মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞানে পরিবেশ এবং তার সম্পদ সম্পর্কিত পাঠে নাইট্রোজেন চক্রের রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর সম্পর্কে জানতে পারা যায়। পরিবেশ বলতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের পাসে থাকা সবকিছুকে বুঝানো হয়, যেমন মানুষ, পশু, উদ্ভিদ, জল, বাতাস, মাটি ইত্যাদি। তাদের সংরক্ষণ করা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
নাইট্রোজেন চক্র হলো নাইট্রোজেন উৎপাদন ও পুনর্বহনের পদ্ধতি যা পরিবেশের জীবনের জন্য সহায়ক। এটি জীবদৈনিক প্রক্রিয়াগুলির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নাইট্রোজেন জীবদৈনিক প্রক্রিয়ায় প্রথমে জীবাণু, প্রস্রাবধারী উদ্ভিদ বা কোন অন্যান্য জীব পদার্থ দ্বারা জীবিত পদার্থকে পুনর্নির্মাণ করে।
একটি রেখাচিত্রের মাধ্যমে নাইট্রোজেন চক্রের বর্ণনা দাও।
নাইট্রোজেন চক্র
বাতাসে নাইট্রোজেনের পরিমাণ শতকরা 78.09 ভাগ। এ ছাড়াও মাটির মধ্যে নাইট্রেট, নাইট্রাইট এবং অন্য যৌগ হিসেবে নাইট্রোজেন আবদ্ধ থাকে। প্রকৃতির নাইট্রোজেন চক্র যে পর্যায়ে হয়, সেগুলি হল — নাইট্রোজেন স্থিতিকরণ বা আবদ্ধকরণ, মাটির নাইট্রোজেন জীবদেহে প্রবেশ, জীবদেহ থেকে নাইট্রোজেনের মাটিতে পুনঃপ্রবেশ এবং নাইট্রোজেনের মুক্তি।
নাইট্রোজেন স্থিতিকরণ বা আবদ্ধকরণ – যে পদ্ধতিতে বায়ুর নাইট্রোজেন মাটিতে মেশে এবং নাইট্রোজেনঘটিত যৌগে পরিণত হয়, তাকে নাইট্রোজেন সংযোজন বা স্থিতিকরণ বা আবদ্ধকরণ বলে। এই স্থিতিকরণ প্রধানত তিনটি পদ্ধতিতে ঘটে থাকে। এগুলি হল — 1. প্রাকৃতিক আবদ্ধকরণ – বজ্রপাত ও অগ্ন্যুৎপাতের সময়ে বাতাসের নাইট্রোজেন গ্যাস অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাইট্রিক অক্সাইড (NO) গঠন করে। এই নাইট্রিক অক্সাইড অক্সিজেনের দ্বারা জারিত হয় ও নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO2) গঠন করে। নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড বৃষ্টির জলে দ্রবীভূত হয়ে নাইট্রাস অ্যাসিড (HNO2) ও নাইট্রিক অ্যাসিড (HNO3)-এ পরিণত হয় এবং তা মাটিতে নেমে আসে।
N2 + O2 → 2NO ; 2NO + 02 → 2NO2
2NO2 + H2O→ HNO2 + HNO3
এই দু-প্রকার অ্যাসিড মাটির ধাতব লবণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাইট্রেট যৌগ (পটাশিয়াম নাইট্রেট, ক্যালশিয়াম নাইট্রেট প্রভৃতি) গঠন করে। 2. জীবজ আবদ্ধকরণ – (A) বিভিন্ন প্রকার অণুজীব, যেমন — অ্যাজোটোব্যাকটর, ক্লসট্রিডিয়াম প্রভৃতি, বাতাসের মুক্ত নাইট্রোজেনকে নিজদেহে আবদ্ধ করে। মৃত্যুর পরে এদের দেহের নাইট্রোজেনঘটিত যৌগগুলি মাটিতে মিশে যায়। এই ব্যাকটেরিয়াগুলিকে নাইট্রোজেন স্থিতিকারী ব্যাকটেরিয়া বলে। (B) বিভিন্ন প্রকার নীলাভ সবুজ শৈবাল সরাসরি বাতাসের নাইট্রোজেনকে আবদ্ধ করে মাটির নাইট্রোজেন যৌগের পরিমাণ বৃদ্ধি করে (যেমন — অ্যানাবিনা, নস্টক ইত্যাদি)। (C) মিথোজীবী ব্যাকটেরিয়া (যেমন — রাইজোবিয়াম) ছোলা, মটর প্রভৃতি শিম্বগোত্রীয় উদ্ভিদের মূলে অর্বুদ (nodule) গঠন করে বসবাস করে এবং বায়ু থেকে সরাসরি নাইট্রোজেন শোষণ করে নানাপ্রকার নাইট্রোজেনঘটিত যৌগ উৎপাদন করে। এইসব ব্যাকটেরিয়ার মৃত্যুর পরে তাদের দেহের নাইট্রোজেনঘটিত যৌগগুলি মাটিতে মিশে যায় ও নাইট্রোজেনের আবদ্ধকরণ ঘটে। 3. শিল্পজাত আবদ্ধকরণ – কলকারখানায় বিভিন্ন ধরনের নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ সার তৈরি হয়। যেমন — হ্যাবার বস্ পদ্ধতিতে 300-400°C তাপমাত্রায় এবং 35-100 MPa চাপে (MPa = মেগাপাসকাল, চাপের মেট্রিক বা SI একক) N2 ও H2 যুক্ত হয়ে NH3, উৎপন্ন হয়। NH3, ও অন্যান্য N2-যুক্ত সার প্রয়োগের ফলে মাটিতে নাইট্রোজেন সংবন্ধন ঘটে।
মাটির নাইট্রোজেন জীবদেহে প্রবেশ – উদ্ভিদ, মাটিতে আবদ্ধ নাইট্রোজেনঘটিত লবণ শোষণ করে এবং নিজদেহের চাহিদাপূরণ করে। এই নাইট্রোজেন উদ্ভিদদেহে উদ্ভিজ্জ প্রোটিনরূপে অবস্থান করে। প্রাণীরা খাদ্যের মাধ্যমে তা গ্রহণ করে নিজদেহে প্রবেশ করায় এবং প্রাণীদেহে প্রাণীজ প্রোটনিরূপে অবস্থান করে।
জীবদেহ থেকে নাইট্রোজেনের মাটিতে পুনঃপ্রবেশ – জীবদেহ থেকে নাইট্রোজেনের মাটিতে পুনঃপ্রবেশ ঘটে দুটি পদ্ধতির মাধ্যমে। এই পদ্ধতি দুটি হল — 1. অ্যামোনিফিকেশন – উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃতদেহ এবং প্রাণীর নাইট্রোজেনযুক্ত রেচন পদার্থ বিভিন্ন বিয়োজক দ্বারা বিয়োজিত হয়ে মাটিতে নাইট্রোজেনঘটিত যৌগের পরিমাণ বাড়ায়। এরপর এই যৌগগুলি অ্যামোনিফাইং ব্যাকটেরিয়া (ব্যাসিলাস মাইকয়ডিস ও মাইক্রোকক্কাস)-র দ্বারা বিশ্লিষ্ট হয়ে যে প্রক্রিয়ায় অ্যামোনিয়ায় পরিণত হয়, তাকে অ্যামোনিফিকেশন বলে। 2. নাইট্রিফিকেশন – মাটির অ্যামোনিয়া বিভিন্ন প্রকার নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা বিশ্লিষ্ট হয়ে নাইট্রাইট ও নাইট্রেটে পরিণত হয়, যে প্রক্রিয়ায় তাকে নাইট্রিফিকেশন বলে। নাইট্রিফিকেশনে অংশগ্রহণকারী ব্যাকটেরিয়াগুলিকে নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া বলে। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে অ্যামোনিয়া বা অ্যামোনিয়াম আয়নগুলি মাটিতে নাইট্রোসোমোনাস নামক ব্যাকটেরিয়ার ক্রিয়ায় নাইট্রাইট যৌগে পরিণত হয়। তারপর মাটিতে বসবাসকারী নাইট্রোব্যাকটর নামক ব্যাকটেরিয়া নাইট্রাইট যৌগকে নাইট্রেটে পরিণত করে।
2NH+4 +3O2→2N0–2+4H++2H20 ; 2N0–2+02→2N0–3
নাইট্রোজেনের মুক্তি বা মোচন বা ডিনাইট্রিফিকেশন – যে প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকাস্থিত নাইট্রাইট ও নাইট্রেট যৌগ থেকে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে নাইট্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন হয় এবং তা পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসে, তাকে ডিনাইট্রিফিকেশন বা নাইট্রোজেন মোচন বলে। এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে থায়োব্যাসিলাস, সিউডোমোনাস ইত্যাদি, ডিনাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া।
NO–3 →NO–2 →NO + N2O→N2
মানব ক্রিয়াকলাপ কীভাবে নাইট্রোজেন চক্রকে প্রভাবিত করে এবং মানব ক্রিয়াকলাপে মুক্ত অধিক নাইট্রোজেনের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো।
নাইট্রোজেন চক্রে প্রভাব সৃষ্টিকারী মানব ক্রিয়াকলাপ
- নাইট্রোজেন সারের ব্যবহার – জমির ফসল বৃদ্ধির জন্য জমিতে নাইট্রোজেন সার ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পরিবেশে N2O, NO2 প্রভৃতি গ্যাসগুলির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
- নাইট্রোজেন স্থিতিকারী উদ্ভিদচাষ – শিম্বগোত্রীয় উদ্ভিদ, যেমন — বিন, মটর, ডাল, বাদাম, ছোলা, রাজমা, সয়াবিন প্রভৃতি কৃষিজ উদ্ভিদগুলি প্রোটিনের জোগানদার বলে তাদের চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বায়ুর নাইট্রোজেন অধিকমাত্রায় মাটিতে আবদ্ধ হচ্ছে।
- জীবাশ্ম জ্বালানির দহন – খনিজ তেল, কয়লার দহনে নাইট্রিক অক্সাইড (NO), নাইট্রাস অক্সাইড (N2O) ও নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO2) গ্যাসের মুক্তি ঘটে। ফলে পরিবেশে নাইট্রোজেনের জোগান বৃদ্ধি পায়।
মানব ক্রিয়াকলাপে মুক্ত অধিক নাইট্রোজেনের ক্ষতিকারক প্রভাব
- বিশ্ব উষ্ণায়ন ও অম্লবৃষ্টি – নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাসটি তাপশোষী গ্রিনহাউস গ্যাস বা সূর্যালোকের প্রতিফলনে সৃষ্ট অবলোহিত আলো বা উত্তাপ শোষণ করে গ্রিনহাউস প্রভাব তথা বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটায়। নাইট্রোজেনের অক্সাইডগুলি বৃষ্টির জলের সঙ্গে বিক্রিয়ায় নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে, যা অম্লবৃষ্টির অন্যতম উপাদান। অম্লবৃষ্টি জলজ জীব ও উদ্ভিদ ধ্বংস করে নদী, হ্রদ, পুকুর প্রভৃতির বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে। এ ছাড়া অম্লবৃষ্টির প্রভাবে বনজ সম্পদের বিনাশ, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
- আলোকরাসায়নিক ধোঁয়াশা বা ফোটোকেমিক্যাল স্মগ – পেট্রোলিয়াম সৃষ্ট নাইট্রিক অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন আলোকের উপস্থিতিতে PAN (পারঅক্সি-অ্যাসিটাইল নাইট্রেট) উৎপন্ন করে যা আলোকরাসায়নিক ধোঁয়াশা উৎপন্ন করে। এটি দৃশ্যদূষণ ও শ্বাসনালীর প্রদাহ, শ্বাসকষ্ট সমস্যা সৃষ্টি করে।
নাইট্রোজেন চক্রে, বায়ুর নাইট্রোজেন অণুজীব দ্বারা কীভাবে আবদ্ধ হয় তা আলোচনা করো।
নাইট্রোজেন চক্রে বায়ুর নাইট্রোজেন অণুজীব দ্বারা নাইট্রোজেন আবদ্ধকরণ
কিছুকিছু অণুজীব বায়ুর নাইট্রোজেনকে, নাইট্রোজেনঘটিত যৌগে রূপান্তরিত করে মাটিতে আবদ্ধ করে। অণুজীব দ্বারা নাইট্রোজেন স্থিতিকরণকে জীবজ আবদ্ধকরণ বলে। দুই ধরনের অণুজীব দ্বারা এই পদ্ধতিটি সম্পন্ন হয়। নীচে সেগুলি আলোচনা করা হল।
- স্বাধীনজীবী অণুজীব দ্বারা আবদ্ধকরণ – কিছু স্বাধীনজীবী ব্যাকটেরিয়া, যেমন — ক্লসট্রিডিয়াম, অ্যাজোটোব্যাকটর প্রভৃতি এবং নস্টক, অ্যানাবিনা প্রভৃতি সায়ানোব্যাকটেরিয়া (নীলাভ-সবুজ শৈবাল) বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেনকে আবদ্ধ করে নাইট্রোজেনঘটিত যৌগ গঠন করে। এদের মৃত্যুর পরে নাইট্রোজেনঘটিত যৌগগুলি মাটিতে মিশে যায়।
- মিথোজীবী অণুজীব দ্বারা আবদ্ধকরণ – ছোলা, মশুর, শিম প্রভৃতি শিম্বগোত্রীয় উদ্ভিদের মূলে যে অর্বুদ বা নডিউল থাকে, তাতে রাইজোবিয়াম নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া বসবাস করে। এই ব্যাকটেরিয়া বায়ুমণ্ডল থেকে সরাসরি নাইট্রোজেন শোষণ করে, তার কিছুটা ভাগ আশ্রয়দাতা উদ্ভিদকে সরবরাহ করে তাকে সাহায্য করে এবং বাকি অংশ নিজের দেহে সঞ্চয় করে রেখে পরবর্তীকালে ব্যবহার করে। ব্যাকটেরিয়া এবং আশ্রয়দাতা শিম্বগোত্রীয় উদ্ভিদের মৃত্যুর পরে তাদের দেহের নাইট্রোজেন যৌগ মাটিতে মিশে যায়।
পরিবেশ তার সম্পদ এবং তাদের সংরক্ষণ, নাইট্রোজেন চক্র, এবং রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞানের আধারভূত বিষয়গুলি নিয়ে আমরা অনেক কিছু জানতে পেরেছি। পরিবেশ সম্পর্কিত জ্ঞানটি আমাদের বুদ্ধিমত্তা ও পরিচয় বৃদ্ধি করে এবং এর মাধ্যমে আমরা জীবনের সম্পদ সংরক্ষণের প্রশ্নগুলির প্রত্যাশা পাওয়ার জন্য উদ্যোগী হতে পারি। নাইট্রোজেন চক্রের মাধ্যমে আমরা বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারি এবং জীবনের বিভিন্ন প্রক্রিয়াগুলির জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রয়োজন হয়। এছাড়াও রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর আমাদের পাঠকের বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও তার বিজ্ঞানিক প্রক্রিয়া বিকাশে সহায়তা করে।