বিশ শতক ইউরোপের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুগ। এই শতাব্দীতে ইউরোপের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের মূল কারণ ছিল শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং শীতল যুদ্ধের উত্তেজনা।
স্পেনের গৃহযুদ্ধ (Spanish Civil War) সম্বন্ধে কী জান?
স্পেনীয় রাজতন্ত্রের দুর্বলতা স্পেনকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পরিণত করে। রাজা আলফানসোর ক্ষমতাচ্যুতি, রিভেরার সামরিক একনায়কত্ব, প্রজাতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের নির্বাচনী সাফল্য এবং দক্ষিণপন্থী জোটের প্রতিক্রিয়া স্পেনের রাজনীতিতে অস্থিরতার সৃষ্টি করে। এই পরিস্থিতিতে পপুলার ফ্রন্ট ও ফ্যাসিবাদী সেনাপতি ফ্রাঙ্কোর প্রতিযোগিতা স্পেনে গৃহযুদ্ধের সূচনা করে (১৯৩৬-১৯৩৯ খ্রি.)।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের কারণ – ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে জয়লাভ করে বামপন্থীগণ স্পেনে সরকার গঠন করে। ক্ষমতায় আসীন হয়ে এই দল বহু সামরিক কর্মচারীকে পদচ্যুত করে। এমনকি রাজতন্ত্রের সমর্থক সন্দেহে অনেককে বহুদূরে স্পেনীয় উপনিবেশে বদলি করে দেওয়া হয়। এর ফলে বামপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীসহ অনেকের মনেই ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল ফ্রাঙ্কো (General Franco) – র নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করলে এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং স্পেনে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়।
স্পেনের গৃহযুদ্ধ – স্পেনের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার যা ‘পপুলার ফ্রন্ট’ নামে পরিচিত তার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ স্পেনীয় সেনাদের নেতা জেনারেল ফ্রাঙ্কো বিদ্রোহের পতাকা তোলেন। এই ঘটনাকে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য বিশ্বের ২৭টি দেশ নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু জার্মানি ও ইটালির দ্বারা সমর্থিত ফ্রাঙ্কো সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারা সমর্থিত পপুলার ফ্রন্ট সরকারকে পরাজিত করে। নতুন মারণাস্ত্রের পরীক্ষানিরীক্ষা হয় এই যুদ্ধের মাধ্যমে এবং ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। এজন্য স্পেনীয় গৃহযুদ্ধকে ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া’ বলে। শেষে ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে স্পেনে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের গুরুত্ব – স্পেনের গৃহযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বহু রাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধের ব্যাপকতার ফলে জাতিসংঘের আদর্শের অসারতা প্রমাণিত হয়। সর্বোপরি স্পেনে ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিস্ট সরকার জয়লাভ করায় পশ্চিম ইউরোপে ফ্যাসিবাদী প্রভাব পড়ে।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের গুরুত্ব কী ছিল?
স্পেনের গৃহযুদ্ধ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিন বছর ধরে চলেছিল। এই গৃহযুদ্ধের প্রধান দুই প্রতিপক্ষ ছিল স্পেনের প্রজাতন্ত্রী সরকার ও জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে সরকার বিরোধী গোষ্ঠী। ইউরোপ তথা বিশ্ব ইতিহাসে এই যুদ্ধের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের গুরুত্ব –
- ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রভাব বৃদ্ধি – স্পেনের ফ্যাসিবাদী নেতা জেনারেল ফ্রাঙ্কো ইটালি ও জার্মানির সাহায্য নিয়ে জয়লাভ করেন। ফলে স্পেনেও জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
- বিশ্বযুদ্ধের মহড়া – স্পেনের গৃহযুদ্ধকে অনেকে ক্ষুদে বিশ্বযুদ্ধ (Little World War) বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া’ (Stage Rehearsal of the Second World War) বলে অভিহিত করেছেন। এই যুদ্ধে হিটলার তাঁর বিমানবাহিনী ও যুদ্ধাস্ত্র পরীক্ষা করে নিয়েছিলেন।
- পাশ্চাত্য দেশের সাম্যবাদ ভীতি – স্পেনের গৃহযুদ্ধ প্রমাণ করেছিল যে ইউরোপের ধনতান্ত্রিক দেশগুলি ফ্যাসিবাদ অপেক্ষা সাম্যবাদকে বেশি ভয় করে।
- জাতিসংঘের ব্যর্থতা – স্পেনের গৃহযুদ্ধে জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। এতে জাতিসংঘের অসারতা ও দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেছিল।
- কূটনৈতিক ব্যর্থতা – স্পেনের গৃহযুদ্ধ গণতান্ত্রিক পশ্চিমি দেশগুলির কূটনৈতিক ব্যর্থতা প্রমাণ করে। ২৭টি দেশের জোট গঠন করে তারা স্পেনে হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ করে। এই সুযোগে ফ্যাসিবাদী ইটালি ও নাৎসিবাদী জার্মানি স্পেনে সশস্ত্র হস্তক্ষেপ করে সফল হয় এবং ফ্রান্সের সীমান্তে স্পেন শত্রুরাষ্ট্রে পরিণত হয়।
- গণতন্ত্রের সংকট – স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্যাসিস্টদের সাফল্যলাভ ইউরোপীয় গণতন্ত্রের সংকট সৃষ্টি করে। স্পেনের নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটে। জার্মানি অস্ট্রিয়া ও চেকোশ্লোভাকিয়া দখল করে। পোল্যান্ডের পতন ঘটে।
স্পেনের গৃহযুদ্ধ একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা হলেও তা সমগ্র ইউরোপ তথা বিশ্বকে আলোড়িত করে। ফ্যাসিবাদের আগ্রাসীরূপ বিশ্ব প্রত্যক্ষ করে।
বিশ শতকে ইউরোপে ঘটেছিল একাধিক যুদ্ধ, বিপ্লব এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনগুলি ইউরোপের ভবিষ্যতকে গঠন করেছিল এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশের উপরও প্রভাব ফেলেছিল। বিশ শতকের ইউরোপের ইতিহাস হল একটি জটিল এবং বৈচিত্র্যময় ইতিহাস যা আমাদের বিশ্বকে বুঝতে সাহায্য করে।