দশম শ্রেণির জীববিজ্ঞানে জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় বিষয়টি অধ্যয়ন করা হয়। উদ্ভিদের সাড়া প্রদান এবংজীবনবিজ্ঞান বিষয়ে জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় উপবিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। উদ্ভিদের সাড়া প্রদান এবং রাসায়নিক সমন্বয়-হরমোন এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। উদ্ভিদদেহে সাইটোকাইনিন এবং জিব্বেরেলিন নামক দুটি হরমোন এর প্রভাব ও ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর দেওয়া হয়েছে।
সাইটোকাইনিনের উৎসগুলি লেখো। উদ্ভিদদেহে সাইটোকাইনিনের ভূমিকা লেখো।
সাইটোকাইনিন
উদ্ভিদের ফল ও সস্যে উৎপন্ন নাইট্রোজেনযুক্ত পিউরিন বর্ণভুক্ত ক্ষারীয় যে জৈব যৌগ মূলত উদ্ভিদের কোশ বিভাজনকে উদ্দীপিত করে, তাকে সাইটোকাইনিন বলে।
সাইটোকাইনিনের বৈশিষ্ট্য
সাইটোকাইনিন হরমোনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করা হল —
- সাইটোকাইনিন প্রধানত নাইট্রোজেনধর্মী ক্ষারীয় প্রকৃতির জৈব যৌগ।
- এটি পিউরিন বর্গভুক্ত রাসায়নিক উপাদান।
- অক্সিনের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে কাজ করে থাকে।
- এটির পরিবহণ সবদিকে হয়। তবে উৎপত্তিস্থলে কাজ করতেও সাইটোকাইনিন সক্ষম।
- এই হরমোনটি জলে দ্রবণীয়। তাই ব্যাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সহজে পরিবাহিত হতে পারে।
- হরমোনটি উদ্ভিদকোশের সাইটোকাইনেসিসে বিশেষভাবে সাহায্য করে। এই কারণে এর নাম সাইটোকাইনিন।
সাইটোকাইনিনের উৎসগুলি লেখো। উদ্ভিদদেহে সাইটোকাইনিনের ভূমিকা লেখো।
সাইটোকাইনিনের উৎস
সাইটোকাইনিনের উৎসগুলি হল প্রধানত উদ্ভিদের সস্য (যেমন — ডাবের জল) ও ফল। এ ছাড়া কিছু উদ্ভিদের ফল ও ফুলের নির্যাসেও সাইটোকাইনিন পাওয়া যায় (যেমন — টম্যাটো, পিচ)।
সাইটোকাইনিনের ভূমিকা
উদ্ভিদদেহে সাইটোকাইনিনের ভূমিকাগুলি নীচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
- কোশ বিভাজন ঘটানো – সাইটোকাইনিনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল উদ্ভিদকোশের সাইটোপ্লাজমের বিভাজনে বা সাইটোকাইনেসিসে সাহায্য করা। এই হরমোন অক্সিনের সহায়তায় কোশচক্রের S দশায় DNA সংশ্লেষের মাধ্যমে মাইটোসিস কোশ বিভাজনে সাহায্য করে। নবজাত কোশের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধিতেও এর বিশেষ ভূমিকা আছে।
- পার্শ্বীয় মুকুলের বৃদ্ধি ঘটানো – সাইটোকাইনিনের অপর একটি কাজ হল পার্শ্বীয় মুকুলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করা। এই হরমোন পার্শ্বীয় মুকুল বা কাক্ষিক মুকুলের বৃদ্ধি ও পরিস্ফুরণে সাহায্য করে এবং অসংখ্য শাখাপ্রশাখা সৃষ্টির মাধ্যমে উদ্ভিদটিকে ঝোপের মতো আকৃতি দান করে।
