নবম শ্রেণি – বাংলা – ধীবর-বৃত্তান্ত (নাটক) কালিদাস

ধীবর বৃত্তান্ত নাট্যাংশে ধীবর নামক একজন সাধারণ মানুষের সততা, সত্যবাদিতা ও ন্যায়পরায়ণতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। নাট্যাংশের শুরুতে ধীবর রাজনামাঙ্কিত একটি আংটি চুরির অপরাধে গ্রেপ্তার হন। কিন্তু তিনি নির্ভীকচিত্তে সত্য কথা বলেন এবং আংটিটি যেভাবে পেয়েছেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেন। ধীবরের সততা ও সত্যবাদিতার কাছে মুগ্ধ হয়ে রাজশ্যালক তাকে মুক্তি দেন।

নবম শ্রেণি – বাংলা – ধীবর-বৃত্তান্ত (2)

লেখক পরিচিতি

ভূমিকা – সংস্কৃত সাহিত্যে বাল্মীকি এবং ব্যাসদেবের পরেই উচ্চারিত হয় কালিদাসের নাম।

ব্যক্তিগত জীবন ও আবির্ভাবকাল – কালিদাসের ব্যক্তিগত জীবন ও আবির্ভাবের সময় নিয়ে বিশেষ কিছু জানা যায় না। উজ্জয়িনী, কলিঙ্গ এমনকি কাশ্মীরকেও তাঁর জন্মস্থান বলে ভাবা হয়। কালিদাস সম্পর্কে কিংবদন্তি আছে যে প্রথম জীবনে যথেষ্ট বুদ্ধিমান না হলেও পরবর্তীতে তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটে। বিক্রমাদিত্যের নবরত্ব সভার অন্যতম রত্ন ছিলেন কালিদাস। এই হিসেবে ৩০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি বর্তমান ছিলেন মনে করা হয়।

সাহিত্যকর্ম – কালিদাস তিনটি নাটক রচনা করেছিলেন — অভিজ্ঞান শকুন্তলম্, বিক্রমোর্বশীয়ম্, মালবিকাগ্নিমিত্রম্। রচনা করেছিলেন রঘুবংশ এবং কুমারসম্ভব – এর মতো মহাকাব্যতুল্য কাব্যগ্রন্থ এবং মেঘদূত ও ঋতুসংহার নামে দুটি খণ্ডকাব্য।

কবিপ্রতিভা – রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, ছন্দ, অলংকার, বেদ, ব্যাকরণ ইত্যাদি বহু বিষয়েই কালিদাসের দখল ছিল। তিনি প্রায় তিরিশ প্রকারের ছন্দ ব্যবহার করেছেন। কালিদাসের কাব্যে ধ্বনিময়তা ও ব্যঞ্জনা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। মেঘদূত কাব্যে মেঘের মাধ্যমে বিরহিণী প্রিয়ার কাছে নির্বাসিত যক্ষের বার্তা পাঠানো কিংবা ঋতুসংহার কাব্যে ছয় ঋতুর বর্ণনা — ভারতীয় কাব্যসাহিত্যে রোমান্টিকতার সূচনা করেছিল। শেকসপিয়র, মিলটন প্রমুখ বিশ্বসাহিত্যের স্মরণীয় স্রষ্টাদের সঙ্গে কালিদাসকেও এক আসনে বসানো হয়।

উৎস

কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ নাটকের ষষ্ঠ অঙ্ক থেকে ধীবর-বৃত্তান্ত নাট্যাংশটি নেওয়া হয়েছে। বাংলায় এটির তরজমা করেছেন সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী।

নাট্যাংশের পূর্বসূত্র

রাজা দুষ্মন্ত মহর্ষি কণ্ঠের আশ্রমে শকুন্তলাকে বিয়ে করে রাজধানীতে ফিরে যান এবং তারপরে শকুন্তলার খোঁজ নিতে আর কেউ সেখানে আসে না। স্বামীর চিন্তায় অন্যমনস্কা হয়ে থাকেন শকুন্তলা। তিনি খেয়ালও করেন না যে মহর্ষির আশ্রমে মুনি দুর্বাসার আগমন হয়েছে। অপমানিত দুর্বাসা অভিশাপ দেন যে, যে ব্যক্তির চিন্তায় শকুন্তলা মগ্ন হয়ে দুর্বাসাকে উপেক্ষা করেছেন সেই ব্যক্তি শকুন্তলাকে ভুলে যাবেন। শকুন্তলার সখী প্রিয়ংবদার অনুরোধে দুর্বাসা বলেন যে, রাজাকে যদি শকুন্তলা কোনো স্মারকচিহ্ন দেখাতে পারেন তাহলেই এই অভিশাপের প্রভাব দূর হবে। সখীদের তখন মনে হয়, বিদায় নেওয়ার সময়ে শকুন্তলাকে রাজা দুষ্মন্তের দেওয়া আংটিই হতে পারে সেই স্মারকচিহ্ন।

কিন্তু মহর্ষি কণ্বের উদ্যোগে শকুন্তলা দুষ্মন্তের কাছে গেলেও যাত্রাপথে শচীতীর্থে স্নানের পরে অঞ্জলি দেওয়ার সময়ে তার হাতের আংটিটি জলে পড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই শকুন্তলা কোনো চিহ্ন দেখাতে না পারায় দুষ্মন্তও শকুন্তলাকে চিনতে পারেন না। ঘটনাচক্রে সেই আংটি এক ধীবর পান।

বিষয়সংক্ষেপ

রাজার নাম লেখা আংটি রাখার অপরাধে এক ধীবরকে ধরে নিয়ে আসেন রাজার শ্যালক এবং রক্ষীরা। ধীবর বলে যে সে চুরি করেনি। সেই কথা বলার পরও রক্ষীরা তাকে তীব্র ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে, এমনকি তার জীবিকা নিয়েও ব্যঙ্গ করতে ছাড়ে না। ধীবর এর তীব্র প্রতিবাদ করে। সে জানায়, রুই মাছ টুকরো করে কাটার সময়েই মাছের পেট থেকে এই আংটিটা সে পেয়েছে। সেই আংটি বিক্রির সময়েই ধীবর ধরা পড়ে যায়। রাজশ্যালক পুরো ঘটনা মহারাজকে জানাতে যান। ধীবরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য রক্ষীরা উৎসুক হয়ে পড়ে। কিন্তু শ্যালক ফিরে এসে ধীবরের বক্তব্য সত্য বলে জানান এবং তাকে ছেড়ে দিতে বলেন। শুধু তা-ই নয়, মহারাজ আংটির সমপরিমাণ মূল্যও ধীবরকে দিয়েছেন বলে জানান। আংটির কথা শুনে রাজা যে বিহ্বল হয়ে পড়েন, সে কথাও রাজশ্যালক উল্লেখ করেন। ধীবরের এই সৌভাগ্য – উদয় রক্ষীরা ঈর্ষান্বিত হয়। কিন্তু রাজশ্যালক ধীবরকে তাঁর বিশিষ্ট প্রিয় বন্ধু হিসেবে মেনে নেন ।

নামকরণ

যে-কোনো সাহিত্যে প্রবেশের চাবিকাঠি হল তার নামকরণ। এই নামকরণ নানান দিক থেকে হতে পারে। কখনও তা হয় ব্যঞ্জনাধর্মী, কখনও বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক, কখনও – বা চরিত্রকেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে আমাদের পাঠ্য ধীবর-বৃত্তান্ত নাট্যাংশটির নামকরণ কতদূর সার্থক, তাই বিচার্য। রাজা দুষ্মন্তের শকুন্তলাকে ভুলে যাওয়া — শকুন্তলাকে দুর্বাসা মুনির অভিশাপ দেওয়ার ঘটনা — শকুন্তলাকে দেওয়া আংটি দেখে দুষ্মন্তের সব মনে পড়ে যাওয়া — এইসব কাহিনির মধ্যে ধীবর চরিত্রটির অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। শচীতীর্থের ঘাটে স্নান সেরে অঞ্জলি দেওয়ার সময়ে শকুন্ডলার হাতের আংটিটি জলে পড়ে যায়। কিন্তু এই আংটিই ছিল একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন, যেটি রাজা দুষ্মন্তকে দেখালে রাজা শকুন্তলাকে চিনতে পারতেন। ধীবর তার ধরা রুই মাছ কাটতে গিয়ে আংটিটি পায় ও সেটি বিক্রি করতে গিয়ে রাজার শ্যালক এবং রক্ষীদের হাতে ধরা পড়ে। সে সত্যি কথা বলতে চাইলেও কেউই তার কথা বিশ্বাস করে না। তাকে ব্যঙ্গ করা হয়। শাস্তি দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে রক্ষীরা। কিন্তু রাজার কাছ থেকে ঘুরে এসে রাজার শ্যালক জানান, ধীবর সত্যি কথাই বলেছে। অতএব তার কোনো শাস্তি হয় না, বরং আংটি দেখে রাজার শকুন্তলাকে মনে পড়ে যাওয়ায় তিনি আংটির মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ পুরস্কার হিসেবে ধীবরকে দেন। রাজার শ্যালকের বন্ধুত্বের মর্যাদাও লাভ করে ওই ধীবর। এইভাবে এই নাট্যাংশে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলা অপেক্ষা ধীবর চরিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এটি তারই কাহিনি। দুষ্মন্ত শকুন্তলা যেখানে নিতান্তই পরোক্ষভাবে আছেন ৷ তাই কাহিনির নাম ধীবর বৃত্তান্ত অত্যন্ত সার্থক ও যথাযথ হয়েছে।

ধীবর বৃত্তান্ত নাট্যাংশ একটি মনোরম ও শিক্ষামূলক নাট্য। নাট্যাংশের মাধ্যমে আমরা সততা ও সত্যবাদিতার গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারি।

Share via:

মন্তব্য করুন