নবম শ্রেণি – বাংলা – আবহমান – সামগ্রিক বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর

আবহমান কবিতাটি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী রচিত একটি বিখ্যাত কবিতা। এই কবিতাটিতে কবি গ্রাম বাংলার চিরন্তন সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছেন। কবি বলেন, গ্রাম বাংলার প্রকৃতি চিরন্তন। সেখানে বসন্তের আগমনে ফুল ফোটে, শরতে ধানের ক্ষেত হলুদ হয়ে ওঠে, শীতকালে গাছে গাছে বরফ জমে, আর গ্রীষ্মে ঝড় বৃষ্টি হয়। এই প্রকৃতির সাথে গ্রাম বাংলার মানুষও চিরন্তন। তারা প্রকৃতির সাথে মিশে আছে। তারা প্রকৃতিকে ভালোবাসে এবং প্রকৃতি তাদের ভালোবাসে।

নবম শ্রেণি – বাংলা – আবহমান – সামগ্রিক বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর

আবহমান কবিতাটির নামকরণ কতদূর সার্থক সে বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

যে-কোনো সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রেই নামকরণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নামের মধ্য দিয়েই পাঠকের মনে লেখাটি সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা করেন সাহিত্যস্রষ্টা। পাঠককে আকর্ষণ করার তাগিদ থেকেই স্রষ্টা তার সাহিত্যকর্মের নামকরণের দিকটিতে লক্ষ রাখেন। কবিতার ক্ষেত্রে সাধারণত বিষয়বস্তু, ভাব বা ব্যঞ্জনা অনুসারে নামকরণ করা হয়ে থাকে।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী রচিত আলোচ্য কবিতাটির নাম আবহমান। আবহমান শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ক্রমাগত বা চিরপ্রচলিত। সহজ কথায় যুগ যুগ ধরে একইভাবে চলে আসা যে – কোনো কিছুকেই আবহমান বলা হয়। আবহমান কবিতায় কবি গ্রামবাংলার মানুষের দুঃখকষ্টে ভরা প্রকৃতির ছায়ায় লালিত জীবনের চিরন্তন ছবিকে নিপুণ তুলিতে এঁকেছেন। সুদূর অতীতে মানুষ সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা বাংলাকে ভালোবেসে এখানেই বসতি বানিয়েছিল। আবহমান কবিতায় লাউমাচার প্রতীকের মধ্য দিয়ে সেই সহজসুন্দর গ্রামজীবনকেই তুলে ধরা হয়েছে। কবি এই লাউমাচার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে বলেছেন কারণ সেখান থেকেই নাগরিক জীবনে ক্লান্ত মানুষ খুঁজে পেতে পারে শান্তির নিশ্বাস। মাটি আর হাওয়াকে ভালোবেসে মানুষ তাই গিয়ে দাঁড়ায় সেই প্রকৃতির কাছে। ঘাসের গন্ধ মেখে আর সারা রাত তারায় তারায় স্বপ্ন এঁকে রেখে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়।

অসংখ্য বাধাবিপত্তির মধ্যেও এদেশের মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে, হাসিমুখে দু-চোখে নতুন জীবনের স্বপ্ন এঁকে বংশানুক্রমে তার জীবনপ্রবাহকে সচল রেখেছে। এই গ্রাম্যপ্রকৃতির দ্বারা লালিত জীবন থেকেই সুখ খুঁজে নিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চলে নাগরিক জীবনে ক্লান্ত মানুষ। যুগ যুগ ধরে বয়ে চলা বাংলার গ্রামজীবন, তার প্রকৃতি আর তার কাছে মানুষের ঋণের কাহিনিই এই কবিতায় নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন কবি। তাই বলা যায়, কবিতাটির আবহমান নামটি অসাধারণ ব্যঞ্জনাধর্মী এবং যথাযথ।

আবহমান কবিতাটি প্রত্যেক মানুষের আত্ম-অনুসন্ধানের কাহিনি। — আলোচনা করো।

অথবা, আবহমান কবিতা অবলম্বনে কবির মনোভঙ্গি ব্যাখ্যা করো।

অথবা, আবহমান কবিতার মূল ভাবনাটি সংক্ষেপে নিজের ভাষায় লেখো।

মানুষের আত্মানুসন্ধানের কাহিনি – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর আবহমান কবিতাটি প্রত্যেক মানুষের তার শিকড়ের কাছে, উৎসের কাছে ফিরে যাওয়ার কাহিনি। একদিন মানুষ গভীর ভালোবাসা দিয়ে ঘর বেঁধেছিল গ্রামবাংলায়। দেশের মাটি আর জলহাওয়ার প্রতি ছিল সেই ভালোবাসা। কিন্তু দিন এগিয়েছে। নগরসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষও শহরমুখী হয়েছে। কিন্তু এই শহরজীবনে মানুষ আরাম-স্বাচ্ছন্দ্য পেলেও মনের শান্তি পায়নি। যন্ত্রসভ্যতার দমবন্ধ করা জীবনযাত্রার ক্লান্তি আর অবসন্নতা গ্রাস করেছে তাকে। আর তখনই তৈরি হয় তার গ্রামজীবনে ফিরে আসার ইচ্ছা। একসময় কবি কীট্স নাইটিঙ্গেল পাখির গান শুনে স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন, কবি অরুণ মিত্রের ঘরে ফেরার ক্ষেত্রে কার্যকরী ছিল দেশজননীর আহ্বান। আর আবহমান কবিতায় উঠোনে লাউমাচায় দুলতে থাকা ছোট্ট ফুল যেন ফিরে আসা মানুষকে স্বাগত জানানোর জন্য তৈরি হয়ে থাকে। যাওয়া এবং আসার এই পর্ব – পর্বান্তরে স্পষ্ট হয়ে থাকে প্রকৃতি আর সহজসরল জীবনকে কাছে পাওয়ার মানুষের পিপাসা। সারাদিন আপন মনে ঘাসের গন্ধ মেখে, আর সারারাত তারায় তারায় স্বপ্ন এঁকে মানুষের বেঁচে থাকাই আলোচ্য কবিতাটির বিষয়। এ আসলে ক্লান্তি – অবসন্নতাকে অতিক্রম করে প্রতিটি মানুষের নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা।

আবহমান কবিতায় কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বারংবার যে কয়েকটি পঙ্ক্তির ব্যবহার করেছেন তার প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করো।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর আবহমান কবিতায় ছ-টি পঙ্ক্তিকে একাধিকবার ব্যবহার করেছেন।

পঙ্ক্তিগুচ্ছ-১ – যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া,/লাউমাচাটার পাশে।/ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল/সন্ধ্যার বাতাসে। – আবহমান কবিতাটি আসলে মানুষের তার উৎসের কাছে ফিরে যাওয়ার চিরকালীন আকুলতার প্রকাশ। এই উৎস হল তার ফেলে আসা গ্রামজীবন। একসময় তার পূর্বপুরুষেরা অরণ্যজীবনের অবসান ঘটিয়ে এই গ্রামসভ্যতার প্রতিষ্ঠা করেছিল। আর আজ শহরের ক্লান্তি আর অবসন্নতার অবসান ঘটাতে এই গ্রামই একমাত্র আশ্রয় হতে পারে। সেখানে লাউমাচার পাশে সন্ধ্যার বাতাসে ছোট্ট একটা ফুল দুলছে। এটা যেন নিৰ্মল বেঁচে থাকার ইঙ্গিত। কবিতায় ফিরে যাওয়ার বার্তাকে স্পষ্ট করতে মোট চারবার এই পঙ্ক্তিগুচ্ছকে ব্যবহার করা হয়েছে।

পঙ্ক্তিগুচ্ছ-২ – ফুরয় না তার কিছুই ফুরয় না,/নটেগাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়য় না! — গ্রামজীবনে মানুষের নিজের শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়ার তাগিদ শেষ হয় না। তাই মনের মধ্যে সে ঘাসের গন্ধ মাখতে থাকে, সমস্ত রাত ধরে তারায় তারায় স্বপ্ন আঁকতে থাকে। তার বাগান থেকে কুন্দফুলের হাসি কখনও হারিয়ে যায় না। ফিরে যাওয়ার দুরত পিপাসা যেমন শেষ হয় না, সেরকম গ্রামজীবনে কখনোই ফুরোয় প্রকৃতির সজীবতা। সূর্য ওঠে, ছায়ার বিস্তার হয়, নদীর সান্ধ্য বাতাস বয়ে যায়। সেই বাতাস ক্লান্ত মানুষকে দেয় বেঁচে থাকার সজীব আশ্বাস। প্রকৃতি  এবং তার কাছে ফিরে যাওয়ার চিরকালীন আকুলতাকে বোঝাতেই এই পঙ্ক্তিগুচ্ছকে কবি তাই তিনবার ব্যবহার করেছেন।

আবহমান কবিতাটি গ্রাম বাংলার অপার সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের এক অসাধারণ চিত্র। এ কবিতা আমাদের গ্রাম বাংলার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করে। এ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।

Share via:

মন্তব্য করুন