আজকের এই আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের চতুর্থ পাঠের তৃতীয় অধ্যায়, ‘আবহমান’ -এর কিছু রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রশ্নোত্তরগুলো নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নবম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষায় এই ধরনের প্রশ্ন নিয়মিত আসে।

‘আবহমান’ কবিতার মূল বক্তব্যটি বুঝিয়ে দাও।
বহমান কাল ধরে প্রবাসী বাঙালির পল্লিবাংলায় ফিরে আসার টান ‘আবহমান’ কবিতায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সংবেদনে ধরা পড়েছে। জননী এবং জন্মভূমির সৌন্দর্য আজীবন অমলিন থাকে মানুষের মনে। প্রবাসী মানুষকে তাই বারেবারে ফিরতেই হয় জন্মভূমিতে। কবির ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গেও এই শিকড় হারানোর যন্ত্রণা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শৈশবের স্বভূমিকে ছেড়ে কবিকে চলে আসতে হয়েছিল শহর কলকাতায়। কেবল কবি নন, জন্মভূমি থেকে দূরে চলে যাওয়া এমনই অনেক মানুষের ঘরে ফেরার অমোঘ আকর্ষণ আলোচ্য কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে।
প্রথম স্তবকটি কবিতায় বারবার ব্যবহার করে আত্মবিশ্বাসী কবি জন্মভূমির চিরায়ত রূপের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বঙ্গপ্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য পুরাকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বঙ্গজনকে এমনভাবে আকৃষ্ট করে রেখেছে যে, তারা দূরে গিয়েও বারেবারে ফিরে এসেছে এই বাংলায়। আসলে বিদেশ-বিভুঁই বিলাসিতা দিতে পারে, দিতে পারে পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ-খ্যাতি-যশ। কিন্তু ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ বাংলার এই গ্রামগুলির মধ্যে যে অকৃত্রিম আনন্দের উপাদান সাজানো আছে, তার কণামাত্র সন্ধান প্রবাসে পায় না বলে বাঙালি বারবার ফিরে আসে স্বভূমিতে। ‘নিবিড় অনুরাগে’ তাদের ফিরে আসা সময়ের সঙ্গে সচল থাকে। তাই কবি বলেছেন, বাংলাদেশে মানুষের ফিরে আসার গল্প ফুরায় না বলে নটে গাছটি না মুড়িয়ে বুড়িয়ে ওঠে। প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্য উপভোগের নেশায় মাতোয়ারা বঙ্গবাসীর যাওয়া-আসা বন্ধ থাকে না। দিন-রাতের সবটুকু সৌন্দর্য সে মন প্রাণ দিয়ে উপভোগ করে। দিনের আলোয় বাস্তবের মাটিতে সে যেমন প্রকৃতির সান্নিধ্য পায় ঘাসের গন্ধে, তেমনই রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশ তার মনকে স্বপ্নময় করে তোলে। সূর্যের উদিত হওয়া কিংবা আড়ালে চলে যাওয়া, নদীর বয়ে চলার মতোই এ বাংলাকে ঘিরে বঙ্গজনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, যন্ত্রণা-উন্মাদনা পুরোনো হয় না কখনও। বঙ্গজন ঘরে ফিরলে নদীমাতৃক এ দেশের সন্ধ্যার শীতল-স্নিগ্ধ হাওয়া যেন তাকে আপ্যায়ন করে। লাউমাচায় ফুটে থাকা ফুল তার জন্যে রচনা করে মুগ্ধতার পরিমণ্ডল। যুগ যুগ ধরে বঙ্গদেশ অর্থাৎ গ্রামবাংলা এভাবেই নিবিড় সম্পর্কে বেঁধে ফ্যালে মানুষকে। তাই তার আসা-যাওয়ার স্রোত বহমান থাকে সবসময়।
‘আবহমান’ কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করো।
ভূমিকা – সাহিত্যবিষয়ের ক্ষেত্রে নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কখনও বিষয়, কখনও চরিত্র, আবার কখনও সাহিত্যে নিহিত ব্যঞ্জনাকে কেন্দ্র করে নামকরণ তৈরি হয়। এই নামকরণ প্রাথমিকভাবে সাহিত্যের সঙ্গে পাঠকের যোগসূত্র গঠন করে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আধুনিক এবং আঙ্গিকসচেতন কবি। ‘অন্ধকার বারান্দা’ কাব্যের ‘আবহমান’ কবিতায় বঙ্গদেশের গ্রামজীবনের অনাবিল সৌন্দর্য এবং সেই সৌন্দর্যে যুগ যুগ ধরে মুগ্ধ মানুষের হারিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসার চিরায়ত গল্পকথাটি ফুটিয়ে তুলেছেন। আলোচ্য কবিতায় কবি প্রথম স্তবকটি চারবার ব্যবহার করে গ্রামবাংলার শান্ত-স্নিগ্ধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহমানতাকে তুলে ধরেছেন। আঙ্গিক সচেতন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আলোচ্য স্তবকটিতে সামান্য পরিবর্তন এনেছেন শেষবার। ‘ছোট্ট একটা ফুল দুলছে’ -এর পরিবর্তে ‘এখনও সেই ফুল দুলছে’-র ব্যবহারে কবিতার নামকরণকে সার্থক করে তুলেছেন।
