আজকের এই আর্টিকেলে অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের সপ্তবিংশ অধ্যায় ‘আদাব’ এর বিষয়সংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করবো। এই বিষয়সংক্ষেপ অষ্টম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখান থেকে প্রশ্নোত্তর প্রায়ই পরীক্ষায় আসতে দেখা যায়।
আদাব অধ্যায়ের লেখক পরিচিতি
সমরেশ বসু আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতম কথা-সাহিত্যিক। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল সুরথ বসু। পিতা মোহিনীমোহন, মা শৈবলিনী। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে ঢাকা জেলার রাজনগর গ্রামে তাঁর জন্ম। প্রথাগত শিক্ষালাভের উচ্চতম সুযোগ তাঁর জীবনে তেমনভাবে আসেনি। কিন্তু জীবনযাপনের পর্বে পর্বে তিনি যেমন পেশা পরিবর্তন করেছিলেন, তেমনি সঞ্চয় করেছিলেন অভিজ্ঞতার মণিমুক্তা; ফেরি করেছেন, চটকল শ্রমিকের কাজ নিয়েছেন, বস্তিতে থেকে ভগ্নগৃহে জীবনযাপন করেছেন। সর্বত্রই ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। এককথায় অল্পবয়সেই চরম জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় তাঁকে। প্রথম জীবনে কম্যুনিস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়ে উক্ত পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন তিনি। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে আটক হওয়ার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন সাহিত্যই হবে তাঁর উপলব্ধি বিকাশের প্রধান হাতিয়ার। এ সময়েই তিনি শ্যালকের দেওয়া সমরেশ নামটি গ্রহণ করেন। যারা থাকে মাটির কাছাকাছি, সব অর্থে যারা মাটিঘেঁষা, তারাই তাঁর সাহিত্যের কুশীলব। সাহিত্যকে তিনি কোনোদিন ফাঁকির দৃষ্টিতে দেখেননি। বলেছিলেন, ‘সাহিত্যের যা কিছু দায়, সে তো জীবনেরই কাছে।’ তাই তাঁর সাহিত্য সত্যিকারের জীবনময়। ‘নয়নপুরের মাটি’ তাঁর প্রথম উপন্যাস, যদিও প্রথম ছাপা হয় তাঁর ‘উত্তরবঙ্গ’ উপন্যাসটি। সমরেশ বসুর সাহিত্যিক ছদ্মনাম ‘কালকূট’। এই ছদ্মনামে তিনি অজস্র যুগান্তকারী উপন্যাস রচনা করেছেন। ছদ্মনামে লেখা ‘শাম্ব’ উপন্যাসের জন্য তিনি ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’ লাভ করেন। সমরেশ বসু নামে তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি উপন্যাস হল – ‘যুগ যুগ জীয়ে’, ‘ছিন্ন বাধা’, ‘গঙ্গা’, ‘বি টি রোডের ধারে’, ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’ ইত্যাদি। ‘কালকূট’ ছদ্মনামে তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাস হল – ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’, ‘কোথায় পাব তারে’, ‘আরব সাগরের জল নোনা’, ‘তুষার সিংহের পদতলে’ ইত্যাদি। ছোটোগল্পে লেখকের দক্ষতা ছিল প্রবাদপ্রতিম। ‘আদাব’ তাঁর প্রথম ছোটোগল্প। সমরেশ বসুর মৃত্যুর ঘটে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে।
আদাব অধ্যায়ের পাঠপ্রসঙ্গ
প্রায় পৌনে দুশো বছর উপনিবেশবাদী ব্রিটিশবাহিনী ভারত শাসন করেছিল, আর তার বহু আগে থেকে এদেশে মুসলমান শাসনতন্ত্রের ফলে দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়েছিল হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিত জীবনযাপন প্রণালী। ভারতে স্বাধীনতাবোধ জাগ্রত হলে এবং ক্রমে ক্রমে তা পুষ্ট হলে সুচতুর ইংরেজ লক্ষ করল এই হিন্দু-মুসলমান সম্মিলনকে দুর্বল না করলে ভারতে ইংরেজ উপনিবেশ টলমল করবে। জন্ম নিল দ্বিজাতিতত্ত্ব। লর্ড কার্জনের আমলে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের মধ্যেও এই দ্বিজাতিত্ত্বের উসকানিমূলক ভেদনীতি প্রবল ছিল। কিন্তু আত্মপ্রকাশ করে তখনকার মতো তা চাপা পড়ে যায়। এরপর রাজনীতির সমুদ্রে অনেক উথালপাথাল ঘটে যায় এবং ক্রমে ইংরেজের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে এই দ্বিজাতিতত্ত্ব ভারতের রাজনীতিকে তোলপাড় করে তোলে। প্রাক্স্বাধীনতা পর্বে সমগ্র ভারতে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা এত প্রবল হয়ে ওঠে যে, প্রথমে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও পরে দেশভাগের দুঃসহ বেদনা বহন করতে হয় দেশবাসীকে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর সাহিত্যে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বারবার জোরালো ছাপ ফেলেছিল। ‘আদাব’ গল্পে তিনি যেন প্রত্যক্ষ দাঙ্গবিরোধিতার কথাই বলেছেন। দুই অতিসাধারণ মানুষের আলাপনে দাঙ্গার প্রতি সাধারণ মেহনতি মানুষের বিরূপ মনোভাবের কথা যেন এ গল্পে এক দাঙ্গাবিরোধী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছে। গল্পটি চরম মানবিক। কারণ যারা দাঙ্গা বাধায়, এ গল্পে পরোক্ষে যেন লেখক তাদের প্রতি ঘৃণাই জানিয়েছে।
আদাব অধ্যায়ের বিষয়সংক্ষেপ
রাত্রির নিস্তব্ধতা কেঁপে উঠছে টহলদারি মিলিটারি গাড়ির গর্জনে। হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা বাধার কারণে শহরে ১৪৪ ধারা। মতলববাজ মানুষের হাতে নানা অস্ত্র, গুপ্তঘাতই তাদের উদ্দেশ্য। বস্তিতে আগুন, ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুমুখীন মানুষের চিৎকার তার মধ্যে সৈন্যবাহিনীর অতর্কিত হামলা।
দুটো গলি যেখানে এসে এক হয়েছে, তার একপাশে ডাস্টবিন; সেখানে হঠাৎ একটা লোক যেন প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল। প্রায় নির্জীবের মতো পড়ে থেকে চাপা ধ্বনিতে শুনতে থাকল – ‘আল্লাহু-আকবর’ ও ‘বন্দেমাতরম্’। হঠাৎ নিস্তব্ধতার মধ্যে ডাস্টবিনটা নড়ে ওঠার পর দেখা গেল, দাঙ্গাভীত আর-একটা মানুষ তার মধ্য থেকে মাথা তুলছে। ডাস্টবিনটার দু-পাশে আতঙ্কিত দুটি মানুষ। চোখের দৃষ্টিতে ভয় ও উত্তেজনার ছাপ। দুজনে দুজনকে খুনি বলে ভাবছে। অনেকক্ষণ এমন স্থিতাবস্থার পর তাদের মনে একটাই প্রশ্ন মাথাচাড়া দিল – ‘হিন্দু, না মুসলমান।’ একজন জিজ্ঞাসা করে – বাড়ি কোথায়? অন্যজন উত্তর দেয়-বুড়িগঙ্গার পরপারে, সুবইডায়। অন্যজনও নিজের ঠিকানা জানায় নারায়ণগঞ্জের কাছে। ক্রমে জানা যায় এদের একজন নৌকোর মাঝি, অন্যজন সুতাকলের কর্মী।
