নবম শ্রেণী – ইতিহাস – বিংশ শতকে ইউরোপ – বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

বিংশ শতাব্দী ইউরোপের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুগ। এই শতাব্দীতে ইউরোপে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে রয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, এবং ঠান্ডা যুদ্ধ। এই ঘটনাগুলি ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

Table of Contents

বিংশ শতকে ইউরোপ – বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর
বিংশ শতকে ইউরোপ – বিশ্লেষণমূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন ও উত্তর

জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার – এর সংস্কারগুলি সংক্ষেপে লেখো।

জার প্রথম নিকোলাসের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় আলেকজান্ডার জার হিসেবে সিংহাসনে বসেন (1855 খ্রি.)। দ্বিতীয় আলেকজান্ডার পিতার মতো স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ এবং প্রজাকল্যাণকামী শাসক।

দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কার –

  • উদারনৈতিক ব্যবস্থা – দ্বিতীয় আলেকজান্ডার জার নিকোলাসের আমলের দমননীতিকে রদ করেন। বিদ্রোহীদের নির্বাসনদণ্ড মকুব করেন, গুপ্তচর বাহিনী ভেঙে দেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেন।
  • ভূমিদাসপ্রথার বিলোপসাধন – ভূমিদাসরা (সার্ফ) রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের মেরুদণ্ডস্বরূপ ছিল। সার্ফদের জীবন ছিল দুর্দশাগ্রস্ত। তাদের মুক্তির উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার 1861 খ্রিস্টাব্দের 19 ফেব্রুয়ারি মুক্তির ঘোষণাপত্র (Edict of Emancipation) তে স্বাক্ষর করেন। এর ফলে রাশিয়া থেকে ভূমিদাসপ্রথার অবসান ঘটে। ভূমিদাসদের মুক্তি দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে “মুক্তিদাতা জার” (Czar Liberator) নামে খ্যাতি দেওয়া হয়।
  • বিচারবিভাগীয় সংস্কার – দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের অনুকরণে বিচারবিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করেন। শাসনবিভাগ থেকে বিচারবিভাগকে পৃথক করা হয় এবং একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়।
  • শাসনবিভাগীয় সংস্কার – তিনি সমগ্র রাশিয়াকে 350টি জেলায় বিভক্ত করে প্রত্যেক জেলায় জেমস্টোভো (Zemstvo) নামে একটি কাউন্সিল বা প্রাদেশিক সভা গঠন করেন। তিনি শিক্ষা ও শিল্পের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি আনার চেষ্টা করেন।

যদিও দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কারগুলি রাশিয়ার উন্নতির লক্ষ্যে করা হয়েছিল, তবে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা চালু থাকায় সংস্কারের সুফল জনগণের কাছে সম্পূর্ণভাবে পৌঁছায়নি। ভূমিদাসপ্রথা আইনত বিলুপ্ত হলেও গ্রাম্য সমবায় বা মিরের প্রভাব বজায় ছিল।

রুশ বিপ্লবের পিছনে জারদের স্বৈরাচারী শাসনের কী ভূমিকা ছিল?

অথবা, রুশ বিপ্লবের পটভূমিতে জার তৃতীয় আলেকজান্ডার ও দ্বিতীয় নিকোলাস – এর ভূমিকা কী ছিল?

1917 খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের পটভূমিতে জার তৃতীয় আলেকজান্ডার ও দ্বিতীয় নিকোলাসের প্রতিক্রিয়াশীল নীতিগুলি বিশেষভাবে দায়ী ছিল।

জার তৃতীয় আলেকজান্ডার –

  • দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র তৃতীয় আলেকজান্ডার রাশিয়ার জার হন। তিনি ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল শাসক এবং রাশিয়াকে একটি স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করেন।
  • তাঁর শাসনামলে তিনি “এক জার, এক চার্চ, এক রাশিয়া” নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, যা একক জাতি ও ধর্মের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল।
  • তিনি অ-রুশ ও ইহুদিদের চাকুরি, শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেন এবং সংবাদপত্র, বিদ্যালয় ও বিচারালয়ের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন।

জার দ্বিতীয় নিকোলাস –

  • তৃতীয় আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় নিকোলাস রাশিয়ার জার হন। তিনি ছিলেন স্বৈরাচারী শাসক এবং তাঁর পিতার নীতির অনুসারী।
  • দ্বিতীয় নিকোলাসও “এক জার, এক চার্চ, এক রাশিয়া” নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনি সংবাদপত্র, বই-পুস্তক, এবং রাজনৈতিক দলের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন।
  • তাঁর শাসনামলে রাশিয়ার অ-রুশ প্রজাদের উপর রুশ ভাষা ও সংস্কৃতি জোরপূর্বক আরোপ করা হয়েছিল।
  • দ্বিতীয় নিকোলাসের রাজত্বে রানি আলেকজান্দ্রা, কয়েকজন মন্ত্রী ও ভণ্ড সন্ন্যাসী রাসপুটিনের অত্যধিক প্রভাব ছিল।
  • দ্বিতীয় নিকোলাসের আমলে রাশিয়ার জারতন্ত্রের অবসান ঘটে। তাঁর স্বৈরাচারী শাসনের কারণে 1905 ও 1917 খ্রিস্টাব্দে দুটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। 1917 খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের ফলে 300 বছরের রোমানভ বংশের শাসনের অবসান ঘটে।

নারদনিক আন্দোলন (Narodnik Movement) — টীকা লেখো।

রুশ জারদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন এবং সামন্ততান্ত্রিক শোষণের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ায় চরমপন্থী ভাবধারার জন্ম হয়। অনেক গুপ্ত সমিতি গড়ে ওঠে, কিন্তু যখন এইসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, তখন নারোদনিক আন্দোলন গড়ে ওঠে।

নারোদনিক আন্দোলন –

সার্ফ প্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও রাশিয়ার কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়, এবং কৃষক অভ্যুত্থানগুলো রাশিয়ায় দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হয়। রাশিয়ার উদারপন্থী শিক্ষিত সম্প্রদায় এই ভূমিহীন কৃষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। নিহিলিস্ট আন্দোলন (Nihilist Movement) কেবলমাত্র দার্শনিক তত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে ‘জনতাবাদী আন্দোলন’ (Populist Movement)। রুশ ভাষায় ‘নারোদ’ (Narod) শব্দের অর্থ হল ‘জনতা’ বা ‘জনগণ’। এখান থেকেই আন্দোলনের নাম রাখা হয় ‘নারোদনিক আন্দোলন’ (Narodnik Movement)।

  • কর্মসূচি – নারোদনিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রায় 1,000 জন শিক্ষিত যুবক-যুবতী গ্রামে গিয়ে কৃষকদের বিপ্লবী আদর্শের সঙ্গে পরিচিত করাতে থাকে। তারা বোঝাতে চায় যে গ্রামের কৃষক এবং শহরের শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ না হলে শোষণের অবসান সম্ভব হবে না। কিন্তু শীঘ্রই নারোদনিকরা সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়।
  • নারোদনিক আন্দোলনের ব্যর্থতা – নারোদনিক আন্দোলন নানা কারণে ব্যর্থ হয়েছিল কৃষকরা নারোদনিকদের আবেদনে সাড়া দেয়নি। সরকারি দমননীতির চাপে আন্দোলন তার গতি হারায়।
  • গুরুত্ব – ব্যর্থতা সত্ত্বেও এই আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই আন্দোলনই পরবর্তীকালে বৃহত্তর রুশ বিপ্লবের মানসিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়। এর ফলে জনগণ বিপ্লবী আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়।

নারদনিয়া ভলিয়া (Narodnaya Volya) সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

নারোদনিক আন্দোলনের ব্যর্থতার পর আন্দোলনকারীরা তাদের আন্দোলনের মত ও পথ পরিবর্তন করে। তারা কৃষকদের মধ্যে প্রচারের কর্মসূচি ত্যাগ করে সন্ত্রাসের পথ গ্রহণ করে। 1879 খ্রিস্টাব্দে তারা ‘নারোদনয়া ভোলিয়া’ (Narodnaya Volya) নামক বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি গঠন করে আন্দোলন চালিয়ে যায়।

  • নারোদনয়া ভোলিয়া শব্দের অর্থ – রুশ ভাষায় ‘নারোদ’ শব্দের অর্থ ‘জনগণ’ এবং ‘ভোলিয়া’ শব্দের অর্থ ‘ইচ্ছা’। অর্থাৎ, নারোদনয়া ভোলিয়ার অর্থ ‘জনগণের ইচ্ছা’।
  • নারোদনয়া ভোলিয়ার কর্মসূচি – নারোদনয়া ভোলিয়া গুপ্ত সমিতি জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে জঙ্গি কার্যকলাপ শুরু করেছিল। তারা অত্যাচারী রাজকর্মচারীদের হত্যার কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই সংগঠনের নারী বিপ্লবী ভেরা জাসুলিচ (Vera Zasulich) অত্যাচারী রুশ সামরিক গভর্নর জেনারেল ট্রেপভ (General Trepov)-কে গুলি করেন। পরে তিনি ধরা পড়লেও বিচারে মুক্তি পান।
  • লক্ষ্য পরিবর্তন – জার সরকার কঠোর দমননীতি অনুসরণ করে। পরবর্তীকালে বিপ্লবীরা নরম মনোভাব নিয়ে জার তৃতীয় আলেকজান্ডারের কাছে আবেদন জানায় যে জার সরকার নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা বন্ধ করবে। গণপরিষদ আহ্বান করা হলে বিপ্লবীরা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বন্ধ করবে।
  • জার সরকারের দমননীতি – জার তৃতীয় আলেকজান্ডার বিপ্লবীদের আবেদনে সাড়া না দিয়ে কঠোর দমননীতি অনুসরণ করেন। অনেক আন্দোলনকারী কঠোর দণ্ডে দণ্ডিত হন। লেনিনের বড় ভাই আলেকজান্ডার উলিয়ানভ (Alexander Ulyanov) আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। সরকারের এই দমননীতির ফলে আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
  • গুরুত্ব – বিপ্লবীদের আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এই আন্দোলনের গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। এই আন্দোলন পরবর্তীকালের রুশ বিপ্লবের দিশা নির্ধারণে সহায়ক হয়েছিল।

1905 সালের বিপ্লবের প্রাক্কালের রাশিয়ার কৃষক ও শ্রমিকদের অবস্থা কীরূপ ছিল?

অথবা, ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবের প্রাক্কালে রাশিয়ার সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।

1905 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় বিপ্লবের প্রাক্কালে সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ চরম আকার ধারণ করেছিল, যার ফলে সবচেয়ে দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছিল কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণি।

  • কৃষকশ্রেণির অবস্থা — বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ার সমাজ ছিল দুটি ভাগে বিভক্ত — সুবিধাভোগী অভিজাত সম্প্রদায় এবং দরিদ্র কৃষক শ্রেণি। ভূমিদাস প্রথার অবসান হলেও কৃষকদের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। মুক্তিপ্রাপ্ত ভূমিদাসরা রাষ্ট্র, জমিদার এবং মিরকে নানা প্রকার কর দিতে বাধ্য ছিল। মির-গুলোই ছিল জমির প্রকৃত মালিক, এবং কৃষকরা সম্পূর্ণভাবে মিরগুলোর অধীনস্থ হয়ে পড়েছিল। রাশিয়ার জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ভূমি সমস্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পায়, যা কৃষকদের উপর শোষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে তোলে।
  • শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা — রাশিয়ায় ব্যাপক শিল্পায়নের ফলে জাতীয় ঋণের পরিমাণ দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়, এবং এর ফলে রুশ শ্রমিকদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে ওঠে। তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এবং অসহনীয় অবস্থার মধ্যে দিনযাপন করতে বাধ্য হত। শ্রমিকদের এই দুরবস্থা সম্পর্কে জার সরকার সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল।

1905 সালের বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণগুলি সংক্ষেপে লেখো।

1905 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় যে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, তা নানা কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

1905 খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণগুলি হল –

  • কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যের অভাব — কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও তাদের মধ্যে কোনো ঐক্যবোধ গড়ে ওঠেনি, যা বিপ্লবের সাফল্যের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।
  • বিপ্লবের সীমিত পরিসর — বিশালায়তন রাশিয়ার সর্বত্র এই বিপ্লব সংঘটিত হয়নি; শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে এটি কার্যকর হয়েছিল, যা বিপ্লবের শক্তি ও প্রভাবকে সীমাবদ্ধ করে।
  • অপরিকল্পিত এবং বিক্ষিপ্ত আন্দোলন — 1905 খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব ছিল অপরিকল্পিত এবং বিক্ষিপ্ত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক শ্রেণি এতে যোগদান করলেও তাদের মধ্যে ঐক্যবোধের অভাব ছিল; প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বার্থকে বড় করে দেখেছিল, যা আন্দোলনের শক্তিকে দুর্বল করেছিল।
  • সামরিক সমর্থনের অভাব — নৌবাহিনী ও স্থলবাহিনীর কিছু সৈন্য বিপ্লবে যোগ দিলেও, সামগ্রিকভাবে সেনাবাহিনী জার সরকারের পক্ষেই অবলম্বন করেছিল, যা বিপ্লবের ব্যর্থতার একটি বড় কারণ।
  • জার সরকারের কঠোর দমননীতি — জার সরকারের কঠোর দমননীতি ছিল বিপ্লবের ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ। তাদের কঠোর পদক্ষেপের ফলে বিপ্লবীরা শক্তি হারায় এবং বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

1917 সালের রুশ বিপ্লবের সামাজিক পটভূমি কী ছিল?