নামকরণের সার্থকতা – ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ বাংলার গ্রামগুলি বুক ভরে যে অকৃত্রিম আনন্দের উপাদান সাজিয়ে রেখেছে বহুকাল ধরে, তার আকর্ষণেই মানুষ বারবার ফিরে আসে এই বাংলায়। কবি লিখেছেন –
“কে এইখানে হারিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে,
এই মাটিকে এই হাওয়াকে আবার ভালোবাসে।”
কবি আলোচ্য কবিতায় দেখিয়েছেন বাংলার নিসর্গসৌন্দর্য উপভোগের বাসনা বাঙালির ফুরায় না বলে এই বাংলায় তার যাওয়া-আসা অব্যাহত থাকে। গ্রামজীবনের সঙ্গে তথা প্রকৃতির সঙ্গে লগ্ন হয়ে মানুষের বেঁচে থাকার স্বাদ এবং সাধ ফুরোয় না। সূর্যের উদিত হওয়া কিংবা আড়াল হয়ে যাওয়া, নদীর বয়ে চলার যেমন বিরাম নেই, তেমনই বঙ্গজনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, যন্ত্রণা-উন্মাদনাও পুরোনো হয় না কখনও। বহমান কাল ধরে জন্মভূমিতে ফিরে আসার ইচ্ছে মানুষের অটুট থাকে। বাংলার গ্রামজীবনের, প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের নিবিড় অন্বয়ের, ভালোবাসার টানে মানুষের ঘরে ফেরার যে গল্প কবি শোনান, তা শেষ হওয়ার বা থামার নয়। তাই ‘আবহমান’ কবিতার ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণটি যথাযথ ও সার্থক হয়েছে।
‘আবহমান’ কবিতার মধ্য দিয়ে গ্রামীণ প্রকৃতির যে প্রতিচ্ছবি প্রকাশিত হয়েছে তার পরিচয় দাও।
“যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া,
লাউমাচাটার পাশে।
ছোট্ট একটা ফুল দুলছে,
ফুল দুলছে, ফুল সন্ধ্যার বাতাসে।”-
‘অন্ধকার বারান্দা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘আবহমান’ কবিতা থেকে নেওয়া উপরোক্ত উদ্ধৃতিটিতে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একটি গ্রামীণ চিত্রকল্প রচনা করে বঙ্গপ্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কবিতায় উপরোক্ত স্তবকটি চারবার ব্যবহার করে পাঠককে অনুরোধ কিংবা আবদারের ছলে কবি বঙ্গপ্রকৃতির চিরায়ত রূপের প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
গ্রামবাংলার প্রতি গভীর অনুরাগ – এই বাংলার মাটি, হাওয়া এমন এক ভালোবাসার বাতাবরণে বঙ্গজনকে লালন করে যে প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গ্রামজীবনের সঙ্গে তথা প্রকৃতির সঙ্গে লগ্ন হয়ে মানুষের বেঁচে থাকার স্বাদ ও সাধ ফুরোয় না। তাই প্রবাসীরা বারে বারে ‘নিবিড় অনুরাগে’ ফিরে আসে এ গ্রামবাংলায়। তারা –
“সারাটা দিন আপন মনে ঘাসের গন্ধ মাখে,
সারাটা রাত তারায়-তারায় স্বপ্ন এঁকে রাখে।”
বাংলার মানুষ যখন মাটির তথা বাস্তবের কাছাকাছি থাকে তখনও সে প্রকৃতির সাহচর্যে বাঁচে, আবার যখন স্বপ্নের আকাশ খুঁজতে চায় তখনও প্রকৃতিই তাকে প্রশ্রয় দেয়। দিনের আলোয় ঘাসের গন্ধ মাখতে কিংবা রাতের তারায় স্বপ্ন এঁকে রাখতে এই বাংলার প্রকৃতিই যেন তাকে হাতছানি দেয়। নদীমাতৃক এই বাংলার সঙ্গে বঙ্গবাসীর আত্মীয়তার কথা বলতে গিয়ে কবি নদীতীরের স্নিগ্ধ-শীতল হাওয়ার প্রসঙ্গ এনেছেন। এই বাংলার মাটিতে বাঙালির বারে বারে ফিরে আসার প্রসঙ্গ প্রতীকায়িত করেছেন সূর্যের আলো-ছায়ার পরম্পরার মাধ্যমে। প্রকৃতিলগ্ন মানুষের গ্রামবাংলার উদার প্রাকৃতিক প্রাঙ্গণে ফিরে আসার গল্প না ফুরোনো প্রসঙ্গে কবি লিখেছেন – “ফুরয় না, তার কিছুই ফুরয় না,/নটেগাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়য় না।” গল্প ফুরোলে নটেগাছের মুড়িয়ে যাওয়ার এই রূপকথার গল্পের প্রসঙ্গটি ব্যবহারের মধ্যেও গ্রামীণ বাংলার প্রকৃতির প্রতিচ্ছবিই প্রকাশিত হয়েছে।
‘আবহমান’ কবিতায় পল্লিবাংলার সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার যে আভাস আছে তা উল্লেখ করো।
