অষ্টম শ্রেণি – বাংলা – আদাব – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

Sourav Das

অষ্টম শ্রেণির বাংলা বিষয়ের আদাব অধ্যায়ের রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর গুলি পরীক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এইভাবে আদাব অধ্যায়ের রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর গুলি যদি তোমরা প্রস্তুত করে না যাও তাহলে পরীক্ষায় আদাব অধ্যায়ের রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর গুলোর উত্তর দিতে পারবে না। তাই আদাব অধ্যায়ের রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর গুলি ভালো করে মুখস্ত করে গেলে তোমরা পরীক্ষায় খুব ভালো ফলাফল পাবে।

Table of Contents

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর “আদাব” গল্পটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মানবিকতার জয়গান গায়। গল্পের শুরুতেই লেখক তুলে ধরেছেন দাঙ্গার তীব্রতা, যেখানে বস্তি জ্বলছে, মানুষ চিৎকার করছে, রাস্তাঘাট ফাঁকা, এবং শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে। এই অসম্প্রীতির পরিবেশেই দুই ভিন্ন ধর্মের মানুষ – একজন হিন্দু সুতার কলের মজুর এবং একজন মুসলিম নাওয়ের মাঝি – একে অপরের সাথে পরিচিত হয়।

লেখক দু’জন চরিত্রের মধ্যে আলাপনার মাধ্যমে পারস্পরিক বিশ্বাস ও বোঝাপড়া তৈরি করেছেন। ধর্মীয় পার্থক্য ভুলে তারা একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করে। এই আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন যে, মানুষের ধর্ম বা পেশা তার মৌলিক মানবিকতাকে সংজ্ঞায়িত করে না।

গল্পের শেষে যদিও মুসলিম নাওয়ের মাঝি নির্মমভাবে নিহত হয়, তবুও তার মৃত্যুতে হিন্দু সুতার কলের মজুরের মনে সম্প্রীতির বোধ আরও দৃঢ় হয়। এই ট্র্যাজেডির মাধ্যমে লেখক আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, ঘৃণা ও বিভেদের পরিবর্তে আমাদের সকলেরই একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত।

“আদাব” কেবল একটি গল্প নয়, এটি একটি শক্তিশালী বার্তা। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মানবতা ধর্ম বা পটভূমির চেয়েও বড়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্য গড়ে তোলার জন্য আমাদের সকলেরই এগিয়ে আসতে হবে।

আদাব – অষ্টম শ্রেণি – বাংলা – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

শহরে ১৪৪ ধারা আর কারফিউ অর্ডার জারি। হয়েছে – লেখকের অনুসরণে গল্প ঘটনার রাতের দৃশ্য বর্ণনা করো।

আদাব গল্পের শুরুতে দাঙ্গা-আতঙ্কিত যে রাত্রিকালীন ছবি আঁকা হয়েছে তা এরকম – রাত্রির নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে মিলিটারি টহলদার গাড়িটা একবার ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে একটা পাক খেয়ে গেল। সারা শহর ১৪৪ ধারার কবলে, কারফিউ জারি হয়েছে। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বেঁধেছে। গুপ্তঘাতকের দল চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে শাণিত অস্ত্র হাতে। অন্ধকারের সুযোগে লুকিয়েছাপিয়ে আঘাত হানছে তারা। মানুষের হাতে হাতে দা-সড়কি-ছুরি-লাঠি। মুখোমুখি লড়াই চলছে। লুটপাট যাদের কাজ, মৃত্যু-বিভীষিকাময় এই রাত্রিতে তাদের উল্লাসও প্রবল। বস্তি জ্বলছে। মৃত্যুকাতর নারী ও শিশুর চিৎকার স্থানিক আবহাওয়াকে বীভৎসতা দিয়েছে। এর উপর রয়েছে সৈন্যবাহী গাড়ির হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়া এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গুলি ছোঁড়া।

হঠাৎ ডাস্টবিনটা একটু নড়ে উঠল। – ‘ডাস্টবিন্ নড়ে ওঠা’র অব্যবহিত পরে কী দেখা গেল?

দুটি রাস্তার মোড়ে উলটে থাকা ভাঙাচোরা ডাস্টবিনটাকে আড়াল করে গলি থেকে একটা লোক দাঙ্গা-পরিস্থিতির নির্জন আবহাওয়ায় বের হয়ে এল, ভীতসন্ত্রস্ত তার অবস্থা। ডাস্টবিনটার আড়ালে হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে তার শিরা-উপশিরা যেন শিরশিরিয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে হাত-পাগুলোকে কঠিন করে সে প্রতীক্ষা করে রইল ভীষণ কিছুর জন্য। নিশ্চল-নিস্তব্ধ অবস্থায় কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল। কুকুর সন্দেহে লোকটা ডাস্টবিনটায় একটু ঠেলা দিল। কিছু হল না। আবার সেটা নড়ে উঠতেই এবার লোকটার ভয়ের সঙ্গে এল কৌতূহল। লোকটা যেমনি একটু মাথা তুলেছে, দেখে, ওপাশ থেকে অন্য একটা মাথা উঠে এল। ‘মানুষ! ডাস্টবিনের দুই পাশে দুটি প্রাণী, নিস্পন্দ নিশ্চল।’ লোকটার হৃৎস্পন্দন তাল হারাচ্ছে, থেমে যেতে চাইছে। চারটে চোখেই এখন ভয়-সন্দেহ-উত্তেজনা। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চাইছে না, ভাবছে খুনি। চোখে চোখ স্থির, অজানা আক্রমণের প্রতীক্ষা দুজনেরই। যখন প্রকৃতই তা হল না, তখন দুজনের মনেই প্রশ্ন জাগল – হিন্দু, না মুসলমান। দুজনেই ভাবছে-পরিচয় জানলেই হয়তো বিপরীত দিক থেকে আক্রমণ আসবে। তাই কেউ কারও পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে পারছে না, পালানোর শক্তিও তাদের নেই পিছন থেকে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে।

হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির আবহ গল্পে কীভাবে রচিত হয়েছে তা বিশ্লেষণ করো।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিকায় রচিত। গল্পের শুরুতে গল্পকার দাঙ্গার ভয়াবহতা, দাঙ্গা-পরিস্থিতির আবহ রচনা করেছেন বটে; তবে পরবর্তী ক্ষেত্রে দুটি সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের মধ্যে আত্মিক মিলনের মধ্য দিয়ে তিনি একটা দাঙ্গাবিরোধী পরিস্থিতির পত্তন করেছেন গল্পে।

পরিবেশ ছিল অসম্প্রীতির। দাঙ্গা চারদিকে আগুন জ্বালিয়েছে। বস্তি জ্বলছে। মানুষের মৃত্যু-চিৎকারে আকাশ-বাতাস মুখরিত। রাস্তাঘাট ফাঁকা, রাত্রির নিস্তব্ধতা খান খান করে মিলিটারি টহলদার গাড়ি ছোটাছুটি করছে। শহরে কারফিউ, ১৪৪ ধারা।

এ গল্পে তীব্র ভয়ার্ত পরিবেশ, হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক অবিশ্বাস, দাঙ্গার আগুন, সবমিলিয়ে যে অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল – লেখক সেখানে দুটি ভিন্নধর্মের ভয়ার্ত মানুষকে সুকৌশলে কাছাকাছি এনেছেন। পরস্পরের আলাপনের মধ্য দিয়ে বিশ্বাস ও মানবতার বাতাবরণ তৈরি করেছেন এবং গল্পে শেষপর্যন্ত অসম্প্রীতির পরিবেশের মধ্যে সম্প্রীতির ফুল ফুটেছে। যদিও গল্পের শেষে মুসলমান নাওয়ের মাঝির বীভৎস মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে। তবুও তাতে ভয়াবহ মৃত্যুমুখিন পরিস্থিতিতে সদ্য পরিচিত হিন্দু সুতাকলের মজুরের মনে সম্প্রীতির আবহ আরও জোরালো হয়েছে।

মুহূর্তগুলিও কাটে যেন মৃত্যুর প্রতীক্ষার মতো। – সেই রুদ্ধ উত্তেজনাকর মুহূর্তগুলির ছবি গল্পে কীভাবে ধরা পড়েছে তা দৃষ্টান্তসহ আলোচনা করো।

প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-পরিস্থিতির যে চিত্র সংযোজিত হয়েছে তার মধ্যে দুটি অতিসাধারণ হিন্দু-মুসলমান খেটে-খাওয়া মানুষকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে দেখা যায়। কারফিউ-এর রাতে দুটি মানুষ দু-দিক থেকে এসে সবে নিজেদের মন মেলে ধরার চেষ্টা করেছে, এমন সময় দূরে একটা শোরগোল ওঠে। একসময় তা মিলিয়েও যায়। মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধতা নেমে আসে সেখানে।

এই মৃত্যু প্রতীক্ষিত নিস্তব্ধতায় নাওয়ের মাঝির দেশলাই হঠাৎ জ্বলে ওঠার পর ‘সোহান্ আল্লা’ বলায় নিমেষে গল্পের পরিস্থিতি বদলে যায়। লেখকের ভাষায়, ‘ভূত দেখার মতো চমকে উঠল সুতা-মজুর। টেপা ঠোঁটের ফাঁক থেকে লড়ে গেল বিড়িটা – তুমি? একটা হালকা বাতাস এসে যেন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল কাঠিটা। অন্ধকারের মধ্যে দু-জোড়া চোখ অবিশ্বাসে উত্তেজনায় আবার বড়ো বড়ো হয়ে উঠল।’ আবার নাওয়ের মাঝি যে মুসলমান, এ জানার পর সুতামজুর যখন মাঝির বগলের পুঁটলি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করে – ‘ওইটার মধ্যে কী আছে?’ তখনও দাঙ্গাজনিত আতঙ্ক আরও একবার দানা বেঁধে উঠতে দেখা যায়। মুসলমান মাঝির মনেও সুতামজুর সম্পর্কে সন্দেহ দানা বাঁধে। সেও জিজ্ঞাসা করে – ‘তুমি কিছু রাখ-টাখ নাই তো?’ সুতামজুর জবাব দেয় – ‘ভগবানের কিরা কইরা কইতে পারি একটা সুইও নাই।’ মারণাস্ত্র হিসেবে সূচের কোনো মূল্য নেই, কিন্তু লেখক তাকে শিল্পিত ব্যবহার করেছেন।

এমনভাবে মানুষ নির্মম নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে কী করে? – উদ্ধৃতিটির আলোকে সেই সময়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি আলোচনা করো।

দাঙ্গার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যারা দাঙ্গা বাধায়, দাঙ্গার রক্তাক্ত পরিণাম থেকে তারা থাকে দুরে আর নিরপরাধ সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। ভারতের দীর্ঘ স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষে যখন ব্রিটিশ সরকার আর বুঝে উঠতে পারছে না, তখনই তারা এদেশে প্রয়োগ করে তাদের চরম ভেদনীতি। এদেশের দুই প্রধান ধর্মগোষ্ঠী হিন্দু ও মুসলমানকে রাজনৈতিকভাবে লড়িয়ে দিয়ে তারা ভারতের অন্তরশক্তিকে ভেঙে দিতে চায়। এর পরিণতিতে প্রাক্‌স্বাধীনতা পর্বে ১৯৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দে যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উদ্ভব হয় তাতে অবিস্মরণীয় সাধারণ মানুষ কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনকারী মানুষের উসকানিতে হাতে তুলে নেয় হাতিয়ার। রক্তের নদী বয়ে যায়। সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে নারী-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-শিশু কেউই বাদ পড়েনি। সরে যায় মানবিকবোধ, গড়ে ওঠে পারস্পরিক চরম অবিশ্বাস ও হিংসাশ্রয়ী হত্যালীলার বাতাবরণ। স্থানে স্থানে ছিন্নমূল, গৃহহারা মানুষের ঢল নামে। এই হানাহানি আর নিষ্ঠুরতার প্রেক্ষাপটেই ভারত স্বাধীন হয় ভৌগোলিকভাবে দ্বিখণ্ডিত হয়ে।

রাত্রির নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে দিয়ে মিলিটারি টহলদার গাড়িটা একবার ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে একটা পাক খেয়ে গেল। – বাক্যটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পে উক্ত উদ্ধৃতিটি রয়েছে। দেখা যায় দিনে যে দাঙ্গা ততটা প্রকট হয় না, রাতে তা প্রবলভাবে প্রমত্ত হয়ে ওঠে। কারণ আততায়ী, লুটেরা, দাঙ্গাবাজের দল রাতের অন্ধকারকে আশ্রয় করেই তাদের উদ্দেশ্যসাধন করতে চায়। দাঙ্গা বাধায় মতলববাজরা; আর তাকে খুনোখুনি, রক্তারক্তি, লুঠতরাজ, অগ্নিকাণ্ডে পরিণত করে অমানুষের দল। সরকার তা জানে বলেই তা দমন করতে তৎপর হয়। এতে পুলিশের একটা বড়ো ভূমিকা তো থাকেই। আবার মিলিটারি অর্থাৎ সৈন্যবাহিনীর লোকজনকেও অনেকসময় দাঙ্গা দমনে কাজে লাগানো হয়। গল্পের শুরুতে দেখা যায়, কারফিউ অর্থাৎ ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে দাঙ্গা দমনে। তাই মিলিটারি টহলদারি গাড়ি রাত্রির নিস্তব্ধতাকে খান খান করে রাস্তায় রাস্তায় পাক খেয়ে যাচ্ছে।

ডাস্টবিনের দুই পাশে দুটি প্রাণী, নিস্পন্দ নিশ্চল। – বাক্যটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্প থেকে উক্ত উদ্ধৃতিটি সংকলিত হয়েছে। রাস্তার পাশে ডাস্টবিনের অবস্থান। খানিকটা যেন হেলে পড়া। স্থানে স্থানে ভাঙাচোরা অবস্থা। চারদিকে দাঙ্গা পরিস্থিতির একটা থমথমে ভাব। ডাস্টবিনটাকে আড়াল করে ভীতসন্ত্রস্ত একটা লোক বেরিয়ে এসে নির্জীবের মতো ভূমিলগ্ন হয়ে পড়ে রইল। ভয়ে মাথা তোলারও সাহস নেই তার। কিছুক্ষণের মধ্যে ডাস্টবিনটা হঠাৎ নড়ে উঠল। ওপাশে ঘাপটি মেরে এতক্ষণ বসে ছিল অন্য একটা লোক। সেও সমান ভীতসন্ত্রস্ত। হয়তো বাইরের শব্দ তাকে আতঙ্কিত করেছে। প্রথম লোকটার দেহের শিরা-উপশিরা শিরশিরিয়ে উঠল, দাঁতে দাঁত চেপে হাত-পাগুলোকে কঠিন করে সে যেন ভয়ানক কিছুর প্রতীক্ষা করে রইল। আরও কিছুক্ষণ মৃত্যু-প্রতীক্ষার পর ওপাশের লোকটা মাথা তুলতেই ডাস্টবিনের দু-পাশে দুটো মানুষ যেন নিস্পন্দ-নিশ্চল হয়ে গেল। কারণ দুজনের প্রতি দুজনের প্রবল অবিশ্বাস। দুজনে দুজনকে ভাবছে খুনি। এক্ষুনি বুঝি আক্রমণ আসতে পারে যে-কোনো দিক থেকে।

স্থান-কাল ভুলে রাগে-দুঃখে মাঝি প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে। – বাক্যটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পে দাঙ্গা পরিস্থিতির দারুণ রাতে দুটি সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ যখন এক অপেক্ষাকৃত নির্জন স্থানে মিলিত হয়েছিল, কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কাছাকাছি কোথাও শোরগোল উঠতেই নাওয়ের মাঝি স্থানত্যাগ করতে চেয়েছিল। সুতামজুর তা করতে দিতে চায় না। কারণ সে জানত খুনির দলের সামনে পড়ে গেলে মরণ নিশ্চিত। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে প্রবল সন্দেহের চাপানউতোর শুরু হয়। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না, পরিস্থিতিও সত্যিকার তেমন ছিল না। কিন্তু মাঝি যাবেই। আর সুতামজুর তাকে যেতে দেবে না। এ এক সাধারণ মানবিক অনুভূতির ব্যাপার। কিন্তু মাঝির চলে যাওয়ার জেদ দেখে সুতামজুরের যখন মনে হয় – ও দলবল ডেকে আনতে যাচ্ছে খুনের উদ্দেশ্যে তখনই স্থান-কাল ভুলে মাঝি তার প্রতিবাদ করে ওঠে – ‘এইটা কেমুন কথা কও তুমি?’ বলাবাহুল্য পরিস্থিতির চাপও এর জন্য দায়ী।

