যের গুরুদোংমার ও সো লামো ভারতের দুটি অন্যতম উচ্চ হ্রদ। মণিপুর রাজ্যের লোকটাক ভারতের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাদু জলের হ্রদ।

লবণাক্ত জলের হ্রদ: ভারতের লবণাক্ত জলের হ্রদগুলি রাজস্থান রাজ্যে বেশি দেখা যায়। সাম্ভার, দিদওয়ানা, পুষ্কর, দেগনা, পচপদ্রা, কাচমান প্রভৃতি রাজস্থান রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ লবণাক্ত জলের হ্রদ। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের প্যাংগং, সোমোরিরি, অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের কোলেরু এবং তামিলনাড়ু রাজ্যের পুলিকট ভারতের উল্লেখযোগ্য লবণাক্ত জলের হ্রদ। ওডিশা রাজ্যের চিলকা প্রকৃতপক্ষে একটি উপহ্রদ। এটি ভারতের বৃহত্তম উপহ্রদ। কেরল রাজ্যের ভেম্বানাদ ও অষ্টমুদি দুটি বিখ্যাত উপহ্রদ বা কয়াল।

ভারতীয় কৃষিতে জলসেচের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভারতীয় কৃষিতে জলসেচের প্রয়োজনীয়তা

ভারতীয় কৃষিতে জলসেচের প্রয়োজনীয়তা সীমাহীন। কারণ –

  1. অনিশ্চিত মৌসুমি বৃষ্টিপাত – ভারতে সারাবছর বৃষ্টিপাত হয় না। শতকরা প্রায় ৬৭ থেকে ৭২ ভাগ বৃষ্টিপাত বর্ষাকালের ৪ মাসের মধ্যে হয়, যা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ঘটে। কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন ও প্রত্যাগমন অনিশ্চিত এবং অনিয়মিত। একমাত্র জলসেচের মাধ্যমেই কৃষির এই অনিশ্চিত অবস্থার প্রতিকার সম্ভব।
  2. বৃষ্টিপাতের অসম বণ্টন – ভারতে মৌসুমি বৃষ্টিপাত সব জায়গায় সমান হারে হয় না। উত্তর-পশ্চিম ভারতের অধিকাংশ জায়গায় বছরে ৭৫ সেন্টিমিটারেরও কম বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টিপাত বণ্টনের এই আঞ্চলিক বৈষম্যের দরুন রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, গুজরাতের উত্তর ও পশ্চিমাংশ, দাক্ষিণাত্য মালভূমির অভ্যন্তরভাগ প্রভৃতি এলাকায় কৃষিকাজের জন্য জলসেচের বিশেষ প্রয়োজন।
  3. শুষ্ক শীতকাল – উত্তর-পশ্চিম ভারতের কিছু অংশ এবং করমণ্ডল উপকূলের দক্ষিণাংশ ছাড়া ভারতের অন্যত্র শীতকালে বিশেষ বৃষ্টিপাত হয় না। সুতরাং, শীতকালে ভারতে রবিশস্য যেমন – গম, ডাল, তৈলবীজ, বোরোধান প্রভৃতি চাষের জন্য জলসেচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
  4. মৃত্তিকার জলধারণক্ষমতার তারতম্য – লাল মৃত্তিকা এবং ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার জলধারণক্ষমতা কম। তাই, ওইসব মাটিতে কৃষিকাজ করার জন্য জলসেচ প্রয়োজন।
  5. উচ্চফলনশীল বীজের চাষ – বর্ধিত খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য ভারতের বিভিন্ন অংশে উচ্চফলনশীল বীজের চাষ করা হয়। কিন্তু উচ্চফলনশীল শস্য চাষের জন্য অধিক পরিমাণে জল প্রয়োজন। একমাত্র জলসেচের মাধ্যমেই তা সরবরাহ করা সম্ভব।
  6. সারাবছরব্যাপী চাষ – কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য একই জমিতে প্রতিবছর তিন-চার বার চাষ করা হয়। একমাত্র জলসেচের ব্যবস্থা থাকলেই জমিতে সারাবছর চাষ করা সম্ভব হয়।