গ্রামবাংলায় ফিরে আসার অমোঘ টান – কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখা ‘আবহমান’ কবিতায় বঙ্গপ্রকৃতির পটভূমিতে আভাসিত হয়েছে পল্লিবাংলার সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার কথা। বহুকাল ধরে কত মানুষ এই বাংলার নিসর্গ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ‘নিবিড় অনুরাগে’ এখানে ঘর বেঁধেছে। এই বাংলার মাটি-হাওয়া যে ভালোবাসার বাতাবরণ রচনা করেছে, তার সঙ্গে মানুষ নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, ‘হারিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে’ বাংলার গ্রামজীবনে। তার এই ফিরে আসার চাহিদা যুগ যুগ ধরে ফুরোয় না।
ফিরে আসার না ফুরোনো গল্প – বাংলাদেশের সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কবি মিলিয়ে দিয়েছেন আলোচ্য কবিতায়। বাঙালির অন্তর্গত ইচ্ছের পরিতৃপ্তি ঘটে এই বাংলার প্রকৃতির সান্নিধ্যে। কবি লিখেছেন বঙ্গজন –
“সারাটা দিন আপন মনে ঘাসের গন্ধ মাখে,
সারাটা রাত তারায়-তারায় স্বপ্ন এঁকে রাখে।”
অর্থাৎ সে যখন মাটির তথা বাস্তবের কাছাকাছি থাকে তখন সে প্রকৃতির সাহচর্যে বাঁচতে চায়, আবার যখন স্বপ্নের আকাশ খুঁজতে চায় তখনও প্রকৃতির কাছেই সে প্রশ্রয় খোঁজে। দিনের আলোয় ঘাসের গন্ধ মাখতে কিংবা রাতের তারায় স্বপ্ন এঁকে রাখতে এই বাংলার প্রকৃতিই তাকে হাতছানি দেয়। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, যন্ত্রণা-উন্মাদনা সবই নিখুঁতভাবে ধরা থাকে বঙ্গপ্রকৃতির চালচিত্রে। সূর্যের আলো-ছায়া, নদীর বহমানতা যেমন চিরকালের, গ্রামবাংলার মানুষের যাবতীয় প্রত্যাশার আনন্দপূর্ণ প্রাপ্তি তেমনই ঘটে আসছে প্রকৃতিলগ্নতা থেকে। তাই বারবার তাকে ফিরে আসতে হয় গ্রামবাংলায়। তার ফিরে আসার গল্প ফুরোয় না বলে নটেগাছটি না মুড়িয়ে বুড়িয়ে ওঠে।
‘আবহমান’ কবিতাটিতে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কয়েকটি পঙক্তি বারবার ব্যবহার করেছেন। এই ব্যবহার কবিতাটিতে কী তাৎপর্য বহন করেছে?
ভূমিকা – আবহমান কাল ধরে মানুষের ঘরে ফেরার টান কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুভবে ধরা পড়েছে ‘আবহমান’ কবিতায়। আলোচ্য কবিতায় কয়েকটি পঙক্তি বারবার ব্যবহার করে আঙ্গিক সচেতন কবি কবিতার বিষয়কে সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করতে এবং ব্যঞ্জনাবাহী করে তুলতে চেয়েছেন।
বঙ্গপ্রকৃতির চিরায়ত রূপের প্রকাশ –
“যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া,
লাউমাচাটার পাশে।
ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল
সন্ধ্যার বাতাসে।”
কবিতার প্রথম চার পঙক্তি অনুরোধ, উপরোেধ কিংবা আবদারের ছলে বারবার ব্যবহার করে কবি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। এই পুনরুক্তি আবার বঙ্গপ্রকৃতির চিরায়ত রূপের প্রকাশ ঘটিয়েছে। কবিতার শেষে সেই পঙক্তিগুলির ব্যবহারে সামান্য পরিবর্তন এনে, দুটি শব্দ বদলে দিয়ে পল্লিপ্রকৃতির আবহমানতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
ঘরে ফেরার না ফুরোনো গল্পের প্রকাশ – ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ গ্রামজীবনের সঙ্গে তথা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে মানুষের বেঁচে থাকার স্বাদ এবং সাধ ফুরায় না। যুগ যুগ ধরে সূর্যের যাওয়া-আসা, নদীর বয়ে চলার মতোই বঙ্গবাসীর সুখ-দুঃখ, আশা-আনন্দ, বেদনা-উন্মাদনা কখনও ফুরিয়ে যায় না। আবহমান কাল ধরে তাই বঙ্গদেশে তথা মাতৃভূমিতে ফিরে আসার ইচ্ছে মানুষের অটুট থাকে। এই চিরায়ত সত্যটিকে প্রতিষ্ঠা দিতে কবি আলোচ্য কবিতায় বারবার ব্যবহার করেছেন নিম্নলিখিত চরণটি –
“ফুরয় না, তার কিছুই ফুরয় না,
নটেগাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়য় না।”
মানুষের ঘরে ফেরার গল্প ফুরাবার নয় বলেই নটেগাছটি না মুড়িয়ে বুড়িয়ে ওঠে।
