নবম শ্রেণী – ইতিহাস – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তারপর – ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন ও উত্তর

আজকে আমরা এই আর্টিকেলে নবম শ্রেণীর ইতিহাসের পঞ্চম অধ্যায় “বিংশ শতকে ইউরোপ” অধ্যায়ের কিছু ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষার জন্য এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলো মাধ্যমিক পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়।

Table of Contents

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তারপর – ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

ইতালিতে বেনিটো মুসোলিনি (Benito Mussolini) – এর অভ্যন্তরীণ নীতি কী ছিল?

মুসোলিনি ইতালির সর্বময় ক্ষমতা দখল করে ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ অনুসারে ইতালির অভ্যন্তরীণ নীতি পরিচালনা করেন।

অভ্যন্তরীণ নীতির উদ্দেশ্য

মুসোলিনির অভ্যন্তরীণ নীতির উদ্দেশ্য ছিল ইতালিতে ফ্যাসিস্ট দলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা এবং বিরোধীদের দমন করা।

একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা – মুসোলিনি ফ্যাসিস্ট দল ও রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা হস্তগত করে সংসদের আইন প্রণয়নের অধিকারও লাভ করেছিলেন। তিনি ইতালিতে গণতান্ত্রিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা উচ্ছেদ করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভিক্টর ইমানুয়েল (Victor Emmanuel) ছিলেন ইতালির নামমাত্র রাজা। বাস্তবে, মুসোলিনি ছিলেন ইতালির সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী।

বিরোধী মতবাদ দমন – অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মুসোলিনির প্রধান কাজ ছিল বিরোধীদের দমন করা। মুসোলিনি পরিচালিত ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধীদের উপর কঠোর দমনপীড়ন ও হত্যালীলা চালিয়েছিল। সরকার সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করেছিল।

অভ্যন্তরীণ নীতি

শিক্ষানীতি – মুসোলিনির শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ছিল ইতালিতে ফ্যাসিস্ট ভাবধারার সম্প্রসারণ ঘটানো। এজন্য ফ্যাসিস্ট প্রশাসন দলের অনুগামীদের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেছিল এবং পাঠ্যপুস্তকগুলি ফ্যাসিস্ট আদর্শ অনুসারে রচিত হয়েছিল। মুসোলিনি ইতালির একনায়কতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা চালু করেছিলেন।

কৃষিনীতি – খাদ্যসমস্যার সমাধান ও শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনের উপর মুসোলিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি ঋণদান, সেচব্যবস্থা ও পতিত জমিগুলিকে চাষজমিতে পরিণত করার ব্যবস্থা করেছিলেন।

শিল্পনীতি – শিল্পোন্নয়নের জন্য মুসোলিনি পুরোনো শিল্পগুলির আধুনিকীকরণ ও নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শিল্পগুলির উন্নতি অব্যাহত রাখার জন্য তিনি শ্রমিক ধর্মঘট নিষিদ্ধ করেছিলেন। এর ফলে ইতালিতে রেল শিল্প, জাহাজ শিল্প, বিদ্যুৎ, বিমান, মোটর প্রভৃতি শিল্পের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছিল।

পোপের সঙ্গে মৈত্রী – পোপ ও ক্যাথলিকদের সমর্থন লাভের জন্য 1929 খ্রিস্টাব্দে মুসোলিনি পোপের সঙ্গে ‘ল্যাটেরান চুক্তি’ (Lateran Treaty) স্বাক্ষর করেছিলেন। পরিশেষে বলা যায় যে, আইনের শাসন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা লোপ করে মুসোলিনি ইতালিতে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শক্তিশালী আধুনিক ইতালি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

ইতালিতে বেনিটো মুসোলিনির পররাষ্ট্রনীতি কী ছিল?

ইতালির ক্ষমতা দখলের পর মুসোলিনি ফ্যাসিস্ট দলের আদর্শ অনুযায়ী পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করেন।

  • মুসোলিনির পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য – মুসোলিনির পররাষ্ট্রনীতি বা বিদেশনীতির উদ্দেশ্য ছিল –
    • আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইতালির মর্যাদা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
    • ইতালির উপনিবেশ তৈরি বা সাম্রাজ্য বিস্তার করা।
  • ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইতালির সঙ্গে ফ্রান্সের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। এর কারণ ছিল –
    • ফ্রান্স ছিল ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে ইতালির প্রতিদ্বন্দ্বী।
    • ফ্রান্স আবার ইতালির নাগরিকদের ফ্রান্সে বসবাসের জন্য আহ্বান জানিয়েছিল।
  • রোমের সন্ধি স্বাক্ষর – জার্মানিতে হিটলারের উত্থান ফ্রান্স ও ইতালি উভয় দেশকেই শঙ্কিত করেছিল। তাই 1935 সালে ফ্রান্স ও ইতালি পারস্পরিক স্বার্থরক্ষার জন্য রোমের সন্ধি (Treaty of Rome) স্বাক্ষর করে।
  • মুসোলিনির আবিসিনিয়া আক্রমণ – মুসোলিনির সাম্রাজ্যবাদী নীতির বহিঃপ্রকাশ ছিল আফ্রিকার আবিসিনিয়া আক্রমণ। মুসোলিনির আবিসিনিয়া আক্রমণের কারণ ছিল –
    • ইতালি দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক কারণে আবিসিনিয়াতে উপনিবেশ স্থাপন করতে আগ্রহী ছিল।
    • ফ্রান্স ইতালিকে আফ্রিকায় কিছু সুযোগসুবিধা প্রদান করে পরোক্ষভাবে আবিসিনিয়া দখলে উৎসাহিত করেছিল।
  • ওয়াল ওয়াল ঘটনা – 1934 সালের 5 ডিসেম্বর আবিসিনিয়ার ওয়াল ওয়াল গ্রামে ইতালি ও আবিসিনিয়ার বাহিনীর মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ হয়। এতে ইতালির কিছু সৈন্য মারা যায়। মুসোলিনি এই ঘটনার অজুহাতে আবিসিনিয়ার সম্রাট হেইলে সেলাসির (Haile Selassie) কাছে বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ ও নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করেন। এই সময় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ইতালির প্রতি তোষণনীতি অনুসরণ করে। ফলে 1935 সালের 3 অক্টোবর ইতালি আবিসিনিয়া আক্রমণ করে এবং 1936 সালে সমগ্র আবিসিনিয়া দখল করে নেয়।
  • ইতালির জাতিসংঘ ত্যাগ – আবিসিনিয়া দখলের অপরাধে জাতিসংঘ ইতালির বিরুদ্ধে আর্থিক অবরোধ ঘোষণা করে। ফলে 1937 সালে ইতালি জাতিসংঘ ত্যাগ করে।
  • স্পেনে হস্তক্ষেপ – 1936 সালে স্পেনে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলে মুসোলিনি স্পেনের বিদ্রোহী সেনাপতি ফ্রাঙ্কোকে সামরিক সাহায্য দেন। এর ফলে ফ্রাঙ্কো বিজয়ী হন।
  • অ্যান্টি-কমিন্টার্ন প্যাক্ট – জাতিসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ করার পর ইতালি 1937 সালে জার্মানি ও জাপানের সঙ্গে অ্যান্টি-কমিন্টার্ন প্যাক্ট (Anti-Comintern Pact বা কমিউনিস্ট সোভিয়েত রাশিয়া বিরোধী চুক্তি) স্বাক্ষর করে। ফলে রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষজোট (Rome-Berlin-Tokyo Axis) গড়ে ওঠে।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদান – 1939 সালের 1 সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পোল্যান্ডের পক্ষে এবং জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মুসোলিনি জার্মানির পক্ষে যোগদান করেন।

রোমের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য মুসোলিনি যুদ্ধনীতি ও উপনিবেশবাদকে সমর্থন করেন। পরিণামে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশীদার হন এবং পরাজিত হয়ে নির্মমভাবে নিহত হন।