অন্ধকারের মধ্যে দু-জোড়া চোখ অবিশ্বাসে উত্তেজনায় আবার বড়ো বড়ো হয়ে উঠল। – বাক্যটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পে দাঙ্গার প্রেক্ষাপট এবং দাঙ্গাজনিত পরিস্থিতির ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। গল্পের শুরুতে অন্ধকারের আতঙ্কিত বাতাবরণে যখন ‘দিন আনি দিন খাই’ জীবনে নাওয়ের মাঝি ও সুতামজুর একে অপরকে আবিষ্কার করল; তখন দুজনের মনেই প্রবল আলোড়ন, প্রবল অবিশ্বাস। তারা মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ভেবেছে এ খুনি নয়তো, এ আক্রমণ করবে না তো? এর কাছে কোনো গুপ্ত অস্ত্র নেই তো, কিংবা এ হিন্দু না মুসলমান? অথচ কেউ স্পষ্ট করে কারও পরিচয় জানতেও চাইছে না। এমন দমবন্ধ পরিস্থিতিতে সুতামজুর মাঝিকে একটা বিড়ি উপহার দেয়। কিন্তু দেশলাই জ্বালাতে গিয়ে মাঝির মুখ থেকে ‘সোহান্ আল্লা।’ কথাটি বের হতেই মুহূর্তে পরিস্থিতি বদলে যায়। প্রবল অবিশ্বাস আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সুতামজুর বুঝতে পারে মাঝি মুসলমান। সে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। অন্ধকারের মধ্যে দু-জোড়া চোখ অবিশ্বাস উত্তেজনায় যেন আবার বড়ো হয়ে ওঠে।

সুতা-মজুরের বুকের মধ্যে টনটন্ করে ওঠে। – বাক্যটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পের শেষে দেখা যায় দাঙ্গা দমনের জন্য পুলিশি তৎপরতা যখন তুঙ্গে, তখন নাওয়ের মাঝি ঘরে ফেরার জন্য ছটফট করছে। তার বগলের পুঁটলিতে বিবির জন্য ইদের শাড়ি, ছেলেমেয়েদের জামাকাপড়। কিন্তু একটি নিদারুণ রাতের মন্দ পরিস্থিতিতে মাঝি ও সুতামজুরের মনে তখন তৈরি হয়েছে ভালোবাসার জমি। এই মানবিকতার জন্যই সুতামজুর কিছুতেই মাঝিকে বিপদের মধ্যে ঝাঁপ দিতে নিষেধ করে। মাঝি বলে, ‘নৌকা না পাই সাঁতরাইয়া পার হমু বুড়িগঙ্গা।’ সুতামজুর জানে পরিস্থিতির ভয়াবহতা। সে মাঝির কামিজ চেপে ধরে। মাঝির ঘরে ফেরার তাড়া দেখে সুতামজুরও মনে মনে বেদনাকাতর হয়। কারণ কাল ইদ। মাঝির বিবি-বাচ্চারা নতুন জামাকাপড় আশা করে তার পথ চেয়ে আছে। তাই সুতামজুরের বুকের মধ্যে টনটন করে ওঠে। কামিজ ধরা হাতটা শিথিল হয়ে আসে।

ভুলুম না ভাই এই রাত্রের কথা। – বাক্যটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

সুসাহিত্যিক সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পে ঘনিয়ে উঠেছে দাঙ্গা-পরিস্থিতির রাত্রিকালীন ভয়াবহতার ঘনবদ্ধ চিত্র। এমন নিদারুণ রাত্রে তীব্র ভয়কাতর পরিবেশে সম্পূর্ণ অপরিচিত নাওয়ের মাঝি ও সুতামজুর একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়। পরিচয়ের প্রথম লগ্নে এদের মনে দানা বেঁধেছিল অস্বাভাবিক অবিশ্বাস, নিদারুণ সন্দেহ এবং আক্রান্ত হওয়ার ভীষণ ভয়। কিন্তু পরিস্থিতির ভয়াবহতাই বুঝি পরবর্তী ক্ষেত্রে বিপরীত স্রোতে জাগিয়ে তুলেছিল একে অপরের প্রতি আস্থা, সহানুভূতি ও ভালোবাসা। তাই যখন অবস্থার ভয়াবহতার কথা ভুলে এক জেদি দুশ্চিন্তিত মাঝি বুড়িগঙ্গা পার হয়ে নিজের ঘরে ফিরতে তৎপর, তখন সুতামজুর তাকে বাধা দেয়। সে কিছুতেই মাঝিকে পুলিশের বা দাঙ্গাবাজদের হাতে খুন হতে দিতে চায় না। নাচার সুতামজুরের আতঙ্কিত জিজ্ঞাসা – ‘যদি তোমায় ধইরা ফেলায়?’ তার অনুকম্পার উত্তরে মাঝি বলে, না তাকে ধরতে পারবে না; সে যেন ভয় না পেয়ে, সেখানেই থাকে। সেও সেই রাতের কথা কখনও ভুলবে না।

ছাড়াছাড়ি হওয়ার আগে মাঝি ও সুতামজুরের মনের অবস্থা বর্ণনা করো।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পে মাঝি ও সুতামজুরের ধর্ম ছিল ভিন্নকর্ম ও বাসস্থানও। ঘটনাক্রমে দুজনের মধ্যে যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল তা কিন্তু নিতান্তই মানবিক। তাই সুতামজুরকে ছেড়ে যাওয়ার আগে মাঝি যখন বলল – ‘আমি যাইগা’, তখন মাঝির গলায় আবেগ ও আশঙ্কায় ভেঙে পড়ে। মাঝি জানায়-তার পক্ষে আর থাকা সম্ভব নয়, আজ আটদিন সে ঘরছাড়া। তাই নৌকো না পেলে সাঁতরেই সে বুড়িগঙ্গা পার হবে। তার কামিজ চেপে ধরে মাঝি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। উত্তেজনায় তার গলা কাঁপছে। মাঝি জানায় কাল ইদ। ছেলেমেয়েরা আশা করে রয়েছে যে ইদে নতুন জামা পরবে। বাপজানের কোলে চড়বে। তার বিবি হয়তো চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছে। মাঝির এই ব্যক্তি-দুঃখের কথা শুনে সুতামজুরের বুকের ভিতর টনটন করে ওঠে। একের দুঃখ যেন অন্যের হৃদয়ের জমিকে ভিজিয়ে দেয়। তাই আতঙ্কিত কণ্ঠে সুতামজুর বলে – ‘যদি তোমাকে ধরে ফেলে?’ মাঝি উদবেলিত কণ্ঠে জানায় – ‘পারবে না ধরতে। ভয় পেও না। এখানেই থেকো। এই রাতের কথা ভুলব না।’ এরপর সে আদাব জানায়, প্রত্যুত্তরে সুতামজুরও বলে ‘আদাব’।

মাঝি চলে যায়। এক বুক আত্মীয়সুলভ উদবেগ নিয়ে সুতা – মজুর দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে দেবতার কাছে প্রার্থনা করে – ‘ভগমান্ মাজি য্যান্ বিপদে না পড়ে।’ মাঝি সম্পর্কে তার মন আরও প্রসারিত হয়ে মুহূর্তে পৌঁছে যায় মাঝির বাড়িতে। সে ভাবে-আহা! মাঝির পোলা-মাইয়ারা কত আশা করে আছে নতুন জামা পরবে বলে। আনন্দে তাদের মুখ আলো হয়ে যাবে। বাপজানেরও কত আনন্দ। সোহাগে আর কান্নায় মাঝির বিবি বুঝি ভেঙে পড়বে মিয়া সাহেবের বুকে। বলবে – ‘মরণের মুখ থেইকা তুমি বাঁইচা আইছ?’ মাঝির এই পরিবারের সঙ্গে মিলন কল্পনা করে সুতামজুরের মুখেও যেন একটু হাসি খেলে যায়।

সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পে দাঙ্গা পরিস্থিতির যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর একটি অসাধারণ গল্প ‘আদাব’, যেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে বিষয় করে লেখক একটি মানবিক সত্যে পৌঁছোতে চেয়েছেন। দাঙ্গা মানুষের জীবনবোধের পথে চরম বৈরী। দাঙ্গা সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষকে সাম্প্রদায়িক করে ঘাতকে পরিণত করে। লেখক গল্প শুরু করেছেন রাত্রির নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে মিলিটারি টহলদার গাড়ির পাক খাওয়ার চিত্র দিয়ে। শহরে তখন প্রযুক্ত ১৪৪ ধারা আর কারফিউ। মানুষজন মুখোমুখি দা, সড়কি, ছুরি, লাঠি নিয়ে। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে পড়েছে গুপ্তঘাতকের দল, যারা অন্ধকারকে আশ্রয় করে চোরাগোপ্তা আঘাত হানছে। লুটেরারাও থেমে নেই। মৃত্যুর বিভীষিকা তাদের উল্লাসকে তীব্রতর করে তুলেছে। বস্তিতে বস্তিতে আগুনের ডালপালা ক্রমে বিস্তৃত হয়ে উঠছে। কান পাতলেই আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হতে শোনা যাচ্ছে মৃত্যুকাতর নরনারী-শিশুর চিৎকার। স্থানিক আবহাওয়া যেন বীভৎস হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে সোনায় সোহাগার মতো মাঝেমধ্যে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সৈন্যবাহী গাড়ি। আইনরক্ষার্থে তারা দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গুলি ছুঁড়ছে।

এ গল্পে দাঙ্গার পরিবেশ লেখক সর্বত্রই বজায় রেখেছেন। মাঝি ও সুতামজুরের ভাবনা, তাদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা তাদের সন্দেহ-অবিশ্বাস-আতঙ্কই প্রমাণ করে দাঙ্গার ভয়াবহতা কীভাবে মানুষের মনে প্রবেশ করে তাদের সাধারণ জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। হিন্দু কর্তৃক মুসলমান ও মুসলমান কর্তৃক হিন্দুর প্রতি তীব্র অবিশ্বাস ও সন্দেহের ছবি এ গল্পে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। কথাপ্রসঙ্গে সুতামজুর জানায় – ‘রায়টে’ আমার ভগ্নিপতিরে কাইটা চাইর টুকরা কইরা মারল।’ মেথর যাতায়াতের সরু গলির মধ্যে দুই বিপন্ন মানুষ যখন লুকিয়ে আছে, তখন এক ইংরেজ অশ্বারোহী রিভলবার হাতে তাদের বুকেও অশ্বখুরধ্বনি তুলে দিয়ে চলে যায়। এ যেন দাঙ্গাজনিত পরিস্থিতিরই ছবি। গল্প শেষে দেখা যায়, সম্পূর্ণ অকারণে ভয়ার্ত এক মানুষকে পুলিশ গুলি করে মারছে দাঙ্গা-নিয়ন্ত্রণের কারণে। দরিদ্র নাওয়ের মাঝি এ গল্পে দাঙ্গারই শিকার প্রকারান্তরে।

সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পে নাওয়ের মাঝির চরিত্র আলোচনা করো।

সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পটি বক্তব্যপ্রধান। চরিত্র এখানে গৌণ। তবে যেহেতু গল্পে ঘটনার বাহক চরিত্রই, সেহেতু এ গল্পেও লেখকের ভাববাহী দুটি চরিত্রের আগমন লক্ষ করা যায়, যারা গল্পে তেমন চরিত্ররেখায় স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। তবুও এ গল্পে অনেকাংশে স্পষ্টতর চরিত্র হিসেবে যাদের পাওয়া যায় তারা হল – নাওয়ের মাঝি ও সুতামজুর। এদের চরিত্ররেখা পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। নাওয়ের মাঝি মুসলমান। বুড়িগঙ্গার হেইপারে সুবইডায় তার বাড়ি। বাড়িতে তার সন্তান ও বিবি বর্তমান। আর্থিক দিক থেকে সে প্রায় হতদরিদ্র। তবে তার নাও আছে। খেয়াপারাপার করেই তার জীবিকা নির্বাহ হয়। তার বগলে একটা পুঁটলি। যার মধ্যে ইদের তোফা হিসেবে সন্তানদের জামা ও বিবির একখানা শাড়ি ছিল। আলাপ হওয়ার পর প্রথম প্রথম সুতামজুরের প্রতি তার প্রবল সন্দেহ থাকলেও পরে সে যথেষ্ট মানবিক হয়ে ওঠে। দেশলাই জ্বালার আনন্দে অকস্মাৎ ‘সোহান্ আল্লা’ বলে নিজেকে চিনিয়ে ফেলার পর সে তেজের সঙ্গে ঘোষণা করে ‘হ আমি মোছলমান।– কী হইছে?’ এতে তার শুদ্ধ অন্তরাত্মার প্রকাশ দেখা যায়। বিদায়ের মুহূর্তে সে সুতামজুরকে বলে ‘যাই ভুলুম না ভাই এই রাত্রির কথা। নসিবে থাকলে আবার তোমার লগে মোলাকাত হইব।-আদাব।’ পুলিশের গুলিতে সে দাঙ্গার শিকার হয়।

সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পে সুতা মজুরের চরিত্র আলোচনা করো।

সুতামজুর হিন্দু। নারায়ণগঞ্জের কাছে চাষাড়ায় তার বাড়ি। সেখানে সে সুতাকলে মজদুরি করে। ইতিপূর্বে এক দাঙ্গায় তার ভগ্নীপতির মৃত্যু হলে ভগ্নী ও তার ছেলেমেয়েরা তার ঘাড়ে এসে পড়ে। বেশ বোঝা যায়, তার দারিদ্র্যের সংসারে তাকে বেশ মেহনত করেই বাঁচতে হয়। দাঙ্গা-পরিস্থিতিতে মাঝির সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর তারও মনে তীব্র সন্দেহ, অবিশ্বাস, আতঙ্ক ইত্যাদি ভাবের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। তবে শেষপর্যন্ত মাঝিকে সে আত্মীয়বৎ গ্রহণ করে। মাঝিকে সে একটা বিড়ি বের করে খেতে দেয়। অকস্মাৎ মাঝি যে মুসলমান তা জানতে পেরে আতঙ্কিতও হয় সে। দাঙ্গা সম্পর্কে উষ্মা প্রকাশিত হয় তার কথায় এভাবে – ‘তুমি মরবা, আমি মরুম, আর আমাগো পোলামাইয়াগুলি ভিক্ষা কইরা বেড়াইব।’ এতে তার দাঙ্গাবিরোধী মনোভাবই প্রকাশিত হয়। মাঝিকে সে কিছুতেই যেতে দিতে চায় না, সামনে বিপদ আছে ভেবে। তার চলে যাওয়ার কালে ‘না’ বলে সে মাঝির কামিজ চেপে ধরে। প্রার্থনা করে – ‘ভগমান্-মাজি য্যান বিপদে না পড়ে।’ অর্থাৎ সুতামজুর চরিত্রটিও যথেষ্ট মানবিক।

সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পটি গল্প হিসেবে সার্থক কিনা আলোচনা করো।

সাহিত্যিক সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পটি তাঁর একটি অন্যতম সেরা ছোটোগল্প। এ গল্পে দাঙ্গাই প্রাধান্য লাভ করেছে। অর্থাৎ একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে এ গল্প রচনা করে তিনি একটি বিশিষ্ট আবেদন পাঠককুলের সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন। এখন বিচারবিশ্লেষণ করে দেখা যাক এর সার্থকতার দিকটি।

কোনো গল্পকে গল্প হয়ে উঠতে গেলে তাকে কতকগুলি শর্ত পালন করতে হয়। গল্পে আদি-মধ্য-অন্ত্যবিশিষ্ট একটি অনতিদীর্ঘ কাহিনি থাকতে হবে, যা শুরু থেকে শেষপর্যন্ত একমুখীন গতি নিয়ে অগ্রসর হবে। এই কাহিনিতে ঘটনার ঘনঘটা, চরিত্রের অকারণ প্রাচুর্য, বর্ণনার বাড়াবাড়ি ততটা থাকবে না। গল্পটি পড়ে গল্পশেষে পাঠক একটি চরম অতৃপ্তির সম্মুখীন হবে, অর্থাৎ মনে হবে এ বুঝি শেষ হয়েও শেষ হল না।

এই নিরিখে বিচার করলে দেখা যায় – লেখক যথেষ্ট সার্থকতার নিদর্শন আমদানি করেছেন। গল্পের শুরুতে ভয়াবহ দাঙ্গা-পরিস্থিতির সামনে দুই অতিসাধারণ ভয়ার্ত মানুষ হাজির হয়। তাদের পারস্পরিক অবিশ্বাস, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠা, তাদের কাছে আসা উক্ত পর্বে বর্ণিত হয়েছে। পরবর্তী স্তরে দেখা যায় কোথাও শোরগোল উঠলে তাদের মনে আতঙ্ক, আতঙ্ক থেকে সাবধানতা, সাবধানতা থেকে আত্মগোপনের কৌশল অবলম্বন ইত্যাদি ঘটে। শেষ পর্বে দেখা যায়, তাদের মধ্যে ঘরে ফেরার তাগিদ। একে অপরকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনায় মানসিক অস্থিরতা এবং ছেড়ে যাওয়ার অন্তিমতায় একজনের দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণকারী পুলিশের গুলিতে মৃত্যু। অর্থাৎ এখানে আদি-মধ্য-অন্ত্যবিশিষ্ট গল্পরেখাটি বর্তমান। চরিত্র বলতে এখানে লেখক স্পষ্টরেখায় মাঝি ও সুতামজুরকেই কেবল প্রয়োগ করেছেন। গল্পশেষে একটি চমকও লক্ষ করা যায় মাঝির অকালমৃত্যুজনিত আবহে।

অতএব পরিকাঠামোগত দিক ও পরিণতিগত দিক উভয়ত এ গল্প যে সার্থক, তা বলা যায়।

নীচের বাক্যগুলি থেকে অব্যয় পদ খুঁজে নিয়ে কোনটি কোন্ শ্রেণির অব্যয় তা নির্দেশ করো –

  • শহরে ১৪৪ ধারা আর কারফিউ অর্ডার জারি হয়েছে।
  • তারা গুলি ছুঁড়ছে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে।
  • উভয়েই একটা আক্রমণের প্রতীক্ষা করতে থাকে, কিন্তু খানিকক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনো পক্ষ থেকেই আক্রমণ এল না।
  • তোমার মতলবডা তো ভালো মনে হইতেছে না।
  • মাঝি এমনভাবে কথা বলে যেন সে তার কোনো আত্মীয়বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে।
অব্যয়অব্যয়ের শ্রেণিবিভাগ
আরসংযোজক অব্যয়
সংযোজক অব্যয়
কিন্তুসংযোজক অব্যয়
তোআলংকারিক অব্যয়
যেনসংশয়সূচক অব্যয়

নীচের বাক্যগুলি থেকে সন্ধিবদ্ধ পদ খুঁজে নিয়ে তাদের সন্ধিবিচ্ছেদ করো –

  • তা ছাড়া চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে গুপ্তঘাতকের দল।
  • মৃত্যু-বিভীষিকাময় এই অন্ধকার রাত্রি তাদের উল্লাসকে তীব্রতর করে তুলেছে।
  • নির্জীবের মতো পড়ে রইল খানিকক্ষণ।
  • দাঁতে দাঁত চেপে হাত পা-গুলোকে কঠিন করে লোকটা প্রতীক্ষা করে রইল একটা ভীষণ কিছুর জন্য।
  • সমস্ত অঞ্চলটার নৈশ নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে দুবার গর্জে উঠল অফিসারের আগ্নেয়াস্ত্র।
সন্ধিবদ্ধ শব্দসন্ধি বিচ্ছেদ
চতুর্দিকেচতুঃ + দিকে
উল্লাসকেউৎ + লাসকে
নির্জীবেরনিঃ + জীবের
প্রতীক্ষাপ্রতি + ঈক্ষা
আগ্নেয়াস্ত্রআগ্নেয় + অস্ত্র

ব্যাসবাক্যসহ সমাসের নাম লেখো –

চোরাগোপ্তা, পথনির্দেশ, নির্জীব, দীর্ঘনিশ্বাস, পোলামাইয়া।

সমাসব্যাসবাক্যসমাসের শ্রেণি
চোরাগোপ্তাচোরা ও গোপ্তাদ্বন্দ্ব
পথনির্দেশপথের নির্দেশসম্বন্ধ তৎপুরুষ
নির্জীবনিঃ (নাই) জীবন যারনঞবহুব্রীহি
দীর্ঘনিশ্বাসদীর্ঘ যে নিশ্বাসকর্মধারয়
পোলামাইয়াপোলা ও মাইয়াদ্বন্দ্ব

নিম্নরেখাঙ্কিত অংশের কারক-বিভক্তি নির্দেশ করো –

  • দু-দিক থেকে দুটো গলি এসে মিশেছে এ জায়গায়
  • সন্দেহের দোলায় তাদের মন দুলছে।
  • নিষ্ফল ক্রোধে মাঝি দু-হাত দিয়ে হাঁটু দুটোকে জড়িয়ে ধরে।
  • আমাগো কথা ভাবে কেডা?
  • মুহূর্তগুলি কাটে রুদ্ধ নিশ্বাসে
শব্দকারক-বিভক্তি
জায়গায়অধিকরণ কারকে ‘য়’ বিভক্তি।
সন্দেহেরসম্বন্ধপদে ‘এর’ বিভক্তি।
ক্রোধেনিমিত্ত কারকে ‘এ’ বিভক্তি।
আমাগো
কেডা
সম্বন্ধপদে ‘গো’ বিভক্তি।.
কর্তৃকারকে ‘শূন্য’ বিভক্তি।
রুদ্ধ নিশ্বাসেকরণ কারকে ‘শূন্য’ বিভক্তি।

নীচের শব্দগুলিতে ধ্বনি পরিবর্তনের কোন্ কোন্ নিয়ম কাজ করেছে লেখো –

হেইপারে, নারাইনগঞ্জ, ডাইকা, আঙুল, চান্দ।

শব্দধ্বনিতত্ত্বপরিবর্তন
হেইপারেসেইপারে > হেইপারেবর্ণবিপর্যয়
নারাইনগঞ্জনারায়ণগঞ্জ > নারাইনগঞ্জবর্ণবিকার
ডাইকাডাকিয়া > ডাইকাঅপিনিহিতি
আঙুলআঙ্গুল > আঙুলব্যঞ্জনলোপ
চান্দচন্দ্র > চান্দধ্বনিলোপ

নির্দেশ অনুযায়ী বাক্য পরিবর্তন করো –

রাত্রির নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে দিয়ে মিলিটারি টহলদার গাড়িটা একবার ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে একটা পাক খেয়ে গেল। (জটিল বাক্যে)

রাত্রির যে নিস্তব্ধতা, তাকে মিলিটারি টহলদার গাড়িটা কাঁপিয়ে একবার ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে একটা পাক খেয়ে গেল।

খানিকক্ষণ চুপচাপ। (না-সূচক বাক্যে)

খানিকক্ষণ কোনো শব্দ নেই।

পরিচয়কে স্বীকার করতে উভয়েই নারাজ। (প্রশ্নবোধক বাক্যে)

পরিচয়কে স্বীকার করতে উভয়েই নারাজ নয় কি?

শোরগোলটা মিলিয়ে গেল দূরে। (যৌগিক বাক্যে)

শোরগোলটা উঠল এবং দূরে মিলিয়ে গেল।

মাঝি বলল, চল যেদিকে হউক। (পরোক্ষ উক্তিতে)

মাঝি যেদিকে হউক, যেতে নির্দেশ করল।

ক্রিয়ার কাল নির্দেশ করো –

  • কান পেতে রইল দূরের অপরিস্ফুট কলরবের দিকে।
  • সন্দেহের দোলায় তাদের মন দুলছে।
  • ধারে-কাছেই য্যান লাগছে।
  • অশান্ত চঞ্চল ঘোড়া কেবলি পা ঠুকছে মাটিতে।
  • বাদামতলির ঘাটে কোন অতলে ডুবাইয়া দিছে তারে।
বাক্যক্রিয়ার কাল
কান পেতে রইল দূরের অপরিস্ফুট কলরবের দিকে।অতীত কাল
সন্দেহের দোলায় তাদের মন দুলছে।বর্তমান কাল
ধারে-কাছেই য্যান লাগছে।বর্তমান কাল
অশান্ত চঞ্চল ঘোড়া কেবলি পা ঠুকছে মাটিতে।বর্তমান কাল
বাদামতলির ঘাটে কোন অতলে ডুবাইয়া দিছে তারে।বর্তমান কাল

নীচের শব্দগুলির শ্রেণিবিভাগ করো –

মজুর, লীগওয়ালো, পুলিশ, নসিব, রাত্রি।

শব্দশ্রেণিবিভাগ
মজুরবিদেশি (ফারসি)
লীগওয়ালোমিশ্র বা সংকর
পুলিশবিদেশি (ইংরেজি)
নসিববিদেশি (ফারসি)
রাত্রিতৎসম

সমরেশ বসুর “আদাব” গল্পটি শুধু দাঙ্গার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে না, বরং তার বিপরীতে মানবিক সম্প্রীতির এক অমলিন স্পর্শও জাগিয়ে তোলে। দাঙ্গার আবহে, ধর্মীয় বিভেদের অন্ধকারে দুই অপরিচিত মানুষের মিলন – এ যেন এক অসাধ্য ঘটনা। লেখক সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন কিভাবে সুতাকলের মজুর ও নাওয়ের মাঝির মধ্যে ক্রমশ গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব, বিশ্বাস আর সহমর্মিতা।

যদিও গল্পের শেষে মাঝির মৃত্যুতে টান পড়ে এই মানবিক বন্ধন, তবুও সুতাকলের মজুরের মনে জেগে ওঠে অপার সম্প্রীতির অনুভূতি। দাঙ্গার বিভীষিকার মধ্যেও মানুষের মনের মহত্ব আর ভালোবাসার শক্তিই এই গল্পের মূল বার্তা।

“আদাব” শুধু একটি কাল্পনিক গল্প নয়, বরং এটি আমাদের সকলকেই স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ধর্ম, জাতি, বর্ণের ঊর্ধ্বে মানুষের মধ্যে এক অদৃশ্য বন্ধন বিদ্যমান। ঘৃণা ও বিভেদের অন্ধকারেও যদি আমরা আমাদের মনের মানবিকতাকে জাগ্রত রাখতে পারি, তাহলেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সত্যিকারের শান্তি ও সম্প্রীতি।

আদাব কেবল একটি গল্প নয়, এটি একটি গভীর মানবিক বার্তা। দাঙ্গার বিষবাষ্পে বিষিয়ে যাওয়া সমাজেও মানবিকতা ও সহমর্মিতার বীজ অঙ্কুরিত হতে পারে।

JOIN US ON WHATSAPP

JOIN US ON TELEGRAM

Please Share This Article

About The Author

Related Posts

লোকটা জানলই না – অষ্টম শ্রেণি – বাংলা – অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর

অষ্টম শ্রেণি – বাংলা – লোকটা জানলই না – অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর

লোকটা জানলই না – অষ্টম শ্রেণি – বাংলা – ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর

অষ্টম শ্রেণি – বাংলা – লোকটা জানলই না –  ব্যাখ্যাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর

লোকটা জানলই না – অষ্টম শ্রেণি – বাংলা – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

অষ্টম শ্রেণি – বাংলা – লোকটা জানলই না – রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর

Tags

মন্তব্য করুন

SolutionWbbse

Trending Now

Class 9 – English – A Day in The Zoo – Question and Answer

Class 9 – English Reference – Tom Loses a Tooth – Question and Answer

Class 9 – English Reference – The North Ship – Question and Answer

Class 9 – English – His First Flight – Question and Answer

Class 9 – English – A Shipwrecked Sailor – Question and Answer