‘ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল/সন্ধ্যার বাতাসে’ – কোন্ ফুলের কথা বলা হয়েছে? সন্ধ্যার বাতাসে ফুলটি দোলার তাৎপর্য নির্দেশ করো।
লাউফুলের কথা – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখা ‘অন্ধকার বারান্দা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘আবহমান’ কবিতা থেকে নেওয়া আলোচ্য উদ্ধৃতিটিতে লাউমাচায় ছড়িয়ে থাকা লাউফুলের কথা বলা হয়েছে।
তাৎপর্য – কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আলোচ্য কবিতায় বঙ্গপ্রকৃতির আবহমান সৌন্দর্যের এবং বঙ্গজনের এই বাংলার প্রতি অমোঘ আকর্ষণের কথা চিত্ররূপময় ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। কবি কবিতার প্রথম স্তবকটি মোট চারবার (শেষবার সামান্য পরিবর্তন করে) ব্যবহার করেছেন।
“যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া,
লাউমাচাটার পাশে।
ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল
সন্ধ্যার বাতাসে।”
এইভাবে পাঠককে অনুরোধ বা আবদারের ছলে কবি বাংলার চিরায়ত রূপের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সন্ধ্যার শীতল-স্নিগ্ধ বাতাসে একটি ছোট্ট ফুল দোলার মধ্য দিয়ে কবি বঙ্গপ্রকৃতির নিরুপদ্রব শান্তির বাতাবরণটি রচনা করেছেন। আপাত ক্ষুদ্র-তুচ্ছ এই প্রাকৃতিক অনুষঙ্গটিও বঙ্গজনের মনে এমন অনিবার্য আকর্ষণ তৈরি করে যে, হারিয়ে গিয়েও তাকে ফিরে আসতে হয় বাংলার গ্রামজীবনের উদার-অপার প্রকৃতির সংস্পর্শে। শুধু বর্তমান সময়ে নয়, লাউমাচার পাশে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার বাতাসে ছোট্ট ফুলের দোদুল্যমানতা বঙ্গজন উপভোগ করে এসেছে দূর অতীত থেকেই। সন্ধ্যার বাতাসে ফুলটির দুলে চলা বঙ্গপ্রকৃতির সেই চিরন্তন সৌন্দর্যকেই প্রকাশ করেছে।
‘কে এইখানে হারিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে’, – কার কথা বলা হয়েছে? হারিয়ে গিয়েও ফিরে আসার তাৎপর্য নির্দেশ করো।
ঘরমুখী মানুষের কথা – বঙ্গপ্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য পুরাকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাঙালিকে এমনভাবে আকৃষ্ট করে রেখেছে যে সে দূরে গিয়েও বারবার ফিরে আসে। বাঙালির তথা মানুষের জন্মভূমি অর্থাৎ ঘরে ফেরার যে চিরকালীন টান তা কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুভবে ধরা পড়েছে ‘অন্ধকার বারান্দা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘আবহমান’ কবিতায়।
তাৎপর্য – অর্থ-খ্যাতি-যশের কারণে পল্লিবাংলা ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল সেইসব মানুষ। যারা একসময় গভীর ভালোবাসায় বাংলাতেই আশ্রয় পেয়েছিল। কিন্তু ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ গ্রামগুলি চিরকাল ধরে যে স্নেহে লালন করেছে মানুষদের তার টানে আবার প্রবাসীরা ‘নিবিড় অনুরাগে’ ফিরে আসতে চায় এ বাংলায়। কবি বলেছেন তারা – ‘হারিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে,/এই মাটিকে এই হাওয়াকে আবার ভালোবাসে।’ গ্রামজীবনের সঙ্গে তথা প্রকৃতির সঙ্গে লগ্ন হয়ে মানুষের বেঁচে থাকার স্বাদ এবং সাধ ফুরোয় না। যুগ যুগ ধরে কবি খেয়াল করেন বঙ্গজন –
“সারাটা দিন আপন মনে ঘাসের গন্ধ মাখে,
সারাটা রাত তারায় তারায় স্বপ্ন এঁকে রাখে।”
সূর্যের যাওয়া-আসা, নদীর বয়ে চলার মতোই বঙ্গবাসীর সুখ-দুঃখ, আশা-আনন্দ, বেদনা-উন্মাদনা পুরানো হয় না কখনও। আবহমান কাল ধরে স্বদেশে ফিরে আসার ইচ্ছে বাঙালির অটুট থাকে। এই ইচ্ছে সে মনে মনে লালন করে বলেই তাকে বারবার ফিরে আসতে হয় এ বাংলার মাটিতে। হারিয়ে গিয়েও সে নিজেকে খুঁজে পেতে, নিজের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করতে বারে বারে ফিরে আসে তার জন্মভূমিতে।
‘ফুরয় না তার কিছুই ফুরয় না,/নটেগাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়য় না!’ – ‘ফুরয় না’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? ‘নটে গাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়য় না’ – কথাটির তাৎপর্য কী?
‘যা ‘ফুরয় না’ – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখা ‘আবহমান’ কবিতায় কবি গ্রামজীবনে বঙ্গপ্রকৃতির নিসর্গসৌন্দর্যের সজীব উপাদানগুলি না ফুরোনোর কথা বলেছেন। আবহমান কাল ধরে যে সৌন্দর্য গ্রামবাংলাকে আকর্ষণীয় করে রেখেছে, সেই সৌন্দর্য কখনও ফুরাবে না বলে কবি বিশ্বাস করেন।
তাৎপর্য – আলোচ্য পঙক্তিটি ‘আবহমান’ কবিতার সংগৃহীত অংশ। সংবেদনশীল কবিমন ধরে ফেলেছে আপামর বাঙালি হৃদয়ের এক না-ফুরোনো অনুভূতিকে। বিদেশ মানুষকে বিলাসিতা দিলেও বাংলার গ্রামজীবনের শান্তির বাতাবরণ দিতে পারে না কখনোই। কবি খেয়াল করেছেন বহুযুগ ধরে মানুষ তাই এই বাংলার গ্রামীণ জীবনকে ভালোবেসে ফেলেছে ‘নিবিড় অনুরাগে’। এই বাংলার মাটিকে, হাওয়াকে ভালোবেসে ঘর ছাড়া বাংলার মানুষ তাই বারবার ফিরে এসেছে ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ গ্রামবাংলায়। কবি উপলব্ধি করেছেন—প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার ইচ্ছা তার চিরকালীন। যুগ যুগ ধরে বঙ্গবাসী –
“সারাটা দিন আপন মনে ঘাসের গন্ধ মাখে,
সারাটা রাত তারায়-তারায় স্বপ্ন এঁকে রাখে।”
সূর্যের যাওয়া-আসা, নদীর বয়ে চলার মতোই মানুষরা সুখ-দুঃখ, আশা-আনন্দ, বেদনা-উন্মাদনা পুরানো হয় না কখনও। তাই স্বদেশে ফিরে আসার ইচ্ছে বাঙালির অটুট থাকে। কবির অনুভূতিতে ধরা পড়ে এক আশ্চর্য সত্য; – জন্মভূমিতে ফিরে আসার, গ্রামজীবনে ফিরে আসার গল্প মানুষের ফুরোনোর নয়। রূপকথার গল্পে গল্পকথা ফুরোলে তবে নটেগাছটি মুড়িয়ে যায়। আলোচ্য কবিতায় বহমান কাল ধরে মানুষের ঘরে ফেরার যে গল্প কবি শোনান তা ফুরোয় না তাই নটেগাছটি না মুড়িয়ে বুড়িয়ে ওঠে।
‘ফুরয় না সেই একগুঁয়েটার দুরন্ত পিপাসা।’ – ‘একগুঁয়েটা’ কে? তার দুরন্ত পিপাসা ফুরয় না বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
যে ‘একগুঁয়ে’ – কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘অন্ধকার বারান্দা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘আবহমান’ কবিতা থেকে উপরিউক্ত চরণটি নেওয়া হয়েছে। আলোচ্য কবিতায় ‘একগুঁয়েটা’ বলতে সেইসব প্রবাসী বাঙালিকে বোঝানো হয়েছে, যারা ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ এই বাংলার প্রকৃতি ও গ্রামজীবনের অনাবিল সৌন্দর্য উপভোগের নেশায় বারেবারে ফিরে আসে। জন্মভূমি ছেড়ে যাকে চলে যেতে হয়েছে বিদেশ-এ, সে মাতৃভূমির প্রতি নাড়ির টান অনুভব করে অনবরত। কবি আলোচ্য কবিতায় কবি একগুঁয়ে বলতে এই মানুষদের বুঝিয়েছেন।
তাৎপর্য – আলোচ্য কবিতায় কবি বহমান কাল ধরে মানুষের ঘরে ফেরার ইচ্ছেকে উল্লেখ করেছেন আশ্চর্য সংবেদনে। জন্মভূমির কাছে ফিরে আসার তাগিদকেই কবি ‘পিপাসা’ শব্দে প্রতীকায়িত করেছেন। কবি এ কবিতায় লিখেছেন –
“কে এইখানে হারিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে,
এই মাটিকে এই হাওয়াকে আবার ভালোবাসে।’
আসলে বিদেশ-বিভুঁই মানুষকে সাফল্য-খ্যাতি দিলেও গ্রামবাংলায় সাজিয়ে রাখা অনাবিল আনন্দ দিতে ব্যর্থ হয় সে। তা ছাড়া জন্মভূমি যেভাবে একটি মানুষের সত্তার প্রাথমিক সংগঠনে লগ্ন হয়ে থাকে, সেই লগ্নতা আজীবন অন্য কোথাও তৈরি হয় না। ফলে বঙ্গজন কর্মসূত্রে জন্মভূমি ছাড়লেও নাড়ির অমোঘ টানে তাকে ফিরে আসতেই হয় এ বাংলায়। বঙ্গভূমির নিসর্গসৌন্দর্য ও গ্রামজীবনের নিরুপদ্রব শান্তি উপভোগের বাসনা বঙ্গবাসীর ফুরায় না কখনোই। বঙ্গজনের এই বঙ্গভূমিতে ফেরার অতীত-বর্তমান কবিকে বিস্মিত করে। জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়া এবং ফিরে আসার গল্প মানুষ চিরকাল ধরে রচনা করে। তাই কবি পৌঁছে যান এক সত্য উপলব্ধিতে; –
“ফুরয় না তার যাওয়া এবং ফুরয় না তার আসা,
ফুরয় না সেই একগুঁয়েটার দুরন্ত পিপাসা।”
‘সারাটা দিন আপন মনে ঘাসের গন্ধ মাখে,/সারাটা রাত তারায় তারায় স্বপ্ন এঁকে রাখে।’ – সারাটা দিন আপনমনে ‘ঘাসের গন্ধ’ মাখা ও ‘তারায় তারায় স্বপ্ন এঁকে’ রাখার তাৎপর্য কী?