জার্মানিতে হিটলারের অভ্যন্তরীণ নীতির বিবরণ দাও।

1933 খ্রিস্টাব্দে হিটলার জার্মানিতে নাৎসি দলের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি চ্যান্সেলার (প্রধানমন্ত্রী) ও রাষ্ট্রপতির সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে জার্মানির সর্বময় কর্তা বা ফ্যুয়েরার (Führer) হয়েছিলেন এবং ফ্যাসিবাদী নীতি অনুসারে জার্মানির অভ্যন্তরীণ নীতি পরিচালনা করেছিলেন।

হিটলারের অভ্যন্তরীণ নীতির উদ্দেশ্য –

হিটলারের অভ্যন্তরীণ নীতির উদ্দেশ্য ছিল –

  1. জার্মানিতে নাৎসি দলের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা বা একদলীয় শাসন কায়েম করা।
  2. হেরেনভলক তত্ত্ব (Herrenvolk Theory) অনুসারে জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
  3. শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তোলা।
  4. জার্মানিকে নাৎসিকরণ করা।
  5. জার্মানির অর্থনৈতিক পুনর্গঠন করা।

অভ্যন্তরীণ নীতি

  • জার্মানিতে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা – হিটলার জার্মানিতে নাৎসি দলের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, অর্থাৎ জার্মানিতে নাৎসি দল ছাড়া সব দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক সামারভেল বলেছেন যে, হিটলারের দৃষ্টিতে জার্মানরা “হয় একজন নাৎসি নয়তো দেশদ্রোহী।”
  • ইহুদি বিতাড়ন – হিটলার জার্মান জাতির বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য জার্মানি থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ইহুদিরা জার্মানির অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল। অনেক ইহুদি জার্মানি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু যারা থেকে গিয়েছিল তাদের মধ্যে কয়েক লক্ষকে নানাভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
  • শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন – হিটলার একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেছিলেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল –
  • স্টর্ম ট্রুপার্স (Stormtroopers, SA) – জার্মান যুবকদের নিয়ে গঠিত স্টর্ম ট্রুপার্সদের কাজ ছিল নাৎসিদের রক্ষা করা ও অন্য দলের সভাসমিতি ভেঙে দেওয়া।
  • এলিট গার্ডস (Elite Guards, SS) – এরা ছিল নাৎসি নেতাদের দেহরক্ষী। অত্যন্ত নৃশংস ছিল এরা। এছাড়াও ছিল ‘গেস্টাপো’ (Gestapo) বা গুপ্ত পুলিশবাহিনী প্রভৃতি। মূলত সামরিক বাহিনীর সাহায্যে হিটলার তাঁর নীতি জার্মানদের উপর চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা – হিটলার জার্মানিতে সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন। কারণ তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একটি বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করা।

  • জার্মানিকে নাৎসিকরণ – ক্ষমতা দখলের পর হিটলার জার্মানিকে নাৎসিকরণ করার নীতি গ্রহণ করেন।
    • জার্মানিতে নাৎসি দল ছাড়া সমস্ত দল অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
    • সমস্ত সরকারি কর্মচারীকে নাৎসি সরকারের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে বাধ্য করা হয়।
    • স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকগুলি নাৎসি আদর্শে রচনা করা হয়।
    • সংবাদপত্রগুলিকে নাৎসি আদর্শ প্রচারের কাজে ব্যবহার করা হয়।
  • অর্থনৈতিক পুনর্গঠন – হিটলার জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থার পুনর্গঠন করেছিলেন।
    • জার্মানিতে অনেক কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
    • কারখানায় শিফ্ট প্রথা (Shift System) চালু করেছিলেন।
    • কারখানাগুলিতে শ্রমিক ধর্মঘট নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
    • কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার ও সারের প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করেছিলেন। তবে খাদ্য উৎপাদনের চেয়ে অস্ত্র উৎপাদনে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। এই নীতিকে ‘মাখনের চেয়ে কামানের অগ্রাধিকার’ (Cannon before butter) নীতি বলা হয়।

এইভাবে তিনি জার্মানিকে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শক্তিশালী করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জার্মানির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হন

হিটলারের পররাষ্ট্রনীতির বিবরণ দাও।

হিটলার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জার্মানিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জার্মানির ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ক্ষমতা দখলের পর তিনি গৌরবজনক পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন।

পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য

হিটলারের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য ছিল –

  1. জার্মানিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত করা।
  2. জার্মানির পক্ষে অপমানজনক ভার্সাই সন্ধি লঙ্ঘন করা।
  3. বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী জার্মানদের নিয়ে একটি বৃহৎ জার্মান সাম্রাজ্য গঠন করা।

কূটনীতি –

  1. জেনেভা সম্মেলন – 1933 খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত জেনেভার নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে জার্মান প্রতিনিধিরা দাবি করেছিলেন যে, সমস্ত রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি হ্রাস করে জার্মানির পর্যায়ে আনা হোক অথবা জার্মানিকে অন্যান্য রাষ্ট্রের সমান সামরিক শক্তি বৃদ্ধির অনুমতি দেওয়া হোক। মিত্রপক্ষ জার্মানির এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে হিটলারের নির্দেশে জার্মান প্রতিনিধিরা সম্মেলন ত্যাগ করেন এবং পরে জার্মানি জাতিসংঘের সদস্যপদও ত্যাগ করে।
  2. পোল্যান্ড-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি – হিটলার ইউরোপকে সচকিত করে শত্রুতা থাকা সত্ত্বেও পোল্যান্ডের সঙ্গে দশ বছরের জন্য অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন (1934 খ্রি.)। হিটলারের উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের জার্মানবিরোধী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে পোল্যান্ডের সম্পর্কের অবনতি ঘটানো।
  3. সার অঞ্চল পুনরুদ্ধার – ভার্সাই সন্ধির দ্বারা জার্মানির শিল্পসমৃদ্ধ সার অঞ্চল পনেরো বছরের জন্য ফ্রান্সের দখলে ছিল। বলা হয়েছিল যে, পনেরো বছর পরে 1935 খ্রিস্টাব্দে সার অঞ্চল জার্মানি বা ফ্রান্স কোন্ রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হবে তা গণভোটের দ্বারা স্থির হবে। গণভোটে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সার অঞ্চল জার্মানির সঙ্গে যুক্ত হয়।
  4. ইঙ্গ-জার্মান নৌ-চুক্তি – 1935 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের সঙ্গে জার্মানির একটি নৌ-চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে জার্মানি ব্রিটিশ নৌবহরের 35% হারে নৌশক্তি বৃদ্ধি করার অধিকার লাভ করে।
  5. কমিন্টার্ন বিরোধী চুক্তি – 1936 খ্রিস্টাব্দে জার্মানি, ইটালি ও জাপানের মধ্যে সাম্যবাদবিরোধী ‘অ্যান্টি-কমিন্টার্ন প্যাক্ট’ (Anti-Comintern Pact) স্বাক্ষরিত হয়।
  6. রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষজোট গঠন – 1937 খ্রিস্টাব্দে ইটালি, জার্মানি ও জাপানের মধ্যে একটি শক্তিজোট গড়ে ওঠে। এটি রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষজোট (Rome-Berlin-Tokyo Axis) নামে পরিচিত।
  7. মিউনিখ চুক্তি ও চেকোস্লোভাকিয়া অধিকারের চেষ্টা – চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতান অঞ্চল ছিল জার্মান জাতি অধ্যুষিত। হিটলার তাদের উপর নিপীড়নের মিথ্যা অজুহাতে সুদেতান অঞ্চল দখল করতে সচেষ্ট হন। এমতাবস্থায় ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন (Chamberlain), ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী দালাদিয়ের (Daladier), ইটালির মুসোলিনি (Mussolini) ও জার্মানির হিটলারের (Hitler) মধ্যে 1938 খ্রিস্টাব্দের 29 সেপ্টেম্বর ‘মিউনিখ চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে জার্মানি সুদেতান অঞ্চল লাভ করে।
  8. রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি – হিটলার পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে ঘোর শত্রু রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। 1939 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া ও জার্মানির মধ্যে দশ বছরের জন্য অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে জার্মানি ও রাশিয়া উভয়েই লাভবান হয়েছিল।

আগ্রাসন নীতি –

  1. স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ – স্পেনে প্রজাতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে জেনারেল ফ্রাঙ্কো (General Franco) যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। 1936 খ্রিস্টাব্দে স্পেনের এই গৃহযুদ্ধে হিটলার জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে সাহায্য করেছিলেন। ফলে জেনারেল ফ্রাঙ্কো জয়ী হয়েছিলেন।
  2. হিটলারের অস্ট্রিয়া জয় – হিটলারের উদ্দেশ্য ছিল জার্মান জনগণের একতাসাধন। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য 1938 খ্রিস্টাব্দে জার্মানবাহিনী অস্ট্রিয়া দখল করে। অস্ট্রিয়ার নতুন নির্বাচনে 99.75% জনগণ হিটলারকে সমর্থন করেছিল।
  3. হিটলারের পোল্যান্ড-নীতি – চেকোস্লোভাকিয়া দখলের পর হিটলার পোল্যান্ডের ডানজিগ বন্দর ও পোলিশ করিডর দাবি করেন। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তোষণনীতির ব্যর্থতা উপলব্ধি করে জার্মান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পোল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়।
  4. হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ – রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরের পর 1939 খ্রিস্টাব্দের 1 সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। পোল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে 3 সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।
১৯৪১-১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে নাৎসি জার্মানির অধিকারভুক্ত ইউরোপ

মূল্যায়ন – ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের অনৈক্য এবং তোষণনীতির কারণে হিটলারের পররাষ্ট্রনীতিতে কূটনৈতিক সাফল্য লক্ষ করা যায়। তবে তাঁর আগ্রাসী নীতি কালক্রমে তাঁর পতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের কারণ ও পরিণতি লেখো।

ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যর্থ হয়ে হিটলার 1941 খ্রিস্টাব্দের 22 জুন কোনোরকম যুদ্ধ ঘোষণা না করেই রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি (Russo-German Non-Aggression Pact) অস্বীকার করে রাশিয়া আক্রমণ করেন। এই আক্রমণের পিছনে একাধিক কারণ ছিল –

কারণ –

  1. কৌশল অবলম্বন – রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি ছিল হিটলারের একটি কৌশল মাত্র। ঐতিহাসিক অ্যালান বুলক (Allan Bullock)-এর মতে, এই চুক্তি ছিল তাঁর “One by One” নীতির ফলশ্রুতি। তিনি একসঙ্গে সমগ্র ইউরোপে আক্রমণ করতে চাননি। তাই পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ শেষ করে পূর্বে রাশিয়ার দিকে অগ্রসর হন।
  2. জার্মান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা – রাশিয়া কর্তৃক রোমানিয়া এবং তিনটি বাল্টিক রাজ্য যথাক্রমে এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া ও লাটভিয়া আক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই এই সকল অঞ্চলে জার্মান আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করেন।
  3. ইংল্যান্ড জয়ের বাসনা – কিছু ঐতিহাসিকের মতে, হিটলার আশা করেছিলেন রাশিয়াকে পরাজিত করতে পারলে পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত জার্মান বাহিনীকে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে।
  4. রুশ ব্যবহারে অসন্তুষ্টি – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকে রাশিয়া জার্মানিকে প্রচুর খাদ্য ও রসদ সরবরাহ করত। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপে ফ্রান্সের পতনের পর রুশ নেতারা জার্মানির সামরিক শক্তি সম্পর্কে আতঙ্কিত হয়ে খাদ্য ও অন্যান্য রসদ পাঠানো বন্ধ করে দেন। এতে জার্মানি ক্ষুব্ধ হয়।
  5. রাশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ – কিছু ঐতিহাসিকের মতে, রাশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করেন। তাঁদের মতে, হিটলার আশা করেছিলেন রাশিয়াকে পরাজিত করতে পারলে ইউক্রেনের গমের ভাণ্ডার ও বাকুর পেট্রোলিয়াম খনি তাঁর হস্তগত হবে, যা তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রে রসদের জোগান দেবে।
  6. সন্দেহ – জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে অনাক্রমণ চুক্তি থাকলেও কেউ কাউকে বিশ্বাস করত না। হিটলার সন্দেহ করতেন যে রাশিয়া হয়তো জার্মানিকে আক্রমণ করবে। এই জন্য তিনি রুশ সীমান্তে প্রচুর সৈন্য ও যুদ্ধ উপকরণ মোতায়েন রাখেন। “আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে আক্রমণ করা শ্রেয়” – এই নীতি অনুসরণ করে তিনি রাশিয়া আক্রমণ করেছিলেন।
  7. সাম্যবাদ – নাৎসি জার্মানি আদর্শগতভাবে কমিউনিস্ট রাশিয়ার শত্রু ছিল। তাই রাশিয়া আক্রান্ত হলে কমিউনিস্ট বিরোধী আমেরিকা ও ইংল্যান্ড সাহায্য করবে না – এই ধারণা নিয়ে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করেন।
হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের মানচিত্র

পরিণতি – উপরোক্ত বিভিন্ন কারণে 1941 খ্রিস্টাব্দের 22 জুন হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করেন। ৫ মাসের যুদ্ধে হিটলার রাশিয়ার 614,000 বর্গমাইল স্থান অধিকার করেন। কিন্তু 1942 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধে জার্মান বাহিনীর পরাজয় ঘটে। এই যুদ্ধে জার্মানির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধজয় রুশ বাহিনীকে উদ্দীপ্ত করে তোলে। 1943 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে জার্মান সেনাপতি ভন পাউলাস আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। এইভাবে হিটলারের রাশিয়া অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

মন্তব্য – নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মতো হিটলারের রাশিয়া অভিযান ব্যর্থ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতপুষ্ট রাশিয়া সফল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। এর ফলে বিশ্বযুদ্ধের গতি মিত্রপক্ষের অনুকূলে চলে যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটনে হিটলারের দায়িত্ব আলোচনা করো।

হিটলারের ভূমিকা – নাৎসি নেতা হিটলারের “মেইন ক্যাম্প” (Mein Kampf) গ্রন্থে হিটলার স্বয়ং Pan-Germanism ধারণার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেন। তিনি চেয়েছিলেন, ব্রিটেনের সহযোগিতায় জার্মানিকে এক বিশ্বশক্তিতে পরিণত করতে এবং সোভিয়েত রাশিয়া দখলের মাধ্যমে বাসযোগ্য ভূখণ্ডের সমস্যার সমাধান করতে। হিটলারের মতে, যুদ্ধ অনিবার্য ছিল; হয়তো কিছুটা পিছিয়ে দেওয়া যেত, কিন্তু তা এড়ানো যেত না। 1937 খ্রিস্টাব্দের “Hossbach Report”-এ যুদ্ধের অনিবার্যতার উল্লেখ রয়েছে।

হিটলারের ভার্সাই সন্ধি অমান্য – 1933 খ্রিস্টাব্দে হিটলার জার্মানির ক্ষমতা দখল করেন। এরপর তিনি ভার্সাই সন্ধির বিভিন্ন ধারা অমান্য করতে শুরু করেন। উদাহরণস্বরূপ –

  1. ক্ষতিপূরণ প্রদান বন্ধ করেন।
  2. সার অঞ্চল সংযুক্তিকরণে গণভোটকে প্রহসনে পরিণত করেন।
  3. বেসামরিক রাইন অঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ করেন।
  4. জার্মানিতে জেনারেল স্টাফ পদ পুনরায় চালু করেন।
  5. প্রথমে 36, পরে 65 ডিভিশন পদাতিক বাহিনী এবং বিমান ও নৌবহর গড়ে তোলেন।
  6. বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা চালু করেন।
  7. জার্মানির হারানো অঞ্চলগুলির পুনরুদ্ধারের দাবি করেন।

হিটলারের আগ্রাসী নীতি –

  1. স্পেন – সমকালীন ইউরোপে মুসোলিনি ও হিটলার একনায়করূপে আবির্ভূত হন। এই সময় স্পেনে রাজনৈতিক সংকটের কারণে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। বিদ্রোহী সেনাপতি ফ্রাঙ্কোকে হিটলার সামরিক সহায়তা দেন এবং সফল হন।
  2. অস্ট্রিয়া – প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির মিত্র ছিল অস্ট্রিয়া। যুদ্ধ শেষে জার্মানির মতো অস্ট্রিয়াও সেন্ট জার্মেইন সন্ধি দ্বারা শাস্তি লাভ করে। কিন্তু হিটলার অস্ট্রিয়ার রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে অস্থিরতা সৃষ্টি করেন এবং পরবর্তীতে বলপূর্বক অস্ট্রিয়া দখল করেন। তিনি এর নাম দেন “আনস্লুস”।
  3. চেকোশ্লোভাকিয়া – জার্মানির প্রতিবেশী নবগঠিত চেকোশ্লোভাকিয়া রাষ্ট্রের সুদেতান অঞ্চল জার্মান অধ্যুষিত ছিল। হিটলার এই অঞ্চলটি জার্মানির সঙ্গে সংযুক্তির দাবি করেন। 1938 খ্রিস্টাব্দের মিউনিখ চুক্তির মাধ্যমে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইটালি হিটলারের দাবি মেনে সুদেতান অঞ্চল জার্মানিকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু অল্পকালের মধ্যে হিটলার সমগ্র চেকোশ্লোভাকিয়া দখল করেন।
  4. মেমেল বন্দর দখল – হিটলার 1939 খ্রিস্টাব্দে জার্মানির প্রতিবেশী লিথুয়ানিয়ার মেমেল বন্দর দখল করেন।
  5. পোল্যান্ড – এরপর হিটলার পোল্যান্ডের ডানজিগ বন্দর দাবি করেন। জার্মানির সঙ্গে ডানজিগের সংযোগপথ পোলিশ করিডোর নিয়ে বিরোধের শেষ পর্যন্ত হিটলার 1 সেপ্টেম্বর, 1939 খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ড আক্রমণ করেন।

ঐতিহাসিকদের মতামত – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংঘটন হিটলারের দ্বারাই ত্বরান্বিত হয়েছিল কি না, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। ই. এইচ. কার (E. H. Carr), জি. হার্ডি (G. Herdy) প্রমুখের মতে, জার্মানির সাম্রাজ্যবিস্তার নীতি ও উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিণতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মরিস বুমন্ট (Maurice Baumont) বলেন যে, হিটলার কর্তৃক যুদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে হিটলারের যুদ্ধ রূপে অভিহিত করা অধিক যুক্তিযুক্ত। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব পরিকল্পিত ছিল। এ. জে. পি. টেলর (A. J. P. Taylor)-এর মতে এই বিশ্বযুদ্ধ মোটেই পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না। হিটলার মোটেও যুদ্ধ চাননি; তিনি স্নায়ুযুদ্ধের মাধ্যমে তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন।ক্ষ্যে পৌঁছোতে চেয়েছিলেন।

ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণনীতি (British and French Policy of Appeasement) গ্রহণের কারণ কী ছিল? কীভাবে তা রূপায়িত হয়? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য এই তোষণনীতি কতখানি দায়ী ছিল?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স কর্তৃক অনুসৃত জার্মানি ও ইতালির প্রতি তোষণনীতি (British and French Policy of Appeasement)। 1919 খ্রিস্টাব্দের ভার্সাই সন্ধির পর ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স ইউরোপের শান্তি বজায় রাখার জন্য ইতালি ও জার্মানিকে যে সুবিধা দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছিল, তা তোষণনীতি নামে পরিচিত। এই তোষণনীতির উদ্গাতা ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বাল্ডউইন (Baldwin) ও নেভিল চেম্বারলিন (Neville Chamberlain)।

ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণনীতি গ্রহণের কারণ

ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণনীতি গ্রহণের কারণগুলো ছিল –

  • ভার্সাই সন্ধির অন্যায় প্রতিকার – ভার্সাই সন্ধির পর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স মনে করেছিল যে, তারা ভার্সাই সন্ধিতে ইতালি ও জার্মানির প্রতি অন্যায় করেছে। সুতরাং এখন তাদের উচিত ইতালি ও জার্মানিকে কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা।
  • সাম্যবাদভীতি – ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের কাছে ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদ সমান বিপজ্জনক ছিল। তারা আপাতত সাম্যবাদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট জার্মানি ও ইতালিকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল।

ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণনীতির রূপায়ণ

  • সাম্রাজ্যবাদী স্পৃহা – 1931 খ্রিস্টাব্দে জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ এবং 1936 খ্রিস্টাব্দে ইতালির আবিসিনিয়া দখলের সময় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের উদাসীনতা একনায়কতন্ত্রী দেশগুলির সাম্রাজ্যবাদী স্পৃহাকে আরও বৃদ্ধি করে।
  • জার্মানির নৌশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা – ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বাল্ডউইনের আমলে 1935 খ্রিস্টাব্দে ইঙ্গ-জার্মান নৌ-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে জার্মানি তাদের নৌশক্তি ব্রিটিশ নৌবহরের 35% পর্যন্ত বৃদ্ধি করার অনুমতি লাভ করেছিল। ফলে জার্মানির নৌবহর শক্তিশালী হয়েছিল।
  • ইতালির আবিসিনিয়া দখলে উদাসীনতা – ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স ইতালির আবিসিনিয়া দখলের সময় উদাসীন থেকে পরোক্ষভাবে ইতালির সাম্রাজ্যবিস্তারে ইন্ধন জুগিয়েছিল।
  • রাইন উপত্যকা অধিকার – ভার্সাই ও লোকার্নো চুক্তির শর্তাবলি উপেক্ষা করে জার্মানি বিনা বাধায় রাইন অঞ্চলটি দখল (1936 খ্রি.) করলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তার কোনো প্রতিবাদ করেনি।
  • স্পেনে বিদ্রোহ – স্পেনের গৃহযুদ্ধে (1936-39 খ্রি.) রাশিয়ার মদতপুষ্ট প্রজাতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে জার্মানি ও ইতালি বিদ্রোহীদের নেতা ফ্রাঙ্কোর সমর্থনে এগিয়ে এলেও ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে।
  • অস্ট্রিয়ার সংযুক্তি – 1938 খ্রিস্টাব্দে জার্মানি-অস্ট্রিয়ার সংযুক্তিকরণের বিষয়ে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স তোষণনীতি অনুসরণ করে জার্মানির বিরুদ্ধে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে জার্মানি শক্তিশালী হয়েছিল।
  • মিউনিখ চুক্তি – মিউনিখ চুক্তি ছিল জার্মানির প্রতি ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের অনুসৃত তোষণনীতির চূড়ান্ত নিদর্শন। 1938 খ্রিস্টাব্দে মুসোলিনির মধ্যস্থতায় ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে মিউনিখ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে হিটলার চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতান অঞ্চল লাভ করে। এই চুক্তির ছয় মাসের মধ্যেই হিটলার সমগ্র চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নিয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য তোষণনীতির দায়িত্ব –

  • হিটলার ও মুসোলিনির শক্তিবৃদ্ধি – ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইতালি ও জার্মানিকে খুশি রেখে ইউরোপে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু ইতালি ও জার্মানির প্রতি তোষণনীতি গ্রহণের ফলে মুসোলিনি ও হিটলারের ক্ষমতা ও রাজ্যজয়ের আকাঙ্ক্ষা বেড়ে গিয়েছিল।
  • তোষণনীতির ব্যর্থতা – ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স অনুসৃত তোষণনীতির উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছিল। এর ফলে হিটলার ও মুসোলিনির সাম্রাজ্যবাদী স্পৃহা বেড়েছিল এবং এর চরম পরিণতি ছিল হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা। অধ্যাপক এ জে পি টেলর (A. J. P. Taylor) তোষণনীতিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী করেছেন।
  • হিটলারের শক্তিবৃদ্ধি – ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি জার্মানিকে খুশি করে ইউরোপের শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেও ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির এই তোষণনীতি জার্মান শাসক হিটলারের ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস ও রাজ্যজয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরও বৃদ্ধি করে তোষণনীতির মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয়।
  • চেকোস্লোভাকিয়া দখল – মিউনিখ চুক্তি একদিকে যেমন ছিল তোষণনীতির চূড়ান্ত পর্যায় তেমনি অন্যদিকে তার ব্যর্থতারও প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই চুক্তি স্বাক্ষরকালে হিটলার চেকোস্লোভাকিয়ার অবশিষ্ট অংশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রতিশ্রুতি দিলেও মাত্র ছয় মাসের মধ্যে সমগ্র চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে তোষণনীতির অসারতা প্রমাণ করেন।
  • ব্রিটিশ বিদেশনীতিতে পরিবর্তন – 1939 খ্রিস্টাব্দ থেকেই ব্রিটিশ বিদেশনীতিতে জার্মানবিরোধী প্রবণতা দেখা দেয় এবং জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণের পর ব্রিটেনের দিকে এগিয়ে আসতে পারে এই আশঙ্কায় ব্রিটেন-ফ্রান্স জার্মানির সঙ্গে সমঝোতার পথে এগিয়ে যায়।
  • রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি – একদিকে হিটলারের পশ্চিমের রণাঙ্গনে সর্বশক্তি প্রয়োগের প্রচেষ্টা ও অন্যদিকে রাশিয়ার সম্ভাব্য জার্মান আক্রমণ এড়ানোর অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে 1939 খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত হয় রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি।
  • যৌথ নিরাপত্তার সমাধি – তোষণনীতির সুযোগ নিয়ে মুসোলিনি আবিসিনিয়া দখলে (1936 খ্রি.) উৎসাহিত হলে কিংবা হিটলার রাইন অঞ্চলে সেনাসমাবেশ করলেও (1936 খ্রি.) পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলি ও জাতিসংঘ এ বিষয়ে নীরব থাকে। ফলে জাতিসংঘের যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার সমাধি রচিত হয়। তাই তোষণনীতির ব্যর্থতা প্রসঙ্গে ডেভিড থমসন বলেছেন, “যে চুক্তিগুলির উপর তোষণনীতি দাঁড়িয়েছিল সেগুলি চূড়ান্ত ভ্রান্ত হিসেবে প্রমাণিত হয়।”
  • পোল্যান্ড আক্রমণ – হিটলার ডানজিগ বন্দরে যাওয়ার জন্য পোলিশ করিডোর (Polish Corridor) দাবি করেন। কিন্তু এতে প্রত্যাখ্যাত হলে 1939 খ্রিস্টাব্দের 1 সেপ্টেম্বর তিনি পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। ব্রিটেন ও ফ্রান্স পোল্যান্ডের পক্ষে যোগ দিলে 3 সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।

মিউনিখ চুক্তি (Munich Agreement) কী? এই চুক্তির পটভূমি ও শর্ত কী ছিল? এই চুক্তির গুরুত্ব উল্লেখ করো।

মিউনিখ চুক্তি –

1938 খ্রিস্টাব্দের 29 সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলিন (Chamberlain), ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী দালাদিয়ের (Daladier), ইতালির মুসোলিনি (Mussolini) ও জার্মানির হিটলারের (Hitler) মধ্যে জার্মানির মিউনিখ শহরে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তা ‘মিউনিখ চুক্তি’ (Munich Agreement) নামে পরিচিত।

পটভূমি –

চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতেন অঞ্চলে প্রায় 3.5 মিলিয়ন জার্মান জাতির মানুষ বসবাস করত। হিটলার সুদেতেন অঞ্চলকে জার্মানির অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সুদেতেন-জার্মানদের নেতা কনরাড হেনলাইন (Konrad Henlein)-এর মাধ্যমে বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালান। হিটলার জোরপূর্বক সুদেতেন অঞ্চল দখল করতে চাইলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স হিটলারের সঙ্গে মিউনিখ চুক্তি স্বাক্ষর করে।

চুক্তির শর্ত –

মিউনিখ চুক্তির শর্তগুলি ছিল:

  1. সুদেতেন অঞ্চল জার্মানির অন্তর্ভুক্ত হবে।
  2. ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি ও চেকোস্লোভাকিয়ার প্রতিনিধিরা অবশিষ্ট চেকোস্লোভাকিয়ার সীমানা নির্ধারণ করবে।
সুদেতান অঞ্চল

চুক্তির গুরুত্ব –

  1. হিটলারের ইচ্ছাপূরণ: মিউনিখ চুক্তির ফলে হিটলারের ইচ্ছাপূরণ হয়। হিটলার জার্মান অধ্যুষিত সুদেতেন অঞ্চল লাভ করেন। চেকোস্লোভাকিয়া তার 5 মিলিয়ন প্রজা-সহ সাম্রাজ্যের এক-চতুর্থাংশ হারিয়েছিল।
  2. জার্মানির কূটনৈতিক সাফল্য: মিউনিখ চুক্তির মাধ্যমে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স, জার্মানির বিস্তারনীতিকে সমর্থন করেছিল, যা ছিল জার্মানির কূটনৈতিক সাফল্যের পরিচায়ক।
  3. তোষণনীতির বহিঃপ্রকাশ: জার্মানির প্রতি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের অনুসৃত তোষণনীতির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ছিল মিউনিখ চুক্তি। হিটলারের চাহিদামতো তাঁর হাতে সুদেতেন তুলে দেওয়া ছিল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দুর্বলতা ও স্বার্থপরতার নির্লজ্জ প্রকাশ।
  4. হিটলারের সামরিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ লাভ: মিউনিখ চুক্তির ফলে হিটলার সুদেতেন অঞ্চলের সামরিক শক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদ ও কলকারখানাগুলি লাভ করে জার্মানির অর্থনীতিকে মজবুত করে তুলেছিলেন।

মূল্যায়ন –

ঐতিহাসিক ডেভিড থমসন এই মিউনিখ চুক্তিকে ‘যৌথ ব্ল্যাকমেল’ ও ‘ধাপ্পার নীতি’ বলে অভিহিত করেছেন। মিউনিখ চুক্তি ছিল জার্মানির প্রতি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণনীতির চূড়ান্ত নিদর্শন।কমেল’ ও ‘ধাপ্পার নীতি’ বলে অভিহিত করেছেন। মিউনিখ চুক্তি ছিল জার্মানির প্রতি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণনীতির চূড়ান্ত নিদর্শন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (World War II) কারণগুলি কী কী ছিল?

ভূমিকা – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার 20 বছরের ব্যবধানে 1939 খ্রিস্টাব্দের 3 সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রনেতাগণ জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বকে ভয়াবহ যুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলিকে দুভাগে ভাগ করা যায়: যথা — পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কারণ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরোক্ষ কারণ:

  • ভার্সাই সন্ধির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া: 1919 খ্রিস্টাব্দে ভার্সাই সন্ধিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিজয়ী মিত্রপক্ষ জার্মানির উপর অপমানজনক ভার্সাই সন্ধির শর্ত চাপিয়ে দিয়েছিল, যা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জার্মান জাতির পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। বরং জার্মান জাতির মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠেছিল। জার্মানি এই একতরফা ও জবরদস্তিমূলক চুক্তি ভেঙে ফেলার সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তাই ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার যথার্থই বলেছেন যে, ভার্সাই চুক্তির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল।
  • উগ্র জাতীয়তাবাদ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল জার্মানি, ইতালি ও জাপানের উগ্র জাতীয়তাবাদী নীতি। হেরেনডক তত্ত্বে বিশ্বাসী হিটলার বলতেন, জার্মানরাই হল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি। তিনি জার্মানিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। হিটলারের আগ্রাসী নীতির সঙ্গে জার্মানির উগ্র জাতীয়তাবাদের সমন্বয়ে যে সাম্রাজ্যবাদী নীতির জন্ম হয়েছিল তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল।
  • অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ: জার্মানির অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল। এই অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদকে চরিতার্থ করতে নাৎসি দলের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে জার্মানিতে প্রাক-বিশ্বযুদ্ধকালীন সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
  • ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা: উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ভার্সাই সন্ধির ফলে জার্মানি তার উপনিবেশগুলি হারিয়েছিল এবং নতুন উপনিবেশ গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর ছিল। অপরদিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা প্রভৃতি রাষ্ট্রগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ বৃদ্ধি করেই চলেছিল। এমতাবস্থায় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রগুলি নতুন উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।
  • ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণনীতি: ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মানির প্রতি তোষণনীতি গ্রহণ করেছিল। তারা ভেবেছিল, এভাবে হিটলারকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু তাদের এই কর্মপন্থা হিটলারের আগ্রাসী মনোভাবকে চূড়ান্ত মাত্রা দেয়। তবে এক্ষেত্রে বলা ভালো, জার্মানির থেকে রাশিয়াকে আরও বিপজ্জনক মনে করেই জার্মানির প্রতি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তোষণনীতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এই তোষণনীতির ফলে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির আগ্রাসন আরও বৃদ্ধি পায়।
  • নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের ব্যর্থতা: জেনেভার নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে (1933 খ্রি.) বৃহৎ শক্তিবর্গ জার্মানির অস্ত্রশক্তি হ্রাসে অত্যন্ত উদগ্রীব হলেও তারা নিজেদের অস্ত্রশক্তি হ্রাস করতে রাজি ছিল না। জার্মানি নিজের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির সুযোগ না পেয়ে সম্মেলন ত্যাগ করে নিজের ইচ্ছামতো সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে।
  • জাতিসংঘের ব্যর্থতা: জাতিসংঘের ব্যর্থতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘ তার কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। জাতিসংঘ বৃহৎ শক্তিবর্গের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে অপারগ থাকায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল। ইতালির আবিসিনিয়া অধিকার কিংবা জাপানের মাঞ্জুরিয়া অধিকারের ঘটনায় জাতিসংঘ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল।
  • পরস্পরবিরোধী শক্তিজোট গঠন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে পরস্পরবিরোধী শক্তিজোট গঠন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচনা করেছিল। একদিকে জার্মানি, ইতালি, জাপান এই অতৃপ্ত রাষ্ট্রগুলি রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষশক্তি গঠন করেছিল। অপরদিকে জোটবদ্ধ হয়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স গঠন করেছিল মিত্রশক্তি। যুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যোগদান করে মিত্রশক্তিকে আরও জোরদার করেছিল।

প্রত্যক্ষ কারণ:

হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ। রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষশক্তি গঠন হওয়ার পর হিটলার পোলিশ করিডর দাবি করেন। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড এই ঘোষণার বিরোধিতা করে পোল্যান্ডের পক্ষ নেবে বলে হুমকি দেয়। এই হুমকি নস্যাৎ করে দিয়ে হিটলার 1939 খ্রিস্টাব্দের 1 সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পোল্যান্ডের সঙ্গে সামরিক সাহায্যের শর্তে চুক্তিবদ্ধ ছিল। তাই 3 সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পোল্যান্ডের পক্ষে ও জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।

সময়সারণির মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতি সম্পর্কে আলোচনা করো।

1939 খ্রিস্টাব্দের 1 সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে। 3 সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতি –

1939 খ্রিস্টাব্দ:

  • 1 সেপ্টেম্বর — জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণ – 1939 খ্রিস্টাব্দের 1 সেপ্টেম্বর জার্মান বাহিনী আচমকা পোল্যান্ড আক্রমণ করে। সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই জার্মান বাহিনী পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ দখল করে নেয়।
  • 17 সেপ্টেম্বর — রাশিয়ার পোল্যান্ড আক্রমণ – রুশ-জার্মান গোপন চুক্তি অনুসারে রাশিয়া 17 সেপ্টেম্বর পূর্ব পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এক মাসের মধ্যেই জার্মানি ও রাশিয়া যথাক্রমে পশ্চিম ও পূর্ব পোল্যান্ড দখল করে নেয়।
  • 30 নভেম্বর — রাশিয়ার ফিনল্যান্ড আক্রমণ – রাশিয়া 1939 খ্রিস্টাব্দের 30 নভেম্বর ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে।

1940 খ্রিস্টাব্দ:

  • জুন — রাশিয়া বাল্টিক অঞ্চলের তিনটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া দখল করে নেয়।
  • পশ্চিম ইউরোপে জার্মানির দ্রুত অগ্রগতি — জার্মান বাহিনী দ্রুত গতিতে একের পর এক পশ্চিম ইউরোপের দেশ হল্যান্ড, লুক্সেমবুর্গ ও বেলজিয়াম দখল করে নেয়।
  • জার্মানির ফ্রান্স আক্রমণ — জার্মান বাহিনী ফ্রান্সকে তিনদিক থেকে আক্রমণ করে। ফলে 1940 খ্রিস্টাব্দের 21 জুনের মধ্যে ফ্রান্স আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
  • জার্মানির ব্রিটেন আক্রমণ — এরপর জার্মানি ব্রিটেন আক্রমণের চেষ্টা করে। কিন্তু জার্মান বাহিনী ব্রিটিশ নৌবাহিনীর বাধা পেরিয়ে ব্রিটেনে প্রবেশ করতে পারে না। এই অবস্থায় জার্মান বিমানবাহিনী ব্রিটেনের উপর বোমাবর্ষণ করতে শুরু করে। কিন্তু ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর আক্রমণে জার্মান বাহিনী ব্যর্থ হয়।

1941 খ্রিস্টাব্দ:

  • 22 জুন — জার্মানির রাশিয়া আক্রমণ – জার্মানি রাশিয়ার সঙ্গে 10 বছরের জন্য অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। সেই চুক্তি অগ্রাহ্য করে 1941 খ্রিস্টাব্দের 22 জুন জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করে। প্রথমদিকে জার্মানি রাশিয়ার কিয়েভ, ওডেসা, রোস্তভ প্রভৃতি অঞ্চল দখল করে নেয়।
  • রাশিয়ায় জার্মানির পরাজয় — রাশিয়ায় তীব্র শীত শুরু হলে এবং রুশ বাহিনীর আক্রমণে জার্মান বাহিনী বিধ্বস্ত হয়। 1942 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে বিখ্যাত স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে 1943 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জার্মান বাহিনী পর্যুদস্ত হয়।

1944-1945 খ্রিস্টাব্দ:

  • জাপানের আত্মসমর্পণ — জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে 1941 খ্রিস্টাব্দে। 7 ডিসেম্বর জাপান আমেরিকার নৌ-ঘাঁটি পার্ল হারবার আক্রমণ করে। এরপর ইতালি ও জার্মানি আত্মসমর্পণ করায় মিত্রশক্তি জাপানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমেরিকা 1945 খ্রিস্টাব্দের 6 ও 9 আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে দুটি পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করে। শহর দুটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ফলে জাপান বাধ্য হয়ে 1945 খ্রিস্টাব্দের 2 সেপ্টেম্বর মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে।
  • জার্মানির আত্মসমর্পণ — রাশিয়ার স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর 1944 খ্রিস্টাব্দের 6 জুন ব্রিটিশ ও আমেরিকান সেনাবাহিনী ফ্রান্সের নর্মান্ডি উপকূলে এসে নামে। এই দিনটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে মুক্তি দিবস বা D-Day নামে পরিচিত। ব্রিটেন, রাশিয়া-সহ মিত্রবাহিনীর আক্রমণে 7 মে জার্মানি আত্মসমর্পণ করে। এই ঘটনার জন্য 1945 খ্রিস্টাব্দের 8 মে সমগ্র ইউরোপে বিজয় দিবস বা Victory in Europe Day বা সংক্ষেপে VE Day পালিত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে (1939-1945 খ্রি.) পরমাণু বোমার আবিষ্কার ও প্রয়োগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে (1939-1945 খ্রি.) যুদ্ধাস্ত্রের ক্ষেত্রে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধাস্ত্রটি ছিল পরমাণু বোমা। 1939 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1945 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পরমাণু বোমার আবিষ্কার, পরীক্ষা ও প্রয়োগ ঘটতে দেখা যায়।

  • পরমাণু বোমা – পরমাণু বোমা হল এক বিধ্বংসী ও ভয়ংকর বোমা। পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা নিউট্রনকে বিদীর্ণ করে নির্দিষ্ট ওজনের এই বোমা তৈরি করতে হয়। ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, প্লুটোনিয়াম সমৃদ্ধ এই বোমা আবিষ্কার সংক্রান্ত পরীক্ষানিরীক্ষার পথিকৃৎ ছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী অটো হান।
  • পরমাণু বোমার আবিষ্কার – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকজন প্রবাসী বিজ্ঞানীর ইচ্ছায় 1939 খ্রিস্টাব্দের 2 আগস্ট বিজ্ঞানী আইনস্টাইন (Einstein) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে এক নতুন ধরনের বোমা তৈরির কথা জানিয়ে চিঠি লেখেন। 1941 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু বোমা তৈরির প্রচেষ্টা শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ম্যানহাটন প্রকল্পের (1942-1946 খ্রি.) মাধ্যমে প্রথম পরমাণু বোমা তৈরি করে। প্রথমে তিনটি বোমা তৈরি হয়। একটি পরীক্ষামূলকভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। অন্য দুটি লিটল বয় ও ফ্যাট ম্যান জাপানে বর্ষিত হয়।
  • উদ্দেশ্য – ইউরোপে জার্মানির পরাজয়ের ক্ষেত্রে রাশিয়ার বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম মিত্রপক্ষের বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে ম্লান করে দেয়। তাই জাপান বিরোধী যুদ্ধে রাশিয়াকে বাদ দিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অগ্রণী ভূমিকা নিতে চেয়েছিল। সেজন্য নব আবিষ্কৃত এই বোমার প্রয়োগ করেছিল জাপানের উপর।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে পরমাণু বোমার প্রয়োগ –
    • পরীক্ষামূলক প্রয়োগ – পরমাণু বোমাকে অস্ত্র হিসেবে প্রথম পরীক্ষা করা হয় 1945 খ্রিস্টাব্দের 16 জুলাই। এই দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো রাজ্যে আলামোগোর্ডোর কাছে পরমাণু বোমার প্রথম সফল পরীক্ষা হয়।
    • জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বিস্ফোরণ – 1945 খ্রিস্টাব্দের মে মাসে জার্মানির আত্মসমর্পণের পরেও জাপানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ চলছিল। এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 1945 খ্রিস্টাব্দের 6 ও 9 আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে দুটি পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করে।
  • ফলাফল – জাপানে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের ফলে –
    • কয়েক লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
    • জাপান 1945 খ্রিস্টাব্দের 2 সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। পৃথিবী পরমাণু যুগে প্রবেশ করে।

পরিশেষে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই পরমাণু বোমা ভয়ংকর অস্ত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর পাশাপাশি পরমাণু বোমার মতো মারাত্মক অস্ত্রের প্রয়োগ বন্ধ করারও প্রচেষ্টা চলছে।”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগদানের কারণ কী ছিল?

থম বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের রাজনীতির ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকার নীতি গ্রহণ করেছিল। তাই 1939 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আমেরিকা কোনো পক্ষে যোগ দেয়নি। কিন্তু কয়েকটি ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে এসে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগদানের কারণগুলোকে দুভাগে ভাগ করা যায় –

  1. পরোক্ষ কারণ
  2. প্রত্যক্ষ কারণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ কারণ:

  1. আমেরিকার ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি (Cash and Carry) নীতি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় জার্মানির সাফল্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শঙ্কিত করে তুলেছিল। এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক দেশগুলিকে অর্থের বিনিময়ে যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করার নীতি গ্রহণ করে, যা ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি (Cash and Carry) নীতি নামে পরিচিত। ফলে আমেরিকা নাৎসিবাদী জার্মানির বিরোধীশক্তিকে সাহায্য করে।
  2. লেন্ড-লিজ আইন (Lend-Lease Law): আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট 1941 খ্রিস্টাব্দে মার্কিন সিনেটে লেন্ড-লিজ আইন পাস করেন। এই আইনে বলা হয়, আমেরিকা মিত্রপক্ষভুক্ত দেশগুলিকে সবরকম যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে। এই আইনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার (Arsenal of Democracy) এ পরিণত করা হয়।
  3. রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষজোট (Rome-Berlin-Tokyo Axis): ইটালি, জার্মানি ও জাপানের মধ্যে রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শঙ্কিত হয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন ও ইন্দোচীন থেকে জাপানি সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের সঙ্গে সমস্তরকম বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং জাপান বিরোধী ইন্দোনেশিয়াকে সমর্থন করে।
  4. গণতন্ত্র রক্ষা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে ও গণতন্ত্রের মড়ক শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথমদিকে ফ্যাসিবাদের জয়জয়কার দেখা যায়। পোল্যান্ড ও ফ্রান্সের পতন ঘটে। অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া আগেই জার্মানির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় গণতন্ত্র রক্ষায় সচেষ্ট হয়।
  5. বাণিজ্য রক্ষা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যস্ত ইংল্যান্ডের উপনিবেশগুলিতে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের জোগান দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলে মার্কিন বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এমতাবস্থায় ফ্যাসিস্ট শক্তি সফল হলে মার্কিন বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে, এই আশঙ্কা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ কারণ:

  1. পার্ল হারবার ঘটনা: 1941 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হন হিদেকি তোজো (Hideki Tojo)। জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিবাদ আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নেওয়ার জন্য ওয়াশিংটনে এক বৈঠকে মিলিত হয়। কিন্তু বৈঠক চলাকালে 1941 খ্রিস্টাব্দের 7 ডিসেম্বর হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-ঘাঁটি পার্ল হারবারে জাপান আক্রমণ করে। জাপানের আক্রমণে পার্ল হারবার ধ্বংস হয়। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরের দিন অর্থাৎ 8 ডিসেম্বর জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। 10 ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানি ও ইটালির বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করে। এইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী ছিল?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বরাজনীতিতে নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ইতালি ও জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং জাপানের আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিচলিত করে তোলে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা –

  • রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের ভূমিকা – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। যদিও প্রথমদিকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিত্রপক্ষের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল।
  • ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি (Cash and Carry) নীতি গ্রহণ – 1939 সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর 1939 সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে অর্থের বিনিময়ে অস্ত্র ও যুদ্ধের বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহের নীতি গ্রহণ করে। এই নীতি ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি নীতি নামে পরিচিত। এর ফলে মিত্রপক্ষের রাষ্ট্রগুলি অনেক উপকৃত হয়েছিল।
  • জার্মান ভীতির ফলে নিরপেক্ষতার নীতি ত্যাগ – 1940 সালের জুন মাসে জার্মানির হাতে ফ্রান্সের পতন ঘটে। এরপর জার্মানি ইংল্যান্ডের উপর বিমান আক্রমণ শুরু করে। জার্মানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ ও অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হতে শুরু করে এবং নিরপেক্ষতার নীতি ত্যাগ করে। জার্মানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যজাহাজ আক্রমণ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির জাহাজগুলিকে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয়।
  • লেন্ড-লিজ আইন (Lend-Lease Law) পাস – 1941 সালের মার্চ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লেন্ড-লিজ আইন পাস করে গণতান্ত্রিক মিত্রপক্ষকে সমস্তরকম অস্ত্র সাহায্যের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার (Arsenal of Democracy) বলে অভিহিত করা হয়।
  • জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণ – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির সহযোগী জাপানের আগ্রাসী নীতির বিরোধিতা করে এবং জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এতে বিক্ষুব্ধ জাপান 1941 সালের 7 ডিসেম্বর প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-ঘাঁটি পার্ল হারবার ধ্বংস করে দেয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 8 ডিসেম্বর জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং মিত্রপক্ষে যোগদান করে।
  • রাশিয়াকে সাহায্য দান – জার্মানি ইতিমধ্যে রাশিয়াকে আক্রমণ করেছিল (22 জুন, 1941)। এই আক্রমণে রাশিয়ার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। জার্মান আক্রমণ মোকাবিলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে সাহায্য করে। মার্কিন নৌবহর ভ্লাডিভোস্টক বন্দর দিয়ে যুদ্ধাস্ত্র ও রসদ পাঠায়। এছাড়া ইরানের মধ্য দিয়ে সরবরাহ পথ তৈরি করে রাশিয়ায় সাহায্য পৌঁছে দেয়।
  • মিত্রপক্ষকে সাহায্য দান – উত্তর আফ্রিকার রণাঙ্গনে অক্ষশক্তিকে প্রতিরোধ করতে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করে। এরপর জার্মানির বিরুদ্ধে ইউরোপে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খুলে দেয়। এরপরই জার্মান বাহিনীর বিপর্যয় শুরু হয়।
  • জাপানের উপর পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ – 1945 সালের 26 জুলাই মিত্রপক্ষ জাপানের আত্মসমর্পণ দাবি করে কিন্তু জাপান এতে কর্ণপাত করেনি। এর ফলস্বরূপ 1945 সালের 6 আগস্ট হিরোশিমা ও 9 আগস্ট নাগাসাকির উপর পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এরপর 2 সেপ্টেম্বর জাপান আত্মসমর্পণ করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে।

এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বিশ্ব ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব লেখো।

ভূমিকা – 1939 থেকে 1945 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। এই যুদ্ধেই সর্বপ্রথম পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে বিশ্ববাসী পরিচিত হয়েছিল। বিভিন্ন প্রধানমন্ত্রী মিউনিখ চুক্তি দ্বারা সম্মান অর্জন করেছিলেন। ফলে ইংরেজ অভিধানে ‘সম্মান’ কথাটির অর্থ সমাজ, অর্থনীতি প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক প্রভাব পড়ে।

বিশ্ব ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব –

  • সাম্রাজ্যবাদের পতন – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে যে সাম্রাজ্যবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, তা যুদ্ধের পর অনেকাংশে হ্রাস পায়। এই সময় বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জন্মলাভ করে। এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশ এই সময় স্বাধীনতা লাভ করে।
  • অক্ষশক্তির প্রাধান্য হ্রাস – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইতালি, জার্মানি ও জাপান অর্থাৎ অক্ষশক্তি যে শক্তি ও প্রাধান্য অর্জন করেছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে তার অবসান ঘটে। 1943 খ্রিস্টাব্দে মিত্রশক্তি রোম অধিকার করলে ইতালির, 1945 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার লাল ফৌজ বার্লিন দখল করলে জার্মানির এবং 1945 খ্রিস্টাব্দে মার্কিন সরকার হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা নিক্ষেপ করলে জাপানের পরাজয় ঘটে।
  • বিজয়ী শক্তির উপর প্রভাব – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী ইউরোপীয় শক্তির অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। জনবল, জাতীয় সম্পদ, শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষয়ক্ষতির ধাক্কায় ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি বিজয়ী শক্তিগুলির অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে।
  • জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে লীগ অব নেশনসের পতন হয় এবং বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সম্মিলিত জাতিসংঘের (United Nations Organisation) প্রতিষ্ঠা হয়।
  • আর্থিক পুনর্বাসন – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমগ্র পৃথিবীতে কমবেশি আর্থিক প্রভাব ফেলেছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলির মৃতপ্রায় অর্থনীতিকে সচল করার উদ্দেশ্যে 1943 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে আমেরিকার ওয়াশিংটন শহরে জাতিসংঘ ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংস্থা বা UNRRA (United Nations Relief and Rehabilitation Administration) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সাহায্যের ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশের বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন, কৃষি ও শিল্পের পুনরুজ্জীবন, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি প্রভৃতি সম্ভব হয়।
  • দ্বি-মেরু বিশ্বের আবির্ভাব – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যেমন ইউরোপ মহাদেশের একক প্রাধান্য হ্রাস করে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রবর্গকে (ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল, ঠিক তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ও গুরুত্ব বৃদ্ধি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে সমগ্র বিশ্ব দুটি পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই দুই গোষ্ঠীর একদিকে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অপরদিকে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া আলোচ্য পর্বে ভারতের নেতৃত্বে এশিয়া ও আফ্রিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলিকে নিয়ে জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল।
  • আমেরিকার আধিপত্য – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশগুলির মধ্যে একমাত্র আমেরিকা সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে যুদ্ধের পর আমেরিকা বিশ্বের সর্ববৃহৎ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং বিশ্ব রাজনীতিতে সক্রিয় হস্তক্ষেপের নীতি গ্রহণ করে।
  • ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির দ্বারা আক্রান্ত হয়। তার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই অবস্থায় জার্মান আক্রমণের চাপ কমানোর জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলার আবেদন জানায়। কিন্তু আবেদন গ্রাহ্য না হওয়ায় তখন থেকেই আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে অবিশ্বাস ও পারস্পরিক উত্তেজনা শুরু হয়। এরপর প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ফুলটন বক্তৃতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরমাণু শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার এবং সোভিয়েত লাল বাহিনীর আক্রমণ থেকে ইউরোপীয় সভ্যতাকে রক্ষার আহ্বান জানান। এর ফলে ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা হয়।
  • জাতীয়তাবাদের বিকাশ – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক দেশগুলির সাফল্য। ফলে গণতন্ত্র জয়যুক্ত হলে সমগ্র বিশ্বে নতুন আবহের সূত্রপাত হয়। সমাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্রে বিভক্ত পৃথিবীর মেরুকরণে জাতীয়তাবাদী মানসিকতা গড়ে উঠতে থাকে। এই সময় বিভিন্ন উপনিবেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটতে থাকে।
  • তৃতীয় বিশ্বের উদ্ভব – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের মতো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে। যুদ্ধের প্রভাবে উপনিবেশগুলিতে জনজাগরণ ঘটে এবং অনেক উপনিবেশ স্বাধীন হয়। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় এই সদ্য স্বাধীন দেশগুলি নিয়ে তৃতীয় বিশ্বের উদ্ভব হয়।
  • পরমাণু যুগের সূচনা – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম পরমাণু বোমা তৈরি ও ব্যবহার করে। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন পরমাণু শক্তিধর হয়। একে একে অনেক দেশ পরমাণু শক্তিধর হয়ে ওঠে। শুরু হয় পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা।
  • উপসংহার – এই সমস্ত বিষয়গুলি ছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উদ্ভূত পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও শান্তির ক্ষেত্রে সমস্যা, ঔপনিবেশিক সমস্যা, মারণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণের সমস্যা প্রভৃতিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সুদূরপ্রসারী ফল ছিল আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এই যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মানবজাতি যে শিক্ষা নিয়েছিল, তার কারণেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আজও স্থগিত রয়েছে।

আজকের এই আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর ইতিহাসের পঞ্চম অধ্যায়, “বিংশ শতকে ইউরোপ” অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নগুলো নবম শ্রেণীর পরীক্ষার প্রস্তুতি বা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সহায়ক হবে, কারণ এগুলো প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের কাজে এসেছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, তবে টেলিগ্রামে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি সর্বদা প্রস্তুত থাকব। ধন্যবাদ।

Share via:

মন্তব্য করুন