- পত্রমোচন বিলম্বিত করা – পাতার পত্রমূলের গোড়ার কোশগুলির কোশপ্রাচীরের ক্ষয়ের কারণে পত্রমোচন হয়। সাইটোকাইনিন এই কোশগুলির কোশপ্রাচীরকে ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে, ফলে পত্রমোচন বিলম্বিত হয়।
- জরা বিলম্বিতকরণ – সাইটোকাইনিন উদ্ভিদের বার্ধক্য বা জরা বিলম্বিত করে। মূলত নিউক্লিক অ্যাসিড ও প্রোটিনের বিনাশ বিলম্বিত করে এবং নতুন প্রোটিন উৎপাদনের দ্বারা পরিপোষণে সহায়তার মাধ্যমে হরমোনটি এই কাজ করে থাকে। এই কারণে ফুলদানিতে রাখা ফুল বা পাতাবাহার গাছের শাখায় সাইটোকাইনিন প্রয়োগ করা হলে তা অনেকদিন সতেজ থাকে।
- অগ্রমুকুলের বৃদ্ধি রোধ করা – সাইটোকাইনিন, অগ্রমুকুলের অবাধ বৃদ্ধি রোধ করে এবং উদ্ভিদের দৈর্ঘ্যবৃদ্ধি বিলম্বিত করে উদ্ভিদকে ঝোপে পরিণত করে।
জিব্বেরেলিনের সংজ্ঞা ও উৎস লেখো। এর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি কী?
জিব্বেরেলিনের সংজ্ঞা ও উৎস
সংজ্ঞা – বীজের পরিণত বীজপত্র থেকে উৎপন্ন টারপিনয়েড গোষ্ঠীভুক্ত, নাইট্রোজেনবিহীন, অম্লধর্মী উদ্ভিদ হরমোন যা বীজের সুপ্ত দশা ভঙ্গ করতে ও অঙ্কুরোদ্গমে সাহায্য করে তাকে জিব্বেরেলিন বলে।
উৎস – অঙ্কুরিত বীজ, পরিণত বীজপত্র, মুকুল, পাতার বর্ধিষ্ণু অঞ্চল প্রভৃতি থেকে জিব্বেরেলিন উৎপন্ন হয়।
জিব্বেরেলিনের বৈশিষ্ট্য
জিব্বেরেলিন হরমোনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি এখানে সংক্ষেপে আলোচিত হল —
- এটি কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন নিয়ে গঠিত একপ্রকার নাইট্রোজেনবিহীন উদ্ভিদ হরমোন।
- এটি টারপিনয়েড গোষ্ঠীভুক্ত আম্লিক প্রকৃতির জৈবরাসায়নিক পদার্থ।
- এটি জাইলেম ও ফ্লোয়েম-উভয় কলার মাধ্যমে প্রবাহিত হতে পারে। এই কারণে জিব্বেরেলিনের প্রবাহ উভমুখী।
- এটি জলে দ্রবণীয়। তাই অতি সহজেই ব্যাপন ক্রিয়ার দ্বারা পরিবাহিত হয়।
- বীজপত্রে জিব্বেরেলিন সঞ্চয়ের হার সবথেকে বেশি।
জিব্বেরেলিনের কয়েকটি প্রকারভেদের নাম লেখো। উদ্ভিদদেহে জিব্বেরেলিনের ভূমিকা উল্লেখ করো।
জিব্বেরেলিনের প্রকারভেদ
জিব্বেরেলিনের রাসায়নিক নাম জিব্বেরেলিক অ্যাসিড। বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ থেকে প্রায় 40 প্রকার জিব্বেরেলিন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি হল GA3, GA, GA7 |
জিব্বেরেলিনের ভূমিকা
উদ্ভিদদেহে জিব্বেরেলিনের ভূমিকাগুলি নিম্নরূপ।
- মুকুল ও বীজের সুপ্তাবস্থা ভঙ্গ – প্রতিটি বীজের একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত জীবনের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। বীজের এই দশাকে সুপ্তাবস্থা বলে। জিব্বেরেলিন মুকুলের এই সুপ্তাবস্থা দূর করে। বীজের সুপ্তাবস্থায় এর মধ্যে জিব্বেরেলিনের পরিমাণ কম থাকে। অঙ্কুরোদ্গমের আগে বীজে এই হরমোনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এর ফলে বীজমধ্যস্থ উৎসেচকের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়, যা বীজের সুপ্তাবস্থা দূর করে এবং অঙ্কুরোদ্গম ঘটায়।
- পর্বমধ্যের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি – জিব্বেরেলিন উদ্ভিদের কাণ্ডের পর্বমধ্যের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করে সঠিকভাবে কাণ্ডের দৈর্ঘ্যের বৃদ্ধি ঘটায়। এই হরমোন উদ্ভিদের নিবেশিত ভাজক কলাকোশের বিভাজন ঘটায়। ফলে পর্বমধ্য অংশের বৃদ্ধি ঘটে ও উদ্ভিদের দৈর্ঘ্যের বৃদ্ধি ঘটে।
- ফলের বৃদ্ধি – জিব্বেরেলিন অধিক সংখ্যক ফল উৎপাদনে এবং ফলের আকার বৃদ্ধিতে অংশগ্রহণ করে। আপেল, নাসপাতি, আঙুর প্রভৃতির ফুলের গর্ভাশয়ের কোশ বিভাজন ঘটিয়ে বীজবিহীন বা পার্থেনোকার্থিক ফল তৈরিতেও জিব্বেরেলিনের প্রয়োগ করা হয়।
- পাতা ও ফুলের আয়তন বৃদ্ধি – গাছের পাতা ও ফুলের আয়তন বৃদ্ধিতেও জিব্বেরেলিন সাহায্য করে।
অক্সিন, জিব্বেরেলিন ও সাইটোকাইনিনের তুলনা করো।
অক্সিন, জিব্বেরেলিন ও সাইটোকাইনিনের পার্থক্য —
বিষয় | অক্সিন | জিব্বেরেলিন | সাইটোকাইনিন |
1. রাসায়নিক প্রকৃতি | ইনডোল বৰ্গযুক্ত। | টারপিনয়েড গোষ্ঠীভুক্ত। | পিউরিন গোষ্ঠীভুক্ত। |
2. N2 -এর উপস্থিতি | উপস্থিত। | অনুপস্থিত। | উপস্থিত। |
3. প্রবাহ অভিমুখ | নিম্নমুখী। | ঊর্ধ্বমুখী ও নিম্নমুখী। | সৰ্বমুখী। |
4. উৎস | কাণ্ড ও মূলের অগ্রস্থ ভাজক কলা। | অঙ্কুরিত চারা ও বীজপত্র। | প্রধানত বীজের সস্য। |
5. কোশ বিভাজন | কোশ বিভাজনে প্রভাব আছে। | কোশ বিভাজনে প্রভাব নেই। | কোশ বিভাজনে প্রভাব আছে। |
6. ট্রপিক চলন | ট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণ করে। | কোনো প্রভাব নেই। | কোনো প্রভাব নেই। |
7. মুকুলের বৃদ্ধি | অগ্র মুকুলের বৃদ্ধি ঘটায়, পার্শ্বীয় বা কাক্ষিক মুকুলের বৃদ্ধি রোধ করে। | কাক্ষিক বা পার্শ্বীয় মুকুলের বৃদ্ধি ঘটায়, অগ্র মুকুলের বৃদ্ধি হ্রাস করে। | কাক্ষিক বা পার্শ্বীয় মুকুলের বৃদ্ধি ঘটায়, অগ্র মুকুলের বৃদ্ধি রোধ করে। |
জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় বিষয়টি জীববিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উদ্ভিদদের জীবনকে সাধারণত উদ্ভিদের সাড়া প্রদান এবং রাসায়নিক সমন্বয় হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে। উদ্ভিদদেহে সাইটোকাইনিন ও জিব্বেরেলিন এমন হরমোন যা প্রধানতঃ বিকাশ এবং বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। প্রশ্নোত্তর অংশটি রচনাধর্মী হওয়ায় উদ্ভিদদের সাধারণ রচনা এবং বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত বোঝার সুযোগ দেয়।