আবার চুপচাপ। হঠাৎ কাছে কোথাও শোরগোল ওঠে। উন্মত্ত কণ্ঠের ধ্বনির প্রকাশ, দুজনেই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সুতামজুর আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে – ‘ধারে-কাছেই য্যান লাগছে।’ মাঝি সমকণ্ঠে বলে, ‘চল, এইখান থেইক্যা উইঠা যাই।’ সুতামজুর তাকে বাধা দেয়, বলে ‘উইঠো না। জানটারে দিবা নাকি?’ কথার আন্তরিকতা না বুঝে মাঝির মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। সুতামজুর শেষপর্যন্ত তাকে উঠতে দেয় না। মাঝি সন্দেহজনকভাবে জিজ্ঞাসা করে, ‘ক্যান?’ সুতামজুর তাকে দাঙ্গা পরিস্থিতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কথার উত্তেজনা, সন্দেহের ভাব-কথা বলতে বলতে খানিকটা চলে যায় বলে, দুজনে যেন দুজনকে বুঝতে পারে অনেকটা। জমে ওঠা শোরগোল একসময় মিলিয়ে যায়। আবার মৃত্যুর প্রতীক্ষা। দুই বিপন্ন প্রাণীর মনে মৃত্যুভয় সরে গিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসে পরিবার-পরিজনদের কথা। তারা ভাবে – আর কি ঘরে ফিরতে পারবে? হঠাৎ ধেয়ে আসা দাঙ্গার কথাও ভাবে তারা। রক্তগঙ্গার দুঃসহ স্মৃতিতে তাদের বুক খালি করে দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হয়।
দেশলাই জ্বালতে গিয়ে আচম্বিতে প্রকাশ হয়ে পড়ে – মাঝি মুসলমান। দুজনের মধ্যে আবার জেগে ওঠে আতঙ্ক। অবিশ্বাসের দোলায় কয়েকটা নিস্তব্ধ পল কেটে যায়। আতঙ্কিত সুতামজুর মাঝির পুঁটলির সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে মাঝি জানায় তার মধ্যে আছে ছেলেমেয়ের দুটো জামা আর বিবির একটা শাড়ি। কাল ইদ। কথায় কথায় দুজনের উপর দুজনের বিশ্বাস স্থির হয়, কথায় কথায় দুজনের বক্তব্যেই দাঙ্গার প্রতি ঘৃণা ঝরে পড়ে। দাঙ্গা কীভাবে তাদের মতো মেহনতি মানুষকে ভূমিলগ্ন করে তারই ইতিকথা যেন রচিত হয়। তাদের ক্ষোভ যেন ধীরে ধীরে উঠে আকাশ-বাতাসকে স্পর্শ করতে চায়, তারা পালাতে চায়। বাঁচতে চায় দাঙ্গাবাজদের হিংসার আগুন থেকে।
মোড় পেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে তারা ছোটে। দৃষ্টি তাদের ঘুরছে। কেউ কোথাও আততায়ীর মতো আত্মগোপন করে নেই তো? হঠাৎ অশ্বক্ষুরধ্বনি ধেয়ে এল। রিভলবার হাতে এক অশ্বারোহী দূরে মিলিয়ে গেল। আতঙ্কিত সুতামজুর হাত ধরে মাঝিকে নিয়ে গেল একটা পান-বিড়ির দোকানের আড়ালে। দেখল সামান্য দুরত্বে একটা ঘরে সেনাদের উত্তেজিত জটলা। মাঝি সুতামজুরকে সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে অনতিদুরের বাদামতলির ঘাটে চলে যেতে চাইল। মুহূর্তে হিন্দু-মুসলমান এলাকা ভাগ করে মাঝি জানাল-সেটা হিন্দু এলাকা। সে থাকুক তাকে যেতেই হবে। কারণ আটদিন ঘরছাড়া সে আর বাড়ি না ফিরে থাকতে পারছ না। নৌকো না পেলে সে সাঁতরেই নদী পার হবে। সুতামজুর তাকে যেতে দিতে চায় না। আন্তরিকতায় তার গলা করুণ ও উত্তেজনায় কম্পমান। মাঝি ‘আদাব’ জানিয়ে চলে যায়। সুতামজুর প্রত্যুত্তরে বলে-‘আদাব’।
হঠাৎ আওয়াজ ওঠে – ‘হলট্’। সুতামজুর চমকে ওঠে। সে লক্ষ করে – মাঝিকে দেখে ‘ডাকু ভাগতা হ্যায়’ বলে পুলিশ অফিসার রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ। শোনা যায় ‘মরণ আর্তনাদ’। সুতামজুর দেখল পুলিশের গুলিতে মাঝির রক্তে তার বগলের পুঁটলির জামাকাপড় ভেসে যাচ্ছে। এহেন পরিণতিতেই গল্পের সমাপ্তি।
আদাব অধ্যায়ের নামকরণ
পাঠকমনে সঠিক তথা যথাযথ প্রাথমিক ধারণা জাগানোর জন্য সাহিত্যের নামকরণ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ দিক। বিষয়বস্তু তথা মুখ্য কাহিনি কিংবা প্রধান চরিত্র অথবা ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণ সাহিত্যক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। .
কালকূট ছদ্মনামে সুপরিচিত বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর ছোটোগল্পগুলির মধ্যে প্রতিনিধি স্থানীয় ছোটোগল্প ‘আদাব’। ‘আদাব’ কথাটির অর্থ মুসলমান সম্প্রদায়ের অভিবাদন প্রকাশরীতি বা সেলাম। প্রাক্স্বাধীনতালগ্নে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সমগ্র ভারতে যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, শহর কলকাতা তা থেকে বাদ যায়নি। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে রচিত গল্পটি মানবিক আবেদনে চির ভাস্বর।
গল্পটির সূচনাংশেই গল্পকার উল্লেখ করেছেন ‘দাঙ্গা বেধেছে হিন্দু আর মুসলমানে’। সেই কারণেই দাঙ্গার মর্মান্তিক ছবি ফুটে উঠেছে গল্পটিতে। মৃত্যু-মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের অরাজকতার ভয়াবহ ছবি প্রকাশিত হয়েছে গল্পটিতে। লুঠ, হত্যা, আগুন, অসহায় শিশুর ক্রন্দন, লাঞ্ছিতা নারীর আর্তনাদ এসবের মধ্য দিয়ে সেই সময়ের অস্থিরতার কথা লেখক প্রকাশ করেছেন। অবিশ্বাসের এই বাতাবরণের মধ্যেই অন্ধকার গলির এক ডাস্টবিনকে অবলম্বন করে অসহায় দুটি মানুষের আত্মগোপনের প্রয়াস গল্পটির মধ্যে উত্তেজনা সঞ্চার করায়। সন্দেহ আর ভয়ে চারটে চোখই যেন বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। কেউই নিজের পরিচয় আগে প্রকাশ করতে নারাজ। এমন অবস্থার মধ্যেই দুটি মানুষ পরস্পরকে অবলম্বন করে আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করে, এভাবেই পরস্পর কাছাকাছি আসে। কিন্তু ভিজে বা সেঁতলে – যাওয়া দেশলাই কাঠি জ্বালানোর প্রয়াসে উন্মোচিত হয় মুসলিম ব্যক্তির পরিচয়। আসন্ন মৃত্যুভয় অচেনা, অজানা মানুষ দুটিকে এক করেছিল -এখন পরিচয় প্রকাশের পরেও তাদের একতা ভাঙে না। তারা তখন জাতিধর্মের অনেক উপরে মানবতার ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন। তাইতো ইদের আগে মুসলমান মাঝির বাড়ি পৌঁছোনোর আপ্রাণ চেষ্টা মন ছুঁয়ে যায় হিন্দু সুতামজুরের। তারা সাধারণ, তারা দিন আনে দিন খায় -এমন সমাজের মানুষ। তাদের সাধারণ মন যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না তা হল – এই রায়টে ‘দ্যাশের কী উপকারটা হইব?’ রাজনৈতিক ক্ষমতার সমীকরণ এই মানুষগুলির অচেনা কিন্তু প্রকৃত দেশবাসী যারা ক্ষমতার হস্তান্তর কিংবা ভাগবাঁটোয়ারায় তাদের সত্যিই কতটুকু লাভ হয়? যে অপূরণীয় ক্ষতি হয় তার ক্ষতিপূরণ দেয় কোন্ সরকার? গল্পটি শেষ হয়েছে বিয়োগান্তক পরিণতির মধ্য দিয়ে। আদাব জানিয়ে মুসলিম মাঝি বাড়ির পথে পা বাড়ালে তার নিরাপদে পৌঁছোনোর প্রার্থনা জানানোর মাঝেই হিন্দু সুতামজুরের কানে আসে গুলির শব্দ ‘মরণ আর্তনাদ’।
এই সাধারণ মানুষরা কোনোদিন ক্ষমতায় যায় না, ক্ষমতাশালীদের কাছাকাছিও পৌঁছোয় না কিন্তু তাদের মধ্যে মানবিকতার যে সহজাতবোধ আছে তা যদি গুরুত্ব পেত তাহলে হয়তো ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত। সাহিত্যিক সমরেশ বসু-র লেখা বক্তব্য বিষয়কেন্দ্রিক ‘আদাব’ গল্পটির নামকরণ যথাযথ।
আদাব অধ্যায়ের শব্দার্থ ও টীকা
মিলিটারি টহলদার – রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে নিযুক্ত টহলদারি সেনাদল। ১৪৪ ধারা – ভারতীয় সংবিধানের বিশেষ ধারা; জরুরি পরিসেবা হিসেবে যা প্রযুক্ত হয়। দা – কোপ দিয়ে কাটার কাজে ব্যবহৃত অস্ত্রবিশেষ; কাটারি। সড়কি – বল্লম; বর্শা; তীক্ষ্ণধার ফলাযুক্ত লম্বা ধাতুর অস্ত্র। গুপ্তঘাতক – গোপন হত্যাকারী; নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে যারা হত্যাকর্ম চালায়। মৃত্যু-বিভীষিকাময় – মৃত্যুর ভয়ে ভীষণভাবে আতঙ্কিত। মৃত্যুকাতর – মৃত্যুভয়ে আর্ত বা অভিভূত। ডাস্টবিন্ – ময়লা বা আবর্জনা ফেলার স্থান বা জায়গা; নোংরা ফেলার বৃহৎ পাত্র। অপরিস্ফুট – অস্পষ্ট; আবছা। আল্লাহ্-আকবর – ‘আল্লা মহান’ এই ধ্বনি। বন্দেমাতরম্ – স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের স্লোগান। সাহিত্যসম্রাট বঙ্গিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের একটি গান। উপন্যাসে সন্তানদলের গীত এই বিশেষ গানটির মধ্যে দেশপ্রেমের যে মহান বাণী লিপিবদ্ধ ছিল, তা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে একদা বীজমন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রাক্স্বাধীনতা পর্বে যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রবল আকার ধারণ করে তখন হিন্দুত্ববাদীরাও একে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে। লেখক তারই প্রয়োগ দেখিয়েছেন দাঙ্গার পটভূমিতে। নিষ্পন্দ-নিশ্চল – স্পন্দনহীন; অচল বা অকম্পিত স্থির। প্রাণভীত – প্রাণ যাওয়ার ভয়ে ভীত। আততায়ী – হিংস্র আক্রমণকারী বা আঘাতকারী; বধ বা প্রাণনাশ করতে উদ্যত শত্রু। সন্দিহান – সন্দেহযুক্ত; সন্দেহ করা হচ্ছে এমন। অস্বস্তিকর – দেহ বা মনের পক্ষে অসুবিধা বা অশান্তিজনক। নারাজ – অরাজি; রাজি নয় এমন; অসম্মত। বুড়িগঙ্গা – একটি নদী বিশেষ। নারাইনগঞ্জ – নারায়নগঞ্জ; অধুনা বাংলাদেশের একটি স্থাননাম। সুতাকল – সুতো প্রস্তুত হয় যে কলে বা কারখানায়। শোরগোল – উচ্চরববিশিষ্ট তীব্র হইচই বা গোলমাল। অভিপ্রায় – উদ্দেশ্য; অভিসন্ধি বা মতলব। আন্দাইরা গলি – যে গলি অন্ধকার। মতলবডা – অভিপ্রায়টি বা অভিসন্ধিটি। আশ্বস্ত – ভরসা পেয়েছে; ভয় বা উদবেগ থেকে মুক্তি পেয়েছে এমন। দাঙ্গা – অনেক লোকের একত্র হয়ে মারামারি-হানাহানি। মানুষের মনে যখন কোনোভাবে কোনো কিছুর জন্য তীব্র উষ্মা বা চাহিদা বা আবেগ সঞ্চারিত হয়, তা যদি প্রবল আকার ধারণ করে তবে দাঙ্গা পরিস্থিতি দেখা দেয়। ভারতে প্রাক্স্বাধীনতা পর্বে ইংরেজের চক্রান্তে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে তা তীব্র মারামারি-হানাহানিতে রূপান্তরিত হয় এবং বহু মানুষের প্রাণসংশয় হয়। স্থানে স্থানে ছিন্নমূল মানুষের ঢল নামে। রক্তগঙ্গা – রক্তের গঙ্গা। গঙ্গার ধারার মতো রক্তের প্রবাহিত হয়ে চলা। সেঁতাইয়া – সিন্তপ্রায়। অসবুর – অধৈর্য; ধৈর্যহীনতা। নিস্তব্ধ পল – সম্পূর্ণ নীরব সময়খণ্ড। মোছলমান – মুসলমান শব্দের বিকৃত উচ্চারণ। পুঁটলি – কিছু রাখার বস্ত্রবন্ধনী। পোলা-মাইয়ার – ছেলেমেয়ের। আমাগো – আমাদের। কিরা – দিব্যি বা শপথ। সুঁই – সুচ। পরাণটা – প্রাণটা। মাই’র দ’ইর – মারধোর; মারামারি। তোমাগো – তোমাদের। উষ্ণকণ্ঠেই – যে কণ্ঠস্বরে ক্রোধের স্পর্শ আছে। কটূক্তি – কড়া কথা; গালিগালাজ বা দুর্বাক্য। দ্যাশের – দেশের। রায়টে – দাঙ্গায়। কাইটা – কেটে। ন্যাতারা – নেতারা। সুমুন্দি – বৌ-এর ভাই হল সম্বন্ধি, তার বিকৃত উচ্চারণ। খোরাকি – খাইখরচা। ভগবানের কিরা – ভগবানের দিব্য বা শপথ। পথনির্দেশ – পথের দিশা; পথ চলার হদিশ। অশ্বারোহী – ঘোড়ায় চড়ে আছে যে। অশ্বখুরধ্বনি – ঘোড়ার খুরের শব্দ। স্থাণুর – স্থির; নড়াচড়া করে না এমন। অনর্গল – অবাধ; কোনো বাধা নেই এমন। জিন্ – ঘোড়ার লাগাম। ফাঁড়ি ছোটো থানা; পুলিশের চৌকি বা ঘাঁটি। আস্তানা – বাসস্থান। কামিজ – ঊর্ধ্বাঙ্গ ঢেকে রাখার হাতাওয়ালা জামা; পিরান। অনুকম্পা – সহানুভূতি; দয়া; অনুগ্রহ। আদাব – সালাম; অভিবাদন; নমস্কার। বিহ্বল – আত্মহারা; অভিভূত। ছাওয়ালরা – ছেলেরা। দুশমনরা – শত্রুরা। তাগো – তাদের।
আজকের এই আর্টিকেলে অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের সপ্তবিংশ অধ্যায় ‘আদাব’ এর বিষয়সংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছি। এই বিষয়সংক্ষেপ অষ্টম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি প্রায়ই পরীক্ষায় আসে। আশা করি, এই নিবন্ধটি আপনার জন্য সহায়ক হয়েছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে বা আরও সহায়তার প্রয়োজন হয়, আপনি টেলিগ্রামে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। এছাড়াও, আপনার বন্ধুদের সঙ্গে এই পোস্টটি শেয়ার করতে ভুলবেন না, যাতে তারা ও উপকৃত হতে পারে। ধন্যবাদ!