মাধ্যমিক ইতিহাস – সংস্কার – বৈশিষ্ট ও পর্যালোচনা

ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম দিককার পর্যায়ে সংস্কার আন্দোলন ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করা। এই আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেনবংশী, রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ।

Table of Contents

সংস্কার-বৈশিষ্ট ও পর্যালোচনা-Class 10 History

ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নোত্তর

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় বাংলার সমাজব্যবস্থার কোন্ কোন্ দিক প্রতিফলিত হয়েছে তা ব্যাখ্যা করো। গ্রামবার্তা প্রকাশিকার বিভিন্ন দিক চিহ্নিত করো।

প্রথম অংশ – সমকালীন সংবাদপত্র উনিশ শতকের সমাজের বিভিন্ন দিকের বর্ণনা পাওয়া যায় থেকে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হিন্দু প্যাট্রিয়ট নামক ইংরেজি সংবাদপত্র। এটি থেকে গ্রামীণ সমাজ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথা জানা যায়।

  • সমাজজীবন – হিন্দু প্যাট্রিয়টের বর্ণনা থেকে সমাজজীবনের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি এভাবে চিহ্নিত করা যায় –
  • কৃষিকাজ – গ্রামীণ সমাজে জমিদারদের উপস্থিতি থাকলেও কৃষকেরা আউশ ও আমন চাষের মাধ্যমে সারা বছরের খাদ্যশস্য জোগাড় করত। তবে নীলচাষের ব্যাপক প্রসার ঘটলে কৃষকেরা তাদের আউশ জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য হয়।
  • অলাভজনক নীলচাষ – কৃষকদের কাছে নীলচাষ ছিল। অলাভজনক। তাই কৃষকরা নীলচাষে অসম্মতি জানায়। অবশ্য যে কৃষক একবার নীলকর সাহেবের কাছ থেকে নীলচাষের জন্য অগ্রিম অর্থ বা দাদন গ্রহণ করেছিল তাদের নীলচাষ থেকে অব্যাহতি ছিল না। শেষ পর্যন্ত নীলচাষিরা নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
  • আদিবাসী বিদ্রোহ – হিন্দু প্যাট্রিয়ট থেকে বাংলার আদিবাসী সমাজের কথা ও সাঁওতাল বিদ্রোহের কথাও জানা যায়। এই পত্রিকার মতে, জোরপূর্বক সাঁওতালদের বেগার খাটানো, অতিরিক্ত খাজনার দাবি ও অর্থনৈতিক শোষণই ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।
  • মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অবস্থা – উনিশ শতকে খাদ্যশস্যের বদলে অর্থকরী ফসল (যেমন-পাট, তুলা, তৈলবীজ, আখ) চাষ ও তা বিদেশে রফতানির কারণে কৃষিপণ্য ও খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি পেলে জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • বেকারত্ব বৃদ্ধি – শিক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। এই পত্রিকায় বলা হয় যে, কৃষি ও বাণিজ্য ছাড়া শিক্ষিতদের সামনে আর কোন বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা নেই।
  • উপসংহার – হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় যেভাবে বাংলার সমাজব্যবস্থা প্রতিফলিত হয়েছিল তা মূলত জাতীয়তাবাদীর দৃষ্টিভঙ্গিতে ফুটিয়ে তোলা। এই পত্রিকার বক্তব্যেও ছিল স্বদেশি মেজাজ।

দ্বিতীয় অংশ – গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামক সাময়িকপত্র থেকেও উনিশ শতকের বাংলার সমাজব্যবস্থার চিত্র পাওয়া যায়। এই পত্রিকার বিভিন্ন দিক হল –

  • পত্রিকার প্রকাশ – কুমারখালি বাংলা পাঠশালার প্রধান শিক্ষক হরিনাথ মজুমদার ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রকাশ করেন। এটির মোট ১৯টি ভাগ প্রকাশিত হয়েছিল।
  • গ্রামবাসীর উপকার – গ্রাম ও গ্রামবাসী প্রজাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও প্রজাদের উপর অত্যাচারের কথা সরকারের কাছে জানানো এবং তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করাই ছিল এই পত্রিকার প্রধান উদ্দেশ্য। প্রজাদের উপর সরকার ও জমিদারদের অত্যাচারের কথা এই পত্রিকা থেকে জানা যায়।
  • স্থানীয় ইতিহাস – গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় হরিনাথ মজুমদার শাস্তিপুর উলাদি উপনগরের প্রাচীন ইতিহাস তুলে ধরেছিলেন। এছাড়া তৎকালীন বাংলার মেহেরপুর, চাকদহ ও উলা প্রভৃতি স্থানের দুর্ভিক্ষ ও মহামারির কথাও বর্ণিত হয়েছিল।

প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্ক কী? মেকলে মিনিট কী?

প্রথম অংশ – ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্টে এদেশের শিক্ষাখাতে প্রতি বছর একলক্ষ টাকা বরাদ্দকরণ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু এই টাকা প্রাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে খরচ করা হবে সে সম্পর্কে ১৮২০-র দশকে এক তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়, যা প্রাচ্য শিক্ষা-পাশ্চাত্য শিক্ষা-বিষয়ক দ্বন্দ্ব নামে পরিচিত।

  • বিতর্ক – ওই সময়ে যারা প্রাচ্য ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাচর্চার কথা বলেন তাঁরা প্রাচ্যবাদী এবং যাঁরা ইংরেজির মাধ্যমে শিক্ষাচর্চার কথা বলেন তাঁরা পাশ্চাত্যবাদী নামে পরিচিত হন। জেমস প্রিন্সেপ, কোলব্রুক প্রমুখ প্রাচ্যবাদীদের মত ছিল। দেশীয় ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো। অন্যদিকে লর্ড মেকলে, চার্লস গ্রান্ট প্রমুখ পাশ্চাত্যবাদীদের উদ্দেশ্য ছিল মূলত ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো। ভারতীয়দের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় ছিলেন পাশ্চাত্যবাদী, পক্ষান্তরে রাজা রাধাকান্ত দেব প্রমুখ ছিলেন প্রাচ্যবাদী। রাজা রামমোহন রায় কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি করেন। ভারতে ইংরেজি শিক্ষা-বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রাচ্যবাদী- পাশ্চাত্যবাদী বিতর্কে শেষ পর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীদের মতই সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক মেকলে মিনিট-এর ভিত্তিতে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার প্রসারকে সরকারি নীতি বলে ঘোষণা করেন।
  • মূল্যায়ণ – ভারতের বাংলা প্রদেশে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্ক শুরু হলেও বোম্বাই প্রদেশসহ অন্যান্য প্রদেশে অনুরূপ বিতর্ক হয়নি। এই স্থানগুলিতে পাশ্চাত্য শিক্ষারীতিই গৃহীত হয়েছিল। যাইহোক, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্কের অবসানের ফলে ভারতে দ্রুত পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে।

দ্বিতীয় অংশ – বড়োলার্ট উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনকালে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে মেকলে মিনিট ছিল খুব তাৎপর্যপূর্ণ। টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে বড়োলাটের পরিষদে আইন সদস্যরূপে যোগ দেন ও পরবর্তীকালে শিক্ষাসভার সভাপতি হন। তিনি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে সচেষ্ট হন এবং ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ করেন। তাঁর মতের সমর্থনে যুক্তি দেন যে-

  • ভারতীয় ভাষার দৈন্যতা – ভারতের ভাষাসমূহ অত্যন্ত ক্ষীণ, দৈন্য ও ঐশ্বর্যহীন। তাই ভারতীয়দের মাতৃভাষাগুলি শিক্ষার বাহনরূপে যথার্থ ভূমিকা পালনে অক্ষম। তিনি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন যে, সমস্ত ভারত ও আরবের যে প্রাচীন সাহিত্য রয়েছে তা ইউরোপীয় ভাষা অপেক্ষা নিকৃষ্টতর।
  • ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব – তিনি মনে করেন যে, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য হল জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক অফুরন্ত খনি। তাই ইংরেজি ভাষা প্রবর্তিত হলে ভারতে নবজীবনের সূচনা হবে। তাছাড়া ব্রিটিশ প্রশাসনে ইংরেজি ভাষা জানা কর্মচারী নিয়োগ করাও সম্ভব হবে। মেকলে মিনিট প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের নীতি গৃহীত হয়। তাই ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে মেকলে মিনিট ছিল খুব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

বাংলার সরকারি উদ্যোগে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তার কীভাবে হয়েছিল? এর ফলাফল বিশ্লেষণ করো।

  • ভূমিকা – বাংলায় উনিশ শতকের প্রথমে মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে। কিন্তু সামাজিক ও প্রশাসনিক কারণে ভারতে ইংরেজ কোম্পানি ভারতীয়দের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

ব্রিটিশ শিক্ষানীতি –

  • ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্ট – ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের একটি ধারায় ভারতে জনশিক্ষার জন্য কোম্পানিকে প্রতি বছর অন্তত এক লক্ষ টাকা ব্যয়বরাদ্দ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে কোম্পানির উদ্যোগে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন বা জনশিক্ষা কমিটি গঠিত হয়।
  • মেকলে মিনিট – গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্কের শাসনকালে আইন সচিব টমাস ব্যাবিংটন মেকলের উদ্যোগে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ ইংরেজি শিক্ষাকে সরকারি নীতি বলে ঘোষণা করা হলে সরকারি শিক্ষানীতিতে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে
    • কলকাতায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ
    • বোম্বাইয়ে এলফিনস্টোন ইনস্টিটিউশন
    • মাদ্রাজে মাদ্রাজ ইউনিভারসিটি হাই স্কুল এবং
    • রুরকি-তে থমসন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপিত হয়।
  • হাজির ঘোষণা – ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর লর্ড হার্ডিও ঘোষণা করেন যে, এবার থেকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সময় ইংরেজি ভাষায় দক্ষ লোকেরেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এই ঘোষণার পর থেকে মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষায় প্রবল আগ্রহ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি বিদ্যালয় ও তাদের ছাত্র সংখ্যা দুটোই বাড়তে থাকে।
  • উডের ডেসপ্যাচ – ভারতবর্ষের শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উচ্চ শিক্ষা সংক্রান্ত এক নির্দেশনামা জারি করেন। ভারতের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসারের জন্য চার্লস উডের বিভিন্ন সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল –
  • নিম্নতম শ্রেণি থেকে উচ্চতর শ্রেণি পর্যন্ত যথাযথ সমন্বয়মূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন
  • সরকারি শিক্ষাবিভাগ স্থাপন
  • প্রত্যেক প্রেসিডেন্সি শহরে (অর্থাৎ-কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ শহরে) একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন।
  • হান্টার কমিশন – ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হান্টার কমিশন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সরকারি অনুদান সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ করতে সচেষ্ট হয়। প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারের জন্য বেশ কিছু সুপারিশও করে। সরকারি সাহায্যে বিদ্যালয়ে লাইব্রেরি স্থাপন, মেধাবি ছাত্রদের বৃত্তিদান ও স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে।

দ্বিতীয় অংশ – উনিশ শতকের ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবগুলি হল –

  • যুক্তিবাদের প্রসার – পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে ভারতবাসীর মধ্যে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার পরিবর্তন ঘটে এবং যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার প্রতিষ্ঠা হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতে যুক্তিবাদী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়।
  • পাশ্চাত্যবাদী আদর্শের প্রসার – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতবাসীরা পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাস, জ্ঞান-বিজ্ঞান, মানবতাবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, যুক্তিবাদ প্রভৃতি উচ্চ আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে।
  • ধর্ম ও সমাজসংস্কার – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকের শিক্ষিত ভারতীয়রা কুসংস্কারমুক্ত হয়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, রাজনীতি, সমাজতন্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে প্রগতিমূলক চিন্তাভাবনার উন্মেষ হয়। ভারতে নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের বিস্তার ঘটে। ভারতে ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। পরিশেষে বলা যায় যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে, যা পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিণতি লাভ করেছিল।

ভারতে বেসরকারি উদ্যোগে কীভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে? এ প্রসঙ্গে রাধাকান্ত দেবের ভূমিকা উল্লেখ করো।

প্রথম অংশ – ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার শুরু হয় বেসরকারি ও খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে। প্রাথমিক পর্বে সরকারি উদ্যোগের বিষয়টি একেবারেই ছিল না।

পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগ –

  • প্রাথমিক পর্ব – ভারতে কোম্পানির শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদেশে নিত্যনতুন ইংরেজদের সওদাগরি অফিস, আইন-আদালত, সরকারি অফিস-কাছারি ও বাণিজ প্রতিষ্ঠান চালু হতে থাকে। এই সময় থেকে ইংরেজদের প্রতিষ্ঠানগুলিতে চাকরি পাওয়ার আশায় বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই যুগে শোরবোর্ন, ডেভিড ড্রামন্ড প্রমুখ বিদেশি কলকাতায় ইংরেজি শেখার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
  • উনিশ শতকে উদ্যোগ – উনিশ শতকের বেসরকারি ইংরেজি স্কুল-কলেজগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল, ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ডেভিড হেয়ারের উদোগে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজ (পরবর্তীকালের প্রেসিডেন্সি কলেজ) এবং ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত পটলডাঙ অ্যাকাডেমি (পরবর্তীকালের হেয়ার স্কুল)।

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে খ্রিস্টান মিশনারিদের অবদান –

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারও করতে থাকেন, যেমন –

  • শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগ – শ্রীরামপুরে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড নামে তিনজন খ্রিস্টান মিশনারি শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠান প্রায় ১২৬টি বিদ্যালয় স্থাপন করে। এবং সেখানে প্রায় দশ হাজার ছাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষালাভের সুযোগ পায়।
  • লন্ডন মিশনারি উদ্যোগ – লন্ডন মিশনারি সোসাইটির সদস্য বরাট মে প্রথমে চুঁচুড়ায় (১৭৯৫ খ্রি.) এবং পরবর্তীকালে অন্যত্র ৩৬টি ইংরেজি শিক্ষার বিদ্যালয় স্থাপন করেন। চা মিশনারি সোসাইটি (১৭৯৯ খ্রি.) ছিল এমনি আরও এক মিশনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
  • উচ্চশিক্ষা – ভারতে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রের মিশনারিদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে, যেমন
    • ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগে শ্রীরামপুর কলেজ,
    • ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে স্কটিশ মিশনের উদ্যোগে জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন (পরবর্তীকালের স্কটিশ চার্চ কলেজ),
    • বেলজিয়ামের মিশনারিদের উদ্যোগে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ (১৮৩৫ খ্রি.) ও লরেটো হাউস স্থাপিত হয়।

দ্বিতীয় অংশ – রাজা রাধাকান্ত দেব ছিলেন কলকাতায় রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের একজন বিশিষ্ট নেতা। তথাপি তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে যেরূপ ভূমিকা পালন করে, তা হল –

  • হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা – প্রতিষ্ঠাকালে তিনি ছিলেন হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম ও হিন্দু কলেজ পরিচালন কমিটির সদস্য। এদেশীয় হিন্দুসন্তানদের প্রাচ্যশিক্ষার পাশাপাশি পাশ্চাত্য শিক্ষার ব্যবস্থা করাই ছিল হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।
  • সম্পাদক – ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটির সম্পাদকরূপেও রাধাকান্ত দেব বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এই সোসাইটির উদ্দেশ্য ছিল অল্পদামে শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা।
  • নারীশিক্ষার প্রসার – রাধাকান্ত দেব নারীশিক্ষার প্রসারেও যত্নবান ছিলেন। তাঁর সহযোগিতায় ব্যাপটিস্ট মিশনারিরা ক্যালকাটা ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।

উনিশ শতকের ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের প্রভাব কী ছিল?

  • ভূমিকা – উনিশ শতকের ভারতে খ্রিস্টান মিশনারি ও দেশীয় ব্যক্তিদের এবং সরকারি উদ্যোগে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটেছিল। এইরূপ পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সুপ্রভাব ও কুপ্রভাব দুইই ছিল।

ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের সুপ্রভাব –

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সুপ্রভাবের মধ্যে ছিল —

  • আধুনিক ভাবধারার বিস্তার – ঊনবিংশ শতকে পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শন পাঠের প্রভাবে ভারতীয়দের মধ্যে যুক্তিবাদী মানসিকতা গড়ে ওঠে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত উনিশ শতকের যুক্তিবাদী মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীবর্গ।
  • পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচর্চার উদ্ভব – উনিশ শতকের পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে নানান বিষয়ে মানুষের উৎসাহ ও কৌতূহল বৃদ্ধি পাওয়ায় বিজ্ঞানচর্চা শুরু হয়। বিজ্ঞানচর্চার ফলে প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের প্রভাব এযুগে ক্রমশ কমে আসতে থাকে। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন এই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভারতীয় বৈজ্ঞানিক।
  • গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ ধারণা – পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভারতীয়দের মধ্যে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদের ধারণার উদ্ভব ঘটে।
  • মানবতাবাদের ধারণা – পাশ্চাত্য সাহিত্য, দর্শন, শিল্প, বিজ্ঞান প্রভৃতি চর্চার ফলে এদেশের মানুষ বুঝতে পারে যে, এই জগৎ আনন্দময় এবং দেহ ও মনের উন্নতিসাধনই জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য। ভারতীয় জনগণের মনে এই নতুন চিন্তাধারার উদ্ভব ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার অন্যতম মানবতাবাদী দিক।
  • মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব – অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের অন্যতম ফলশ্রুতি ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উদ্ভব। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী ভাবধারায় দীক্ষিত হয়ে সমাজ ও ধর্ম সংস্কার, শিক্ষাবিস্তার ও রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করে। রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জ্যোতিবা ফুলে, বীরসালিঙ্গম পানতুলু প্রভৃতি মনীষীরা ছিলেন এই গোষ্ঠীর মানুষ।

সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের সূচনা – পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলশ্রুতিতে উনিশ শতকে সমাজসংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয় যা ভারতীয় নারীদের কল্যাণসাধন এবং ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে পরিণতি লাভ করে।

  • জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ – ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদ, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসে ভারতীয়দের মনে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষে বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী প্রমুখ মনীষীদের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের কুপ্রভাবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল –

  • ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির অবহেলা
  • বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি শিক্ষায় অবহেলা
  • অবহেলিত নারীশিক্ষা ও গণশিক্ষা এবং
  • পরোক্ষভাবে খ্রিস্টধর্মের প্রচার প্রভৃতি।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তা ব্যাখ্যা করো। পাশ্চাত্য চিকিৎসা শিক্ষাবিস্তার প্রসঙ্গে মধুসূদন গুপ্তের অবদান চিহ্নিত করো।

প্রথম অংশ – ভারতে ইংরেজ শাসনের একটি বিশেষ দিক ছিল জনস্বাস্থ্য নীতি। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই নীতির প্রথম প্রতিফলন পড়েছিল।

প্রেক্ষাপট – কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা আকস্মিক ছিল না। এর পশ্চাতে দেখা যায় যে –

  • পরিপূর্ণ শিক্ষাদান – ১৮২০-র দশকে প্রতিষ্ঠিত স্কুল ফর নেটিভ ডক্টরস, সংস্কৃত কলেজ ও কলকাতা মাদ্রাসার চিকিৎসাবিদ্যা বিভাগে ব্যবহারিক অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ ব্যবস্থা ছিল না। এছাড়া ব্যাপক পরিসরে চিকিৎসা প্রদানেরও অভাব ছিল।
  • কমিটি গঠন – এই বিবিধ অভাব পূরণের জন্য লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক একটি কমিটি গঠন করেন (১৮৩৩ খ্রি.)। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন মি. জে. গ্র্যান্ট এবং অন্যান্য সদস্য ছিলেন জে. সি. সাদারল্যান্ড, সি. জি. সাদারল্যান্ড, এম. জে. ব্রামলি, বাবু রামকমল সেন প্রমুখ। এই কমিটি সংস্কৃত ও আরবি-ফারসির পরিবর্তে ইংরেজির মাধ্যমে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষাদানের সুপারিশ করে।
  • বেন্টিঙ্কের পদক্ষেপ – লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক উপরোক্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সংস্কৃত কলেজ ও মাদ্রাসার চিকিৎসাবিদ্যার বিভাগ এবং নেটিভ মেডিক্যাল স্কুল বন্ধ করেদেন (১ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৫ খ্রি.)। পাশাপাশি এদেশীয় যুবকদের চিকিৎসাশাস্ত্রের বিভিন্ন বিভাগে ইংরেজিতে শিক্ষিত করে তোলার উদ্দেশ্যে একটি নতুন মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

দ্বিতীয় অংশ – প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য চিকিৎসা শিক্ষার বিস্তারে পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত (১৮০৬-১৮৫৬ খ্রি.) ছিলেন এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব।

  • সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিত – সম্প্রতি সুতপা ভট্টাচার্য তাঁর কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের ইতিহাস (১৮২৪-১৮৭৪ খ্রি.) নামক গবেষণা নিবন্ধে দেখিয়েছেন যে, মধুসূদন গুপ্ত ছিলেন। সংস্কৃত কলেজের প্রতিভাবান ছাত্র এবং তিনি এখানের বৈদ্যক বিভাগে তিন বছর পড়াশোনা করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই কলেজেই হিন্দু ঔষধির পণ্ডিত রূপে নিযুক্ত হন। তিনি এই কলেজের মেডিক্যাল ক্লাসে পাশ্চাত্যধারায় অ্যানাটমি শিক্ষাদান করতেন। এছাড়া সংস্কৃত কলেজ সংলগ্ন হাসপাতালেও খুব দক্ষতার সঙ্গে চিকিৎসা করেন।
  • মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার – কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে মধুসূদন গুপ্ত এই কলেজের ডাক্তার হিসাবে নিযুক্ত হন। তিনি পরবর্তীকালে এই কলেজের প্রথম পদমর্যাদার সাব-অ্যাসিট্যান্ট সার্জন পদে উন্নীত হন।
  • শব ব্যবচ্ছেদ – ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে মধুসূদন গুপ্ত যাবতীয় হিন্দু কুসংস্কার উপেক্ষা করে প্রথম ভারতীয়রূপে শব ব্যবচ্ছেদ করেন। এভাবে এদেশীয় মেডিক্যাল ছাত্রদের কাছে শব ব্যবচ্ছেদ বিষয়ে পথপ্রদর্শকে পরিণত হন।

পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে ডেভিড হেয়ারের অবদান ব্যাখা করো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তা ব্যাখ্যা করো।

প্রথম অংশ – ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে ডেভিড হেয়ার ছিলেন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি একজন সামান্য ঘড়িওয়ালা হলেও এদেশের পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারে বিশেষভাবে সচেষ্ট হন। তাঁর অবদানগুলি হল-

  • হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ – ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক উদ্যোক্তাদের মধ্যে ডেভিড হেয়ার ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও অধিকাংশের মতে, তিনিই ছিলেন হিন্দু কলেজের প্রস্তাবক। তিনি এদেশীর ধনবান ব্যক্তিদের আর্থিক সহযোগিতায় এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
  • পটলডাঙা অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা – এদেশে শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি কলকাতায় পটলডাঙা অ্যাকাডেমি (বর্তমানের হেয়ার স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন।
  • স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা – ইংরেজি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি (১৮১৭ খ্রি.) এবং ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি (১৮১৮ খ্রি.)।

দ্বিতীয় অংশ – ভারতে শিক্ষা তথা উচ্চশিক্ষার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক্‌চিহ্ন হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা (১৮৫৭ খ্রি.)। এটি উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ অনুযায়ী লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে গঠিত হয়েছিল।

প্রতিষ্ঠা – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া ছিল এরকম –

  • ইউনিভারসিটি কমিটি – উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশের ভিত্তিতে লর্ড ডালহৌসির শাসনকালে কলকাতায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত হয় ইউনিভারসিটি কমিটি। এই কমিটির দেওয়া রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (২৪ জানুয়ারি, ১৮৫৭ খ্রি.)।
  • প্রশাসন – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে ৪১ জন সিনেট সদস্য নিয়ে গঠিত সিনেট-এর হাতে শিক্ষানীতি রূপায়ণের ভার ন্যস্ত করা হয়। লর্ড ক্যানিং হলেন প্রথম আচার্য এবং স্যার জেমস উইলিয়াম কোলভিল প্রথম উপাচার্য।
  • বিস্তার – প্রতিষ্ঠাকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এলাকা ছিল লাহোর থেকে বর্তমান মায়ানমারের রেঙ্গুন পর্যন্ত। দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয় ও কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়।
  • কর্ম শুরু – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট-এর প্রথম মিটিং হয় ৩০ জানুয়ারি, ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কাউন্সিল রুম-এ। ক্যামাক স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী অফিস গড়ে ওঠে। অন্যদিকে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ২৪৪ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে।
  • মূল্যায়ণ – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষার বিষয়টি পরিপূর্ণতা লাভ করে। তবে প্রতিষ্ঠাকালে এটি উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল না, বরং তা ছিল পরীক্ষাগ্রহণকারী কেন্দ্র। লাভ করে। তবে প্রতিষ্ঠাকালে এটি উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল না, বরং তা ছিল পরীক্ষাগ্রহণকারী কেন্দ্র।

রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলন ব্যাখ্যা করো।

  • ভূমিকা – উনিশ শতকের ভারতের ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস। চিন্তার জগতে যুক্তিবাদের অভাব সমাজের অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দেয়। ভারতবর্ষের এই সামাজিক পটভূমিতে রাজা রামমোহন রায় সর্বপ্রথম কুসংস্কার ও কুপ্রথা দূর করে ভারতবর্ষের জাতীয় জীবনে জাগরণ ঘটাতে সচেষ্ট হন।
  • সমাজসংস্কারক – রামমোহন তাঁর যুক্তিবাদী আধুনিক চিন্তাধারার সাহায্যে সমস্ত বাধাবিঘ্নকে অতিক্রম করে সতীদাহ প্রথা, বহুবিবাহ, বর্ণভেদ প্রথা প্রভৃতি কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়যুক্ত হয়েছিলেন।
  • আধুনিক চিন্তাধারার পথিকৃৎ – উনিশ শতকের ভারতীয় জীবনে ধর্ম, শিক্ষা, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি বিষয়ে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী আধুনিক চিন্তাধারার পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। এইসব কারণের জন্য রামমোহন রায়কে ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ বলা হয়।
  • ধর্মসংস্কার – রাজা রামমোহন রায় উপলব্ধি করেছিলেন যে, প্রথমত, ভারতে সমাজের সঙ্গে ধর্মের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। প্রচলিত হিন্দুধর্মের সংস্কারসাধন করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, খ্রিস্টান মিশনারিগণ কর্তৃক হিন্দু ধর্মের সমালোচনা ও হিন্দুদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরকরণ প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করা। এই উদ্দেশ্যে —
  • আত্মীয়সভা গঠন – ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় কলকাতায় আত্মীয়সভা গঠন করেন। মূর্তিপূজার অসারতা, জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।
  • ব্রাক্ষ্মসভা স্থাপন – ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল বহুদেবতাবাদের স্থলে একেশ্বরবাদী মতাদর্শ প্রচার করা এবং নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করা। পরবর্তীকালে এই সভা ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত হয়।
  • মূল্যায়ণ – রামমোহন রায়ের কতকগুলি সীমাবদ্ধতা ছিল, যেমন — তিনি সমাজ ও ধর্মের কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটাননি। তাই ঐতিহাসিক সালাউদ্দিন আহম্মদ তাঁকে সংযত সংস্কারক বলে অভিহিত করেছেন। রামমোহন রায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি অংশগ্রহণ করে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে এই আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে।

সতীদাহ বিরোধী আন্দোলন কেন ও কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করো। এ প্রসঙ্গে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান চিহ্নিত করো।

ভূমিকা –

প্রথম অংশ – বাংলা তথা ভারতের সমাজসংস্কার আন্দোলনে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ছিল সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন। মৃত স্বামীর চিতায় তার সদ্যবিধবা জীবন্ত স্ত্রীর সহমরণ সতীদাহ প্রথা নামে পরিচিত।

আন্দোলন – সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন ছিল একটি ব্যাপক আন্দোলন। এর বিভিন্ন দিক হল-

সতীদাহ
সতীদাহ
  • সার্বিক আন্দোলন – প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে সতীদাহ প্রথা চলে আসছিল। এই প্রথা গোঁড়া হিন্দুদের কাছে পবিত্র ও মহান প্রথা হলেও বাস্তবে ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর। তাই এই প্রথার বিরুদ্ধে উনিশ শতকে কলকাতাসহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলন গড়ে ওঠে।
  • সরকারি নিয়ন্ত্রণ – জোর-জবরদস্তিমূলক উপায়ে সতীদাহ প্রথার ব্যাপকতায় ইংরেজ সরকার চিন্তিত ছিল। তাই ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে একটি আইনের মাধ্যমে গর্ভবর্তী ও অল্পবয়সি নারীর সতী হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়।

দ্বিতীয় অংশ – রামমোহন রায় ছিলেন একজন যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী। তিনি নারীকল্যাণের ক্ষেত্রেও সচেষ্ট হন এবং নিজেকে সতীদাহ বিরোধী আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট করেন।

  • স্ত্রী-হত্যা – রামমোহন মত প্রকাশ করেন যে, সতীদাহের = অধিকাংশ ঘটনাই স্বেচ্ছা প্রণোদিত ছিল না, তা ছিল জ্ঞানপূর্বক ক স্ত্রী-হত্যা। সমসাময়িককালের বিভিন্ন তথ্য ও সরকারি নথিপত্র থেকেও এই বক্তব্য সমর্থিত হয়।
  • স্বতস্ফূর্ত রদ – রামমোহন রায় আইনের পরিবর্তে মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও চেতনার প্রসারের মাধ্যমেই এই প্রথা রদ করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ স্বতস্ফূর্তভাবেই মানুষ একদিন এই প্রথার অবসান ঘটাবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।
  • চেতনা সৃষ্টি – রামমোহন রায় সতীদাহ বিরোধী চেতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় গ্রন্থ রচনা করে সতীদাহ প্রথাকে অশাস্ত্রীয় প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন। এছাড়া সংবাদপত্রে বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে জনগণের চেতনা সপ্তার করেন। প্রচারসভার পাশাপাশি শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে স্বামীর চিতায় সতী হতে ইচ্ছুক বিধবাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন।
  • বেন্টিঙ্কের উদ্যোগকে সমর্থন – রামমোহন রায় অবশেষে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের জন্য সরকারি সমর্থনের উপর নির্ভর করেন। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইংল্যান্ডের জনগণের একাংশ নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথা বন্ধের জন্য আবেদন জানায়। এছাড়া তৎকালীন বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কও এই প্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাই তিনি ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সপ্তদশ বিধি (১৭নং রেগুলেশান) জারি করে এই প্রথা রদ করেন।
  • মূল্যায়ণ – এভাবে দেখা যায় যে, সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন শুধু রামমোহন রায়ের গড়ে তোলা আন্দোলন ছিল না। তা ছিল পূর্বেই গড়ে ওঠা এক আন্দোলন। তবে এই আন্দোলন তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে শেষপর্যন্ত সাফল্যলাভ করে।

উনিশ শতকের বাংলায় সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনগুলি ব্যাখ্যা করো।

অথবা, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় সমাজ সংস্কার সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ রচনা করো।

উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বঙ্গবাসীরা প্রচলিত ধ্যানধারণা ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। তাঁরা বাংলার সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন এবং অশিক্ষা, অধর্ম ও সামাজিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ব্রতী হন। যুক্তিবাদী ও প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও।

  • সমাজসংস্কার আন্দোলন – আলোচ্য সময়ে সমাজসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রধান ঘটনাগুলি ছিল –
    • সতীদাহ প্রথার অবসান
    • বাল্যবিবাহ নিবারণ ও বিধবাবিবাহ প্রবর্তন এবং
    • নব্যবঙ্গ আন্দোলন।
  • সতীদাহ প্রথার অবসান – ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় গভর্নর-জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে আইন জারি করেন।
  • বিধবাবিবাহ প্রবর্তন ও বাল্যবিবাহ নিবারণ – বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের ক্ষেত্রে মহান সমাজসংস্কারক পণ্ডি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গড়ে তোলা আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে এই আইন প্রণয়ন করে বিধবাবিবাহকে আইনসিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। এছাড়া বাল্যবিবাহ প্রসার বিরোধী বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পরবর্তী সময়ে (১৮৬০ খ্রি.) আইন-প্রণয়ন করে কন্যার বিবাহের বয়স সর্বনিম্ন দশ বছর নির্ধারিত করা হয়।
  • নব্যবঙ্গ আন্দোলন – রামমোহনের সমসাময়িককালে হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র নেতৃত্বে বাংলায় একদল যুক্তিবাদী তরুণ ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরোধিতা করতে থাকেন। এই তরুণ গোষ্ঠী ইয়ং বেঙ্গল বা নব্যবঙ্গ সম্প্রদায় নামে। পরিচিত হয়। অবশ্য নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর আন্দোলন জনমানসে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী নব্যবঙ্গ আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে না পেয়ে একে নকল নবীশের দল আখ্যা দিয়েছেন।
  • ধর্মসংস্কার আন্দোলন – ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে সমাজসংস্কার আন্দোলনের পাশাপাশি ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়। এক্ষেত্রে পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা, আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপকতা দূর করার জন্য রামমোহন রায় উপনিষদের আদর্শের ভিত্তিতে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন (আগস্ট, ১৮২৮ খ্রি.)। রামমোহন প্রতিষ্ঠিত বাত্মসমাজ পরবর্তীকালে জাতিভেদ প্রথার নিরসন, স্ত্রীশিক্ষা প্রসার প্রভৃতি সামাজিক-সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে।
  • শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ – শ্রীরামকৃষ্ণদেবের আবির্ভাবের পূর্বে বাংলার হিন্দু সমাজে ব্রাত্ম ধর্ম ও খ্রিস্টধর্মের প্রসারকে কেন্দ্র করে একেশ্বরবাদ ও বহুদেবতাবাদ সম্পর্কিত দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। রামকৃয়দেব বিভিন্ন ধর্ম বর্ণিত ঈশ্বরলাভের পথ ধরে ঈশ্বর সাধনা করেন ও সফল হন। তাঁর উপলব্ধির ভিত্তিতে তিনি প্রচার করেন যে, সাকার ও নিরাকার (একই ঈশ্বরের বিচিত্র রূপ)। একেশ্বরবাদ ও বহুদেবতাবাদ হল ধর্মের বিভিন্ন অঙ্গ। এভাবে তিনি ধর্মসমন্বয়বাদী আদর্শের প্রচার করেন।

সমালোচনা –

বাংলার সামাজিক ও ধর্মসংস্কার আন্দোলন ত্রুটিমুক্ত ছিল না, কারণ –

  • কোম্পানির আমলে উল্লেখিত সংস্কারগুলি মূলত হিন্দুসমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল। সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজে এই সংস্কারগুলি প্রভাব ফেলতে পারেনি।
  • এই আন্দোলন ছিল শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন, যা কেবল উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকেই প্রভাবিত করেছিল।
  • যোগ্য উত্তরসূরির অভাবে বিদ্যাসাগর ও ডিরোজিও পরিচালিত আন্দোলন মাঝপথেই থেমে যায়।

মূল্যায়ণ – এতসব দুর্বলতা সত্ত্বেও বরণীয় বাঙালির স্মরণীয় প্রচেষ্টার সদর্থক পরিণতিস্বরূপ ভারতবাসী ক্রমশ আত্মসচেতন ও আধুনিক চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়।

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর নেতৃত্বে সংস্কার আন্দোলন ব্যাখ্যা করো। এই আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণগুলি চিহ্নিত করো।

পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার তরুণ বুদ্ধিজীবীদের একাংশ যে উগ্র সংস্কারপন্থী আন্দোলন সৃষ্টি করেন তা ইয়ং বেঙ্গল বা নব্যবস্থা আন্দোলন নামে পরিচিত। নব্যবঙ্গ আন্দোলনের প্রেরণাদাতা ও প্রাণপুরুষ ছিলেন হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১ খ্রি.)।

নব্যবঙ্গ দলের মূল উদ্দেশ্য – নব্যবঙ্গ দলের মূল উদ্দেশ্য ছিল —

  • জনসাধারণের মধ্যে যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠা
  • হিন্দুসমাজে প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরোধিতা করা এবং
  • আধুনিক ও যুক্তিবাদী পাশ্চাত্য চিন্তাধারা ও শিক্ষার বিস্তার ঘটানো।
  • নব্যবঙ্গ দলের কার্যকলাপ – ডিরোজিও-র ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ছাত্ররা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সভাসমিতি ও প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে প্রগতিশীল ধ্যানধারণা প্রচার করেন। ডিরোজিওর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন প্যারীচাদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
  • ইয়ংবেঙ্গলের সদস্যরা তাঁদের পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে হিন্দুসমাজের বহুবিবাহ, নারীশিক্ষা, জুরির বিচার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন ও তাঁদের সুচিন্তিত মতামত দেন।
  • নারীকল্যাণ সাধন – নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সদস্যরা নারীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার আদর্শ ব্যক্ত করেন। তাঁরা সতীদাহ প্রথা বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে কলম ধরেন এবং সতীদাহ প্রথা নিবারণের পর সরকারকে তারা অভিনন্দন জানান।
  • শিক্ষার বিস্তার – নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী জ্ঞানের বিস্তার সাধনের মাধ্যমে স্বদেশের উন্নতিতে সচেষ্ট হয়। এই উদ্দেশ্যে তারা এদেশে ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের দাবি জানায়।

দ্বিতীয় অংশ – নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর আন্দোলন বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হয়। এগুলি হল —

  • সমর্থনের অভাব – সমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগসূত্র না থাকায় সমাজজীবনে ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। সবচেয়ে বড়ো কথা, দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাঁরা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ করতে আগ্রহী ছিলেন। তাই এই আন্দোলন গণ সমর্থন লাভ করেনি। এই কারণে ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীকে নকল নবীশের দল বলে মন্তব্য করেছেন।
  • ধারাবাহিকতার অভাব – নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সদস্যরা ধারাবাহিকভাবে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার অনুসরণ ও কার্যকলাপ করতে ব্যর্থ হন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের উদ্দীপনা ও দৃষ্টিভঙ্গি হ্রাস পেতে থাকে।
  • কলকাতাকেন্দ্রিক – নব্যবঙ্গ আন্দোলন ছিল কলকাতার কিছু শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীর আন্দোলন। কলকাতা ও কলকাতার বাইরে বাংলায় এটি ব্যাপক আন্দোলন হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়।

প্রবন্ধ রচনা করো। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় সমাজ-সংস্কার আন্দোলন।

সত্তর ঊনবিংশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে ভারতের আর্থ-সামাজিক তথা ধর্মীয় জীবনে এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা হয়। বিভিন্ন মনীষী ও প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টায় এই পরিবর্তন তথা আন্দোলন আরও ব্যাপক আকার লাভ করে। প্রগতিশীল এই আন্দোলনের রূপকার ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, কেশবচন্দ্র সেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ। এছাড়া প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে।

  • ব্রাত্মসমাজ –
  • রাজা রামমোহন রায়কে বাংলা তথা ভারতবর্ষের নবজাগরণের অগ্রদূত বলা যায়। তিনি ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সহায়তায় সতীদাহের মতো অমানবিক প্রথার অবসান ঘটান। আর্থ-সামাজিক সংস্কারের পাশাপাশি উদারনৈতিক ধর্মীয় মনোভাব গড়ে তোলার জন্য রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে তিনি হিন্দুধর্মের কুসংস্কার, মূর্তিপূজা ও রক্ষণশীলতা দূর করে একটি যুগোপযোগী ধর্ম প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন।
  • রামমোহনের মৃত্যুর পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্ব দেন। কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু প্রমুখ ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের নবীন সদস্য।

কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন সমাজসংস্কারক। তিনি স্ত্রীশিক্ষার প্রসারসহ শিক্ষার বিস্তার, অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ প্রথার অবলুপ্তি এবং সামাজিক কুপ্রথার অবসান ঘটিয়ে সামাজিক বিপ্লব আনতে চেয়েছিলেন।

  • বিদ্যাসাগর – উনিশ শতকের মহান সমাজসংস্কারক ন বিদ্যাসাগরের কার্যকলাপ এই সংস্কার আন্দোলনকে আরও চা শক্তিশালী করে। বাল্যবিবাহ নিবারণ ও বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের এ ক্ষেত্রে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণীয়। তার প্রচেষ্টায় গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে এক আইন প্রণয়ন করে বিধবাবিবাহকে আইনসিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। এছাড়া প্রধানত বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে আইন প্রণয়ন করে কন্যার বিবাহের বয়স সর্বনিম্ন দশ বছর নির্ধারিত করা হয়।
  • প্রেসিডেন্সি কলেজ – বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই কলেজটি আগে হিন্দু কলেজ নামে পরিচিত ছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষা, জ্ঞানবিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের বিকাশে অংশগ্রহণ করে আলোচ্য সময়ে এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাই পরবর্তীকালে ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠেন। ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ এই কলেজের কৃতী ছাত্র ছিলেন। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁদের নানান চিন্তাধারা ও প্রচেষ্টা বাংলায় নবজাগরণের সূচনা করে।
  • রামকৃষ্ণ মিশন – ব্রাত্ম আন্দোলনের গতি যখন স্তিমিত হয়ে আসছিল সেই মুহূর্তে হিন্দুধর্মে নতুন প্রাণসঞ্চার করেন যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণের ধ্যানধারণাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর কাছে দেশপ্রেম ধর্মের বিকল্প হয়ে উঠেছিল। তাঁর উদ্যোগে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠন সমাজসেবা ও জাতীয়তাবাদী চেতনা সঞ্চারে আত্মনিয়োগ করে।
  • মূল্যায়ন – বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন কিন্তু সমালোচনামুক্ত ছিল না, কারণ –

প্রথমত, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সমাজসংস্কার আন্দোলন মূলত হিন্দু সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল। সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমান সমাজে এই সংস্কারগুলি প্রভাব ফেলতে পারেনি।

দ্বিতীয়ত, এটি ছিল প্রধানত শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন, যা কেবল উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকেই প্রভাবিত করেছিল। এতসব দুর্বলতা সত্ত্বেও বাংলার বরণীয় বাঙালিদের এই সদর্থক প্রচেষ্টার পরিণতিস্বরূপ ভারতবাসীরা ক্রমশ আত্মসচেতন ও আধুনিক চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়। ক্রমশ তারা জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বরাজ লাভের স্বপ্ন দেখতে থাকে।

শ্রীরামকৃষ্ণের সমন্বয়বাদী মতাদর্শকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে? বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের অভিমুখ ব্যাখ্যা করো।

প্রথম অংশ – উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন ব্রাহ্মসমাজের মতাদর্শের পাশাপাশি শ্রীরামকৃয়দেবের (১৮৩৬-১৮৮৬ খ্রি.) সমন্বয়বাদী মতাদর্শও ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণেশ্বরে রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দিরের পুরোহিত গদাধর চট্টোপাধ্যায় বিভিন্ন ধর্মসাধনার মাধ্যমে শ্রীরামকৃদেব-এ পরিণত হন।

  • সমন্বয়বাদী মতাদর্শ – শ্রীরামকৃষ্ণ যেভাবে সমন্বয়বাদী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন তা হল –
  • ধর্মভাবনা – রামকৃষ্মদেব সব ধরনের ধর্মীয় বিভেদ ও। বিদ্বেষ অপচ্ছন্দ করতেন। তিনি প্রচার করেন যে, প্রত্যেকেই নিজ নিজ মত ও পথ অনুসরণ করে ঈশ্বর সাধনায় নিয়োজিত। হতে পারে। তিনি বলেছেন, সাকার নিরাকার একই ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপ, যত মত তত পথ
শ্রীরামকৃষ্ণদেব
শ্রীরামকৃষ্ণদেব
  • মানবতাবাদ – ধর্ম নয় মানুষের মনুষ্যত্বই তাঁর কাছে গুরুত্ব লাভ করে ; তাই তাঁর কাছে তাঁর ধর্মমতের একটি বিশেষ দিক হল মানবতাবোধ। তাঁর কাছে জীবসেবা ও মানবসেবা ছিল ঈশ্বরসেবার প্রকারভেদ মাত্র।
  • আধ্যাত্মিক শাস্তি – উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শিক্ষিত যুবকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বেকারত্বও বৃদ্ধি পায়। ফলে বাঙালি যুব সম্প্রদায়ের মনে বেকারজনিত হতাশা বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতিতে তিনি আধ্যাত্মিক শান্তির পথনির্দেশ করেন। জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা – শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, প্রত্যেক মানুষই হল শক্তির আধার; তাই তিনি প্রত্যেক মানুষকে সমান মর্যাদাদানের কথা প্রচার করেন। এভাবে সমাজে জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতা অনেকটা হ্রাস পায়।
  • মূল্যায়ণ – শ্রীরামকৃষ্ণের এই সমন্বয়বাদী মতাদর্শ একদিকে যেমন বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের মধ্যে সংহতিদান করেছিল। তেমনি তা ক্ষয়িষ্ণু হিন্দুধর্মেও প্রাণস্যার করেছিল।

দ্বিতীয় অংশ – মানবতাবাদী ও সমাজপ্রেমী বিবেকানন্দ আত্মমুক্তি অপেক্ষা সমাজে উন্নতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী বিবেকানন্দ বনের বেদান্তকে ঘরে আনার কথা প্রচার করেন এবং বেদান্তকে মানবহিতের কাজে ব্যবহারের কথা বলেন। এভাবে বিবেকানন্দ বেদান্তের নতুন যে ব্যাখ্যা দেন তা নবাবেদান্ত নামে পরিচিত।

  • দরিদ্রদের সেবা – ভারতবর্ষের পথে-প্রান্তরে ভ্রমণ করে বিবেকানন্দ দরিদ্র ও অজ্ঞ ভারতবাসীর মধ্যে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ভারতের পর্ণকুটিরের দরিদ্র, কাঙাল, ক্ষুধার্ত জনতা তাঁর কাছে ছিল দরিদ্রনারায়ণ। জীবের মধ্যেই তিনি ভগবান শিবকে প্রত্যক্ষ করে বলেছিলেন – যত্র জীব তত্র শিব।
  • রামকৃত্ব মিশন প্রতিষ্ঠা – বিবেকানন্দ ছিলেন একজন জন্মযোদ্ধা সন্ন্যাসী — তবে তাঁর যুদ্ধ ছিল জাতির অশিক্ষা, কুসংস্কার, জাতিভেদ ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। কর্মের মাধ্যমে মানবসেবার আদর্শকেই তিনি তাঁর ধর্ম বলে মনে করতেন। জাতির মধ্যে ত্রাণকার্য, শিক্ষার প্রসার, সুচিকিৎসার প্রসার এবং প্রকৃত মানুষ গড়ার উদ্দেশ্যে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে তারিখে তাঁর উদ্যোগে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। আজও এই সংস্থাটি জনসেবামূলক নানান কাজকর্মে ভারতবর্ষের একটি অগ্রণী প্রতিষ্ঠান।

বাংলার নবজাগরণ-এর ভিত্তি, চরিত্র ও সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যা করো।

  • ভূমিকা – উনিশ শতকে বাংলায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শবাদের ভিত্তিতে সমাজ ও সংস্কৃতিতে এক নবচেতনার উন্মেষ ঘটে, যা নবজাগরণ নামে পরিচিত। নবজাগরণের একটি দিক ছিল বাংলা তথা ভারতের প্রাচীন গৌরবময় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মূল্যায়ন করা। তবে বাংলার নবজাগরণ ক্রমশ সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি ও বিজ্ঞানচিন্তার ক্ষেত্রেও পরিব্যাপ্ত হয়েছিল।
  • নবজাগরণের ভিত্তি – প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদী আদর্শ ছিল বাংলার নবজাগরণের প্রধানতম ভিত্তি। প্রাচ্য আদর্শের প্রধানতম দিকটি হল এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা মাদ্রাসা, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা। প্রাচ্যবাদের চর্চা ভারতের ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটায়। অন্যদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষা বাংলাদেশে মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ, প্রগতিবাদী আদর্শের সংখ্যার ঘটায়। এই দুই আদর্শের ঘাত-প্রতিঘাতেই সৃষ্টি হয় বাংলার নবজাগরণ।

নবজাগরণের চরিত্র – বাংলার নবজাগরণের কয়েকটি বিশিষ্ট দিক হল –

  • অনুসন্ধানী মানসিকতা – পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির অনেকে রক্ষণশীলতা বর্জন করে যুক্তিবাদী হয়ে ওঠেন। ধর্ম ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র যুক্তিবাদের দ্বারা মূল্যায়িত হতে থাকে।
  • সমাজ ও ধর্ম সংস্কার – বাংলার ধর্ম ও সমাজের কুসংস্কারগুলি দূর করে আধুনিক করে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। হিন্দুধর্মের মধ্য থেকেই হিন্দুধর্মের সংস্কারসাধন ছিল নবজাগরণের একটি দিক। আবার সরকারি সাহায্যে সতীদাহ প্রথা রদ ও বিধবা বিবাহ প্রবর্তন সমাজসংস্কারের বিখ্যাত উদাহরণ।
  • গৌরবময় অতীত পুনরুদ্ধার – প্রাচ্যবাদ চর্চার নীতি এবং ধর্ম ও সমাজসংস্কারের প্রয়োজনে ভারতের অতীত গৌরব পুনরুদ্ধার করা হয়। সমাজ ও ধর্মসংস্কারের প্রয়োজনে যুক্তিবাদের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় প্রমাণের অনুসন্ধান থেকে সংস্কৃত সাহিত্যের চর্চা শুরু হয়।
  • স্বতন্ত্র নবজাগরণ – বাংলার নবজাগরণ ইটালির নবজাগরণের সঙ্গে তুলনীয় নয়। বাংলার নবজাগরণের সামাজিক ভিত্তি ছিল উদীয়মান শিক্ষিত পেশাজীবী ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়।

সীমাবদ্ধতা – বাংলায় নবজাগরণের সীমাবদ্ধতাগুলি হল –

  • সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলন মূলত হিন্দুসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তাই তা ছিল হিন্দু নবজাগরণ।
  • নবজাগরণ ছিল শহরকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন তাই তার প্রভাব সীমিত ছিল।
  • নবজাগরণের ফলে জমিদার, ব্যবসায়ী, শিক্ষিত পেশাজীবী ব্যক্তিরা লাভবান হলেও কৃষকসহ সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়নি।

সংস্কার আন্দোলন ভারতীয় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলনের ফলে ভারতীয় সমাজে অনেক সংস্কার সাধিত হয় এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ সুগম হয়।

Share via:

মন্তব্য করুন