1917 খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। রুশ বিপ্লব ছিল জনগণের দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের প্রকাশ। ঐতিহাসিক লিপসন (Lipson) বলেছেন যে, রুশ বিপ্লবের কারণ রাশিয়ার ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত। এই বিপ্লবের জন্য রাশিয়ার দীর্ঘদিনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং রাজনৈতিক অন্যায়-অবিচার দায়ী ছিল।

সামাজিক পটভূমি –

রাশিয়ার সামাজিক অবস্থা – 1917 খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ার সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। সমাজটি ছিল বিভক্ত এবং বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের শিকার।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের সামাজিক পটভূমি কী ছিল

শ্রেণিবিভক্ত সমাজ –

রাশিয়ার সমাজব্যবস্থা মূলত তিনটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল – অভিজাত, কৃষক-শ্রমিক, এবং মধ্যবিত্ত।

  • অভিজাত – রুশ সমাজে অভিজাতরা ছিলেন সংখ্যায় মুষ্টিমেয়, কিন্তু তারা জার সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট ছিলেন। ফলে, তারা দেশের শাসনব্যবস্থায় প্রধান ভূমিকা পালন করতেন এবং দেশের বেশিরভাগ জমির মালিক ছিলেন।
  • কৃষক ও শ্রমিক – রুশ সমাজে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি ছিল জনসংখ্যার অধিকাংশ অংশ। 1861 সালের ভূমিদাস মুক্তির আইন অনুসারে, ভূমিদাসরা মুক্তি পেলেও প্রকৃত অর্থে তারা কৃষকের মর্যাদা লাভ করেনি। অনেক কৃষক জমি বিক্রি করে পুনরায় ভূমিদাসের পর্যায়ে নেমে আসে। তাদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত দুর্বিষহ ছিল; সারা বছর পর্যাপ্ত খাবারও তারা পেত না।
  • মধ্যবিত্ত – রুশ সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল অত্যন্ত নগণ্য। সমাজে তাদের ভূমিকা সীমিত ছিল এবং তারা খুব কমই প্রভাবশালী ছিল।

সমাজে মদ্যপানের কু-অভ্যাস – দরিদ্র ও অশিক্ষিত কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে মদ্যপানের কু-অভ্যাস ছিল প্রচলিত। তারা ‘ভদকা’ (Vodka) নামে এক ধরনের মদ পান করত, যা তাদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থাকে আরও খারাপ করেছিল।

শিক্ষার অভাব – জার আমলে রাশিয়ায় শিক্ষার প্রসার তেমন ঘটেনি। কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের বেশিরভাগই ছিল নিরক্ষর। রুশ সরকারও শিক্ষাবিস্তারের জন্য কোনো সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

উপসংহার – স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণে জর্জরিত আধা-মধ্যযুগীয় রাশিয়ার সমাজ ছিল স্থবির ও পশ্চাদপদ। এই অবস্থা রুশ বিপ্লবের সামাজিক পটভূমি রচনা করেছিল, যা অবশেষে 1917 সালে রুশ বিপ্লবে রূপ নিয়েছিল।

1917 সালের রুশ বিপ্লবের অর্থনৈতিক পটভূমি কী ছিল?

১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। রুশ বিপ্লব ছিল জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ। ঐতিহাসিক লিপসন বলেছেন যে, রুশ বিপ্লবের (1917) কারণ রাশিয়ার ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এই বিপ্লবের জন্য রাশিয়ার অর্থনৈতিক পটভূমি যথেষ্ট দায়ী ছিল।

অর্থনৈতিক পটভূমি –

1917 সালের রুশ বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়।

  • সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা – রাশিয়ায় ভূমিদাস মুক্তি আইন পাস হলেও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় ছিল। চার্চ ও জমিদারদের জমি অধিগ্রহণ করা হলেও ‘কুলাক’ (জোতদার) শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। আগের মতোই আধা-সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক ও শোষণ সমাজে বজায় ছিল। ফসলের অর্ধেক অংশ জমির মালিক আদায় করত।
  • প্রযুক্তির অভাব – সমসাময়িক পশ্চিম ইউরোপে কৃষি বিপ্লব ঘটলেও রাশিয়ায় তা ঘটেনি। রাশিয়ায় তখনও পুরোনো দিনের মতো লাঙল-বলদের ব্যবহার ছিল, এবং সেচব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল অত্যন্ত কম।
  • বিদেশি মূলধননির্ভর শিল্প – শিল্পের ক্ষেত্রেও রাশিয়া অনেক পিছিয়ে ছিল। রাশিয়ায় যে শিল্পায়ন হয়েছিল তাতেও বিদেশি পুঁজির আধিপত্য ছিল। রাশিয়ায় মূলধন বিনিয়োগ করেছিল প্রধানত তৈল শিল্পে ব্রিটেন, কয়লা ও ধাতু শিল্পে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম, এবং ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে জার্মানি। রাশিয়ার শিল্পায়নের জন্য বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার ফলে 1914 সালে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ হয়েছিল 5,400 মিলিয়ন রুবল।
  • মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভাব – রাশিয়ায় ব্রিটেন বা ফ্রান্সের মতো ধনী বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থান ঘটেনি। মুষ্টিমেয় ধনী অভিজাতদের হাতে সম্পদ সঞ্চিত থাকলেও তা ব্যবসাবাণিজ্যে মূলধন হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি।
  • সমুদ্রপথের অভাব – রাশিয়ায় সমুদ্রপথে গমনাগমনের সুযোগ সীমিত ছিল, ফলে রাশিয়ার বৈদেশিক বাণিজ্যের যথেষ্ট বিকাশ ঘটেনি।

1917 সালে রুশ বিপ্লবের রাজনৈতিক পটভূমি কী ছিল?

1917 সালের রুশ বিপ্লব আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। রুশ বিপ্লব ছিল জনগণের দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ঐতিহাসিক লিপসন বলেছেন, রুশ বিপ্লবের (1917 খ্রি.) কারণ রাশিয়ার ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এই বিপ্লবের জন্য রাশিয়ার রাজনৈতিক পটভূমি যথেষ্ট দায়ী ছিল।

রাজনৈতিক পটভূমি –

  • জারের স্বৈরাচারী শাসন – বিংশ শতকের শুরুতে রাশিয়া ছিল একটি মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র। তখন রাশিয়ায় ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাসী রোমানভ বংশীয় জারদের স্বৈরাচারী শাসন বজায় ছিল। জারের অনুগ্রহপুষ্ট অভিজাতরা দেশের শাসন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। সাধারণ মানুষের শাসনে কোনো অংশগ্রহণ ছিল না।
  • বৈদেশিক যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় – 1904-1905 খ্রিস্টাব্দের রুশ-জাপান যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হয়, যা রুশ জারের মর্যাদায় আঘাত হানে। এরপর, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হতে থাকলে রুশ জনগণ জারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হয়।
  • জার শাসনে অবৈধ হস্তক্ষেপ – 1917 খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লবের প্রাক্কালে রাশিয়ার জার ছিলেন দ্বিতীয় নিকোলাস। তিনি ছিলেন তাঁর রানি জারিনা আলেকজান্দ্রার প্রভাবাধীন। রানি আলেকজান্দ্রা ছিলেন রাসপুটিন নামে এক ভন্ড সন্ন্যাসীর দ্বারা প্রভাবিত, যিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করতেন।
  • রুশিকরণ নীতি – রাশিয়ার পোল, ফিন, ইউক্রেনীয়, তুর্কি, জর্জীয়, আর্মেনীয় প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোক বসবাস করত, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় 20%। 1905 খ্রিস্টাব্দের পর জার সরকার এদের উপর জোরপূর্বক রুশ ভাষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয় এবং তিন গুণ বেশি কর আরোপ করে। ফলে অ-রুশ জনগোষ্ঠী বিদ্রোহে শামিল হয়।
  • রাজনৈতিক দল – রাশিয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে, যার মধ্যে বলশেভিক দল ও তার নেতা লেনিন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লেনিন তাঁর বিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিস’ ঘোষণা করেন এবং ‘শান্তি, জমি ও রুটি’-র স্লোগান দেন, যা রুশ জনগণের মধ্যে বিপ্লবের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে।

সময়সারণির মাধ্যমে 1917 সালের মার্চ মাসের রুশ বিপ্লবের বা মার্চ বিপ্লবের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা নির্ণয় করো।

সময়সারণি –

  • 8 মার্চ 1917 – পেট্রোগ্রাড শহরে প্রায় 80-90 হাজার শ্রমিক বলশেভিক দলের নেতৃত্বে আন্দোলনে যোগ দেয়। শ্রমিকদের দাবি ছিল, “স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক”, “শান্তি চাই, জমি চাই, রুটি চাই”। শ্রমিকরা লাল পতাকা নিয়ে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
  • 11 মার্চ 1917 – জার নিকোলাস ধর্মঘট দমন করতে সেনাবাহিনী পাঠান। তিনি একটি ঘোষণা জারি করে শ্রমিকদের কাজে ফেরার আদেশ দেন এবং নবনির্বাচিত ডুমা ভেঙে দেন। তিনি ডুমার সদস্যদের পদত্যাগ করতে বলেন।
  • 12 মার্চ 1917 – পাভলোভস্কি রেজিমেন্ট (Pavlovsky Regiment) এবং ভলিনস্কি রেজিমেন্ট (Volinsky Regiment) বিদ্রোহীদের উপর গুলি চালানোর আদেশ অমান্য করে এবং বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়। পেট্রোগ্রাড শহর বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এই সময়ে বিপ্লবীরা পেট্রোগ্রাড ও রাশিয়ার অন্যান্য শহরে সোভিয়েত (Soviet) বা শ্রমিক পরিষদ গঠন করে।
  • 13 মার্চ 1917 – সোভিয়েত সদস্যরা ঘোষণা করেন যে এখন থেকে তারা সরকার পরিচালনা করবে।
  • 15 মার্চ 1917 – পেট্রোগ্রাড সোভিয়েত এবং ডুমা একত্রিত হয়ে প্রিন্স জর্জি লুভ-এর নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠন করে। এই ঘটনাকে ‘মার্চ বিপ্লব’ নামে অভিহিত করা হয়।
  • 16 মার্চ 1917 – পেট্রোগ্রাড-এর দিকে জার দ্বিতীয় নিকোলাস রেলযাত্রা করার সময় রেলশ্রমিকেরা পথ অবরোধ করে। জারকে পদত্যাগের দলিলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। এর ফলে জার দ্বিতীয় নিকোলাস ও রোমানভ বংশের পতন ঘটে এবং রাশিয়ায় বুর্জোয়া সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

1917 সালের রাশিয়ায় নভেম্বর বিপ্লবের (November, Revolution) কারণ কী ছিল?

1917 সালের 16 মার্চ বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার জারতন্ত্রের পতন ঘটে এবং একটি অস্থায়ী প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এই সরকার রাশিয়ার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়। ফলে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।

নভেম্বর বিপ্লবের প্রধান কারণগুলো নিম্নরূপ –

  • কৃষকদের ক্ষোভ – কৃষকরা আশা করেছিল যে রাশিয়ার নতুন সরকার ভূমিসংস্কার করবে এবং ‘কুলাক’ প্রথার অবসান ঘটবে। তারা জমির মালিকানা পাবে বলে আশা করেছিল। কিন্তু প্রজাতান্ত্রিক সরকার এই ভূমিসংস্কার করতে ব্যর্থ হয়, ফলে কৃষকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কৃষকদের অনেককেই সৈনিক হিসেবে পাঠানো হয়, যেখানে তারা উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে জার্মান বাহিনীর হাতে দলে দলে নিহত হয়।
  • শ্রমিকদের ক্ষোভ – শ্রমিকরা আশা করেছিল যে নতুন সরকার তাদের বেতন বৃদ্ধি করবে এবং দৈনিক কাজের সময় 8 ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ করবে। কিন্তু তাদের এই দাবি পূরণ হয়নি, ফলে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।
  • সেনাবাহিনীর অসন্তোষ – রাশিয়ার সেনাবাহিনী আশা করেছিল যে সরকার যুদ্ধ বন্ধ করবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই কারণে সেনাবাহিনী ও তাদের পরিবার-পরিজন সরকারের প্রতি ক্রমাগত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
  • অ-রুশ জনগণের অসন্তোষ – রাশিয়ার অনেক অ-রুশ জনগণ আশা করেছিল যে নতুন সরকার তাদের স্বায়ত্তশাসন দেবে। কিন্তু এই আশা পূরণ না হওয়ায় তারা প্রজাতান্ত্রিক সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল।
  • বলশেভিকদের নেতৃত্ব – লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা জনগণকে একত্রিত করতে থাকে। 16 এপ্রিল, 1917 খ্রিস্টাব্দে লেনিন ‘এপ্রিল থিসিস’ ঘোষণা করেন, যেখানে সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে হস্তান্তরের দাবি জানানো হয়। বলশেভিকরা জনগণের মধ্যে বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা ছড়িয়ে দেয়। 7 নভেম্বর, 1917 খ্রিস্টাব্দে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা সফলভাবে ক্ষমতা দখল করে, যা ‘নভেম্বর বিপ্লব’ নামে পরিচিত।

লেনিনের চিন্তাধারা ও মতবাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

লেনিন ছিলেন সাম্যবাদের প্রবর্তক কার্ল মার্কস-এর আদর্শে বিশ্বাসী। তিনি তাঁর মতাদর্শ ‘ইসক্রা’ (Iskra), ‘প্রাভদা’ (Pravda) প্রভৃতি পত্রিকায়, বিভিন্ন গ্রন্থে এবং বক্তৃতার মাধ্যমে প্রচার করেন।

লেনিনের চিন্তা ও মতবাদ –

সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (Social Democratic Party)-র লন্ডন সম্মেলন –
1903 সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির দ্বিতীয় অধিবেশনে লেনিন দুটি প্রধান বক্তব্য তুলে ধরেন –

  • দলের সদস্যপদ শুধুমাত্র দলের সক্রিয় কাজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
  • দলের মূল উদ্দেশ্য হবে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটানো।

এই দল রাশিয়ায় জারতন্ত্র ও পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করে সর্বহারা শ্রেণির একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করবে। এই নীতিগত পার্থক্যের কারণে দলটি বলশেভিক (Bolshevik) ও মেনশেভিক (Menshevik) নামে দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

লেনিনের চিন্তাধারা ও মতবাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও

লেনিনের এপ্রিল থিসিস (April Theses) – লেনিন 1917 সালের 16 এপ্রিল সুইজারল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং বলশেভিকদের সামনে তাঁর বিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিস’ ঘোষণা করেন। এতে উল্লেখ ছিল—

  • মার্চ বিপ্লবে জারতন্ত্রের পতন ঘটেছে, এবং অস্থায়ী সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করতে হবে।
  • সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে অর্পণ করতে হবে।
  • রাশিয়ার সমস্ত জমি অধিগ্রহণ করে তা রাষ্ট্রীয়করণ করতে হবে।
  • রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে সরে আসবে।
  • রাশিয়ার সৈনিক, কৃষক এবং শ্রমিকদের জন্য ‘শান্তি, জমি এবং রুটি’-র তত্ত্ব বাস্তবায়িত করা হবে।
  • রাশিয়াতে সর্বহারা শ্রেণির একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
  • নভেম্বর বিপ্লবের পর, লেনিন রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এই পথে বাধার সৃষ্টি হলে তিনি মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের চেষ্টা করেন, যার অংশ হিসেবে তিনি নতুন আর্থিক নীতি বা ‘New Economic Policy (NEP)’ ঘোষণা করেন।

লেনিনের অবদান – লেনিনের ‘শান্তি, জমি ও রুটি’-র স্লোগান রাশিয়ার জনগণকে আকৃষ্ট করে। 1917 সালের 10 অক্টোবর, পেট্রোগ্রাডে এক গোপন বৈঠকে লেনিন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেন। 1917 সালের 7 নভেম্বর, ট্রটস্কি-র নেতৃত্বে 25 হাজার লাল ফৌজ পেট্রোগ্রাড দখল করে। এর ফলে কেরেনস্কি সরকারের পতন ঘটে এবং লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

লাল ফৌজ

এপ্রিল থিসিস – টীকা লেখো

অথবা, এপ্রিল থিসিস কে প্রবর্তন করেন? এর বিষয়বস্তু ও গুরুত্ব লেখো।

অথবা, এপ্রিল থিসিস কী? এর বিষয়বস্তু ও গুরুত্ব লেখো।

1917 খ্রিস্টাব্দের 16 এপ্রিল, বলশেভিক নেতা লেনিন সুইজারল্যান্ডের নির্বাসন থেকে রাশিয়ায় ফিরে এসে বলশেভিক কর্মীদের উদ্দেশ্যে একটি কর্মধারা প্রকাশ করেন, যা ‘এপ্রিল থিসিস’ নামে পরিচিত।

বিষয়বস্তু – বলশেভিক কর্মীদের উদ্দেশ্যে লেনিন যে এপ্রিল থিসিস ঘোষণা করেছিলেন, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল যে –

  • যেহেতু মার্চ বিপ্লবে সোভিয়েতগুলি প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তাই সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েতগুলির হাতে দিতে হবে।
  • বুর্জোয়া শাসনের অবসান ঘটিয়ে সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হবে।
  • “শান্তি, রুটি ও জমি” স্লোগানকে বাস্তবায়িত করে শ্রমিকদের রুটি, কৃষকদের জমি এবং সেনাবাহিনীকে শান্তি প্রদান করা হবে।
  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে রাশিয়াকে বিরত রাখা হবে, ইত্যাদি।

গুরুত্ব – রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব সংগঠনে এপ্রিল থিসিসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কারণ –

  • লেনিনের “শান্তি, জমি ও রুটি” স্লোগান সৈনিক, কৃষক ও শ্রমিকদের একত্রিত করে বিপ্লবের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল।
  • এপ্রিল থিসিস ঘোষণার পরই বলশেভিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি কৃষক, শ্রমিক ও সেনা প্রতিনিধিদের সংগঠন সোভিয়েতের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।
  • এইভাবে লেনিনের এপ্রিল থিসিস মার্চ বিপ্লবকে নভেম্বর বিপ্লবে রূপায়িত করতে সক্ষম হয়েছিল।

বলশেভিক দল কীভাবে রাশিয়ায় ক্ষমতা দখল করে?