গ্রামে ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা – আবহমান কাল ধরে মানুষের ঘরে তথা জন্মভূমিতে ফেরার টান কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ধরেছেন ‘আবহমান’ কবিতায়। উন্নতির আশায় মানুষ গ্রাম ত্যাগ করলেও, এক সময় ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ গ্রামগুলির স্নেহ-মমতা তার অর্জিত যশ-প্রতিপত্তির তুলনায় অধিক প্রিয় হয়ে ওঠে। তখনই তারা ‘নিবিড় অনুরাগে’ ফিরে আসতে চায় পল্লিবাংলার সাধারণ ও চেনা পরিবেশে। গ্রামজীবনের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে লগ্ন হয়ে মানুষের বেঁচে থাকার স্বাদ এবং সাধ ফুরোয় না। কবি তাই বলেছেন, তারা কর্মব্যস্ততার মধ্যেও পল্লিবাংলার স্পর্শ অনুভব করে, রাতের আকাশে শৈশবের পরিচিত রাজ্যে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন এঁকে রাখে।
তাৎপর্য – এই বাংলার মাটিতে জন্মগ্রহণ করার সুবাদে বাংলার মানুষের প্রতিটি দিন এবং রাত বড়োবেশি করে প্রকৃতিলগ্ন। সে যখন মাটির কাছাকাছি তথা বাস্তবের কাছাকাছি থাকে তখনও সে প্রকৃতির সাহচর্যে বেঁচে থাকে, আবার যখন স্বপ্নের আকাশ খুঁজতে চায় তখনও প্রকৃতিই তাকে প্রশ্রয় দেয়। দিনের আলোয় ঘাসের গন্ধ মাখতে কিংবা রাতের তারায় স্বপ্ন এঁকে রাখতে এই বাংলাই যেন তাকে হাতছানি দেয়। তাই বঙ্গবাসী দিন এবং রাতের সব সৌন্দর্যটুকু আপন মনে উপভোগ করে। এভাবেই বঙ্গপ্রকৃতি হয়ে ওঠে তার আত্মার আত্মীয়। এই মাতৃভূমির সঙ্গে তৈরি হয় তার অবিচ্ছেদ্য নাড়ির টান, যে টানে সে বারে বারে হারিয়ে গিয়েও ফিরে আসে এই বাংলায়।
‘নেভে না তার যন্ত্রণা যে, দুঃখ হয় না বাসি,/হারায় না তার বাগান থেকে কুন্দফুলের হাসি।’ – তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
প্রসঙ্গ – প্রশ্নোদ্ধৃত চরণটি কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী রচিত ‘অন্ধকার বারান্দা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘আবহমান’ কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোচ্য কবিতায় কবি বাংলাদেশের পল্লিপ্রকৃতির আবহমান সৌন্দর্য এবং মানুষের সঙ্গে তার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক প্রকাশ করতে গিয়ে প্রশ্নোদ্ধৃত চরণটি ব্যবহার করেছেন।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আলোচ্য কবিতায় বঙ্গজনের বারবার ঘরে ফেরার চিরন্তন গল্পটি বলেছেন সংবেদনশীল মন নিয়ে। কবি খেয়াল করেছেন যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষ গ্রামবাংলার নিসর্গসৌন্দর্যের অমোঘ আকর্ষণ উপেক্ষা করতে না পেরে বারে বারে ফিরে আসে। কর্মসূত্রে প্রবাসে গেলেও বাংলা মায়ের স্নেহ-মমতার সামনে ম্লান হয়ে যায় ক্ষণিকের যশ প্রাপ্তি। তাই বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষ ‘এই মাটিকে’, ‘এই হাওয়া’ ভালোবেসে ‘নিবিড় অনুরাগে’ ফিরে আসে। গ্রামজীবনের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে লগ্ন হয়ে মানুষের বেঁচে থাকার স্বাদ এবং সাধ ফুরোয় না কখনও। সূর্যের আলো-ছায়া, নদীর বয়ে চলার মতো বঙ্গবাসীর সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, যন্ত্রণা-উন্মাদনা ম্লান হয় না কোনোদিন। বাংলাদেশের প্রকৃতির অনন্ত সৌন্দর্যে ঘাটতি পড়ে না কখনও, অটুট থাকে ‘কুন্দফুলের হাসি’। বহমান কাল ধরে বঙ্গদেশের নিসর্গপ্রকৃতির এই অসীম সৌন্দর্যই বাঙালির আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু।
‘তেমনি করেই সূর্য ওঠে, তেমনি করেই ছায়া’ – সূর্য ওঠা ও ছায়ার তেমনি করেই ফিরে আসার তাৎপর্য নির্দেশ করো।
প্রসঙ্গ – প্রশ্নোদ্ধৃত চরণটি কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী রচিত ‘অন্ধকার বারান্দা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘আবহমান’ কবিতা থেকে সংগৃহীত। আলোচ্য কবিতায় বঙ্গপ্রকৃতির সৌন্দর্যের আবহমানতা বোঝাতে অন্যান্য প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের সঙ্গে সূর্যের ওঠা এবং আড়ালে চলে যাওয়ার প্রসঙ্গটিকে ব্যবহার করেছেন কবি। সূর্যের এই যাওয়া-আসা চিরকালীন।
তাৎপর্য – প্রবহমান কাল ধরে প্রবাসী বাঙালির প্রকৃতির সান্নিধ্যে বাংলার গ্রামজীবনে ফিরে আসার যে টান, কবির অনুভবে তা আলোচ্য কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে। কবি এ কবিতায় দেখিয়েছেন ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ ছোটো ছোটো গ্রামগুলি যুগ যুগ ধরে যে অকৃত্রিম আনন্দের উপাদান সাজিয়ে রেখেছে তার বুকে, তা পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না বলে প্রবাসীরা বারেবারে ফিরে আসে এ বাংলায় তাদের মাতৃভূমিতে। এই বাংলার মাটিকে-হাওয়াকে বঙ্গবাসী ভালোবেসেছে ‘নিবিড় অনুরাগে’। তাই এই বাংলাকে ঘিরে বাঙালির যাওয়া-আসার স্রোত অবিরত থাকে চিরকাল। কবি নানা প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ ব্যবহার করে বাংলার নিসর্গসৌন্দর্যের চিরায়ত রূপটি ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই এ কবিতায় অনিবার্য হয়ে পড়েছে সূর্যের যাওয়া-আসার চিত্রকল্পটির ব্যবহার। সূর্য যেমন নিয়ম করে উদিত হয়, সূর্যের সঙ্গে নিয়ম করে আসে ছায়া, তেমনই বাংলার বুক জুড়ে থাকে মানুষের চলমান স্রোত। এ বাংলার বুকে ঘর বেঁধেও তারা হারিয়ে যায়, আবার এ বাংলাকে ভালোবেসেই তারা ফিরে আসে। প্রকৃতি আর মানুষের চলাচল এ বাংলায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
‘নামলে আবার ছুটে আসে সান্ধ্য নদীর হাওয়া।’ – নদীর হাওয়া কোথায় ছুটে আসে? নদীর হাওয়া ছুটে আসার তাৎপর্য নির্দেশ করো।
‘নদীর হাওয়া’ যেখানে আসে – উদ্ধৃতিটি কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখা ‘অন্ধকার বারান্দা’ কাব্যগ্রন্থের ‘আবহমান’ কবিতাটির অন্তর্গত। গ্রাম বাংলার সৌন্দর্যের আবহমানতার কথা কবির অনুভবে ধরা পড়েছে আলোচ্য কবিতায়। নদীমাতৃক বাংলার গ্রামজীবনে পুনরায় ফিরে আসে প্রবাসী বাঙালিরা। তাদের আসাকে কেন্দ্র করে বাংলা মায়ের উচ্ছ্বাস, আবেগ সন্ধ্যার স্নিগ্ধ অথচ দুরন্ত বাতাসের মতো নদীর হাওয়া ছুটে আসে তাদের কাছে।
তাৎপর্য – আলোচ্য কবিতায় কবি নানান প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের ব্যবহার করে বঙ্গপ্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। নদীমাতৃক বাংলার সঙ্গে বঙ্গবাসীর অন্তরঙ্গতা, তাদের পারস্পরিক স্নেহ-মমতা, আবেগকে কবি নদীর স্নিগ্ধ বাতাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বাংলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ প্রবাসী মাতৃভূমির প্রতি গভীর অনুরাগের কারণে ফিরে আসতে চায়। মাতৃভূমির থেকে বিচ্ছেদের যে বেদনা, ফিরে আসার যে আকুলতা প্রবাসী মানুষ অনুভব করে, তেমনি প্রকৃতিও বারবার আহ্বান করেছে তাদের। কবি বলেছেন তাই যখন প্রবাসী পুনরায় এই বাংলায় আসে, পল্লিবাংলার আবেগ-উচ্ছ্বাস সন্ধ্যার স্নিগ্ধ প্রবল