জলবিভাজিকা উন্নয়ন বলতে কী বোঝায়? এর গুরুত্ব এবং এর উন্নয়ন পদ্ধতি সম্পর্কে লেখো।

জলবিভাজিকা উন্নয়ন

কোনো নদী অববাহিকা অঞ্চলের জলবিভাজিকার সামগ্রিক ও বিভাজনসম্পন্ন উন্নয়নই হল জলবিভাজিকা উন্নয়ন। এর মাধ্যমে নদী অববাহিকা অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশের উপাদান ও সম্পদের স্থায়ী উন্নয়ন করা যায়।

গুরুত্ব

জলবিভাজিকার মাধ্যমে নদী অববাহিকা অঞ্চলগুলিকে চিহ্নিত করা যায়। এটি প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার একটি একক। একটি দেশের জলসম্পদ তার নদী অববাহিকার বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে। ভূপৃষ্ঠে এবং ভূগর্ভে কত পরিমাণ জল সঞ্চিত আছে তা নিয়ন্ত্রণ করে নদী অববাহিকার ক্ষেত্রফল, ওই অঞ্চলের বৃষ্টিপাত, শিলার প্রকৃতি প্রভৃতি।

জলবিভাজিকা উন্নয়ন পদ্ধতি

  • ঢাল উন্নয়ন – নদী অববাহিকার উঁচু খাড়া অংশে ভূমিক্ষয় এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বৃক্ষরোপণ, তৃণভূমির আচ্ছাদন তৈরি, ধস নিয়ন্ত্রক দেয়াল নির্মাণ, প্রয়োজনে পাহাড়ি নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা যেতে পারে। এর সাথে ঝুম চাষের মতো কুপ্রথা বন্ধ করা দরকার।
  • সমোন্নতি রেখা বরাবর বনভূমি তৈরি – ধাপচাষযুক্ত অঞ্চলে সমোন্নতি রেখা বরাবর বনভূমি তৈরি করলে মাটি ক্ষয় কম হয় এবং ভূমিজলের পরিমাণ বাড়ে।
  • নদীখাতের ছোটো বাঁধ তৈরি – অববাহিকার ছোটো নদীগুলির প্রবাহপথে বাঁধ বেঁধে দিলে স্থানীয়ভাবে জলসংরক্ষণ ও মাটিক্ষয় রোধ করা যায়।
  • বন্যা নিয়ন্ত্রণ – বন্যাপ্রবণ নদী অববাহিকায় প্রচুর জলাভূমি, পুকুর, খাল কাটতে হবে এবং নদীখাতের পলি কেটে তুলে ফেলতে হবে। এতে জলধারণ ক্ষমতা বাড়ে।
  • বহুমুখী নদী উন্নয়ন পরিকল্পনা – নদী অববাহিকার সঠিক উন্নতির জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, সুনিয়ন্ত্রিত জলসেচ, নৌপরিবহণ, মাছচাষ ইত্যাদি করা প্রয়োজন। ভূমিক্ষয় রোধেও নানা ব্যবস্থা নিতে হবে।

দক্ষিণ ভারতের প্রধান নদনদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়

অথবা, দক্ষিণ ভারতের পূর্ববাহিনী ও পশ্চিমবাহিনী নদীগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

দক্ষিণ ভারতের প্রধান নদনদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়

ভারতের প্রধান প্রধান নদনদী

প্রবাহের দিক অনুসারে দক্ষিণ ভারতের নদনদীকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায় — 1. পূর্ববাহিনী নদী ও 2. পশ্চিমবাহিনী নদী।

পূর্ববাহিনী নদী

নদীর নামগতিপথউপনদী/শাখানদী
সুবর্ণরেখা (470 কিমি)ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ছোটোনাগপুর মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর ওডিশার তালসারির কাছে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। হুড্রু এই নদীর গতিপথে সৃষ্ট একটি বিখ্যাত জলপ্রপাত।খরকাই, রোরো, দামড়া প্রভৃতি।
মহানদী (851 কিমি)ছত্তিশগড় রাজ্যের সিহাওয়ার উচ্চভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে ছত্তিশগড় ও ওডিশার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। মহানদীর মোহানায় একটি বদ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে।শিবনাথ, ইব, ব্রাহ্মণী, পাইকা, বিরূপা প্রভৃতি।
গোদাবরী (1465 কিমি)মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার ত্রিম্বকেশ্বর থেকে উৎপন্ন গোদাবরী নদী মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। দক্ষিণ ভারতের দীর্ঘতম এই নদীটির মোহানায় একটি বিশাল বদ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে।মঞ্জিরা, ইন্দ্রাবতী, পূর্ণা, গৌতমী, বশিষ্ঠ প্রভৃতি।
কৃষ্ণা (1400 কিমি)মহারাষ্ট্র রাজ্যের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মহাবালেশ্বরের কাছ থেকে উৎপন্ন হওয়ার পর কৃষ্ণা নদী মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। কৃষ্ণা নদীর মোহানাতে একটি বদ্বীপ আছে।ভীমা, তুঙ্গভদ্রা, ঘাটপ্রভা, মুসি প্রভৃতি।
কাবেরী (800 কিমি)কর্ণাটক রাজ্যের ব্রহ্মগিরি পর্বত থেকে উৎপন্ন কাবেরী নদী কর্ণাটক ও তামিলনাড়ু রাজ্যের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। শিবসমুদ্রম কাবেরী নদীর ওপর গঠিত একটি বিখ্যাত জলপ্রপাত। এই নদীটির মোহানাতেও একটি বদ্বীপ দেখা যায়।হেমবতী, অর্কাবতী, ভবানী প্রভৃতি।

পশ্চিমবাহিনী নদী

নদীর নামগতিপথউপনদী/শাখানদী
নর্মদা (1312 কিমি)মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের অমরকণ্টক পাহাড় থেকে উৎপন্ন নর্মদা নদী মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও গুজরাতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খাম্বাত উপসাগরে এসে মিশেছে। মধ্যপ্রদেশের জবলপুরের কাছে নর্মদা নদীর ওপর নয়নাভিরাম ধুঁয়াধার জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে।বরণা, কোলার, হিরণ প্রভৃতি।
তাপ্তি বা তাপী (724 কিমি)মধ্যপ্রদেশের মুলতাই মালভূমি থেকে উৎপন্ন তাপ্তি নদী মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র হয়ে সুরাতের কাছে খাম্বাত উপসাগরে পড়েছে।পূর্ণা, গিরনা, পান্জারা প্রভৃতি।
সবরমতী (416 কিমি)রাজস্থান রাজ্যের আরাবল্লি পর্বতের জয়সমুদ্র হ্রদ থেকে উৎপন্ন হয়ে সবরমতী নদী রাজস্থান ও গুজরাত রাজ্যের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খাম্বাত উপসাগরে পড়েছে।ওয়াকাল, হাতমতি, সেই প্রভৃতি।
মাহী (580 কিমি)মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের বিন্ধ্য পর্বত থেকে উৎপন্ন মাহী নদী মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও গুজরাত রাজ্যের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খাম্বাত উপসাগরে পড়েছে।

ভারতে জলসেচের সম্ভাবনা কীরূপ আলোচনা করো।

ভারতে জলসেচের সম্ভাবনা

ভারতে জলসেচের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির অনুকূল ভৌগোলিক অবস্থাগুলি হল –

  1. বরফগলা জলে পুষ্ট নদনদী – উত্তর ভারতে বড়ো বড়ো নদীগুলি বরফগলা জলে পুষ্ট বলে এগুলিতে সারাবছর জল থাকে। এর ফলে উত্তর ভারতের নদীগুলি থেকে নিত্যবহ খাল খনন করার সুবিধা রয়েছে, যেখান থেকে সারাবছর কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ করা যাবে।
  2. বিস্তীর্ণ সমভূমি – উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ও পূর্ব উপকূলে বিস্তীর্ণ সমভূমি থাকায় সহজে খাল কেটে জলসেচ করা যায়।
  3. স্বল্প গভীর ভৌমজলস্তর – পলিগঠিত অঞ্চলগুলিতে পলিস্তরের সামান্য নীচে জলস্তর থাকায় সহজেই কূপ, নলকূপ খনন করে ভূগর্ভস্থ জল সেচের কাজে ব্যবহার করা যায়।
  4. বৃষ্টির জলের প্রাচুর্য – বর্ষাকালে দেশের খালবিল, নদীনালা, হ্রদ, পুকুর ও অন্যান্য জলাশয় জলপূর্ণ হয়ে যায় বলে বছরের অন্যান্য সময় সেগুলি থেকে সেচের জন্য জল সরবরাহ করা সম্ভব হয়।
  5. বাঁধ তৈরির অনুকূল ভূপ্রকৃতি – উপদ্বীপীয় মালভূমির শক্ত ও কেলাসিত শিলা দ্বারা গঠিত ভূপ্রকৃতি ওই অঞ্চলের নদনদীসমূহের গতিপথে বাঁধ এবং কৃত্রিম জলাধার তৈরির পক্ষে বিশেষভাবে অনুকূল।

ভারতীয় কৃষিতে খাল দ্বারা জলসেচের উপযোগিতা কতখানি?

খাল দ্বারা জলসেচের উপযোগিতা

প্রধানত নদনদী বা জলাধারের জল কৃষিজমিতে ব্যবহারের জন্য যে খাল খনন করা হয়, তাকেই বলে সেচখাল। এই খাল দুই প্রকার-প্লাবন খাল ও নিত্যবহ খাল। ভারতীয় কৃষিতে এই খাল দ্বারা জলসেচের উপযোগিতা অপরিসীম। এর কারণ –

  1. অসংখ্য নদনদীর জল – ভারত নদীমাতৃক দেশ, অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন অংশের ওপর দিয়ে অসংখ্য নদনদী প্রবাহিত হয়েছে। এর ফলে এখানকার অধিকাংশ জায়গায় খাল খনন করে কৃষিজমিতে জলসেচ করা যায়।
  2. সারাবছর বরফগলা জলের যোগান – সুবিস্তৃত উত্তর ভারতের নদীগুলি বরফগলা জলে পুষ্ট বলে এগুলিতে সারাবছর জল থাকে এবং তাই প্রায় সমগ্র উত্তর ভারতেই সারাবছর খাল দ্বারা জলসেচ করা যায়।
  3. খাল খননের উপযোগী ভূমিরূপ – ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সমভূমি থাকায় সহজে খাল খনন করে জলসেচ করা যায়।
  4. ভূমির ঢালজনিত সুবিধা – দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভূমির ঢাল সুষম বলে খাল দিয়ে সহজেই জল প্রবাহিত হতে পারে (যেমন- সমভূমি অঞ্চলে)।
  5. জলাধার তৈরির সুবিধা – দক্ষিণ ভারতে বরফগলা জলে পুষ্ট নদী না থাকলেও ওখানকার ভূমিরূপ ঢেউখেলানো বলে সহজেই বাঁধ দিয়ে জলাধার নির্মাণ করা যায় এবং তারপর ওগুলি থেকে খাল খনন করে জলসেচ করা হয়।
  6. ভূগর্ভস্থ জলস্তর হ্রাস – দেশের অধিকাংশ জায়গাতেই এখন ভূগর্ভস্থ জলস্তর হ্রাস পাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে ভূপৃষ্ঠস্থ জল অর্থাৎ নদনদী, জলধারা খালের মাধ্যমে কৃষিকাজে ব্যবহার করা ছাড়া আমাদের কৃষির উন্নতিবিধান বা জলসম্পদ সংরক্ষণের আর কোনো বিকল্প নেই।

সবশেষে বলা যায়, খাল দ্বারা জলসেচের উপযোগিতা এতটা বেশি বলেই বর্তমান ভারতের মোট সেচসেবিত কৃষিজমির সর্বাধিক অংশে (প্রায় ২৬ শতাংশ) খালের মাধ্যমে জলসেচ করা হয়।

অতিরিক্ত জলসেচের ফলে কী কী বিপদ হতে পারে?

অতিরিক্ত জলসেচের ফলে বিপদ

অতিরিক্ত জলসেচের ফলে নিম্নলিখিত বিপদগুলি ঘটতে পারে –

  1. উদ্ভিদের অক্সিজেনের অভাব – জলাবদ্ধ মাটিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকায় উদ্ভিদ শিকড়ের সাহায্যে পর্যাপ্ত অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে না। ফলে উদ্ভিদের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়।
  2. উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রকার রোগ সৃষ্টি – জলাবদ্ধ মাটিতে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া, জীবাণু ইত্যাদি সক্রিয় হওয়ার ফলে গাছের শিকড় পচে যায়। এ ছাড়া উদ্ভিদদেহে নানা রকম ছত্রাকঘটিত রোগের সংক্রমণ ঘটে।
  3. বিষাক্ত বস্তুর সৃষ্টি – মাটিতে দীর্ঘকাল জল থাকলে নানা রকম বিষাক্ত পদার্থ, যেমন- হাইড্রোজেন সালফাইড, ভোলাটাইল ফ্যাটি অ্যাসিড ইত্যাদি উৎপন্ন হয়।
  4. জমির উর্বরতা হ্রাস – জলসেচের সুবিধা নিয়ে বহু জমিতে সারাবছর চাষ করা হয়। অনেকসময় একই ফসল বারবার চাষ করা হয়। এর ফলে মাটির ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং জমির স্বাভাবিক উর্বরতা কমতে থাকে।
  5. মাটির লবণতা বৃদ্ধি – অতিরিক্ত জলসেচের ফলে মাটির নীচের ভর থেকে লবণ সেচের জলে দ্রবীভূত হয়ে মাটির ওপরের ভরে এসে সঞ্চিত হয়। এভাবে মাটি লবণাক্ত হয়ে পড়ে।
  6. ভৌমজলতলের পতন – অতিরিক্ত জল তোলার ফলে মাটির নীচে ভৌমজলতলের পতন ঘটে। ফলে গ্রীষ্মকালে প্রয়োজনমতো জল পাওয়া যায় না।

এ ছাড়া অতিরিক্ত জলসেচের ফলে (i) বাস্তুতন্ত্রের নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে, (ii) জলবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে পারে এবং (iii) আর্সেনিক দূষণের সম্ভাবনা বাড়তে পারে।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কীভাবে জলসেচ করা হয়, বর্ণনা করো।

অথবা, ভারতে ব্যবহৃত জলসেচ পদ্ধতিগুলির বিবরণ দাও।

ভারতে প্রচলিত জলসেচের পদ্ধতিসমূহ:

ভৌগোলিক পরিবেশের পার্থক্যের জন্য ভারতের বিভিন্ন অংশের সেচসেবিত জমিতে সেচের প্রধান তিনটি মাধ্যম বা পদ্ধতি হল –

  • সেচখাল
  • কূপ ও নলকূপ এবং
  • জলাশয়

এই তিন পদ্ধতিতে সেচের কাজে সাধারণ পারস্য চক্র (Persian wheel), ডোঙা কিংবা বৈদ্যুতিক পাম্প ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কীভাবে জলসেচ করা হয় বর্ণনা করো।

সেচখাল

ভারতে দুই ধরনের সেচখাল দেখা যায়। যথা –

  1. প্লাবন খাল: যেসব খাল বর্ষা বা বন্যার অতিরিক্ত জল পরিবহন করে সেই খালগুলিকে প্লাবন খাল বলা হয়। প্লাবন খালের মাধ্যমে কেবল বর্ষাকালেই জলসেচ করা যায়। যেমন – কৃষ্ণা বদ্বীপ খাল, গোদাবরী বদ্বীপ খাল, কাবেরী বদ্বীপ খাল প্রভৃতি।
  2. নিত্যবহ খাল: যেসব নদীতে সারাবছর জল থাকে, সেইসব নদী থেকে খনন করা খালগুলিকে নিত্যবহ খাল বলা হয়। উৎস-নদী সারাবছর জলপূর্ণ থাকার জন্য নিত্যবহ খালের মাধ্যমে কৃষিজমিতে সারাবছরই জলসেচ করা যায়। তুষারগলা জলে পুষ্ট উত্তর ভারতের নদীগুলি নিত্যবহ হওয়ায় উত্তর ভারতেই নিত্যবহ খাল বেশি দেখা যায়। যেমন – উত্তরপ্রদেশের উচ্চ-গঙ্গা খাল, পাঞ্জাবের পশ্চিম যমুনা খাল ও উচ্চ-বারি দোয়াব খাল, পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর খাল, ইডেন খাল, হিজলি খাল, ওডিশা উপকূল খাল এবং দামোদর-ময়ূরাক্ষী-কংসাবতী পরিকল্পনার সেচখালসমূহ। এইরূপ খালের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সেচকাজ হয় উত্তরপ্রদেশে।

কূপ ও নলকূপ

  • উত্তর ভারতের পলিমাটি গঠিত অঞ্চলে মাটির নিচে সঞ্চিত ভূগর্ভের জল বা ভৌমজল (underground water) কূপ ও নলকূপের মাধ্যমে তুলে এনে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হয়।
  • কূপ ও নলকূপের গভীরতা ভূগর্ভের জলস্তরের ওপর নির্ভর করে। জলস্তর যদি ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকে তাহলে কূপ ও নলকূপের গভীরতা কম হয়।
  • দুই ধরনের নলকূপ দেখা যায় –
    • সাধারণ নলকূপ: সাধারণ নলকূপ অগভীর হয় এবং হাত দিয়ে পাম্প করে জল তোলা হয়।
    • বৈদ্যুতিক নলকূপ: গভীর নলকূপ থেকে বৈদ্যুতিক পাম্প বা ডিজেলচালিত পাম্পের সাহায্যে জল তোলা হয়। এতে স্বল্প সময়ে প্রচুর জল তোলা যায়।
  • উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চলের পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশ, পূর্ব ভারতের বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের অসমে কূপ ও নলকূপের প্রচলন বেশি।
  • কূপের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সেচ হয় উত্তরপ্রদেশে।
  • বর্তমানে পশ্চিম ভারতের শুষ্ক অঞ্চলগুলিতে কূপ ও নলকূপের দ্বারা সেচের ব্যবহার বেড়েছে।
  • এ ছাড়াও তামিলনাড়ুর দক্ষিণাংশ ও কেরলে কূপ ও নলকূপের মাধ্যমে সেচকাজ করা হয়।

জলাশয় বা পুকুর

  • দাক্ষিণাত্য মালভূমিতে মাটির নিচে অধিকাংশ জায়গায় অপ্রবেশ্য শিলাস্তর থাকায় বৃষ্টির জল ভূগর্ভে বিশেষ সঞ্চিত হয় না।
  • এখানকার ভূপৃষ্ঠ তরঙ্গায়িত বলে বর্ষার জল সহজেই নিম্নভূমিতে ধরে রাখা যায়।
  • এ ছাড়া, ভারতের যেসব অঞ্চলে নিয়মিত বৃষ্টিপাত হয় না, সেখানে জলাশয় নির্মাণ করে জল জমিয়ে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে ওই জল সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়। যেমন – কাথিয়াবাড় উপদ্বীপের দক্ষিণাংশ।
  • দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুতে এই পদ্ধতির প্রচলন বেশি। পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা, অসম, বিহার, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি রাজ্যে এই পদ্ধতিতে সামান্য জলসেচ করা হয়।
  • জলাশয় বা পুকুরের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সেচকাজ হয় অন্ধ্রপ্রদেশে।
ভারতের জলসেচ ব্যবস্থা

আজকের এই আর্টিকেলে আমরা মাধ্যমিক ভূগোলের পঞ্চম অধ্যায় “ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশ” এর অন্তর্ভুক্ত ভারতের ভূপ্রকৃতি বিভাগের কিছু রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য, অথবা যদি আপনি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে, আপনি টেলিগ্রামে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। এছাড়া, আমাদের এই পোস্টটি আপনার প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করুন, যাদের এর প্রয়োজন হতে পারে। ধন্যবাদ।

Share via:

মন্তব্য করুন