অথবা, রুশ বা বলশেভিক বিপ্লবে (১৯১৭ খ্রি.) লেনিনের ভূমিকা কী ছিল?

1917 খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় বলশেভিক দলের নেতৃত্বে সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বলশেভিক দলের নেতা লেনিন।

  • অস্থায়ী সরকারের ব্যর্থতা – রুশ বিপ্লবের ফলে জার সরকারের পতন ঘটলে প্রিন্স লভ এবং কেরেনস্কির নেতৃত্বে অস্থায়ী প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এই সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়।
  • ক্ষমতা দখলের আহ্বান – লেনিন বলেছিলেন যে, বলশেভিকদের উদ্যোগেই মার্চ মাসে জারতন্ত্রের পতন ঘটায় দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা বলশেভিকদেরই প্রাপ্য। তিনি বুর্জোয়া প্রজাতান্ত্রিক সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা দখলের জন্য বলশেভিকদের আহ্বান জানান।
  • লেনিনের নেতৃত্ব এবং বলশেভিক দল – এমতাবস্থায় বলশেভিক নেতা লেনিন রাশিয়ায় ফিরে বিখ্যাত এপ্রিল থিসিস ঘোষণা করেন। তিনি বলেন – সেনাবাহিনীকে শান্তি, কৃষকদের জমি, এবং শ্রমিকদের রুটি দিতে হবে এবং সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে থাকবে। এর ফলে কৃষক, শ্রমিকসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বলশেভিক দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
  • বলশেভিক দল ও সংকট সমাধান – জেনারেল কর্নিলভ-এর অভ্যুত্থান ঘটলে প্রথমে কেরেনস্কি কর্নিলভের সাহায্যে বলশেভিকদের দমন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কর্নিলভ একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে কেরেনস্কি বলশেভিকদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। বলশেভিকরা সাহায্য করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
  • বিদ্রোহ – 1917 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে বলশেভিকরা অস্থায়ী সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ ঘোষণা করলেও কেরেনস্কি সরকার তা কঠোরভাবে দমন করে। 25 অক্টোবর শ্রমিকদের বিশাল বিক্ষোভ মিছিলে পেট্রোগ্রাড শহর উত্তাল হয়ে ওঠে। সোভিয়েত সৈন্যরা সরকারি বাড়ি, টেলিগ্রাফ অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, সরকারি ব্যাংক ইত্যাদি দখল করে। ট্রটস্কির নেতৃত্বে ‘রেড গার্ড’ বা ‘লাল ফৌজ’ ছিল এই কর্মকাণ্ডের মূল শক্তি।
  • সরকারের পতন ও ক্ষমতা দখল – 1917 খ্রিস্টাব্দের 7 নভেম্বর লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকদের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানে অস্থায়ী সরকার ভেঙে পড়ে এবং বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করে। লেনিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন সমাজতান্ত্রিক সরকার।

রুশ বিপ্লবে বলশেভিকদের সাফল্যের কারণগুলি কী ছিল?

1917 সালের রুশ বিপ্লবে বলশেভিকরা সাফল্যলাভ করায় রাশিয়ায় তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রুশ বিপ্লবে বলশেভিক দলের সাফল্যের পেছনে একাধিক কারণ ছিল।

বলশেভিকদের সাফল্যের কারণ –

  • জার শাসনের দুর্বলতা – রাশিয়ার জার শাসন রুশ বিপ্লবের প্রাক্কালে চরম সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। জাররা ছিলেন দুর্বল, অযোগ্য এবং স্বৈরাচারী। এর ফলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, যা বলশেভিকদের পক্ষে জনসমর্থন আদায়ে সাহায্য করে।
  • সমকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি – 1917 সালে যখন রুশ বিপ্লব শুরু হয়, তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। ফলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপানসহ অন্যান্য দেশ যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার কারণে তারা রাশিয়ার বিপ্লবে জারের শাসনকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করতে পারেনি।
  • দুর্বল প্রতিবিপ্লব – রাশিয়ায় বিপ্লববিরোধী শক্তিগুলির মধ্যে কোনো ঐক্য ছিল না। তাদের মাঝে মতবিরোধের কারণে তারা বলশেভিকদের মোকাবেলায় সফল হতে পারেনি, যা বলশেভিকদের জন্য সহায়ক প্রমাণিত হয়।
  • সামরিক বিপর্যয় – প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ব্যাপক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। প্রশিক্ষণহীন কৃষক ও শ্রমিকদের যুদ্ধে পাঠানো হলে তারা জার্মান বাহিনীর হাতে নিহত হয়। এর ফলে জনগণের ক্ষোভ জারের শাসনের ওপর পড়ে। এই পরিস্থিতির সুযোগে বলশেভিকরা প্রচার চালিয়ে জনগণের সমর্থন অর্জন করে।
  • লেনিনের নেতৃত্ব – বলশেভিক দলের নেতা লেনিন ছিলেন অসাধারণ নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি রাশিয়ার সংকটময় পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধের বদলে শান্তি, খাদ্য সরবরাহ, এবং জমির প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণকে বলশেভিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হন।

রুশ বিপ্লব কবে হয়? এ বিপ্লব রাশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজে কী প্রভাব ফেলেছিল?

1917 সালে সংঘটিত রুশ বিপ্লব ছিল পৃথিবীর অন্যতম যুগান্তকারী ঘটনা। রাশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে এই বিপ্লবের প্রভাব ছিল অপ্রতিরোধ্য।

রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজে প্রভাব –

  • রাজনৈতিক প্রভাব – রুশ বিপ্লব রাশিয়ায় জারের স্বৈরতন্ত্র, অভিজাতদের বিশেষাধিকার এবং যাজকদের প্রভাবকে বিলুপ্ত করে। এর ফলে সর্বহারাদের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক সরকার ছিল।
  • শ্বেত সন্ত্রাস (White Terror) – বিপ্লবের প্রভাবে রাশিয়ায় ‘শ্বেত সন্ত্রাস’ নামে পরিচিত প্রতিবিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয়। যদিও জনগণের একাংশ বলশেভিক সরকারের পক্ষ নেয়, অভিজাত শ্রেণি, যাজকরা এবং বিত্তশালী মানুষ বলশেভিকদের বিরোধিতা করে।
  • অর্থনৈতিক প্রভাব – রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে। ব্যক্তিগত মালিকানা ও ব্যক্তিগত মুনাফার নীতি পরিত্যাগ করা হয় এবং কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, জমি জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়। এসব সম্পত্তি শ্রমিকদের হাতে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং জমিদারদের জমি কেড়ে নিয়ে কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।
  • সামাজিক প্রভাব – রুশ বিপ্লবের প্রভাবে অ-রুশ জাতিগুলিকে সমমর্যাদা ও সমান অধিকার প্রদান করে সমাজে অংশীদার করা হয়। এতে রাশিয়ার সামাজিক কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আসে এবং সাম্যবাদের বাস্তব প্রয়োগ হয়।

মার্কস-এঙ্গেলসের সাম্যবাদের আদর্শ রাশিয়ায় বাস্তবায়িত হয়েছিল, এবং 1917 সালের রুশ বিপ্লব রাশিয়ার সমাজ কাঠামোকে নতুন রূপ দিয়েছিল।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রুশ বিপ্লবের কয়েকটি প্রভাব লেখো।

1917 খ্রিস্টাব্দে রুশ বা বলশেভিক বিপ্লব শুধুমাত্র রাশিয়াতেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল। এই বিপ্লব পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবিত করেছে।

রুশ বিপ্লবের প্রভাব –

  • ঔপনিবেশিক আন্দোলনে প্রভাব – 1917 খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবে বলশেভিক দলের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশবিরোধী মুক্তি আন্দোলন শুরু হয়। বিশেষ করে চীন, ভারতসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশবিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলন জোরদার হয়।
  • সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা – রুশ বিপ্লবের প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা ঘটে। লেনিনের নেতৃত্বে 1919 খ্রিস্টাব্দে মস্কোতে তৃতীয় আন্তর্জাতিক বা কমিন্টার্ন (Comintern) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করে।
  • বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর উত্থান – রুশ বিপ্লবের পর রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে ইউরোপের ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ উত্থাপিত হয়। এর ফলে বিশ্ব রাজনীতি পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
  • বিভিন্ন রাজবংশের পতন – রুশ বিপ্লবের প্রভাবে রাশিয়ার রোমানভ রাজবংশ, জার্মানির হোহেনজোলার্ন রাজবংশ এবং অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ রাজবংশের পতন ঘটে। এ ছাড়া আরও অনেক দেশে রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।
  • শ্রমিক শোষণে অব্যাহতি – ইউরোপে সাম্যবাদী ভাবধারা রোধ করার জন্য ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের মতো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি শ্রমিক কল্যাণমূলক আইন প্রবর্তন করে শ্রমিকদের শোষণ কমানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়।

সমকালীন বিশ্বের সমাজে রুশ বিপ্লবের কী প্রভাব পড়েছিল?

1917 খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব সমকালীন বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। ঐতিহাসিক ই.এইচ. কার বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বলশেভিক বিপ্লব একটি বৈশ্বিক আন্দোলনে পরিণত হয়।

সমাজব্যবস্থায় প্রভাব –

  • সাম্যবাদী ভাবধারার বিস্তার – রুশ বিপ্লব সমাজব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে। এর প্রভাবে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাম্যবাদী ভাবধারার বিস্তার ঘটে।
  • শ্রমিক শ্রেণির মর্যাদা বৃদ্ধি – রুশ বিপ্লবের পর সমাজে শ্রমিক শ্রেণির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি শ্রমিক শোষণ রোধে বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে।
  • নাগরিকের সমানাধিকার – রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় সকল নাগরিকের সমান অধিকারের নীতি ঘোষণা করা হয়। এই নীতি পরবর্তীকালে বিশ্বের অনেক দেশেই অনুসরণ করা হয়েছিল।
  • ধর্মীয় স্বাধীনতা – রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় রাষ্ট্র ও গির্জাকে পৃথক করা হয় এবং নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়, যা পরবর্তীকালে অন্যান্য দেশেও প্রভাব ফেলেছিল।

সমকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রুশ বিপ্লবের কী প্রভাব পড়েছিল?

1917 খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব সমকালীন বিশ্বের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। ঐতিহাসিক ই.এইচ. কার (E.H. Carr) বলেছেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বলশেভিক আন্দোলন একটি বিশ্ব আন্দোলনে পরিণত হয়।

রাজনৈতিক প্রভাব –

  • সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা – বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় প্রথমবারের মতো শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু দেশে সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বৃদ্ধি – রুশ বিপ্লবের প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন উপনিবেশে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন জোরদার হয়। ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশের পরাধীন জাতিগুলি নতুন উৎসাহ নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে।
  • ট্রেড ইউনিয়ন গঠন – রুশ বিপ্লবের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়, যা ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সহায়ক হয়। শ্রমিকরা নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।
  • বিশ্বে আদর্শগত গোষ্ঠীবিভাজন – রুশ বিপ্লবের ফলে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ও পুঁজিবাদী আদর্শের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন সৃষ্টি হয়। সমাজতন্ত্র ধনতন্ত্রের বিরোধী আদর্শ হওয়ায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই দুই শিবিরের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হয়।

সমকালীন বিশ্বের অর্থনীতিতে রুশ বিপ্লবের কী প্রভাব পড়েছিল?

1917 খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব সমকালীন বিশ্বের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।

অর্থনৈতিক প্রভাব –

  • ব্যক্তিমালিকানার অবসান – রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় ব্যক্তিমালিকানা ও ব্যক্তিগত মুনাফার নীতি বিলুপ্ত হয়। কলকারখানার উৎপাদন ও বণ্টন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আসে, যা অনেক দেশেই প্রভাব ফেলেছিল।
  • জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ – জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করে কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এই জমি সংস্কার নীতি অন্য দেশগুলিতেও প্রভাব বিস্তার করে।
  • কৃষিক্ষেত্রে প্রভাব – রুশ বিপ্লবের ফলে কৃষকরা উদ্বৃত্ত ফসল নিজেরা বাজারে বিক্রি করতে পারত এবং নগদ মূল্যে কর প্রদান করত। কৃষি উন্নয়নের জন্য কৃষি ব্যাংক ও সমবায় ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। এই নীতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুসরণ করা হয়।
  • শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়ন – শ্রমিকদের দৈনিক কাজের সময়সীমা 8 ঘণ্টায় নির্ধারিত হয় এবং তাদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা, দক্ষতা অনুযায়ী মজুরি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এই নীতিগুলি বিভিন্ন দেশে শ্রমিক আন্দোলনে প্রভাব ফেলে।
  • পুঁজিবাদের বিকল্প – সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি পুঁজিবাদের বিকল্প হিসেবে উদ্ভূত হয়। 1929 সালে আমেরিকার মহামন্দার সময়ে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এই মন্দার প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল, যা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির জনপ্রিয়তা বাড়ায়।

রুশ বিপ্লব বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল এবং পরবর্তীতে এর প্রভাব বহু দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

সাম্রাজ্যবাদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য কতখানি দায়ী ছিল?

1914 সালের 28 জুলাই অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের সার্বিয়ার উপর আক্রমণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য যে সকল কারণ দায়ী ছিল, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির সাম্রাজ্যবাদ। অনেক ঐতিহাসিক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী 1870 থেকে 1914 সময়কালকে ‘সাম্রাজ্যবাদের যুগ’ (Age of Imperialism) হিসেবে চিহ্নিত করেন।

  • ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা – পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে ভৌগোলিক আবিষ্কারের পর, ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে। শিল্পবিপ্লবের পর, ইউরোপের বিশেষত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, এবং জার্মানির শিল্পপতি শ্রেণি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য নিজ দেশের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে ইউরোপের দেশগুলি এশিয়া ও আফ্রিকায় উপনিবেশ দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।
  • ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি সাম্রাজ্য বিস্তারকে গর্বের প্রতীক হিসেবে দেখত। আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের ক্ষেত্রে ব্রিটেন ও ফ্রান্স অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীকালে ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলি সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব পোষণ করলে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
  • জার্মানির সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ – 1870 সালে জার্মানি একীভূত হওয়ার পর চ্যান্সেলর বিসমার্ক বলেছিলেন, জার্মানি একটি ‘পরিতৃপ্ত দেশ’। কিন্তু কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম ঘোষণা করেন, ‘জার্মানি পরিতৃপ্ত দেশ নয়, তার সামনে অনন্ত সম্প্রসারণের সম্ভাবনা আছে।’ জার্মানির সাম্রাজ্যবিস্তারের প্রচেষ্টা এবং ব্রিটেনের জার্মান ভীতি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী ছিল।
  • সাম্রাজ্যবিস্তারের জন্য সামরিকশক্তি বৃদ্ধি – জার্মানি সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম নৌ-শক্তি বৃদ্ধি করেন। বিভিন্ন দেশে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা ও অস্ত্র নির্মাণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এর ফলে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।

এছাড়াও, সশস্ত্র শান্তির যুগে বিভিন্ন মারণাস্ত্রের আবিষ্কার এবং পরস্পরবিরোধী সামরিক জোট উত্তেজনার পারদ বাড়িয়ে দেয়। সেরাজেভোর ঘটনা তাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যোগ করলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘটে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির দায়িত্ব কতখানি তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। একদল ঐতিহাসিক বলেন, জার্মানিই দায়ী ছিল; অপরপক্ষ বলেন, জার্মানি একা দায়ী ছিল না।

  • জার্মানির দায়িত্ব – কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের বিদেশনীতি: কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম ছিলেন উগ্র সাম্রাজ্যবাদী শাসক। তিনি সাম্রাজ্যবিস্তার ও বিশ্ব রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের নীতি গ্রহণ করলে, ইউরোপে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।
  • জার্মানির উগ্র জাতীয়তাবাদ – জার্মানরা ছিল টিউটন জাতির বংশধর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে জার্মানিতে প্রচারিত হয়েছিল যে, টিউটন জাতি হল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি। কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামও বিশ্বে টিউটন জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠেছিলেন।
  • জার্মানির ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা – জার্মানিতে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছিল অনেক দেরিতে। কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের আমলে শিল্পের ক্ষেত্রে জার্মানির ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। ফলে, শিল্পের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রির বাজারের প্রয়োজনে জার্মানি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠে। এই উপনিবেশ প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি রাষ্ট্রের সঙ্গে জার্মানি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।
  • জার্মানির সামরিক শক্তি বৃদ্ধি – জার্মানি ইউরোপে সামরিক প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ স্থলবাহিনী, দ্বিতীয় বৃহত্তম নৌবহর, শক্তিশালী বিমানবহর এবং আধুনিক মারণাস্ত্র জার্মানিকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত হতে উদ্বুদ্ধ করে। এই সামরিক প্রতিযোগিতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
  • জার্মানির শক্তিজোট গঠন – জার্মানি নিজের শক্তিবৃদ্ধি এবং ইউরোপের রাজনীতিতে ফ্রান্সকে নিঃসঙ্গ করার জন্য শক্তিজোট গঠন করে। অস্ট্রিয়া ও ইতালিকে নিয়ে জার্মানি ত্রিশক্তি মৈত্রী বা ট্রিপল অ্যালায়েন্স গঠন করে (1882)। রাশিয়ার সঙ্গেও জার্মানি রি-ইনসিওরেন্স চুক্তিতে (1887) আবদ্ধ হয়। জার্মানির এই শক্তিজোটের বিরুদ্ধে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও রাশিয়া ত্রিশক্তি আঁতাত নামে শক্তিজোট গঠন করে। ফলে, ইউরোপ দুটি পরস্পরবিরোধী শক্তিশিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
  • বিরুদ্ধ মত – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানিকে দায়ী করা হলেও অন্যান্য দেশগুলির দায়িত্বও কম ছিল না। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সেরাজেভো ঘটনার জন্য সার্বিয়া-অস্ট্রিয়ার বিরোধও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে দায়ী ছিল।

পরিশেষে বলা যায় – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানি দায়ী ছিল এই কথা অস্বীকার করা যায় না, তবে জার্মানি একাই দায়ী ছিল — এই কথা বলাও যুক্তিযুক্ত নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করেছিল?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ থেকে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু 1917 সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিত্রপক্ষে যোগ দিলে যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তিত হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগদানের প্রধান কারণ –

  • গণতন্ত্রের প্রতি দুর্বলতা – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, এবং স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর প্রতি তাদের সমর্থন ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে গণতান্ত্রিক দেশ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মার্কিন জনমত মিত্রশক্তির পক্ষে দাঁড়ায়।
  • অর্থনৈতিক কারণ – যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিল, তবুও তাদের ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। যুদ্ধের সময়ে আমেরিকা উভয় পক্ষকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। তবে, জার্মানির বিজয় হলে ভবিষ্যতে মার্কিন বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
  • রাজনৈতিক কারণ – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে জার্মানির সাফল্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আতঙ্কিত করে। বিশেষত, রাশিয়ার পরাজয় এবং জার্মানির সঙ্গে সন্ধি স্বাক্ষর করার ফলে জার্মানি শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যা ফ্রান্সের পতনের শঙ্কা তৈরি করে এবং ইউরোপের রাজনীতিতে অস্থিরতা দেখা দেয়।
  • জার্মান নৌ-আক্রমণ – 1915 সালে জার্মান সাবমেরিন লুসিটানিয়া নামে একটি মার্কিন যাত্রীবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দেয়, এতে অনেক মার্কিন নাগরিক নিহত হয়। এই ঘটনার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

উড্রো উইলসন এই যুদ্ধকে গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ বলে উল্লেখ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, “আমরা যুদ্ধ করছি গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং মুক্ত পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য।” এই কারণগুলোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের কারণগুলি কী ছিল?

যদিও জার্মানি এবং তার মিত্রশক্তি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শক্তিশালী ছিল, তবুও বিভিন্ন কারণে তারা পরাজিত হয়।

জার্মানির পরাজয়ের কারণ –

  • তুলনামূলক দুর্বলতা – ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, এবং রাশিয়ার জোটের তুলনায় জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ও তুরস্কের জোট তুলনামূলকভাবে দুর্বল ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিত্রপক্ষে যোগ দিলে মিত্রশক্তির সামরিক শক্তি আরও বৃদ্ধি পায়।
  • উপনিবেশ থেকে সুবিধা – ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স তাদের উপনিবেশ থেকে প্রচুর অর্থ এবং সৈন্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিল, যেখানে জার্মানির উপনিবেশ তুলনামূলকভাবে কম সমৃদ্ধ ছিল।
  • একক দায়িত্ব – যুদ্ধের শেষ দিকে, জার্মানির মিত্রশক্তিগুলি পরাজিত হলে, জার্মানিকে এককভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়, যা তাদের কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করে দেয়।
  • স্বল্প আয়তন – জার্মানির আয়তন ছোট হওয়ায় তারা রাশিয়ার মতো পশ্চাদপসরণ করে পুনর্গঠন করতে পারেনি, যার ফলে তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
  • ইউ-বোট প্রতিরোধ – যদিও প্রথম দিকে জার্মানির ইউ-বোট কার্যকরী ছিল, মিত্রশক্তি দ্রুত ইউ-বোটের প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করে, যা ইউ-বোটের কার্যকারিতা হ্রাস করে দেয়।
  • সামরিক শক্তির দুর্বলতা – জার্মানির স্থলবাহিনী শক্তিশালী হলেও, তাদের নৌবাহিনী ইংল্যান্ডের তুলনায় দুর্বল ছিল। বিমানবাহিনীতেও তারা মিত্রশক্তির তুলনায় পিছিয়ে ছিল। স্থলযুদ্ধে যেমন ফ্রান্সের সোম যুদ্ধ এবং মার্ন নদীর তীরের যুদ্ধে, জার্মান বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
  • শ্রমিক ধর্মঘট – যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জার্মানির অস্ত্রনির্মাণ কারখানায় শ্রমিক ধর্মঘট হয়, যা অস্ত্র ও গোলাবারুদের উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে রসদ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায়।

এই সব কারণের ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় ঘটে। এছাড়া জার্মানির জনগণ দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ আর চাইছিল না। যুদ্ধকালীন সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, এবং জনগণের বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ জার্মানির রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতাকে দুর্বল করে তোলে।

টীকা লেখো – প্যারিসের শান্তি সম্মেলন (Paris Peace Conference)

1918 সালের 11 নভেম্বর জার্মানির আত্মসমর্পণের মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। যুদ্ধের সমাপ্তির পর 1919 সালের 18 জানুয়ারি প্যারিসে বিজয়ী পক্ষের 32টি দেশের প্রতিনিধিগণ প্যারিস সম্মেলনে সমবেত হন।

প্যারিস সম্মেলনে যোগদানকারী রাষ্ট্রসমূহ –

সম্মেলনে যে দেশগুলি যোগদান করেছিল, সেগুলো হলো – ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা, ইতালি, পোল্যান্ড, বেলজিয়াম, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, চীন, জাপান, গ্রিস প্রভৃতি।

সম্মেলনের প্রধান নেতৃবৃন্দ –

প্যারিস সম্মেলনে চারজন নেতৃবৃন্দ সম্মেলনের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণকারী ছিলেন –

  • আমেরিকার রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson)
  • ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ (Lloyd George)
  • ফরাসি প্রধানমন্ত্রী জর্জ ক্লেমেনশোঁ (Georges Clemenceau)
  • ইতালির প্রধানমন্ত্রী ভিত্তোরিও অর্ল্যান্ডো (Vittorio Orlando)
  • এদেরকে ‘বিগ ফোর’ (Big Four) নামে অভিহিত করা হয়। সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন ফরাসি প্রধানমন্ত্রী জর্জ ক্লেমেনশোঁ।
প্যারিসের শান্তি সম্মেলন (Paris Peace Conference)

সম্মেলনের উদ্দেশ্য –

প্যারিস সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল —

  • পরাজিত রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বিজয়ী পক্ষের সন্ধির শর্ত নির্ধারণ করা।
  • আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা।

প্যারিস সম্মেলনে রচিত সন্ধিপত্র –

সম্মেলনের আলোচনার পর পাঁচটি প্রধান সন্ধিপত্র রচনা করা হয়েছিল –

  • জার্মানির সঙ্গে ভার্সাই সন্ধি (Treaty of Versailles)
  • অস্ট্রিয়ার সঙ্গে সেন্ট জার্মেইনের সন্ধি (Treaty of St. Germain)
  • বুলগেরিয়ার সঙ্গে নিউলির সন্ধি (Treaty of Neuilly)
  • হাঙ্গেরির সঙ্গে ট্রিয়াননের সন্ধি (Treaty of Trianon)
  • তুরস্কের সঙ্গে সেভরের সন্ধি (Treaty of Sevres)

প্যারিস সম্মেলনে 70 জন রাজনীতিবিদ এবং 1037 জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও আলোচনার জন্য 56টি কমিশন গঠন করা হয়। যদিও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অসুবিধা ছিল, তবু সমবেত রাষ্ট্রনেতারা সফলভাবে সন্ধি চুক্তিগুলি সম্পন্ন করতে সক্ষম হন।

টীকা লেখো – ভার্সাই সন্ধি (Treaty of Versailles, ১৯১৯ খ্রি.।

1918 খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর বিজয়ী মিত্রপক্ষ এবং পরাজিত জার্মানির মধ্যে 1919 খ্রিস্টাব্দের 28 জুন ফ্রান্সের ভার্সাই প্রাসাদে এই সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। ভার্সাই সন্ধির শর্তসমূহ 15 ভাগে বিভক্ত করে 230 পৃষ্ঠার 440টি ধারায় রচনা করা হয় এবং জার্মানির উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।

সন্ধির উদ্দেশ্য –

ভার্সাই সন্ধির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল –

  • জার্মানিকে চিরতরে পঙ্গু করে রাখা।
  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ জার্মানির কাছ থেকে আদায় করা।

ভার্সাই সন্ধির শর্ত –

ভার্সাই সন্ধির শর্তসমূহ প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল –

  • ভূখণ্ড-সম্পর্কিত শর্ত
  • অর্থনৈতিক শর্ত
  • সামরিক শর্ত

ভূখণ্ড-সম্পর্কিত শর্ত –

ভার্সাই সন্ধির ভূখণ্ড-সম্পর্কিত শর্তাবলির মধ্যে ছিল –

  • ফ্রান্সকে আলসাস এবং লোরেন অঞ্চল পুনরায় দিতে হবে।
  • বেলজিয়ামকে ইউপেন, মেলমেডি এবং মরেসনেট প্রদান করতে হবে।
  • লিথুয়ানিয়াকে মেমেল বন্দর দিতে হবে।
  • নবগঠিত স্বাধীন পোল্যান্ডকে পোজেন এবং পশ্চিম প্রাশিয়া অঞ্চল দিতে হবে।
  • পোল্যান্ডকে সমুদ্রপথে প্রবেশের সুবিধার্থে 260×40 মাইলের একটি করিডোর পোল্যান্ডকে দিতে হবে।

অর্থনৈতিক শর্ত –

  • জার্মানিকে 1921 সালের 1 মে-র মধ্যে 100 কোটি পাউন্ডের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, যা পরবর্তীতে 660 কোটি পাউন্ডে বৃদ্ধি করা হয়।
  • জার্মানির খনিজ এবং শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো, যেমন রূঢ় এবং সার, মিত্রপক্ষের অধীনে থাকবে।
  • জার্মানির বাণিজ্যবন্দর এবং যুদ্ধজাহাজগুলো মিত্রপক্ষের হাতে তুলে দিতে হবে।
  • 15 বছরের জন্য সার অঞ্চল ফ্রান্সের অধীনে থাকবে এবং পরে গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কোন রাষ্ট্রের অধীনে থাকবে।
  • জার্মানির বাজার মিত্রপক্ষের শিল্পপণ্যের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।

সামরিক শর্ত –

  • জার্মানির সামরিক ক্ষমতা সীমিত করে কেবলমাত্র অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য 1 লাখ সৈন্য রাখার অনুমতি দেওয়া হয়।
  • বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা বাতিল করতে হবে।
  • জার্মানির অস্ত্রভাণ্ডার এবং সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস করতে হবে।

ভার্সাই সন্ধি ইতিহাসের অন্যতম সমালোচিত ও নিন্দিত সন্ধি। এই সন্ধিকে ‘জবরদস্তিমূলক সন্ধি’ (Dictated Peace) বলা হয়। ঐতিহাসিক ই.এইচ. কার মন্তব্য করেছেন, এই সন্ধি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ বপন করেছিল।

ভার্সাই সন্ধির অর্থনৈতিক শর্তগুলি কী ছিল?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর 1919 খ্রিস্টাব্দের 28 জুন ফ্রান্সের ভার্সাই প্রাসাদের মিরর হলে মিত্রশক্তির সঙ্গে পরাজিত জার্মানির যে সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়, তাকে ‘ভার্সাই সন্ধি’ বলা হয়। এই সন্ধিতে জার্মানিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অপরাধী বলে গণ্য করা হয় এবং জার্মানির উপর বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়।

ভার্সাই সন্ধির অর্থনৈতিক শর্ত –

ভার্সাই সন্ধিতে জার্মানির উপর যেসব কঠোর অর্থনৈতিক শর্ত আরোপ করা হয়েছিল, সেগুলি নিম্নরূপ –

  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানিকে অপরাধী ঘোষণা করে তার উপর £660 কোটি মূল্যের ক্ষতিপূরণ চাপিয়ে দেওয়া হয়।
  • ক্ষতিপূরণ পরিশোধের নীতি নির্ধারণ করার জন্য একটি ক্ষতিপূরণ কমিশন গঠন করা হয়।
  • জার্মানির অধিকাংশ বাণিজ্যবন্দর ফ্রান্সের অধীনে চলে যায় এবং যুদ্ধজাহাজ ব্রিটেনের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
  • ফ্রান্সের কয়লাখনিগুলি ধ্বংস করার অপরাধে জার্মানির কয়লা সমৃদ্ধ সার অঞ্চল 15 বছরের জন্য ফ্রান্সের অধীনে থাকবে। 15 বছর পর গণভোটের মাধ্যমে ঠিক হবে তারা কোন রাষ্ট্রের অধীনে থাকবে।
  • জার্মানির বাজার মিত্রশক্তির শিল্পদ্রব্য বিক্রির জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।
  • জার্মানির বাইরে অবস্থানরত জার্মান নাগরিকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার মিত্রশক্তির হাতে থাকবে।
  • জার্মানি মিত্রশক্তিকে লোহা, কাঠ, কয়লা, রাবার, অন্যান্য খনিজ দ্রব্য, 5000 রেলইঞ্জিন ও 1.5 লক্ষ মোটরগাড়ি সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবে।

ফলাফল –

  • ভার্সাই সন্ধিতে জার্মানির উপর কঠোর অর্থনৈতিক শর্ত আরোপিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক ল্যাংসাম (Langsom) উল্লেখ করেন যে, এই সন্ধির ফলে জার্মানিকে 25,000 বর্গমাইল এলাকা, 65% লৌহ খনি, 40% কয়লা খনি, 15% কৃষিজমি, 12% পশুসম্পত্তি ও 10% বৃহদায়তন শিল্প হারাতে হয়। এর ফলে জার্মানির অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে।
  • ভার্সাই সন্ধি সমস্যার সমাধান করতে না পেরে বরং নতুন সমস্যার জন্ম দিয়েছিল।

ভার্সাই সন্ধির ভৌগোলিক শর্তাবলি আলোচনা করো।

ভার্সাই সন্ধির বহুবিধ শর্তাবলির মধ্যে ভৌগোলিক শর্তাবলির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জার্মানির ভূখণ্ড পুনর্গঠন ও মিত্রশক্তির সুবিধার জন্য তার শক্তি কমিয়ে দেওয়া।

ভৌগোলিক শর্তাবলি –

  • ইউপেন, ম্যালমেডি ও মরেসনেট অঞ্চলগুলো জার্মানিকে বেলজিয়ামের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।
  • আলসাস ও লোরেন প্রদেশ ফ্রান্সকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
  • স্লেজউইগ প্রদেশ ডেনমার্ককে ফিরিয়ে দিতে হবে।
  • মেমেল বন্দর জার্মানিকে লিথুয়ানিয়ার কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
  • পোল্যান্ড নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং জার্মানির পূর্ব সীমান্তের পশ্চিম প্রাশিয়া ও পোজেন অঞ্চল পোল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়।
  • পোলিশ করিডর (Polish Corridor) – পোল্যান্ডের সমুদ্র যোগাযোগের জন্য জার্মানির মধ্য দিয়ে করিডর তৈরি করা হয়।
  • ডানজিগ বন্দরকে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত বন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
  • উত্তর সাইলেশিয়া ও পূর্ব প্রাশিয়া – গণভোটের মাধ্যমে পোল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হলে জার্মানিকে তা মেনে নিতে হয়।
  • চেকোশ্লোভাকিয়া – জার্মানির চেক অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠিত হয়।
  • রাইন অঞ্চল – জার্মানির রাইন অঞ্চলকে বেসামরিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

ফলাফল –

ভার্সাই সন্ধির মাধ্যমে জার্মানির প্রায় 10,27,000 বর্গমাইল এলাকা মিত্রপক্ষের দখলে আসে, যার ফলে জার্মানি তার পূর্বের ভূখণ্ডের একটি বড় অংশ হারায় এবং অনেক ছোট হয়ে যায়।

ভার্সাই চুক্তিকে কেন অপমানজনক এবং জবরদস্তিমূলক চুক্তি বলা হয়?

জার্মান জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরা ভার্সাই চুক্তিকে অপমানজনক ও জবরদস্তিমূলক হিসেবে বিবেচনা করেন। কারণ –

  • 1919 সালের 28 জুন ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে জার্মানিকে মিত্রশক্তির দ্বারা নির্ধারিত শর্তাবলি মেনে নিতে বাধ্য করা হয়।
  • মিত্রশক্তি চুক্তির শর্ত তৈরি করলেও জার্মান প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনো আলোচনার প্রয়োজন মনে করেনি।
  • যারা চুক্তি গ্রহণের জন্য প্যারিসে এসেছিলেন, তাদের সাথে অপরাধীর মতো ব্যবহার করা হয়।
  • জার্মানি আপত্তি জানালেও সামান্য পরিবর্তন করে খসড়া চুক্তি জার্মানির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
  • চুক্তি গ্রহণ না করলে পুনরায় আক্রমণ করা হবে বলে জার্মানিকে ভয় দেখানো হয়।
  • ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ বলেছিলেন, “যদি জার্মানি ভার্সাইতে চুক্তি গ্রহণ না করে, তবে বার্লিনে বসে তা করতে বাধ্য হবে।”
  • জার্মানিকে ইচ্ছামতো বিভক্ত করে দুর্বল করে দেওয়া হয়।
  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী করে জার্মানির ওপর 660 কোটি পাউন্ড ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়।
  • জার্মানির সামরিক শক্তি সংকুচিত করে সৈন্য ও পুলিশ মিলিয়ে মাত্র 1 লাখে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।

এইসব কারণে, জার্মানির কাছে ভার্সাই সন্ধি ছিল এক অপমানজনক ও জবরদস্তিমূলক চুক্তি।

উড্রো উইলসন – এর চোদ্দো দফা নীতি ঘোষণার প্রেক্ষিত বা পটভূমি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

উড্রো উইলসন ছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের 28তম রাষ্ট্রপতি। তিনি সৎ ও আদর্শবাদী নেতা ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি 1918 সালের 8 জানুয়ারি তাঁর বিখ্যাত ‘চোদ্দো দফা নীতি’ ঘোষণা করেন। এই নীতির মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।

উড্রো উইলসনের চোদ্দো দফা নীতি ঘোষণার প্রেক্ষিত –

  • উড্রো উইলসনের সততা – আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন ছিলেন সৎ ও আদর্শবাদী। তিনি বিশ্বাস করতেন যে আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নৈতিক আদর্শের অনুসরণ করা প্রয়োজন।
  • যুদ্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে উইলসনের অভিমত – 1917 সালের 2 এপ্রিল উড্রো উইলসন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে ভাষণ দেন যেখানে তিনি বলেন, “আমাদের যুদ্ধের উদ্দেশ্য কোনো ধরনের স্বার্থ চরিতার্থ করা নয়, বরং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বিশ্বশান্তি রক্ষা এবং মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।” এটি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রপক্ষের যুদ্ধের আদর্শ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রথম সুস্পষ্ট ঘোষণা।
  • লয়েড জর্জের ঘোষণা – ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ 1918 সালের 5 জানুয়ারি এক বক্তৃতায় ঘোষণা করেন যে, মিত্রপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল না জার্মান সাম্রাজ্য, তুর্কি সাম্রাজ্য বা অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য ধ্বংস করা। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
  • উইলসনের চোদ্দো দফা ঘোষণা – লয়েড জর্জের ঘোষণার তিন দিন পর 1918 সালের 8 জানুয়ারি, মার্কিন কংগ্রেসে উড্রো উইলসন তাঁর বিখ্যাত ‘চোদ্দো দফা নীতি’ ঘোষণা করেন যা স্থায়ী বিশ্বশান্তি ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য প্রস্তাবিত হয়।

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় উড্রো উইলসন – এর চোদ্দো দফা নীতি কী ভূমিকা নিয়েছিল?

মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধ থেকে দূরে রেখেছিলেন, কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং ইউরোপের বিপর্যস্ত অবস্থা তাকে শেষপর্যন্ত যুদ্ধে যুক্ত হতে বাধ্য করে। 1918 সালের 8 জানুয়ারি তাঁর ঘোষিত ‘চোদ্দো দফা নীতি’ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন ভিত্তি স্থাপন করে এবং দীর্ঘমেয়াদী শান্তির জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে।

উইলসনের আদর্শ – উড্রো উইলসন মনে করতেন, বিশ্বে অশান্তির প্রধান কারণ ছিল গোপন কূটনীতি, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে পদানত করে রাখা এবং স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র। তাঁর মতে, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যেক জাতির স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের অধিকার প্রয়োজন। তিনি উল্লেখ করেন –

  • পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমস্যা ও বিবাদের সমাধান করতে হবে।
  • প্রত্যেক পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতা এবং সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিতে হবে।
  • প্রত্যেক স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন করতে হবে।
  • বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন তৈরি করতে হবে (পরবর্তীতে যার ফলস্বরূপ জাতিসংঘের জন্ম হয়)।
  • কোনো ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সময় সেখানকার জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করবে।
  • বিশ্বব্যাপী অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণ কমাতে হবে।

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা – উড্রো উইলসনের আদর্শের ভিত্তিতে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপে জাতীয়তাবাদের জাগরণ ঘটে এবং পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া-সহ বিভিন্ন রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে। তাঁর চোদ্দো দফা নীতি আন্তর্জাতিক বিরোধ-মীমাংসা এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়াকে অনুপ্রাণিত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে উইলসনের আদর্শবাদ বিশ্বকে নতুন মূল্যবোধের দিকে পরিচালিত করে এবং দীর্ঘমেয়াদী শান্তির আশা জাগায়।

ট্রিয়াননের সন্ধি (Trianon)-র শর্তাবলি উল্লেখযোগ্য ছিল কেন?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্রশক্তিবর্গের সঙ্গে পরাজিত হাঙ্গেরির ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুন ‘ট্রিয়াননের সন্ধি’ (Treaty of Trianon) স্বাক্ষরিত হয়।

ট্রিয়াননের সন্ধি-র শর্তাবলি – এই সন্ধির শর্তানুযায়ী-

  • অস্ট্রিয়া থেকে হাঙ্গেরিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
  • শ্লোভাকিয়াকে চেক প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
  • রোমানিয়াকে ট্রানসিলভানিয়া ও টেমসভারের অধিকাংশ দেওয়া হয়।
  • যুগোশ্লাভিয়াকে ক্রোয়েশিয়া প্রদান করা হয়।
  • হাঙ্গেরির সামরিক বাহিনী ৩৫ হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।
  • প্রতিবেশী যুগোশ্লাভিয়া ও রোমানিয়া রাষ্ট্রের মধ্যে বানাতকে ভাগ করে দেওয়া হয়।
  • হাঙ্গেরির জনসংখ্যা আট মিলিয়ন (৮০ লক্ষ) এবং আয়তন ৩৫,০০০ বর্গমাইলে সীমিত হয়।

ফলাফল – হাঙ্গেরির সমরাস্ত্র ও সৈন্যসংখ্যা হ্রাস করা হয় এবং নৌবাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস করে তাকে বাধ্য করা হয় মিত্রপক্ষকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে।

নিউলির সন্ধি (Treaty of Neuilly)-র শর্তাবলি আলোচনা করো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্রশক্তিবর্গের সঙ্গে বুলগেরিয়ার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ নভেম্বর ‘নিউলির সন্ধি’ (Treaty of Neuilly) স্বাক্ষরিত হয়।

নিউলির সন্ধি-র শর্তাবলি – এই সন্ধির শর্তানুসারে-

  • ম্যাসিডোনিয়া প্রদেশ যুগোশ্লাভিয়াকে প্রদান করা হয়।
  • রোমানিয়াকে দোবুজা দেওয়া হয়।
  • বুলগেরিয়ার অস্ত্র, নৌবাহিনী হ্রাস করা হয় এবং সৈন্যসংখ্যা ২০ হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়।
  • পশ্চিম থ্রেস ও ইজিয়ান উপকূল গ্রিসকে প্রদান করা হয়।
  • ১৯১২-১৩ খ্রিস্টাব্দে বলকান যুদ্ধের সময় বুলগেরিয়া যেসব স্থান দখল করেছিল সেগুলি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
  • বুলগেরিয়াকে ক্ষতিপূরণ দানে বাধ্য করা হয়।

ফলাফল – এই চুক্তির দ্বারা বুলগেরিয়াকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ইত্যাদি প্রায় সকল দিক থেকেই বলকানের এক দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়।

সেভরের সন্ধি (Treaty of Sevres) কেন গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

মিত্রপক্ষের সঙ্গে পরাজিত তুরস্কের ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট ‘সেভরের সন্ধি’ (Treaty of Sevres) স্বাক্ষরিত হয়।

সেভরের সন্ধি-র শর্তাবলি – এই সন্ধির শর্তগুলি ছিল-

  • মিশর, সুদান, সাইপ্রাস, মরক্কো, টিউনিস ইত্যাদি স্থানের উপর তুরস্ক অধিকার ত্যাগ করে।
  • বসফরাস ও দার্দেনালিস প্রণালী দুটি আন্তর্জাতিক জলপথ হিসেবে ঘোষিত হয়।
  • আরব, প্যালেস্টাইন, মেসোপটেমিয়া ও সিরিয়ার উপর তুরস্কের অধিকার বিলুপ্ত হয়।
  • সিরিয়া ফ্রান্সকে এবং প্যালেস্টাইন ও মেসোপটেমিয়া ব্রিটেনকে দেওয়া হয়।
  • কনস্ট্যান্টিনোপল, আলেকজান্দ্রিয়া প্রভৃতি বন্দরগুলিকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
  • তুরস্ক সাম্রাজ্য কনস্ট্যান্টিনোপল ও এশিয়া মাইনরের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
  • তুরস্কের সৈন্যসংখ্যা ৫০ হাজারে সীমাবদ্ধ করা হয়।
  • খ্রিস্টান প্রজাতন্ত্র হিসেবে আর্মেনিয়া সৃষ্টি করা হয়। এই নবগঠিত রাষ্ট্রকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়।
  • গ্যালিসিয়ায় ফরাসি প্রভাব স্বীকৃতি লাভ করে।
  • দক্ষিণ আনাতোলিয়ায় ইটালির প্রভাব স্বীকৃতি পায়।’
  • আদ্রিয়ানোপল, গ্যালিপলি, অ্যামব্রোস, টেনেডস ও স্মার্নাদ্বীপ এবং এশিয়া মাইনরের উপকূলীয় অঞ্চল গ্রিসকে সমর্পণ করতে হয়। এ ছাড়া গ্রিস ডোডিকানিজ দ্বীপপুঞ্জ লাভ করে।
  • তুরস্ককে বিশাল পরিমাণ যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।

ফলাফল – এই সন্ধির ফলে বিশাল তুরস্ক সাম্রাজ্যকে বিভক্ত করা হয়। ফলে ইউরোপের সামান্য অংশ ও আনাতোলিয়ার পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যে তুরস্ক সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

প্রতিক্রিয়া – মুস্তাফা কামাল পাশা নামে এক জাতীয়তাবাদী নেতা এই সন্ধির বিরোধিতা করেন। মিত্রপক্ষ সৈন্য পাঠালে কামাল পাশা তাদের পরাজিত করেন। ফলে মিত্রপক্ষ সেভরের সন্ধির শর্ত বদল করে ল্যসেন-এর সন্ধি স্বাক্ষর করে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে।

টীকা লেখো – জাতিসংঘ (League of Nations) প্রতিষ্ঠার পটভূমি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ‘জাতিসংঘ’ (League of Nations) নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পটভূমি –

  • স্থায়ী শান্তি স্থাপনের আন্দোলন – ভবিষ্যৎ যুদ্ধের সম্ভাবনা চিরতরে দূর করার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি এতে অংশগ্রহণ করেন ও আন্দোলন পরিচালনার জন্য বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে আমেরিকার League of Nations Society ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
  • উইলসনের ‘চোদ্দো দফা নীতি’ – মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন তাঁর বিখ্যাত ‘চোদ্দো দফা নীতির’ মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের শান্তিকামী মনোভাব ও প্রচেষ্টাকে সর্বোৎকৃষ্টভাবে রূপদান করেন। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিরোধকে শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা করে বিশ্বশান্তি অব্যাহত রাখার কথা ঘোষণা করেন। ইংল্যান্ড ও অন্যান্য কয়েকটি রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ মার্কিন রাষ্ট্রপতির এই ঘোষণাকে সমর্থন করেন।
  • প্রস্তাব গ্রহণ – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর প্যারিস শান্তি সম্মেলনে উইলসন কর্তৃক উত্থাপিত ‘লিগ অফ নেশনস’-এর প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। জাতিসংঘ গঠনের প্রস্তাবটি ভার্সাই সন্ধির শর্তের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
  • লিগ কভেনান্ট – জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা ও তার নিয়মাবলি রচনার উদ্দেশ্যে প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে উইলসনের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি ‘লিগ কভেনান্ট’ বা ‘লিগের চুক্তিপত্র’ নামে জাতিসংঘের একটি খসড়া সংবিধান রচনা করে।

জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা – ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি জাতিসংঘের প্রথম অধিবেশন বসে।

জাতিসংঘের (Leauge of Nations) ব্যর্থতার কারণগুলি উল্লেখ করো। অথবা, জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণগুলি সংক্ষেপে লেখো।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ঘোষিত (৮ জানুয়ারি, ১৯১৮ খ্রি.) ‘চোদ্দো দফা শর্ত’-র শেষ দফা শর্তানুসারে জাতিসংঘ (League of Nations) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জাতিসংঘ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফল হলেও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও যুদ্ধ নিবারণে ব্যর্থ হয়েছিল।

ব্যর্থতার কারণ – জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণগুলি হল-

  • আমেরিকা-সহ অনেক রাষ্ট্রের অনুপস্থিতি – বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকা জাতিসংঘের সদস্যপদ গ্রহণ করেনি। তা ছাড়া জার্মানি, ইটালি, ল্যাটিন আমেরিকার অনেক রাষ্ট্র জাতিসংঘ ত্যাগ করেছিল এবং রাশিয়া বহিষ্কৃত হয়েছিল।
  • সাংবিধানিক ত্রুটি – জাতিসংঘ শক্তিধর ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির দ্বারা পরিচালিত হত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী রাষ্ট্রগুলি জাতিসংঘকে নিজেদের স্বার্থরক্ষায় ব্যবহার করছিল বলে পরাজিত রাষ্ট্রগুলি জাতিসংঘের বিরোধিতা করেছিল। এ ছাড়া আক্রমণকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আর্থিক অবরোধ ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
  • নিজস্ব সামরিক বাহিনীর অভাব – নিজস্ব সামরিক বাহিনী ছিল না বলে জাতিসংঘ প্রয়োজনে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে পারেনি।
  • তোষণনীতি – ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জাতিসংঘকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। জাতিসংঘ দুর্বল সংস্থা ছিল বলে শক্তিশালী দেশগুলির অন্যায় কাজের বিরোধিতা করতে পারেনি। ফ্রান্স জার্মানির রূঢ় শিল্পাঞ্চলে এবং জাপান চিনের মাঞ্জুরিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালায়। জার্মানি রাইন অঞ্চলে সেনা অভিযান চালায় (১৯৩৬ খ্রি.) এবং অস্ট্রিয়া দখল করে (১৯৩৮ খ্রি.)। এ ছাড়া ইটালি ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে আবিসিনিয়া দখল করে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে জাতিসংঘ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে বা তোষণনীতি অনুসরণ করে।
  • নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের ব্যর্থতা – জাতিসংঘের উদ্যোগে জেনিভা শহরে নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (১৯৩২-৩৩ খ্রি.)। এই সম্মেলনে ইটালি ও জার্মানির অস্ত্র মজুতের পরিমাণের প্রশ্নে মতভেদ দেখা দেয়। ফলে হিটলারের নির্দেশে জার্মান প্রতিনিধি সম্মেলন ত্যাগ করেন এবং নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন ব্যর্থ হয়।

ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক স্বার্থসংঘাত, নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের ব্যর্থতা, জার্মানি ও ইটালির সদস্যপদ ত্যাগ এবং সর্বোপরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা জাতিসংঘের পতনকে সম্পূর্ণ করেছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় দেশগুলি কী কী অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় দেশগুলি নানান অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে জার্মানি, ইটালি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, রাশিয়া প্রভৃতি দেশগুলি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

ইউরোপীয় দেশগুলির অর্থনৈতিক সমস্যা – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দার ফলে ইউরোপীয় দেশগুলি ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়।

  • মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি – প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশগুলির প্রচুর ব্যয় হওয়ায় তাদের জাতীয় ঋণের পরিমাণ বিপুল হারে বেড়ে যায়। এই কারণে তাদের মুদ্রা ছাপাতে হয়, ফলে স্বাভাবিকভাবে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। এই অবস্থায় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেলে সাধারণ মানুষ দুর্দশার সম্মুখীন হন।
  • বেকার সমস্যা বৃদ্ধি – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য যে বাড়তি সৈন্য নেওয়া হয়েছিল যুদ্ধশেষে তারা বেকার হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনের কারখানা এবং অন্যান্য কারখানা থেকে প্রচুর শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছিল।
  • কৃষি ও শিল্পের ক্ষতি – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। কৃষির সঙ্গে যুক্ত শিল্পেও সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। তা ছাড়া সরকার বেশি পরিমাণে কর আদায় করে আর্থিক সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করলে কৃষক ও শিল্পমালিকদের সমস্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল।
  • ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষতি – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধ উপকরণের প্রচুর চাহিদা ছিল। তাই সহায়ক শিল্প ও বাণিজ্যের তেজিভাব দেখা দিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলে অবস্থা বদলে যায়। চাহিদা না থাকায় ব্যাবসাবাণিজ্যে মন্দা দেখা দেয়। এর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহামন্দার প্রভাব ইউরোপীয় দেশগুলির উপর পড়ে। ফলে ইউরোপের আর্থিক জীবনে অচলাবস্থা দেখা দেয়।
  • খাদ্যসংকট – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল এবং তীব্র খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়েছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। উরোপ যেহেতু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, তাই এই মহাদেশেই এর প্রভাব ছিল সর্বাধিক। এই ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে অনেক সময় লাগে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার সংকট প্রকটিত হয় এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক তেজিভাবের কারণ কী ছিল?

১৯২০-র দশক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমৃদ্ধির দশক হিসেবে পরিচিত। এই সময় (১৯২১-২০ খ্রি.) রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট হার্ডিং, কূলিজ ও হুভার-এর দৃঢ় অর্থনৈতিক নীতির ফলে শিল্প-বাণিজ্যে জোয়ার আসে। জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি পায় এবং জীবনযাপনের মানোন্নয়ন ঘটে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতির কারণ –

  • সরকারি নীতি – রিপাবলিকান যুগে শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহ দেওয়া হয়। শিল্প সংরক্ষণ আইন পাস করা হয়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে শুল্ক আইন পাস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা পণ্যদ্রব্যের উপর চড়া আমদানি শুল্ক আরোপের ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতার নীতি গৃহীত হওয়ায় বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানগুলি সরকারি সাহায্য লাভ করে। সরকার আয়কর ও কোম্পানি কর কমিয়ে দেয়। ফলে সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
  • বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কার – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আমেরিকায় নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত আবিষ্কার ঘটে। এর ফলে কলকারখানায় ব্যাপকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ফলে আমেরিকা বিশ্বের প্রধান উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়।
  • কাজের বাজার – রিপাবলিকান যুগে সরকারি নীতির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিল্প-বাণিজ্যে প্রচুর বিনিয়োগ হয়। প্রচুর কলকারখানা গড়ে ওঠে। প্রচুর উৎপাদনের ফলে রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। ফলে কাজের বাজার সম্প্রসারিত হয়। জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায় ৩১% এবং শ্রমিকের মজুরি বাড়ে ২৬%। বেকারত্বের অবসান ঘটে।
  • পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি – ১৯২০-র দশকে আমেরিকায় যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতি ঘটে। নতুন রাস্তা ও রেলপথ নির্মাণের ফলে পণ্য পরিবহণ সহজ হয় এবং শিল্পদ্রব্য সহজে মানুষের নাগালের মধ্যে চলে আসে।
  • ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি – এই সময় আমেরিকায় বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য যেমন- মোটরগাড়ি, টেলিফোন, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন প্রভৃতির উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। জনগণের মধ্যে ভোগ্যপণ্যের ব্যবহারের ফলে শিল্পেরও প্রসার ঘটে।
  • বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি – এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়। বিদ্যুতের জোগানের প্রাচুর্য শিল্প উৎপাদনের সহায়ক হয়।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কেন বিশ্ব অর্থনীতি মহামন্দার (The Great Depression) কবলে পড়ে?

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র-সহ ইউরোপীয় দেশগুলিতে যে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছিল, তাকে ঐতিহাসিক ও অর্থনীতিবিদরা ‘মহামন্দা’ বা Great Depression বলে উল্লেখ করেছেন।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে মহামন্দার কারণ – বিশ্বব্যাপী মহামন্দার পিছনে প্রধান কারণগুলি ছিল —

  • কৃষিসংকট – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কৃষিজ পণ্যের চাহিদা থাকায় কৃষকরা প্রচুর ঋণ নিয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু যুদ্ধের শেষে কৃষিজ পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেলে কৃষকরা চরম আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়।
  • মার্কিন বাণিজ্যে সংকোচন – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মার্কিন ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে আমেরিকার উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষে ইউরোপে মার্কিন পণ্যের রপ্তানি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়।
  • ঋণ বৃদ্ধি  – সমৃদ্ধির সময় থেকে আমেরিকানদের মধ্যে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
  • শেয়ার বাজারে ধস – বিংশ শতকের দুইয়ের দশকে আমেরিকাবাসীরা শেয়ার বাজারের প্রত্যাশিত সমৃদ্ধির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে শেয়ার বাজারে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে। প্রথমদিকে শেয়ারের দাম বাড়লেও অচিরেই শেয়ারের দাম কমতে থাকে। এর ফলে আমেরিকার অর্থনীতিতে মন্দা নেমে আসে।
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কেন বিশ্ব অর্থনীতি মহামন্দার (The Great Depression) কবলে পড়ে

উপরোক্ত কারণগুলি ছাড়াও আরও অনেক কারণ ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের বিশ্বব্যাপী মহামন্দার জন্য দায়ী ছিল।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের মহামন্দার সমকালীন ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর কী প্রভাব পড়েছিল?

অর্থনীতির ভাষায় দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ধীরগতি বা বাণিজ্যের সংকোচনকে মন্দা (Depression) বলা হয়। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপ ও আমেরিকা-সহ সারা বিশ্বে যে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, তাকে ‘১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের মহামন্দা’ (The Great Depression of 1929 ) বলা হয়।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহামন্দার প্রভাব –

  • শেয়ার ক্রেতাদের বিপর্যয় – ইউরোপ ও আমেরিকার লক্ষ লক্ষ মানুষ শেয়ার কিনে অর্থ বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু শেয়ার বাজারে ধস নামায় তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, অনেকে সর্বস্বান্তও হয়ে পড়েছিল।
  • ব্যাংক ব্যবস্থায় বিপর্যয় – ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক ব্যাংকই শেয়ার বাজারে অর্থলগ্নি করেছিল। শেয়ার বাজারের বিপর্যয়ের ফলে তাদের লগ্নি করা অর্থ  হাতছাড়া হয়ে যায়। তা ছাড়া ব্যাংকগুলি সাধারণ মানুষকে যে ঋণ দিয়েছিল সেগুলিও আমার ফেরত পায়নি। এর ফলে শুধু আমেরিকাতেই ৫৭০টি নর হে ব্যাংক বন্ধ হয় ও ৩৫০০টি ব্যাংক তাদের লেনদেন বন্ধ করে দেয়।
  • শিল্প উৎপাদনে বিপর্যয় – ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের আর্থিক মন্দার ফলে শিল্পে উৎপাদন হ্রাস পায়। ফলে শিল্পমালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দেয়।
  • বেকার সমস্যা বৃদ্ধি – ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের মহামন্দার প্রভাবে ইউরোপ ও আমেরিকায় বেকার সমস্যা বহুগুণ বেড়ে যায়। শুধু আমেরিকায় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে বেকারের সংখ্যা ছিল ১০ লক্ষ। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তা বেড়ে হয়েছিল দেড় কোটি। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের অর্থনৈতিক মহামন্দার প্রভাব শুধু ইউরোপ আমেরিকা নয়, সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছিল। এর পরিণতিতে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়।
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের মহামন্দার সমকালীন ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর কী প্রভাব পড়েছিল

লেনিনের নতুন অর্থনৈতিক নীতি (New Economic Policy) বা সংক্ষেপে NEP সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো।

লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সাম্যবাদী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও কিছুদিনের মধ্যে রুশ জনগণ সোভিয়েত সরকারের বিরোধিতা করতে শুরু করে। দেশে খাদ্যসংকট দেখা দেয়। উৎপাদন হ্রাস পায়, জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে। এমনকি কৃষক বিদ্রোহ, নৌবিদ্রোহ ও শিল্পসংকটও পরিলক্ষিত হয়। এই অবস্থায় লেনিন ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে দশম পার্টি কংগ্রেসে ‘নতুন অর্থনৈতিক নীতি’ (NEP) ঘোষণা করেন।

লেনিনের নতুন অর্থনৈতিক নীতি (New Economic Policy) বা NEP-র গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ

কৃষিক্ষেত্রে –

  • আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষির উৎপাদনে জোর দেওয়া হয়।
  • কৃষকদের উদ্‌বৃত্ত শস্য বাজারে বিক্রি করার অধিকার দেওয়া হয়।
  • কৃষি ব্যাংক তৈরি করে কৃষকদের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

শিল্পক্ষেত্রে –

  • যেসব শিল্পকারখানায় ২০ জনের কম শ্রমিক কাজ করে তাদের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
  • শ্রমিকদের দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুসারে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
  • [শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিদেশি মূলধনকে স্বাগত জানানো হয়েছিল।

ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে –

  • ব্যাংক ব্যবস্থা, বৈদেশিক বাণিজ্য, পরিবহণ ব্যবস্থা, বৃহৎ শিল্প সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
  • দেশে ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ উঠে গিয়েছিল।
  • সরকারি বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে মূল্যবৃদ্ধি রদ করা হয়।

NEP-র প্রকৃতি – অনেক ঐতিহাসিক বলেন, লেনিনের নতুন অর্থনৈতিক নীতি ছিল সাম্যবাদ থেকে বিচ্যুত হয়ে ধনতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের প্রথম ধাপ। আবার অনেকে বলেন, লেনিনের নতুন অর্থনীতি ছিল প্রয়োজনভিত্তিক মিশ্র অর্থনীতি। আসলে লেনিন পুঁথিগত কমিউনিজম থেকে বাস্তব প্রয়োজনকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে NEP গ্রহণ করেছিলেন।

হুভার স্থগিতকরণ বা হুভার মোরাটোরিয়াম (Hoover Moratorium)- টীকা লেখো।

হারবার্ট ক্লার্ক হুভার (Herbert Clark Hoover) ছিলেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি (১৯২৯-১৯৩৩ খ্রি.)। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন তিনি ঘোষণা করেন যে, ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই থেকে এক বছরের জন্য বিভিন্ন দেশ পরস্পরের ঋণশোধ করা স্থগিত রাখবে। এই ঘোষণা হুভার স্থগিতকরণ’ বা হুভার মোরাটোরিয়াম’ (Hoover Moratorium) নামে পরিচিত।

হুভার স্থগিতকরণ বা হুভার মোরাটোরিয়াম (Hoover Moratorium)-টীকা লেখো।

হুভার মোরাটোরিয়ামের পটভূমি –

  • ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ভার্সাই সন্ধিতে মিত্রপক্ষ জার্মানির উপর বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেয়। জার্মানি যাতে মিত্রশক্তির ক্ষতিপূরণের অর্থ দিতে পারে সেজন্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র জার্মানিকে ডয়েজ (Dawes) ও ইয়ং (Young) পরিকল্পনা অনুসারে ঋণ দিত। জার্মানি সেই অর্থ দিয়ে মিত্রশক্তির পাওনা মেটাত। আবার মিত্রশক্তিভুক্ত দেশগুলি সেই অর্থ দিয়ে যুদ্ধকালে আমেরিকার কাছে নেওয়া ঋণের টাকা শোধ করত।
  • ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের অর্থনৈতিক মহামন্দা সৃষ্টি হলে আমেরিকার পক্ষে জার্মানিকে ঋণ দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। এদিকে জার্মানিও আমেরিকার সাহায্য না পাওয়ার জন্য মিত্রশক্তির ক্ষতিপূরণের অর্থ দিতে পারছিল না। এর ফলে আন্তর্জাতিকক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়।
  • এই সংকট মোচনের জন্য আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হুভার (Hoover) তাঁর ঋণশোধ স্থগিতকরণের নীতি ঘোষণা করেন।
  • হুভার মোরাটোরিয়ামের ফলে আমেরিকা আর্থিক দিক থেকে লাভবান হয়নি। ১৯৩৩-এর নির্বাচনে হুভারের রিপাবলিকান দল পরাজিত হয় এবং ডেমোক্র্যাটিক দলের ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট (Franklin Roosevelt) রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট মনরো এক ঘোষণার দ্বারা ইউরোপীয় শক্তিগুলিকে আমেরিকায় হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত করেন (১৮২১ খ্রি.)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত (১৮২১-১৯১৭ খ্রি.) এই বিচ্ছিন্নতা বজায় থাকে। পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ইউরোপের রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র –

  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধে – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে (১৯১৪-১৮ খ্রি.) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিত্রপক্ষে (ব্রিটেন, ফ্রান্স) যোগদান করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ, অস্ত্র ও ঋণলাভ করে মিত্রপক্ষ নানাভাবে উপকৃত হয়। মিত্রপক্ষের শক্তিবৃদ্ধির ফলে জার্মানির পতন ত্বরান্বিত হয়। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ২ এপ্রিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উদ্দেশ্য হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন ঘোষণা করেন যে, ‘গণতন্ত্রের জন্য বিশ্বের নিরাপত্তা বিধান করা এবং মানবাধিকার রক্ষা করা আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।’ এটিই ছিল মিত্রপক্ষের যুদ্ধের আদর্শ সম্পর্কে প্রথম ঘোষণা ৷
  • জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠায় – উড্রো উইলসন ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ জানুয়ারি বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর বিখ্যাত ‘চোদ্দো দফা নীতি’ ঘোষণা করেন। এই চোদ্দো দফা-র সর্বশেষ দফায় জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। তাঁর আদর্শের ভিত্তিতেই জাতিসংঘ (League of Nations) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ এপ্রিল।
  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে মিত্রপক্ষ ভার্সাই সন্ধিতে জার্মানির উপর কঠোর অর্থনৈতিক শর্ত আরোপ করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানিকে ঋণ দিয়ে ইউরোপীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভারসাম্য বজায় রেখেছিল।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠায় – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলিকে সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠাতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

পরিশেষে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ইটালিতে মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট দলের উত্থানের কারণ কী ছিল?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে যেসব দেশে একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল এবং যারা ইউরোপ ও বিশ্বের ইতিহাসে আলোড়ন তুলেছিল সেই দেশগুলির অন্যতম ছিল ইটালি। ইটালিতে বেনিটো মুসোলিনি (Benito Mussolini) – র নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল।

ইটালিতে মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট দলের উত্থানের কারণ কী ছিল

মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট দলের উদ্ভবের কারণ

মুসোলিনির নেতৃত্বে ইটালিতে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রের উদ্ভবের কারণগুলি হল —

  1. ভার্সাই সন্ধির অতৃপ্তি – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ইটালি ত্রিশক্তি মৈত্রীতে আবদ্ধ হলেও প্রকৃতপক্ষে বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় ইটালি যোগদান করেছিল ইংল্যান্ড জারিয়া ও ফ্রান্সের পক্ষে। অর্থাৎ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইটালি ছিল বিজয়ী পক্ষ। কিন্তু ভার্সাই সন্ধিতে ইটালি তার প্রত্যাশামতো ফিউম বন্দর, আলবেনিয়া প্রভৃতি লাভে ব্যর্থ হয়ে মিত্রশক্তির উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিল।
  2. অর্থনৈতিক বিপর্যয় – প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রভূত অর্থ ও জীবনহানি ঘটায় ইটালি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। একদিকে মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটেছিল, অপরদিকে কৃষি ও শিল্পে বিপর্যয় হওয়ার দরুন তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল।
  3. গণতান্ত্রিক সরকারের ব্যর্থতা – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নির্বাচনের মাধ্যমে ইটালিতে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকার সমস্যা, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইটালির মর্যাদা হ্রাস, শিল্পের অবক্ষয় প্রভৃতি কারণে ইটালিবাসীর মনে গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল।
  4. রুশ সাম্যবাদের প্রভাব – এই সময় রাশিয়ায় সাম্যবাদী বলশেভিক সরকারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইটালির কৃষক ও শ্রমিকরা সাম্যবাদী সরকার গঠনে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠেছিল। এমতাবস্থায় ইটালির গণতান্ত্রিক সরকার তাদের দমন করতে অপারগ ছিল। ইটালির ভূস্বামী ও শিল্পপতিরাও দুর্বল সরকারের পরিবর্তে শক্তিশালী সরকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছিল।
  5. প্রচার – মুসোলিনি ও তাঁর ফ্যাসিস্ট দলের প্রচার ইটালিবাসীকে মোহিত করে। মুসোলিনি প্রাচীন রোমের গৌরব পুনরুদ্ধার এবং ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। ফলে মুসোলিনি ও ফ্যাসিস্ট দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

এই পরিস্থিতিতে ইটালিতে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট দলের নেতৃত্বে একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল।

ফ্যাসিবাদের (Fascism) মূল নীতিগুলি বা বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।

ফ্যাসিবাদ (Fascism) হল ইটালিতে বেনিটো মুসোলিনি-র নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট দল পরিচালিত এক বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ‘ফ্যাসিবাদ হল উগ্র জাতীয়তাবাদী ও আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত একদলীয় একনায়কতন্ত্রী শাসনব্যবস্থা এবং একটি সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী মতবাদ।’

ফ্যাসিবাদের মূল নীতি বা বৈশিষ্ট্য –

  • সর্বশক্তিমান ও সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা – ফ্যাসিবাদের মূলনীতি হল রাষ্ট্রের চূড়ান্ত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে জনগণের উপর রাষ্ট্রের অধিকার সর্বাধিক। ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয়— রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি – এই নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • একদলীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা – ফ্যাসিবাদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল একদলীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে যে – কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্ব লুপ্ত করার জন্য গ্রেফতার, হত্যা এবং সন্ত্রাস সৃষ্টির পথ অনুসরণ করা হয়।
  • ব্যক্তিস্বাধীনতার উপেক্ষা – ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয়। এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কাছে জনগণের আত্মসমর্পণ বাধ্যতামূলক। ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য বলিপ্রদত্ত।
  • উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদে সমর্থন – ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র জল প্রকৃতিগতভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী। তাদের মতে, সাম্রাজ্যবিস্তার জাতির ‘পবিত্র কর্তব্য’ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ‘কাপুরুষের স্বপ্ন’।
  • কর্পোরেট রাষ্ট্র – ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য সার্বিক চেষ্টা করে। খাদ্যসংকট, নৈরাজ্য ও বেকার সমস্যার সমাধান, শিল্পের জাতীয়করণ, শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজ ও বিভিন্ন সুযোগসুবিধা জার্মা প্রদান, বাণিজ্যের উন্নতি, পথ ও পরিবহনের উন্নতি, জনমানসে রাষ্ট্রের জৌলুস বৃদ্ধি করে। কিন্তু ক্ষমতা থাকে একনায়কের হাতে। এখানে খ্রিষ্টধর্ম প্রধান হলেও চার্চের কর্তৃত্ব হ্রাস পায়। চার্চের সম্পত্তির জাতীয়করণ করা হয়।

ফ্যাসেস বা ফ্যাসিও শব্দ থেকে ফ্যাসিস্ট কথাটি এসেছে। এর অর্থ দণ্ডের আটি বা শলাকাগুচ্ছ। প্রাচীন রোমের কনসালরা এই রকম শলাকাগুচ্ছ বহন করতেন। এই প্রতীকের অর্থ হল — একতাই শক্তি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ইটালি ও জার্মানির ফ্যাসিবাদী মতবাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচনা করেছিল।

ভাইমার প্রজাতন্ত্র (Weimar Republic ) – টীকা লেখো।

ভাইমার প্রজাতন্ত্র (Weimar Republic) – প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় এবং জার্মানির সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ম হল্যান্ডে পালিয়ে যান। ফলে জার্মানিতে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং সমাজতান্ত্রিক নেতা ফ্রেডরিখ ইবার্টের (Friedrich Ebert) নেতৃত্বে প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। জার্মানির ভাইমার শহরে এই প্রজাতান্ত্রিক সরকারের প্রথম অধিবেশন বসেছিল বলে, একে ভাইমার প্রজাতন্ত্র’ (Weimar Republic) বলা হয়। এই সরকারের চ্যান্সেলার নিযুক্ত হন ইবার্ট। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে গণতান্ত্রিক জাতীয় পরিষদ (National Assembly) নির্বাচিত হয়। এই পরিষদ সুইজারল্যান্ডের অনুকরণে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করে।

কার্যকলাপ – এই সরকারের প্রথম কাজ ছিল মিত্রশক্তির সঙ্গে সন্ধির শর্ত নিয়ে আলোচনা করা। ভার্সাই সন্ধির বিভিন্ন সংশোধনী দাবি করে ব্যর্থ হলে এই সরকার বাধ্য হয়ে ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষর করে ( ২৮ জুন, ১৯১৯ খ্রি.)। এই সন্ধির বিরুদ্ধে জার্মানিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও নতুন সরকার শর্তপালনে সচেষ্ট হয়। এ ছাড়া অর্থনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলায়ও এই সরকার তৎপর হয়।

ভাইমার প্রজাতন্ত্রের ব্যর্থতা – জন্মলগ্ন থেকেই ভাইমার প্রজাতন্ত্র নানান জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। বিভিন্ন সমস্যা জর্জরিত জার্মানিতে ভাইমার প্রজাতন্ত্রের কার্যাবলিকে ঐতিহাসিকগণ ‘আগ্নেয়গিরির উপর নৃত্য’ (The Dance on Volcano) বলে বর্ণনা করেছেন।

প্রথমত – প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জার্মানিকে অপমানজনক ভার্সাই সন্ধি মেনে নিতে হয়।

দ্বিতীয়ত – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্যাভাব, বেকারত্ব প্রভৃতি ভাইমার প্রজাতন্ত্রের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব হয়নি।

পরিশেষে ভাইমার প্রজাতন্ত্রের প্রতি হতাশ জনগণ হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি দলের উত্থান ঘটায়।

জার্মানিতে হিটলারের উত্থানে ভার্সাই সন্ধির ভূমিকা সংক্ষেপে লেখো।

অতি সাধারণভাবে জীবন শুরু করে হিটলার যেভাবে জার্মানির সর্বোচ্চ শাসকে পরিণত হয়েছিলেন তা চমকপ্রদ হলেও অস্বাভাবিক ছিল না। জার্মানিতে হিটলারের সাফল্যের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন মত পোষণ করেন। ঐতিহাসিক বুমন্ট (Beaumont), ব্যারাক্ল (Barraclough), ই এইচ কার (EH Carr) প্রমুখ মনে করেন, হিটলারের উত্থানের পিছনে ভার্সাই সন্ধির ভূমিকা ছিল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য।

ভার্সাই সন্ধির ভূমিকা – উপরোক্ত তিনজন ঐতিহাসিকের মতে, জার্মানির উপর আরোপিত অপমানজনক ভার্সাই সন্ধি হিটলারের উত্থানের পথ মসৃণ করেছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় এবং ভার্সাই সন্ধির গ্লানি জার্মান জাতিকে গভীরভাবে আহত করেছিল। তারা এই জাতীয় অপমানের অবসানের অপেক্ষায় ছিল। এমতাবস্থায় হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি দল ভার্সাই সন্ধির বিরোধিতা করে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।

ভার্সাই সন্ধির সামরিক বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করে হিটলার জার্মানিতে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা চালু করেন। এইভাবে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি, কামান, ডুবোজাহাজ প্রভৃতি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সমন্বয়ে জার্মানবাহিনীকে তিনি শক্তিশালী করে তোলেন।

এইভাবে যুদ্ধ এবং অপমানে বিধ্বস্ত এবং হতাশ জার্মানিবাসী নাৎসি দল ও হিটলারকে ভিত্তি করে বিশ্বে তাদের লুপ্ত মর্যাদা পুনরুদ্ধারে আশাবাদী হয়ে ওঠে। জার্মানিবাসীর এই আশাই হিটলারকে জার্মানির ফ্যুয়েরার’ (Führer) বা সর্বেসর্বায় পরিণত করেছিল।

ভার্সাই চুক্তির দ্বারা জার্মানির শিল্পসমৃদ্ধ সার উপত্যকা ফ্রান্সকে দেওয়া হয় এবং ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে গণভোটের দ্বারা এই স্থানের ভাগ্য নির্ধারণ হবে বলে ঠিক করা হয়। কিন্তু নির্বাচনের আগেই হিটলার এই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ এবং ভোটদাতাদের ভয় দেখানো শুরু করেন। ফলে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে গণভোটের দ্বারা হিটলার এই অঞ্চল জার্মানির অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হন।

এইভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানির হতাশাগ্রস্ত জনগণের কাছে হিটলার ও তাঁর নাৎসি দল জার্মানির হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধারের আশা জাগিয়েছিল।

জার্মানিতে নাৎসি দল (Nazi Party)-এর উদ্ভবের পটভূমি বা কারণ লেখো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হয়। কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ম দেশত্যাগ করলে জার্মানি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এই সময়ে জার্মানিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে, যেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল নাৎসি দল।

নাৎসি দল প্রতিষ্ঠা – ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে অ্যান্টন ড্রেক্সলার ‘জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই দলের সদস্যসংখ্যা যখন মাত্র ২৩ জন তখন অ্যাডলফ হিটলার এর সদস্য হন। কিছুকাল পর হিটলারের দক্ষতায় দলের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে তিনি দলের নতুন নামকরণ করেন ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি’।

নাৎসি দলের উদ্ভবের কারণ – এই দলের উদ্ভবের জন্য নানা কারণ বিদ্যমান ছিল-

  • সাম্যবাদ বিরোধিতা – রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের প্রভাব জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্পার্টাকাস নামে একটি কমিউনিস্ট দল গড়ে ওঠে। শ্রমিক ধর্মঘট সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। রোজা লুক্সেমবার্গ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন। এই অবস্থায় নাৎসি দল কমিউনিস্ট বিরোধিতা করে, ফলে শিল্পপতিরা এই দলকে সমর্থন জানায়।
  • ইহুদি বিরোধিতা – জার্মানির অর্থনীতিতে ইহুদিদের প্রভাব ছিল। বড়ো বড়ো সরকারি পদে ইহুদিরা নিযুক্ত ছিল। নাৎসি দল আর্যায়ন-এর নামে ইহুদি বিরোধিতা শুরু করলে সাধারণ জার্মানরা তা সমর্থন করে।
  • বিশিষ্টদের সমর্থন – জার্মানির বিখ্যাত সেনাপতি লুডেনডর্ফ, জাংকার গোষ্ঠী এবং বেকার সৈনিক ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এই দলকে সমর্থন জানায়।
  • নাৎসি দলের কর্মসূচি – ভার্সাই সন্ধি বাতিল, হারানো উপনিবেশ উদ্ধার, সমস্ত জার্মানভাষীদের সমন্বয়ে জার্মান রাষ্ট্রগঠন, সাম্যবাদের অবসান ইত্যাদি নাৎসি কর্মসূচি বিধ্বস্ত জার্মান জাতির মনে আশার সঞ্চার করে। ফলে দলে দলে শিক্ষিত যুবক এই দলে যোগদান করে।
  • জনমত গঠন – হিটলার বিভিন্ন জনসভায় প্রজাতান্ত্রিক সরকারের জাতীয়তাবাদবিরোধী কার্যকলাপ প্রচার করে জনমত গঠন করেন।
  • হিটলারের প্রভাব – জার্মানিতে নাৎসি দলের উদ্ভবে হিটলারের সাংগঠনিক শক্তি, নেতৃত্ব ও বাগ্মিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। ‘মেইন ক্যাম্প’ (Mein Kampf) গ্রন্থে তিনি নাৎসি দলের উদ্দেশ্য, আদর্শ ও জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্বের কথা তুলে ধরে জার্মানিবাসীকে নাৎসি দলের প্রতি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এই সমস্ত কারণে জার্মানিতে নাৎসি দল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে এই দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এর ফলে এই দলের নেতা অ্যাডলফ হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলার পদ লাভ করেন। পরে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গ মারা গেলে হিটলারই প্রেসিডেন্ট হন। তাঁর পদবি হয় ‘ফ্যুয়েরার’। এভাবে নাৎসি দল রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে সমর্থ হয়।

নাৎসি দলের (Nazi Party) সংগঠনটি কীরূপ ছিল?

নাৎসি মতানুসারে দলনেতা বা ফ্যুয়েরার (Führer) ছিলেন অভ্রান্ত। তাঁর প্রতি অন্ধ আনুগত্য ও বিনা প্রশ্নে তাঁর নির্দেশ পালন করাই ছিল এই দলের নীতি। নাৎসি দলের বিভিন্ন সংগঠন ছিল। যেমন-

নাৎসি দলের সংগঠন –

সাধারণ সদস্য – জার্মান নাগরিকরা এই দলের সদস্য হতে পারত। তারা দলীয় প্রতীক ‘স্বস্তিকা’ চিহ্ন ধারণ করতেন। তাদের দলীয় সভায় যোগ দিতে হত এবং এজন্য তাদের চাঁদা দিতে হত।

স্টর্ম টুপার্স (Stormtroopers) – বেকার যুবকদের নিয়ে গঠিত আধা-সামরিক ঝটিকাবাহিনীকে বলা হত স্টর্ম ট্রুপার্স। এই বাহিনী নাৎসি দলের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অন্য দলের সভাসমিতিগুলিকে ভেঙে দিত এবং নিজেদের সভাসমিতিগুলিকে পাহারা দিত। এরা বাদামি পোশাক পরত বলে, এদের ‘ব্রাউন শার্টস্’ (Brown Shirts)-ও বলা হত।

এলিট গার্ডস্ (Elite Guards) – স্টর্মটুপার্সের উপরে ছিল এলিট গার্ডস্। এরা নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে নেতাদের জীবন রক্ষা করত। এরা কালো রঙের পোশাক পরত বলে, এদের ব্ল্যাক শার্টস্ (Black Shirts)-ও বলা হত।

অন্যান্য বাহিনী – এ ছাড়া এই দলে ছিল যুববাহিনী, নারীবাহিনী, গুপ্ত পুলিশবাহিনী বা গেস্টাপো (Gestapo) প্রভৃতি।

এ ছাড়া দলীয় প্রচারবিভাগ ছিল, যাদের কাজ ছিল ভাইমার প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে হেয় করা এবং রাষ্ট্রের মধ্যে দলীয় সমান্তরাল প্রশাসন গড়ে তোলা।

নাৎসি দলের সর্বোচ্চ পদে ছিলেন ফ্যুয়েরার তথা হিটলার। তাঁর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন রাইখ ডাইরেক্টরেট। যেমন- বিভিন্ন কর্মাধ্যক্ষ, কোষাধ্যক্ষ প্রভৃতি নেতারা।

নাৎসি পতাকা – নাৎসি দলের পতাকাটি ছিল লাল বর্ণের এবং পতাকার মঝখানে সাদা রঙের মধ্যে কালো রঙের স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা থাকত। লাল ধনতন্ত্র বিরোধিতা, সাদা জাতীয়তাবাদ এবং স্বস্তিকা চিহ্ন ছিল আর্য রক্তের প্রতীক।

নাৎসি মুখপত্র – নাৎসি দলের একটি মুখপত্র ছিল, যার নাম ছিল পিপলস্ অবজারভার (People’s Observer) I

নাৎসি দল সমাজের সব শ্রেণি এবং সব অংশকে যুক্ত করার জন্য বিভিন্ন শাখা সংগঠন গড়ে তোলে। একক নেতৃত্ব, সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদলের মাধ্যমে হিটলার রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র গড়ে তোলেন।

স্পেনের গৃহযুদ্ধ (Spanish Civil War) সম্বন্ধে কী জান?

স্পেনীয় রাজতন্ত্রের দুর্বলতা স্পেনকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পরিণত করে। রাজা আলফানসোর ক্ষমতাচ্যুতি, রিভেরার সামরিক একনায়কত্ব, প্রজাতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের নির্বাচনী সাফল্য এবং দক্ষিণপন্থী জোটের প্রতিক্রিয়া স্পেনের রাজনীতিতে অস্থিরতার সৃষ্টি করে। এই পরিস্থিতিতে পপুলার ফ্রন্ট ও ফ্যাসিবাদী সেনাপতি ফ্রাঙ্কোর প্রতিযোগিতা স্পেনে গৃহযুদ্ধের সূচনা করে (১৯৩৬-১৯৩৯ খ্রি.)।

কারণ – ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে জয়লাভ করে বামপন্থীগণ স্পেনে সরকার গঠন করে। ক্ষমতায় আসীন হয়ে এই দল বহু সামরিক কর্মচারীকে পদচ্যুত করে। এমনকি রাজতন্ত্রের সমর্থক সন্দেহে অনেককে বহুদূরে স্পেনীয় উপনিবেশে বদলি করে দেওয়া হয়। এর ফলে বামপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীসহ অনেকের মনেই ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল ফ্রাঙ্কো (General Franco)-র নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করলে এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং স্পেনে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়।

গৃহযুদ্ধ – স্পেনের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার যা ‘পপুলার ফ্রন্ট’ নামে পরিচিত তার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ স্পেনীয় সেনাদের নেতা জেনারেল ফ্রাঙ্কো বিদ্রোহের পতাকা তোলেন। এই ঘটনাকে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য বিশ্বের ২৭টি দেশ নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু জার্মানি ও ইটালির দ্বারা সমর্থিত ফ্রাঙ্কো সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারা সমর্থিত পপুলার ফ্রন্ট সরকারকে পরাজিত করে। নতুন মারণাস্ত্রের পরীক্ষানিরীক্ষা হয় এই যুদ্ধের মাধ্যমে এবং ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। এজন্য স্পেনীয় গৃহযুদ্ধকে ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া’ বলে। শেষে ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে স্পেনে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

গুরুত্ব – স্পেনের গৃহযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বহু রাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধের ব্যাপকতার ফলে জাতিসংঘের আদর্শের অসারতা প্রমাণিত হয়। সর্বোপরি স্পেনে ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিস্ট সরকার জয়লাভ করায় পশ্চিম ইউরোপে ফ্যাসিবাদী প্রভাব পড়ে।

স্পেনের গৃহযুদ্ধের গুরুত্ব কী ছিল?

স্পেনের গৃহযুদ্ধ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিন বছর ধরে চলেছিল। এই গৃহযুদ্ধের প্রধান দুই প্রতিপক্ষ ছিল। স্পেনের প্রজাতন্ত্রী সরকার ও জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে সরকার বিরোধী গোষ্ঠী। ইউরোপ তথা বিশ্ব ইতিহাসে এই যুদ্ধের গুরুত্ব ছিল। অপরিসীম।

স্পেনের গৃহযুদ্ধের গুরুত্ব –

ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রভাব বৃদ্ধি – স্পেনের ফ্যাসিবাদী নেতা জেনারেল ফ্রাঙ্কো ইটালি ও জার্মানির সাহায্য নিয়ে জয়লাভ করেন। ফলে স্পেনেও জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিশ্বযুদ্ধের মহড়া – স্পেনের গৃহযুদ্ধকে অনেকে ‘ক্ষুদে বিশ্বযুদ্ধ’ (Little World War) বা ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া’ (Stage Rehearsal of the Second World War) বলে অভিহিত করেছেন। এই যুদ্ধে হিটলার তাঁর বিমানবাহিনী ও যুদ্ধাস্ত্র পরীক্ষা করে নিয়েছিলেন।

পাশ্চাত্য দেশের সাম্যবাদ ভীতি – স্পেনের গৃহযুদ্ধ প্রমাণ করেছিল যে ইউরোপের ধনতান্ত্রিক দেশগুলি ফ্যাসিবাদ অপেক্ষা সাম্যবাদকে বেশি ভয় করে।

জাতিসংঘের ব্যর্থতা – স্পেনের গৃহযুদ্ধে জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। এতে জাতিসংঘের অসারতা ও দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেছিল।

কূটনৈতিক ব্যর্থতা – স্পেনের গৃহযুদ্ধ গণতান্ত্রিক পশ্চিমি দেশগুলির কূটনৈতিক ব্যর্থতা প্রমাণ করে। ২৭টি দেশের জোট গঠন করে তারা স্পেনে হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ করে। এই সুযোগে ফ্যাসিবাদী ইটালি ও নাৎসিবাদী জার্মানি স্পেনে সশস্ত্র হস্তক্ষেপ করে সফল হয় এবং ফ্রান্সের সীমান্তে স্পেন শত্রুরাষ্ট্রে পরিণত হয়।

গণতন্ত্রের সংকট – স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্যাসিস্টদের সাফল্যলাভ ইউরোপীয় গণতন্ত্রের সংকট সৃষ্টি করে। স্পেনের নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটে। জার্মানি অস্ট্রিয়া ও চেকোশ্লোভাকিয়া দখল করে। পোল্যান্ডের পতন ঘটে।

স্পেনের গৃহযুদ্ধ একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা হলেও তা সমগ্র ইউরোপ তথা বিশ্বকে আলোড়িত করে। ফ্যাসিবাদের আগ্রাসীরূপ বিশ্ব প্রত্যক্ষ করে।

বিংশ শতকে ইউরোপের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিবর্তনগুলি বিশ্বের ইতিহাসের গতিপথকে বদলে দেয়। এই পরিবর্তনগুলির পিছনে বিভিন্ন কারণ কাজ করেছিল। এই অধ্যায় থেকে আমরা এই পরিবর্তনগুলি সম্পর্কে জানতে পারি এবং ইতিহাসের গতিপথ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে পারি।

Share via:

মন্তব্য করুন