বাতাসের বেশে তাদের ঘিরে ধরে। আলোচ্য কবিতায় কবি মানুষের ঘরে ফেরার অসমাপ্ত গল্পটিকে উল্লেখ করেছেন। কবির অনুভূতিতে এই সত্য সমগ্র কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। গ্রামজীবনের সঙ্গে লগ্ন হয়ে বেঁচে থাকার সাধ কখনও ফুরিয়ে যায়নি। এ সত্য অতীতের চাঁদ বণিকের চম্পক নগরীতে ফিরে আসার কথায় ভিন্ন অনুভবে ধরে রেখেছেন জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘রূপসী বাংলায়’। আবার অরুণ মিত্রের ‘জনমদুখিনির ঘর’-এ উঠে এসেছে ফেরার এই কাহিনী। তেমনি কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ‘আবহমান’ কবিতায় ঘর ছাড়া মানুষকে ফিরিয়ে এনেছেন এবং সেই আনন্দে ছুটে এসেছে মাতৃকার স্নেহাবেগ নদীর সান্ধ্যবায়ুর বেশে।
‘এখনও সেই ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল/সন্ধ্যার বাতাসে’ – কোন্ প্রসঙ্গে এই উক্তি? উক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
প্রশ্নোদ্ধৃত চরণটি কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘আবহমান’ কবিতার অন্তর্গত।
প্রসঙ্গ – আলোচ্য কবিতায় পল্লিবাংলার সৌন্দর্যের আবহমানতা প্রকাশ পেয়েছে। কর্মসূত্রে বাংলা ত্যাগ করেও প্রবাসী মানুষ মাতৃভূমির প্রতি স্নেহের টান অনুভব করে দিবারাত্রি। ফিরে আসার স্বপ্ন দেখে চেতন-অবচেতনে। কবি বলেছেন প্রবহমান প্রকৃতিও যেন এই ফিরে আসার অপেক্ষা করে। প্রকৃতিও মানুষের পারস্পরিক অন্তরঙ্গতার টান এবং প্রকৃতির আহ্বানকে কবি নানা প্রাকৃতিক অনুষঙ্গে উল্লেখ করেছেন। প্রবাসীকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রকৃতির যে আহ্বান, তা কবি আলোচ্য চরণটির মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন।
কবি আলোচ্য কবিতায় উক্ত চরণটি যে স্তবকের অন্তর্গত তা বারবার ব্যবহার করেছেন। পাঠককে অনুরোধ, উপরোধের ছলে কবি প্রকৃতি-মানুষের চিরায়ত সম্পর্ককে প্রকাশ করেছেন। ‘ছোট লাউফুল’ সামান্য-তুচ্ছ হলেও তা প্রবাসী মানুষের কাছে ছেড়ে আসা মাতৃভূমির স্মৃতি প্রকাশক। কবি বলেছেন প্রবাসীকে ফিরে পাওয়ার অপেক্ষা করেছে পল্লিবাংলা আবহমান কাল ধরে, কারণ মানুষের যাওয়া-আসা চিরকালীন। কর্মব্যস্ত মানুষ যশ-খ্যাতি-প্রতিপত্তি লাভের আশায় বাংলা থেকে চলে গিয়েও সেই অন্তরঙ্গতার টানে ফিরে আসতে চায়। তার ঘুমে-জাগরণে বাংলার চিরপরিচিত সহজ-সামান্য দৃশ্যগুলি ঘুরে বেড়ায়, তাকে হাতছানি দেয়। ব্যাকুল প্রবাসীও স্বপ্নে এঁকে রাখে মাতৃভূমির সঙ্গে মিলনের তীব্র বাসনাকে। প্রকৃতির এই আহ্বান কবি মাধ্যম হয়ে পৌঁছে দিয়েছেন প্রবাসীর কাছে। তিনি বলেছেন অতীতে চেনা উঠোনের লাউমাচায় যে ফুলটি দুলছিল, তা ‘এখনও’ সন্ধ্যার স্নিগ্ধ বাতাসে দুলছে। কারণ প্রবাসীকে ফিরে পাওয়ার আশায় পল্লিপ্রকৃতি এখনও অপেক্ষারত।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা নবম শ্রেণীর বাংলা বিষয়ের চতুর্থ পাঠের তৃতীয় অধ্যায়, ‘আবহমান’ -এর কিছু রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রশ্নোত্তরগুলো নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নবম শ্রেণীর বাংলা পরীক্ষায় এই ধরনের প্রশ্ন নিয়মিত আসে। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের উপকারে এসেছে। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, তবে টেলিগ্রামে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমরা সর্বদা প্রস্তুত। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন