আজকের এই আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের প্রথম পাঠের প্রথম অধ্যায়, ‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ -এর কিছু ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নোত্তরগুলো নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নবম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষায় এই ধরনের প্রশ্ন নিয়মিত আসে।

মঙ্গলকাব্য কাকে বলে? এটি কয় প্রকার ও কী কী?
মঙ্গলকাব্য সংজ্ঞা – আনুমানিক খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত কালসীমার মধ্যে রচিত পৌরাণিক সংস্কার দ্বারা লালিত, বাংলার শক্তিসঞ্চারক দেবদেবীগণের মাহাত্ম্যগাথা যে কাহিনি কাব্যে বর্ণিত হয়েছে তাকে মঙ্গলকাব্য বলা হয়।
প্রকার – বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্যধারায় প্রধান ও অপ্রধান দুটি শাখাপ্রশাখাই বিস্তৃত হতে দেখা যায়। ‘মনসামঙ্গল’, ‘চণ্ডীমঙ্গল’ অন্নদামঙ্গল ও ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যগুলিকে মঙ্গলকাব্যের প্রধান শাখা হিসেবে ধরা হয়। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি অপ্রধান মঙ্গলকাব্য সেইসময় প্রচলিত ছিল। এগুলি হল – ‘শিবমঙ্গল’, ‘অন্নদামঙ্গল’, ‘কালিকামঙ্গল’, ‘শীতলামঙ্গল’, ‘রাধিকামঙ্গল’, ‘গঙ্গামঙ্গল’ ইত্যাদি।
‘শ্রীকবিকঙ্কণ’ কার উপাধি? তিনি কার গান রচনা করেছেন?
যার উপাধি – মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি তথা ‘অভয়ামঙ্গল’ বা ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের রচয়িতা মুকুন্দ চক্রবর্তীর উপাধি ছিল ‘শ্রীকবিকঙ্কণ’।
যার গান রচনা করা হয়েছে – শ্রীকবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী তাঁর অনন্যসাধারণ কাহিনিকাব্যে ‘অম্বিকা’ তথা ‘চণ্ডী’-র গান গেয়েছেন। তাই কবিতার ভণিতাংশে তিনি বলেছেন – ‘অম্বিকামঙ্গল গান শ্রীকবিকঙ্কণ’।
‘ভণিতা’ কাকে বলে? পাঠ্যাংশে কবি যে ভণিতা প্রয়োগ করেছেন, তা উল্লেখ করো।
ভণিতা – মধ্যযুগে রচিত দেবদেবীর মাহাত্ম্যমূলক কাহিনিকাব্যগুলির পদশেষে কবিকর্তৃক নিজ নামের উল্লেখকে বলা হয় ‘ভণিতা’।
কবির ব্যবহৃত ভণিতা – কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘অম্বিকামঙ্গল’ বা ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের ‘আখেটিক খণ্ড’ -এর ‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ নামক নির্বাচিত পাঠ্যাংশটির শেষাংশে কবি যে ‘ভণিতা’ প্রয়োগ করেছেন, তা হল – ‘অম্বিকামঙ্গল গান শ্রীকবিকঙ্কণ।’ বলাবাহুল্য কবি এখানে নিজ নামের পরিবর্তে প্রাপ্ত উপাধিটি ব্যবহার করেছেন।
‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ কাব্যাংশ অবলম্বনে মেঘের স্বরূপ বর্ণনা করো।
মেঘের স্বরূপ – কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ কাব্যাংশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পটভূমিকায় মেঘের একটা নিজস্ব স্বরূপ দেখা যায়। কলিঙ্গের আকাশে অন্ধকার করে ঘন মেঘ ঘনিয়ে আসে। ঝলকিত বিদ্যুৎরেখার ভয়ংকর চিত্র আঁকতে আঁকতে ঈশান কোণ থেকে সে মেঘের উৎপত্তি ও বিকাশ। নিমেষে সে মেঘ সারা আকাশ ছেয়ে ফেলে বজ্রনিনাদে নিনাদিত করে। উচ্চনাদী সেই চারিমেঘ তথা সম্বর্ত, আবর্ত, পুষ্কর, দ্রোণ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হয়, মনে হয় যেন অষ্টগজরাজ বারিবর্ষণ করছে।
‘দেখিতে না পায় কেহ অঙ্গ আপনার।’ – কে, কেন এই কথা ব্যক্ত করেছেন?
বক্তা ও বক্তব্যের কারণ – ‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ কাব্যাংশের কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী তাঁর কাব্যবর্ণনা প্রসঙ্গে প্রশ্নোক্ত কথাটি ব্যক্ত করেছেন। বর্ণনানুসারে দেখা যায়, কলিঙ্গদেশে হঠাৎ প্রবল ঝড়-বৃষ্টি-প্লাবনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মুহূর্তমধ্যে আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন, যার বুক বিদীর্ণ করে ঘনঘন আবির্ভূত হচ্ছে ভয়াল বিদ্যুতের ঝলক। মেঘান্ধকার এমন আলোকহীনতা সৃজন করেছে, তার গাঢ় প্রলেপ পরিবেশকে এত কালো করে দিয়েছে যে প্রজারা কেউ কারও দেহ দেখতে পাচ্ছে না।
‘উড়িয়া মেঘ ডাকে উচ্চনাদ।’ – মেঘ কোথায় ডাকে? প্রাসঙ্গিক পরিণতি লেখো।
যেখানে মেঘ ডাকে – ‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ কাব্যাংশে বর্ণিত কলিঙ্গরাজ্যের আকাশে মেঘ ডাকে।
পরিণতি – কলিঙ্গদেশের আকাশে হঠাৎই ঘন কালো মেঘের উত্থান দেখা যায় ঈশান কোণ থেকে। নিমেষে তা সমগ্র আকাশকে ছেয়ে ফেলে তীব্র বজ্র-বিদ্যুতের আগমনবার্তা ঘোষণা করে। প্রজারা বিপদের আশঙ্কায় প্রমাদ গুণতে শুরু করে। তাদের মন আচ্ছন্ন করে ফেলে তীব্র বিষাদক্লিষ্টতা। এরপর মেঘ-বৃষ্টি-বজ্র-বিদ্যুতের দোসর হয়ে যখন প্রবল ঝড় ধেয়ে আসে, তখন – ‘বিপাকে ভবন ছাড়ি প্রজা দিল রড়।’
‘প্রজা ভাবয়ে বিষাদ।’ – প্রজাদের মন বিষাদগ্রস্ত কেন?
প্রজাদের রাজ্য – প্রখ্যাত মধ্যযুগীয় কবি মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ কাব্যাংশে কলিঙ্গরাজ্যের প্রজাদের কথা বলা হয়েছে।
প্রজাদের বিষাদগ্রস্ত অবস্থার কারণ – কলিঙ্গরাজ্যের প্রজাদের মন বিষাদে আচ্ছন্ন, কেন-না হঠাৎ সে-রাজ্যের আকাশে রাশি-রাশি মেঘের সমাবেশ ঘটেছে। ঈষাণ কোণ থেকে এই মেঘরাশি জমাট বাঁধতে বাঁধতে সমূহ আকাশকে ক্রমে আচ্ছন্ন করে পরিবেশকে অন্ধকার করে দিয়েছে। ক্রমে সঞ্চারিত হয়েছে উত্তুরে বাতাস, ধেয়ে এসেছে তীব্র ঝড়। দূর থেকে ভেসে এসেছে মেঘগর্জন। দেখা দিয়েছে আকাশচেরা তীব্র বিদ্যুতের ঝলক। বাজ পড়েছে ঘনঘন। একসময় শুরু হয়েছে প্রবল বর্ষণ, যা থেকে নির্দয় দুর্যোগ আশঙ্কায় প্রজারা বিষাদক্লিষ্ট হয়ে পড়েছে।
কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ হলে প্রজাদের পরিস্থিতি কেমন হয়েছিল তা বর্ণনা করো।
প্রজাদের অবস্থা – ‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ কাব্যাংশে দেখা যায় কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ হলে প্রজারা সম্পূর্ণ দিশেহারা হয়ে পড়ে। সারা আকাশ জুড়ে মেঘসজ্জার কারণে প্রজারা এমনিতেই কেউ কারো অঙ্গ দেখতে পাচ্ছিল না। ঝড়-বৃষ্টি-বজ্র-বিদ্যুৎ সহযোগে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হলে ‘প্রলয় গনিয়া প্রজা ভাবয়ে বিষাদ।’ এমতাবস্থায় বিপাকে পড়ে প্রজারা ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। মাঠের শস্য নষ্ট হল দেখে তারা আশঙ্কায় চমকে ওঠে। ঘন মেঘের আঁধারে রাস্তা দেখা যায় না, দিন-রাত এক হয়ে গেছে। তাই ত্রস্ত প্রজারা ঋষি জৈমিনিকে একাগ্রচিত্তে স্মরণ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা রীতিমতো সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
‘সঘনে চিকুর পড়ে বেঙ্গ-তড়কা বাজ।’ – তাৎপর্য লেখো।
তাৎপর্য – মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ কাব্যাংশে এক অকাল দুর্যোগের পত্তন দেখানো হয়েছে। দৈবী প্রভাবজাত এই দুর্যোগ পরিস্থিতির ছবি আঁকতে গিয়ে কবি আকাশে সঞ্চারিত ঘন কালো মেঘের বর্ণনা দিয়েছেন। একসময় সেই মেঘের বুকে ঘন ঘন ও তীব্র বিদ্যুতের ঝলকানি লক্ষিত হয়। যার ফলশ্রুতি বজ্রপতন। ব্যাঙের মতো অহরহ লাফিয়ে পড়তে থাকে সে বাজ।
‘জলে মহী একাকার পথ হইল হারা।’ – ‘মহী’ শব্দের অর্থ কী? মহীর অবস্থা কী হয়েছিল?
‘মহী’ অর্থ – কবিকঙ্কন মুকুন্দ চক্রবর্তী রচিত ‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ কাব্যাংশ থেকে নেওয়া প্রশ্নোধৃত অংশে ‘মহী’ অর্থে পৃথিবীকে বোঝানো হয়েছে।
‘মহী’র অবস্থা – কলিঙ্গদেশের অবস্থা ছিল সুস্থ ও স্বাভাবিক। হঠাৎ আকাশের ঈষাণ কোণ থেকে ধেয়ে আসে ঘন কালো মেঘরাশি, যা ক্রমে ক্রমে সারা আকাশে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। এই মেঘাড়ম্বরের সঙ্গে চলতে থাকে তীব্র বিদ্যুৎ ঝলকানি ও সুতীব্র মেঘগর্জন। শুরু হয় প্রবল বারিবর্ষণ। মনে হয় যেন আট দিক থেকে আটটি হাতি তাদের শুঁড় থেকে ক্রমান্বয়ে বারিবর্ষণ করে চলেছে। পৃথ্বী বুঝি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এই ধারাবর্ষণে।
‘নদনদীগণ’ কার আদেশে কী করেছিল?
নদীর কার্যকলাপ – মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাহিনিকাব্যকার মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ কাব্যাংশটি রচিত হয়েছিল দেবী চণ্ডীর আদেশে। দেবী চণ্ডীর আদেশেই কলিঙ্গদেশের আকাশে হঠাৎ ঘনকালো মেঘরাশি সঞ্চারিত হয়ে অকালবর্ষণের পরিস্থিতি সৃজন করেছিল। এ বর্ষণ চলেছিল ক্রমাগত সাতদিন ধরে বিরামহীনভাবে। মহাপ্লাবনে জল ও স্থল সব যেন একাকার হয়ে গিয়েছিল। তাই যেন দৈবাদেশেই নদ-নদী ফুলেফেঁপে উঠেছিল সৃষ্টি হয়েছিল পর্বতপ্রমাণ ঢেউ। যার অভিঘাতে প্রজাদের ঘরবাড়ি সব সেই সর্বগ্রাসী ঢেউ -এর মাথায় টলমল করে দুলছিল।
‘সোঙরে সকল লোক যে জৈমিনি।’ – কোথাকার লোক? কবির এমন উক্তির কারণ কী?
‘লোক’ যেখানকার – মধ্যযুগীয় কবি মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ কাব্যাংশে ‘সকল লোক’ বলে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, তারা কলিঙ্গদেশের বা কলিঙ্গরাজ্যের অধিবাসী।
এমন উক্তির কারণ – কলিঙ্গরাজ্যের আকাশে দৈবাদেশে হঠাৎ ঘনকালো মেঘরাশি সঞ্চারিত হয় এবং দেখতে দেখতে শুরু হয় অকালবর্ষণ। কালো মেঘের বুক চিরে বিদ্যুৎ শিখার ঝলকানি লোকের মনে ত্রাস সঞ্চার করে, আর তার সঙ্গে বজ্রপতনও ঘটতে থাকে। পরিস্থিতি এমন হয় যে, বিপদের চরম আশঙ্কায় প্রজারা বজ্রনিবারক ঋষি জৈমিনির নাম স্মরণ করতে থাকে।
‘না পায় দেখিতে কেহ রবির কিরণ।’ – কবির এমন মন্তব্যের কারণ কী?
এমন মন্তব্যের কারণ – মধ্যযুগের কাহিনিকাব্যকার মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ কাব্যাংশে লক্ষ করা যায়, কলিঙ্গের আকাশে হঠাৎই দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দেয় আকাশ কালো করা মেঘাড়ম্বরে। মেঘরাশি গম্ভীর সজ্জায় ঈষাণ কোণ থেকে ধেয়ে এসে সমগ্র আকাশ ছেয়ে ফ্যালে। সঙ্গে অবিরাম বিদ্যুৎঝলক, গুরুগম্ভীর মেঘধ্বনি ও মুষলধারে বৃষ্টিপাত হতে থাকে। কালো মেঘের নিশ্ছিদ্র সমাবেশে মুহূর্তমধ্যে দিন রাত্রির পার্থক্য দূর হয়ে যায়। দিন সাতেক ধরে অবিচ্ছিন্ন বৃষ্টিপাতের ফলে কেউ সূর্যের মুখ দেখতে পায় না। এ কারণেই কবি এমন মন্তব্য করেছেন।
‘নিরবধি সাত দিন বৃষ্টি নিরন্তর।’- কতদিন বৃষ্টি হয়েছিল? এর পরিণতি কী হয়?
যতদিন বৃষ্টি হয়েছিল – কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ কাব্যাংশে সাত দিন অবিরত বৃষ্টি হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
পরিণতি – এমন সাতদিন নিরন্তর বৃষ্টিপাতের দরুণ কলিঙ্গরাজ্যের অবস্থা একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মুষলধারে বর্ষণ হচ্ছিল, জল ও স্থল একাকার হয়ে গিয়েছিল। দিনরাত্রির তফাত মুছে গিয়েছিল। সূর্যকিরণ দৃষ্ট হচ্ছিল না। আশ্রয় হারিয়ে সর্পকুলও জলে ভেসে গিয়েছিল। খেতের কাজ বন্ধ হয়েছিল, ঘরবাড়ি জলে ভিজে ভগ্নদশাপ্রাপ্ত হয়েছিল। বাড়ির চাল ভেদ করে ভাদ্রের তালের মতো বড়ো বড়ো শিল এসে পড়ছিল। পর্বতপ্রমাণ ঢেউ এসে মঠ-অট্টালিকা ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছিল। ঢেউ -এর উপর ঘরগুলো যেন টলমল দুলছিল।
‘ভাদ্রপদ মাসে যেন পড়ে থাকা তাল।’ – তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
তাৎপর্য – মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মঙ্গলকাব্যকার মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ কাব্যাংশে কলিঙ্গরাজ্যে ঝড়-বৃষ্টি-বন্যাজনিত এক প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের বর্ণনা আছে। হঠাৎ আকাশ কালো করে আসা মেঘরাশি থেকে যেন অকাল ধারাবর্ষণ নেমে এসে সমগ্র কলিঙ্গদেশকে প্লাবিত করেছিল। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছিল ভাদ্রমাসের তাল পড়ার ন্যায় ভয়ানক শিলা বৃষ্টি। ঘরের চাল ভেদ করে এই শিল মেঝেতে এসে পড়ে ঘরবাড়ি নষ্ট করতে বসেছিল বলে লেখক এমন কথা বলেছেন।
‘ভাদ্রপদ মাসে যেন পড়ে থাকা তাল।’ – কবিতায় ‘তাল’ শব্দটি কী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে? কোন্ ঘটনার প্রেক্ষিতে এই উপমা?
কবিতায় ‘তাল’ শব্দের ব্যবহার – উদ্ধৃতিটিতে কবি যে ‘তাল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, তার অর্থ- এক সুদীর্ঘ, ঋজু ও শাখাহীন গাছের ফলবিশেষ। ভাদ্রমাসে এটি সুপক্ব হয়ে গাছ থেকে খসে পড়ে।
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত – কলিঙ্গদেশে হঠাৎ ঘনিয়ে আসা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে শিলাবৃষ্টিও হয়েছিল। বড়ো বড়ো শিল ঘরের চাল ভেদ করে মেঝেতে পড়ছিল। একেই কবি আলোচ্য উপমার দ্বারা বুঝিয়েছেন। বৃহৎ সেইসব শিল ঘরের চাল ভেদ করে মেঝেতে এসে পড়ছিল, তাকে উপমিত করতেই এমন উপমা।
দেখিতে না পায় কেহ অঙ্গ আপনার। — কখন এবং কেন এরকম হয়েছিল?
মুকুন্দ চক্রবর্তীর কবিতায় কলিঙ্গদেশে ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এটা ঘটে। আকাশ হঠাৎ কালো মেঘে ঢেকে যায়। চারদিক এত অন্ধকার হয়ে যায় যে মানুষ নিজের শরীরও দেখতে পায় না।
ঈশানে উড়িল মেঘ সঘনে চিকুর। — ঈশান শব্দটির অর্থ লিখে উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
ঈশান শব্দের অর্থ উত্তর-পূর্ব দিক। কলিঙ্গদেশে ভয়ানক ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। ঈশান দিক থেকে আসা মেঘে সব জায়গা অন্ধকার হয়ে যায়। বিদ্যুতের চমক আর মেঘের শব্দে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়।
নিমিষেকে জোড়ে মেঘ গগন-মণ্ডল। — নিমিষেকে কথাটির অর্থ কী? গগনমণ্ডলে এর ফলে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হল?
নিমিষেকে মানে এক মুহূর্তে বা খুব তাড়াতাড়ি। আকাশ মুহূর্তের মধ্যে কালো মেঘে ভরে যায়। বিদ্যুতের চমক, মেঘের গর্জন আর অন্ধকারে চারিদিক আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।
চারি মেঘে বরিষে মুষলধারে জল। — মুশলধারে জলবর্ষণের কারণ কী?
কলিঙ্গদেশের আকাশ হঠাৎ ঘন কালো মেঘে ঢাকা পড়ে। অন্ধকারে মানুষ নিজেদের চিনতেও পারে না। মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের চমক শুরু হলে তারপরই মুষলধারায় বৃষ্টি নামে।
কলিঙ্গে উড়িয়া মেঘ ডাকে উচ্চনাদ। — কলিঙ্গের অবস্থান উল্লেখ করে উদ্ধৃতাংশটির ব্যাখ্যা করো।
কলিঙ্গদেশ ছিল এখনকার ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশের কিছু অংশ আর মধ্যপ্রদেশে। কবিতায় কলিঙ্গদেশে ভয়ানক বন্যার বর্ণনা আছে। আকাশ মেঘে ঢাকা পড়ে, বিদ্যুতের চমক দেখা যায় আর ভয়ানক শব্দে বৃষ্টি শুরু হয়।
প্রলয় গণিয়া প্ৰজা ভাবয়ে বিষাদ। – প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রজাদের বিষাদের কারণ আলোচনা করো।
এটা মুকুন্দ চক্রবর্তীর কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি কবিতা থেকে নেওয়া। আকাশে হঠাৎ অনেক মেঘ জমে। অন্ধকার, মেঘের গর্জন আর বৃষ্টি দেখে মানুষ ভয় পায়। তারা ভাবে বড় বন্যা আসছে, তাই তারা খুব দুঃখ পায়।
বিপাকে ভবন ছাড়ি প্রজা দিল রড়। — রড় শব্দের অর্থ কী? কোথাকার প্রজারা কী কারণে বিপাকে পড়েছিল?
রড় মানে পালানো। কলিঙ্গদেশের মানুষ বিপদে পড়েছিল। দেবী চণ্ডীর ইচ্ছায় ভয়ানক ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। অন্ধকার আর ভয়ানক শব্দে মানুষ তাদের ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়।
জলে মহী একাকার পথ হইল হারা। — কোথাকার পথ কেন হারিয়ে গিয়েছে?
কলিঙ্গদেশের পথ হারিয়ে গিয়েছিল। প্রবল বৃষ্টিতে সব জায়গা পানি তে ভরে যায়। পানি আর মাটির মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। তাই রাস্তা-ঘাট চেনা যায় না।
পরিচ্ছিন্ন নাহি সন্ধ্যা দিবস রজনী। — পরিচ্ছিন্ন শব্দের অর্থ কী? কবি এরকম বলেছেন কেন?
পরিচ্ছিন্ন মানে আলাদা করা বা পার্থক্য বোঝা। কবি বলেছেন কারণ অন্ধকার এত ঘন ছিল যে দিন আর রাতের মধ্যে কোন ফারাক থাকেনি। মানুষ বুঝতেই পারত না এখন দিন না রাত।
চারি মেঘে জল দেয় অষ্ট গজরাজ। — উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
দেবী চণ্ডীর আদেশে কলিঙ্গদেশে বড় বিপর্যয় আসে। প্রবল বৃষ্টিতে সব ডুবে যায়। কবির মনে হয় আট দিকের আট হাতি (ঐরাবত, পুণ্ডরীক ইত্যাদি) তাদের শুঁড় দিয়ে মেঘ থেকে পানি ফেলছে। তাই এত বৃষ্টি হচ্ছে।
কলিঙ্গে সোঙরে সকল লোক যে জৈমিনি। — জৈমিনি কে? কলিঙ্গবাসীর জৈমিনিকে স্মরণের কারণ কী?
জৈমিনি ছিলেন একজন ঋষি। মানুষ বিশ্বাস করত তাঁর নাম নিলে বজ্রপাত বন্ধ হয়। কলিঙ্গের মানুষ ভয়ানক ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাত আর শব্দে ভয় পেয়ে তাঁকে ডাকতে থাকে।
না পায় দেখিতে কেহ রবির কিরণ। — কারা, কেন রবির কিরণ দেখতে পায়নি?
ঝড়-বৃষ্টিতে আতঙ্কিত কলিঙ্গদেশের মানুষ সূর্যের আলো দেখতে পায়নি। কারণ সাত দিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি আর কালো মেঘে আকাশ ঢাকা ছিল। দিন-রাতেরও পার্থক্য বোঝা যাচ্ছিল না।
ভাদ্রপদ মাসে যেন পড়ে থাকা তাল। — কীসের কথা বলা হয়েছে? মন্তব্যটির প্রসঙ্গ আলোচনা করো।
বড় শিল পড়ার কথা বলা হয়েছে। ভাদ্র মাসে পাকা তাল যেমন গাছ থেকে পড়ে, তেমনই বড় বড় শিল পড়ছিল। এই শিল ঘরের চাল ভেঙে ঘর-বাড়ি নষ্ট করছিল।
চণ্ডীর আদেশে ধায় নদনদীগণ। — এর ফলে কী হয়েছে?
দেবী চণ্ডীর আদেশে কলিঙ্গের নদীগুলো ফুলে উঠল। পাহাড়ের মতো উঁচু ঢেউ এল। এই ঢেউয়ে ঘর-বাড়ি ভেসে গেল আর টলমল করতে লাগল।
কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি কবিতায় প্রকাশিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের চিত্র কতটা বাস্তবতার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে আলোচনা করো।
অথবা, কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি কবিতায় কলিঙ্গে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছিল তা কীভাবে কলিঙ্গবাসীর জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছিল বুঝিয়ে দাও।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ছবি – মুকুন্দ চক্রবর্তী রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আখেটিক খণ্ডের অন্তর্গত কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি কাব্যাংশে দেবী চণ্ডী তাঁর কৃপাধন্য ব্যাধ কালকেতুর তৈরি গুজরাট নগরে বসতি প্রতিষ্ঠার জন্য কলিঙ্গদেশে প্লাবন ঘটান। কলিঙ্গের আকাশে ঈশান কোণে মেঘ জমা হয়। ঘনঘন বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যায়। দূরদিগন্তে মেঘের গম্ভীর ধ্বনির সঙ্গে শুরু হয় মুশলধারায় বৃষ্টি। বিপদের আশঙ্কায় প্রজারা ঘর ছেড়ে দ্রুত পালাতে থাকে। ঝড়ের দাপটে সবুজ শস্যক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়। আটটি দিকের আটটি হাতি যেন বৃষ্টিধারায় সব ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। প্রবল বর্ষণে পথঘাট জলে ডুবে যায়। ঘোর অন্ধকারে দিন-রাত্রির পার্থক্য মুছে যায়। জলমগ্ন রাস্তায় সাপ ভেসে বেড়াতে থাকে। ভীত প্রজারা এই ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে নিস্তার পেতে ঋষি জৈমিনিকে স্মরণ করতে থাকে। সাত দিন ধরে অবিরাম বর্ষণের ফলে কৃষিকাজ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ঘরবাড়িও নষ্ট হয়ে যায়। ভাদ্র মাসের তালের মতো বড়ো আকারের শিল ঘরের চাল ভেদ করে পড়তে থাকে। দেবীর আদেশে সমস্ত নদনদী কলিঙ্গের দিকে ছুটে আসে। পর্বতের মতো উঁচু ঢেউয়ের আঘাতে বাড়িঘর ভেঙে পড়ে। দেবী চণ্ডীর আদেশে সৃষ্ট এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অসহায় প্রজারা শঙ্কিত হয়ে ওঠে।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের প্রথম পাঠের প্রথম অধ্যায়, ‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি’ -এর কিছু ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নবম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষায় এই ধরনের প্রশ্ন নিয়মিত আসে। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, তবে টেলিগ্রামে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমরা সর্বদা প্রস্তুত। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন