উৎস
সত্যজিৎ রায় রচিত কর্ভাস কাহিনিটি ১৩৭৯ বঙ্গাব্দে (১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ) আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীতে প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে এই কাহিনিটি শঙ্কুসমগ্র গ্রন্থে সংকলিত হয়।
বিষয়সংক্ষেপ
পাখি সম্পর্কে প্রোফেসর শঙ্কুর কৌতূহল দীর্ঘদিনের। ছোটোবেলায় বাড়ির পোষা ময়নার গলায় ‘ভূমিকম্প’ কথাটি শোনার পরদিন খবরের কাগজে মৃদু কম্পনের খবর পড়ে তাঁর সেই কৌতূহল আরও বেড়ে যায়। সেই থেকেই পাখির বুদ্ধির দৌড় সম্পর্কে গবেষণা করার সুপ্ত ইচ্ছা রয়ে যায় তাঁর মনে। গ্রামবাংলার বাবুই পাখির খড়কুটো দিয়ে বাসা বানানো কিংবা অস্ট্রেলিয়ার ম্যালি-ফাউল পাখির মাটিতে বাসা তৈরি করা অথবা শত্রুর আগমনের ইঙ্গিত পেলে গ্রিব নামক পাখির আত্মরক্ষার কৌশল — এর সবই আকর্ষণ করে বিশ্ব জোড়া খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি বৈজ্ঞানিক প্রোফেসর শঙ্কুকে।
দীর্ঘদিনের অপ্রকাশিত ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে প্রোফেসর শঙ্কু বানিয়ে ফেলেন এক আশ্চর্য পাখি-পড়ানো যন্ত্র। তিনি এর নাম দেন ‘অরনিথন’। ল্যাবরেটরির জানালা দিয়ে আসা বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্য থেকে একটি কাককে খুব পছন্দ হয় প্রোফেসর শঙ্কুর। আচার- আচরণে অন্যান্য কাকদের থেকে পৃথক এই কাকটিই হয়ে ওঠে তাঁর ছাত্র। শঙ্কু তার নামকরণ করেন ‘কর্ভাস’। নভেম্বর মাসে চিলির রাজধানী সানতিয়াগো শহরের আন্তর্জাতিক পক্ষীবিজ্ঞানীদের সম্মেলনে কর্ভাসকে নিয়ে যোগদানের জোরদার প্রস্তুতি শুরু করেন তিনি।
অরনিথন যন্ত্রটি দুই কক্ষবিশিষ্ট। খাঁচার মতো প্রথম অংশে পাখির থাকার জায়গা এবং তার সঙ্গে বৈদ্যুতিক উপায়ে যুক্ত দ্বিতীয় অংশ থেকে জ্ঞান ও বুদ্ধি পাঠানো হয় পাখির মস্তিষ্কে। এই যন্ত্রের মাধ্যমেই প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে ন-টা পর্যন্ত চলে কর্ভাসের প্রশিক্ষণ। বাধ্য ছাত্র কর্ভাস অল্পদিনের মধ্যেই শিখে ফেলে বাংলা, ইংরেজি ভাষা- সহ অঙ্ক, জ্যামিতি, ইতিহাস, ভূগোল, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের প্রাথমিক বিষয়গুলি। বার, তারিখ, মাসের হিসাবের পাশাপাশি আয়ত্ত করে ফেলে খাবার খাওয়ার আদবকায়দাও। সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য বাড়ি থেকে রওনা দেওয়ার আগে সে প্রোফেসর শঙ্কুকে মনে করিয়ে দিতে ভোলে না পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও।
বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের পাশাপাশি মানবসুলভ বুদ্ধিতে ভরপুর কর্ভাসকে নিয়ে প্রোফেসর শঙ্কু রওনা হন সানতিয়াগোর উদ্দেশ্যে।
পক্ষীবিজ্ঞানীদের সম্মেলনে কর্ভাস দু-মাসে যা শিখেছে তার সবই দেখিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দেয়। প্রোফেসর শঙ্কুর বৈজ্ঞানিক প্রতিভার মুকুটে যোগ হয় নতুন পালক। সেখানকার খবরের কাগজ কোরিয়েরে দেল সানতিয়াগোর সান্ধ্য সংস্করণে ফলাও করে প্রকাশিত হয় কর্ভাসের বুদ্ধিমত্তার খবর।
সেদিনই বিকেলে চিলির জাদুকর আর্গাসের ম্যাজিক দেখতে প্লাজা থিয়েটারে বন্ধু গ্রেনফেলের সঙ্গে হাজির হন প্রোফেসর শঙ্কু। নানান ধরনের পাখি নিয়ে ম্যাজিক দেখালেও জাদুকর আর্গাসের অদ্ভুত চেহারাটাই বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে প্রোফেসর শঙ্কুকে। সেদিন রাতেই হোটেলে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে কর্ভাসকে চেয়ে বসেন আর্গাস। প্রথমে সম্মোহনবিদ্যার সাহায্য নেন তিনি। কিন্তু তা বিফল হওয়ায় টাকার লোভ দেখিয়ে কর্ভাসকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন আর্গাস। তবে কোনো কিছুতেই ফল না হওয়ায় হতাশ হয়ে হোটেল ত্যাগ করেন তিনি। কিন্তু মনে মনে তৈরি করতে থাকেন কর্ভাসকে চুরি করার পরিকল্পনা। প্রোফেসর শঙ্কুর অনুপস্থিতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাঁর হোটেলের ঘর থেকে কর্ভাসকে চুরি করেন আর্গাস। রুপোলি ক্যাডিলাক গাড়িতে চড়ে কর্ভাসকে নিয়ে হাইওয়ে ধরে শহর ছাড়ার পরিকল্পনা করেন তিনি।
বিজ্ঞানী সম্মেলনের চেয়ারম্যান সিনিয়র কোভারুবিয়াসের পরামর্শে স্থানীয় পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে আর্গাসকে ধরা এবং কর্ভাসকে উদ্ধারের উদ্দেশ্যে রওনা হন প্রোফেসর শঙ্কু এবং গ্রেনফেল। পথে তাঁদের চোখে পড়ে একটা রুপোলি ক্যাডিলাক গাড়ি গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে পড়ে রয়েছে। তবে উধাও হয়ে গিয়েছেন গাড়ির মালিক আর্গাস এবং সেই সঙ্গে কর্ভাসও। এরপর শঙ্কুরা শুনতে পেলেন কর্ভাসের উদ্দেশে গালিগালাজ করছেন আর্গাস। শঙ্কুরা আর্গাসকে দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও তাঁদের দেখতে পেলেন এবং এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে লাগলেন। পুলিশের ধমকে তিনি অস্ত্র ফেলে এগিয়ে আসতেই বোঝা গেল, চশমা হারিয়ে দৃষ্টিশক্তি এবং সম্মোহন ক্ষমতা দুই-ই হারিয়েছেন আর্গাস। প্রোফেসর শঙ্কুকে দেখে উলটো দিকের ন্যাড়া অ্যাকেসিয়া গাছ থেকে নেমে এসে পুলিশের মারসেডিস গাড়ির ছাদের উপর বসে কর্ভাস। ঠোঁট থেকে নামিয়ে রাখে জাদুকর আর্গাসের বিশ পাওয়ারের সোনার চশমাটা।