মাধ্যমিক – বাংলা – বাচ্য ও তার শ্রেণিবিভাগ

আজকে আমরা এই আর্টিকেলে বাচ্য ও তার শ্রেণিবিভাগ নিয়ে আলোচনা করব। বাচ্য বাংলা ব্যাকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাচ্যের সাহায্যে বাক্যের মধ্যে কর্তা, কর্ম ও ক্রিয়ার ভূমিকা আরও স্পষ্ট হয়। বাংলা ভাষায় সাধারণত চার প্রকার বাচ্য আছে। বাচ্য ও তার শ্রেণিবিভাগ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বাচ্য ও তার শ্রেণিবিভাগ গুলি মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে গেলে, তোমরা অবশই মাধ্যমিক পরীক্ষায় বাচ্য ও তার শ্রেণিবিভাগ সমস্ত রকম প্রশ্ন উত্তরলিখে আস্তে পারবে।

Table of Contents

ক্রিয়ার সঙ্গে কর্তার এবং ক্রিয়ার ভাবের (অথবা ক্রিয়াবিশেষ্যের) সম্পর্কজনিত বাচনভঙ্গিকে বাচ্য বলা হয়ে থাকে।

একই বাক্যের অর্থ পরিবর্তন না করেই শুধুমাত্র বাচ্য পরিবর্তন করে বদলে দেওয়া যায়। যেমন ধরো, এই বাক্যটি –

বাচ্য

ক্রিয়াকে যদি প্রশ্ন করি যে, ‘কাজটা কে করেছে?’ উত্তর হবে ‘আমি’। অর্থাৎ ক্রিয়ার (করেছি) সঙ্গে কর্তা (আমি) সরাসরি সম্পর্কিত। এই ধরনের বাক্যে তাই প্রাধান্য পায় কর্তা।

আবার ধরো বললাম,

বাচ্য

এবার দেখা যাচ্ছে কর্তার (আমার) চেয়ে ক্রিয়ার সঙ্গে কর্মের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, অর্থাৎ বাক্যের মধ্যে প্রাধান্য পাচ্ছে কর্ম।
আবার যদি বলি,

বাচ্য

তাহলে, দেখা যাচ্ছে এই বাক্যে কর্তা বা কর্ম নয়, ক্রিয়ার ভাবটাই প্রধান হয়ে উঠেছে।

উপরের এই তিনটি উদাহরণ থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে ক্রিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন পদের সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটছে। একেই বলে বাচ্য।

ব্যাকরণের ভাষায়, বাক্যের যে প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে বোঝা যায় যে, ক্রিয়ার সঙ্গে কর্তার বা কর্ম-র সম্পর্ক বা ক্রিয়ার নিজস্ব ভাবটি প্রধান হয়ে উঠছে-সেই প্রকাশভঙ্গিকেই বাচ্য বলে।

বাচ্যের শ্রেণিবিভাগ

আমাদের আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার হয় যে, প্রধানত তিন ধরনের বাচ্য হতে পারে। কিন্তু এমন বাক্যও আমরা দেখি যেখানে কর্তা থাকে না, কর্মই কর্তার জায়গা নেয়। যেমন –

গ্লাসটা ভেঙে গেল।

গ্লাস নিজে নিজে ভাঙে না, তাই গ্লাস কখনোই কর্তার ভূমিকা নিতে পারে না। কিন্তু এই বাক্যটি থেকে মনে হয় গ্লাস (যা আসলে কর্ম) এখানে কর্তার ভূমিকায় আসীন। অতএব, এইসব ধরনের বাক্যের উদাহরণগুলিকে মাথায় রেখে আমরা বাচ্যকে চার ভাগে ভাগ করতে পারি।

কর্তৃবাচ্য

যে বাচ্যে বাক্যের মধ্যে কর্তা (বা কর্তৃপদ)-ই প্রাধান্য লাভ করে এবং ক্রিয়া তার অনুগামী হয়, তাকে কর্তৃবাচ্য বলে। যেমন –

সোমনাথ দারুণ ফুটবল খেলছে।

এই বাক্যে ক্রিয়াটি (‘খেলছে’) কর্তা (‘সোমনাথ’)-এর অনুগামী এবং ‘সোমনাথ’ প্রাধান্য লাভ করেছে। এই বাচ্যে ক্রিয়া তিনরকমেরই হতে পারে – সকর্মক, দ্বিকর্মক ও অকর্মক। অকর্মক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে কর্ম না থাকায় কর্তার সঙ্গে কর্তৃকারকের বিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হয়। সকর্মক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে কর্মের সঙ্গে কর্মকারকের বিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হয়।

  • আমি কাজটা করব। (বাচ্যে সকর্মক ক্রিয়া ব্যবহৃত)
  • উৎপল দিল্লি গেছে। (বাচ্যে অকর্মক ক্রিয়া ব্যবহৃত)
  • সজলবাবু দিদিকে অঙ্ক করান। (বাচ্যে দ্বিকর্মক ক্রিয়া ব্যবহৃত)

কর্মবাচ্য

যে বাচ্যে বাক্যের মধ্যে কর্ম (বা কর্মপদ) প্রাধান্য পায় এবং ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে কর্মবাচ্য বলে। কর্তার সঙ্গে সম্বন্ধপদের বিভক্তি বা অনুসর্গ যুক্ত হয়। কর্তা উহ্যও থাকতে পারে। অকর্মক ক্রিয়ায় এই বাচ্য হয় না। যেমন –

ছাগলটি বাঘ দ্বারা (বা বাঘ-কর্তৃক) নিহত হয়েছে।

এই বাক্যটিই কর্তৃবাচ্যে হবে –

বাঘ ছাগলটিকে হত্যা করেছে।

এই কর্মবাচ্য সাধারণত বাংলায় হয় না। বাক্যটি তখন হয়ে যায় ছাগলটি বাঘের হাতে মারা পড়েছে।

কর্তৃবাচ্যেকর্মবাচ্যে
আমি কাজটা করব।কাজটা আমাকে করতে হবে।
পুলিশ চোর ধরেছে।চোর পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে।

ভাববাচ্য

যে বাচ্যে কর্তা বা কর্ম নয়, বাক্যের ক্রিয়া বা ক্রিয়ার ভাবটাই প্রধান হয়ে ওঠে, তাকে ভাববাচ্য বলে। এই ক্রিয়ার কর্তা থাকে না। কখনো-কখনো সম্বন্ধপদ কর্তার রূপ নেয়। সাধারণত যৌগিক ক্রিয়া হয় এবং সমাপিকা অংশে ‘হ’, ‘চল’, ‘পা’ ধাতু হয়। যেমন –

আপনার কোথায় যাওয়া হচ্ছে?

এই বাক্যটিই কর্তৃবাচ্যে হবে –

আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

কর্তৃবাচ্যের বাক্যে ‘আপনি’-র প্রাধান্য ভাববাচ্যে পরিবর্তিত হয়ে ‘যাওয়া’ ক্রিয়ার উপর বর্তাচ্ছে।

কর্তৃবাচ্যেভাববাচ্যে
আমি যাব।আমাকে যেতে হবে।
মহাশয় কোথায় থাকেন?মহাশয়ের কোথায় থাকা হয়?

বাংলা ব্যাকরণের ক্ষেত্রে ভাববাচ্য নানা ধরনের হতে পারে। নীচের সারণিতে ভাববাচ্যের শ্রেণিবিভাগটি দেখানো হল –

বাচ্য

এবার ভাববাচ্যের প্রতিটি বিভাগের উদাহরণগুলি একবার দেখে নেওয়া যাক –

সাধারণ ভাববাচ্যে

অকর্মক ক্রিয়ার সাধারণ ভাববাচ্যআর কতক্ষণ বসে থাকা হবে?
সকর্মক ক্রিয়ার সাধারণ ভাববাচ্যমেসি হওয়া কি সোজা কথা!
লুপ্ত কর্ম সকর্মক ক্রিয়ার সাধারণ ভাববাচ্যওর কাজ চুকল।

সম্ভাবনাবোধক ভাববাচ্যে

  • এখানে সরকারি পাঠ্যপুস্তকগুলি পাওয়া যায়।
  • এখন তাহলে ওঠা যাক।

আবশ্যকতাবোধক ভাববাচ্যে

  • আমাকে কালই কলকাতা যেতে হবে।
  • প্রয়োজন হলে করতে হবে।

কর্মকর্তৃবাচ্য

যে বাক্যবিন্যাসে কর্তা অনুপস্থিত থাকে এবং কর্মই কর্তা হিসেবে প্রতীয়মান হয়, তাকে কর্মকর্তৃবাচ্য বলে। যেমন –

বাঁশি বাজে।

সাধারণত বাঁশি নিজে নিজে বাজে না, বাঁশি বাজানো হয়। কিন্তু এই বাক্যের ক্ষেত্রে বাঁশি যে বাজাচ্ছে (অর্থাৎ কর্তা), তার উল্লেখ নেই। এখানে কর্মই সেই কর্তার স্থান পাচ্ছে। এইরকম আরও কয়েকটি বাক্য –

  • দিন কেটে যায়।
  • সময় বহিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়।
  • সভা ভেঙে গেছে।

বাচ্য পরিবর্তন

বাক্যের অর্থ পরিবর্তিত রেখে যখন এক বাচ্যের বাক্যকে অন্য বাচ্যের বাক্যে রূপান্তরিত করা হয়, তখন তাকে বাচ্য পরিবর্তন বলে। কয়েকটি বাচ্য পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত –

কর্তৃবাচ্য থেকে কর্মবাচ্যে – কর্তৃবাচ্যের কর্তাকে ‘র’ বা ‘এর’ বিভক্তিযুক্ত করতে হয় এবং প্রায়শই তার সঙ্গে ‘দ্বারা’, ‘দিয়ে’ প্রভৃতি অনুসর্গ বসাতে হয়। কর্তৃবাচ্যে যদি একটি কর্ম থাকে, তবে তা বিভক্তিশূন্য হয়ে বাক্যের উদ্দেশ্যে পরিণত হয়। দ্বিকর্মক ক্রিয়ার কর্তৃবাচ্যে গৌণকর্মের রূপ একই থাকে আর মুখ্যকর্ম বিভক্তিশূন্য হয়। কর্তৃবাচ্যের ক্রিয়ার ধাতুর সঙ্গে ‘আ’ বা ‘আনো’ বা ‘তে’ প্রত্যয় যুক্ত করে তৈরি হয় কর্মবাচ্যের যৌগিক ক্রিয়ার অসমাপিকা অংশটি। সঙ্গে থাকে ‘আছে’ বা ‘নেই’ পদ অথবা ‘হ্’ বা ‘যা’ বা ‘আছ্’ বা ‘পড়্’ ধাতুজাত সমাপিকা ক্রিয়া।

কর্তৃবাচ্যেকর্মবাচ্যে
আমি এ কাজ করতে পারব না।আমাকে দিয়ে এ কাজ হবে না।
এ জমি লইব কিনে।এ জমি কিনিয়া লওয়া হইবে।

কর্মবাচ্য থেকে কর্তৃবাচ্যে – কর্মবাচ্যের কর্মরূপী কর্তার বিভক্তি ও অনুসর্গ তুলে দিতে হয়। কর্মবাচ্যের যৌগিক ক্রিয়ার সমাপিকা অংশটি লুপ্ত হয়, অসমাপিকা ক্রিয়ার ধাতুটির সঙ্গে কর্তার পুরুষ ও বচন বিভক্তিযুক্ত করে তৈরি করতে হয় কর্তৃবাচ্যের একপদী ক্রিয়া। কর্মবাচ্যের যুক্তক্রিয়ার প্রথম পদ প্রত্যয়হীন হয় এবং সঙ্গে বসে কর্তার উপযোগী সমাপিকা ক্রিয়া।

কর্মবাচ্যেকর্তৃবাচ্যে
তোমার দ্বারা এ কাণ্ড ঘটতে পারে না।তুমি এ কাণ্ড ঘটাতে পারো না।
চোখে পড়ছে না।চোখে দেখছি না।

কর্তৃবাচ্য থেকে ভাববাচ্য – কর্তৃবাচ্যের কর্তা ভাববাচ্যে ‘র’ বা ‘এর’ বিভক্তিযুক্ত হয়। কর্তৃবাচ্যের কর্ম ভাববাচ্যে ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। তবে কর্তৃবাচ্যে কর্তা উহ্য থাকলে, তার কর্ম ভাববাচ্যে পৃথকভাবে বসে। কর্তৃবাচ্যের ক্রিয়ার ধাতুর সঙ্গে ‘আ’ বা ‘আনো’ বা ‘তে’ প্রত্যয় যুক্ত করে তৈরি হয় ভাববাচ্যের যৌগিক ক্রিয়ার অসমাপিকা অংশটি। সঙ্গে থাকে ‘আছে’ বা ‘নেই’ পদ অথবা ‘হ’ ধাতুজাত সমাপিকা ক্রিয়া। সকর্মক কর্তৃবাচ্যকে ভাববাচ্যে পরিণত করার ক্ষেত্রে ‘হ’ ধাতুর বদলে ‘যা’, ‘আছ’ বা ‘পড়্’ ধাতু ব্যবহার করা হয়।

কর্তৃবাচ্যেভাববাচ্যে
কেমন বেড়ালেন?কেমন বেড়ানো হল?
সেই বেশি চায়।তারই বেশি চাওয়া হয়।

কর্তৃবাচ্য থেকে ভাববাচ্যে রূপান্তর সাধারণত তিনভাবে হয় –

অকর্মক ক্রিয়ার ভাববাচ্য

কর্তৃবাচ্যেভাববাচ্যে
এই সন্ধ্যায় কোথায় যাচ্ছেন?এই সন্ধ্যায় কোথায় যাওয়া হচ্ছে?

লুপ্ত সকর্মক ক্রিয়ার ভাববাচ্য

কর্তৃবাচ্যেভাববাচ্যে
সকালে চা খেয়েছ তো?সকালে চা খাওয়া হয়েছে তো?

যুক্ত সকর্মক ক্রিয়ার ভাববাচ্য

কর্তৃবাচ্যেভাববাচ্যে
কাল থেকেই সে আনন্দ করছে।কাল থেকেই তার আনন্দ করা হচ্ছে।

ভাববাচ্য থেকে কর্তৃবাচ্য – ভাববাচ্যের কর্তা থেকে বিভক্তি লুপ্ত হবে। ভাববাচ্যে ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কর্মকে পৃথক করতে হয়। ভাববাচ্যের স্বাধীন কর্ম কর্তৃবাচ্যে অপরিবর্তিত থাকে। কর্মবাচ্যের মতোই ভাববাচ্যের যৌগিক ক্রিয়ার সমাপিকা অংশটি কর্তৃবাচ্যে লুপ্ত হয়। ভাববাচ্যের যুক্তক্রিয়ার প্রথম পদ প্রত্যয়হীন হয় এবং সঙ্গে বসে কর্তার উপযোগী সমাপিকা ক্রিয়া।

ভাববাচ্যেকর্তৃবাচ্যে
আমার আজ যাওয়া হল না।আমি আজ যাচ্ছি না।
আচ্ছা, সে দেখা যাবে।আচ্ছা, সে দেখব।

বাচ্যের প্রথাগত শ্রেণিবিভাগের সমস্যা ও বিকল্প শ্রেণিবিভাগ

আমরা আগে জেনেছি যে একটি বাক্যে যেমন একটি ক্রিয়া থাকে, তেমনই থাকে একটি কর্তা, যে ক্রিয়াটি সম্পাদন করে বা কাজ করে। একটি উদাহরণ দিই –

বাচ্য

অর্থাৎ ‘যাওয়া’ কাজটি ‘সে’ করে। তাই ‘সে’ কর্তা আর ‘যায়’ ক্রিয়া। এই বাক্যের কর্তার চেহারাটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু বাংলায় এমন অনেক বাক্য আমরা ব্যবহার করি, যেখানে ‘কর্তা’ অংশটি বেশ গোলমেলে। যেমন –

গল্পের বইটা এবার পড়া যাক।

যদি প্রশ্ন করি, এই বাক্যের কর্তা কে? এই প্রশ্ন অবশ্যই ক্রিয়া (পড়া যাক)-কেই করতে হবে। অর্থাৎ গল্পের বইটা কে পড়বে? এর উত্তর স্পষ্ট নয়। যদি ধরি, কথক নিজেই পড়ার কথা বলছে, তাহলে ‘আমি’ বা ‘আমার’ বসালে, আমরা পাব ‘আমি গল্পের বইটা এবার পড়া যাক।’ অথবা, ‘আমার গল্পের বইটা এবার পড়া যাক।’ বাক্যটা অদ্ভুত হয়ে যায়। অর্থাৎ এই বাক্যে ক্রিয়া সম্পাদনকারী পদ কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যভাবে বলতে পারি, ঘটনাটা যে/যিনি ঘটাচ্ছে/ঘটাচ্ছেন, যাকে বলা যেতে পারে ‘ঘটক’ (agent) সেই agent এখানে অনুপস্থিত। তাহলে এই বাক্যে কি কর্তা নেই? আছে।

বাচ্য

আর-এক ধরনের একটি বাক্য হল –

কৌশিককে এবার বিদেশ যেতে হবে।

সাধারণত ক্রিয়াকে যদি ‘কাকে’ দিয়ে প্রশ্ন করা হয় তাহলে কর্ম (গৌণ) পাওয়া যায়। যেমন, ‘আমি রাজাকে বললাম’-বাক্যে কর্ম হল ‘রাজাকে’ আর কর্মের চিহ্ন হল ‘কে’। কিন্তু উপরের বাক্যে যদি ক্রিয়া সম্পাদনকারী বা ঘটক বা agent খুঁজি, তবে ‘কৌশিককে’ পদটি পাব। বাস্তবে তাহলে agent হল ‘কৌশিককে’, কিন্তু তা বহন করছে কর্মের চিহ্ন ‘কে’। তাহলে কর্তা কী হবে?

বাচ্য

আর-একটা বাক্য নেওয়া যাক –

অভীকের আজ যাওয়া হবে না।

এই বাক্যে ক্রিয়াসম্পাদনকারী agent-এর সঙ্গে জুড়ে আছে ‘এর’ বিভক্তি। অর্থের দিক থেকে কর্তা বা agent হল ‘অভীকের’; কিন্তু ব্যাকরণে তা সম্বন্ধ পদ।

বাচ্য

তাহলে এবার উদাহরণ হিসেবে নেওয়া বিভিন্ন বাক্যের মধ্যে থেকে একটি বিকল্প শ্রেণিবিভাগ প্রস্তুত করা যাক –

বাচ্য

এক নজরে

  • ক্রিয়ার সঙ্গে কর্তার বা কর্মের সম্পর্কের প্রাধান্যের ভিত্তিতে বাচ্য নির্ধারণ করা হয়।
  • বাচ্য চার প্রকার – কর্তৃবাচ্য, কর্মবাচ্য, ভাববাচ্য এবং কর্মকর্তৃবাচ্য।
  • কর্তৃবাচ্যে বাক্যের মধ্যে কর্তৃপদ প্রধানভাবে প্রতীয়মান হয়।
  • কর্মবাচ্যে বাক্যের মধ্যে কর্মপদ প্রধানভাবে প্রতীয়মান হয়।
  • ভাববাচ্যে বাক্যের মধ্যে ক্রিয়ার ভাবটাই প্রধান হয়।
  • বাচ্য পরিবর্তনের সময় বাক্যের অর্থ যেন সম্পূর্ণভাবে অপরিবর্তিত থাকে।
  • বাচ্যে ক্রিয়া তিন প্রকার হতে পারে – অকর্মক, সকর্মক ও দ্বিকর্মক।
  • দ্বিকর্মক ক্রিয়ার দুটি কর্ম থাকে – মুখ্য এবং গৌণ।

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

কর্তৃবাচ্যে অকর্মক ক্রিয়ার ব্যবহার হয়েছে এমন একটি উদাহরণ দাও।

কর্তৃবাচ্যে অকর্মক ক্রিয়ার ব্যবহার হয়েছে এমন একটি উদাহরণ – তুমি হাজারবার বললেও আমি ও বাড়িতে আর যাব না।

ভাববাচ্যকে ক-টি ভাগে ভাগ করা যায়? প্রত্যেকটি ভাগের নাম লেখো।

ভাববাচ্যকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় – সাধারণ ভাববাচ্য, সম্ভাবনাবোধক ভাববাচ্য ও আবশ্যকতাবোধক ভাববাচ্য।

যুক্ত সকর্মক ক্রিয়ার ভাববাচ্যকে কীভাবে কর্তৃবাচ্যে রূপান্তরিত করা যায়, তার একটি উদাহরণ দাও।

যুক্ত সকর্মক ক্রিয়ার ভাববাচ্য – আজ আমার পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। কর্তৃবাচ্য – আজ আমি পরীক্ষা দেওয়া শুরু করেছি।

কীসের ভিত্তিতে বাচ্য নির্ধারণ করা হয়?

কর্তা বা ক্রিয়ার সঙ্গে কর্ম বা ক্রিয়ার নিজস্ব ভাবের সম্পর্কের ভিত্তিতে বাচ্য নির্ধারণ করা হয়।

কর্তাহীন ভাববাচ্যের একটি উদাহরণ দাও।

কর্তাহীন ভাববাচ্যের একটি উদাহরণ – কোথায় যে যাওয়া হবে জানা নেই।

অসম্পাদক-কর্তা কর্তৃবাচ্যের একটি উদাহরণ দাও।

অসম্পাদক-কর্তা কর্তৃবাচ্যের উদাহরণ – গ্লাসটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।

গৌণকর্ম-কর্তা ভাববাচ্যের একটি উদাহরণ দাও।

গৌণকর্ম-কর্তা ভাববাচ্যের উদাহরণ – আমাকে এবার উঠে পড়তে হবে।

সম্বন্ধকর্তা ভাববাচ্যের একটি উদহারণ দাও।

শ্যামলের বুঝি আর ম্যাচ দেখা হল না।

কর্মকর্তৃবাচ্য কী? উদাহরণ দাও।

যে বাক্যবিন্যাসে কর্তা অনুপস্থিত থাকে এবং কর্মই কর্তা হিসেবে প্রতীয়মান হয়, তাকে কর্মকর্তৃবাচ্য বলে। উদাহরণ – বাঁশি বাজে।

ঘটক কর্তৃবাচ্য কাকে বলে?

সাধারণভাবে, কর্তাপ্রধান যেসমস্ত কর্তৃবাচ্য (অর্থাৎ কর্মকর্তৃবাচ্য নয়) তাদেরকেই ঘটক কর্তৃবাচ্য বলা হয়।

কোথায় থাকেন? – ভাববাচ্যে পরিবর্তন করো।

কোথায় থাকা হয়?

গুন্ডারা হঠাৎ লোকটিকে আক্রমণ করল। কর্মবাচ্যে রূপান্তর করো।

গুন্ডাদের দ্বারা লোকটি হঠাৎ আক্রান্ত হল।

নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত। (বাক্যটি ভাববাচ্যে লেখো)

নতুন সৃষ্টিকে বারবার বিধ্বস্ত করা হচ্ছিল।

এখন আপনার কি খাওয়া হবে? – বাক্যটি কোন্ বাচ্যের উদাহরণ?

বাক্যটি কর্মবাচ্যের উদাহরণ।

একটি অকর্মক ক্রিয়ার ভাববাচ্যের উদাহরণ দাও।

আপনার দ্রুত এখানে আসা হোক।

লুপ্ত কর্তাবাচক একটি ভাববাচ্যের উদাহরণ দাও।

এরকম গান শুনলে মন ভরে ওঠে।

কর্তৃবাচ্য থেকে কর্মবাচ্যে রূপান্তরের একটি নিয়ম লেখো।

কর্তৃবাচ্যের কর্তাকে কর্মবাচ্যে রূপান্তরের সময় তার সঙ্গে ‘র’, ‘এর’ বিভক্তি যুক্ত করতে হয় এবং তার সঙ্গে ‘দ্বারা’, ‘দিয়ে’ প্রভৃতি অনুসর্গ যুক্ত করতে হয়।

কোন্ বাচ্যের রূপান্তর সম্ভব নয়?

কর্মকর্তৃবাচ্যের রূপান্তর সম্ভব নয়।

কর্মকর্তৃবাচ্য কাকে বলে?

যে বাচ্যে কর্তা অনুপস্থিত থাকে এবং কর্মই কর্তারূপে প্রতীয়মান হয় তাকে কর্মকর্তৃবাচ্য বলে।

বুড়ো মানুষের কথাটা শুনো।- কর্মবাচ্যে পরিণত করো।

বুড়ো মানুষের কথাটা শ্রুত হোক।

কর্তৃবাচ্য কাকে বলে?

যে বাচ্যে কর্তা প্রধান হয় এবং ক্রিয়া কর্তার অনুগামী হয় তাকে কর্তৃবাচ্য বলে।

তারা আর স্বপ্ন দেখতে পারল না। — ভাববাচ্যে পরিবর্তন করো।

তাদের আর স্বপ্ন দেখা হল না।

নীচের বাচ্যগুলি নির্দেশ অনুসারে পরিবর্তন।

প্রশ্নউত্তর
জানোয়ার নিজে নিজে মরতে পারে না। (ভাববাচ্যে)জানোয়ারের নিজে নিজে মরা হয় না।
এখানে সব পাওয়া যায়। (ভাববাচ্যে)এখানে সবেরই পাওয়া হয়।
সকালে ব্যায়াম করা হয়েছে তো? (কর্তৃবাচ্যে)সকালে ব্যায়াম করেছ তো?
এই কথাটা প্রতিদিনই মনে জাগত। (কর্তৃবাচ্যে)আমি এই কথাটা প্রতিদিনই ভাবতাম।
পড়ে থাকা হিমসাগর আম কুড়িয়েছে। (কর্মবাচ্যে)(তাদের দ্বারা) পড়ে থাকা হিমসাগর আম কুড়ানো হয়েছে।
স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থাণুর ললাটে। (কর্মবাচ্যে)বিধি দ্বারা বিধু স্থাণুর ললাটে স্থাপিত হইল।
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি। (কর্মবাচ্যে)আমার দ্বারা বাংলার মুখ দেখা হয়েছে।
শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে। (কর্তৃবাচ্যে)শটিবনে তাহারা ছায়া ফেলিয়াছে।
গল্পটা সবাই জানে। (ভাববাচ্যে)গল্পটা সবার জানা আছে।
তারপর তাদের নজরে পড়ল। (কর্তৃবাচ্যে)তারপর তারা নজর করল।
ভাবতেই ওর কষ্ট হল। (কর্তৃবাচ্যে)ও ভেবেই কষ্ট পেল।
স্বর্গে তাঁরা মেটান তৃষা। (কর্মবাচ্যে)স্বর্গে তাঁদের দ্বারা তৃষা মেটানো হয়।
তাহা রামায়ণে পড়িয়াছিলাম। (কর্মবাচ্যে)তাহা (আমার দ্বারা) রামায়ণে পঠিত হইয়াছিল।
মাটিতে বসে কপালে করাঘাত করতে লাগল। (কর্মবাচ্যে)মাটিতে বসে (তার দ্বারা) কপালে করাঘাত করা হতে লাগল।
কোথাও যেন হাজারটা জয়ঢাক একসঙ্গে বাজছে। (ভাববাচ্যে)কোথাও যেন হাজারটা জয়ঢাকের একসঙ্গে বেজে ওঠা হচ্ছে।
আপনার পরিচর্যায় নিয়োজিত হইবে। (কর্তৃবাচ্যে)আপনি পরিচর্যা পাবেন।
কোথায় যাচ্ছেন বলে গেলেন না? (ভাববাচ্যে)কোথায় যাওয়া হচ্ছে বলে যাওয়া হল না?
আমি একাজ করতে পারব না। (কর্মবাচ্যে) আমাকে দিয়ে এ কাজ করাতে পারা যাবে না।
ওর একবছর জেল হয়েছিল। (কর্তৃবাচ্যে)ও একবছর জেল খেটেছিল।
তোমরা সবাই এখনই বেরিয়ে যাও। (ভাববাচ্যে) তোমাদের সবার এখনই বেরিয়ে যাওয়া হোক।
আর কতক্ষণ এভাবে থাকা যায়? (কর্তৃবাচ্যে) আর কতক্ষণ এভাবে থাকব?
আপনি বুঝি এবারে বাজারে চললেন? (ভাববাচ্যে)আপনার বুঝি এবারে বাজারে যাওয়া হচ্ছে?
যে একাজ করেছে, সে মজাটি টের পাবে। (কর্মবাচ্যে)যাকে দিয়ে একাজ হয়েছে, তাকে মজাটি টের পাওয়ানো হবে।
আমি কাউকে চিনি না। (ভাববাচ্যে)আমার চেনা কেউ নেই।
এসো যুগান্তের কবি। (ভাববাচ্যে)যুগান্তের কবি (তোমার) আসা হোক।

বাচ্য হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাকরণিক ধারণা যা বাক্যে কর্তা, কর্ম ও ক্রিয়ার ভূমিকা স্পষ্ট করে। বাংলা ভাষায় চার প্রকার বাচ্য প্রচলিত: ক্রিয়াপদ, কর্ম, ক্রিয়াপদ-কর্ম এবং অকর্ম। এই আর্টিকেলে আমরা বাচ্যের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ এবং মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য এর গুরুত্ব বিষয়ে আলোচনা করেছি।

ক্রিয়াপদ বাচ্যে ক্রিয়াপদই বাক্যের মূল ভাব প্রকাশ করে। কর্ম বাচ্যে কর্ম বাক্যের মূল ভাব প্রকাশ করে। ক্রিয়াপদ-কর্ম বাচ্যে ক্রিয়াপদ ও কর্ম উভয়ই বাক্যের মূল ভাব প্রকাশ করে। অকর্ম বাচ্যে ক্রিয়াপদ কোনো কর্মের উপর ক্রিয়া করে না।

মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য বাচ্য ও তার শ্রেণিবিভাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই অধ্যায় থেকে নিয়মিত প্রশ্ন আসে। তাই এই অধ্যায়টি ভালোভাবে জানা পরীক্ষায় ভালো করার জন্য অপরিহার্য।

এই আর্টিকেলটি আপনাদের বাচ্য ও তার শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে সহায়ক হবে।

Share via:

মন্তব্য করুন