আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ইতিহাসের তৃতীয় অধ্যায় উনবিংশ শতকের ইউরোপ : রাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সংঘাত অধ্যায়ের প্রশ্ন কিছু ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়।
ভিয়েনা সম্মেলন (1815 খ্রি., Congress of Vienna) সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, ভিয়েনা সম্মেলন বলতে কী বোঝায়? এই সম্মেলনে কারা যোগদান করেছিলেন? ভিয়েনা সম্মেলনের উদ্দেশ্য কী ছিল?
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ফ্রান্সের ক্ষমতা দখল করার পর একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি একের পর এক যুদ্ধে জয়লাভ করে ইউরোপের রাজনৈতিক মানচিত্র ওলট-পালট করে দিয়েছিলেন। এই পরিবর্তন ইউরোপের রাজারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তাই নেপোলিয়নের পতনের পর 1815 খ্রিস্টাব্দে তাঁরা ইউরোপীয় রাজ্যগুলির পুনর্গঠন, পুনর্বিন্যাস এবং সেখানে উদ্ভূত নানা সমস্যার সমাধানের জন্য অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে সমবেত হন। একে ভিয়েনা সম্মেলন বলা হয়।
ভিয়েনা সম্মেলনে যোগদানকারী
পোপ ও তুরস্কের সুলতান ছাড়া ইউরোপের সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা ভিয়েনা সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজা, রাজনীতিক এবং সাংবাদিকদের উপস্থিতির ফলে ভিয়েনা সম্মেলন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পরিণত হয়েছিল।
এই সম্মেলনে যোগদানকারী ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন –
1. সমসাময়িক প্রধান তিন রাজা –
- প্রথম ফ্রান্সিস (Francis I), অস্ট্রিয়া
- প্রথম আলেকজান্ডার (Alexander I), রাশিয়া
- তৃতীয় ফ্রেডরিক উইলিয়াম (Frederick William III), প্রাশিয়া
2. উপস্থিত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি, মন্ত্রী-কূটনীতিক –
- অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স ক্লেমেন্স ভন মেটারনিখ (Prince Klemens von Metternich)
- ইংল্যান্ডের রাজপ্রতিনিধি ডিউক অফ ওয়েলিংটন (Duke of Wellington)
- ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাসালরি (Castlereagh)
- প্রাশিয়ার মন্ত্রী হার্ডেনবার্গ (Hardenberg)
- রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নেসেলরোড (Nesselrode)
- ফ্রান্সের প্রতিনিধি টেলির্যান্ড (Talleyrand)
3. চার প্রধান (Big Four) –
ভিয়েনা সম্মেলনে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকলেও নেপোলিয়নের পতনে বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণকারী চারটি রাষ্ট্র ছিল প্রধান। এগুলি হল –
- অস্ট্রিয়া
- রাশিয়া
- ইংল্যান্ড
- প্রাশিয়া
ভিয়েনা সম্মেলনে এই চারটি শক্তি চার প্রধান বা Big Four নামে পরিচিত।
4. প্রধান ব্যক্তিত্ব
সম্মেলনে যোগদানকারী প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন –
- অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মেটারনিখ (Prince Metternich)
- রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার (Tsar Alexander I)
- ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ক্যাসালরি (Robert Castlereagh)
- পরাজিত ফ্রান্সের প্রতিনিধি টেলির্যান্ড (Talleyrand)
5. সম্মেলনের সভাপতি
ভিয়েনা সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স ক্লেমেন্স ভন মেটারনিখ। তিনি ছিলেন এই সম্মেলনের সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও মূল নিয়ন্ত্রক। তিনি নিজেকে বিজয়ীর বিজয়ী (Conqueror of Conquerors) বলে মনে করতেন।
ভিয়েনা সম্মেলনের সমস্যা
ভিয়েনা সম্মেলনের প্রতিনিধিদের সামনে অনেক সমস্যা ছিল। যেমন –
- নেপোলিয়নের আগ্রাসনের ফলে ইউরোপে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছিল তার পুনর্গঠন করা।
- ফ্রান্স পুনরায় যাতে ইউরোপের শান্তি বিঘ্নিত করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা।
- নেপোলিয়ন কর্তৃক বিতাড়িত রাজবংশগুলির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
- পোল্যান্ড, ইটালি, জার্মানি, ব্যাভারিয়া, স্যাক্সনি, রাইন অঞ্চল প্রভৃতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা।
ভিয়েনা সম্মেলনের উদ্দেশ্য
1. ভিয়েনা সম্মেলনের ঘোষিত উদ্দেশ্য –
ভিয়েনা সম্মেলনে ঘোষিত উদ্দেশ্যগুলি ছিল –
- ইউরোপে নিরবচ্ছিন্ন স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা।
- ন্যায় ও সতত ভিত্তিতে ইউরোপের পুনর্গঠন।
- রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপন।
2. ভিয়েনা সম্মেলনের প্রকৃত উদ্দেশ্য –
ভিয়েনা সম্মেলনে উচ্চ আদর্শের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হলেও সম্মেলনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল –
- ফরাসি বিপ্লবে উদারনৈতিক ভাবধারা দমন করে ইউরোপে পুরাতনতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
- নেপোলিয়নকে পরাজিত করতে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল আত্মসাৎ করা।
ভিয়েনা সম্মেলনের মূল নীতি
ভিয়েনা সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ ইউরোপের পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে তিনটি মূল নীতি গ্রহণ করেছিলেন –
- ন্যায্য অধিকার নীতি
- ক্ষতিপূরণ নীতি
- শক্তিসাম্য নীতি
মূল্যায়ন
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে ভিয়েনা সম্মেলন একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হলেও তা বিভিন্নভাবে সমালোচিতও হয়েছে। তবে নানা ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও এর গুরুত্বকে স্বীকার করতেই হয়। ঐতিহাসিক ডেভিড থমসন (David Thomson) বলেছেন যে, ভিয়েনা সম্মেলন পরবর্তী প্রায় 40 বছর ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল।
ভিয়েনা সম্মেলনের (1815 খ্রি., Congress of Vienna) কার্যকাল সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত ন্যায্য অধিকার, ক্ষতিপূরণ ও শক্তিসাম্য নীতি সম্পর্কে আলোচনা করো। এই নীতিগুলি কি ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ বজায় রেখেছিল?
নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপীয় শক্তিবর্গ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা শহরে এক সম্মেলনে সমবেত হন। এই সম্মেলন চলেছিল 1814 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর থেকে 1815 খ্রিস্টাব্দের জুন মাস পর্যন্ত। একে ভিয়েনা সম্মেলন বলা হয়। পোপ ও তুরস্কের সুলতান ছাড়া ইউরোপের সব দেশের রাষ্ট্রনেতারা সম্মেলনে যোগ দেন। এই সম্মেলন ছিল ইউরোপ তথা বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত নীতি
ভিয়েনা সম্মেলনে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর তিনটি নীতি গ্রহণ করা হয়। এই তিনটি নীতি হল –
- ন্যায্য অধিকার নীতি (Principle of Legitimacy)
- ক্ষতিপূরণ নীতি (Principle of Compensation)
- শক্তিসাম্য নীতি (Principle of Balance of Power)
এই নীতিগুলির উপর ভিত্তি করে সম্মেলনের কার্যকলাপ পরিচালিত হয়।
ন্যায্য অধিকার নীতি (Principle of Legitimacy)
ন্যায্য অধিকার নীতিতে বলা হয়, ফরাসি বিপ্লবের আগে যে রাজা বা রাজবংশ যে দেশে রাজত্ব করতেন, সেখানে সেই রাজার বা রাজবংশের আবার রাজত্ব করার অধিকার আছে। এই নীতি অনুসারে –
- ফ্রান্সে বুরবোঁ বংশের শাসক অষ্টাদশ লুই সিংহাসনে বসেন।
- স্পেন, সিসিলি ও নেপলসেও বুরবোঁ বংশের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
- হল্যান্ডে অরেঞ্জ বংশ এবং স্যাভয়, জেনোয়া, পিডমন্ট ও সার্ডিনিয়ায় স্যাভয় বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
ক্ষতিপূরণ নীতি (Principle of Compensation)
নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভিয়েনা সম্মেলনে তারা নিজেদের ক্ষতিপূরণ করে নেওয়ার জন্য যে নীতি গ্রহণ করেছিল, তা ক্ষতিপূরণ নীতি নামে পরিচিত।
যেসব দেশ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেগুলি হল — ইংল্যান্ড, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, সুইডেন প্রভৃতি। ক্ষতিপূরণ নীতি অনুসারে এই দেশগুলি যেভাবে উপকৃত হয়, তা নিম্নরূপ —
অস্ট্রিয়া – অস্ট্রিয়া উত্তর ইতালিতে পায় লম্বার্ডি, ভেনিসিয়া, টাইরল প্রভৃতি প্রদেশ। মধ্য ইতালিতে পার্মা, মডেনা ও টাসকানির উপর অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ বংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অস্ট্রিয়া নবগঠিত জার্মান কনফেডারেশনের সভাপতির পদ লাভ করে।
রাশিয়া – রাশিয়া পায় পোল্যান্ডের বৃহদংশ, ফিনল্যান্ড ও তুরস্কের বেসারাভিয়া।
প্রাশিয়া – প্রাশিয়া পায় স্যাক্সনির উত্তরাংশ, পোজেন, থর্ন, ডানজিগ, পশ্চিম পোমেরানিয়া ও রাইন নদীর বাম তীরবর্তী অঞ্চল।
ইংল্যান্ড – ইংল্যান্ড ঔপনিবেশিক স্বার্থে ক্ষতিপূরণ হিসেবে নেয় ভূমধ্যসাগরের মাল্টা দ্বীপ, মরিশাস, হেলিগোল্যান্ড, সিংহল প্রভৃতি।
শক্তিসাম্য নীতি (Principle of Balance of Power)
ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত শক্তিসাম্য নীতি বলতে বোঝায় ফ্রান্সের শক্তি খর্ব করে সমতা তৈরি করা, ফ্রান্স যাতে শক্তিশালী হয়ে ইউরোপের শান্তি বিঘ্নিত করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। এই নীতি অনুসারে —
- ফ্রান্সকে বিপ্লব পূর্ববর্তী সীমানায় ফিরিয়ে আনা হয়।
- ফ্রান্সের সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়। 5 বছরের জন্য ফ্রান্সে মিত্রপক্ষের সেনা মোতায়েন রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
- মিত্রপক্ষের এই সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার ফ্রান্সকে বহন করতে হয়।
- মিত্রপক্ষকে 70 কোটি ফ্রাঙ্ক ক্ষতিপূরণ দিতে ফ্রান্সকে বাধ্য করা হয়।
ফ্রান্সের চারপাশে শক্তিশালী রাষ্ট্রবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়।
- ফ্রান্সের পূর্বসীমান্তে রাইন অঞ্চলকে প্রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
- ফ্রান্সের উত্তর-পূর্বে লুক্সেমবুর্গ ও বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
- ফ্রান্সের দক্ষিণে স্যাভয় ও জেনোয়াকে সার্ডিনিয়ার সঙ্গে এবং
- ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে কয়েকটি অঞ্চল যুক্ত করা হয়। সুইজারল্যান্ডকে নিরপেক্ষ দেশ বলে ঘোষণা করা হয়।
ভিয়েনা সম্মেলনের নীতি ও ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ
ভিয়েনা সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ ন্যায্য অধিকার ও ক্ষতিপূরণ নীতি প্রয়োগ করে ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত জাতীয়তাবাদের চরম অবমাননা করেছিলেন। জার্মানি ও ইতালির রাজ্যগুলিকে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় রাষ্ট্রে পরিণত না করে পুনরায় স্বৈরতন্ত্রী অস্ট্রিয়া বা প্রাশিয়ার অধীনে স্থাপন করা হয়েছিল। এ ছাড়া শক্তিসাম্য নীতিকে কার্যকর করতে গিয়ে সম্মেলনের আয়োজকরা ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত ভাবাদর্শকে বিসর্জন দিয়েছিলেন।
মেটারনিখ ব্যবস্থা (Metternich System) বলতে কী বোঝো? এই ব্যবস্থা কেন ব্যর্থ হয়েছিল?
মেটারনিখ ব্যবস্থা (Metternich System)
1815-48 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখ। উদারতন্ত্র, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের প্রবল বিরোধী এবং রক্ষণশীলতার সমর্থক মেটারনিখ চেয়েছিলেন ফরাসি বিপ্লব-পূর্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করতে এবং অস্ট্রিয়ার স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে ইউরোপের রাজনীতিতে তার একাধিপত্য বজায় রাখতে। এই স্বার্থগুলিকে বাস্তবে রূপায়িত করতে মেটারনিখ তাঁর দেশ অস্ট্রিয়া তথা ইউরোপে তাঁর মতবাদকে যেভাবে প্রয়োগ করেন, তাকেই মেটারনিখ ব্যবস্থা বলা হয়।
অস্ট্রিয়ার মেটারনিখ ব্যবস্থা
ফরাসি বিপ্লবের প্রতি ছিল মেটারনিখের সীমাহীন ঘৃণা। তাঁর বিশ্বাস ছিল – বিপ্লবের জীবাণু সমগ্র ইউরোপের স্বাস্থ্যহানি ঘটাবে। তিনি মনে করতেন, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বহু জাতি অধ্যুষিত অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেবে। বিপ্লবী ভাবধারা যাতে অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বহু জাতিগোষ্ঠীর ও ভাষাভাষী মানুষের দেশ অস্ট্রিয়ায় তিনি বিভেদনীতির আশ্রয় নেন। অস্ট্রিয়ায় সকল প্রকার সংস্কার ও বিপ্লবী ভাবধারা নিষিদ্ধ করা হয়। ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীন ও যুক্তিবাদী শিক্ষার প্রসার যাতে না ঘটে সেদিকে লক্ষ রাখা হয়, ছাত্র ও অধ্যাপকদের গতিবিধির উপর নজরদারি করা হয়। 1819 খ্রিস্টাব্দে কার্লসবার্ড ডিক্রি জারি করে রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ করা হয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়।
মেটারনিখ জার্মানিকে 39টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত করে একটি রাষ্ট্রমণ্ডল গড়ে তোলেন। সেই রাষ্ট্রমণ্ডলের সভাপতির আসনে বসান অস্ট্রিয়াকে। জার্মানিতে তিনি রক্ষণশীল নীতি প্রবর্তন করেন।
ইউরোপে মেটারনিখতন্ত্র
প্রাক-বিপ্লব অবস্থা ও রক্ষণশীলতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় শক্তি সমবায় গঠিত হয়। এই সমবায়ের কাজ ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করা। 1820 খ্রিস্টাব্দে ট্রপাউ বৈঠকে বলা হয় যে, কোনো দেশে বিপ্লব ঘটলে শক্তি সমবায় সেখানে হস্তক্ষেপ করে স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনবে। এই ঘোষণা অনুসারে ইতালির নেপলস ও পিডমন্টের প্রজাবিদ্রোহ, ফ্রান্স ও স্পেনের উদারনৈতিক আন্দোলন দমন করা হয়। জুলাই বিপ্লবের ফলে ইতালির পার্মা, মডেনা ও পোপের রাজ্যে গণ আন্দোলন দেখা দেয়। গ্রিসের স্বাধীনতা সংগ্রামে রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার সাহায্য করতে অগ্রসর হলে মেটারনিখ তাঁকে নিবৃত্ত করেন।
মেটারনিখের সমর্থনে বলা যায়, ফরাসি বিপ্লবের সময় হিংসার আতিশয্য ও নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ক্রমাগত যুদ্ধে ইউরোপ যখন শান্তি কামনা করছিল, মেটারনিখ তখন পুরাতনতন্ত্র কায়েম করে সুদীর্ঘ 40 বছর ইউরোপে শান্তির পরিবেশ বজায় রেখেছিলেন।
মেটারনিখতন্ত্রের ব্যর্থতার কারণ
1815 থেকে 1822 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপের সর্বত্র মেটারনিখের আধিপত্য বজায় ছিল। কিন্তু 1830 থেকে 1848 খ্রিস্টাব্দ সময়কালে মেটারনিখ পদ্ধতি দ্রুত শিথিল হতে থাকে। নানা কারণে মেটারনিখতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল –
- অতিরিক্ত রক্ষণশীলতা এবং সমকালীন যুগের ভাবধারাকে অস্বীকার করার ফলে এই ব্যবস্থা সফলতা পায়নি।
- মেটারনিখ পদ্ধতি ছিল নেতিবাচক, সুবিধাবাদী ও দমনমূলক।
- ফরাসি বিপ্লবের ধ্বংসাত্মক দিকের প্রতি মেটারনিখের দৃষ্টি পড়েছিল। বিপ্লবের গঠনমূলক দিকগুলি তিনি দেখতে পাননি।
- মেটারনিখ পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইউরোপের সব দেশ সহযোগিতা করেনি। বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করতে না পারাই তাই প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিফলতার প্রধান কারণ হয়ে ওঠে।
ইউরোপে মেটারনিখ ব্যবস্থার প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো।
ইউরোপের ইতিহাসে 1815-1848 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল মেটারনিখের যুগ নামে পরিচিত। ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার আদর্শের চরম বিরোধী মেটারনিখ সমস্ত রকমের উদারনৈতিক সংস্কারমূলক চিন্তাধারাকে অবদমিত করার মনোভাব নিয়ে অস্ট্রিয়া এবং ইউরোপের সর্বত্র মেটারনিখতন্ত্রকে কায়েম করতে উদ্যত হন।
অস্ট্রিয়ায় মেটারনিখ পদ্ধতির প্রয়োগ –
বিভিন্ন ভাষা, জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সংবলিত দেশ অস্ট্রিয়ার ঐক্য বজায় রাখার জন্য উদারনৈতিক গণতন্ত্র অপেক্ষা প্রতিক্রিয়াশীল পুরাতনতন্ত্রই বেশি কার্যকর। তাই অস্ট্রিয়ায় যাতে ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত ভাবধারা না প্রবেশ করতে পারে সেই জন্য উদারপন্থী ছাত্র ও অধ্যাপকদের কারারুদ্ধ করার ব্যবস্থা হয়; অস্ট্রিয়ায় ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো বিষয় পড়ানো বা আলোচনা নিষিদ্ধ হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে ক্যাথলিক গির্জার প্রাধান্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়।
প্রতিক্রিয়া –
মেটারনিখতন্ত্রের অভিঘাতে ফ্রান্সে 1848 খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় ফেব্রুয়ারি বিপ্লব। সমগ্র ফ্রান্সের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপে এর প্রভাব পড়ে। অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের অধীন হাঙ্গেরিতে জাতীয়তাবাদী নেতা লুই কোশুতের নেতৃত্বে ব্যাপক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দরুন হাঙ্গেরি স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। একইভাবে বোহেমিয়াতেও চেক জাতি আন্দোলনে সাফল্য লাভ করে। শেষ পর্যন্ত 1848-এর 13 মার্চ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে সর্বসাধারণের তীব্র গণ আন্দোলনের দরুন মেটারনিখ পদত্যাগ করে ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান। ফলে মেটারনিখতন্ত্রের পতন ঘটে।
ফ্রান্সে মেটারনিখতন্ত্রের প্রভাব –
ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত ন্যায্য অধিকার নীতি অনুসারে ফ্রান্সে বুরবো রাজবংশের শাসন ফিরে আসে। পুরাতন্ত্রে বিশ্বাসী দশম চার্লসের আমলে মন্ত্রী পলিগন্যাক এমন কিছু সংস্কারবিমুখ বিপ্লবী ভাবাদর্শবিরোধী সিদ্ধান্ত কার্যকর করার চেষ্টা করেন যে, তার পরিণতিতে সমগ্র ফ্রান্স 1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে এই প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। স্বৈরাচারী রাজবংশ বিদায় নিয়ে অলিয়েভ বংশের রাজা লুই ফিলিপ সিংহাসনে বসেন। লুই ফিলিপ এক মধ্যপন্থা মেনে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও তার এই মধ্যপন্থী নীতি ফ্রান্সবাসীদের মধ্যে অসন্তোষের বাতাবরণ সৃষ্টি করে। ফলত 1848 খ্রিস্টাব্দের 23 ফেব্রুয়ারি শুরু হয় সশস্ত্র বিপ্লব। ফ্রান্সে রাজতান্ত্রিক ভাবধারার অবসান ঘটে। এর অভিঘাত ছড়িয়ে পড়ে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ইতালি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে যা মেটারনিখতন্ত্রের পতনকে সুনিশ্চিত করে।
ইতালিতে মেটারনিখতন্ত্রের প্রভাব –
ইতালিতে একদিকে ছিল অস্ট্রিয়া-সহ অন্যান্য বিদেশি রাষ্ট্রের প্রভুত্ব, অন্যদিকে মেটারনিখের উদ্দেশ্য ছিল এখানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করে পুরাতনতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখা। কিন্তু তার এই অভিসন্ধিকে ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ঐক্য আন্দোলন – রিসারজিমেন্টো বা পুনর্জাগরণের প্রয়াস। বিদেশি শাসন ও দমননীতির প্রতিবাদে শুরু হয় কার্বোনারি আন্দোলন। জোসেপে ম্যাজিনির নেতৃত্বে ইয়ং ইতালি বা নব্য ইতালি দল ইতালিকে জাতীয়তাবাদের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করায়। শেষকালে সার্ডিনিয়া-পিডমন্টের প্রধানমন্ত্রী ক্যাভুর ও ম্যাজিনিপন্থী গারিবাল্ডির নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলন, বিদেশি প্রভুত্বকারী শক্তির বিরুদ্ধে। প্রত্যক্ষ যুদ্ধের দ্বারা ইতালি স্বাধীন হয়। মেটারনিখ ব্যবস্থাপ্রসূত পুরাতনতন্ত্রের আবরণ সরিয়ে ইতালি ভৌগোলিক সংজ্ঞা থেকে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে।
জার্মানিতে মেটারনিখতন্ত্রের প্রভাব –
ভিয়েনা সম্মেলনের (1815 খ্রি.) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখকে জার্মানির রাষ্ট্র সমবায়ের সভাপতি নিয়োগ করা হয়। তিনি পুরাতনতন্ত্রকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে কার্লসবাড ডিক্রি জারি করে ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ ইত্যাদি দমনমূলক রক্ষণশীল নীতি প্রয়োগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র, অধ্যাপক, পাঠ্যক্রম সবকিছুর উপরই সরকারি নজরদারি চালানোর ব্যবস্থা করা হয়। এইভাবে মেটারনিখ ব্যবস্থা বলবৎ করার মাধ্যমে জার্মানির ঐক্যের পথে অন্তরায় সৃষ্টির সবরকম চেষ্টা হলেও ঐক্যের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন সকল বাধা দূর করে দেয়। জার্মানির বিভিন্ন ছাত্র, অধ্যাপক, কবি, দার্শনিক দ্বারা প্রচারিত অখণ্ড জার্মান জাতি গঠনের জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বা সর্বজার্মানবাদ এই ঐক্যের ভিত্তি স্থাপন করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় জোলভেরাইন নামক শুল্কসংঘের দ্বারা অর্থনৈতিক ঐক্যকরণের প্রয়াস। এরপর প্রথমে জুলাই বিপ্লব ও পরে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের অভিঘাতে জার্মানিতে শুরু হয় ঐক্য আন্দোলন। 1848 খ্রিস্টাব্দে জার্মানির বিভিন্ন রাজ্য থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ফ্রাঙ্কফুর্ট পার্লামেন্ট জার্মানিকে ঐক্যের পথে বেশ কিছুটা অগ্রসর করে। 1862 খ্রিস্টাব্দে বিসমার্ক প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর রক্ত ও লৌহ নীতি দ্বারা জার্মানির ঐক্যকরণ সম্পন্ন করেন। জার্মানির উপর অস্ট্রিয়ার প্রভাব বিলুপ্ত হয়।
মূল্যায়ন –
মেটারনিখের এই ধরনের তীব্র দমনমূলক রক্ষণশীল নীতি গ্রহণের পিছনে ছিল উদারতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি আধুনিক ভাবধারার ধ্বংসসাধনের প্রচেষ্টা। এই ধরনের মনোভাবের জন্য মেটারনিখ নানাভাবে সমালোচিত হলেও কয়েকটি ইতিবাচক বিষয় অস্বীকার করা যাবে না। এই নীতিই ইউরোপকে 40 বছরের জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুদ্ধের অশান্তি থেকে মুক্তি দিয়েছিল। ফলস্বরূপ সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে এই শান্তি ও স্থিতিশীলতার কারণে। মেটারনিখের নিজের দেশ অস্ট্রিয়ার মতো বহু জাতি, ভাষা, গোষ্ঠীভুক্ত একটি জাতিকে ঐক্যের বাঁধনে বেঁধে রাখার ক্ষেত্রে মেটারনিখের নীতি যুক্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল এর নেতিবাচকতা ও সংস্কার বিরোধিতা। ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত আধুনিক ভাবধারার গতিরোধ করার চেষ্টা করে মেটারনিখ যেভাবে যুগধর্মকে অস্বীকার করেন তার পরিণতিতেই এই ব্যবস্থার ব্যর্থতা নিহিত ছিল। তাই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ মেটারনিখের নীতিকে ত্যাগ করে। 1822 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড, 1825 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া ও 1830 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স এই নীতি বর্জন করে। এরপর আসে 1848-এ ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের আঘাত। তীব্র ছাত্র ও শ্রমিক আন্দোলনে জর্জরিত হয়ে মেটারনিখের প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করা ও ইংল্যান্ডে পালিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপে মেটারনিখ যুগের অবসান ঘটে।
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের (July Revolution) কারণগুলি আলোচনা করো। এর গুরুত্ব কী ছিল?
ফ্রান্স তথা ইউরোপের ইতিহাসে 1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অষ্টাদশ লুই-এর (1814-1824 খ্রি.) পর তাঁর ভাই দশম চার্লস (Charles X, 1824-1830 খ্রি.) ফ্রান্সের সম্রাট হন। দশম চার্লসের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে 1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে যে বিপ্লব ঘটে, তা ইতিহাসে জুলাই বিপ্লব (July Revolution) নামে পরিচিত।
জুলাই বিপ্লবের কারণ
জুলাই বিপ্লবের পিছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল –
বুরবোঁ রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা – ভিয়েনা সম্মেলনের ন্যায্য অধিকার নীতি অনুযায়ী ফ্রান্সে বুরবোঁ বংশীয় অষ্টাদশ লুই সিংহাসনে বসেন। তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বন করে পুনঃস্থাপিত রাজতন্ত্রের সঙ্গে বিপ্লবী ভাবধারার মেলবন্ধনে এক নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু অষ্টাদশ লুই-এর সঙ্গে সঙ্গে দেশত্যাগী অভিজাতরাও ফ্রান্সে ফিরে আসেন। অভিজাতরা তাদের হারানো সম্পত্তি ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে সচেষ্ট হলে ফরাসি জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
অষ্টাদশ লুই-এর স্বৈরাচারিতা – অষ্টাদশ লুই সিংহাসনে আরোহণ করে প্রথমদিকে কিছুটা উদারনীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু 1820 খ্রিস্টাব্দে এক আততায়ীর হাতে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নিহত হলে উদারপন্থীদের বিরুদ্ধে এক দারুণ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং অষ্টাদশ লুই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। ফ্রান্সের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিও রাজার সনদকে গ্রহণ করতে রাজি ছিল না।
দশম চার্লসের প্রতিক্রিয়াশীল নীতি – 1824 খ্রিস্টাব্দে অষ্টাদশ লুই-এর মৃত্যুর পর ডিউক অফ আর্টয়েন্স (Duke of Artois) দশম চার্লস উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন উগ্র রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা ও পুরাতনতন্ত্রের সমর্থক। সিংহাসনে বসেই তিনি অষ্টাদশ লুইয়ের সনদ বাতিল করে দেন। বিপ্লবের সময় যে সমস্ত অভিজাতরা দেশত্যাগ করেছিল তাদের পুনর্বাসন ও আর্থিক ক্ষতি তিনি ফ্রান্সের রাজকোষ থেকে মেটান। শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্মযাজকদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও জেসুইটদের দেশে ফিরিয়ে এনে উচ্চপদ দান করেন। ফলে ফরাসিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
পলিগন্যাকের (Polignac) ভূমিকা – 1829 খ্রিস্টাব্দে দশম চার্লস পলিগন্যাক কে প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন। পলিগন্যাক বিপ্লবপ্রসূত সমস্ত রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলি নাকচ করে প্রাক্-বিপ্লব শাসনব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলে উদারপন্থীরা ক্ষুব্ধ হয়। তারা পলিগন্যাকের অপসারণের দাবি জানালে রাজা তাদের বিরোধিতা করে আইনসভা ভেঙে দেন।
প্রত্যক্ষ কারণ – 1830 খ্রিস্টাব্দের 25 জুলাই সনদের 14 নং ধারায় বর্ণিত রাজার বিশেষ ক্ষমতা অনুসারে দশম চার্লসের নির্দেশে পলিগন্যাক এক স্বৈরাচারী অর্ডিন্যান্স (July Ordinance) জারি করেন। এই অর্ডিন্যান্স অনুসারে –
- সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়।
- আইনসভা ভেঙে দেওয়া হয়।
- ভোটাধিকার সংকুচিত করা হয়।
- বুর্জোয়া শ্রেণিকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, কেবল সম্পত্তিবান অভিজাতরাই ভোটদানের অধিকার পায়।
- আইনসভার নির্বাচনের দিন ঘোষণা করা হয়।
বিপ্লবের সূচনা
এই অর্ডিন্যান্স জারির সঙ্গে সঙ্গে উদারপন্থী নেতা অ্যাডলফ থিয়ার্সের (Adolphe Thiers) নেতৃত্বে প্যারিসের জনসাধারণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। 28 জুলাই বিদ্রোহী জনতা প্যারিসের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। 30 জুলাই বিদ্রোহী জনসাধারণ দশম চার্লসকে সিংহাসনচ্যুত করে অলিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপকে (Louis Philippe) রাজা ঘোষণা করে। এইভাবে মাত্র তিনটি দিনের (27-29 জুলাই) মধ্যে জুলাই বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল।
জুলাই বিপ্লবের গুরুত্ব
ইউরোপের ইতিহাসে জুলাই বিপ্লবের গুরুত্ব অপরিসীম –
প্রথমত – জুলাই বিপ্লবের ফলে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের অধিকার বিলুপ্ত হয়।
দ্বিতীয়ত – সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা স্বীকৃতি লাভ করে।
তৃতীয়ত – এই বিপ্লবের প্রভাব ফ্রান্সের গণ্ডি ছাড়িয়ে সমগ্র ইউরোপে বিস্তৃত হয়। প্রায় একই সঙ্গে ইতালি, জার্মানি ও পোল্যান্ডে জাতীয় আন্দোলন শুরু হয়। অবশ্য শাসকরা এই বিদ্রোহগুলি কঠোর হাতে দমন করেন। একমাত্র বেলজিয়ামের বিপ্লব সাফল্য লাভ করে। জুলাই বিপ্লবের প্রভাবে গ্রিস, ইংল্যান্ড, স্পেন, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে আন্দোলন হয়। জুলাই বিপ্লব ইউরোপের পুরাতনতন্ত্রকে ভেঙে ফেলতে না পারলেও এর ভিত্তি যে দুর্বল করেছিল তা অনস্বীকার্য।
1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ইউরোপে রাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের সংঘাত কী রূপ পেয়েছিল?
1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব কেবলমাত্র ফ্রান্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না – ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। জুলাই বিপ্লবের প্রভাবে বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে রাজতন্ত্রের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সংঘাত ঘটে।
বেলজিয়াম
ভিয়েনা সম্মেলনে বেলজিয়ামের জাতীয়তাবাদকে উপেক্ষা করা হয়। ফ্রান্সের সীমান্তে হল্যান্ডকে শক্তিশালী করার জন্য বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। জাতীয়তাবাদী বেলজিয়ানরা 1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের প্রভাবে আন্দোলন গড়ে তোলে। তারা ব্রাসেলস শহরে অস্থায়ী সরকার গঠনের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং স্যাক্স-কোবার্গ (Saxe-Coburg) বংশের লিওপোল্ডকে (Leopold) রাজা নির্বাচন করে। শেষ পর্যন্ত 1839 খ্রিস্টাব্দের 22 জানুয়ারি হল্যান্ড বেলজিয়ামের স্বাধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
পোল্যান্ডের বিদ্রোহ
1830 খ্রিস্টাব্দের ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লবের প্রভাবে পোল্যান্ড আলোড়িত হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে স্বাধীন পোল্যান্ড রাজ্যকে রাশিয়া ও প্রুশিয়া নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার পোল্যান্ডে স্বায়ত্তশাসন, সংবিধান ও নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পরবর্তী রুশ জার প্রথম নিকোলাস (Nicholas I) পোলিশদের সব অধিকার প্রত্যাহার করে নেন। এর প্রতিবাদে 1830 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে পোলিশ বিপ্লবীরা ওয়ারশ শহরে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিদ্রোহীরা অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা করে জার নিকোলাসের কাছে উদারনৈতিক সংস্কার দাবি করে। কিন্তু নিকোলাসের নিষ্ঠুর দমননীতির ফলে পোলিশ বিদ্রোহ প্রশমিত হয়।
ইতালিতে বিদ্রোহ
ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লবের ঢেউ ইতালিকেও নাড়া দিয়েছিল। 1815 খ্রিস্টাব্দের ভিয়েনা বন্দোবস্ত ইতালিবাসী মেনে নিতে পারেনি। ইতালির ঐক্যপন্থী জাতীয়তাবাদীরা কার্বোনারি (Carbonari) ও অন্যান্য গুপ্ত সমিতি গঠন করে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে। যার ফলে –
- রোমা ও বোলোগনা পোপের অধীনতা অস্বীকার করে।
- মডেনার রাজা চতুর্থ ফ্রান্সিস সিংহাসনচ্যুত হন।
- পার্মার রানি ডাচেস মারিয়া লুইস (Duchess Marie Louise) রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যান।
পোপ ও শাসকবৃন্দ অস্ট্রিয়ার সাহায্য প্রার্থনা করলে অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর মেটারনিখ তীব্র দমননীতির মাধ্যমে ইতালির আন্দোলন দমন করেন।
জার্মানিতে বিদ্রোহ
1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব জার্মান জাতীয়তাবাদীদের উৎসাহিত করেছিল। জার্মানির ব্রান্সউইক, লিপজিগ, স্যাক্সনি, হ্যানোভার প্রভৃতি রাজ্যে আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের ফলে –
- ব্রান্সউইকের ডিউক পদত্যাগ করেন এবং নতুন ডিউক উদারনৈতিক শাসন চালু করেন।
- স্যাক্সনি, হেস, হ্যানোভার রাজ্যের শাসকরা উদারনৈতিক শাসন চালু করতে রাজি হন।
- দক্ষিণ জার্মানির ব্যাভারিয়া, উইটেনবার্গ, ব্যাডেন প্রভৃতি রাজ্যে সংসদীয় শাসন চালু থাকলেও তা সম্প্রসারিত হয়। তবে জার্মানির এই সাফল্য ছিল সাময়িক। মেটারনিখের দমননীতির ফলে জার্মান রাজ্যগুলিতে আগের অবস্থা ফিরে আসে।
স্পেন ও পর্তুগালে পরিবর্তন
1830 খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে স্পেন ও পর্তুগালেও পরিবর্তন ঘটে। তবে এই পরিবর্তনের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব।
- স্পেনের রানি ইসাবেলা (Isabella) ফ্রান্সের অনুকরণে একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন।
- পর্তুগালের রানি ডোনা মারিয়া (Dona Maria) পর্তুগালে উদারনৈতিক সংবিধান প্রবর্তন করেন।
নরওয়েতে বিদ্রোহ
ভিয়েনা সম্মেলনে নরওয়েকে সুইডেনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। 1830 খ্রিস্টাব্দে জুলাই বিপ্লবের প্রভাবে নরওয়েবাসীরা আন্দোলন করে। তাদের আন্দোলনের ফলে সুইডেনরাজ বার্নাডোট (Bernadotte) স্বায়ত্তশাসন ও সংবিধান প্রবর্তনের দাবি মেনে নেন।
সুইজারল্যান্ডে বিদ্রোহ
1830 খ্রিস্টাব্দের আন্দোলনের ফলে সুইজারল্যান্ডে গণ আন্দোলন শুরু হয়। এর ফলে সুইজারল্যান্ডে আন্দোলন আংশিক সাফল্য লাভ করে।
ইংল্যান্ডে বিদ্রোহ
1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব ইংল্যান্ডকেও প্রভাবিত করেছিল। গণ আন্দোলনের ফলে ইংল্যান্ডে 1832 খ্রিস্টাব্দে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার করা হয়।
1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জনগণকে উৎসাহিত করলেও আন্দোলনকারীরা সব দেশে সাফল্য পায়নি। তবে এই আন্দোলন সেইসব দেশে বৃহত্তর আন্দোলনের পটভূমি রচনা করে দিয়েছিল।
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ কী ছিল? এর গুরুত্ব লেখো।
1830 খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে লুই ফিলিপ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। জুলাই বিপ্লবের ফলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্র জুলাই মনার্কি (July Monarchy) নামে পরিচিত হয়। এই জুলাই মনার্কি ফরাসিদের আশা, প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। মাত্র 18 বছরের মধ্যেই গণরোষে এই রাজতন্ত্রের পতন ঘটে।
বিপ্লবের কারণ – জুলাই রাজতন্ত্রের পতনের বা 1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের একাধিক কারণ লক্ষ করা যায় –
সমস্ত রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা
প্রথম থেকেই লুই ফিলিপ কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন পাননি। দক্ষিণপন্থী ন্যায্য অধিকার সমর্থক বা লেজিটিমিস্ট (Legitimist)-রা ফ্রান্সের সিংহাসনে লুই ফিলিপের অধিকারকে অবৈধ বলে মনে করত। বামপন্থী প্রজাতান্ত্রিক দল ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলি জুলাই রাজতন্ত্রের তীব্র বিরোধী ছিল। মধ্যপন্থীরা লুই ফিলিপের মধ্যপন্থা নীতি ও শ্রমিককল্যাণবিরোধী নীতিতে এবং বোনাপার্টিস্ট দল ফিলিপের অগৌরবজনক পররাষ্ট্রনীতিতে হতাশ হয়।
বুর্জোয়া রাজতন্ত্র
লুই ফিলিপ বুর্জোয়া স্বার্থ রক্ষা করে শাসনকার্য চালাতেন। তাঁর শাসনব্যবস্থায় উচ্চবিত্ত ভূস্বামী, বণিক ও শিল্পপতিদের স্বার্থ রক্ষিত হত। প্রতিনিধি সভার সদস্য হওয়ার ও ভোটদানের অধিকার কেবলমাত্র বিত্তশালী শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন তিনি। এইভাবে গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্থাপিত হয় গোষ্ঠীতন্ত্র।
লুই ফিলিপের স্বৈরাচারী নীতি
জুলাই বিপ্লবের ফলে লুই ফিলিপ ফ্রান্সের সাংবিধানিক রাজা হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি স্বৈরশাসন কায়েম করেন। পরিণামে জনগণ হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের এই হতাশাই পুঞ্জীভূত হয়ে প্রকাশ পায় ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে।
শ্রমিক অসন্তোষ
ফ্রান্সে শ্রমিকদের অবস্থা ছিল অবর্ণনীয়। কাজের অনির্দিষ্ট সময়সীমা, স্বল্প মজুরি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ শ্রমিকদের অবস্থাকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। শ্রমিকদের কল্যাণসাধনের জন্য জুলাই রাজতন্ত্র কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সেন্ট সাইমন (Saint Simon), লুই ব্ল্যাঙ্ক (Louis Blanc) প্রমুখ সমাজতন্ত্রীরা শ্রমিকদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন এবং রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।
দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি
লুই ফিলিপের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য ছিল বৈদেশিক ক্ষেত্রে যুদ্ধ এড়িয়ে চলা এবং যে-কোনো মূল্যে শান্তি বজায় রাখা। অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র উভয় নীতির ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করায় সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনে তিনি ব্যর্থ হন।
অর্থনৈতিক সংকট
1846 এবং 1847 খ্রিস্টাব্দে পর পর দুই বছর অনাবৃষ্টির ফলে কৃষি উৎপাদন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায়, খাদ্যসংকট তীব্র হয় ও শ্রমিকদের দারিদ্র্য চরমসীমায় পৌঁছায়। আর্থিক সংকট নিরসনে রাজা ব্যর্থ হলে রাজতন্ত্রের পতন ঘটাতে জনগণ তৎপর হয়ে ওঠে। ফলে দেশের নানান অঞ্চলে বিদ্রোহ শুরু হয়।
প্রত্যক্ষ কারণ ও বিপ্লবের সূচনা –
1848 খ্রিস্টাব্দের 22 ফেব্রুয়ারি ভোটাধিকার সম্প্রসারণের দাবিতে প্যারিসের ময়দানে এক কেন্দ্রীয় সমাবেশের আয়োজন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী গিজো (Guizot) এই সমাবেশকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ক্ষুব্ধ জনতা গিজোর বাসভবন আক্রমণ করলে তাঁর দেহরক্ষীর গুলিতে 23 জন নিহত হয়। এই ঘটনার প্রত্যুত্তরে বিক্ষুব্ধ জনতা অবিলম্বে লুই ফিলিপের পদত্যাগ দাবি করে। লুই ফিলিপ তাঁর পৌত্রের হাতে সিংহাসনের দায়িত্বভার অর্পণ করে ইংল্যান্ডে পালিয়ে গেলে রাজতন্ত্রের অবসান হয় (24 ফেব্রুয়ারি, 1848 খ্রিস্টাব্দ)। ফ্রান্সে প্রজাতান্ত্রিক দল ও সমাজতান্ত্রিক দল মিলিতভাবে সরকার গঠন করে।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের গুরুত্ব –
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে জুলাই রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। ফ্রান্সের বাইরে জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে হাঙ্গেরি, বোহেমিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লাভ জাতিগোষ্ঠী স্বাধীনতা ঘোষণা করে। গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও শক্তিশালী হয়। ইউরোপে মেটারনিখতন্ত্রের পতন ঘটে। এককথায়, ইউরোপের পুরাতনতন্ত্রের পতন ত্বরান্বিত হয়।
1848 খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্স ও ইউরোপে রাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের সংঘাত কী রূপ পেয়েছিল?
ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফ্রান্স বিপ্লবের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছিল। ইউরোপে প্রায় সর্বত্র শুরু হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের অভ্যুত্থান। ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান ও প্রজাতন্ত্রের জয় হয়। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত হয় এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন রাষ্ট্রপতি লুই নেপোলিয়ন (Louis Napoleon), যিনি জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন।
ইউরোপে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব
1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ফ্রান্সে শুরু হলেও তা কেবলমাত্র ফ্রান্সেই সীমাবদ্ধ ছিল না — ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয়।
1. অস্ট্রিয়া – 1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে অস্ট্রিয়ায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় মেটারনিখের বাসভবন আক্রান্ত হয়। মেটারনিখ অস্ট্রিয়া ছেড়ে পালিয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে আশ্রয় নেন। এর ফলে ইউরোপে মেটারনিখতন্ত্রের অবসান ঘটে। অস্ট্রিয়ার সম্রাট উদারনৈতিক সংবিধান মেনে নিতে বাধ্য হন।
2. হাঙ্গেরি – হাঙ্গেরি ছিল অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যভুক্ত। ফ্রান্সের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে অস্ট্রিয়াতে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ শুরু হয়। হাঙ্গেরির অধিবাসীরা লুই কসুথ (Louis Kossuth) নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই আন্দোলনের ফলে হাঙ্গেরির স্বায়ত্তশাসনের দাবি স্বীকৃত হয়। লুই কসুথ-কে হাঙ্গেরির ম্যাৎসিনি (Mazzini of Hungary) বলা হয়।
জার্মানি – ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে জার্মান রাজ্য প্রাশিয়া, স্যাক্সনি, হ্যানোভার, ব্যাভেরিয়া, ব্যাডেন, ব্রান্সউইক প্রভৃতি রাজ্যে উদারনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়। এইসব রাজ্যের রাজারা উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র মেনে নিতে বাধ্য হন। জার্মান জাতীয়তাবাদীরা ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে সমবেত হয়ে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির জন্য একটি পার্লামেন্ট ও সংবিধান রচনা করেন। এই পার্লামেন্ট ফ্রাঙ্কফুর্ট পার্লামেন্ট (Frankfurt Parliament) নামে পরিচিত। প্রাশিয়ার রাজা চতুর্থ ফ্রেডরিক উইলিয়ামকে (Frederick William IV) ঐক্যবদ্ধ জার্মানির রাষ্ট্রপ্রধানের পদ গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। কিন্তু চতুর্থ ফ্রেডরিক উইলিয়াম ছিলেন স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের ও রাজার দৈবসত্তার অধিকারে বিশ্বাসী। তাই তিনি জাতীয়তাবাদীদের দেওয়া ক্ষমতা নিতে অস্বীকার করেন। ফ্রাঙ্কফুর্ট পার্লামেন্ট সফল না হলেও তা জার্মানির ঐক্য আন্দোলনের পথকে প্রশস্ত করেছিল।
ইতালি – ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে ইতালির ভেনিস, টাসকানি, পার্মা, মডেনা, মিলান, নেপলস, সিসিলি এবং পোপের রাজ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। বিপ্লবের ফলে লম্বার্ডি, ভেনেসিয়া, মিলান প্রভৃতি রাজ্য থেকে অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনী বিতাড়িত হয়। পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার রাজা চার্লস আলবার্ট (Charles Albert) নিজের রাজ্যে উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করেন। ভেনিসে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপ্লবী জোসেফ ম্যাৎসিনির (Giuseppe Mazzini) নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় রোমেও।
ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রে প্রভাব
1848 খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে ডেনমার্ক, সুইডেন, হল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশেও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। ইংল্যান্ডেও এই আন্দোলনের প্রভাব পড়ে।
মূল্যায়ন
তবে 1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের বিশেষ গুরুত্ব থাকলেও এর সাফল্য ছিল সীমিত। প্রাথমিক আন্দোলনের ধাক্কা কাটিয়ে অস্ট্রিয়া প্রতি-আক্রমণ শুরু করে। ফলে ইতালি, জার্মানি, অস্ট্রিয়ার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ভেঙে পড়ে। 1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ইউরোপের ইতিহাসের দিক পরিবর্তন করে।
ইতালির ঐক্য আন্দোলনে জোসেফ ম্যাৎসিনির (Giuseppe Mazzini) ভূমিকা আলোচনা করো।
ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ম্যাৎসিনির ভূমিকা –
ইতালির মুক্তি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, আত্মা ও হৃৎস্পন্দন ছিলেন গিউসেপ (ইংরেজি উচ্চারণ জোসেফ) ম্যাৎসিনি (Giuseppe Mazzini)। বাল্যকাল থেকেই জেনোয়ার অধিবাসী ম্যাৎসিনি ইতালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ম্যাৎসিনির নিরলস চেষ্টায় ইতালিবাসীর মনে স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ ইতালির আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে।
ইয়ং ইতালি (Young Italy) আন্দোলন –
প্রথম জীবনে ম্যাৎসিনি কার্বোনারি দলের সদস্য ছিলেন। পরে এই দলের ধ্বংসাত্মক আদর্শে আস্থা হারিয়ে তিনি ইয়ং ইতালি বা নব্য ইতালি নামে এক নতুন দল গঠন করেন। এই দলের আদর্শ ছিল শিক্ষণ, চরিত্র-নিষ্ঠা এবং আত্মত্যাগের দ্বারা ইতালিতে জাতীয়তাবাদ সঞ্চারিত করা। তিনি ইতালির গৌরব ও মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য দেশের যুবকদের আহ্বান জানান। তিনি বিশ্বাস করতেন শহীদের রক্ত ঝরলে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা পুষ্টি লাভ করবে। তাঁর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে হাজার হাজার ইতালীয় যুবক মাতৃভূমির বন্ধনমোচনে এগিয়ে আসে। তিনি ঐক্যবদ্ধ ইতালির স্বপ্ন দেখতেন এবং ইতালির ঐক্যের পথে প্রধান বাধাস্বরূপ অস্ট্রিয়াকে ইতালি থেকে উচ্ছেদ করা অপরিহার্য বলে মনে করতেন। এই কাজে কোনো বিদেশি শক্তির সাহায্যের পরিবর্তে তিনি ইতালির আত্মনির্ভরশীল যুবশক্তির উপর অধিক আস্থা রেখেছিলেন।
প্রজাতন্ত্র স্থাপন –
ফেব্রুয়ারি বিপ্লব শুরু হলে সাময়িকভাবে কিছু সময়ের জন্য ম্যাৎসিনির নেতৃত্বে রোম ও টাসকানিতে প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়।
মূল্যায়ন
তবে ইয়ং ইতালি আন্দোলন অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের চাপে ব্যর্থ হয়। প্রজাতন্ত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ম্যাৎসিনি ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান। ব্যর্থতা সত্ত্বেও ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ম্যাৎসিনির ভূমিকাকে গুরুত্বহীন বলা যাবে না। তিনিই প্রথম স্বদেশবাসীর মধ্যে বিপ্লবের মানসিকতা জাগিয়ে তোলেন এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার সঞ্চার ঘটান।
ইটালির ঐক্য আন্দোলনে কাউন্ট ক্যাভুরের (Count Cavour) ভূমিকা আলোচনা করো।
ইটালির ঐক্য আন্দোলনে কাউন্ট ক্যাভুরের (Count Cavour) ভূমিকা
1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ব্যর্থতায় ইটালিবাসী যখন দিশেহারা, তখন পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ক্যাভুর ইটালিবাসীকে নতুন পথের সন্ধান দেন। কঠোর বাস্তববাদী ক্যাভুর বুঝেছিলেন যে ইটালিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য অস্ট্রিয়াকে বিতাড়িত করতে হবে এবং এর জন্য বিদেশি শক্তির সাহায্যের প্রয়োজন।
অভ্যন্তরীণ ও সামরিক সংস্কার
ক্যাভুর ইটালিবাসীর মধ্যে স্যাভয় রাজবংশের শাসনের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য অভ্যন্তরীণ ও সামরিক সংস্কার করে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়াকে শক্তিশালী করে তোলেন। তিনি ইটালির সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত করার জন্য ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (Crimean War) ইঙ্গ-ফরাসি পক্ষে যোগদান করেন। 1856 খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে ইটালিতে অস্ট্রিয়ার স্বৈরাচারী শাসনের স্বরূপ তুলে ধরে ইটালির সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যায় রূপান্তরিত করেন।
প্লোমবিয়েরেসের সন্ধি (Plombieres Agreement)
ক্যাভুর ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের (Napoleon III) সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পান অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে। উভয়ের মধ্যে প্লোমবিয়ের (Plombieres) নামক স্থানে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ক্যাভুরের প্ররোচনায় অস্ট্রিয়া 1859 খ্রিস্টাব্দে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে তৃতীয় নেপোলিয়নের সাহায্যে ক্যাভুর ম্যাজেন্টা ও সলফেরিনোর যুদ্ধে অস্ট্রিয়াকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। অস্ট্রিয়ার ইটালি থেকে বিদায় যখন আসন্ন, সেই সময় তৃতীয় নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়ার সঙ্গে 1859 খ্রিস্টাব্দে ভিল্লাফ্রাঙ্কার চুক্তি (Treaty of Villafranca) স্বাক্ষর করেন। সেই সন্ধির দ্বারা পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার সঙ্গে লম্বার্ডি ও মিলান যুক্ত হলেও ভেনিসিয়া অস্ট্রিয়ার অধীনে থেকে যায়।
উত্তর ইটালির ঐক্যসাধন
ইতিমধ্যে অস্ট্রিয়ার পরাজয় ইটালিবাসীর মধ্যে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। পার্মা, মোডেনা, টাসকানি, রোমাগনা প্রভৃতি রাজ্যগুলি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির ইচ্ছা প্রকাশ করে। অবশেষে মধ্য ইটালির রাজ্যগুলি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হলে উত্তর ইটালি ঐক্যবদ্ধ হয়।
দক্ষিণ ইটালির ঐক্যসাধন
উত্তর ইটালির ঐক্যের পর দক্ষিণ ইটালির সিসিলি ও নেপলসে বুরবোঁ শাসকদের বিরুদ্ধে ইটালির ঐক্য আন্দোলন শুরু হয়। গ্যারিবল্ডি তাঁর লালকোট বাহিনী নিয়ে সিসিলি ও নেপলস দখল করে নেন। এই অবস্থায় তিনি রোম আক্রমণের উদ্যোগ নিলে ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। এমন অবস্থায় ক্যাভুর গ্যারিবল্ডিকে ওই স্থান প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানালে গৃহযুদ্ধ এড়ানোর জন্য গ্যারিবল্ডি ওই স্থান দুটি পিডমন্টকে ছেড়ে দেন। এইভাবে ভেনিসিয়া ও রোম ব্যতীত ইটালি ঐক্যবদ্ধ হয়।
ইতালিতে কীভাবে রিসর্গিমেন্টো (Risorgimento)-র উৎপত্তি হয়েছিল? ইতালির ঐক্যে জুসেপ্পে গ্যারিবাল্ডির (Giuseppe Garibaldi) ভূমিকা লেখো।
রিসর্গিমেন্টো (Risorgimento) কথার অর্থ হলো নবজাগরণ। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পূর্বে ইতালিবাসী দীর্ঘকালীন বিদেশি শাসন ও শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বহু মানুষ দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দি ছিল। উপরন্তু, ভিয়েনা কংগ্রেসের ফলে উদ্ভূত শোচনীয় অবস্থা ইতালিবাসীদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে ইতালির ভাবজগতে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়, যা রিসর্গিমেন্টো বা নবজাগরণ নামে খ্যাত।
রিসর্গিমেন্টো-র বিভিন্ন পর্যায় –
ইতালিতে রিসর্গিমেন্টো বা নবজাগরণকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায় —
প্রথম পর্যায় – প্রথম পর্যায়ে নবজাগরণের অগ্রদূত ছিল কার্বোনারি সম্প্রদায়। এটি ছিল একটি গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি। এই সমিতির সদস্যরা ইতালির মুক্তিকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। এদের প্রধান কর্মকেন্দ্র ছিল ইতালির নেপলস। কার্বোনারি দল সাময়িকভাবে নেপলস-এর বুরবোঁ বংশীয় রাজা চতুর্থ ফার্দিনান্দকে উদারতান্ত্রিক সংবিধান প্রবর্তন করতে এবং পিডমন্টের রাজা ভিক্টর ইমান্যুয়েলকে (Victor Emmanuel) সংবিধান রচনা করতে বাধ্য করে সফল হয়েছিল। তবে কার্বোনারি আন্দোলন নিতান্ত স্থানীয় স্তরে সীমাবদ্ধ থাকায় এবং গণসংযোগ না থাকায় সফলতা পায়নি।
দ্বিতীয় পর্যায় – ইতালিতে নবজাগরণের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় 1832 খ্রিস্টাব্দের পর। এই পর্বে বুদ্ধিজীবীরা নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও নেতৃত্ব সামনে রেখে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট হন। এই পর্বে ইতালির সর্বত্র বিপ্লববাদী গ্রন্থ ও রচনাদির আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকে। বিপ্লবীদের এই চিন্তাধারা ইতালির রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। যেমন –
- 1846 খ্রিস্টাব্দে জিওবার্টি (Gioberti) তাঁর ‘মোরাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল হেডশিপ অফ ইতালি’ (Moral and Political Headship of Italy) গ্রন্থে পোপের নেতৃত্বে ইতালির ঐকাবস্থানের কথা প্রচার করেন।
- 1846 খ্রিস্টাব্দে আজেগলিয়ো (Azeglio) তাঁর ‘রিসেন্ট ইভেন্টস ইন রোমাগনা’ (Recent Events in Romagna) গ্রন্থে পোপ শাসিত রাজ্যে দুর্নীতিপরায়ণ ও অপদার্থ শাসনব্যবস্থার তীব্র নিন্দা করেন এবং জাতীয় ঐক্যের কথা বলেন।
- 1847 খ্রিস্টাব্দে সেতেমব্রিনি (Settembrini) তাঁর ‘প্রোটেস্ট অফ দ্য পিপল অফ দ্য টু সিসিলিস’ (Protest of the People of the Two Sicilies) গ্রন্থে দ্বিতীয় ফার্দিনান্দের নির্মম স্বৈরাচারী শাসনের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনিও জাতীয় ঐক্যের উপর জোর দেন।
ইতালির নবজাগরণে ক্যাভুরের ‘II Risorgimento’ পত্রিকাটিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রগতিমূলক সংস্কার ও ইতালির ঐক্যের গুরুত্ব সম্পর্কে ইতালিবাসীকে ক্যাভুর সচেতন করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। এইভাবে ইতালির নবজাগরণের প্রথম পর্যায়ে কার্বোনারি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে বুদ্ধিজীবীদের আন্তরিক প্রয়াস লক্ষ করা যায়।
ইতালির ঐক্যে জুসেপ্পে গ্যারিবাল্ডির (Giuseppe Garibaldi) অবদান –
দক্ষিণ ইতালির সংযুক্তিকরণের প্রধান নায়ক ছিলেন জুসেপ্পে গ্যারিবাল্ডি। তিনি ছিলেন বাস্তববাদী এবং দেশের প্রতি তাঁর ছিল গভীর ভালোবাসা। ম্যাজিনির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে 1836 খ্রিস্টাব্দে গ্যারিবাল্ডি ইতালির মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন। 1860 খ্রিস্টাব্দে তিনি নেপলস ও সিসিলির গণ অভ্যুত্থানে যোগদান করেন এবং নেপলস ও সিসিলি দখল করে দক্ষিণ ইতালিকে বিদেশি শাসনমুক্ত করেন। এরপর গ্যারিবাল্ডি দক্ষিণ ইতালিতে প্রজাতন্ত্র স্থাপন করতে চাইলে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ক্যাভুর তাঁকে বাধা দেন। গৃহবিবাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে গ্যারিবাল্ডি নেপলস ও সিসিলি ভিক্টর ইমান্যুয়েল-এর হাতে তুলে দেন।
সর্বোপরি বলা যায় যে, ইতালির ঐক্য আন্দোলনের ইতিহাসে ম্যাজিনি ও ক্যাভুরের পাশাপাশি ‘সিংহ হৃদয়’ গ্যারিবাল্ডিও স্বমহিমায় ভাস্কর হয়ে রয়েছেন।
ইতালির ঐক্য আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ম্যাৎসিনি, ক্যাভুর ও গ্যারিবল্ডির ভূমিকা আলোচনা করো।
ইতালির ঐক্য আন্দোলন –
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে ইউরোপের একটি যুগান্তকারী ঘটনা হল ইতালির ঐক্য আন্দোলন। ইতালির ঐক্যসাধনে জোসেপ্পে ম্যাৎসিনি, কাউন্ট ক্যামিলো ক্যাভুর এবং গ্যারিবল্ডির ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখ বলেছিলেন, “ইতালি একটি ভৌগোলিক সংজ্ঞায় পরিণত হয়েছে।” কারণ তখন ইতালি কয়েকটি ইউরোপীয় রাষ্ট্রের দ্বারা অধিকৃত ছিল; যথা — উত্তর ইতালিতে অস্ট্রিয়া, মধ্য ইতালিতে পোপ এবং দক্ষিণ ইতালিতে স্পেনের কর্তৃত্ব ছিল। স্বাধীন ইতালির কোনো অস্তিত্ব ছিল না।
কার্বোনারি বিদ্রোহ –
বিদেশি শাসন থেকে ইতালিকে মুক্ত করতে কার্বোনারি দলের বিপ্লবীরা আন্দোলন করেন, কিন্তু জনগণের অসহযোগিতা ও সামরিক দুর্বলতার জন্য তাঁরা ব্যর্থ হন।
জোসেপ্পে ম্যাৎসিনি ও ইয়ং ইতালি আন্দোলন –
ইতালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন জোসেপ্পে ম্যাৎসিনি। তিনি 1831 খ্রিস্টাব্দে Young Italy বা তরুণ ইতালি নামে একটি দল গঠন করেন। ম্যাৎসিনিকে ইতালির ঐক্য আন্দোলনের ভাবপুরুষ, দার্শনিক ও আত্মা বলা হয়। তিনি বলতেন, ইতালির জনগণই ইতালির ভাগ্য নির্ধারণ করবে এবং স্বাধীন ইতালি হবে একটি ঐক্যবদ্ধ প্রজাতন্ত্র। 1848 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে রোমে গণবিপ্লব দেখা দেয়। পোপ পালিয়ে যান। ম্যাৎসিনি রোমে প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন রোমের প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে উচ্ছেদ করেন।
ক্যাভুরের ভূমিকা –
ম্যাৎসিনির ব্যর্থতার পর ইতালিতে বাস্তববাদী প্রধানমন্ত্রী কাউন্ট ক্যামিলো ক্যাভুরের আবির্ভাব হয়। 1852 খ্রিস্টাব্দে তিনি পিডমন্ট ও সার্ডিনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ক্যাভুর ফ্রান্সের তৃতীয় নেপোলিয়নের সঙ্গে প্লোম্বিয়ার্সের গোপন চুক্তি (1858 খ্রি.) স্বাক্ষর করেন। তৃতীয় নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক সাহায্য দিতে সম্মত হন। কিন্তু সার্ডিনিয়ার সঙ্গে অস্ট্রিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে তৃতীয় নেপোলিয়ন ভিলাফ্রাঙ্কার সন্ধি (1859 খ্রি.) স্বাক্ষর করে যুদ্ধ থেকে সরে যান। ইতিমধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে মধ্য ইতালি গণভোটের মাধ্যমে সার্ডিনিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হয়।
গ্যারিবল্ডির ভূমিকা –
1860 খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ইতালির নেপলস-সিসিলিতে গণ অভ্যুত্থান দেখা দেয়। গ্যারিবল্ডির ‘লালকোট’ বাহিনী নেপলস ও সিসিলি জয় করে। ইতালিতে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হলে গ্যারিবল্ডি তাঁর বিজিত রাজ্য সার্ডিনিয়ার রাজা ভিক্টর ইমানুয়েলের হাতে তুলে দেন।
ভেনেসিয়া ও রোম অধিকার –
1866 খ্রিস্টাব্দে প্রুশিয়া-অস্ট্রিয়া যুদ্ধে ইতালি প্রুশিয়ার পক্ষে যোগ দেয় এবং বিনিময়ে ভেনেসিয়া লাভ করে। 1870 খ্রিস্টাব্দে প্রুশিয়া-ফ্রান্স যুদ্ধে ফ্রান্স পরাজিত হয়। অপরদিকে ইতালিও রোম দখল করে তার ঐক্য সম্পূর্ণ করে। এইভাবে ‘ভৌগোলিক সংজ্ঞা’র দেশ ইতালি ‘ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন ইতালি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
জার্মানিতে জাতীয়তাবাদের উত্থানের পটভূমি আলোচনা করো। কার্লসবাড ডিক্রি (Cartsbad Decree) কীভাবে জার্মানির ঐক্যের পথে বাধাদান করেছিল?
জার্মানিতে জাতীয়তাবাদের উত্থানের পটভূমি
উনিশ শতকে ইউরোপে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারায় অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল জার্মানির জাতীয় ঐক্যসাধন এবং জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ৩০০টি ছোটো ছোটো রাষ্ট্রে বিভক্ত জার্মানিতে জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের পিছনে একাধিক উপাদান সক্রিয় ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি জার্মানিতে একটি রোম্যান্টিক বা ভাববাদী আদর্শের জাগরণ ঘটে। কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সংগীত সাধকেরা এমন এক সংস্কৃতির সৃষ্টি করেন, যার দ্বারা সমগ্র জার্মানি অনুপ্রাণিত হয়। জার্মানির হালে (Halle), গটিংজেন (Göttingen), লিপজিগ (Leipzig), জেনা (Jena) প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এই নবসংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থান হয়ে ওঠে। জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এই সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতির বাণীকে নিজ নিজ রাজ্যে বহন করে নিয়ে যায়। এর ফলে জার্মান জাতির ঐক্যবোধ দৃঢ় হয়।
সাহিত্যিকদের প্রভাব
মার্টিন লুথার কর্তৃক জার্মান ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ আপামর জার্মানবাসীর মনে ধর্মীয় ও ভাবগত ঐক্যের পটভূমি সৃষ্টি করে। ফরাসি সাহিত্যের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে জার্মান সাহিত্য সৃষ্টির কাজে লেসিং (Lessing) ছিলেন অগ্রণী। সাহিত্যিক হার্ডার (Herder) জার্মানির লোকসাহিত্য ও বীরগাথাকে সংকলন করে সাহিত্যের দরবারে হাজির করেন। মহাকবি গ্যেটে (Goethe) জার্মান সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন।
শুধু সাহিত্যিকই নন, দার্শনিক, ঐতিহাসিক এবং সংগীত সাধকরাও জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করেন। সেবাস্তিয়ান বাক (Sebastian Bach) বহু জাতীয়তাবাদমূলক ও দেশপ্রেম বিষয়ক সংগীত রচনা করে জনমানসে দারুণ উদ্দীপনার সঞ্চার করেন। ফিটে (Fichte), হেগেল (Hegel), স্টেইন (Stein), কান্ট (Kant) প্রমুখের রচনার প্রভাবে ‘সর্বজার্মানবাদ’ (Pan-Germanism) ব্যাপক প্রসার লাভ করে।
নেপোলিয়নের অবদান
ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট মানচিত্রের সরলীকরণের মাধ্যমে তিন শতাধিক জার্মান রাজ্যকে 39টি সংঘবদ্ধ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেন। এ ছাড়া বিচ্ছিন্ন রাজ্যগুলিতে এক শাসনব্যবস্থা, এক রকমের কর কাঠামো, বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা ও অভিন্ন আইনবিধি প্রবর্তন করে জার্মানবাসীকে জাতীয়তাবাদের স্বাদ অনুভব করতে শেখান।
অর্থনৈতিক ঐক্য
1819 খ্রিস্টাব্দে ‘জোলভেরেইন’ (Zollverein) নামক শুল্কসংঘ স্থাপনের উদ্যোগ শুরু হলে জার্মানির ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রকৃত সূত্রপাত হয়। এই সংঘের উদ্যোক্তা ছিলেন মাশেন (Massen)। অস্ট্রিয়া ব্যতীত জার্মানির সর্বত্র একইরকমের করব্যবস্থার প্রচলন জার্মানির ঐক্যের পথকে সুগম করেছিল।
বুরশেনশাফট (Burschenschaft) সংগঠনের প্রভাব
1815 খ্রিস্টাব্দের পর জেনা (Jena) বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বুরশেনশাফট (Burschenschaft) নামে এক জাতীয়তাবাদী সংগঠন স্থাপন করেন। জার্মানির 13 থেকে 15টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই সংগঠনে যোগ দেয়। এই সংগঠনের সদস্যরা জার্মানির ঐক্য ও জাতীয়তাবাদের স্বার্থে প্রচার চালায়।
ওয়ার্টবার্গ উৎসব (Wartburg Festival)
সর্বোপরি 1817 খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের (Martin Luther) 300তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে তাঁর জন্মস্থান ওয়ার্টবার্গে এক মহতী উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই উৎসবে ছাত্র ও অধ্যাপকেরা জার্মানির ঐক্য ও জাতীয়তাবাদের সমর্থনে আবেগপূর্ণ বক্তৃতা দেন। এই উৎসবে মেটারনিখের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।
কার্লসবাড ডিক্রি (Carlsbad Decree)
জার্মানিতে ছাত্র আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে 1819 খ্রিস্টাব্দে মেটারনিখ কার্লসবাড ডিক্রি (Carlsbad Decree) জারি করেছিলেন।
জার্মানিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ছাত্র এবং দার্শনিকদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। জার্মানির প্রায় 16টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। ছাত্ররা প্রতিবাদী ধর্মসংস্কার আন্দোলনের (Protestant Reformation) 300 বছরের পূর্তি উৎসব পালনের সিদ্ধান্ত নিলে মেটারনিখ চিন্তিত হন এবং ছাত্রদের আন্দোলন স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে এই দমনমূলক আইন জারি করেন। এই আইন অনুসারে-
- জার্মানির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর পুলিশি কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়,
- সমস্ত রকমের রাজনৈতিক সভা-সমিতি নিষিদ্ধ করা হয় এবং
- সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়।
এইভাবে কার্লসবাড ডিক্রি দীর্ঘদিন ধরে জার্মানির জাতীয় ঐক্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বিসমার্ক (Bismarck) কীভাবে জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করেন?
1862 খ্রিস্টাব্দে অটো ভন বিসমার্ক (Otto von Bismarck) নামে এক কূটনীতিজ্ঞ প্রুশিয়ার প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হলে জার্মানির ঐক্য আন্দোলনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
জার্মানির ঐক্যসাধন
বিসমার্কের কূটনীতি – জার্মানির ঐক্যসাধন বিষয়ে বিসমার্কের কূটনীতির দৃষ্টান্তগুলি উল্লেখযোগ্য। তিনি কেন্দ্রীয় আইনসভায় অস্ট্রিয়ার মর্যাদা নষ্ট করে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে জার্মানির ক্ষুদ্র রাজ্যগুলিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেন, ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয় বাণিজ্যচুক্তি সম্পাদন করে ফ্রান্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন, এবং পোলদের বিদ্রোহ দমনে রাশিয়াকে সাহায্য করে বিসমার্ক রাশিয়ার আস্থা অর্জন করেন।
রক্ত ও লৌহ নীতি (Blood and Iron Policy)
রক্ষণশীল রাজতন্ত্রের ঘোর সমর্থক বিসমার্ক মনে করতেন, প্রুশিয়ার রাজতন্ত্রের অধীনেই জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হবে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির উপর তাঁর আস্থা ছিল না। তিনি বলেন যে, বক্তৃতা দিয়ে বা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রস্তাব পাস করিয়ে দেশের সমস্যার সমাধান হবে না, এর জন্য গ্রহণ করতে হবে রক্ত ও লৌহ নীতি (Blood and Iron Policy)। রক্ত ও লৌহ নীতি হল সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীলতা। সামরিক শক্তির দ্বারাই জার্মানির ঐক্যলাভ সম্ভব — এ কথা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। শেষ পর্যন্ত সামরিক শক্তির সাহায্যে তিনটি যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করেন।
তিনটি যুদ্ধ হল –
- ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধ
- অস্ট্রো-প্রুশিয় যুদ্ধ
- ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয় যুদ্ধ
ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধ (Battle with Denmark)
শ্লেজউইগ ও হলস্টিন প্রদেশ জার্মানির রাজ্যসীমার অন্তর্ভুক্ত হলেও আইনত ডেনমার্কের অধীন ছিল। বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মিলিত হয়ে ডেনমার্কের সঙ্গে 1864 খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরাজিত ডেনমার্ক ভিয়েনা চুক্তির দ্বারা দুটি প্রদেশের উপর সব দাবি ত্যাগ করে। কিন্তু অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়ার মধ্যে এই দুই প্রদেশের কর্তৃত্ব নিয়ে বিবাদ বাধে। গ্যাস্টিনের সন্ধি (Treaty of Gastein, 1865 খ্রি.) দ্বারা প্রুশিয়া শ্লেজউইগ ও অস্ট্রিয়া হলস্টিন প্রদেশ লাভ করে।
অস্ট্রো-প্রুশিয় যুদ্ধ (Austro-Prussian War)
বিসমার্ক অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় রাজনীতিতে তাকে মিত্রহীন করার জন্য সচেষ্ট হন। পোল বিদ্রোহের সময় রাশিয়া প্রুশিয়ার সাহায্য পেয়েছিল। ইতালি অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যোগ দিলে ভেনিস পেতে পারে এবং ফ্রান্স নিরপেক্ষ থাকলে জার্মানির কিছু ভূখণ্ড লাভ করতে পারে এই আশায় রাশিয়া, ইতালি, ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে চলে যায়। সাত সপ্তাহের যুদ্ধে (Seven Weeks War) এবং স্যাডোয়ার যুদ্ধে (Battle of Sadowa) 1866 খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়া শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং প্রাগের সন্ধির (Peace of Prague, 1866 খ্রি.) দ্বারা যুদ্ধের অবসান ঘটে।
ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয় যুদ্ধ (Franco-Prussian War)
অস্ট্রিয়ার পরাজয়ের পর ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হয় প্রুশিয়া। অস্ট্রিয়া, ইতালি ও রাশিয়াকে নিরপেক্ষ রেখে বিসমার্ক ফ্রান্সকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করেন। ফ্রান্স বিসমার্কের কূটনৈতিক জালে জড়িয়ে 1870 খ্রিস্টাব্দে প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সেডানের যুদ্ধে (Battle of Sedan) ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন (Napoleon III) চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন। 1871 খ্রিস্টাব্দের 10 মে ফ্রাঙ্কফুর্টের সন্ধির (Peace of Frankfurt) দ্বারা এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। জার্মানি রাজনৈতিক ঐক্য সম্পন্ন হয়।
এইভাবে বিসমার্ক কূটনীতি ও যুদ্ধনীতির মাধ্যমে জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন। ঐক্যবদ্ধ জার্মানির প্রথম সম্রাট হন কাইজার প্রথম উইলিয়াম (Kaiser Wilhelm I)।
ঊনবিংশ শতকে পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যার উপাদানগুলি কী ছিল?
ভূমিকা
পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যা ইউরোপের ইতিহাসে একটি অন্যতম জটিল সমস্যা। ইউরোপের পূর্বদিকে তুরস্ক শাসনাধীন ইজিয়ান সাগর ও দানিয়ুব নদীর মধ্যবর্তী গ্রিস, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, আলবেনিয়া, সার্বিয়া, মলদাভিয়া, ওয়ালাচিয়া প্রভৃতি অঞ্চলগুলি পূর্বাঞ্চল নামে পরিচিত। এই অঞ্চলকে ‘বলকান’ অঞ্চলও বলা হয়। বলকান শব্দের আক্ষরিক অর্থ পাহাড়। এই অঞ্চলগুলি পর্বতময় বলেই এগুলিকে বলকান অঞ্চল (Balkan) বলা হয়।
পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যার কারণ
পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যার পিছনে চারটি কারণ লক্ষণীয় –
- তুরস্ক সাম্রাজ্যের অবনতি
- তুরস্ক সাম্রাজ্যাধীন বলকান অঞ্চলে বসবাসকারী খ্রিস্টান জাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে মুক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষা
- বলকান অঞ্চলে রাশিয়ার আগ্রাসন
- রুশ সম্প্রসারণ রোধে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার প্রয়াস
তুরস্ক সাম্রাজ্যের দুর্বলতা
পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিস্তীর্ণ অংশ নিয়ে তুরস্ক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলেও অষ্টাদশ শতক থেকেই তুর্কি সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। তুরস্কের আধুনিকীকরণ না হওয়ায় তুরস্ক সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামরিক সবদিক থেকেই পিছিয়ে পড়ে। তুরস্কের শাসকরা ছিলেন স্বেচ্ছাচারী, অকর্মণ্য, সংস্কারবিমুখ। প্রজাবর্গের মঙ্গলসাধন বা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রবর্তনে তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না, সেনাবাহিনীও ছিল মধ্যযুগীয়। আধুনিক সমরাস্ত্র ও রণকৌশলে শিক্ষিত ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির পাশে তুরস্ক ছিল অনেকটাই নিষ্প্রভ। এই কারণে অষ্টাদশ শতকে তুরস্ককে ইউরোপের রুগ্ণ মানুষ (Sick Man of Europe) বলা হত।
বলকান জাতীয়তাবাদ
তুরস্ক শাসনাধীন বলকান অঞ্চল অর্থাৎ সার্বিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রগুলিতে বিভিন্ন জাতির মানুষ বসবাস করত। ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি কোনো দিক থেকেই এক জাতির সঙ্গে অপর জাতির কোনো মিল ছিল না। শাসক ও শাসিতের মধ্যেকার সম্পর্ক ছিল তিক্ত। শাসকরা সরকারবিরোধী যে-কোনো বিদ্রোহকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতেন। ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত সরকারবিরোধী ভাবধারা এই সমস্ত জাতিদের জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে বলকান অঞ্চল বিদ্রোহের অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়।
রাশিয়ার অগ্রগতি
তুরস্ক সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাশিয়া কৃষ্ণসাগরের উপর দিয়ে দার্দোনেলিস প্রণালী অতিক্রম করে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কারণ রাশিয়ার প্রধান সমস্যা ছিল বহির্বিশ্বে যোগাযোগের অভাব।
ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের স্বার্থ
বলকান অঞ্চলের উপর রুশ প্রভাব বিস্তার ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের স্বার্থবিরোধী ছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল বলকানে রুশ প্রভাব বৃদ্ধিতে শক্তিসাম্য বিনষ্ট হবে। তারা চাইত তুরস্কের অখণ্ডতা বজায় থাকুক এবং রুশ আগ্রাসন বন্ধ হোক।
গুরুত্ব
এই অবস্থায় 1853 খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে রাশিয়া তুরস্ক সাম্রাজ্যাধীন জেরুজালেমে গ্রোটোর গির্জার রক্ষণাবেক্ষণ এবং গ্রিক খ্রিস্টানদের অভিভাবকত্ব দাবি করে। তুরস্ক প্রথম দাবিটি মেনে নিলেও দ্বিতীয় দাবিটি মানতে অস্বীকার করে। এমতাবস্থায় রাশিয়া, তুর্কি শাসনাধীন দানিয়ুব উপত্যকার মলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া অঞ্চল দুটি দখল করে নিলে নিজ নিজ স্বার্থে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া তুরস্কের পক্ষে অস্ত্রধারণ করে। এর ফলে 1854 খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (Crimean War) শুরু হয়।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের (Crimean War) কারণ কী ছিল? এই যুদ্ধের অবসান কীভাবে হয় এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে লেখো।
1854 খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়। তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্তর্গত জেরুজালেমের পবিত্র গির্জার কর্তৃত্ব নিয়ে ল্যাটিন ও গ্রিক খ্রিস্টানদের বিরোধকে কেন্দ্র করে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সূচনা হয়। একটি গির্জার কর্তৃত্ব নিয়ে ধর্মীয় কারণে এই যুদ্ধের সূচনা হলেও এর পিছনে আরও অনেক কারণ বিদ্যমান ছিল।
প্রত্যক্ষ কারণ –
তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্তর্গত যিশুখ্রিস্টের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র জেরুজালেমের গির্জার কর্তৃত্ব নিয়ে ল্যাটিন ও গ্রিক খ্রিস্টানদের মধ্যে বিরোধ ছিল। ল্যাটিন খ্রিস্টানদের সমর্থক ছিল ফ্রান্স এবং গ্রিক খ্রিস্টানদের সমর্থক ছিল রাশিয়া। 1852 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন তুরস্কের সুলতানের কাছে জেরুজালেমের অধিকার দাবি করেন। 1853 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার জার তুরস্কে অবস্থিত গ্রিক ধর্মপ্রতিষ্ঠান ও তুরস্কনিবাসী গ্রিক প্রজাদের উপর অধিকার দাবি করেন। তুরস্কের সুলতান ফ্রান্সের দাবি মানলেও রাশিয়ার দাবি মানতে অস্বীকার করেন।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে রাশিয়া তুরস্কের মোল্দাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া দখল করে। রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া তুরস্কের পক্ষে যোগ দিলে 1854 খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়।
- ভিয়েনা নোট (Vienna Note) – রাশিয়া মোল্দাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া দখল করলে রুশ প্রভাব বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া ভিয়েনা শহরে সম্মিলিত হয়। তারা আলাপ-আলোচনা করে রাশিয়ার কাছে একটি প্রস্তাব পাঠায়। এই প্রস্তাব ভিয়েনা নোট নামে পরিচিত। এই প্রস্তাবে রাশিয়াকে মোল্দাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বলা হয়। রাশিয়া এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয় (মার্চ, 1854 খ্রি.)। পরে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া তুরস্কের পক্ষে যোগ দেয়।
পরোক্ষ কারণ –
খ্রিস্টানদের তীর্থস্থানের অধিকার নিয়ে বিরোধ ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হলেও এই যুদ্ধের পিছনে প্রকৃত কারণ ছিল তুর্কি সাম্রাজ্যে রাশিয়ার দখলদারি এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির স্বার্থপ্রণোদিত আচরণ।
- তুর্কি সাম্রাজ্যে রাশিয়ার দখলদারি – তুর্কি সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে রাশিয়া চেয়েছিল কৃষ্ণসাগর দিয়ে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছোনোর জন্য প্রয়োজনীয় এলাকা দখল করতে। এজন্য রাশিয়া বারবার ইংল্যান্ডের কাছে তুরস্ক বিভাজনের প্রস্তাব দেয়। ইংল্যান্ড সরাসরি এই প্রস্তাবে রাজি না হলে রাশিয়া তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত মোল্দাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া দখল করে নেয়।
- ইংল্যান্ডের স্বার্থ – ইংল্যান্ড বলকান অঞ্চলে রাশিয়ার সম্প্রসারণের বিরোধী ছিল। কারণ এর ফলে ইংল্যান্ডের ভারত ও আফ্রিকায় যাওয়ার পথে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই ইংল্যান্ড রাশিয়ার বিরুদ্ধে ও তুরস্কের পক্ষে যোগদান করে।
- ফ্রান্সের স্বার্থ – ফ্রান্সও বলকান অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারকে ভালো চোখে দেখেনি। কারণ এই অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পেলে ফ্রান্সের ব্যবসাবাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হত। তা ছাড়া ফ্রান্স চেয়েছিল রাশিয়াকে পরাজিত করে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মস্কো অভিযানের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে।
- অস্ট্রিয়ার স্বার্থ – অস্ট্রিয়া তার বাণিজ্যিক স্বার্থ ও সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য বলকান অঞ্চলে রাশিয়ার সম্প্রসারণের বিরোধী ছিল।
- পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার স্বার্থ – পিডমন্ট ও সার্ডিনিয়ার স্বার্থ ছিল যে, ইতালির ঐক্য আন্দোলনে তারা প্রয়োজনে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সাহায্য পাবে।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (Crimean War) –
ক্রিমিয়ার যুদ্ধ ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস থেকে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস পর্যন্ত দু-বছর ধরে চলেছিল। রাশিয়া প্রথমদিকে কিছু সাফল্য পেলেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অবসান –
প্যারিসের সন্ধি (Treaty of Paris) – 1856 খ্রিস্টাব্দের 30 মার্চ প্যারিসের সন্ধির মাধ্যমে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অবসান ঘটে। প্যারিসের মন্দিরগুলি ছিল নিম্নরূপ –
- রাশিয়া তুরস্ককে মোল্দাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া ফিরিয়ে দেবে।
- মোলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়াকে তুরস্কের অধীনে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে।
- তুর্কি সাম্রাজ্যের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষা করা হবে।
- তুরস্ক আন্তর্জাতিক আইনের এক্তিয়ারভুক্ত হবে।
- তুরস্কের সুলতান আধুনিকীকরণ ও ধর্মীয় সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করবে।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের (Crimean War) ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করো।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফল
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল নিয়ে ঐতিহাসিক মহল দ্বিধাবিভক্ত ছিল। কোনো কোনো ঐতিহাসিক এই যুদ্ধকে অনাবশ্যক যুদ্ধ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ এই যুদ্ধের আবশ্যিকতাকে অস্বীকার করেননি। ফরাসি ঐতিহাসিক ও মন্ত্রী থিয়ার্স (Thiers) ক্রিমিয়ার যুদ্ধকে অভিহিত করেছেন এইভাবে যে, “গ্রোটো গির্জার চাবিকাঠি নিয়ে হীনমনোবৃত্তিসম্পন্ন যাজকদের মধ্যে বন্দুপ্রসূত যুদ্ধ” (A war to give a few wretched monks the key of Grotto)। অপরদিকে ঐতিহাসিক গ্রান্ট ও টেম্পারলি এই যুদ্ধকে ইউরোপের ইতিহাসে এক বিশেষ যুদ্ধ আখ্যা দিয়েছেন (The Crimean War occupies a peculiar place in the history of Europe in the 19th century.)। অধ্যাপক এ জে পি টেলর (AJP Taylor) মনে করেন “পারস্পরিক আগ্রাসন নয়, পারস্পরিক সন্দেহ থেকেই এই যুদ্ধের সূত্রপাত, যদিও এটি অনাবশ্যক যুদ্ধ নয়” (Mutual fear, not mutual aggression caused the Crimean War, nevertheless it was not a war without a purpose.)।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফলকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রত্যক্ষ ফলাফল
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফলাফলগুলি হল —
- এই যুদ্ধের দ্বারা বলকান অঞ্চল ও কৃষ্ণসাগরে রুশ অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। রাশিয়া তুরস্কের যেসব অঞ্চল দখল করেছিল, তুরস্ক সেগুলি ফেরত পায়।
- তুরস্ক ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের সদস্যপদ লাভ করে। শক্তি সমবায় তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। শক্তি সমবায়ভুক্ত ইউরোপীয় আধুনিক রাষ্ট্রগুলির সংস্পর্শে এসে তুরস্ক আধুনিক সংস্কারের মাধ্যমে পুনর্জীবনের সুযোগ পায়।
- ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন (Napoleon III) যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একই সঙ্গে তাঁর এবং ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন তিনি।
পরোক্ষ ফলাফল
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পরোক্ষ ফলাফল ছিল অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। লর্ড ক্রোমার এই যুদ্ধকে “Watershed of European History” অর্থাৎ ইউরোপীয় ইতিহাসের জলবিভাজিকা আখ্যা দিয়েছেন। জলবিভাজিকা বা ঝরনার জলধারার মতো ক্রিমিয়ার যুদ্ধও ইতিহাসের গতিপ্রকৃতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল।
- ইউরোপে সাম্রাজ্যবিস্তার নীতি প্রতিহত হওয়ায় রাশিয়া মধ্য এশিয়ায় সেই নীতি অনুসরণ করে। এর ফলে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
- ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের ফলে জারতন্ত্রের দুর্বলতা প্রকট হয়ে পড়ে। এই যুদ্ধের পর থেকেই রুশ জনগণ জারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে। গণবিক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য পরবর্তী জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার (Alexander II) বেশ কিছু সংস্কার প্রবর্তন করেন।
- ক্রিমিয়ার যুদ্ধ ইতালি ও জার্মানির ঐক্যের সহায়ক হয়। পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া এই যুদ্ধে যোগদান করে ইতালির সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত করে। সার্ডিনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ক্যাভুর ইতালির ঐক্য প্রচেষ্টায় ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সহানুভূতি আদায়ে সক্ষম হন।
- ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়া রাশিয়াকে সমর্থন না করায় রাশিয়া জার্মানির ঐক্য আন্দোলনে প্রাশিয়ার পক্ষ নেয়। প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ক রাশিয়ার সাহায্যে জার্মানি থেকে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য খর্ব করে জার্মানির ঐক্য প্রচেষ্টাকে সহজ করেন। ঐতিহাসিক কেটেলবি (Ketelbee) বলেছেন, ‘ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলেই নব ইতালি এবং নব জার্মানি জন্মলাভ করে’ (It was out of the mud of Crimea that a new Italy was made and less obviously, a new Germany)।
- ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর বলকান জাতিগুলির মধ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দেখা দেয়। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী স্বাধীনতার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। এই তৎপরতা বলকান অঞ্চলকে ইউরোপের অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করে।
গুরুত্ব
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। অনেকে এই যুদ্ধকে অনাবশ্যক ও অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। আবার অনেকে বলেন, এর ফলে —
- বলকান অঞ্চলে রাশিয়ার আগ্রাসন বাধাপ্রাপ্ত হয়।
- তুরস্কের আধুনিকীকরণ সম্ভবপর হয় এবং
- পরোক্ষভাবে ইতালি ও জার্মানির ঐক্য আন্দোলন সম্ভব হয়।
এমস টেলিগ্রাম (Ems Telegram / Ems Dispatch) কী? এর পটভূমি কী ছিল? এর ফল কী হয়েছিল?
এমস টেলিগ্রাম
প্রুশিয়ার রাজা প্রথম উইলিয়াম (William I) এমস (Ems) নামক স্থান থেকে তাঁর প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ককে টেলিগ্রামের মাধ্যমে একটি খবর পাঠান (13 জুলাই, 1870 খ্রি.)। এর বিষয় ছিল ফরাসি দূত বেনেদিতির (Benedetti) সঙ্গে রাজা প্রথম উইলিয়ামের আলোচনার সারসংক্ষেপ। এটি ইতিহাসে এমস টেলিগ্রাম (Ems Telegram) নামে খ্যাত। এর ফলে ফ্রান্সের সঙ্গে প্রুশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণ হয়েছিল।
এমস টেলিগ্রামের পটভূমি
একটি বহির্দেশীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমস টেলিগ্রামের পটভূমি রচিত হয়েছিল। ঘটনাটি হল —
- স্পেনের সিংহাসন নিয়ে বিরোধ – স্পেনের রানি ইসাবেলা II (Isabella II)-র বিরুদ্ধে স্পেনে বিদ্রোহ শুরু হয় এবং রানি সিংহাসনচ্যুত হন (1868 খ্রি.)। এই সময় স্পেনীয়রা প্রুশিয়ার হোহেনজোলার্ন (Hohenzollern) রাজবংশের প্রিন্স লিওপোল্ডকে (Leopold) স্পেনের রাজা হওয়ার জন্য অনুরোধ করে। লিওপোল্ড ছিলেন প্রুশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনের পুত্র।
- ফ্রান্সের বিরোধিতা – স্পেনের সিংহাসনে লিওপোল্ডের মনোনয়নে ফ্রান্স বিরোধিতা করে। কারণ ফ্রান্সের পূর্বদিকে প্রুশিয়া এবং পশ্চিমদিকে স্পেনে জার্মান হোহেনজোলার্ন বংশের রাজা লিওপোল্ড সিংহাসনে বসলে ফ্রান্সের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ফলে ফ্রান্সের বিরোধিতায় লিওপোল্ড স্পেনের এই প্রস্তাবে রাজি হননি।
- প্রুশিয়ার প্রতিশ্রুতি লাভের জন্য ফ্রান্সের চেষ্টা – ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন এতেও সন্তুষ্ট হননি। তিনি প্রুশিয়ার রাজা প্রথম উইলিয়ামের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি চেয়েছিলেন যে, জার্মান হোহেনজোলার্ন বংশের কেউ কখনও স্পেনের সিংহাসনে বসবে না।
- এমসে আলোচনা – ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের নির্দেশ অনুসারে ফরাসি দূত কাউন্ট বেনেদিতি (Count Benedetti) প্রুশিয়ার রাজা প্রথম উইলিয়ামের প্রতিশ্রুতি আদায় করতে চান। প্রুশিয়ার রাজা প্রথম উইলিয়াম তখন এমস (Ems) নামক স্থানে বিশ্রামরত ছিলেন। বেনেদিতি এমসে গিয়ে রাজার সঙ্গে দেখা করেন এবং এ বিষয়ে আলোচনা করেন। রাজা অত্যন্ত বিনীতভাবে তাঁকে জানিয়ে দেন যে, এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
- এমস টেলিগ্রাম ও পরিবর্তিত বিষয় প্রকাশ – প্রুশিয়ার রাজা আলোচনার বিষয়টি টেলিগ্রামের মাধ্যমে তাঁর প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ককে জানিয়ে দেন (13 জুলাই, 1870 খ্রি.)। কূটনীতিবিদ বিসমার্ক টেলিগ্রামের কিছু শব্দ বাদ দিয়ে টেলিগ্রামটি এমনভাবে সাজান যাতে মনে হয় প্রুশিয়ার রাজা ফরাসি দূত বেনেদিতিকে অপমান করেছেন। পরের দিন বিসমার্ক এটি নর্থ জার্মান গেজেট (North German Gazette) ও অন্যান্য সংবাদপত্রে প্রকাশ করে দেন (14 জুলাই, 1870 খ্রি.)।
এমস টেলিগ্রামের ফলাফল
- প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্সের যুদ্ধ ঘোষণা – এই ঘটনার কথা জানতে পেরে ফরাসি জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন (15 জুলাই, 1870 খ্রি.)।
- ফ্রান্স-প্রুশিয়া যুদ্ধ – অপ্রস্তুত ফ্রান্স হঠাৎ যুদ্ধ ঘোষণা করায় প্রুশিয়ার কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। ফ্রাঙ্কফোর্ট সন্ধি (Peace of Frankfurt, 10 মে, 1871 খ্রি.)-এর মাধ্যমে এই যুদ্ধের অবসান ঘটে।
- ঐক্যবদ্ধ জার্মানির আত্মপ্রকাশ – জার্মান জাতি অধ্যুষিত আলসাস ও লোরেন জার্মানির সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রুশিয়ার রাজা প্রথম উইলিয়াম জার্মানির সম্রাট বা কাইজার (Kaiser) বলে ঘোষিত হন।
রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথার অবসান কে করেন এবং কীভাবে? ভূমিদাস আইনের ত্রুটিগুলি কী ছিল?
রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথার অবসান ঘটান জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার (Tsar Alexander II)।
ভূমিদাস প্রথার উচ্ছেদের জন্য জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার তাঁর সেনাপতি রোস্তোভস্তেভের (Rostovtsev) নেতৃত্বে একটি কমিটি নিয়োগ করেন। 1861 খ্রিস্টাব্দের 19 ফেব্রুয়ারি এই কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হলে জার ভূমিদাসদের মুক্তির ঘোষণাপত্র জারি করেন।
মুক্তির ঘোষণাপত্র (Edict of Emancipation)
ভূমিদাস মুক্তির ঘোষণাপত্র চারটি নীতির উপর রচিত হয়। এগুলি হল —
- ভূমিদাসদের স্বাধীন ও মুক্ত নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হবে।
- ভূমিদাসদের চাষের জন্য জমি দেওয়া হবে।
- অভিজাত বা সামন্তদের আর্থিক ক্ষতি না করে ভূমিদাসদের মুক্ত করা হবে।
- শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমগ্র ব্যবস্থাটি পরিচালিত হবে।
ভূমিদাস উচ্ছেদ আইন
1861 খ্রিস্টাব্দে ভূমিদাস উচ্ছেদ আইন পাস হয়। এই আইনে বলা হয় যে,
- রাজকীয় জমি ও সামন্তদের জমিতে নিয়োজিত ভূমিদাসরা স্বাধীন প্রজার মর্যাদা পাবে।
- মুক্ত ভূমিদাসদের উপর জমিদার বা সামন্তদের কোনো অধিকার থাকবে না।
- জমিদারদের জমির প্রায় অর্ধেক মুক্তিপ্রাপ্ত ভূমিদাসদের দেওয়া হবে।
- জমির জন্য জমিদারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে এবং কৃষকেরা 49 বছরের কিস্তিতে এই অর্থ সরকারকে প্রদান করবে ইত্যাদি।
ভূমিদাস আইনের ত্রুটি
জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ভূমিদাস প্রথা উচ্ছেদ আইনের জন্য রুশ জনগণের নিকট মুক্তিদাতা জার (Tsar Liberator) হিসেবে পরিচিত হন। কিন্তু ভূমিদাস প্রথা উচ্ছেদ আইনের বেশ কিছু ত্রুটি ছিল, যার জন্য এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। যেমন —
- জমির জন্য কৃষকেরা সরকারকে যে অর্থ প্রদান করত তা প্রাপ্ত জমির তুলনায় অনেক বেশি ছিল।
- জমিদাররা উর্বর এলাকাগুলি নিজেদের কাছে রেখে দিয়ে অনুন্নত এলাকাগুলি মুক্তিপ্রাপ্ত ভূমিদাসদের দিত। এজন্য বারবার কৃষক বিদ্রোহ দেখা দিত।
- কৃষকদের জমি ভোগ করার অধিকার দেওয়া হয়েছিল, মালিকানাস্বত্ব নয়।
ত্রুটি সত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের আন্তরিক প্রয়াসের ফলে রাশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ভূমিদাস প্রথার অবসান সম্ভব হয়েছিল। তাঁর এই প্রয়াস তাঁকে মুক্তিদাতা জার-এ রূপান্তরিত করেছিল।
আজকে আমরা আমাদের আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ইতিহাসের তৃতীয় অধ্যায় উনবিংশ শতকের ইউরোপ : রাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সংঘাত অধ্যায়ের প্রশ্ন কিছু ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষার জন্য বা আপনি যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে। আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা অসুবিধা হলে, আপনারা আমাকে টেলিগ্রামে যোগাযোগ করতে পারেন। আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ।